[স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছর পূর্তিতে ভবিষ্যৎ ভারতের রূপরেখা নির্মাণে নানান আলোচনা হচ্ছে। ভবিষ্যৎ ভারতের স্বপ্ন স্বামী বিবেকানন্দ দেখেছিলেন এবং আমাদের সামনে সেই রূপটি অতি স্পষ্ট করে দেখিয়ে দিয়ে গেছেন। তিনি চাইতেন ভবিষ্যৎ ভারত গড়ে তুলতে আমাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ। তিনি বিশ্বাস করতেন ভবিষ্যৎ ভারত গড়ে উঠবে আদর্শ মানুষের হাত দিয়ে। সেজন্য আগে নিজেদের তৈরি করা উচিত। আদর্শ মানুষ প্রসঙ্গে স্বামীজী বলছেন : “আমরা এমন মানুষ দেখিতে চাই, যিনি সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে গড়িয়া উঠিয়াছেন… উদারহৃদয়, উন্নতমনা (কর্মে নিপুণ)। প্রয়োজন এইরূপ ব্যক্তির, যাঁহার অন্তঃকরণ জগতের দুঃখকষ্ট তীব্রভাবে অনুভব করে।… আর (আমরা চাই) এমন মানুষ, যিনি যে শুধু অনুভব করিতে পারেন তাহা নয়, পরন্তু বস্তুনিচয়ের অর্থ ধরিতে পারেন, যিনি প্রকৃতি এবং বুদ্ধির মর্মস্থলে গভীরভাবে ডুব দেন। (আমাদের দরকার) এমন মানুষের, যিনি সেখানেও থামেন না, (কিন্তু) যিনি (সেই অনুভবকে বাস্তব কর্মে) রূপায়িত করিতে ইচ্ছুক। মস্তিষ্ক, হৃদয় এবং হাত—এই তিনটির এইপ্রকার সমন্বয় আমাদের কাম্য।”
অর্থাৎ স্বামীজীর আদর্শ মানুষেরা হবেন হৃদয়বান, কর্মঠ, চিন্তাশীল ও শক্তিশালী। স্বামীজী চেয়েছিলেন এইরকম আদর্শ মানুষদের মাধ্যমে আদর্শ সমাজ ও দেশ গড়ে উঠবে। এবিষয়ে তিনটি দিক গুরুত্বপূর্ণ—আমাদের হৃদয়ের প্রসারতা, কর্মকুশলতা ও মনের বিকাশসাধন। এই তিনটি জায়গা আগামী ভবিষ্যৎ ভারত গড়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম ভূমিকা নিতে পারে। আমরা এই জায়গাগুলোকেই ধরার চেষ্টা করেছি। পৌঁছে গিয়েছিলাম তিনজনের কাছে। একজন সন্ন্যাসী—তিনি সুদূর আমেরিকায় রয়েছেন। তাঁর কাছে আগামী ভারতবর্ষের দিকে তাকিয়ে কীভাবে আমাদের মনকে আমরা তৈরি করব, মানসিক জায়গাটাকে আরো সুদৃঢ় করতে পারি—সেই প্রে‌ক্ষিতে জেনেছি। একজনের কাছে পৌঁছে গিয়েছিলাম, যিনি রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলের সঙ্গে বহুদিন ধরে যুক্ত ছিলেন শিক্ষক হিসাবে—তাঁর কাছ থেকে শুনেছি স্বামীজীর বলা ত্যাগ ও সেবার মাধ্যমে হৃদয়ের প্রয়োগের কথা। আরেকজন যুবক, যিনি স্বামীজীর ভাব নিয়ে আগামী ভারতের জন্য যুবক-যুবতীদের তৈরি করার মহতী প্রচেষ্টা করছেন; যাতে তারা ভবিষ্যৎ ভারতের আদর্শ নাগরিক হয়ে উঠতে পারে। এই সম্পর্কিত তাঁদের ভাবনাগুলোকে আমরা এখানে একত্রিত করার চেষ্টা করেছি।—সম্পাদক]

‘ডেক্সটারিটি গ্লোবাল’ ভারতবর্ষের নবীনতম সংগঠনগুলির অন্যতম, যা সমাজের বিভিন্ন স্তরের ছাত্রছাত্রীদের গড়ে তোলার কাজ করছে। আপনার সেই সংগঠন সম্পর্কে আমাদের কিছু বলুন।

