ইতিহাস অনুসারে বাংলা সংবাদ-সাময়িকপত্রের সূচনা হয়েছে উনিশ শতকের একেবারে গোড়ার দিকে। তবে তার আগে হিকি সাহেবের হাত ধরে বাংলা থেকে ভারতবর্ষের প্রথম সংবাদপত্র ‘বেঙ্গল গেজেট’ (২৯ জানুয়ারি ১৭৮০) ইংরেজি ভাষায় প্রকাশিত হয়েছিল। আর শ্রীরামপুর ব্যাপটিস্ট মিশন থেকে ১৮১৮ সালের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা ভাষায় মুদ্রিত প্রথম মাসিক সাময়িকপত্র ‘দিগদর্শন’; ২৩ মে প্রকাশিত হয়েছিল প্রথম বাংলা সাপ্তাহিক সংবাদপত্র ‘সমাচার দর্পণ’। সেই ধারা আজও সমান বেগে বহমান। কালের নিয়মে অসংখ্য পত্র-পত্রিকা আত্মপ্রকাশের শুভ সূচনা করে বিলীন হয়ে গেছে, শুধু রয়ে গেছে তাদের অমূল্য রচনার রত্নসম্ভার। স্বামী বিবেকানন্দ প্রবর্তিত ‘উদ্বোধন’ পত্রিকা আগামী জানুয়ারিতে ১২৫ বর্ষে পদার্পণ করবে। তারই প্রাক্‌মুহূর্তে আমরা মনোনিবেশ করেছি সেই সমস্ত বিস্মৃত পত্রিকার পাতায়। গবেষক বিজন ঘোষাল অসীম মন নিয়ে তুলে আনবেন রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ পরিমণ্ডলের নানান প্রাসঙ্গিক রচনা, যা আমাদের সমৃদ্ধ করবে।—সম্পাদক

হ্যানরি অ্যান্টোনি জুল বোয়া (১৮৬৮—১৯৪৩) ছিলেন ফরাসি দেশের বিখ্যাত দার্শনিক, লেখক ও সাংবাদিক। জন্ম ফ্রান্সের মার্সেই শহরে। ‘অতিচেতন’ (superconscious) বিষয় নিয়ে গবেষণা করে তিনি ডক্টর উপাধি অর্জন করেছিলেন। নারীমুক্তির বিষয়ে ‘দ্য ইটারনাল ডল’, ‘দ্য নিউ এরা’, ‘দ্য নিউ সরো অ্যান্ড দ্য ফিউচার কাপল’-এর মতো নানান সাংকেতিক নাটক লিখেছিলেন।

স্বামী বিবেকানন্দ ১৯০০ সালে প্যারিসে তাঁর বাড়িতে কিছুদিন ছিলেন। ঐবছর ১ সেপ্টেম্বর স্বামী তুরীয়ানন্দজীকে লেখা একটি পত্রে স্বামীজী জানান : “তাঁর বাড়ি দেখে এসেছি। তিনি গরিব মানুষ—পণ্ডিত। তাঁর ঘরে একঘর বই।” আরেক পত্রে অ্যালবার্টা স্টার্জিসকে জানান : “এখানে আমি খুব সুখী ও পরিতৃপ্ত আছি। মঁ বোয়ার সঙ্গে আমার এখানকার জীবনযাত্রায় বেশ তৃপ্ত—রাশি রাশি বই, চারিদিকে শান্তি—আমাকে পীড়িত করে এমন জিনিস এখানে নেই।” মিস্টার বোয়া স্বামীজীর পুস্তিকাগুলিকে ফরাসিতে অনুবাদ করে প্রচার করতেন। স্বামীজী তাঁর সংস্পর্শে ফরাসি ভাষায় দক্ষ হয়ে উঠেছিলেন। সংস্কৃতের জটিল দার্শনিক তত্ত্বসমূহ স্বামীজী অবলীলায় ফরাসী ভাষার শ্রোতাদের বোঝাতে সক্ষম হতেন।

