“কালীপুজোর জাঁক দেখবা?
তবে বঁধু এড়োল যাবা।”
গ্রামের নাম ‘এড়োয়ালী’। আশপাশের দশ-বিশটা গাঁ-গেরামের লোকে বলে ‘এড়োল’, আবার কেউ কেউ ‘এড়ুল’ও বলে থাকে। থানা ও ব্লক খড়গ্রাম বা ‘খড়গাঁ’, আর সাব-ডিভিশন কান্দি, জেলা মুর্শিদাবাদ। শুধু মুর্শিদাবাদ জেলায় নয়, বীরভূম ও বর্ধমানের বেশ কিছু অংশেও এড়োলের কালীপুজোর রীতিমতো নামডাক আছে।
প্রায় পৌনে তিনশো বছর আগে রাজা রামজীবন রায়ের বংশধর এড়োয়ালীর রায়চৌধুরীরা এই পুজো শুরু করেন। আজ বিভিন্ন শরিক-ঘর মিলিয়ে রায়চৌধুরী পরিবারের কালীর সংখ্যা পুরো এক ডজন। তাছাড়াও দৌহিত্র বন্দ্যোপাধ্যায় বংশের একটি পুজোকে ধরে গ্রামে মোট তেরোটি কালীর অধিষ্ঠান।
রাজা রামজীবন কোথাকার রাজা ছিলেন, এড়োয়ালীই কি তাঁর রাজ্যপাট ছিল কিংবা ‘রায়’রা কীভাবে ‘রায়চৌধুরী’ হলেন—এমনতর অনেক প্রশ্ন মনে ভিড় করে আসা খুবই স্বাভাবিক। কিন্তু সেসব কথা আরেকটু পরে এড়োল পৌঁছেই না হয় বলা
যাবে।
এড়োলের যাত্রাপথে পদে পদে মৌন বিস্মৃতপ্রায় আঞ্চলিক ইতিহাস বাঙ্ময় হয়ে উঠতে চায়। অজস্র কিংবদন্তি আর অদ্ভুত সব লোকাচার বাতাসের স্বরে ফিসফিস করে হারিয়ে যাওয়া অনেক কথা শোনাতে চায়। সুতরাং চলার পথে এমন অনেক কথাই আসবে যাদের সঙ্গে আপাতদৃষ্টিতে এড়োলের কালীপুজোর কোনো সম্পর্কই যেন নেই, মনে হবে ‘ধান ভানতে শিবের গীত’! আবার একটু অন্যভাবে দেখতে গেলে কিন্তু সবই এক জাদু-বাস্তব, যারা সবাই সবার সঙ্গে জড়িয়ে-মড়িয়ে তৈরি করেছে আশ্চর্য মায়ামুকুরের এক-একটা গোটা ছবি।
দেখতে আলাদা হলেও তোমার কৃষ্ণ আর কালীতে তফাত কিগো, দুয়ে মিলেই যে মা আমাদের ‘শ্যামরূপা’! আবার দেখ গা, সেই শ্যামরূপাই কখনো শ্যামা, কখনো বা কালী হয়ে লাজ দেখালছে। কালীই আবার তারা, ধূমাবতী, চামুণ্ডা, হৈমবতীর মতো কত রূপে বিরাজিছে! কাজেই কথাটা বড় সহজ লয় হে বধুঁ, এ বড়ই রঙ্গ। অথচ দেখ, ভাবের ভাবী হলে তার কাছে সবই মিলেমিশে এক অনন্ত শক্তির বিভিন্ন প্রকাশ, যাদের কারো সঙ্গে কারোর কোনো বিরোধ নেই, যত ধন্দ শুধু আমাদের মনে!