দুটো দিক থেকে সংস্থাটিকে আমি দেখার চেষ্টা করব। একটি দর্শন ও উদ্দেশ্যর দিক এবং আরেকটি প্রায়োগিক দিক। বেশির ভাগ দেশে গঠনমূলক কাজ সম্ভব হয়েছে শিক্ষার ব্যাবহারিক প্রয়োগের মাধ্যমে। আসলে ডেক্সটারিটি গ্লোবাল মনে করে যে, আমাদের শিক্ষা ও নেতৃত্বকে আলাদাভাবে দেখা উচিত নয়। অনেক সময়ই আমরা দেখতে পাই, শিক্ষার সফল প্রয়োগ হচ্ছে না। শিক্ষা এবং নেতৃত্বের মধ্যে একটা দূরত্ব থেকে যাচ্ছে। আমাদের উদ্দেশ্য হলো শিক্ষা ও নেতৃত্বের মধ্যে দূরত্বকে দূর করা, আগামী দিনে যুবকেরা যেন তাদের অধীত শিক্ষাকে দেশগঠনের কাজে লাগাতে পারে। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে—নেতৃত্ব কী? নেতৃত্ব হচ্ছে এমন একটা গুণ, যার মাধ্যমে আমাদের সীমিত ক্ষমতা দিয়েও মানুষকে কিছু দিতে পারি, তাদের জীবনকে সমৃদ্ধ করতে পারি। আমাদের লক্ষ্যই হচ্ছে আগামী পঁচিশ-তিরিশ বছরের মধ্যে এমনভাবে এই প্রকল্পকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া যাতে যুবনেতৃত্ব তৈরি হবে, যারা বিভিন্ন শহর ও গ্রাম থেকে উঠে আসবে এবং একসাথে কাজ করবে। সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের অবদান রাখবে। সেটা সমাজসেবা, সংবাদ, ইতিহাস, সাহিত্য, বিজ্ঞান—যেকোনো বিষয় হতে পারে। আমাদের ধারণা, দেশগঠন শুধুমাত্র সীমিত কিছু মানুষ—যেমন শিল্পপতি, বিজ্ঞানী, অধ্যাপক বা সাংসদের কাজ। দেশগঠন ব্যাপারটা কিন্তু তা নয়। প্রত্যেককে অনুভব করতে হবে, এই শপথ নিতে হবে যে, দেশগঠনের কাজে তাদেরও একটা ভূমিকা রয়েছে। স্বামীজী সেটাই চেয়েছিলেন। পাশ্চাত্য থেকে ফিরে এসে কলম্বো থেকে আলমোড়া সারা ভারতবর্ষ ঘুরে তিনি এই কথাই বলে গেছেন সকলকে। আমরা সেই জিনিসটাই যুবসম্প্রদায়ের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চাইছি।   

দেশগঠনের কাজে সকলেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে—এই বিশ্বাসের সূত্র আপনি কোথা থেকে পেলেন? আপনি কীভাবে এই কাজে উদ্বুদ্ধ হলেন?

আসলে, আমার বাবা খুব অল্প বয়স থেকেই পাটনা রামকৃষ্ণ মিশনে যাতায়াত করতেন। সেখানকার লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনাও করতেন। স্বামীজীর বক্তৃতা, রচনা তাঁকে গভীরভাবে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বাবার ইচ্ছে ছিল সন্ন্যাসধর্ম নেওয়ার; কিন্তু সেসময় পারিবারিক অবস্থা এমন ছিল যে, তিনি তা পারেননি। গার্হস্থজীবনে এসে তিনি চেয়েছিলেন, ভবিষ্যতে তাঁর সন্তানরা স্বামীজীর ভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে কাজ করবে। একারণেই স্বামীজীর নামে নাম রেখেছিলেন আমাদের। একেবারে ছোট বয়স থেকেই তিনি আমাদের রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ সাহিত্য পড়াতেন। আমার জীবনের প্রথম বারো বছর আমি স্বামীজীর জীবন, শিক্ষা ইত্যাদি বারবার পড়েছি। মনে আছে, যখন আমার আটবছর বয়স তখন ছাপড়া আশ্রমে আমার হাতে হিন্দিতে স্বামীজীর নয়া ভারত গড়ো গ্রন্থটি এসেছিল। যত দিন গেছে আমার মধ্যে ধীরে ধীরে এই ভাবগুলো প্রবেশ করতে শুরু করছে এবং পরবর্তিকালে সেই ভাবনাগুলোকেই একটা রূপ দেওয়ার চেষ্টা করেছি।

বহু দেশে আপনি ভারতের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। আপনি দেখেছেন—আমাদের অন্তর্নিহিত দেবত্ব বিকাশের যে সুযোগ তা সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। সেগুলি কী করে ছাত্রছাত্রীদের সামনে তুলে ধরা যায় বলে আপনার মনে হয়?

