বাংলার নারীজাগরণের পশ্চাতে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য—তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিপ্লবী দেশনেত্রী লীলা নাগ। ১৯০০ সালের ২ অক্টোবর তাঁর জন্ম। লীলা নাগের জন্মনাম ছিল লীলাবতী নাগ, কিন্তু তিনি ‘লীলা নাগ’ নামেই অধিক পরিচিত (যদিও বিবাহ-পরবর্তী কালে তিনি ‘লীলা রায়’ নাম ব্যবহার করতেন)। তাঁর পিতা গিরিশচন্দ্র নাগ ও মাতা মঞ্জুলতা নাগ। অসমের দেওঘরের একটি স্কুলে তাঁর আনুষ্ঠানিক পড়াশোনা শুরু হয়। তারপর কলকাতার ব্রাহ্ম গার্লস স্কুলে প্রাথমিক পাঠগ্রহণ সমাপ্ত করে ১৯১১ সালে ঢাকার ইডেন হাইস্কুলে ভর্তি হন। ১৯১৭ সালে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলকাতার বেথুন কলেজে যোগদান করেন। জন্মসূত্রে তাঁর মধ্যে ছিল নেতৃত্বদানের সহজাত গুণ। বেথুন কলেজের হোস্টেলে থাকার সময় তিনি কলেজের ছাত্রী-নেত্রীও হয়েছিলেন। প্রিন্সিপ্যাল শ্রীমতী রাইট তাঁকে ‘Senior Student’-এর পদে স্বীকৃতি দেন। সহপাঠ্যক্রমিক কার্যাবলিতেও তিনি ছিলেন অন্যদের থেকে এগিয়ে। আই.এ. এবং বি.এ. দুটি ডিগ্রি তিনি বেথুন কলেজ থেকে লাভ করেন। এরপর তিনি ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে এম.এ. পড়ার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন করেন। কিন্তু সেখানে তখন মেয়েেদর ভর্তির কোনো সুযোগ ছিল না। তিনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ জে. পি. হার্টগ-এর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁর সক্রিয় প্রচেষ্টায় ও অদম্য প্রাণশক্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার পথ উন্মুক্ত হলো। লীলা নাগ ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী। এই প্রসঙ্গে ডঃ রঙ্গলাল সেনের বক্তব্য স্মরণ করা যেতে পারে। তাঁর মতে—“সেসময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সহশিক্ষার ব্যবস্থা না থাকায় লীলা নাগের দৃঢ়চিত্ততা ও উচ্চশিক্ষার আকাঙ্ক্ষা দেখে ভাইস চ্যান্সেলর বিখ্যাত শিক্ষাবিদ ডঃ পি. জে. হার্টগ তাঁকে পড়ার বিশেষ অনুমতি দেন।… কাজেই নিঃসন্দেহে বলা যায় যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নারীশিক্ষার অগ্রদূত হচ্ছেন শ্রীমতী লীলা নাগ।” ১৯২৩ সালে ইংরেজি সাহিত্যে দ্বিতীয় শ্রেণিতে তিনি এম.এ. পাশ করেন। এম.এ. পাশ করার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গবেষণা করার জন্য ডাক পেলেও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার জন্য তাঁর পক্ষে আর সেই আহ্বানে সাড়া দেওয়া সম্ভব হয়নি। লীলা নাগের একই পাড়ার বাসিন্দা অনিল রায়ের ‘Social Welfare’-এর মাধ্যমেই তিনি বৈপ্লবিক ক্রিয়াকর্মের প্রতি আকৃষ্ট হন। ১৯২৩ সালে লীলা নাগ মাত্র বারোজন সহকর্মী নিয়ে গঠন করেন ‘দীপালি সংঘ’। রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ছাড়াও আরো বহুমুখী বিকাশকে ত্বরান্বিত করাই ছিল এই সংঘের লক্ষ্য। ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের পর সরকারের দমননীতি বহুগুণ বেড়ে যায়। বহুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর অনিল রায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন। তখন বিপ্লবী শ্রীসংঘের দায়িত্ব গ্রহণ করেন লীলা নাগ। বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের পাশে তিনি অনুভব করেন মহিলাদের নিজস্ব মুখপত্রের অভাব। ১৯৩১ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘জয়শ্রী’ পত্রিকা। পত্রিকার নামকরণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। প্রথম সংখ্যার প্রচ্ছদ করেন নন্দলাল বসু। পত্রিকাটি মহিলা সমাজের মুখপত্ররূপে প্রকাশিত হলেও সমাজের সার্বিক প্রতিফলন সেখানে ধরা পড়ত। বিশিষ্ট সাংবাদিক