গাঁয়ের নাম ‘লক্ষ্মীপুর’। সুফসলি ধানি মাঠের নাম ‘লক্ষ্মীজোল’। ধানের অপর নাম ‘লক্ষ্মী’। কথায় আছে—‘হাতের লক্ষ্মী পেয়ে ঠেলো না’। ছেলে কিংবা মেয়ে—অনেকের নাম লক্ষ্মী। আদর করে মা সন্তানকে ডাকেন—‘লক্ষ্মীসোনা আমার’। পৌষ মাস লক্ষ্মীমাস, বৃহস্পতিবার লক্ষ্মীবার। আবার ভর্ৎসনাবাক্যেও লক্ষ্মীর বিপরীতে ‘অলক্ষ্মী’ বা ‘লক্ষ্মীছাড়া’। বাংলার লোকজীবনের বারোমাস্যায়, লোকসংস্কৃতিতে দেবী লক্ষ্মী একটা বিরাট স্থান জুড়ে রয়েছেন।

‘লক্ষ্মী’ শব্দটির প্রথম প্রয়োগ লক্ষ্য করি ঋগ্বেদের দশম মণ্ডলের ৭১ সূক্তের দ্বিতীয় ঋকে। বলা হয়েছে : “তাঁহাদিগের বচনরচনাতে অতি চমৎকার লক্ষ্মী সংস্থাপিত আছে।” (ঋগ্বেদ-সংহিতা, শ্রীরমেশচন্দ্র দত্তের অনুবাদ, ২য় সং, সূক্ত ৭১, ২য় ঋক, “যেমন চালনীর দ্বারা শক্তুকে পরিষ্কার করে…সংস্থাপিত আছে”, পৃঃ ১২৩১)। এখানে লক্ষ্মী শব্দের অর্থ সৌন্দর্য, সৌভাগ্য, সমৃদ্ধি—যা পরবর্তিকালে দেবী লক্ষ্মীর মধ্যে সংক্রামিত হয়েছে। পরবর্তী বৈদিক সাহিত্য আরেক দেবীর কথা পাই—‘শ্রী’। তবে তিনি লক্ষ্মীই। শ্রীসূক্তে বলা হয়েছে—

“হিরণ্যবর্ণাং হরিণীং সুবর্ণরজতস্রজাম।
চন্দ্রাং হিরন্ময়ীং লক্ষ্মীং জাতবেদো মমাবহ।।”

অপরূপা সুন্দরী লক্ষ্মী বা শ্রীদেবী। শান্ত-স্নিগ্ধ সৌন্দর্য বোঝাতে বলে—লক্ষ্মীশ্রী। সোনার মতো গায়ের রং। স্বর্ণ ও রজত অলংকারে শোভিতা। আবার তিনি সোনার হরিণও বটেন। মৃগলাঞ্ছিত লক্ষ্মীমূর্তি মেলেনি সত্য, কিন্তু একধরনের প্রাচীন মুদ্রায় হরিণের ছাপ আছে। রামায়ণের অন্যতম ‘ক্লাইম্যাক্স’—সীতার সোনার হরিণ ধরে আনার আবেদন। হিন্দু বিশ্বাসে সীতা লক্ষ্মীর অবতার। সীতার সোনার হরিণ চাওয়ার মধ্যে কি লুকিয়ে আছে তাঁর পূর্বজ প্রতিকৃতি দর্শনের সুতীব্র ব্যাকুলতা?

বৈদিক স্তরের পর মহাকাব্য, পুরাণাদিতে লক্ষ্মী অপ্সরা, জলদেবী। সুরাসুরের সম্মিলিত সাধনে সমুদ্রমন্থন কর্মে লক্ষ্মী উঠে এসেছেন, ক্রমে বিষ্ণু বা নারায়ণের পত্নীর মর্যাদা লাভ করেছেন। পাল-সেন পর্বের পাথুরে ভোগ-বিষ্ণু মূর্তিতে সমপাদস্থানিক ভঙ্গিমায় দণ্ডায়মান ধ্যাননিমগ্ন বিষ্ণুর বামদিকে পদ্মহস্তা শ্রী বা লক্ষ্মীর অবস্থান, ডাইনে পুষ্টি বা বীণাধারী সরস্বতী। বাংলার বিভিন্ন স্থানে এই ধরনের মূর্তি পাওয়া গেছে পর্যাপ্ত পরিমাণে। এছাড়া বিষ্ণুর শয়ন-ভাস্কর্যে সলজ্জ লক্ষ্মীকে বিষ্ণুর পদসেবা করতে দেখা যায়। আদি ও মধ্য যুগে একাধিক লক্ষ্মী-নারায়ণ মূর্তির ভাস্কর্য আবিষ্কৃত হয়েছে।