এই ডেক্সটারিটি গ্লোবাল করতে গিয়ে দেখেছি, আমাদের গ্রামের মানুষরা দেশীয় বা আন্তর্জাতিক স্তরের সুযোগ-সুবিধার কথা জানে না। তাদের হয়তো প্রতিভা রয়েছে কিন্তু তারা জানে না যে তাদের শিক্ষার সুযোগ রয়েছে, স্কলারশিপের ব্যবস্থা রয়েছে। প্রথম সমস্যা হলো—তাদের কাছে এগিয়ে চলার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য পর্যাপ্ত নেই। দ্বিতীয়ত, প্রত্যন্ত গ্রামে অনেকেই রয়েছে যাদের মধ্যে জেগে ওঠার আগুন আছে কিন্তু তাদের গাইড করার মতো কেউ নেই, যারা কি না তাদের ট্রেনিং দিয়ে নিজেদের মেলে ধরতে সাহায্য করবে। সেজন্য আমরা ২০০৮ সালে যখন ডেক্সটারিটি গ্লোবাল শুরু করলাম তখন এই দুটো উদ্দেশ্যই আমাদের ছিল। প্রথমত, যদি কোনো ধরনের সুযোগ থাকে সে-সম্পর্কে যুবকদের জানিয়ে দেওয়া এবং দ্বিতীয়ত, তারা কীভাবে সেই সুযোগ-সুবিধাগুলি পাওয়ার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করবে, সেবিষয়ে তাদের অবহিত করা।

যেভাবে আপনারা কাজ করছেন তাতে মনে হয় আগামী কুড়ি বছরের মধ্যে আমরা দেখবস্বামীজীর আদর্শকে নিজের জীবনে প্রয়োগ করে অনেকে দেশকে একটা অসাধারণ উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে আপনি স্বামীজীর ভাবে কাজ করছেন, স্বামীজীর ভাব নিয়ে বড় হয়েছেন আমাদের জানতে ইচ্ছে হয়, স্বামীজীর জীবনের কোন অংশটি বা ভাবটি এতটা প্রেরণা দিয়েছে?

আমার ছোট থেকেই মনে হয়েছে, স্বামীজী সত্যি সত্যি ‘সুপার হিরো’। অনেকে টিভিতে কার্টুন ফিল্ম দেখে, মুভি দেখে; আমি কিন্তু ছোট থেকে স্বামীজীর বাণী পড়েছি, স্বামীজীর ছোট ছোট বই পড়েছি, মিশনে গিয়েছি। দেখতাম, বাবা স্বামীজীকে নিয়ে গর্ববোধ করতেন; ঠাকুর, মা, স্বামীজীর কাছে প্রার্থনা করতেন। স্বামীজী সত্যি সত্যি আমার কাছে সুপার হিরো, কারণ স্বামীজীর সময়ে ভারতবর্ষ পরাধীন ছিল। একটা অদ্ভুত অরাজকতা চলছিল, মানুষ নিজেদের সংস্কৃতি, অতীতের গৌরব যাকিছু ভাল তা সব ভুলতে বসেছিল। ঠিক সেই সময় স্বামীজী আমাদের গৌরব বিষয়ে সচেতন করলেন। আমাদের আত্মমর্যাদাসম্পন্ন হওয়ার জন্য আহ্বান করলেন। বিদেশে ভারত সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ধারণা, সেগুলো তিনি পালটাতে শুরু করলেন। তাঁর প্রভাবে পাশ্চাত্যবাসী ভারতবর্ষের ব্যাপারে আকৃষ্ট হয়। রক ফেলারের মতো মানুষকেও তিনি সেবামূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি ভারতে ফিরে জ্বালাময়ী বাণী দিয়ে সবাইকে জাগাতে লাগলেন। আপনারা জামশেদজী টাটার কথা জানেন, যিনি স্বামীজীর দ্বারাই উদ্বুদ্ধ হয়ে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স শুরু করেন। স্বামীজী বহু স্বাধীনতা সংগ্রামীকে প্রেরণা দিয়েছেন। তিনি এই সমস্ত করে গেছেন শুধুমাত্র তাঁর আধ্যাত্মিক সম্পদের জোরে। শ্রীরামকৃষ্ণের পদতলে বসে তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেছেন। দেশকে একটা অন্ধকার থেকে তুলে আনার ক্ষেত্রে তাঁর যে-অবদান সেটাই তাঁকে আমার কাছে রোল মডেল করে তুলেছে। আমার তো মনে হয়, যেকোনো মানুষের কাছেই স্বামীজী রোল মডেল হতে পারেন। আর দ্বিতীয়ত, স্বামীজীর যে-বাণী আমার অন্তরে অনবরত বেজে চলেছে, সেটা হচ্ছে—যদি তুমি দেশকে গড়তে চাও তাহলে আগে নিজেকে গড়। যদি তুমি নিজে শক্তিশালী না হও, তাহলে তুমি অন্যকে সাহায্য করতে পারবে না, অন্যের সেবা করতে পারবে না। তৃতীয়ত, স্বামীজী বলছেন—সবসময় তুমি সজাগ থাক। এই জেগে থাকাটার অর্থ হচ্ছে—ভেঙে পড়বে না কোনো সময়। স্বামীজী চাইতেন একশোজন উদ্যমী যুবক। সত্যি কথা বলতে, আমি চেয়েছিলাম এমনভাবে নিজেকে তৈরি করব, যাতে স্বামীজীর ঐ একশোজন যুবকের মধ্যে একজন হতে পারি।