কিংবদন্তি বা লোককথা ইতিহাস নয় সত্যি; কিন্তু একথাও তো ফেলনা নয় যে, ইতিহাসের ঔরসেই কিংবদন্তি লোককথার জন্ম। তাই তাদের মধ্যেও লুকিয়ে থাকে ইতিহাসের উপাদান। আর ইতিহাস, কিংবদন্তি ও বিভিন্ন ধরনের বিশ্বাসের মিথষ্ক্রিয়ায় জন্ম নেয় লোকাচার; সেই লোকাচার যখন সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বদলাতে থাকে তখন তার অতীত রীতকরণ আবার আঞ্চলিক ও সামাজিক ইতিহাসে নতুন নতুন উপাদান যোগ করে।
সুতরাং, একটা অঞ্চলকে কিছুটা জানা-বোঝার চেষ্টা না করে সেখানকার এত বড় একটা ধর্মীয়-সামাজিক আনন্দ উৎসবে শামিল হবেন কেমন করে? বিশেষত যার পটভূমিকায় বিরাজমান প্রায় তিনশো বছরের বিচিত্র ইতিহাস!
তাই বলি কী, চলুন না, গপ্পগাছা করতে করতে এক আশ্চর্য ভূখণ্ডের পথের ধুলায় ধুলোট খেলতে খেলতে একটু গদাইলশকরি চালেই না হয় শুরু হোক আমাদের এড়োয়ালী-যাত্রা!
দুই
তবে শুধু জায়গার নাম-ধাম জানলে তো হবে না, কোথাও যেতে হলে পথের ঠিক-ঠিকানাও তো লাগে। কাজেই আগে যাত্রাপথের হাল-হদিশ বাতলানো যাক, তারপর এড়োল আর তার কালীপুজোর সাতসতেরো কথা।
আপনি কোথা থেকে এড়োল যাবেন তার ওপর নির্ভর করবে পথনির্দেশ। যদি বীরভূমের দিক থেকে আসেন তবে রামপুরহাট কিংবা সাঁইথিয়া থেকে বাসে আসতে পারেন। রামপুরহাট থেকে মারগ্রাম হয়ে এড়োল সরাসরি বাস পাবেন। রাস্তা খুবই ভাল, দূরত্ব মোটামুটিভাবে সাতাশ-আটাশ কিলোমিটারের বেশি নয়। সাঁইথিয়া থেকে বড়ঞা-কুলী-খড়গ্রাম হয়ে এড়োল একটু ঘুরপথ। তাছাড়াও এই পথে এড়োল পর্যন্ত সরাসরি বাস নেই, কুলীতে বাস বদল করতে হবে। সালার-চিরুতি হয়ে ট্রেনে খাগড়াঘাট স্টেশনে নেমেও কান্দি-কুলী-খড়গাঁ হয়ে সরাসরি এড়োল যাওয়ার বাস মেলে বটে, তবে তাতে সিট পাওয়া আর লটারির প্রাইজ জেতা প্রায় একই ব্যাপার। প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পথ ভিড়ের বাসে দাঁড়িয়ে যাওয়া বড় সহজ কথা নয়। অবশ্য শিয়ালদা থেকে লালগোলা লাইনের ট্রেনে এসে বহরমপুর কোর্টে নেমেও এড়োলের বাস পাওয়া যায়। এই পথে দূরত্ব দু-পাঁচ কিলোমিটার বাড়লেও বাসে ভিড় একটু কম থাকে। তাই বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সিটও পাওয়া যায়।
এড়োয়ালীর রায়চৌধুরী পরিবারে আমার মামার বাড়ি। গত শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকের শেষ থেকে ষাটের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রতিবছর লক্ষ্মীপুজো মিটলেই বাবা-মায়ের সঙ্গে আমরা ভাই-বোনেরা এড়োল চলে যেতাম। আমাদের পৌঁছে দিয়ে বাবা ফিরে আসতেন আর আমরা পুরো পুজোর ছুটিটা মামার বাড়িতে কাটিয়ে কালীপুজো দেখে ভাইফোঁটার পরদিন ফিরতাম। সেই সময়ে আমরা কখনো সাঁইথিয়া হয়ে, আবার কখনো খাগড়াঘাট দিয়ে যাতায়াত করতাম।