মিস্টার বোয়া স্বামীজীর সঙ্গে ইউরোপ ভ্রমণে গিয়েছিলেন। ১৯০১ সালে ভারতে এসে বেলুড় মঠে কয়েকদিন কাটিয়েছিলেন। এখানকার গরম আবহাওয়ায় বেশিদিন থাকতে না পেরে তিনি লাহোর ভ্রমণ করে দেশে ফিরে গিয়েছিলেন। বোয়ার ভারতভ্রমণের অভিজ্ঞতা হলো Visions de l’Inde (১৯০৩ সালে প্রকাশিত) গ্রন্থের উপজীব্য বিষয়। মূল সেই ফরাসি গ্রন্থের অংশবিশেষের বাংলা অনুবাদ ‘ভারতী’ পত্রিকার শ্রাবণ ১৩২৪ বঙ্গাব্দে (৪১তম বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা,  পৃ: ৩৩৮—৪৩) প্রকাশিত হয়েছিল।

বিবেকানন্দ-সঙ্গমে

(Jules Bols প্রণীত Visions de L’Inde হইতে)

সহর দূরে চলিয়া গেল। এতক্ষণে বারো মাইল দীর্ঘ পোতাশ্রয় (ডক্) প্রভৃতিরও শেষ হইল। জোয়ার আসিয়াছে। আমাদিগের চারিদিকেই গঙ্গার জল বর্দ্ধিত হইতেছে। জোয়ারের অনুকূল স্রোত আমাদিগের পান্সীখানিকে মঠের দিকেই টানিয়া লইয়া চলিয়াছে। মঠ-বাড়ীটি শুভ্র—সর্ব্বত্র সুন্দর চুনকাম করা, উদ্যান ও তালীকুঞ্জে বেষ্টিত। ত্রিশূল-শীর্ষ মন্দির-চূড়া সকলের উপরে মাথা তুলিয়া আছে। অদূরে মঠ-সংলগ্ন সৌধ-শ্রেণী যেন আমাদিগকে শিষ্টভাবে আহ্বান করিতেছে।

আমার সহযাত্রী মার্কিণ-রমণী গম্ভীর হইয়া পড়িয়াছেন। নিউইয়র্ক সহরে বিবেকানন্দের সর্ব্বচিত্তহারী অপূর্ব্ব শক্তির কথা শুনিয়া তিনি আজ পর্য্যন্ত তাহা ভুলিতে পারেন নাই। একত্রে সাধু-সন্দর্শনে যাওয়ার প্রস্তাব করিতেই তিনি তৎক্ষণাৎ তাহাতে সম্মত হইলেন। এই মহিলাটির দেশ-পর্য্যটনে ক্লান্তি নাই। পারি-নগরীতে প্রদর্শনীর সময় তাঁহার সহিত প্রথম পরিচয় ঘটে। তাহার পর, পুনরায় কায়রো-নগরীতে সাক্ষাৎ। গতকল্য গ্রেট ইষ্টার্ণ হোটেলের সম্মুখে আবার দেখা হইল। তাঁহার সুতীক্ষ্ণ খরধার দৃষ্টি, অপাপবিদ্ধ মুখচ্ছবি ও সেই দুরাকাঙ্ক্ষ্য অতৃপ্ত ভাব সহজেই তাঁহাকে চিনাইয়া দিয়াছিল। আমাকে দেখিয়া তিনি নিজেই বলিলেন, “দেখুন, পৃথিবীটা কত ক্ষুদ্র!” বাস্তবিক ধরিতে গেলে, আমাদের এই বিপুল পৃথিবী একটা বিরাট চতুষ্পথ মাত্র। এখানে ভ্রমণশীল পথিকবৃন্দ অনুপ্রস্থে গমনকালীন সর্ব্বদাই পরস্পরের সাক্ষাৎ লাভ করিয়া থাকে।