লক্ষ্মী শুধু হিন্দু বা ব্রাহ্মণ্য ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত নন, বৌদ্ধ ও জৈনমণ্ডলেও তিনি স্থান পেয়েছেন। খ্রিস্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের ভারহুত ভাস্কর্যে ব্রাহ্মীলেখযুক্ত পদ্মাসনা পদ্মহস্তা দ্বিভুজা লক্ষ্মীকে দণ্ডায়মান দেখা যায়। সাঁচিস্তূপে, বুদ্ধগয়া, অমরাবতী প্রভৃতি স্থানে লক্ষ্মীদেবীর ভাস্কর্য রয়েছে। জৈনসংস্কৃতিতে লক্ষ্মী ব্যন্তর বা নাগ, কিন্নর, গন্ধর্ব প্রভৃতির মতো দেবযোনিবিশিষ্ট উপদেবী। পণ্ডিতদের মতে, ব্যন্তরদেবতাগণ লৌকিক দেবদেবী থেকেই উদ্ভূত হয়েছেন। গবেষক কল্যাণকুমার দাশগুপ্ত দাবি করেছেন, লক্ষ্মী মূলত লৌকিক স্তর থেকে উদ্ভূত দেবী, যা পরবর্তিকালে সংস্কৃতায়নের ফলে উচ্চবর্ণের দেবমণ্ডলে স্থানলাভ করেন। (দ্রঃ দাশগুপ্ত, কল্যাণকুমার, প্রতিমাশিল্পে হিন্দু দেবদেবী, পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি, কলকাতা, ২০০০, পৃ: ১২১)

বাংলায় শিব-দুর্গার আদুরে নম্র স্বভাবের কন্যা লক্ষ্মী। তিনি রূপে লক্ষ্মীই; ক্ষীণকটি, চারুমুখী, সুলোচনা, সুস্তনী এবং সোনার বরন গা। দেবীর এক হাতে অমৃতকলস, অন্য হাতে পদ্ম। যদিও প্রাচীন ভাস্কর্যে দ্বিভুজার পাশাপাশি চতুর্হস্তা লক্ষ্মী দেখা যায়। দেবীর চার হাতে রয়েছে পদ্ম, শ্রীফল, অমৃতকলস ও শঙ্খ। বাংলায় আরেক রূপে তিনি জনপ্রিয়—গজলক্ষ্মী। পদ্মাসনা দেবীর মাথায় কুম্ভোদক ঢালছে হাতি। এই মূর্তি প্রস্তর-ভাস্কর্যে, প্রাচীন মুদ্রায় এবং প্রত্নক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত মাটির সিলে প্রচুর সংখ্যক পাওয়া গেছে। তান্ত্রিক পরিমণ্ডলেও লক্ষ্মী স্থান পেয়েছেন দশমহাবিদ্যার অন্যতম বিদ্যা কমলা-রূপে। এবিষয়ে গবেষক জীতেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন : “খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতকের ভারহুতের স্তূপবেষ্টনীতে শ্রীদেবী বা গজলক্ষ্মীর মূর্তি খোদিত দেখা যায়। ইহার সহিত (দশমহাবিদ্যার—) কমলার পূর্ণ সাদৃশ্য বর্তমান।” (বন্দ্যোপাধ্যায়, জিতেন্দ্রনাথ, পঞ্চোপাসনা, ফার্মা কে. এল. এম. প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৯৪, পৃ: ২৭৮)