সাঁইথিয়া দিয়ে গেলে স্টেশনে নেমে সেখানকার বিখ্যাত শিঙাড়া খেয়ে তবে আমরা কুলীর বাসে উঠতাম। তারপর কুলী থেকে বাস বদল করে খড়গ্রামে গিয়ে নামতে হতো। খাগড়াঘাট দিয়ে গেলেও খড়গ্রামে নামা ছাড়া গতি ছিল না। কারণ, তখন এড়োল ছুঁয়ে বাস যেত না। ফলত, যেদিক দিয়েই যাই না কেন খড়গাঁ থেকে এড়োল প্রায় সাড়ে চার-পাঁচ কিলোমিটার পথে গোযানই ছিল একমাত্র ভরসা। আজকের মতো সেই সময়েও কাটোয়া লাইনের ট্রেনে বিভিন্ন ধরনের খাবার, যার মধ্যে মিষ্টিই বেশি পাওয়া যেত, যদিও বৈচিত্র ছিল অনেক বেশি। এর কিছু কিছু এখন আর পাওয়াই যায় না। এর সঙ্গে বাড়তি আকর্ষণ ছিল খাগড়াঘাটের অধুনা দুষ্প্রাপ্যপ্রায় তিলের খাজা। বহু বছর পরে আশির দশকে ঐরকম তিলের খাজা পেয়েছিলাম গিরিডি বাসস্ট্যান্ডে।
কী কারণে তা আজ আর মনে নেই, একবার বহরমপুর লাইনের বেলডাঙা স্টেশনে নেমে বিস্তর ঝঞ্ঝাট পুইয়ে কাঁদি (কান্দি) হয়ে এড়োয়ালী যাওয়া হয়েছিল। তবে কোনোকিছুরই তো সবটা খারাপ হয় না, তাই সেই দুর্ভোগে সান্ত্বনা ছিল বেলডাঙার শতমূলের মোরব্বা আর মনোহরা। জনাইয়ের বিখ্যাত মনোহরার স্বাদ যে-ভাগ্যবানেরা পেয়েছেন, তাঁদের পক্ষেও বেলডাঙার মনোহরার স্বাদ কল্পনা করা কঠিন। শতমূলের মোরব্বা অবশ্য সিউড়িতেও পাওয়া যেত। বোধহয় এখনো পাওয়া যায়, তবে সাধ্যমতো নিরপেক্ষভাবে বলছি, বেলডাঙার শতমূলের মোরব্বার সোয়াদই ছিল ভিন্নতর। বহুদিন ওদিকে যাওয়া হয় না। জানি না, আজও সেসব সেইরকমই আছে কি না!
এড়োল যাওয়ার একবারের অভিজ্ঞতা কোনোদিনই ভুলব না। সেবার আমরা আমাদের দেশের বাড়ি থেকে দোহালিয়া বা ‘দুইলে’ কালীবাড়ি হয়ে মোষের গাড়িতে এড়োল গিয়েছিলাম। মামার বাড়ির মতো আমাদের দেশের বাড়িও মুর্শিদাবাদ জেলায়, তবে তা বর্ধমান-মুর্শিদাবাদ বর্ডার ঘেঁষে। সালার স্টেশনে নেমে কান্দি-ভরতপুর সড়ক ধরে ছয়-সাত কিলোমিটার গেলে মালিহাটী বা ‘মেলেটী’র পাশের গ্রাম সালিন্দা—লোকমুখে যার নাম হয়েছে ‘সালিন্দে’। বর্ষাকালে কালচে এঁটেল মাটির কুখ্যাত কাদা ছাড়া বলার মতো কিছু সেই গেরামে ছিল না। কাদায় গরুর গাড়ির ‘ধূরো’ পর্যন্ত ডুবে যেত। গাঁয়ে ঢুকেই অতি গুরুত্বপূর্ণ কালীতলার মোড়ে গোটা বর্ষাকাল বাঁশ-দড়ি মজুত রাখতে হতো কাদায় পড়া গাড়ি টেনে তোলার জন্য। পায়ে লাগলে এমনি ধুলে সে-কাদা উঠত না, ঘষে ঘষে রীতিমতো কসরত করে তাকে পদত্যাগ করাতে হতো। তা সত্ত্বেও অনেক সময়েই তার প্রেমের চিহ্ন একটু-আধটু রয়েই যেত!
