[স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে ভবিষ্যৎ ভারতের রূপরেখা নির্মাণে নানান আলোচনা হচ্ছে। ভবিষ্যৎ ভারতের স্বপ্ন স্বামী বিবেকানন্দ দেখেছিলেন এবং আমাদের সামনে সেই রূপটি অতি স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি চাইতেন ভবিষ্যৎ ভারত গড়ে তুলতে আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। তিনি বিশ্বাস করতেন ভবিষ্যৎ ভারত গড়ে উঠবে আদর্শ মানুষের হাত দিয়ে। সেজন্য আগে নিজেদের তৈরি করা উচিত। আদর্শ মানুষ প্রসঙ্গে স্বামীজী বলছেন : “আমরা এমন মানুষ দেখিতে চাই, যিনি সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গড়িয়া উঠিয়াছেন… উদারহৃদয়, উন্নতমনা (কর্মে নিপুণ)। প্রয়োজন এইরূপ ব্যক্তির, যাঁহার অন্তঃকরণ জগতের দুঃখকষ্ট তীব্রভাবে অনুভব করে।… আর (আমরা চাই) এমন মানুষ, যিনি যে শুধু অনুভব করিতে পারেন তাহা নয়, পরন্তু বস্তুনিচয়ের অর্থ ধরিতে পারেন, যিনি প্রকৃতি এবং বুদ্ধির মর্মস্থলে গভীরভাবে ডুব দেন। (আমাদের দরকার) এমন মানুষের, যিনি সেখানেও থামেন না, (কিন্তু) যিনি (সেই অনুভবকে বাস্তব কর্মে) রূপায়িত করিতে ইচ্ছুক। মস্তিষ্ক, হৃদয় এবং হাত—এই তিনটির এইপ্রকার সমন্বয় আমাদের কাম্য।”
অর্থাৎ স্বামীজীর আদর্শ মানুষেরা হবেন হৃদয়বান, কর্মঠ, চিন্তাশীল ও শক্তিশালী। স্বামীজী চেয়েছিলেন এইরকম আদর্শ মানুষদের মাধ্যমে আদর্শ সমাজ ও দেশ গড়ে উঠবে। এবিষয়ে তিনটি দিক গুরুত্বপূর্ণ—আমাদের হৃদয়ের প্রসারতা, কর্মকুশলতা ও মনের বিকাশসাধন। এই তিনটি জায়গা আগামী ভবিষ্যৎ ভারত গড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা নিতে পারে। আমরা এই জায়গাগুলোকেই ধরার চেষ্টা করেছি। পৌঁছে গিয়েছিলাম তিনজনের কাছে। একজন সন্ন্যাসী—তিনি সুদূর আমেরিকায় রয়েছেন। তাঁর কাছে আগামী ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে কীভাবে আমাদের মনকে আমরা তৈরি করব, মানসিক জায়গাটাকে আরো সুদৃঢ় করতে পারি—সেই প্রে‌ক্ষিতে জেনেছি। একজনের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম, যিনি রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলের সঙ্গে বহুদিন ধরে যুক্ত ছিলেন শিক্ষক হিসাবে—তাঁর কাছ থেকে শুনেছি স্বামীজীর বলা ত্যাগ ও সেবার মাধ্যমে হৃদয়ের প্রয়োগের কথা। আরেকজন যুবক, যিনি স্বামীজীর ভাব নিয়ে আগামী ভারতের জন্য যুবক-যুবতীদের তৈরি করার মহতী প্রচেষ্টা করছেন; যাতে তারা ভবিষ্যৎ ভারতের আদর্শ নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। এই সম্পর্কিত তাঁদের ভাবনাগুলোকে আমরা এখানে একত্রিত করার চেষ্টা করেছি।—সম্পাদক]

স্বামী বিবেকানন্দের কথায় আমরা পাই, আধ্যাত্মিকতাই ভারতবর্ষের মূল সুর কিন্তু এক একসময় মনে হয়, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পেরিয়ে এসেও এই মূল সুরকে আমরা আজও মনেপ্রাণে ধারণ করতে পারিনি, বরং বিশ্বায়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আরো বেশি বস্তুকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছি আগামী দিনের কথা ভাবলে, এই আধ্যাত্মিক কেন্দ্রটিকে আরো প্রত্যক্ষভাবে ধরতে আমাদের কী করণীয়?

প্রথম কথা হচ্ছে, আধ্যাত্মিকতা আমাদের মূল সুর কি না এই নিয়েই লোকের মনে এখনো সন্দেহ আছে। স্বামীজী-কথিত এই আধ্যাত্মিকতাই বা কী, আমাদের আধ্যাত্মিক সম্পদই বা কী—এই বিষয়ে আমাদের এখনো সম্যক ধারণা নেই। এর জন্য অবশ্য সাধারণ মানুষকে সম্পূর্ণভাবে দোষী সাব্যস্ত করা যায় না। আমাদের শিক্ষার নীতি কেমন হওয়া প্রয়োজন বা আমাদের যে একটা ‘ন্যাশনাল আইডিয়াল’ আছে, তার রূপায়ণ কেমনভাবে হওয়া দরকার—এই বিষয়ে কখনোই বড় একটা চিন্তা করা হয়নি ভারতে। আমার স্পষ্ট মনে আছে, ১৯৪৮ সালে সর্বেপল্লী রাধাকৃষ্ণনের ‘ইউনিভার্সিটি এডুকেশন কমিশন’-এ একটি চ্যাপ্টার ছিল ‘মরাল অ্যান্ড স্পিরিচুয়াল এডুকেশন’—এই নামে। ঐ অধ্যায়ে রাধাকৃষ্ণন যুক্তি দিয়ে স্পষ্টত বোঝানোর চেষ্টা করছেন একটি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে ধর্মপাঠ ও চর্চার প্রাসঙ্গিকতা, এমনকী ধর্মপাঠ এবং ধর্ম-বিষয়ক পাঠের তফাত। পাঠ্যবিষয়ে ধর্মের উপস্থিতি কাম্য। ভারতের মধ্যে থেকে এই ব্যাপারটা হয়তো খুব স্পষ্ট বোঝা যায় না কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, আমাদের ‘সেকিউলার’ দেশে এক উদ্ভট ধারণা মানুষকে ঘিরে রেখেছে যে, ধর্মনিরপেক্ষ হওয়া মানে ধর্মকে বা ধর্মের পাঠকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করা। এটা কী করে সম্ভব? শিক্ষা আমাদের শেখাবে মানুষের বিষয়ে, সমাজের বিষয়ে; অথচ সেই সমাজের এত বড় একটা অঙ্গ—ধর্ম প্রসঙ্গে কোনো শিক্ষা দেওয়া হবে না?

অন্যান্য দেশে শিক্ষাক্ষেত্রে ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতার উপস্থিতি কি লক্ষণীয়?

জানেন কী, বিদেশে যত বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয় দেখা যায়, তাদের প্রাঙ্গণে একটা ছোট্ট চার্চ বা ‍চ্যাপেল আছে? কেউ সেখানে যাক বা না যাক, ছাত্রছাত্রী বা শিক্ষকদের মধ্যে কেউ খ্রিস্টান হোক বা না হোক, তারা এই ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল এবং গর্বিত। আমি একবারও বলছি না যে, ভারতে আজই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়-প্রাঙ্গণে মন্দির বা ধর্মীয় কোনো স্থান তৈরি করতে হবে। কিন্তু মূল কথা হলো—ধর্মীয় বা আধ্যাত্মিক চিন্তাভাবনা পঠন-পাঠনে নিয়ে আসা তুলনামূলকভাবে অনেক সহজ ভারতবর্ষে। ভারতের সনাতন ধর্ম তো অন্ধবিশ্বাস এবং গোঁড়ামির ভিত্তিতে তৈরি নয়, তার দর্শন অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তাই ভারতের শিক্ষাব্যবস্থায়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এটিকে রাখা মোটেও কোনো কঠিন কাজ নয়; বরং বেশ মানানসই।

কিন্তু কেবলমাত্র পাঠ্য হিসাবে এই বিষয়টি রাখাই কি আমাদের উদ্দিষ্ট বোধের দিকে নিয়ে যাবে?