বৈদিক, পৌরাণিক এবং লৌকিক—এই তিন পর্ব জুড়ে বাংলার সাংস্কৃতিক মানচিত্রে লক্ষ্মীতন্ত্র (Laxmi-Cult) ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষেত্রসমীক্ষা সূত্রে দেখা যায়, গ্রামবাংলায় সবচেয়ে প্রাধান্য পেয়েছে বৈচিত্রময় লৌকিক লক্ষ্মী-উপাসনা—মূলত ব্রীহি বা ধানকে আশ্রয় করে।

দুই

বাংলায় ঠিক কখন থেকে ধানচাষ শুরু হয়েছিল—এ-সম্পর্কে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে হরপ্পা সভ্যতার সমকালীন বর্ধমানের পাণ্ডুরাজার ঢিপির আদি স্তর থেকে ধানের প্রত্ন-নজির মিলেছে। রাঢ় বাংলায় ধান মানেই শস্যলক্ষ্মী। ধানের সঙ্গে লক্ষ্মীর যোগের প্রাচীন প্রমাণ পাওয়া যায় চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত টেরাকোটার প্রত্ন-প্রতিমায়। ঐতিহাসিক ব্রতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় লিখেছেন—একটি গোলাকার ফলকে হেলেনীয় পোশাক পরা নারী ধানের শিষ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। ফলকে খোদিত ব্রাহ্মীলেখে দেবীকে ধানজয়ীরূপে বর্ণনা করা হয়েছে। ড. মুখোপাধ্যায়ের মতে, ইনি ‘ধানের দেবী’ কিন্তু ব্রাহ্মণ্য ধর্মের লক্ষ্মী নন। (দ্রঃ মুখোপাধ্যায়, ব্রতীন্দ্রনাথ, লোকশিল্প বনাম উচ্চ মার্গীয় শিল্প প্রাক-গুপ্ত বঙ্গের প্রেক্ষাপটে, লোকসংস্কৃতি ও আদিবাসী সংস্কৃতি কেন্দ্র, কলকাতা, ১৯৯৯, পৃ: ৪১)

সপ্তদশ শতকের শেষার্ধের কবি কৃষ্ণরামদাস তাঁর কমলামঙ্গলকাব্য-এ ধানের দেবী কমলা অর্থাৎ লক্ষ্মীর অলংকার হিসাবে লিখেছেন সেকালে প্রচলিত নানা জাতির ধানের নাম—যেমন ছায়ারত্ন, বাগিনী, রক্তশালী কিয়াপাতি ইত্যাদি। মনসামঙ্গলকাব্য-এ দেবী মনসার যেমন নাগ-অলংকারের কথা কবিরা লিখেছেন, কমলামঙ্গলকাব্য-এ রয়েছে দেবীর ধান-আভরণের বর্ণনা—

“ছায়ারত্ন শঙ্খচূড় বাগিনী কর্পূর
রক্তশালী ধান্য কেসুর কেলি।
হরিসখুরি কিয়াপাতি আগুনবান নানাজাতি
দুগ্ধভোগ এপানিকলস।
কে জানে লক্ষ্মীর চূড়া মাএর গায়ে নানা গুড়া
একে একে কত লব নাম।”
(ভট্টাচার্য, সত্যনারায়ণ (সম্পাদিত), কবি কৃষ্ণরাম দাসের গ্রন্থাবলী, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৫৮, পৃ: ৩০৫)

শুধু ধান নয়, ধান্যাগারের সঙ্গে নিবিড় যোগ রয়েছে কৃষিলক্ষ্মীর। ধান্যাগার আঞ্চলিক স্তরে নানা নামে পরিচিত; যেমন গোলা, মরাই, ধানগলি, হামার, কড়ুই, বাকারি ইত্যাদি। গুজরাটি আদিবাসীদের গোলাকার ভুঙ্গাঘরের মতো গোলার গঠন। রাঢ় অঞ্চলে খড় দিয়ে তৈরি ‘বড়ের মরাই’ ঠিক যেন লাট্টুর মতো দেখতে! একসময় বাঙালির স্বপ্ন ছিল গোলাভরা ধানের। এখন সেসব গপ্পকথা। কিন্তু গ্রামাঞ্চলে আজও গোলা আছে। সেখানে ‘গোলার দেবী’ প্রাচীন শস্যলক্ষ্মীকে নিয়ে গড়ে উঠেছে এক বিচিত্র লোকসংস্কৃতি।

ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, (দ্রঃ রায়, নীহাররঞ্জন, বাঙ্গালীর ইতিহাস, আদিপর্ব, দেজ, ১৪১০, পৃ: ৭৩৮) মরাই এবং প্রাচীন শস্যদেবীর চিত্র খোদিত হয়েছে চন্দ্রকেতুগড় থেকে প্রাপ্ত আনুমানিক খ্রিস্টীয় প্রথম শতকের একটি ভগ্ন টেরাকোটা ফলকে। ফলকটি পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য প্রত্নবিভাগ সংগ্রহশালায় সংরক্ষিত রয়েছে। ফলকটির ডানদিকে দেখা যায়—একটি বয়স্ক মানুষ দুহাত মাথার পিছনদিকে হেলান দিয়ে পা উঁচিয়ে আরাম করে বসে আছে। মুখে স্মিত হাসি। দীর্ঘ চক্ষুদ্বয়। নীহাররঞ্জন রায়ের মতে, এটি যক্ষমূর্তি। এই মূর্তির বাঁদিকে একটি ছোট ছেলের মাথায় পূজার নৈবেদ্যের থালা। তার বামপাশে মরাইয়ের ওপর দেবীর দুটি পা স্থাপিত হয়েছে। বাকি অংশ ভেঙে গেছে। ইনি হলেন শস্যলক্ষ্মী। রাঢ় অঞ্চলে বলা হয় ‘মরাই-লক্ষ্মী’। মরাই লক্ষ্মী মূর্ত হয়ে ওঠে গোলাঘরের দেওয়ালের আলপনায়।

গোলার সামনের দিকে মাঝামাঝি স্থানে দুই ফুট বাই দুই ফুট বর্গাকার মাটি লেপা জায়গায় একটি অসাধারণ বাস্তুতন্ত্রের ছবি আঁকে গ্রামের মেয়েরা। পিটুলিগোলার আলপনার রেখাচিত্রে মূর্ত হয়ে ওঠে আদ্যিকালের ঠাকুর-ঠাকরুন। চারপাশে ধানের শিষ, পেঁচা আর লক্ষ্মীর প্যাঁজ অর্থাৎ পায়ের ছাপ। অঙ্কিত হয় চন্দ্র, সূর্য, গাছপালা, পাখি, স্বস্তিকচিহ্ন। সিঁদুরের ফোঁটায় উজ্জ্বল হয়ে ওঠে প্রতিটি চিত্র। এই ঠাকুর-ঠাকরুনকে বলে লক্ষ্মী-নারায়ণ। এই নিয়ে সুন্দর একটা কবিয়ালি ধাঁধা সংগ্রহ করেছিলাম—

“বামা নয়, শ্যামা নয়, নয় সিদ্ধেশ্বরী।
স্বামীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকে বলো কোন নারী?”

বামা বা শ্যামাকালী না হয় শিবের বুকে পা দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন, কিন্তু ইনি কে? উত্তরটা প্রতিপক্ষ কবিয়াল পাল্লাদারকে রসিয়ে বলেন—ইনি হলেন লক্ষ্মী ঠাকরুন। ধানই তো লক্ষ্মী। সে আবার জলের মধ্যে জন্মায়। আর এই জল স্বয়ং নারায়ণ। দেওয়াল-আলপনার পাশাপাশি পৌষপার্বণের সময় মরাই-বাড়ির উঠানে চারদিক থেকে গৃহস্থ বধূরা এমন বিচিত্র আলপনা আঁকেন, যাতে মনে করা হয়—মরাই-লক্ষ্মী সেই আলপনার পথে পা দিয়ে এসেই মরাই-বেদিতে উঠবেন।