পবিত্রকুমার ঘোষের মূল্যায়নে ‘জয়শ্রী’র গৌরব প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি লিখেছেন : “মতবাদে ও আদর্শে তিনি সেসময়ই বিপ্লবী ছিলেন। তাঁর রাজনৈতিক যোগাযোগ যা ছিল তাও ঐ বিপ্লবী দলের সঙ্গে। কিন্তু জয়শ্রী পত্রিকার সারা অবয়বে কোথাও উগ্রতার স্পর্শ ছিল না, মতবাদের দৌরাত্ম্য ছিল না, এমনকি ইংরেজ সরকারের প্রতি ঘৃণা বা বিদ্বেষ প্রচারের প্রয়াসও ছিল না।” ‘জয়শ্রী’কে আশীর্বাদ জানিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুবার আশীর্বাণী পাঠিয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদী রচনা প্রকাশের অন্যতম স্তম্ভ হয়ে ওঠে ‘জয়শ্রী’ এবং ইংরেজ সরকারের রোষানলে পড়ে। ১৯৩৫ সালে ‘জয়শ্রী’কে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৩৮ সালে জেল থেকে বের হয়ে লীলা নাগ পুনরায় ‘জয়শ্রী’ প্রকাশের কাজে হাত দেন।
১৩ মে ১৯৩৯ বিপ্লবী দার্শনিক অনিল রায়ের সঙ্গে বিপ্লবী দেশনেত্রী লীলা নাগ চিরবন্ধন-সূত্রে আবদ্ধ হন। এ যেন দুই মহাশক্তির সমন্বয়সাধন। এখন থেকে লীলা নাগ পরিচিত হলেন লীলা রায় নামে।
ইংরেজ সরকার ১৯৪০ সালের ২ জুলাই সুভাষচন্দ্র বসুকে গ্রেপ্তার করলে তিনি লীলা রায়কে আহ্বান করেন ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্বভার গ্রহণ করতে। ৬ জুলাই ১৯৪০ লীলা রায় পত্রিকার সম্পাদনার ভার গ্রহণ করেই লিখলেন বিশেষ সম্পাদকীয়—‘The Arrest’ শিরোনামে।
১৯৪১ সালের শেষদিকে ফজলুল হকের সঙ্গে শরৎ চন্দ্র বসুর কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠনের প্রাক্কালে ১৯ ডিসেম্বর ভারত রক্ষা আইনে শরৎ চন্দ্র বসু গ্রেপ্তার হন। ‘জয়শ্রী’র পৌষ ১৩৪৮ সংখ্যায় তাঁর গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ প্রকাশ করা হয়েছিল। হাজরা পার্কের বিশাল জনসভায় বিপ্লবী দেশনেত্রী লীলা রায়ের জ্বালাময়ী ভাষণ নাগরিক চেতনাকে নাড়া দিয়েছিল। ১৩ মার্চ ১৯৪২ ‘স্টেটসম্যান’ সুভাষচন্দ্র বসুকে ‘বিশ্বাসঘাতক’ আখ্যা দিয়ে সম্পাদকীয় লেখে—‘Fascist in India’। ১৯ মার্চ ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় তিনি জবাব লিখলেন—‘We shall not stand it’। স্বাধীনতার স্বপক্ষে তিনি শুরু করেন লেখালেখি। ফলস্বরূপ ‘জয়শ্রী’ ও ‘ফরোয়ার্ড ব্লক’ পত্রিকাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। গ্রেপ্তার করা হয় লীলা রায়কে। তাঁকে এগারো মাস রাখা হয়েছিল নির্জন কক্ষে। ১৯৪৬ সালে কলকাতা ও নোয়াখালিতে দাঙ্গা-বিধ্বস্ত অঞ্চলে সেবাকাজের জন্য তিনি গঠন করেন ন্যাশনাল সার্ভিস ইনস্টিটিউট। কয়েকজন কর্মীকে সঙ্গী করে তিনি পৌঁছে যান নোয়াখালিতে। এরপর দেশভাগের বিরুেদ্ধ শেষ চেষ্টা হিসাবে তিনি দেশের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। সাক্ষাৎ করেন গান্ধিজীর সঙ্গে। গান্ধিজী বলেন : “My lips are sealed.” ব্যর্থ মন নিয়ে তিনি ফিরে এলেন। ঠেকানো গেল না দেশভাগকে। ১৯৫২ সালে অনিল রায় প্রয়াত হন। ভীষণ মানসিক আঘাত পান লীলা রায়। ১৯৫৫ সালে প্রথম হৃদ্রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৫৭ ও ১৯৫৯ সালে আবার হৃদ্রোগে অসুস্থ হন। ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সালে রাজনৈতিক সামাজিক কাজে তিনি নিবিষ্ট ছিলেন। ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে ডান উরুর হাড় ভেঙে তিনি সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী হয়ে পড়েন। ১৯৬৮-র ৪ ফেব্রুয়ারি সকালে সেরিব্রাল আক্রমণে তিনি সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়েন। তাঁকে ভর্তি করা হয় পি. জি. হাসপাতালে। ১১ জুন ১৯৭০ তিনি শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য রেখে যান আদর্শের এক অনির্বাণ দীপশিখা।