ডেক্সটারিটি গ্লোবাল ওয়েবসাইটে দেখলাম, সেখানেফোর্বসম্যাগাজিন ডেক্সটারিটি গ্লোবাল সম্পর্কে একটা মন্তব্য করেছে—“Equipping young people with the mentality to solve 21st century’s problem.” এই একবিংশ শতাব্দীর সমস্যা কী এবং কীভাবে  যুবকদের এসকল সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য তৈরি করছেন?

আমার মনে হয়, আমাদের সমস্যাগুলি সবই একবিংশ শতাব্দীর। বিগত বেশ কয়েক দশক ধরে আমাদের সমগ্র বিশ্বে অগ্রগতি হচ্ছে, ভারতবর্ষও তার বাইরে নয়। সমস্যার চরিত্র কিন্তু মোটামুটি একইরকম। যেমন শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং ন্যূনতম যে-চাহিদা ও ভাল জীবনযাপন—এই সমস্ত ‌ক্ষেত্রেই অভাব আমাদের জীবনের বিভিন্ন সময়ে অনুভূত হচ্ছে। এগুলিই কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর সমস্যা। আর তার সঙ্গে সঙ্গে অবশ্যই আছে আবহাওয়ার পরিবর্তন, মানসিক স্বাস্থ্য প্রভৃতি। দিনের পর দিন এগুলি আমাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। ছেলেবেলা থেকে সকলেই এসব সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ডেক্সটারিটি গ্লোবাল চায়, ছোটরা বড় হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনের এই সমস্যাগুলি মোকাবিলা করতে শিখুক—স্বাধীনভাবে, কারো ওপর নির্ভরশীল না হয়ে। আমরা ওদের চারটে স্কিল শেখাতে চাই—একটি স্বাধীন চিন্তাভাবনা করার ক্ষমতা, দ্বিতীয় হচ্ছে গবেষণা, তৃতীয় হচ্ছে কমিউনিকেশন—অন্যের সঙ্গে যোগাযোগ করা এবং চতুর্থ হচ্ছে নেতৃত্ব। এই চারটেই আমাদের কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ ‘লাইফ স্কিল’—যেগুলো, আমাদের মনে হয়েছে, শেখা দরকার।

আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি যুব নাগরিকেরই উচিত স্বাধীনভাবে চিন্তা করতে শেখা এবং সেটার সফল প্রয়োগ করা। অনেক সময়েই অন্যদের অনুসরণ করা গতানুগতিক হয়ে যায়। এই চিন্তাপদ্ধতির সঙ্গে দ্বিতীয় যেটা অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত তা হলো গবেষণা। একজন বাচ্চা বা যুবক একজন স্বাধীন চিন্তাশীল ব্যক্তি হয়ে উঠতে পারবে না যতক্ষণ না সে গবেষণা করে। আসলে গবেষণা মানে শুধু ঐ ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি ল্যাবের গবেষণা নয়, এই গবেষণা আমাদের জীবনের প্রতিটি অংশেই থাকতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, কেউ হয়তো একটা মোবাইল কিনবে; সুতরাং মোবাইলের ব্যাটারি লাইফ কীরকম, তার স্টোরেজ ক্যাপাসিটি কীরকম ইত্যাদি একটু ভাল করে খোঁজ নিয়ে, ভাবনা-চিন্তা করে নেওয়া দরকার। এটাও একধরনের গবেষণা। তৃতীয় হচ্ছে কমিউনিকেশন—এটা শেখানো জরুরি। এর কয়েকটা অংশ রয়েছে। প্রথম হচ্ছে, আমরা যেটা বলছি সেটা যেন আমরা নিজেরা বুঝতে পারি। দ্বিতীয় হচ্ছে, যাকে বলছি সে যেন বুঝতে পারে। তৃতীয়, আমার দায়িত্ব হলো—যাকে বলছি সে সেটা বুঝেছে কি না দেখা। এই তিনটি বিষয় কমিউনিকেশনের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। এর সঙ্গে আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে—অন্যের কথা শোনা। অনেকের হয়তো ভিতরে গভীর দুঃখ রয়েছে, বেদনা রয়েছে—তারা কিছু বলতে চায়। আমরা যেন তাদের কথা শোনার জন্য তৈরি থাকি। আমরা আমাদের বাচ্চাদের একটু ট্রেনিং দিতে পারি, যাতে তারা অন্যদের বুঝতে পারে। কখনো হয়তো তারা দেখতে পাবে, রাস্তায় কোনো হোটেলে কোনো বাচ্চা ছেলে কাজ করছে। একটু তার সঙ্গে কথা বলল বা তার কষ্টটাকে বোঝার চেষ্টা করল। এই স্কিলগুলি এবং সফল নেতৃত্ব অর্থাৎ আমি যা শিখেছি সেই চারটে স্কিলকে কাজে লাগাতে হবে। এই চারটের দিকেই আমরা বিশেষ নজর দিই।

এর সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলি বিশেষ গুণ—সহানুভূতি, সাহসিকতা দরকার। অন্যের সঙ্গে যখন আমরা কাজ করব তখন আমাদের সহানুভূতিশীল হতে হবে, সেই সঙ্গে সঙ্গে অন্তরে নির্ভীক হতে হবে। কোনো সিদ্ধান্ত যদি আমরা নিয়ে নিই এবং আমাদের স্থির বিশ্বাস যদি থাকে যে, এটি ঠিক তাহলে সেটা যেন করে যেতে পারি। এসমস্ত গুণ থাকলে আমরা পাবলিক সার্ভিস অর্থাৎ অন্যের জন্য যেকোনো কাজ করতে পারব এবং সেইসঙ্গে দেশগঠনের কাজে লেগে যাব। এর পাশাপাশি চাই বিজ্ঞানমনস্কতা, যার শিকড় থাকবে আধ্যাত্মিকতায়। আমার মনে হয়, এইভাবে যদি আমরা একজন বাচ্চাকে তৈরি করি তাহলে সে পরবর্তিকালে নিঃসন্দেহে দেশগঠনের কাজে সাহায্য করবে।

আমরা আলোচনার একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে উপস্থিত হয়েছি আপনি যখন ডেক্সটারিটি গ্লোবাল শুরু করেছিলেন, তখন আপনার বয়স ছিল ষোলো এর পর প্রায় পনেরো বছর কেটে গেছে আপনার এই ডেক্সটারিটি গ্লোবালে কাজ করতে করতে যুবকদের নিয়ে দুটো ঘটনা যদি বলেন, যা আপনার ওপরে একটা বিশেষ ছাপ ফেলেছে