জমিদারি আমলে পাকা মরাই দেখার মতো স্থাপত্যকীর্তি ছিল। এখনো একটি লক্ষ্মীর মূর্তি-খোদিত পাকা মরাইঘর টিকে রয়েছে বীরভূম জেলার ইলামবাজারের শীর্ষা গ্রামে। পৌষসংক্রান্তিতে অনেক গ্রামে মরাইয়ের পাশে উঠানলক্ষ্মীর পুজো হয়। বৃহস্পতি আর মঙ্গলবারে গোলা থেকে ধান বের করা নিষিদ্ধ। জুতো পরে বা আকাচা অবস্থায় গোলা ছোঁয়া এক্কেবারে বারণ। সকাল, দুপুর, সন্ধে—এই তিনবার মরাই-লক্ষ্মীকে সন্ধ্যাদীপ দেখানোর নিয়ম। মরাই-লক্ষ্মী আসলে পৌষলক্ষ্মী, আমনধান ওঠাকে কেন্দ্র করে যাঁকে পুজো করা হয়; আর আউসধানের কৃষিলক্ষ্মী হলেন ভাদুলক্ষ্মী। তবে ভাদুলক্ষ্মীর কোনো শাস্ত্রীয় পুজো নেই। পালাগানে, নাচে ভাদু সন্তুষ্ট হন।

তিন

সম্পদের দেবী হিসাবে শাস্ত্রীয় লক্ষ্মীর পুজো হয় বছরে দুবার—দুর্গাপুজোর সময় এবং কোজাগরী পূর্ণিমায়। বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ জেলার সীমান্ত জনপদ রামপুরহাট মহকুমার ঘোষগ্রাম। গ্রামের অধীশ্বরী লক্ষ্মীর দারুপ্রতিমা। দেবীর নিত্যসেবা হয়। প্রায় তিন শতাধিক বছরের পুরানো এই পুজোকে কেন্দ্র করে অর্ধশতাধিক গ্রামের গ্রামবাসীরা উৎসবে সামিল হন। পুজোর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন কামদেব ব্রহ্মচারী নামে এক লক্ষ্মীসাধক। বাৎসরিক পুজো কোজাগরী পূর্ণিমাতে হলেও মেলা বসে পৌষ মাসের বৃহস্পতিবারে। মেলার অন্যতম আকর্ষণ সামুদ্রিক কড়ির বিকিকিনি। দেবীর আদি মন্দির তৈরি করে দিয়েছিলেন কান্দির কৃষ্ণকান্ত সিংহ ওরফে লালাবাবু। পরে এই মন্দির নতুন করে তৈরি হয়েছে। লক্ষ্মীপুজোই প্রধান উৎসব বীরভূমের রানিবাজার, বর্ধমানের কাটুনডাঙা, দক্ষিণডিহি বাজার-বনকাপাশি ইত্যাদি গ্রামে।

মেয়েদের ব্রত বা গৃহলক্ষ্মী হিসাবে প্রতি বৃহস্পতিবার দেবীর বিশেষ পুজো বাঙালির ঘরে ঘরে। মেয়েরাই তাঁর পুজো করেন। পুজোর অন্যতম অঙ্গ লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ। কোজাগরী পূর্ণিমায় এবং নির্দিষ্ট সময়ে লক্ষ্মীর বিচিত্র উপাসনা ঘটে-পটে আরো নানা আঙ্গিকে হয়ে থাকে। একে দুটি ভাগে ভাগ করা যায়—যথা রাঢ়ীয় ধারার পুজো এবং পূর্ববঙ্গীয় ধারার পুজো।

ক্ষেত্রসমী‌ক্ষা অনুযায়ী রাঢ়ীয় ধারায় আনুষ্ঠানিকভাবে কোজাগরী পূর্ণিমা ছাড়াও বছরে তিনবার লক্ষ্মীপুজো হয়—যথা চৈত্রসংক্রান্তি, পৌষসংক্রান্তিতে এবং ভাদ্রমাসে শুক্লপক্ষের পঞ্চমী তিথিতে। এই তিনবার লক্ষ্মীপুজোর সময় ঠাকুরঘর বা ভাণ্ডারঘর সুমার্জিত করে আলপনায় অলংকৃত করা হয়। লক্ষ্মীর হাঁড়া (মাটির বড় মাপের কলসি বা হাঁড়ি) থেকে বের করে একুশ কাঠা ধান বর্গাকারে বিছানো হয় নির্দিষ্ট বেদিতে। দেবীর প্রতীক হিসাবে একটি বেতের তৈরি কাঠা বা রেক সামনের দিকে মুখ করে বিছানো ধানের মাঝে গুঁজে দেওয়া হয়। মাথায় দেওয়া হয় একটি লাল চেলি। চারপাশ সজ্জিত করা হয় কড়ি, সামুদ্রিক ঝিনুক সিঁদুরের কৌটা ইত্যাদি দিয়ে। ফাঁকে ফাঁকে গুঁজে দেওয়া হয় কাঠের তৈরি একাধিক পেঁচা। সঙ্গে থাকে লক্ষ্মীর ঝাঁপি।