মালিহাটী অবশ্য বিখ্যাত গ্রাম। সত্যি বলতে কী, তখন অন্তত মালিহাটীর পরিচয়েই ছিল সালিন্দার পরিচয়। সালিন্দার অবস্থান বোঝাতে অনেককেই বলতে শুনেছি—‘মেলেটীর পাশের গাঁ হে।’
মধ্যযুগের বিখ্যাত বৈষ্ণব নেতা শ্রীনিবাস আচার্যের প্রপৌত্র, পদকর্তা, সংগীতজ্ঞ ও পদসংকলক স্বনামধন্য বৈষ্ণব সাধক রাধামোহন ঠাকুরের (১৬৯৭—১৭৭৮) শ্রীপাট ছিল মালিহাটীতে। তিনি ছিলেন পুটিয়ার রাজা রবীন্দ্রনাথ রায় এবং মহারাজা নন্দকুমারের গুরু। মহারাজা নন্দকুমারের কাটানো ৮০—৯০ বিঘের দিঘি ‘রাধাসায়র’ এবং রাধামোহন ঠাকুরের শ্রীপাট এখনো মালিহাটী গেলে দেখা যাবে।
রাধামোহন শ্রীপাটে গোপাল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। সেই গোপালের এতটাই দাপট যে, গোপালের নবান্ন বা ‘লবান’ না হলে গাঁয়ের কোনো বাড়িতে নবান্ন হতো না। শুধু দাপট বললে অবশ্য ভুল হবে, গোপালের প্রতি গ্রামবাসীদের ভালবাসা বা স্নেহও বড় কম নয়। এখন কী হয় বলতে পারব না, তবে আগে গ্রামবাসীরা গাছের প্রথম ফল, আনাজপাতি, গাই বিয়োবার পর একুশ দিন গেলে প্রথম দুধটুকু গোপালকেই নিবেদন করতেন। বিয়ের আগে ‘থুবড়ো’ বা আইবুড়ো ভাতও তাঁরা শ্রীপাটেই গ্রহণ করতেন।
রাধামোহন দিগ্গজ পণ্ডিত ছিলেন। শুধু ওদিগরে নয়, দূর-দূরান্তেও তাঁর পাণ্ডিত্যের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়েছিল। রাজস্থানের জয়পুরের মহারাজা জয়সিংহের আদেশে ‘স্বকীয়া’ মতের বিখ্যাত প্রবক্তা আচার্য কৃষ্ণচন্দ্র স্বকীয়া মত প্রতিষ্ঠার জন্য দিগ্বিজয়ে বেরিয়েছিলেন। ১৭১৮ সালে কৃষ্ণচন্দ্র মুর্শিদাবাদে হাজির হওয়ার পর মোকাম মালিহাটীতে বিচারসভা বসে। বিচারক ছিলেন নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। রাধামোহনের সম্মানে তিনি স্বয়ং মালিহাটীতে এসেছিলেন। দীর্ঘ বিতর্কের পর রাধামোহন কৃষ্ণচন্দ্রকে পরাস্ত করে ‘পরকীয়া’ মতের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। গুণমুগ্ধ নবাব জমিদারি দিয়ে রাধামোহনকে সম্মানিত করেন।
শুধু কী তাই! সে-পণ্ডিতের তেজও বড় কম ছিল না। শোনা যায়, একবার মহারাজা নন্দকুমার তাঁর গুরু রাধামোহনকে নিজের ভদ্রপুরের বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু পথে এক গরিব শিষ্যকে দর্শন দিতে গিয়ে রাধামোহনের রাজবাড়ি পৌঁছাতে দেরি হয়ে গেল। ব্যাপারটা নন্দকুমারের মোটেই ভাল লাগেনি। বাংলার দেওয়ানের মতো মানী-ধনী শিষ্যের চেয়ে কি না গুরুর কাছে এক তুচ্ছ দরিদ্র শিষ্য বড় হলো! নন্দকুমারের মানে লাগে। শিষ্যের দেমাকের কথা বুঝতে পেরে রাধামোহন নন্দকুমারকে বলেন : “আমার কাছে রাজা-মহারাজা আর গরিব শিষ্যের কোনো ফারাক নেই। তা বাবা, তুমি যখন তা মানতে পারছ না, তখন আমিও আর তোমার বাড়িতে পদার্পণ করব না।” এরপর থেকে তিনি আর কখনো নন্দকুমারের ভিটেয় পা রাখেননি।