বিবেকানন্দ অলিন্দে দাঁড়াইয়া আছেন। তাঁহার বিশাল-আয়ত নেত্রদ্বয় মুখমণ্ডলের যেন অধিকাংশই গ্রাস করিয়া ফেলিয়াছে। এই যে শ্যামাঙ্গ ব্যক্তিটি প্রাচীন আর্য্যগণের সেই ছয় সহস্র বৎসরের পুরাতন বেশ ধারণ করিয়া রহিয়াছেন, আমি ভূমণ্ডলের যে কোণটিতে বাস করি সেখান হইতে ইঁহার জন্মস্থান কতই না দূরে অবস্থিত! ইনি ভিন্ন-ভাষাভাষী, ভিন্ন দেবের উপাসক, তথাপি আমি ইঁহাকেই আমার শ্রেষ্ঠ বন্ধুরূপে বরণ করিয়াছিলাম। পারি-নগরীতে অবস্থানকালে তিনি কয়েক সপ্তাহ আমার গৃহেই বাস করিয়াছিলেন। আমরা একত্রে কনস্তান্তিনোপ্‌ল, গ্রীস ও মিসর দেশ ভ্রমণ করিয়া ছিলাম! তিনি তাঁহার অনন্যসাধারণ প্রতিভা ও বিপুল ভাবোন্মাদনার সাহায্যে আমার মানসচক্ষে ভারতবর্ষের যে চিত্র প্রতিফলিত করিয়াছিলেন, তাহাতে সে দেশকে আমার স্বপ্নের পিতৃভূমি-বোধে স্নেহের সহিত হৃদয়ে স্থান দিয়াছিলাম। আমার মনের মাধুরী মিশাইয়া আমি যে আদর্শটি গড়িয়া তুলিয়াছিলাম, তাহা এই কল্পনার নন্দন-কাননেই প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল।

আমরা উভয়ে পরলোক ও অদৃষ্টবাদের কত না কথাই আলোচনা করিয়াছি! যে মহাপ্রাণ টলষ্টয় এখন মহাপথের আসন্নযাত্রী*, তাঁহার ন্যায় এই হিন্দুটিরও বিশেষত্ব এই যে, তিনি নিজের চিন্তা ও বিশ্বাস অনুযায়ী জীবনকে নিয়ন্ত্রিত করিয়া থাকেন। এই জন্যই তিনি ভবঘুরের মত দেশে দেশে ঘুরিয়াছেন, সংসারে মানবের যাহা গর্ব্ব ও আনন্দের বস্তু, সে সমস্তই ত্যাগ করিয়াছেন; স্নেহ-ভালবাসা, আত্মীয়-স্বজন,—এমন-কি, শিল্পী ও সাহিত্যিকরূপে যশোলাভ করিবার আকাঙ্ক্ষাও চিরতরে বিসর্জ্জন দিয়াছেন। ইনি এখন সর্ব্বত্যাগী সন্ন্যাসী! ইমার্সনের ভাষায় ইঁহার জীবনের ইতিহাসকেও representative বা আদর্শ-জ্ঞাপক বলা যাইতে পারে। তরুণ বয়সে, ইঁহার একজন সাধুর সহিত পরিচয় হয়—তিনি ‘পরমহংস’ ‘মহাত্মা’। ইনি অশিক্ষিত ব্রাহ্মণ—বিজ্ঞানের বড় ধার ধারিতেন না; কিন্তু তপশ্চর্য্যা ও কঠোর সন্ন্যাসব্রতে বিশেষ শক্তিমান্ ছিলেন। তাঁহার শিষ্যগণ হিন্দুদিগের দুইটি প্রধান দেবতা ও বীরপুরুষের নামানুসারে তাঁহাকে রামকৃষ্ণ বলিয়া ডাকিত—মনে করিত, একাধারে তিনি এই দুই দেবতারই ‘অবতার’। যে সংস্কৃত ভাষা এখনও ভারতে পবিত্ৰ বলিয়া বিবেচিত তাহাতে রামকৃষ্ণের অধিকার ছিল না। তিনি কখনও বিদেশে ভ্রমণ করেন নাই। কলিকাতার উত্তরে একটি কালিকা-মন্দিরের উদ্যানে তাঁহার অদীর্ঘ জীবন-স্রোত মৃদুভাবেই প্রবাহিত হইয়াছিল। ভাবাবেশ যখন তাঁহাকে আর ধ্যানের অতলস্পর্শ গভীরতায় রুদ্ধ রাখিতে পারিত না সেই সময়ে মুক্তিকামী জনগণের প্রতি তাঁহার কথামৃত অজস্রধারে বর্ষিত হইত। তাঁহার প্রিয়তম শিষ্য বাল্যকাল হইতেই তাঁহার উপদেশাবলী উৎকর্ণ হইয়া শ্ৰবণ করিতেন। বালকের স্বদেশনিষ্ঠ হৃদয়খানি তখন দেশের দুঃখ ও নিরাশায় কত-না বেদনায় ভরিয়া উঠিত! তিনি ভাবিতেন, এই নিঃসঙ্গ সন্ন্যাসীর উপদেশ অবলম্বন করিয়া তিনি জন্মভূমির উন্নতি-সাধনে ব্রতী হইবেন। গুরু তাঁহার বিবেকানন্দ নামকরণ করিয়াছিলেন [তথ্যটি সঠিক নয়] এবং সংস্কারকের উপযোগী অভিজ্ঞতা লাভের জন্য তাঁহাকে দেশে দেশে ভ্রমণ করিয়া জ্ঞানসঞ্চয় করিতে আদেশ দিয়াছিলেন। তরুণ শিষ্যটির মানবাত্মার পরমাত্মায় বিলীনতা সম্বন্ধে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মিয়াছিল। তিনি বেশভূষা ছাড়িয়া, অঙ্গে ভস্ম লেপন করিয়া পরিব্রাজকরূপে ভারতবর্ষের নানাস্থানে ঘুরিয়া বেড়াইতে লাগিলেন। কখনও রাজার প্রাসাদে আহার করেন, কখনও দীনহীন কৃষকের পর্ণকুটীরে আশ্রয় লন—কখনও বা বারান্দায় কখনও বা বৃক্ষতলে রাত্রিযাপন করেন। গুরুদেবের তিরোভাবে শোকাকুল বিবেকানন্দ অশ্রুবর্ষণ করিতে করিতে এইরূপ অধীর ভাবেই দিনপাত করিতে লাগিলেন; যাহাতে প্ৰত্যাদিষ্ট প্রচারকার্য্য সফল ও চিরস্মরণীয় হয়, সে-সম্বন্ধে প্রাণপণ চেষ্টা করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন।