লক্ষ্মীপুজোর অন্যতম উপচার ফল-মিষ্টির নৈবেদ্য ছাড়া অন্নভোগ। চৈত্র মাসের লক্ষ্মীপুজোর ভোগে থাকে কুমড়োশাক, এঁচোড়ের ব্যঞ্জনাদি এবং পায়সান্ন। ভাদ্রলক্ষ্মীর পুজোয় চাই কচুশাক, সবজির পদ এবং অবশ্যই পাকা তালের ফুলুরি, চাপড়া বড়া, তাললুচি ইত্যাদি। পৌষলক্ষ্মীর পুজোয় পুরানো ধান বদলে নতুন ধানে লক্ষ্মীপুজো হয়। সেসময় দেবীর ভোগে চাই পালংশাক, নানা ধরনের পিঠা ইত্যাদি। এই দিনগুলিতে মূলত পূজারি ডেকে পুজো করার নিয়ম। পরের দিন হয় বাসি লক্ষ্মীর পুজো—সেক্ষেত্রে পান্তার ভোগ দেওয়া রীতি।

কার্তিক মাসের সংক্রান্তিতে জমির ঈশানকোণ থেকে আড়াই প্যাঁচে একগুচ্ছ ধান কেটে নিয়ে আসেন গৃহস্থরা। ধানের গুচ্ছকে লক্ষ্মীর আসনের পাশে রেখে মুঠলক্ষ্মী হিসাবে নবান্ন উৎসবের দিন পর্যন্ত গৃহস্থরা পুজো করেন। পরে মুঠলক্ষ্মীর ধান ঝরিয়ে গোলার মধ্যে রাখা বিধিবদ্ধ প্রথা। খড়গুলিকে পৌষসংক্রান্তিতে দড়ির মতো পাকিয়ে আঁউরি চাঁউরির বন্ধন দেওয়া হয় বিভিন্ন দ্রব্যে। তার মধ্যে অবশ্যই লক্ষ্মীর হাঁড়ার সঙ্গে একটি বন্ধন থাকে। বীরভূম-বাঁকুড়া অঞ্চলে মুঠ আনার পাশাপাশি একগুচ্ছ ধানের শিষকে সুন্দর করে বুনে নেওয়া হয় বরফির আকারে। একে বলে ‘ধানের গাই’। এটিও লক্ষ্মীর আসনে বারো মাস পূজিত হয়। আদিবাসীরা বাড়িতে ধানের গাই ঝুলিয়ে রাখে বারো মাস।

পূর্ববঙ্গের মানুষজন সরায় লক্ষ্মীপুজো করেন। গবেষক ময়ূখ ভৌমিকের মতে, প্রায় তেরো রকমের লক্ষ্মীসরা পূজিত হয়—যেমন এক-পুতুলের সরা (শুধুমাত্র লক্ষ্মী), দুই-পুতুলের সরায় থাকেন লক্ষ্মী-নারায়ণ, তিন-পুতুলের সরায় থাকেন লক্ষ্মী ও জয়া-বিজয়া, চার-পুতুলের সরায় রাধাকৃষ্ণের সঙ্গে দুই সখী-সহ লক্ষ্মী, সাত-পুতুলের সরায় থাকেন সপরিবারে দেবী দুর্গা, মহাদেব ইত্যাদি। এছাড়া পারিবারিক কুলাচার মেনে যেসব সরায় লক্ষ্মীপুজো হয়, তা হলো—রামসীতা লক্ষ্মণসরা, হাতি লক্ষ্মীসরা, জোড়া লক্ষ্মীসরা ইত্যাদি।

