বাংলা গীতিকাব্যের জগতে অতুলপ্রসাদ সেনের নাম স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁর জীবনের অনেকটা সময় বাংলার পরিমণ্ডলের বাইরে অতিবাহিত হলেও তাঁর সংগীত ও কবিতা রচনায় কোনো ছেদ পড়েনি। তিনি নিরলসভাবে তাঁর সৃজনশীলতাকে জাগরূক রেখে একদিকে যেমন বাংলা গীতিকাব্যকে সমৃদ্ধ করেছেন, তেমনি অন্যদিকে অশেষ মাধুর্য দান করেছেন।
অতুলপ্রসাদের ব্যক্তিজীবনের দুঃখ ও যন্ত্রণা তাঁকে তীব্রভাবে পীড়িত করেছে। বিদ্যা, উপার্জন, সামাজিক সম্মান ও কবিত্বের স্বীকৃতি অতুলপ্রসাদ প্রভূতভাবে লাভ করলেও তাঁর পারিবারিক জীবন তাঁকে কখনো প্রার্থিত স্বস্তি ও শান্তি দিতে পারেনি। যন্ত্রণাদগ্ধ অতুলপ্রসাদ অজস্র গীতিকবিতা রচনা করে তাঁর অন্তরতর বেদনাকে পরমের কাছে নিবেদন করে উত্তরণের পথ খুঁজেছেন। তবে সেই প্রয়াস তাঁকে কতটা তৃপ্তি দিয়েছে তা অনুমান করা সহজসাধ্য নয়। কিন্তু তিনি নিরন্তর আত্মনিবেদনের পথে অগ্রসর হতে প্রয়াসী হয়েছিলেন।
অতুলপ্রসাদ সেন ১৮৭১ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকায় মাতামহ কালীনারায়ণ গুপ্তের লক্ষ্মীবাজারের বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। পিতা রামপ্রসাদ সেন ও মাতা হেমন্তশশীর পুত্রসন্তানকে কালীনারায়ণ পরম কল্যাণময়ের করুণার প্রসাদ হিসাবে গ্রহণ করে তার নামকরণ করেন ‘অতুলপ্রসাদ’।
রামপ্রসাদ সেন প্রথম জীবনে সংস্কৃত ও পারসি ভাষার চর্চা ও শিক্ষকতা করলেও তাঁর মন তৃপ্ত ছিল না। তিনি বিক্রমপুর থেকে কলকাতায় এসে দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে পরিচিত হন। দেবেন্দ্রনাথের সহযোগিতায় রামপ্রসাদ কলকাতার মেডিকেল কলেজে ভর্তি হন এবং পরে ডাক্তারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁকে ব্রাহ্মধর্মে দীক্ষিত করেন। রামপ্রসাদ সেন ব্রাহ্মধর্ম প্রচারে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন এবং একইসঙ্গে আর্তজনের পাশে থেকে তাদের সেবাদানে তৎপর হয়েছিলেন। প্রতিদিন ভোরে শয্যা ত্যাগ করে রামপ্রসাদ ঊষাবন্দনা করতেন, যা শিশু অতুলপ্রসাদকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিল। ১৮৮৪ সালে রামপ্রসাদ সেন পরলোকগমন করেন। ফলে বিধবা হেমন্তশশী পুত্র-কন্যাদের সঙ্গে নিয়ে পিত্রালয়ে অবস্থান করেন। তাঁর পিতা কালীনারায়ণ গুপ্ত প্রথম জীবনে বৈষ্ণবধর্মাবলম্বী হলেও পরে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন। অবশ্য তিনি অন্যান্য ধর্মের ও জাতের মানুষের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, যা অতুলপ্রসাদের জীবনে ছায়া ফেলেছিল। কালীনারায়ণ কাউকে কিছু দিতে চাইলে অতুলপ্রসাদের হাত দিয়েই তা দান করতেন, ফলে অতুলপ্রসাদের মনে মানসিক উদারতার ভিত্তিভূমি স্থাপিত হয়েছিল।