রাধামোহন ছাড়াও আরেক বিখ্যাত বৈষ্ণব, শ্রীনিবাস আচার্যের কন্যা হেমলতা দেবীর শিষ্য, কর্ণানন্দ গ্রন্থের রচয়িতা যদুনন্দন দাসের শ্রীপাটও ছিল মালিহাটীতে।
শুধু মালিহাটী নয়, এই অঞ্চলেই একসময়ে বৈষ্ণবতার, বিশেষ করে পরকীয়া সাধনভিত্তিক ‘রাগানুগা’ পন্থার বান ডেকেছিল। কাছেই ঝামটপুরে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বৈষ্ণবগ্রন্থ শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত-এর লেখক, সহজপন্থার পথিক, বিখ্যাত বৈষ্ণব সাধক কৃষ্ণদাস কবিরাজের শ্রীপাট। সেখানে এখনো দুর্গাপুজোর ঠিক পরে কীর্তনীয়াদের মেলা হয়, যেখানে বিভিন্ন সহজিয়া উপসম্প্রদায়ের মানুষেরা যথেষ্টই ভিড় জমান।
সালারের খুবই কাছে টেঁয়া-বৈস্যপুরে শ্রীবৈষ্ণবানন্দের শ্রীপাট ছাড়াও পদকল্পতরু গ্রন্থের পদ-সংগ্রহকর্তা শ্রীবৈষ্ণবচরণ দাসের লীলাভূমি ছিল। তিনি কীর্তনের যে বিশেষ ধারাটি চালু করেন, তাকে বলা হতো ‘টেঁয়ার ছপ’।
ভরতপুরে শ্রীচৈতন্যের প্রিয়তম পরিকর, গৌড়ীয় বৈষ্ণবধর্মের ‘পঞ্চতত্ত্ব’-এর অন্যতম, গদাধর পণ্ডিতের ভাইপো নয়নানন্দের শ্রীপাট। তেরেট কাগজে লেখা গদাধর পণ্ডিতের নকল করা গীতার একটি পুঁথিতে স্বয়ং শ্রীচৈতন্য নিজের হাতে লিখে দিয়েছিলেন—“ষটশতানি সর্বিংশানি শ্লোকানামাহ কেশব। অর্জ্জুনঃ সপ্তপঞ্চাশত সপ্তষষ্টিঞ্চ সঞ্জয়ঃ। ধৃতরাষ্ট্র শ্লোকমেকং গীতায়া মানমুচ্যতে।।” অর্থাৎ সমুদয় গীতামধ্যে কেশবের ৬২০, অর্জুনের ৫৭, সঞ্জয়ের ৬৭ এবং ধৃতরাষ্ট্রের ১টি শ্লোক আছে। শ্রীচৈতন্য ও গদাধর পণ্ডিতের হাতের লেখা সমেত সেই অমূল্য পুঁথিটি ভরতপুরে নয়নানন্দের শ্রীপাটে আজও সযত্নে রাখা আছে।
হ্যাঁ, যে-কথা বলছিলাম। আমাদের দেশের বাড়িতে খুব ধুমধাম করে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজো হতো। সেবার আমরা লক্ষ্মীপুজোয় সালিন্দায় ছিলাম। বিসর্জনের পরের দিন সকালে বাবা ফিরে গিয়েছেন, আর ঐদিনই ভোররাতে আমাদের দুইলে কালীবাড়ি হয়ে এড়োল যাওয়ার কথা। সেইমতো রাতের খাওয়া-দাওয়ার পর দুটো মোষের গাড়ি এসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। দুই গাড়োয়ান গাড়ি নামিয়ে গাড়ির নিচেই ঘুমাচ্ছে, মোষ দু-জোড়া বাঁধা আছে গাড়ির পাশেই।