আগে অন্তত সেটুকুই হোক। সেটুকু যদি সম্ভব হয়, তবেই মানুষের মধ্যে একটা সুষ্ঠু ধারণা তৈরি হবে আধ্যাত্মিকতা বিষয়ে। তার পরের ধাপ হচ্ছে—এই আধ্যাত্মিকতা আমাদের জাতীয় জীবনের মূল সুর কি না, তা বিবেচনা করা। স্বামীজী তো এই বিষয়ে খুব স্পষ্টভাবেই বলেছিলেন যে, ধর্ম বা আধ্যাত্মিকতা ভারতের একটি কেন্দ্রীয়, প্রবহমান ধারা। অথচ এখন ভারতে অনেকে বলে বসেন যে, ওসবে তাঁরা বিশ্বাস করেন না! ইংল্যান্ড-জার্মানি-পোল্যান্ডের মতোই ভারত আরেকটি দেশ মাত্র, আর প্রতি দেশেরই কিছু বিশেষত্ব, কিছু খামতি আছে। ওসব মূল সুর-টুর বলে কিছু হয় না। এই এক অদ্ভুত ধারণার সৃষ্টি হয়েছে ভারতীয় সমাজে এবং তা বেশ ছড়িয়েও পড়েছে। এই ধারণা কী থেকে সৃষ্ট হয় জানেন? চূড়ান্ত অজ্ঞানতা থেকে। অনেক দার্শনিক ধারাও আছে—যেমন ‘Non-essentialism’, তারা বলে একটা দেশের কোনো মূল ধারা হয় না; জোর করে একটা কিছুকে তার মূল ধারা বলে দাগিয়ে দেওয়া সত্যের অপলাপ মাত্র। যাই হোক, স্বামীজী যা বলেছিলেন, তাকে বাস্তবায়িত করতে গেলে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্বন্ধিত করতে হবে ধর্মকে। কোনো গোঁড়ামি নয়, বরং সকল ধর্মের যে উদার এবং দার্শনিক ভাব তা সমস্ত ছাত্রছাত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়া খুবই দরকার। তাতে অন্তত প্রাথমিকভাবে নিজের স্বাতন্ত্র্য সম্বন্ধে আমাদের একটা ধারণা তৈরি হবে; তারপর তাকে কীভাবে আমাদের ব্যক্তিজীবন, সমাজজীবন বা জাতীয় জীবনে আনা যায়—সে নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ঐ এডুকেশন কমিশনের যে-চ্যাপ্টারটার কথা বলছিলাম, ওতে রাধাকৃষ্ণন পুরো সিলেবাসই করে দিয়েছিলেন ‘মরাল অ্যান্ড স্পিরিচুয়াল এডুকেশন’-এর জন্য—ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ড ইয়ারে কী কী পড়াতে হবে না হবে, ইত্যাদি। কিন্তু তার প্রয়োগ হয়নি। অথচ এটা থাকলে ভাল হতো এই কারণে যে, আমি জাতীয় জীবনের মূল সুর বলে ধর্মকে মানি বা না মানি, অন্তত আমার মধ্যে একটা শিক্ষিত দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হতো। জেনে-শুনে, তারপর কিছুকে তবু না হয় আমি অস্বীকার করতে পারি। আর আমাদের যা ঐতিহ্য, তার আমরা কিছুটা জানতে পারলেও তাকে অস্বীকার করার আর কোনো প্রশ্নই উঠবে না।

শিক্ষার কথাই বলছেন যখন, যদি একটা উদাহরণ দিয়ে বিস্তৃতভাবে বলেন এই বিষয়ে

দর্শনের ক্ষেত্রেই দেখুন, Western Philosophy-র ওপর সাংঘাতিক জোর দেওয়া হয়, আর তার সঙ্গে একটা ছোট্ট প্রান্তিক অংশ হিসাবে আমরা পড়ি Indian Philosophy! উলটোটাই তো বরং হওয়া উচিত ছিল—ভারতীয় দর্শন মূল পাঠ্য এবং তার সঙ্গে পাশ্চাত্য বা আরো অন্যান্য দর্শনের কথা জানা। এগারো-বারো ক্লাসে আমরা যখন লজিক পড়েছিলাম, সেই অ্যারিস্টটেলিয়ান লজিকই পড়ানো হয়েছিল। এমন নয় যে ভাল লাগেনি, কিন্তু অনেক পরে জানতে পারলাম—ভারতে ন্যায়-দর্শন আছে, লজিক কতটা অগ্রগতি করেছে ন্যায় এবং নব্য-ন্যায়ের মাধ্যমে, ইত্যাদি। এত সমৃদ্ধ ইতিহাস আমাদের ছেলেমেয়েদের কেন জানানো হবে না বলুন তো? বলা হতে পারে, আমাদের দর্শনের তুলনায় পাশ্চাত্য দর্শন এখন অনেক বেশি এগিয়ে আছে, বাকি পৃথিবীর গতিপ্রকৃতির সঙ্গে আপ-টু-ডেট সে; কিন্তু ভেবে দেখুন, নিজেদের পিছিয়ে পড়ার কারণ কিন্তু সেই আমরাই। যুগের পর যুগ একটা বিষয়কে চর্চার মধ্য দিয়ে যদি সময়োপযোগী করে তোলার চেষ্টাই না করা হয়, সে তো পিছিয়ে পড়বেই। তার সুরাহা তো এটা কখনোই হতে পারে না যে, আমাদের দর্শনকে সম্পূর্ণভাবে বর্জন করে বৈমাত্রেয় হয়ে যাব! সত্যিই যদি কেউ সমাধান চায়, আরো বেশি করে এই বিষয় নিয়ে চর্চা করুক সে; আর পাশাপাশি, বিশ্ব-দর্শনের সঙ্গে নিয়মিত কথোপকথনের মাধ্যমে নিজেকে বৃহত্তর বাস্তবের সঙ্গে ওয়াকিবহাল করে চলা—এ তো খুব সহজেই হতে পারে।

তাহলে এই মুহূর্তে দেশের ঐতিহ্যকে অস্বীকার করার যেপ্রবণতা, তার ঠিক বিপরীত মেরুতে যাওয়া প্রয়োজন বলছেন?