ঢাকা শহরের তাঁতিবাজারে নাটক, বাউল, যাত্রা, কবিগান ও কীর্তনের প্রায়শই আসর বসত। সেইসব গানের আসরে হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের রসিকজন উপস্থিত থাকতেন। সংগীতের প্রতি আকর্ষণে অতুলপ্রসাদ সেইসব আসরে উপস্থিত হতেন। এছাড়াও মহরমের তাজিয়া, জন্মাষ্টমীর মিছিল এবং দোলযাত্রা উপলক্ষে আয়োজিত গানের শোভাযাত্রা হিন্দু-মুসলমানের প্রতিবছর মিলনের উপায় হিসাবে চিহ্নিত করেছিল। সেই পরিমণ্ডল অতুলপ্রসাদকে সহিষ্ণুতা ও গ্রহিষ্ণুতার পাঠ দিয়েছিল। এছাড়াও পিতা রামপ্রসাদ সেনের দরিদ্র হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সেবাকর্মের প্রেক্ষিতে উভয় সম্প্রদায়ের প্রতি অতুলপ্রসাদের ভালবাসা ও মধুর সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করেছিল।
অতুলপ্রসাদের পিতা রামপ্রসাদ সেনের মৃত্যুর কিছুকাল পর অতুলপ্রসাদের মাতা হেমন্তশশী দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের জ্যাঠামশাই দুর্গামোহন দাশকে বিবাহ করেন। দুর্গামোহন দাশ ব্রাহ্মসমাজের নেতা ও ধনী ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত ছিলেন। অতুলপ্রসাদ প্রাথমিকভাবে সেই বিবাহ মেনে নিতে পারেননি। যদিও অতুলপ্রসাদের তিন ভগিনী কিরণ, হিরণ ও প্রভার দায়িত্ব দুর্গামোহন দাশ গ্রহণ করেছিলেন, তবু অতুলপ্রসাদের দ্বিধা দূর হয়নি।
অতুলপ্রসাদ ১৮৯০ সালে প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। তারপর কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেই কলেজে অতুলপ্রসাদের সহপাঠী ছিলেন চিত্তরঞ্জন দাশ, বিহারীলাল মিত্র, ব্রজেন্দ্রনাথ মিত্র প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ। অবশেষে চিত্তরঞ্জন দাশের প্রচেষ্টায় মাতা পুত্রের দূরত্ব ঘুচে যায়। ১৮৯০ সালে মা হেমন্তশশীকে প্রণাম করে ব্যারিস্টারি পড়ার জন্য অতুলপ্রসাদ বিলাত যাত্রা করেন। বিলাতে অতুলপ্রসাদের সঙ্গে চিত্তরঞ্জন দাশের পুনরায় যোগাযোগ হয়। এছাড়াও অরবিন্দ ঘোষ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, মনমোহন ঘোষ, সরোজিনী নাইডু প্রমুখের সঙ্গে অতুলপ্রসাদের আলাপ হয়েছিল। তাঁরা সকলে বিদেশে সাহিত্যচর্চা ও সংগীতচর্চার জন্য একটি ‘স্টাডি সার্কেল’-এ মিলিত হতেন। মনমোহন ঘোষের মাধ্যমে অতুলপ্রসাদ বিলাতে মহম্মদ আলি জিন্নার সঙ্গেও পরিচিত হয়েছিলেন।
১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্বামী বিবেকানন্দের শিকাগো-বক্তৃতার সংবাদ লন্ডনের ভারতীয়দের মন ও প্রাণে গভীর আনন্দদান করেছিল। অরবিন্দ-চিত্তরঞ্জন-দ্বিজেন্দ্রলালসহ অতুলপ্রসাদও সেইসব প্রকাশিত সংবাদের জন্য উৎসুক হয়ে থাকতেন। তাঁদের আলোচনাচক্রে স্বামী বিবেকানন্দের বিশ্বজয়ের সপ্রশংস আলোচনায় প্রত্যেকের হৃদয় উদ্বুদ্ধ হতো। তাঁরা মনে মনে সংকল্প করেছিলেন যে, ভারতবর্ষে ফিরে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দের আদর্শ ও কর্মধারায় নিজেদের সংযুক্ত করবেন।
