স্বাধীনতা বলতে সেই স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্ত স্থিতিকে বোঝায়, যেখানে উন্নীত হলে ব্যক্তি ও জাতি স্বকীয় ভাবালোকে নিজে বলিষ্ঠ ও তৃপ্ত হয় এবং অপরের সামনে আদর্শের আলোকমালা জ্বেলে দিয়ে যায়। স্বাধীনতার মূল ভিত্তি স্বার্থশূন্যতা। সাধারণভাবে ব্যক্তি-স্বাধীনতায় মানুষ দাসসুলভ মানসিকতা ও পরানুকরণের আবরণ থেকে বিমুক্ত হয়ে এবং আপনার পথে আপনি নিয়ন্ত্রিত থেকে জীবনের উদ্দেশ্যটিকে সফল করতে প্রয়াসী হয়। এই একই বোধ যখন সমষ্টি-মনকে আবেশিত করে তখন বলা হয়, জাতির স্বাধীন সত্তা জাগরিত হয়েছে। সাধারণভাবে স্বাধীনতার অর্থ এইরকম হলেও, বৈদেশিক আক্রমণে পরাভূত হওয়ার অনেক হাজার বছর আগে থেকে ভারতবর্ষে ব্যক্তি ও জাতি-স্বাধীনতার চেতনা আরো ব্যাপ্ত ও গভীর আকারে বিশেষ একটি রূপ ধারণ করেছিল। অনন্ত শান্তি ও সৌন্দর্যকে বাইরের পৃথিবীতে খুঁজে ব্যর্থ হয়ে কিছু মানুষ উপলব্ধি করেছিলেন, নিজেদের শরীর ও মনের সীমারেখাই সেই আপ্তির পথে অন্তরায়। তখন সংযত অনুশীলনে শরীর ও মনের পরাধীনতাকে জয় করে অন্তরস্থ আনন্দের সন্ধান তাঁরা একদিন পেলেন; জন্ম-মৃত্যুর কালপাশ কেটে তাঁরা স্বাধীন হলেন। সেই আত্মানন্দের অপূর্ব প্রেরণায় সেই বীরেরা উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তাঁদের সমাজকেও। এইভাবে নিয়মিত হয়েছিল ভারতীয় সংস্কৃতির শিশুলগ্ন। স্মৃতিকারেরাও তাই আত্মমোক্ষের উদ্দেশ্যে বর্ণাশ্রম প্রথায় কর্মের বিভাজন করে আপন পথে চলে মানুষকে আপনার স্বাধীনতা খুঁজে নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছিলেন।
ফলত ভারতীয়েরা একদিকে উদার ব্যক্তিত্বের প্রাচুর্য অর্জন করেছিল; আবার অন্যদিকে শাস্ত্র, বিজ্ঞান, শিল্প, সাহিত্য, অর্থনীতি ইত্যাদি বৈষয়িক ক্ষেত্রে স্বকীয় প্রতিভার এতখানি অভিব্যক্তি ঘটিয়েছিল যে, বিদেশির দল মত্ত ভ্রমরের মতো খুঁজে বেড়াত, সসাগরা এই ধরণিতে কোথায় সেই ভারত-মধুর উৎসমুখ। তবে অতীতের পাতায় অখণ্ড ভারতবর্ষ অর্থে একটিমাত্র রাজনৈতিক সীমায় আবদ্ধ ভূমিভাগকে কখনো বোঝায়নি। বরঞ্চ একটিমাত্র আধ্যাত্মিক ও সাংস্কৃতিক ভাবনায় স্পন্দিত ভূখণ্ডের বিস্তৃতি বহির্বিশ্বের নয়নে ও দেশবাসীর মননে ভারত নামে ভাস্বর হয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একনায়ক-হীনতাই একদিন ভারতের ইতিহাসকে অন্ধকার করে তুলল। দীর্ঘকালীন অনুবর্তনে আদর্শের উচ্চতাকে আমরা যেন ততদিনে ভিতরে ভিতরে খাটো করেও ফেলেছিলাম। ফলে বৈদেশিক মক্ষীদের আগমন এবং প্রথমে আহরণ, পরে শোষণ ও দংশন আমাদের সাংস্কৃতিক ভিত্তিকে ক্রমাগত দুর্বল করে চলল। আমরা যত দুর্বল হতে থাকলাম ততই বাড়ল নিপীড়ন ও লুঠতরাজ। ভারতের বৈভবে যে বিদেশিরা একদিন লোলুপ পশুর মতো ছুটে এসেছিল, তারাই এবার বিশ্বমঞ্চে এই লাঞ্ছিতা, বঞ্চিতা, উপবাসিনী ভারতজননীকে ঘৃণা, অবজ্ঞা ও মিথ্যা কুৎসায় জর্জরিত করে চলল। ভারতবাসী নিজেও ততদিনে ভুলে গেছে আত্মগরিমা ও আত্মসম্মান; নিজের ওপর আস্থা হারিয়ে ‘পরানুকরণ’ ও ‘পরানুবাদ’কেই জীবনদীপ ভেবে বসেছে!