ঠিক তাও নয়। প্রাক্তন ফরাসি শিক্ষামন্ত্রী ও দার্শনিক লুই ফেরির History of Thought বইটি যদি পড়েন, দেখবেন গোটা বই জুড়ে এবং বইয়ের শেষে গ্রন্থতালিকায় শুধুমাত্র ফরাসি দর্শনশাস্ত্র, দার্শনিক, তাঁদের ভাবনা—এর কথাই বলা; দুই-একজন জার্মান বা রাশিয়ান দার্শনিক ছাড়া ইংল্যান্ড-আমেরিকার দার্শনিকদের কোনো উল্লেখই নেই! পড়তে পড়তে এক একসময় তো মনে হয়, ফ্রান্স বাদে বাকি পৃথিবীতে বুঝি দর্শন বলে কোনো বস্তুই নেই! নিজের দেশের দর্শন, ইতিহাস সম্বন্ধে গভীর শ্রদ্ধা, সততা এতে প্রকাশ পেলেও মনে রাখতে হবে, এটাও কিন্তু আবার একরকমের চরমপন্থী জাতীয়তাবাদ। এমন হতে হবে আমাদের—তা বলছি না, কিন্তু যাকিছু আমাদের ঘরের তা দিয়েই তো আমরা সবসময় শুরু করব! নাকি প্রথমেই বিদেশের ধ্যানধারণা নিয়ে পড়ব? আমাদের দর্শন শুরু হবে আমাদেরই দেশের ফসল দিয়ে; বাকি বিশ্বের সঙ্গে কথাবার্তায় তবে না যেতে পারব! স্বামীজীর দৃষ্টিভঙ্গি কিন্তু খুব ‘cosmopolitan’ ছিল; নিজের ঐতিহ্যে শিকড় বিস্তার করা আর পাশাপাশি বাকি বিশ্বের প্রতিও উদারমনস্ক হওয়া—এই দুয়েই তিনি বিশ্বাস করে এসেছেন। আমরা এখন যে-অবস্থানে আছি, সেটা একটা মেরু—সবকিছুতেই বাইরের নকল করা। আবার এর বিপরীত মেরু হলো, সব ব্যাপারে গেঁাড়ামি—নিজেকে এতটাই জ্ঞানী ভেবে দম্ভ করা যে, বাইরে থেকে কিছু গ্রহণ করার মানসিকতাই আর না রাখা। স্বামীজীর মতে, এই দম্ভই একসময় ভারতের পতনের কারণ হয়েছিল। কাজেই, এই দুটির কোনো পন্থাই কাম্য নয়।

স্বাধীনতার পর আমরা অনেকটা সময় পেরিয়ে এসেছি, পঁচাত্তর বছরে আমাদের নানা বিষয়ে অগ্রগতি নেহাত কম নয়! কিন্তু তার পাশাপাশি উচ্চাকাঙ্ক্ষা যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে অপ্রাপ্তিবোধ মানসিক অস্থিরতা সাংঘাতিকভাবে ঢুকে পড়ছে সমাজে আমাদের এত গভীর জীবনবোধের রসদ থাকা সত্ত্বেও এই সমস্যা আমরা ঠেকাতে পারছি না এই বিষয়ে আগামী দিনে আমাদের কী করণীয়?

একথা ঠিকই—চোখ-কান খোলা রাখলে আমরা সত্যিই বুঝতে পারব যে, দেশের কিন্তু অগ্রগতি হয়েছে এত বছরে। ইতিহাসের দিকে তাকালেই দেখা যাবে, স্বাধীনতার আগে সামাজিক পরিস্থিতি কী দুর্বিষহ ছিল! নিঃসন্দেহে, একটা ধারাবাহিক অগ্রগতির ফলে আমরা বর্তমান অবস্থায় এসে পৌঁছেছি। সমাজে নারী-অধিকার ও ক্ষমতায়নে পরিবর্তন এসেছে; জাতিভেদের সমস্যাও—একশো বছর আগে যে-অবস্থায় ছিল এখন তো সে-তুলনায় বেশ কিছুটা ঠিক হয়েছে। মোটকথা, সব মিলিয়ে ভারতে স্বাধীনতা-উত্তর যুগে অনেকটাই পরিবর্তন এসেছে। এবং ভবিষ্যতের দিকে তাকালে স্পষ্টতই বোঝা যায়, আরো উন্নতির অবকাশ থাকবে।

কিন্তু এর অন্যদিকে, অর্থনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে কিছু শ্রেণির মানুষের হাতে বিত্ত এবং বিত্তের বিড়ম্বনাও ঢুকে পড়েছে ভারতে। তার মধ্যে বেশ বড় সমস্যা হলো অপ্রাপ্তিবোধ, অসুখী মানসিকতা, হতাশা, একাকিত্ব, উদ্দেশ্যহীনতা ইত্যাদি। আর বিশেষত যুবসমাজকে যদি দেখা যায়—একদিকে তাদের মধ্যে দারুণ উচ্চাকাঙ্ক্ষা, তারা বস্তুগত সচ্ছলতা বা সমৃদ্ধির দিকে যেতে উৎসুক। আর যদি বা কেউ অতটা উৎসুক নাও হয়, সমাজ যেন সম্মিলিতভাবে তার ওপর চাপ দিতে থাকে উচ্চাকাঙ্ক্ষী হওয়ার জন্য, অর্থের পিছনে ছোটার জন্য! ফলত, এসে পড়ছে অস্বাস্থ্যকর এক প্রতিযোগিতা। মানসিক চাপে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা। সুযোগ যেমন নিশ্চিতভাবে আগের থেকে বেড়েছে, তেমন এটাও তো সত্যি যে, সেই সুযোগ আজও সবার কাছে সমানভাবে নেই। যারা সেই সুযোগ পাচ্ছে, শেষে গিয়ে দেখা যায়—তারা সবকিছু পেয়েও কোথায় যেন অপূর্ণতা অনুভব করছে! দেখা যাচ্ছে, অতি সাধারণ ঘরের ছেলে মেধার জোরে দারুণ একটা চাকরি পেল, বিদেশে এল, হয়তো তার মাসিক আয় তার বাবার সারাজীবনের আয়ের চেয়েও বেশি; কিন্তু জাগতিক সমস্ত প্রাপ্তির শিখরে পৌঁছেও সে এখন অপ্রাপ্তিবোধের শিকার! “এরপর কী?”—এই প্রশ্ন তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। সাধারণ বাড়ির অভিভাবকদের কাছেও সেই উত্তর নেই; তাঁরা চেয়েছিলেন তাঁদের সন্তান ভাল পড়াশোনা করে একটা ভাল চাকরি করুক—এটুকুই। তার পরের কথা তো তাঁরা ভাবেননি। অতএব, যে-জীবনকে একটা ‘অর্থ’ দেওয়ার জন্য এত ছোটাছুটি, সবশেষে সে তেমনই উদ্দেশ্যহীন থেকে গেল, দেখা যাচ্ছে। এই হলো বস্তুজগতের সমস্যা—না পেলে হতাশা, আর পেলেও অপূর্ণতাবোধ। এর কোনো শেষ নেই।

তাহলে কি এই অতৃপ্তি, অসহায়তাই শেষ কথা আজকের দিনে?

এই যে চোখের সামনে এত লাখপতি, কোটিপতিরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন, এঁরা জীবনে পূর্ণতা পেয়েছেন বলে কি আমরা মনে করি? কে তৃপ্তি পেয়েছেন এই বস্তুগত জীবনে? কেউই যদি তৃপ্ত না হয়ে থাকেন শেষ অবধি, আমিই বা কোন ভরসায় ভাবি যে, আমি তৃপ্ত হব? বিত্ত, নতুন নতুন গ্যাজেট, ঝাঁ-চকচকে জীবন—এর কোনোটাই কিন্তু খারাপ নয়। কিন্তু আমাদের চিরন্তন সুখ ও শান্তিলাভের বাসনা যদি আমরা এই বস্তুজগতের ওপর চাপিয়ে দিতে থাকি, তাহলে তো হবে না! সে সাময়িক স্বাচ্ছন্দ্য, বিলাসিতা দিতে পারে আমাদের; কিন্তু সে তো তোমায় কোনোদিন প্রতিশ্রুতি দেয়নি যে, তোমার সব অতৃপ্তি সে ঘুচিয়ে দেবে! তাহলে, সে যেটা দিতে অপারগ, সেটা তার কাছে চাওয়া কেন?