রাত তখন কটা হবে কে জানে, গাঁয়ের তিন খুনখুনে বুড়ি ঠুকঠুক করে এসে রীতিমতো হাঁকডাক শুরু করে দিলেন—এবার বেরতে হবে। এই তিন বৃদ্ধারও আমাদের সঙ্গে যাওয়ার কথা। তাঁরা অবশ্য দুইলে কালীতলায় পুজো দিয়ে সালিন্দায় ফিরে আসবেন।
তখন গাঁ-গঞ্জে বেশির ভাগ বাড়িতেই ঘড়ি থাকত না। আমাদের বাড়িও এর ব্যতিক্রম ছিল না। বাবা-কাকাদের ঘড়ি ছিল বটে, কিন্তু তাঁরা সবাই কর্মসূত্রে বাইরে থাকতেন। লক্ষ্মীপুজোয় তাঁদের সঙ্গে আসা ঘড়িগুলোও তাঁদের সাথেই বিদায় নিয়েছে। কাজেই চন্দ-সুয্যি-ভুল্কো দেখে সময় হিসাব করা ছাড়া গতি নেই। আর গ্রামের বয়স্ক মানুষজনেরা ছিলেন এবিষয়ে বিশেষজ্ঞ। সুতরাং তিন বুড়ি কোনো ভুল করতেই পারেন না।
কিন্তু ভুল যে তাঁরা করেছিলেন তা বোঝা গেল কিছুটা যাওয়ার পরে, যখন আর ফেরা চলে না। ভোররাত মনে করে আমরা বেরিয়ে পড়েছি মাঝরাতের একটু পরেই।
নিশুতি রাতে ঘুমন্ত গ্রামের পথে গাড়ি চলেছে। কৃষ্ণা-দ্বাদশীর ফিনিকফোটা জ্যোৎস্নায় পথ কোথাও দিন হয়ে গিয়েছে, আবার কোথাও অসংখ্য জোনাক-জ্বলা বড় ঝাঁকড়া গাছের ছায়ায় গভীর অন্ধকার। গাড়ি-দুটোর নিচে ঝোলানো লণ্ঠনের আলোয় চলমান চাকার গতিশীল ছায়া ছাড়া কোনো আলোর আভাস চোখে পড়ে না। চারপাশে অবিশ্রান্ত ঝিঁঝির ডাক আর ক্বচিৎ কোনো রাতপাখির ডানা ঝাপটানোর শব্দ, কিংবা অসময়ে গো-শকটের ক্যাঁচকোঁচ হটর-হটর শব্দে কোনো রাতজাগা কৌতূহলী কুকুরের মৃদু ভুকভুক ছাড়া কোথাও কোনো শব্দ নেই।
শুরু থেকেই দুই চালক কেমন যেন উসখুস করছিল। গাঁয়ের হাতা পেরিয়ে কান্দি-ভরতপুর পাকা সড়কে, এখানকার লব্জে ‘সড়ান’, উঠে কিছুদূর যাওয়ার পর হঠাৎই তারা গাড়ি থামিয়ে দিল। মাথার ওপর লক্ষ তারায় ভরা নির্মেঘ আকাশ আর ডানদিকে কাঁদরের বিশাল বিস্তার।
“এখন ক্যানে বারালেন মা-ঠাকরেন, ভোরের তো এখনও ঢের দেরি!” চালকদের কপালে ভাঁজ পড়েছে।
“বলিস কী রে ড্যাকরা, চোখের মাথা খেঁইছিস না কি? ভুল্কো দেখতে পেছিস না?” খ্যান খ্যান করে বেজে উঠল এক বুড়ির গলা।
“চখ্যের মাথা খাব্য ক্যানে? টপর থেকে মুড়োটা বার করে ভুল্কোটা কোথায় টুকুন দেখান না ঠাকরেন।”
এতক্ষণে তিন বৃদ্ধা গাড়ির ছইয়ের ভিতর থেকে মাথা বের করে আকাশ দেখে পরস্পর মুখ চাওয়া-চাওয়ি শুরু করলেন।
“হ্যাঁ লো জুগুদি! সত্যিই তো, ভুল্কো তো নাই, আর চাঁদও তো সবে পচ্চিমে ঢলছে!”