তবু হাজার হাজার বছরের যে-সংস্কৃতি ভারতবাসীকে একবার প্রবল আত্মশ্রদ্ধ হতে শিখিয়েছিল, তার সামর্থ্য মাত্র এক হাজার বছরে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে যেতে পারে না। আবার সিংহশিশু জন্ম নিলেন স্বামী বিবেকানন্দ নামে। মা কুমারীর চরণচিহ্ন-শোভিত শিলাখণ্ডে বসে তিনি সংস্মরণ করলেন বহুধর্মের জন্মভূমি ও মিলনভূমি ভারতের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস কীভাবে হীনবীর্য ও আধ্যাত্মিকতাবর্জিত বর্তমানে পর্যবসিত হলো; উপলব্ধি করলেন আধ্যাত্মিকতাই ভারতের চিরন্তন জাতীয়তাবোধের রহস্য। ভারতকে পুনর্জাগরিত হতে হলে সেই জাতীয় চেতনাকেই আশ্রয় করতে হবে। আধ্যাত্মিকতা ও কৃষ্টির আলোকে উদ্ভাসিত ভারতের ভবিষ্যৎ চিত্রগাথা একের পর এক তাঁর ঋষিদৃষ্টিতে ধরা দিল সেদিন। তারপর কয়েকটা মাসের ব্যবধানে খ্রিস্টধর্মের বিজয়বার্তা উদ্ঘোষ করতে আয়োজিত বিশ্বধর্মমহাসভার যে-মঞ্চে অন্যান্য দেশের সঙ্গে তথাকথিত ঘৃণিত ও বর্বর ভারতের প্রতিনিধি স্বামী বিবেকানন্দ কোনোরকম প্রস্তুতিবর্জিত এবং একরকম রবাহুত হয়ে এসে জুটেছিলেন, সেখানেই ঘটল যুগসন্ধির মহাবিপ্লব। তাঁর সর্বপ্লাবী উপস্থিতি অচিরেই সেখানকার বিদেশিদের মন হরণ করল। তাঁর শাণিত, প্রবুদ্ধ বাগ্মিতায় ভারতভূমির গাম্ভীর্য ও ঔদার্য বীণার মতো ঝংকার তুলে সকলের হৃদয় অধিকার করে নিল। তারপর আর বিবেকানন্দের পরিচয়ের প্রয়োজন হয়নি। জাতীয়তাবোধের উজ্জীবনে জারিত হয়ে তিনি দাপিয়ে বেড়িয়েছেন পাশ্চাত্যের দেশে দেশান্তরে। স্বামীজীর জাতীয়তাবোধ জাতির সুপ্তিতে প্রাণ জাগাল। ব্যুত্থিত হতে থাকল সমাজ। সুভাষ বোসের মতো কত শত সুপরিচিত ও অনন্ত সিংহের মতো অসংখ্য বিস্মৃত বীর এগিয়ে এলেন দেশমাতৃকাকে মুক্ত করতে। তাঁদের সকলের প্রেরণার উৎস স্বামীজী। স্বামীজী যে-জাতীয়তাবোধের জাগরণে দেশে ও বিদেশে ভারতের কলঙ্ক ধুয়ে দিয়েছিলেন, তার ভিত্তি ছিল আধ্যাত্মিকতা ও স্বকীয় সংস্কৃতিতে শ্রদ্ধা। তিনি চেয়েছিলেন, দেশবাসী আত্মসচেতন হোক এবং বুঝে নিক কোন মহত্ত্বের তারা উত্তরাধিকারী। স্বামীজীর বিভিন্ন ভবিষ্যদ্বাণীর বাস্তব রূপায়ণে আশালোক উজাগর হয়। ঋষির প্রজ্ঞায় তিনি দেখেছিলেন শ্রেষ্ঠত্বের আসন ভারতের ললাটপটে জাজ্বল্যমান; আধ্যাত্মিক ও বৈষয়িক উত্থান পূর্ব পূর্ব গরিমাকেও ম্লান করে দিয়ে অগণিত বীর ভারতবাসীর অমিত প্রভায় পৃথিবী আলোকিত। প্রাণময় তৃণগুচ্ছের উচ্ছল শ্যামলিমায় সেদিন উদ্ভাসিত হবে তেজস্বী আবেগ; আত্মদানের গৈরিক শোভা ভাললিখায় উদয়রাগ এঁকে রাখবে; চিত্তের শুভ্রতায় শুচি হবে ভারত-ভারতীর শান্তিনিধি। সময়চক্রের শোকহীন গতি দেশের হৃদয়কুসুমকে বিকশিত করবে। আধ্যাত্মিক মনন সেই পুষ্পের সৌরভ হয়ে জাতির চেতনায় আত্মনির্ভরতা ও পরার্থপরতা জাগিয়ে তুলবে। স্বাধীনচেতা বীরেরা মুক্ত বিহঙ্গের মতো গৌরবধ্বজা উড়িয়ে নিয়ে চলবে। ধর্মীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উদার পরমার্থচিন্তায় যে সংযম ও শক্তি আত্মস্থ হয়, তা দেশকে উন্নতির উচ্চ সীমায় তুলে ধরবে। আধুনিক প্রযুক্তিতে যুক্ত হয়ে ভারতের প্রাচীন গৌরবগাথা নতুন আদর্শ বিরচিত করবে। সেই দিন সমষ্টি ও ব্যষ্টিতে আমোদিত হবে আমাদের ‘বীরভোগ্যা স্বাধীনতা’।