বরং একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, আমাদের ভারতের যে আধ্যাত্মিক ঐতিহ্য আছে, তার সঙ্গে সম্পর্কিত সমস্ত দার্শনিক শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে বস্তুজগতের সীমাবদ্ধতা নিয়ে বলে চলেছেন আমাদের। এতদিন ধরে আলোচিত হয়ে চলা একটা কথা তো আমাদের আগে থেকেই জেনে নেওয়া উচিত ছিল। এখন খুব মনে হয়, এই সমস্ত প্রতিকূলতার মোকাবিলায় স্বামীজী বারে-বারে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়েছেন আত্মশক্তির বাণী। “সাহসী হও, নির্ভীক হও”—স্বামীজীর এই বাণী আজকের যুবপ্রজন্মকে আবার উদ্যমী করে তুলতে পারে; সবার আগে তাদের কাছে এই বাণী পৌঁছানো দরকার। তাদের এই বিষয়ে সম্যক একটা ধারণা হওয়া প্রয়োজন যে শরীর, মন, সাফল্য-ব্যর্থতায় মোড়া যে জীবন—সেটুকু আমাদের অস্তিত্ব, আমার ইতিহাস নয়। আমার আসল পরিচয় হলো—আমি অজর-অমর সেই অনন্ত সত্তা। এই ধারণা যদি মনে প্রোথিত হয়ে যায়, তবে এই বস্তুজগতের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি সামলে নেওয়ার কাজটাও অনেকাংশে সহজ হয়ে যায়।

সন্ন্যাসজীবন তবু না নয় জাগতিক জীবন থেকে দূরে, কিন্তু বাকিদের ক্ষেত্রে?

সন্ন্যাসজীবন কেন দূরে হতে যাবে? বস্তুজগতের এই জীবন প্রত্যেক মানুষের জন্য প্রযোজ্য। একবার শশী মহারাজ সিস্টার দেবমাতাকে তাঁর জীবনের নানারকম সমস্যার কথা বলছেন—বিশেষ করে মাদ্রাজে মঠ স্থাপন করতে গিয়ে কত বাধা-বিপত্তি পেরতে হয়েছিল তাঁকে। সেইসব শুনে স্বাভাবিকভাবেই দেবমাতা বিষণ্ণ হয়েছেন; ভাবছেন—এমন একজন সাধুপুরুষের জীবনেও এত দুঃখ কেন? শশী মহারাজের কাছে এই বিষাদ প্রকাশ করায় মহারাজ থামালেন তাঁকে, বললেন : “কী বলছেন আপনি! আমার সত্তা অনন্ত, অসীম। তার মধ্যে এইটুকু ক্ষুদ্র একটা জীবন নিয়ে প্রভু যেমনভাবে খেলতে চান, খেলুন না! কী যায় আসে!” অর্থাৎ, এমন তো নয় যে, রক্তমাংসের এই জীবন কারো ক্ষেত্রে উপস্থিত, কারো ক্ষেত্রে অনুপস্থিত! প্রাণিমাত্রেই সে সত্য। কিন্তু আধ্যাত্মিক বোধটুকু অনুধাবন আমরা সকলেই করতে পারি। এই খারাপ-ভালয় মোড়া জীবন থেকে আমার কেবল শিক্ষাটুকু নেওয়াই কাজ; জীবনের লক্ষ্য জ্ঞান আহরণ—বিলাসিতা নয়। সেই জ্ঞানটুকু নিয়ে, আধ্যাত্মিকভাবে নিজেকে গড়ে আমি এক জীবন পেরিয়ে পরের জীবনে চলে যাব—এমনটাই তো হওয়া সবচেয়ে ভাল। এরকম দৃষ্টিভঙ্গি থেকে দেখলে জীবনের ওঠা-পড়ার মাঝেও একটা দারুণ শক্তি অনুভব করা যায় নিজের ভিতর।

এই ভাবাদর্শে মানুষকে গড়ে তোলার কোনো নির্দিষ্ট পন্থা আছে কি?

মানুষকে গড়ে তোলার প্রসঙ্গ এলে বলতেই হয়, শৈশব থেকেই এই প্রয়াস শুরু হওয়া দরকার। এবং সেই কারণে, আরো কয়েকটি বিষয়ে আমাদের সচেতন থাকা প্রয়োজন—যেমন, আমরা বড়রা কোন শিক্ষায় শিক্ষিত করেছি নিজেদের? কোন লক্ষ্য আমাদের পরের প্রজন্মের সামনে আমরা রাখছি? স্কুলে কলেজে দারুণ রেজাল্ট করতে হবে, একটা মোটা মাইনের চাকরি করতে হবে—এই-ই যদি আমাদের বড়দের লক্ষ্যস্থির করার নমুনা হয়, তাহলে তা ছোটদের নরকে ঠেলে দেওয়ারই শামিল! আবার তাই বলে ছোটদের সামনে কঠিন আধ্যাত্মিক লক্ষ্য রাখতে হবে, তাও নয়। বরং ভাল মানুষ হওয়া, নিজে শান্তিতে থাকা এবং অপরকে শান্তিতে রাখা—এরকম আদর্শে গড়ে তোলা হোক না ওদের! আজকের দিনের শিক্ষিত, বিবেচক অভিভাবকেরা অবশ্য তাঁদের সন্তানদের যথেষ্ট স্বাধীনতা দিচ্ছেন লক্ষ্যস্থির করার ব্যাপারে—এইটা একটা ভাল দিক। আর ব্যাবহারিক জীবনে স্কুল-কলেজে কাউন্সেলিঙের সুবিধা রাখা, ছাত্রছাত্রীদের ওপর বেশি মানসিক চাপ সৃষ্টি না করা—এইসব ক্ষেত্রে খেয়াল রাখতে হবে। কারণ, বর্তমানে মানুষ যেমন উচ্চাকাঙ্ক্ষী হয়েছে, তেমনই কিছুটা ভঙ্গুরও হয়ে গেছে; ছোট ছোট সাফল্য-ব্যর্থতাতেও বড় ভেঙে পড়ে।

যে অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার কথা একটু আগেই উঠে এল, সেই সূত্রে বলতে চাইমাঝেমাঝে এই competition-এর জগৎ এতই হিংস্র, হৃদয়হীন হয়ে ওঠে, আসলে যে আমরা সহাবস্থান করি একে অন্যের সঙ্গেসেটাই ভুলে যাই অন্যকে সাহায্য করা, ‘cooperate’ করাকে মূল্য দিই না তেমন কিন্তু, competition এবং cooperation—এই দুয়ের মেলবন্ধন কি আদৌ সম্ভব কোনোভাবে?