ইহা বিশ্ব-মানবের ধর্ম্ম—পৃথিবীর সকল ধৰ্ম্মের সমন্বয়। ইহার কোনও নির্দ্দিষ্ট অনুষ্ঠানপদ্ধতি নাই—সকল দেবতা, সকল ধর্ম্মব্যাখ্যাতা মহাপুরুষগণের প্রতিই এ ধর্ম্মের সমান ভক্তি ও অনুরাগ। পর্য্যটনরত ভিক্ষোপজীবী সন্ন্যাসীর় পবিত্র জীবন যাপন করিয়া আধ্যাত্মিক শক্তি বলবতী হইয়া উঠিলে বিবেকানন্দ মার্কিণ দেশে যাত্রা করেন। সেখানে সভায় পরিষদে তাঁহার অভূতপূর্ব্ব যশোলাভ ঘটে। কিন্তু তাহা হইলে কি হয়—তাঁহার় বাঙ্গালী-সুলভ ক্ষণভঙ্গুর স্বাস্থ্যটুকুও সেইখানে নষ্ট হইয়া যায়। বংশগত যকৃতের দোষে ও বহুমূত্ররোগে তাঁহাকে জর্জ্জরিত করিয়া তুলে। যাহা হউক সুখের কথা এই যে, তাঁহার বিদেশগমন নিষ্ফল হয় নাই। তিনি প্রত্যাগমনকালে যে অর্থ সংগ্রহ করিয়া আনিয়াছিলেন, মঠ-প্রতিষ্ঠা ও গুরু-ভাইদের একত্র করিয়া সঙ্ঘ-স্থাপনার জন্য সেই অর্থই পর্য্যাপ্ত হইয়াছিল। তাঁহার গৃহদ্বারে উপস্থিত হইতেই সর্ব্বপ্রথমে এই সম্বন্ধেই কথা-বার্ত্তা হইল।

বিবেকানন্দ বলিলেন, “বন্ধু, আমি মুক্তি পাইয়াছি। গুরুভার শৃঙ্খলের ন্যায় কাঞ্চনরাশি বহন করিতেছিলাম, সমস্ত উৎসর্গ করিয়া—এখন যেন নূতন করিয়া মুক্তি লাভ করিলাম। আমি এখন জগতের দরিদ্রতম দেশের সর্ব্বাপেক্ষা দরিদ্র ব্যক্তি। কিন্তু তাহাতে কি? আমার রামকৃষ্ণের মন্দির নির্ম্মিত হইয়াছে এবং এখানে আমার গুরুভাই ও শিষ্যগণের এখন মাথা গুঁজিবার স্থান হইয়াছে।” তিনি আমার সঙ্গিনী মার্কিণবাসিনীকে লক্ষ্য করিয়া কতই নম্রতার সহিত জোড়করে—মস্তক নত করিয়া অভিবাদন করিলেন। আমাদের প্রতীচ্য দেশে এ ভঙ্গীটি কেবল প্রার্থনার সময়েই দেখা যায়; কিন্তু হিন্দু-শিল্পে দেবগণের সহ-ভঙ্গীতেই ধর্ম্মিণীরা তাঁহাদের ভর্ত্তৃদিগের সম্মুখে এইরূপ পরিকল্পিত হইয়া থাকেন।