লন্ডনে থাকার সময় অতুলপ্রসাদের বড়মামা কৃষ্ণগোবিন্দ গুপ্ত সপরিবারে সেখানে গিয়েছিলেন। মামার কন্যা হেমকুসুম একদিকে যেমন সংগীত ও ছবি আঁকায় পারদর্শিনী ছিলেন, তেমনি অন্যদিকে এস্রাজ-বেহালা-পিয়ানো বাজাতে পারতেন। অতুলপ্রসাদের সংগীতপ্রীতি ও সৃজনশীলতা পরস্পরকে কাছাকাছি এনেছিল। পরিশেষে সেই সম্পর্ক প্রণয়ে রূপান্তরিত হয়।
১৮৯৪ সালে (মতান্তরে ১৮৯৫) ব্যারিস্টারি পাশ করে অতুলপ্রসাদ ভারতে ফিরে আসেন। প্রথমে অতুলপ্রসাদ কলকাতা হাইকোর্টে লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের অধীনে কাজ শুরু করেন এবং পরে কিছুকাল রংপুরেও ব্যারিস্টারি করেছিলেন। ১৮৯৭ সালের ডিসেম্বর মাসে দুর্গামোহন দাশ হঠাৎ পরলোকগমন করেন। বিধবা হেমন্তশশীকে বিবাহ করার জন্য দুর্গামোহন আত্মীয়দের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিলেন। ফলে সেই পরিবারের সম্পূর্ণ দায় অতুলপ্রসাদের ওপর বর্তেছিল। রংপুরে ব্যারিস্টারি করতে গিয়েও হেমকুসুমের আর্তিতে সাড়া দিয়ে অতুলপ্রসাদ পুনরায় কলকাতায় ফিরে আসেন। এছাড়াও কলকাতায় ফিরে আসার আরো একটি কারণ ছিল ‘খামখেয়ালির আসর’। রংপুর যাওয়ার আগে অতুলপ্রসাদ সেই আসরের অন্যতম সদস্য হয়েছিলেন। আসরের যাঁরা সদস্য ছিলেন তাঁরা যথাক্রমে রবীন্দ্রনাথ, অবনীন্দ্রনাথ, জ্ঞানেন্দ্রনাথ, বলেন্দ্রনাথ, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, লোকেন পালিত, মহারাজা জগদীন্দ্রনারায়ণ রায়, রাধিকামোহন গোস্বামী প্রমুখ বিশিষ্ট জন।
অতুলপ্রসাদ এবং হেমকুসুমের বিবাহ উভয় পরিবারের কেউই মেনে নিতে পারেননি। তাঁদের আত্মীয়-পরিজন সম্পর্কে ভ্রাতা ভগিনীর বিবাহে প্রবল প্রতিবাদ জানালেন। কিন্তু অতুল-হেমকুসুম উভয়েই সিদ্ধান্তে অনড়। অবশেষে লর্ড সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের পরামর্শে স্কটল্যান্ডের গ্রেটনাগ্রিন গ্রামের গির্জায় বিবাহ সম্পন্ন করার জন্য অতুলপ্রসাদ হেমকুসুমকে নিয়ে পুনরায় ইংল্যান্ড রওনা হলেন। সেখানে বিবাহ সম্পন্ন করে তাঁরা উভয়ে ইংল্যান্ডে বসবাসের সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ইংল্যান্ডে অতুলপ্রসাদের ব্যারিস্টারি তেমন জমেনি। এই অবস্থায় হেমকুসুম দুটি সন্তানের জননী হলেন। শিশু দুটি যথাক্রমে দিলীপকুমার ও নিলীপকুমার। আর্থিক কষ্ট অতুল-হেমকুসুমের পরিবারের নিত্যসঙ্গী হয়ে উঠল। অসুস্থ নিলীপকুমার সামান্য পথ্য ও চিকিৎসার অভাবে মারা গেল। তাঁদের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল! বিলাতে অতুলপ্রসাদের একজন ভারতীয় বন্ধু মমতাজ হোসেন ভারতে ফিরে লখনৌ শহরে বসবাসের পরামর্শ দিলেন। ১৯০২ সালে অতুলপ্রসাদ সপরিবারে কলকাতায় ফিরে আত্মীয়-বন্ধুদের অবহেলা ও অবজ্ঞা পেলেন। একমাত্র তাঁর পূর্বপরিচিত শিশিরকুমার দত্ত সংবাদ নিয়েছিলেন।