দেখুন, compitition কোনোদিন যাবে না। সে চিরকাল ছিল, এখনো আছে, এর পরেও থাকবে। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জানেন, ‘compitition’ শব্দটার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ যদি জানা যায়, দেখা যাবে ‘com’ কথাটার অর্থ ‘যৌথভাবে’ অর্থাৎ ‘together’। আর ঐ সূত্র ধরে এগলে ‘compitition’ কথাটার অর্থ—‘to excel together’—‘যৌথভাবে উৎকর্ষ অর্জন করা’। কাজেই, যে-পারস্পরিকতার কথা বলছিলেন, তা কিন্তু আপাতবিরুদ্ধ প্রতিযোগিতার মধ্যেই লুকিয়ে আছে। আমি যখন কোনো কাজ করছি, আমার সঙ্গে যদি আরেকজন সেই একই কাজ করতে শুরু করে, আমি নিজের অজানতেই তার কাজের নিরিখে কাজ করা শুরু করব এবং স্বাভাবিকভাবেই আমার performance আগের চেয়ে ভাল হবে। সে যদি না থাকত, আমার কাজে কিন্তু ততটা উন্নতি হতো না। সে আছে বলেই নিজেকে যাচাই করে নেওয়ার, নিজের performance-কে তুলনামূলক মাপকাঠিতে বুঝে নেওয়ার একটা সুযোগ আমি সবসময়ই পাচ্ছি এবং বলাই বাহুল্য, সেও পাচ্ছে। কাজেই, compitition-কে গঠনমূলক অর্থে বোঝার একটা দিক এটা।

এরপর আসি cooperation-এর কথায়। এখন যেকোনো company-কে দেখুন—তারা কেমন মানুষকে চাকরিতে নিতে চায়? যোগ্যতা, performance সবই ঠিক আছে; কিন্তু সংস্থাগুলি এমন মানুষ চায় যে অন্যের সঙ্গে থেকে কাজ করতে পারবে। নিজের ব্যক্তিগত মেধা বা প্রতিভা কাউকেই খুব বেশি দূর নিয়ে যায় না এবং তাতে প্রতিষ্ঠানেরও খুব একটা লাভ হয় না। বরং যে-মানুষ দলে থেকে দলের সঙ্গে কাজ করতে পারে কোনো নেতৃত্বের অধীনে এবং প্রয়োজনে নেতৃত্বও দিতে পারে, তার চাহিদা সবচেয়ে বেশি। কাজেই, নিজের সাফল্যের জন্যও আত্মকেন্দ্রিক হওয়ার চেয়ে সহযোগী হওয়া বেশি দরকার। তাতে ব্যক্তিগত অগ্রগতিও হয়, দলও এগয়, দলের মধ্যে সকলের সম্পর্ক একই সুরে বাঁধা থাকে।

এসবই ভাবতে ভাল লাগে; কিন্তু সত্যিকারের জীবনে তো প্রতিযোগিতায় কেবল অসূয়া, শত্রুতাই চোখে পড়ে!

তার কারণ মূল্যবোধের অভাব। আমাদের প্রত্যেকের মধ্যে একেবারে বুনিয়াদি কিছু মূল্যবোধ থাকা সবচেয়ে বেশি দরকার। আমি নিজেরই আখের গোছাব না, মানুষের সঙ্গে এগব? অমুক আমার শত্রু না বন্ধু?—এসব তো পরের কথা। কিন্তু সবার আগে মানুষের ভেবে দেখা দরকার, তার মূল্যবোধ কোনদিকে নিয়ে যেতে চাইছে তাকে? অর্থ? সাফল্য? ক্ষমতার সিঁড়ির এক-একটা ধাপ? সে কি ইঁদুরদৌড়ে জিততে চায়? যদি তাইই হয়, তাহলে সেও তো একটা ইঁদুরই। এমন মূল্যবোধ আদপেই আমাদের নয়; আধুনিক সময়, সমাজ আমাদের মধ্যে এইগুলো ঢুকিয়ে দিচ্ছে এবং আমরাও অন্ধের মতো তাইই করে চলেছি। বরং এসব থেকে বাঁচতে গেলে নিজের মধ্যে কিছু আদর্শ রাখা ভাল—যেমন সত্যনিষ্ঠা, অন্যের মঙ্গলকামনা, আধ্যাত্মিক লক্ষ্য ইত্যাদি। এরকম কিছু ‘core values’ নিজেদের মধ্যে থাকলে compitition-কে দেখার চোখটা সহজ হয়ে যায়—হার, জিৎ যাই আসুক, মানুষকে টলাতে পারবে না কিছুই। সে নিজ লক্ষ্যে, আদর্শে অবিচল থাকবে।

বর্তমান সময়ে দেশে একাকিত্বের সমস্যা দেখা যাচ্ছে বিপুল পরিমাণেশুধু অল্পবয়সিদের মধ্যে নয়, বয়স্ক মানুষদের মধ্যে আরো বেশি করে মেধাবী ছেলেমেয়েরা চাকরি বা পড়াশোনার কারণে বাবামাকে ছেড়ে প্রবাসী হচ্ছে এবং একাকিত্ব গ্রাস করছে সেই প্রৌঢ় বা বৃদ্ধ মানুষদের এর মোকাবিলা কীভাবে করা যায়?

একদম, ঠিক এই ব্যাপারটিই এখন বহু ক্ষেত্রে ঘটছে। জানেন তো, এখনকার সমাজে—বিশেষত বিদেশে—সবচেয়ে বেশি মানুষ যে-দুটি জীবিকার তা হলো মনোরোগ-বিশেষজ্ঞ আর ওকালতি। বলাই বাহুল্য, এই দুটি জীবিকার প্রাধান্য মোটেও কোনো সুস্থ সমাজের ছবি তুলে ধরে না আমাদের সামনে। যেসব সমস্যা এখন সমাজকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধেছে, তাদের মধ্যে অবশ্যই একাকিত্ব অন্যতম। বিদেশে অবশ্য ব্যাপারটা একটু অন্যরকম—এখানে আমাদের দেশের মতো পারিবারিক বন্ধন ততটা দৃঢ় নয়; ছেলেমেয়েরা একটু বড় হয়ে চাকরি পেলেই নিজেদের বাড়ি করে চলে যায়, বাবা-মায়ের সঙ্গে তেমন ঘনিষ্ঠতা আর রাখে না। ফলত, বৃদ্ধ মানুষেরাও নিজেদের সামলাতে অনেক বেশি দড় হয়ে ওঠেন। কিন্তু সে যেমনই হোক, একাকিত্ব তো আর এড়িয়ে থাকা যায় না। বিশ্বব্যাপী বহু মানুষ আজ একাকিত্বে, উদ্দেশ্যহীনতায় জর্জরিত। এখানে দুটো ভাবার বিষয়—এক, বয়স্করা কী করতে পারেন? দুই, এরকম পরিস্থিতিতে যুব-প্রজন্মের কর্তব্যই বা কী? প্রথমত, বয়স্কদের নিজেদেরই একটু প্রস্তুতি নিতে হবে—অন্য মানুষের উপস্থিতির প্রতি তাঁদের নির্ভরশীলতা কমানোর। নিজের জীবনে সঙ্গ দেওয়ার, কথা বলার জন্য একটা মানুষের থাকার ওপর এই যে নির্ভরতা—এতেই যত বিপত্তি! অনেকের ক্ষেত্রেই দেখবেন, যতদিন চাকরিতে আছেন একরকম কিন্তু অবসর নেওয়ার পরেই শরীর খারাপ হয়ে যাচ্ছে, শরীর ভেঙে যাচ্ছে, হয়তো শেষ অবধি তিনি আর বাঁচলেনই না—অবসাদের ধকল শরীর আর নিতে না পারায়! ঐ যে কাজের মধ্যে থাকা, সবার সঙ্গে যোগাযোগে থাকা—ওগুলো আসলে জীবনকে একটা ছন্দে বেঁধে রেখেছিল, শরীর আর মন ভাল রেখেছিল; যেই না সেসব বন্ধ হলো, অমনি এতদিনের সাজানো জীবনটা যেন এক নিমেষে ভেঙে পড়ে গেল!

আমাদের সনাতন দর্শনে ফিরে গেলে, সেখান থেকে কি কোনো রসদ পাওয়া সম্ভব এই সমস্যার প্রতিকারে?