“তাই তো রে ননী! তিনকাল গে এককালে ঠেকলো, এই বয়েসে এমন গুখুরী কাণ্ড কী করে কল্লাম বল তো? তা, হ্যাঁ বাবা হরি, এখন কি আবার ফিরে যাবা?”
“টুকুন ভাবতে দ্যান ক্যানে। আন তো কিছু লয়, আগের পথটো রাতবিরেতে ভাল লয়।”
“ভাল লয় মানে? ভাল লয় মানেটা কী রে?”
“ওকথা ছাড়েন ক্যানে, ও কিছু লয়।” বয়সে অপেক্ষাকৃত তরুণ চালকটি এতক্ষণে রা কাড়ে।
“ছাড়ব ক্যানে? ও বাবা হরি, ও ভরত, নক্কী বাপ আমার, কিসের ভয়ে ডরালছিস খুলে বল ক্যানে! বউ-বিটি-বাচ্চাকাচ্চা লিয়ে কোনো বেপদ হবে না তো?”
এই সওয়াল-জবাবের মাঝে আমাদের ভূমিকা হতভম্ব নীরব শ্রোতার। ফ্যালফ্যাল করে একবার বক্তার, আরেকবার বক্ত্রীর মুখের পানে তাকাচ্ছি। কী যে ঘটছে কিছুই বুঝছি না, তবে ভয় পাওয়ার মতো কিছু একটা যে ঘটতে যাচ্ছে সেটা বুঝতে আমার মতো বাচ্চাছেলেরও অসুবিধা হচ্ছে না।
দুই চালক খুবই নিচু গলায় নিজেদের মধ্যে কিছু শলা-পরামর্শ করে জানাল, একটু আগে সড়ানের একজায়গায় ডাকাতের ভয় আছে। আগের কোনো এক গ্রামের কিছু লোকজন রাতের বেলা সড়ানের ওপর গাড়ি দেখলে প্রায়ই লুঠপাট চালায়। অল্পদিন আগেই তাতে বাধা দিতে গিয়ে একজন খুন হয়ে গিয়েছে। তবে বেশ কিছুটা ঘুরে কাঁদরের মধ্য দিয়ে হাঁটুভোর জলে ডোবা একটা পথ আছে। সেই পথে গেলে অনেক দূর দিয়ে ঐ এলাকাটা পার হয়ে আবার সড়ানে ওঠা যাবে। পথে যেটুকু জলকাদা আছে তা মোষের গাড়িকে আটকাতে পারবে না। জলকাদায় গরুকে নিয়ে সমস্যা হলেও মোষের খুব একটা অসুবিধা হয় না।
প্রথমেই দুই গাড়ির নিচে ঝোলানো হ্যারিকেন-দুটো নিভিয়ে দেওয়া হলো। তারপর দুই গাড়োয়ান টপরের মধ্যে গদির মতো করে পাতা খড়ের ভিতর থেকে যে-জিনিসগুলো বের করে আনল সেগুলো চাঁদের আলোতেও ঝিলিক দিয়ে উঠল—একটা পাতটাঙি, আরেকটা বিশাল রামদা।
ঘটনার আকস্মিকতায় সকলের কথা হারিয়ে গিয়েছে। শুধু আমাদের দলের নেত্রী সেই জুগুদি, মানে আমাদের জুগু ঠাকমা, কাঁপা গলায় প্রশ্ন করলেন : “হ্যাঁরে, কিছু হল্লে আমাদের ফেলে পালাবি না তো বাপ?”