অল্প কিছুদিনের মধ্যে লখনৌ শহরে ব্যারিস্টার হিসাবে অতুলপ্রসাদ খ্যাতিলাভ করলেন। মমতাজ হোসেন অতুলপ্রসাদকে বড় ভাই হিসাবে সম্মান করতেন। তাই তাঁর হিতৈষণায় লখনৌ শহরের বহু সম্ভ্রান্ত মুসলমান তাঁকে সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। ব্যারিস্টারি ছাড়াও অতুলপ্রসাদ নানা সেবামূলক কর্মে নিজেকে নিয়োজিত করেন। ফলে হেমকুসুম কিছুটা নিঃসঙ্গ বোধ করেন। ইতিমধ্যে মা হেমন্তশশীকে কলকাতা থেকে লখনৌ নিয়ে এলেন অতুলপ্রসাদ। কারণ, ততদিনে বোনেদের বিবাহ হয়ে গেছে। তাই হেমন্তশশী কিছুটা একাকিনী হয়ে পড়েছিলেন। প্রাথমিক পর্বে হেমকুসুমের সঙ্গে হেমন্তশশীর সম্পর্ক আপাতভাবে স্বাভাবিক থাকলেও পরে তা বিদ্বেষের চেহারা নেয়। হেমকুসুমের সেই বিদ্বেষ পরে অতুলপ্রসাদের প্রতি আক্রমণে পর্যবসিত হয়। অতুলপ্রসাদের জীবনে একদিকে জননী আর অন্যদিকে জায়াকে কেন্দ্র করে এক বিপর্যয় নেমে এল। বিধাতার অদৃশ্যলিপিতে শূন্যতার ও বেদনার কঠিন আঘাতে অতুলপ্রসাদের জীবন বিড়ম্বিত হলো।
মা হেমন্তশশীকে কলকাতায় রেখে অতুলপ্রসাদ ১৯১১ সালে হেমকুসুম ও পুত্র দিলীপকুমারকে সঙ্গে নিয়ে একটি মামলার ব্যাপারে পুনরায় বিলাত যান। ১৯১২ সালে লখনৌ শহরে ফিরে এসে অতুলপ্রসাদ ও হেমকুসুমের সম্পর্ক ক্রমে ক্ষোভ ও ঘৃণায় পরিণত হলো। অতুলপ্রসাদ কিছুটা আত্মভোলা মানুষ হয়েও সহ্য করতেন, সাধ্যমতো প্রতিকারের চেষ্টা করতেন। তবু একদিন ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গেল। এক বন্ধুর জন্মদিনের উৎসবে গিয়েছিলেন অতুলপ্রসাদ। রাতে বাড়ি ফিরে দেখলেন, হেমকুসুমের নির্দেশে তাঁর সমুদয় কোট ও পাতলুন স্তূপীকৃত হয়ে আগুনে জ্বলছে। অভিমানে অতুলপ্রসাদ সেই রাত্রে তাঁর এক আত্মীয়ের বাড়ি চলে যান। জীবন-রক্তে কলম ডুবিয়ে সেই রাতে অতুলপ্রসাদ লিখেছিলেন—“যাব না, যাব না, যাব না ঘরে/ বাহির করেছে পাগল মোরে।”
হেমকুসুম অতুলপ্রসাদের মা এবং ভগিনীদের কিছুতেই সহ্য করতে পারতেন না। এমনকী হেমন্তশশীর মৃত্যুর পরেও তাঁর তৈলচিত্র তাঁদের ঘরে রাখার তীব্র বিরোধিতা করেন হেমকুসুম। অবশ্য অতুলপ্রসাদের পক্ষে সেই নির্দেশ মানা সম্ভব হয়নি। অন্যদিকে অতুলপ্রসাদ তাঁর মা হেমন্তশশীর প্রতি গভীর ভালবাসায় আবাসগৃহের নাম রেখেছিলেন ‘হেমন্তনিবাস’। হেমকুসুমের রূঢ় ব্যবহারে অতুলপ্রসাদের সহজ-জীবন বারবার লাঞ্ছিত হয়েছে। ফলে দাম্পত্য জীবনের বোঝাপড়া অধরা থেকে গেছে। সহধর্মিণী ও শিশুপুত্রের থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনে বিপর্যস্ত অতুলপ্রসাদ বোধহয় লিখেছিলেন : “আমায় রাখতে যদি আপন ঘরে/ বিশ্বঘরে পেতাম না ঠাঁই।/ দুজন যদি হত আপন/ হত না মোর আপন সবাই।”