কলাবউ লক্ষ্মীপুজোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য। তবে নামে কলাবউ হলেও আদতে এটি পঞ্চ বা সপ্ত পত্রিকার পুজো। কলা, ধান, মান, হলুদ, তুলসী, আদা, কচু ইত্যাদি পাঁচ বা সাত রকমের গাছ একত্রে বেঁধে, একখণ্ড আখ দিয়ে দেবীর হাত, জোড়া সুপারি দিয়ে স্তন, জোড়া পান দিয়ে পা ইত্যাদি কল্পনা করা হয়। শেষে কাপড় পরিয়ে ঘোমটা দিয়ে বউ সাজিয়ে পূজা করা হয়। কলাবউ পুজোতে নৌকার ছলন দেওয়া সাধারণ নিয়ম। সপ্ত বা পঞ্চ পত্রিকা ছাড়াও তিন পত্রিকার পুজো হয় লক্ষ্মী হিসাবে। এটিও কলাবউয়ের মতোই, তবে এখানে ধান, মান, হলুদ গাছ একসাথে বেঁধে পুজো হয়। গাছগুলি জোগাড় করা হয় বিশেষ তিথিতে।

ধানের ডোল বা ব্যার লক্ষ্মীপুজো পূর্ববঙ্গীয় ঘরানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কলার বাকল গোল করে পাকিয়ে, নারকেল বা বাঁশের কাঠি দিয়ে আটকানো হয়। এগুলোকে ‘ব্যার’ বা ‘ডোল’ বলে। এরকম পাঁচটা বা সাতটা ডোল আলপনা দেওয়া পিঁড়ি জলচৌকির ওপর বসিয়ে ভিতরে ঢেলে দেওয়া হয় পঞ্চ শস্য, কড়ি, হলুদ, সোনা, রুপা ইত্যাদি। পরিবার-ভেদে ভিন্ন ভিন্ন উপকরণ দেওয়া হলেও ধান সব ক্ষেত্রেই দেওয়া হয়। তার ওপর অনেক পরিবারে আস্ত নারকেল দিয়ে কাপড়ের ঘোমটা পরিয়ে পুজো করা হয়। কেউবা ব্যারগুলোর ওপর সরা বসিয়ে পুজো করে। অনেক পরিবারে ধান মাপার পাত্র (কুনকে, কাঠা, আড়ি) ধানপূর্ণ করে কড়ি, হলুদ, টাকা, ধানের শিষ ইত্যাদি সহ পিঁড়িতে বসিয়ে কাপড়ের ঘোমটা দিয়ে লক্ষ্মী হিসাবে পুজো করা হয়।

নদিয়ার গবেষক লোকেশচন্দ্র বিশ্বাস জানিয়েছেন, নদিয়ার অনেক গ্রামে আড়িলক্ষ্মীর পুজো হয়। আড়িলক্ষ্মী হলো মুখোশলক্ষ্মীর পুজো। শোলার তৈরি একটি বিশেষ দেবী পুজোর দিন বেতের কাঠায় চুড়ো করে ধান দিয়ে গেঁথে দেওয়া হয়। পুজোর পর সেই লক্ষ্মীর মুখোশ গোলায় রাখা হয় নিত্যপুজোর জন্য। বর্ধমান অঞ্চলের অনেক স্থানে মুখোশলক্ষ্মীকে ধানের জমির ঈশানকোণে পুঁতে রাখা নিয়ম।

চার

দেবী লক্ষ্মীকে কেন্দ্র করে ঐতিহ্যবাহী লোকশিল্পের সম্ভার আবহমান কাল থেকে বাংলায় বিকশিত হয়েছে— যেমন মৃৎশিল্প, দারুশিল্প, মালাশিল্প, আলপনা, পটশিল্প, মিষ্টান্নশিল্প ইত্যাদি। মৃৎশিল্পের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো লক্ষ্মীপুতুল। পোড়ামাটির লক্ষ্মীপুতুল একসময় কাটোয়া থানার সুদপুর গ্রামের কুম্ভকার পরিবারের মেয়েরা তৈরি করতেন। আষাঢ় মাসের অম্বুবাচির মেলায় এই পুতুল বিক্রি হতো। বর্তমানে বিলুপ্তপ্রায়। লক্ষ্মীসরা এখন নদিয়া জেলার বিভিন্ন স্থানে কুম্ভকার পরিবার তৈরি করেন। লক্ষ্মীর ভাঁড় বা বোবা ভাঁড় রথ ও চড়কের মেলায় এখনো নজরে পড়ে।