হরি আর ভরত জুগু ঠাকমার পায়ে হাত দিয়ে বলে উঠল : “ঠাকরেন, আমরা কালু ঘোষের লাতি। কালু ঘোষ ডাকাত ছিল বট্যে কিন্তু মেয়্যাদের পায়ের দিকে দেখত, মুখের দিকে লয়। আমরা পাঁচপুরুষে বাবুদের নুন খেঁইছি। নেমকহারামি আমাদের অক্তে (রক্তে) লাই গো, অক্তে লাই। মা, বুন, ভাগনা-ভাগনিদের ফেলে কুথ্যা পালাব মা। দেখি না কটা মুচ্ছুদ্দির বিটা সামনে দাঁড়াতে পারে!” হরি আর ভরতের চোখগুলো আঙরার মতো ধকধক করে জ্বলে উঠল।
এতক্ষণে আমাদের ভাবী রক্ষাকর্তা দুজনের দিকে ভাল করে তাকিয়ে দেখলাম। জনহীন, শব্দহীন দিগন্ত-বিস্তারিত মাঠ-সড়ান-কাঁদরের আধিভৌতিক, আলো-আঁধারিতে দুজনকেই কালোপাথর কুঁদে তৈরি করা দুটো অতিকায় আদিম মূর্তি বলে মনে হচ্ছে—জান কবুল করা হিম্মতের জোরে যাদের মাথা বুঝি আকাশ ছুঁতে চাইছে!
হিজল বিলের উপস্থিতির কারণে ভরতপুর থানা ‘হিজল অঞ্চল’ বলে পরিচিত ছিল। আর এখানকার পুরুষদের, বিশেষত গোয়ালাদের বলা হতো ‘হিজলে জোয়ান’। মাথায় ছয় ফুটের চেয়ে খাটো পুরুষকে না কি ‘বেঁটে’ বলে ধরা হতো! অভাবে নয়, শুধুমাত্র অমিত শারীরিক শক্তির দুর্দমনীয় তাড়নায় এককালে তাদের অনেকেই ডাকাতি করত। সালিন্দের বাসিন্দা গোয়ালা কালু ঘোষও ছিল তেমনই এক দুর্ধর্ষ ডাকাত, যে আমাদের দেশের বাড়িতে প্রতিদিন দুধ দিতে আসত কিন্তু কোনোদিন বাড়ির মেয়েদের পা ছাড়া মুখের দিকে তাকায়নি। আমার মা-কাকিমারা এর সাক্ষী।
শুধুমাত্র শক্তিমত্তার পরিচয় দিতে হিজলে জোয়ানরা এককালে ‘পিঠে লড়াই’ লড়ত। পৌষ সংক্রান্তির দিন দুই গ্রামের মাঝের কোনো মাঠে দু-পক্ষের জোয়ানরা নানারকমের পিঠে, প্রচুর চোলাই বা পচাই, লাঠি আর গামছা নিয়ে সার বেঁধে মুখোমুখি বসত। পিঠে আর মদ খেতে খেতে সুখ-দুঃখের গপ্প দিয়ে আড্ডা শুরু হতো। নেশা বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে কথার পিঠে কথা গড়াতে গড়াতে শুরু হতো পরস্পরের গাঁয়ের বিভিন্ন কেচ্ছা নিয়ে নিন্দেমন্দ। তারপর হাতাহাতি থেকে শেষ পর্যন্ত লাঠালাঠি। পিঠে লড়াইয়ে ফিবছর দু-পাঁচটা লাশ পড়া কোনো ব্যাপারই ছিল না!
কম্পাউন্ডারি পাশ করে আমার মেজ জ্যাঠামশাই কয়বছর গাঁয়ে ডাক্তারি করেছিলেন। তাঁর কাছে এবং পরিবারের অন্তরালবর্তিনীদের মুখে শুনেছি, লাঠির ঘায়ে চৌফালা হয়ে যাওয়া মাথায় গামছা জড়িয়ে অনেক হিজলে জোয়ানই আসত ব্যান্ডেজ বাঁধাতে। নেশায় চুর, মুখে শিশুর মতো অনাবিল হাসি, একটাই আবদার— “তাড়াতাড়ি পট্টিটো বাঁধি দ্যান গো, মাঠে যেতে হব্বে।” গত শতকের চারের দশকেও এই উৎসব চালু ছিল, পরে অবশ্য প্রশাসনের আদেশে এবং তৎপরতায় পিঠে লড়াই বন্ধ হয়ে যায়। [ক্রমশ়]