হ্যাঁ, আমি দুজনের কথা বলতেই পারি। প্রথম যার কথা বলব, সে একজন মহাদলিত ছেলে—যদিও আমরা যখন বাচ্চাদের নিয়ে কাজ করি তখন তাদের কী জাত তা জিজ্ঞাসা করি না। সে মুসাহার গোষ্ঠী থেকে এসেছিল। যদিও এটা উল্লেখ করা ঠিক নয়, তবু বোঝানোর জন্য বলছি। এরা দরিদ্রই শুধু নয়, এরা এশিয়ার দরিদ্রতম জাতি। এবং ‘মুসাহারি’ শব্দবন্ধটা বিহার সরকার তাদেরকে বলে। তারা এতটাই দরিদ্র ছিল পনেরো-কুড়ি বছর আগে। শুধু দলিত নয়, তাদের বলা যায় মহাদলিত। এদের বাচ্চারা যে-বাড়িতে থাকে সেটা বলতে পারেন ১০/১০ ঘর, অনেক সময় ১০/৮ ঘর। পুরো পরিবার এরকম একটা ছোট্ট ঘরের মধ্যে থাকে। কিন্তু এই ঘরেরই একটি বাচ্চা যখন আমেরিকার একটা আন্ডার গ্র্যাজুয়েট প্রতিষ্ঠানে সুযোগ পায়, তখন সেটা সত্যি সত্যি গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। তাঁকে আমেরিকার এমন কলেজে সে যাচ্ছে, যেটা হয়তো ভারতবর্ষের অনেক ধনীঘরের ছেলেদের কাছে একটা স্বপ্ন। বারবার মনে পড়ে স্বামীজীর কথাটা—মানুষের ভিতরে শক্তি রয়েছে, অন্তর্নিহিত দেবত্ব আছে; প্রয়োজন তার যথাযথ বিকাশের। এইসব দৃষ্টান্ত থেকেই তো বোঝা যায়, প্রতিটি মানুষের অন্তর্নিহিত ক্ষমতা আছে। তার আয়, সোস্যাল স্ট্যাটাস—এগুলো কোনো বিষয়ই নয়। উপযুক্ত পরিবেশ পেলে সত্যি সত্যিই সেই দেবত্ব ও ক্ষমতার বিকাশ হয়। এই মহাদলিত ছেলেটির ক্ষেত্রে আমরা তাই দেখেছি।

আরেকটি উদাহরণ দিই। আমি গত ২০২০-তে তিরুপুরে ছিলাম। সেখানকার স্থানীয় একটি স্কুলে ২৬ জানুয়ারি বক্তৃতা দিচ্ছিলাম। পরে সেখানকার একটি ছোট মেয়ে আমাকে চিঠি লেখে যে, সে ডেক্সটারিটির সঙ্গে যুক্ত হতে চায়। তার অভিভাবকেরা কৃষিকাজ করে এবং সে কোনোদিনই তিরুপুরের ছোট্ট জীবন ছেড়ে বের হয়নি, ট্রেনে চড়েনি। অভিভাবকদের অনুমতি নিয়ে সে ডেক্সটারিটিতে আসে এবং আমাদের লিডারশিপ প্রোগ্রাম, কেরিয়ার ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রাম ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যেতে থাকে। প্রচণ্ড পরিশ্রম করত। এই বছরই সে ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোতে যাচ্ছে। সেটি বিশ্বের অত্যন্ত উঁচু দরের একটি ইউনিভার্সিটি। প্রায় ১০০ জন নোবেল লরিয়েট এই ইউনিভার্সিটির সঙ্গে যুক্ত। মেয়েটি ইউনিভার্সিটির চার বছরের আন্ডার গ্র্যাজুয়েট প্রোগ্রাম—ব্যাচেলার ডিগ্রি অব মেডিসিন নিয়ে পড়াশোনা করতে যাচ্ছে। এবং সে পুরোটাই স্কলারশিপে পড়বে। এটা আমার কাছে সত্যিই খুব আনন্দের। আমরা তার বাড়ির লোকেদের একটা ছবি চেয়েছিলাম। কারণ, খবরটা সকলের মধ্যে শেয়ার করতে চাই। খবরটা বেশ ছড়িয়েও পড়ে। সেদিন তিরুপুরের ছোট্ট জায়গায় তাদের ঐ ছোট্ট বাড়িতে এত ভিড় হয়েছিল, মিডিয়ার এত লোকজন এসেছিল যে, মেয়েটির মা অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরবর্তিকালে আমি একটা দারুণ ব্যাপার আবিষ্কার করলাম! সে যখন ঐ ইউনিভার্সিটি অব শিকাগোতে অ্যাপ্লিকেশন পাঠিয়েছিল, সেখানে সে স্বামী বিবেকানন্দ সম্পর্কে লিখেছিল! সত্যিই চমকপ্রদ! 

‘স্বামী নির্বাণানন্দ স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।