বিবেকানন্দ আমাদিগকে অপর সকলের সহিত পরিচয় করাইয়া দিয়া কহিলেন, “ইঁহারাই আমার ভ্রাতা ও সন্তানস্থানীয়।”

মোহন উষ্ণীশধারী তরুণ তাপসগণ আমাদিগের প্রতি সহাস্যে ফিরিয়া চাহিলেন। তাঁহাদিগের সরল অপাঙ্গের অকপট দৃষ্টি দেখিয়া সহজেই বুঝা গেল যে, জীবনের কর্ম্মশালায় তাঁহারা এখনও শিক্ষনবীস মাত্র। বৃদ্ধ মঠবাসিগণ কিয়ৎক্ষণের জন্য বেদাদি-সংক্রান্ত গবেষণা হইতে আপনাদিগকে বিচ্ছিন্ন করিয়া তাঁহাদিগের শৈব চিহ্নে চিহ্নিত ললাটদেশ আমাদিগের উদ্দেশ্যে অবনত করিলেন। এখানে ব্রাহ্মণ, শূদ্র, এমন-কি অস্পৃশ্য চণ্ডাল পর্য্যন্ত একত্রে সম্মিলিত। এই ধর্ম্মোপদেষ্টাটির নিকট জাতিভেদের কোনও স্থান নাই—কারণ ঈশ্বর সকল মানবেই সমভাবে বিরাজমান। একজন শিষ্য তামাক খাইতেছিল। স্বামীজি তাঁহার হাত হইতে গড়গড়াটি তুলিয়া লইয়া—তাহাতে একবার টান দিয়া ফিরাইয়া উহা প্রত্যর্পণ দিলেন। গোলাপী গন্ধে চারিদিক ভরপুর হইয়া উঠিল। বিবেকানন্দ আমাদিগের হাতে কয়েকটি পদ্মফুল দিয়া বলিলেন, “চলুন, ছাদের উপর যাওয়া যাক্‌। আমার বন্ধুরা এখন “টিফিন” প্রস্তুত করিতে যাইতেছেন।” ইংরাজাধিকৃত ভারতবর্ষে দ্বিপ্রাহরিক আহার এখন “টিফিন” নামেই অভিহিত।

উপর হইতে কি-এক অপূর্ব্ব প্রাণস্পর্শী দৃশ্য আমাদের নয়ন-পথে পতিত হইল। প্রচণ্ড সৌরকরোদ্ভাসিত মুক্ত গগন-তলে একি বিমোহন চিরনবীন পল্লী-শোভা! সরসীগুলি আরসির ন্যায়ই স্বচ্ছ। যেন কোনও পলায়ন-পরা দেববালা সেগুলি ভূতলে ইতস্ততঃ ছড়াইয়া ফেলিয়া গিয়াছে। দূর হইতে কানন-শ্রেণী মখমল-সুকোমল সুদীর্ঘ রোমাবলীর ন্যায় প্রতীয়মান হইতেছে। গঙ্গায় রজতধারা প্রণয়ীর বাহুর ন্যায় বসুধার় কটিদেশ বেষ্টন করিয়া রহিয়াছে। পর পারে আর-একটি উচ্চ মন্দির়-চূড়া দেখিতে পাইতেছি; উহার সন্নিকটে একটি বিশাল-বিতত-শাখ বটবৃক্ষ। এই প্রাচীন বৃক্ষের শাখাদি হইতে ‘শিকড়’ নামিয়া—মৃত্তিকাসংযুক্ত হইয়া ক্রমশঃ এক-একটি বিভিন্ন বৃক্ষের সৃষ্টি করিয়াছে। স্বামীজি কহিলেন, “ওই ছায়াশীতল বৃক্ষতলে আমার প্রভু রামকৃষ্ণদেব প্রথমে সমাধিমগ্ন হইয়া পরমাত্মায় বিলীন হইয়াছিলেন। গৌতম বুদ্ধের সাধনার স্থান বুদ্ধ-গয়ার বোধিদ্রুম বৌদ্ধগণের নিকট যেরূপ পবিত্ৰ, ওই বৃক্ষটিও আমাদের চক্ষে তাহা অপেক্ষা কম পবিত্র নহে।”