সরাপটে বিবিধ লোকচিত্রের মধ্যে লক্ষ্মীঠাকুরের আঁকা পট বাংলার লোকশিল্পে একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। সরা হলো গোলাকার মাটির ঢাকনা—সাধারণত কলসি বা হাঁড়ির ওপর এটি ঢাকনি হিসাবে ব্যবহৃত হয়। অপরদিকে পট্ট থেকে এসেছে পট। সরার হাঁড়ির উপরিতলকে পট হিসাবে ব্যবহার করে এখানে পটচিত্র অঙ্কিত হয়। হাঁড়ির ঢাকনার মতো দেখতে একটি বিশেষ পদ্ধতিতে বানানো পোড়ামাটির সরা ‘পট’ নামে খ্যাত। লক্ষ্মীপটে লক্ষ্মীর মূর্তি আঁকা থাকে। আমরা এই সরা বা পটের চারটি ভাগের কথা মোটামুটি জানতে পারি—ঢাকাই সরা, ফরিদপুরি, সুরেশ্বরী ও গণকা। এই মূল চার ধারার পট বানানো ও দেবীমূর্তির বিভাজনের নিরিখে তৈরি হয়েছে। নদিয়ার তাহেরপুর অঞ্চলে প্রায় পঞ্চাশটি পরিবারের পুরুষ ও নারী শিল্পীরা এই লক্ষ্মীপট আঁকেন।

শুধু পদ্ম নয়, লক্ষ্মীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে কদমফুলের নামও। তবে সেই কদম শোলার তৈরি। এমনিতে কদমফুল বললেই রাধা-কৃষ্ণ আর বর্ষার কথা মনে পড়ে। বৈষ্ণবপদাবলিতে আছে—“নির্জন যমুনার কূলে, বসিয়া কদম্ব ডালে/ বাজায় বাঁশি বন্ধু শ্যামরায়।” লক্ষ্মীপুজোয় এই শোলার তৈরি কদমফুল দিয়ে ওপার বাংলার মানুষজনেরা সাজায়। এক কদম বা তিন কদমের চাহিদা এই সময় দারুণ। শুধু কদমফুল নয়, এই কদম দিয়ে তৈরি চতুর্দোলা দেবীর মাথায় ঝোলানো হয়। খুব সুন্দর দেখতে এই শোলার চতুর্দোলাগুলি। দেবীর হাতে থাকে চাঁদমালা আর মাথায় থাকে রঙবাহারি চতুর্দোলা। পূর্ববাংলার মানুষেরা শুধু কদম বা পট দিয়ে লক্ষ্মীপুজো করেন না, অনেক বাড়িতে শোলার তৈরি মুখোশে পুজো হয়। এগুলিকে ‘প্রতিমা’ বলে।

লক্ষ্মীপুজোর আলপনায় বৈচিত্র রয়েছে। পিটুলি-গোলা দিয়ে আলপনা আঁকেন মেয়েরা—লক্ষ্মীর পদচিহ্ন, নানা ধরনের লতা-পাতা, ধারা এবং আবর্ত। কোথাও কোথাও ধানের শিষ, মই, ময়ূরপঙ্খি নৌকা, পেঁচা অঙ্কন করা হয়। পূর্ব বর্ধমানের দারুশিল্পীরা নানা ধরনের পেঁচা তৈরি করেন। রাঢ়ীয় গিন্নিরা পেঁচাকেই লক্ষ্মী-জ্ঞানে পুজো করেন। কাটোয়া অঞ্চলের বৈষ্ণব মেলাগুলির অন্যতম আকর্ষণ নতুন গ্রামের কাঠ-পেঁচার পশরা।

সবশেষে মিষ্টান্নশিল্প নিয়ে দু-এক কথা বলতেই হয়। লক্ষ্মীপুজো উপলক্ষে হলুদ মিশ্রিত চালভাজা মুড়ি, গুড়ের মুড়কি, নানা ধরনের নাড়ু—যেমন নারকেল নাড়ু, তিলের নাড়ু, মুড়ির নাড়ু, চিঁড়ের নাড়ু তৈরি করেন রাঢ় অঞ্চলের গিন্নি বউ-ঝিরা। দেবীর ভোগে এই নাড়ুগুলি দেওয়া হয়।