বেলুড় মঠ, ১৯৫০ সাল। তখন আমি স্বামী বিরজানন্দ মহারাজের সেবক। তাঁর পুণ্যজীবনের শেষভাগে তাঁকে সেবা করতে পেরে আমার জীবন ধন্য হয়ে গেছে। সেই পুরানো দিনের কত স্মৃতি এখনো মানসপটে ভেসে ওঠে! রামকৃষ্ণ সংঘের একটা গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা কীভাবে মহারাজ সমাধান করেছিলেন তাই মনে পড়ছে।

আমি একদিন মহারাজকে পাখা দিয়ে হাওয়া করছি, তখন পূজনীয় নির্মল মহারাজ (সাধারণ সম্পাদক স্বামী মাধবানন্দ) এসে মহারাজকে বললেন : “মহারাজ, একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে (বিষয়টি আমার অজ্ঞাত) আমরা ট্রাস্টি মিটিঙে আলোচনা করেছি, কিন্তু নানা মত দেখা দিয়েছে। ট্রাস্টিরা কেউ একমত হতে পারছেন না। অথচ সংঘের প‌ক্ষে বিষয়টা বড়ই গুরুত্বপূর্ণ।” মহারাজ গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনে বললেন : “দেখ নির্মল, কালকে সব ট্রাস্টিদের নিয়ে আমার ঘরে এসো।” তারপর মহারাজ আমাকে বললেন : “তুই কটার সময় আমাকে রেডি করতে পারবি?” আমি বললাম : “মহারাজ, সকালে ব্রেকফাস্টের পরে স্নানাদি সারতে সাড়ে নয়টা বেজে যাবে।” মহারাজ বললেন : “আচ্ছা নির্মল, কাল সকাল দশটা নাগাদ তোমরা সব আমার ঘরে এসো।”

পরদিন সব ট্রাস্টি মহারাজরা বিরজানন্দজীর ঘরে (স্বামীজীর ঘরের পশ্চিমদিকের ঘর) সমবেত হন। সেবকরা দশখানা চেয়ার মহারাজের সামনে সাজিয়ে রাখেন। তাঁরা উপবেশন করলে মহারাজ পূর্বমুখী হয়ে বিছানায় বসলেন এবং আমাকে পিছনে দাঁড়িয়ে মাথায় হাওয়া করতে নির্দেশ দিলেন। তারপর মহারাজ ধীর গম্ভীরভাবে বিষয়টির ওপর ট্রাস্টিদের নিজস্ব মতামত ব্যক্ত করতে বলেন। প্রত্যেকেই নিজেদের ব্যক্তিগত মত বললেন। মহারাজ সকলের মত শুনে বললেন : “তোমরা সবাই যার যার নিজেদের মত বললে; এখন এব্যাপারে ঠাকুরের সংঘের কীভাবে কল্যাণ হয় সেটা আজ গভীরভাবে চিন্তা কর এবং ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা কর। তারপর কাল ট্রাস্টি মিটিঙে আবার বিষয়টি আলোচনা কর। দেখবে বিষয়টির সমাধান হয়ে যাবে।” মহারাজের নির্দেশমতো পরদিন ট্রাস্টি মিটিঙে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হয় এবং সকলে একমত হয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

বিরজানন্দ মহারাজের এই কার্যপ্রণালী আমার মনে গভীর রেখাপাত করেছিল। আমাদের মতবিরোধের একমাত্র কারণ নিজেদের ব্যক্তিগত মত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা; কিন্তু ভেদবুদ্ধি বিদূরিত হয় যখন আমরা ঠাকুরের সংঘের কল্যাণের দিকে তাকাই। মহারাজ কীভাবে তাঁর ব্যক্তিত্ব, আধ্যাত্মিকতা ও ভালবাসার দ্বারা সাধুদের হৃদয় জয় করে সংঘ পরিচালনা করতেন—তা আমার প‌ক্ষে এক বিশেষ শি‌ক্ষণীয় বিষয় ছিল। 

[এই স্মৃতিকথাটি স্বামী শ্রীধরানন্দ ফোনে সেন্ট লুইসে স্বামী চেতনানন্দকে বলেন ১ জুলাই ২০২১ বিকাল ৬টায়। তিনি সেটি লিখে স্বামী শ্রীধরানন্দকে পাঠান এবং মহারাজ তা অনুমোদন করেন। এই মূল্যবান স্মৃতিচারণটি ‘উদ্বোধন’-এর পাঠকদের উপহার দেওয়ার জন্য আমরা উভয়ের কাছে ঋণী।—সম্পাদক]