আধঘণ্টা পরে—তাঁহার ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে বিবেকানন্দ আমাদিগকে স্বহস্তে ‘টিফিন’ আনিয়া দিলেন। ডিম, টাটকা দুগ্ধ, সুগন্ধি অন্ন* ও কতকগুলি আম্র রহিয়াছে দেখিলাম। এই ফলগুলি আমাদিগের নিকট ‘পীচ’ (Peach) অপেক্ষাও সুস্বাদু বলিয়া বোধ হইল। মঠে আমিষের ব্যবহার নাই; সেজন্য আমিষ-সম্পৰ্কীয় খাদ্যাদি আমাদিগকে দিতে পারিলেন না বলিয়া স্বামীজি ক্রটি স্বীকার করিলেন। তাঁহার এই কক্ষটি বড় অদ্ভুত রকমের। হিন্দু সন্ন্যাসীর আড়ম্বরহীন নগ্নতার সহিত যেন পাশ্চাত্য দার্শনিকের ব্যবহারিক গৃহসজ্জা বিচিত্র ভাবে মিশিয়া রহিয়াছে। দোদুল আরাম্-কেদারা—বহুবিধ গ্রন্থপূর্ণ গ্রন্থাগার সবই রহিয়াছে দেখিতেছি। ইমার্সন ও স্পেন্সার কীটদষ্ট দেশীয় পুস্তকাদির সহিত এক পংক্তিতেই ঠাসাঠাসিভাবে স্থান পাইয়াছে। একটি নম্রস্বভাব শিষ্য হরিৎপত্রে মণ্ডিত কয়েকটি (‘দোনা করা’) পান আমাদিগকে আনিয়া দিল। শুনিলাম, পর্ণপত্রগুলি সমস্তই মঠের উদ্যান হইতে সংগৃহীত। আমি খিলি লইয়া চিবাইতে লাগিলাম। ফুলের গন্ধে, তাম্রকূটের আস্বাদে ও খিলির রসে আমার মুখ পরিপূর্ণ হইল—দন্তপাতি আরক্ত হইয়া উঠিল। সন্ন্যাসী হাসিয়া কহিলেন, “ভারতবর্ষের সর্ব্বত্রই লোকে মাদক দ্রব্যাদি ধূমপান বা চর্ব্বণ করিয়া ব্যবহার করে। আমাদিগের নিকট জীবন শুধুই স্বপ্নবৎ। আপনারা যাহাকে স্বপ্ন বলিয়া থাকেন আমরা তাহাই বাস্তব বলিয়া বিবেচনা করি। দৃষ্টিগ্রাহ্য বা স্পর্শযোগ্য বলিয়া আপনারা যাহা সত্য, প্রকৃত ও সত্ত্বাসংযুক্ত বলিয়া মনে করেন, আমাদিগের নিকট তাহা মায়া-প্রপঞ্চ মাত্র—মৃগতৃষ্ণিকার ন্যায় অলীক। এ সকলই সৰ্ব্বক্ষণ পরিবর্ত্তনশীল, সর্ব্বদাই ধ্বংস-প্রবণ। ইহাতে এমন কোনও গুণ নাই যাহাতে আসক্তি জন্মাইতে পারে বা যাহার জন্য এই সকল মায়িক দৃশ্য কষ্ট স্বীকার করিয়া দেখিবার প্রয়োজন ঘটে। নগর-জনপদ, বিলাস-ব্যসন, ঐশ্বর্য্য-গৌরব-সভ্যতা, জাতীয় উন্নতি ও জড়-বিজ্ঞানের অলৌকিক শক্তি প্রভৃতি আমাদের কিছুই অবিদিত নাই। কয়েক শতাব্দীর পরীক্ষার ফলে আমরা এখন ইহাতে বীতশ্রদ্ধ হইয়া পড়িয়াছি; এ সকল শুধু বালকের ক্রীড়নক—বালকের জন্যই নির্ম্মিত। আপনারা যে কঠোর স্বপ্নমোহে এখনও আবিষ্ট রহিয়াছেন, আমরা তাহা বর্জ্জন করিয়া পূর্ব্বাহ্ণেই জাগরিত হইয়াছি। আমরা শ্বাস রোধ করিয়া কোনও সুবৃহৎ বৃক্ষের তলায় বসিয়া সেই পুরাকালীন ‘অগ্নি’র প্রতি অর্দ্ধনিমীলিত নেত্রে চাহিয়া থাকি। যিনি ভূমা—যিনি অনন্ত—যিনি স্বয়ং জগৎচরাচরে ব্যাপ্ত, তিনিই তাঁহার অপরূপ দ্বারগুলি আমাদের সম্মুখে উদ্ঘাটন করিয়া দেন—আমরা সেই পথ দিয়া অন্তর্জ্জগতের সেই একমাত্র সত্যলোকে প্রবেশ করিয়া থাকি। আপনারা নিজেরাই ভাবিয়া দেখুন, এ যাবৎ খুব অল্পসংখ্যক ইউরোপীয়ই যোগসাধনার এই সফল রহস্য ভেদ করিতে সমর্থ হইয়াছেন।”