আমার মনে হয়, আমাদের সমাজের যে একটা সনাতন গঠন—ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ, বানপ্রস্থ এবং সন্ন্যাস—এর একটা বড় মনস্তাত্ত্বিক দিক আছে। মানুষকে মানসিকভাবে দৃঢ় করে তোলে এই তত্ত্ব—ছাত্রাবস্থা, গৃহস্থের জীবন, প্রৌঢ়ত্ব কাটিয়ে শেষে গিয়ে মানুষকে সমাজ, স্বজন, সবকিছু থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে অন্তর্মুখী হতে বলে এই গঠন। বানপ্রস্থ অবধি একসঙ্গে থাকা স্বামী-স্ত্রীও সন্ন্যাসে কিন্তু একদম একাকী। ভেবে দেখতে গেলে, এই যে নিঃসঙ্গতা, একাকিত্ব—সে কিন্তু নিতান্ত খারাপ নয়, বরং অনেকাংশে আকাঙ্ক্ষিত হওয়ার দাবি রাখে। ভাবনাটা কিছুটা এরকম যে, একটা সময়ের পর জগৎ থেকে আমি সরে দাঁড়াব; তখন আমার সম্বল শুধু এবং শুধুমাত্র আমার ঈশ্বর; আর কিচ্ছু নয়। কখন লোক আসবে আমার সঙ্গে কথা বলতে, সেজন্য হাঁ করে বসে থাকা নেই; কখন কেউ ফোন করবে, তার জন্য অপেক্ষা নেই। ফলে মনের এই নির্ভরতা থেকেও মুক্তি পাওয়া যায়। অথচ এটুকুও দেখা যায় না বিশেষ কারো মধ্যে। কিন্তু ভেবে দেখুন তো, যাকে আপনি ধরেই রাখতে পারবেন না, তাকে জোর করে টেনে রেখে কি কোনো লাভ আছে? বিদেশের চেয়েও ভারতে এটা বেশি দেখা যায়। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে, তাদের নিজেদের পরিবার হয়েছে এখন, কিন্তু বাবা-মায়েরাই তাদের ছেড়ে বেরিয়ে আসতে পারছেন না পুরোপুরি—নানা অনুষঙ্গে নিজেদের যুক্ত রেখে তাঁরা যেন উদ্দেশ্য খুঁজে পান বাঁচার।

কিন্তু এতে তো তাঁদের কষ্ট বাড়ছে; সাময়িকভাবে খুশি থাকলেও এই আবেগের বন্ধন তো তাঁদের জর্জরিত করে ফেলছে!

একদমই তাই। আমাদের এখন প্রয়োজন মানসিকভাবে স্বাধীন থাকা। কিন্তু সেই স্বাধীনতা তো এমনি এমনিই আসবে না, তার জন্য চাই একটা উচ্চ আধ্যাত্মিক আদর্শ—ভগবানলাভ, ভক্তি, মুক্তি যাই বলি না কেন! আর যদি কেউ অতটা স্বাধীন মনের দিকে এগতে না-ই পারেন, তার আগের ধাপ হলো—সমাজকে কিছু ফিরিয়ে দেওয়া। বাঁচতে গিয়ে একটা সময় আমরা অনেক কিছু নিয়ে ফেলি সমাজের কাছ থেকে। তারপর সন্তানেরা বড় হয়, নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে যায়; তখন এই বোধ জন্মানো প্রয়োজন যে, এবার নিজের কথা না ভেবে সকলের জন্য হাত বাড়িয়ে দেওয়া যাক—সে দান-ধ্যান হোক, স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে কাজ করা হোক, কোনো সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকা হোক—যেখানে কি না মানুষ তার অর্থ, বিত্ত, অভিজ্ঞতা অন্যের সেবায় ব্যয় করতে পারে। আমাদের ভারতীয় জীবনাদর্শের যে চারটি মূল স্তম্ভ—ধর্ম, অর্থ, কাম, মোক্ষ—তার মধ্যে অর্থ আর কাম নিয়ে থাকা যায় কাজের বয়সে। বানপ্রস্থে শুধুই ধর্ম মানুষের সম্বল, এবং ধর্ম মানে কিন্তু ‘religion’ নয় এখানে। ধর্ম মানে নৈতিক, স্বার্থহীন জীবন। এই নিঃস্বার্থতার উল্লেখ তো আমরা স্বামীজীর লেখাতেও কতবার পাই! নিঃস্বার্থ হলে জীবন এত পূর্ণ লাগে যে, একাকিত্বের কোনো জায়গাই আর থাকে না। তারও ওপরে হচ্ছে মোক্ষ—আধ্যাত্মিক সন্ধান, ঈশ্বরসন্ধান, মুক্তির খোঁজ। সেই পথে একাকী না থেকে উপায় নেই; লোকজন বেশি হলেই বরং বিরক্তি আসে তখন। গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলছেন—যেখানে জনসমাগম, ভিড় সেখানে তাঁর প্রীতি হয় না। ঈশ্বরপ্রীতির জন্য চাই একটু নির্জনতা, একাকিত্ব। সুজান ক্যেন তাঁর লেখা Introvert বইটিতে দেখাচ্ছেন যে, আমেরিকার সমাজে ছোট থেকেই বাচ্চাদের শেখানো হয় বহির্মুখী হতে। খেলাধুলো করা, সবার সঙ্গে মেশা, পার্টিতে যাওয়া—এইসব আর কী। এগুলোই সুস্থ মানসিকতার লক্ষণ হিসাবে ধরা হয়। কিন্তু যত মানুষ তার কাজে এগতে থাকে, ‘achiever’ হয়ে ওঠে—সে লেখক হোক বা বিজ্ঞানী বা শিল্পী—সে ক্রমেই হয়ে ওঠে অন্তর্মুখী। নিজেকে অন্যদের থেকে আলাদা না করে যদি মনের গভীরে ডুব দিয়ে ভাবনায় নিমগ্ন না হওয়া যায়, সৃজনশীল কাজ সেই মানুষের পক্ষে করা অসম্ভব। একজন মানুষ যদি সারাক্ষণ সমাজ নিয়ে থাকে—এখন তো সমাজেরও বাড়া হয়েছে ভার্চুয়াল মাধ্যম—তাতে ডুবে থাকে, তাহলে নির্জনতা আর আসবে কোত্থেকে? এই অনলাইনে মানুষের সঙ্গ পেতে পেতে তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ার উদাহরণও কি আমরা দেখি না? বয়স্ক অনেকেই এমন আছেন, কম্পিউটার বা স্মার্টফোনের নানারকম ব্যবহার সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল নন, কিন্তু হোয়াটসয়্যাপ খুব ব্যবহার করেন। তাঁদের কাছে ওটুকুই আনন্দ—চোখে না দেখতে পেলেও ঐ অনলাইনে আত্মীয়-পরিজন, ছেলে-মেয়ে, নাতি-নাতনি নিয়ে থাকা, তাদের সঙ্গে নিয়মিত কথা বলা, যোগাযোগ রাখার খিদে। এটা কিন্তু কোনো কাজের কাজ নয়; রক্তমাংসের দেখাসাক্ষাতের একটা বিকল্প বই তো আর কিছু নয় এইসব! এর থেকে নিঃসন্দেহে অনেক বেশি দরকারি নিজের মনে নিজে একা থাকতে শেখা।

কিন্তু বয়স্কদের এই নিঃসঙ্গতা কমাতে তরুণ প্রজন্মেরও কি কোনো কর্তব্য নেই?

আছে বৈকি! আজকের প্রজন্মেরও কিন্তু এটা বোঝা উচিত যে, তাদের হাজারো ব্যস্ততার মধ্যেও বয়স্কদের জন্য যেকোনোভাবে কিছুটা সময় অন্তত রাখা প্রয়োজন। আজকের দিনে শিক্ষা, চাকরি প্রভৃতির দাবি মেনে ছেলেমেয়েদের হয়তো সব ক্ষেত্রে বাবা-মায়ের সঙ্গে থাকা সম্ভব হয় না, সেজন্য তাদের দোষ দেওয়াও অনুচিত। যদি একসঙ্গে বয়স্ক বাবা-মা, আত্মীয়-পরিজনদের নিয়ে থাকা যায়, সেটা তো সবচেয়ে ভাল; কিন্তু তেমনটা না হলেও আজকের দিনে এত উন্নত প্রযুক্তির যুগে দূরে থেকেও কিছুটা সময় তাদের বের করে আনা দরকার। বিদেশে বয়স্কদের সঙ্গে যুবক ছেলেমেয়েদের যোগাযোগের রাশ একটু শিথিল, তাই বৃদ্ধদের খেয়াল রাখা, পরিচর্যার জন্য অনেক ‘Elder Care Centre’-এর মতো ভাল ভাল প্রতিষ্ঠান তৈরি করে দেওয়া হয়েছে। এই মুহূর্তে ভারতে যে বিশাল সংখ্যক যুবক-যুবতী, আজ থেকে ত্রিশ-চল্লিশ বছরের মধ্যে তারা বার্ধক্যে পৌঁছাবে; তখন কতটা উপস্থিতি, সাহচর্য যে তারা ছেলেমেয়ে বা আত্মীয়ের কাছ থেকে পাবে, সে ভেবে দেখার বিষয়! তখন দেখা দিতে পারে বিদেশের মতো প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজন। তবে কী জানেন, আমাদের ক্ষেত্রে সুবিধা হলো আমাদের মনে আশ্রমের একটি ধারণা আছে; সেই ধারণারই এক একরকম রূপায়ণ হতে পারে এরকম প্রতিষ্ঠান। বিদেশে এরকম সেন্টার যথেষ্ট পরিমাণে থাকলেও তাতে আধ্যাত্মিক পরিবেশ তেমন একটা থাকে না। উদ্যোক্তারা কেন যে বোঝেন না, মানুষ বয়সকালে আধ্যাত্মিক পরিবেশ কামনা করে! বার্ধক্যে এসে একটা উচ্চতর অর্থ, লক্ষ্য, মৃত্যুরও পারে যে আরো কিছু আছে—এই বোধ আমাদের জীবনকে ভাল রাখে। কাজেই সেই ধারণায় বা ভাবে উপনীত হওয়ার সুযোগ যদি তাঁদের করে দেওয়া যায়, সে তো খুবই ভাল ব্যাপার! তাই ভারতের ক্ষেত্রে ভবিষ্যতে যদি কখনো এই ‘Elder Care Facility’ আসে, তাহলে তার মধ্যে একটা ‘spiritual component’ অবশ্যই থাকা দরকার।

স্বামীজীর কথায় আমরা প্রায়শই পেয়ে থাকি যে, ভারতে আমরা দীর্ঘ শতাব্দীকাল পরাধীন থাকতে থাকতে দাসে পরিণত হয়েছি আজও স্বদেশগৌরবহীন আমরা, দাসমনোবৃত্তিতে দোষী নানা ক্ষেত্রেই এর থেকে কি উত্তরণ নেই আমাদের?

একটা কথা বলি। ভারতীয়দের গুণগত মান এখনো কিন্তু যথেষ্ট উঁচুদরের। বিদেশে যেসব ভারতীয় থাকতে যান, অন্তত আমেরিকায়—তাঁদেরকে কিন্তু এখনো ‘Model Minority’ বলে উল্লেখ করা হয়। হয়তো সেখানে তাঁরা সংখ্যায় কম, কিন্তু তাঁদের ব্যবহার, বিচার, আচার, নীতি সবই শিক্ষণীয়। কিন্তু কোথায় গিয়ে আমাদের ঘাটতি থেকে যায় জানেন? নিজস্বতা বা স্বাতন্ত্র্যের অভাব বড্ড বেশি আমাদের মধ্যে। কে. সি. ভট্টাচার্যের একটি ভাষণ, পরে প্রবন্ধের আকারে প্রকাশিত হয়েছিল—‘Swaraj in Ideas’ নামে। লেখক তাতে বলছেন, আমাদের মাথার ওপর বসে থাকা শাসকেরা (সেসময় ভারত পরাধীন) হয়তো আর কিছুদিনের মধ্যে দেশ ছেড়ে চলে যাবে, কিন্তু আমাদের মনের মধ্যে রয়ে যাবে তারা। অর্থাৎ, যেটি উনি নির্দেশ করতে চাইছেন, তা হলো আমাদের ‘colonised’ মানসিকতা এবং এই মানসিকতার সবচেয়ে বড় লক্ষণ হলো সৃজনশীলতার অভাব। উদাহরণও দিচ্ছেন তিনি—ধরা যাক, ইংল্যান্ডের একজন অধ্যাপক শেক্সপীয়রকে একভাবে দেখেন। সেদেশ পেরিয়ে ফ্রান্সে চলে যাই যদি, দেখব একজন ফরাসি অধ্যাপক যে-দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে শেক্সপীয়রকে দেখছেন, সেটা ইংরেজের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে কিছুটা আলাদা। কাজেই, সেই হিসাবে অনুমান করা যায়—সাত সমুদ্র পেরিয়ে যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক শেক্সপীয়রকে দেখবেন, একজন ভারতীয় হিসাবে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি নিশ্চয়ই একজন ইংরেজের দেখার চোখ থেকে অনেকটা আলাদা হবে! কিন্তু দুঃখের ব্যাপার, তেমন তো হয় না। তাঁর কথাগুলো যেন সেই অক্সফোর্ডে বসে থাকা ইংরেজ অধ্যাপকের কথারই একটা মাঝারি মানের নকল বলে মনে হয়! যেন তাঁর লক্ষ্য—সেই ইংরেজের ভাবটারই যতটা কাছে পৌঁছানো যায়, তার চেষ্টা করা! এসব দেখলেই মনে হয়, আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা বড় সাংঘাতিকরকম ইংরেজ-প্রণোদিত—সেই পুরানো শিক্ষাব্যবস্থার নকল হয়ে থেকে গেছে। এতে আমাদের নিজস্বতা কোথায়?

এর ফলে তো সম্ভবত বাইরের নানা দেশের সঙ্গে আমাদের যে স্বাস্থ্যকর, বৌদ্ধিক লেনদেনের পদ্ধতিতাও ব্যাহত হচ্ছে!

অবশ্যই। আজ তো ইংল্যান্ডের বদলে পৃথিবীতে সুপার পাওয়ার হিসাবে আমেরিকা এসে গেছে। একবার ভেবে দেখুন তো, আমেরিকা কতটা ভারতীয় বিষয় গ্রহণ করছে, আর ভারত কতটা মার্কিনি করে তুলছে নিজেকে? আমেরিকার জনপ্রিয় গানের ধারা বলুন, কথা বলার ভঙ্গি বলুন—ভারতের শিক্ষিত সমাজের তরুণ প্রতিনিধিরা চট করে সেগুলোকে আপন করে নেয়, না ভেবেচিন্তেই। এখন কথা হচ্ছে যে, এর কিছু ভাল হতে পারে, কিছু খারাপ হতে পারে; বিষয়টা সেটা নয়। আমার প্রশ্ন হলো—একদম একইরকম হবে কেন? প্রত্যেকটা দেশেরই তো কিছু না কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে, সেটা কেন প্রকাশ পাবে না ভারতের ক্ষেত্রে?