আমরা প্রকোষ্ঠের জানালার দিকে ঝুঁকিয়া দেখিলাম। কোথায় একটা ঘড়ি টং টং করিয়া বাজিয়া উঠিল। নীচে— বৃক্ষবাটিকায় একটি উদুম্বর তরুতলে সন্ন্যাসীরা বৃত্তাকারে উপবেশন করিয়া রহিয়াছেন। তালে তালে, যেন ছন্দের মাত্রায় মাত্রায় তাঁহারা নিজেদের শির ও পৃষ্ঠদেশ দুলাইতে ছিলেন। যে সন্ন্যাসীটি একটু পূর্ব্বেই আমাদিগের সহচর ছিলেন, তিনিও দেখিতেছি এক অশ্রুতপূর্ব্ব যুগের ধর্ম্মস্তোত্র আবৃত্তি করিতেছেন; শুনিলে আমাদের গির্জ্জা-ঘরের plain-chant গীতের কথা মনে পড়ে। তবে, তার চেয়েও এই স্তোত্র যেন আরও একটু কর্কশ—আরো আনন্দ-পরিপূর্ণ। মধ্যস্থলে অগ্নিকুণ্ড জ্বলিতেছে। অগ্নির একপার্শ্বে পুষ্পমাল্যভারে সজ্জিত শিবের ত্রিশূল প্রোথিত! যে অগ্নিশিখায় দেবতা স্বয়ং বিরাজমান, সকলেই নিবিষ্টচিত্তে তাহারই প্রতি মনঃসংযোগ করিয়া রহিয়াছেন। এই অগ্নিগর্ভ আত্মার সম্মোহন শক্তিপ্রভাবে কোনও অপূর্ব্ব স্বপ্নে অভিভূত এই সকল সেন্দ্রিয় দেহীগণ হইতে কি জানি কি এক বিপুল শান্তি উচ্চে উত্থিত হইতে ছিল। আমাদিগের উন্মত্ত কর্ম্ম-প্রবণতার তুলনায় এ শান্তি যেন আরও ভয়াবহ! মনে হইতেছিল, এই ভীষণ স্থৈর্য্যের ভিতর দিয়া পবিত্ৰ স্তোত্র-গীতের প্রতিধ্বনি যেন পক্ষ বিস্তার করিয়া ত্রিদিবের পথে অগ্রসর হইতেছে! সুবর্ণপ্রভ মধু-মক্ষিকাগণ সূর্য্যকিরণে এই সকল যোগানন্দে মগ্ন সাধুর মস্তকের উপর নাচিয়া নাচিয়া উড়িতেছে। এদিকে পবিত্র গোশালার ভিতর সযত্নপালিত গাভীগণ মস্তক উত্তোলন করিয়া যে অপরূপ ধর্ম্মানুষ্ঠানে মানব বিশ্ব-প্রকৃতির অন্তরে পুনঃপ্রবিষ্ট হইয়া বিনামৃত্যুতে মোক্ষলাভ করে—সেই অসাধারণ আরাধনা-পদ্ধতির সহিত যেন নিজেদের সাহচর্য্য জ্ঞাপন করিতেছিল। 

শ্রীগুরুদাস সরকার

বানান অপরিবর্তিত রাখা হলো।