এই জড় অবস্থা কীভাবে বদলানো সম্ভব?

নিজেদের কাজে স্বাতন্ত্র্য আনতে হবে। নতুন কিছু সৃষ্ট হলে কারুরই সে-জিনিস গ্রহণে আপত্তি থাকে না কোনো। কিন্তু সেই নতুনের সৃষ্টি হবে তখনি, যখন নিজের সংস্কৃতিতে, ইতিহাসে নিজেকে প্রথমে প্রতিষ্ঠিত করবে মানুষ আর তারপর মিলিত হবে বাকি বিশ্বের সঙ্গে। তখন নিজেকে নিয়ে, নিজের দেশ বা ঐতিহ্যকে নিয়ে এই হীনমন্যতাও আর থাকবে না যে, ‘আমার নিজের তো কিছুই নেই, বরং অপরের যা আছে সবই ভাল’! অনেকের প্রবণতা আছে, বিদেশে থাকতে গিয়ে বা বিদেশকে অনুকরণ করতে গিয়ে দেশকে অবজ্ঞা করার। কিন্তু কী যে আসলে তারা অবজ্ঞা করছে, কী যে ফেলে বিদেশে এসেছে সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের টানে—সে-সম্বন্ধে মোটেও সম্যক জ্ঞান নেই! এতে ফল শেষ অবধি ভাল হয় না—ব্যক্তিজীবন বা কর্মজীবন, কোনোটাতেই।

অক্সফোর্ডের অধ্যাপক মার্কাস ডু স্যাটয় আমাকে বলছিলেন ইসরায়েলের কথা। ১৯৪৮ সালে যখন ইসরায়েল গঠিত হলো, তখন তাঁরা ঠিক করেছিলেন যে, ইহুদি সংস্কৃতিকে রক্ষা করার জন্য হিব্রু ভাষার প্রচলন ঘটাতে হবে। হিব্রু কিন্তু সেসময়ে প্রায় হারিয়ে যাওয়া, মৃতপ্রায় একটা ভাষা। কিন্তু সৎ চেষ্টায় কী না হয়! ওঁরা একেবারে কেজি-ক্লাস থেকে উচ্চশিক্ষার মঞ্চ পর্যন্ত হিব্রু ভাষাচর্চাকে পুনরুজ্জীবিত করলেন; গণিতজ্ঞরা নতুন নতুন গাণিতিক শব্দবন্ধ সৃষ্টি করলেন হিব্রু ভাষায়! ঠিক এখানেই আমাদের মনোবলের অভাব। ভারতে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যদি কোনো বিষয় নিয়ে নিজের ভাষায় পড়তে বলা হয়, অনেকে তো এই চিন্তাতেই অস্থির হয়ে যায় যে, সব ভাল ভাল বই যেখানে ইংরেজিতে, সেখানে সে হঠাৎ আঞ্চলিক ভাষায় পড়তে যাবে কেন? আজ দেখুন, মধ্যপ্রাচ্য থেকে কত বিচিত্র সব বিষয়ে তাঁরা নোবেল প্রাইজ পাচ্ছেন! ইংরেজির প্রতি আনুগত্য না দেখিয়ে তাঁদের ক্ষতি হয়েছে—এমনটা কি তাহলে বলা যায়? বরং নিজ ভাষায়, সংস্কৃতিতে প্রতিষ্ঠিত হয়ে তাঁরা একপ্রকার স্বাতন্ত্র্যের, নিজস্বতার অধিকারী হয়েছেন; আর বিশ্বব্যাপী সবাইই এই নিজস্বতাকে অপরিসীম গুরুত্ব দেন। নিজের শিকড় দৃঢ় না হলে এই স্বাতন্ত্র্য আসা খুব কঠিন।

আজকের এই সময়কে আমরা বলে থাকি ‘cosmopolitan age’; যুগের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে অনেকে নিজের শিকড় ভুলে যায়, আবার শিকড় ধরে থাকতে গেলে এই ভয়টা কাজ করে যে, যুগের গতি থেকে যদি আবার সে পিছিয়ে পড়ে! এই দুই বিরুদ্ধ মনোভাবের কি কোনো মধ্যস্থতা সম্ভবযাকে সম্বল করে মানুষ এগিয়ে যেতে পারে?

স্বামী মেধানন্দের লেখা Swami Vivekananda’s Vedantic Cosmopolitanism বইটির ভূমিকায় মহারাজ লিখছেন দুধরনের ‘cosmopolitanism’-এর কথা। একটির প্রকৃতি হলো—সে বিশ্বের কাছে সবকিছু গ্রহণে উদার, কিন্তু নিজে শিকড়হীন। আর অপরটি হলো ‘rooted cosmopolitanism’—নিজের শিকড়ে দৃঢ়, আর বহির্জগৎ থেকে কিছু গ্রহণেও উন্মুক্ত। স্বামী বিবেকানন্দের ‘cosmopolitanism’ হলো এই দ্বিতীয় প্রকৃতির। শিকড়হীন হওয়ার সমস্যা হলো—নিজের জমি ঠিক না থাকলে খুব শীঘ্রই আমার বিদ্যাবুদ্ধি ‘আমি ও আমার’-এর ক্ষুদ্র গণ্ডিতেই ফিরে আসে; নিজের দেশের সঙ্গে, মানবতার সঙ্গে, আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করার ঔদার্য আর থাকে না। আমাদের প্রাচীন দার্শনিকদের মতে এটা জ্ঞান নয়, বরং অজ্ঞানতার লক্ষণ। এর প্রতিকারই হয়ে উঠতে পারে স্বামীজীর ‘rooted cosmopolitanism’।

তাই, যত অল্প বয়স থেকে সম্ভব, মানুষ নিজের দেশকে, সংস্কৃতিকে জানুক; দর্শন ও ইতিহাসকে জানুক। আমাদের অনেক সময় মনে হতে পারে যে, বেদান্ত প্রভৃতির ধারণা বা দর্শন তো বড় কঠিন; অল্পবয়সি ছেলেমেয়েদের এতকিছু বললে কি তারা বুঝবে? উত্তর হলো—অতি অবশ্যই বুঝবে। আমি নিজে বিভিন্ন জায়গায় বেদান্ত সম্বন্ধে বলতে গিয়ে প্রত্যক্ষ করেছি, অল্পবয়সিরা গোগ্রাসে গিলছে এইসব ধারণা। তারা এই ধারণাগুলিকে তাদের সম্পূর্ণতায় এখনি বুঝতে পারুক বা না পারুক, এইই আদর্শ সময় উচ্চতম দর্শনের সঙ্গে তাদের পরিচয় ঘটানোর। এদের সকলের মধ্যে জানার দারুণ আগ্রহ আছে। নিজেদের দেশজ ঐতিহ্য, ইতিহাস, অধ্যাত্মবাদ সম্বন্ধে যেখানে যতটুকু সত্য জানানো সম্ভব, সেটা জানিয়ে চলাই আমাদের একমাত্র কর্তব্য হয়ে উঠুক এই মুহূর্তে। মানুষ যদি উৎসুক হয়, তার গ্রহণের পাত্র যদি মানবিক, বিশ্বজনীন মূল্যবোধ ও সেই সম্বন্ধীয় দর্শনে ভরে দেওয়া যায় তবে সে নিজের শিকড়কে জানবে এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে হোক বা পারিবারিক শিক্ষার মাধ্যমে, ঐ শিকড়কে জানার সূত্র ধরেই তার আত্ম এবং বিশ্ব-পরিচয় ঘটবে। 

‘স্বামী রঙ্গনাথানন্দ স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।