অতুলপ্রসাদ তাঁর জীবনে সহধর্মিণী হেমকুসুমের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ত স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে গেছেন। তাঁর প্রয়াস প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছে। তাঁর দাম্পত্য জীবনের বিষাদ তাঁকে আচ্ছন্ন করে রাখত। সমাজসেবা, রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত রাখলেও অন্তরের অন্তস্তলে বেদনার ফল্গু নিরন্তর প্রবাহিত হতো। কখনো কখনো সাময়িক সম্পর্ক স্থাপিত হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। তাই অতুলপ্রসাদ সেই বেদনাতুর মন নিয়ে রচনা করেছেন অজস্র কাব্যগীতি। ফলে তাঁর রচিত কাব্যগীতিগুলি আজও সংবেদনশীল মনে নাড়া দিয়ে যায়, শ্রোতার মনকে অনেক সময় ভারাক্রান্ত করে তোলে। অতুলপ্রসাদের জীবন-যন্ত্রণা তাঁর রচনার উৎসমুখ আর সেখান থেকে উৎসারিত হয়েছে বেদনার স্রোতোধারা। সময়ের অন্তরালকে সরিয়ে রেখে আজও তা সমধিক প্রবহমান।
রামনিধি গুপ্ত আঠারো শতকে তাঁর সংগীতরচনায় টপ্পাকে আঙ্গিক হিসাবে বেছে নিয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথের অনুরাগ ধ্রুপদে থাকলেও লোকসংগীত ও পাশ্চাত্য সুর তাঁর গানে বিশেষ অভিব্যক্তি খুঁজে পেয়েছে। দ্বিজেন্দ্রলাল খেয়ালের আঙ্গিক গ্রহণ করেও তাঁর গানে কীর্তনের অত্যুজ্জ্বল প্রয়োগ করেছিলেন। অন্যদিকে অতুলপ্রসাদ লখনৌ অঞ্চলের ঠুংরির আঙ্গিক, কাজরি, সাওন ইত্যাদি অবধ অঞ্চলের সংগীতের অবয়ব বাংলায় এনেছিলেন। ঠুংরির মিঠাস্ অতুলপ্রসাদের গানে প্রাধান্য পেলেও বাংলার বাউল ও কীর্তনের আশ্চর্য সংশ্লেষ আমরা তাঁর রচিত ‘আর কতকাল থাকব বসে দুয়ার খুলে/ বঁধু আমার’ গানে পেয়ে যাই।
রামনিধি গুপ্ত যখন রচনা করেন—‘নানান দেশের নানান ভাষা/ বিনে স্বদেশি ভাষা মিটে কি আশা’, তখন তিনি তাঁর ভাষিক সত্তার গৌরবে গৌরবান্বিত বোধ করতে শুরু করেছেন। তিনি স্বদেশি ভাষা বললেও বঙ্গভাষা শব্দ উচ্চারণ করেননি। অথচ আঠারো শতকেই কবি আব্দুল হাকিম সানুরাগে তাঁর কবিতায় ‘বঙ্গবাণী’ শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছেন। সেই পরম্পরা অনুসরণে অতুলপ্রসাদ কুড়ি শতকে লিখেছিলেন : “মোদের গরব মোদের আশা/ আ মরি বাংলাভাষা।” প্রবাসী বাঙালি হয়েও অতুলপ্রসাদের বাঙালি সত্তা চিরজাগরূক ছিল। তাঁর প্রবাসী বঙ্গসাহিত্য সম্মেলনের সাংগঠনিক তৎপরতা এবং কাশী থেকে ‘উত্তরা’ নামে বাংলা মাসিক পত্রিকা প্রকাশের প্রচেষ্টার মধ্যে আমরা সেই বাঙালিয়ানাই প্রত্যক্ষ করি। অতুলপ্রসাদের সমকালে স্বাজাত্যবোধের নবীন উন্মেষে রচিত অতুলপ্রসাদের ‘সবারে বাসরে ভালো’, ‘মিছে তুই ভাবিস মন’ গানগুলি সেই লক্ষণকে প্রকটিত করেছে। চিত্তরঞ্জন দাশ ও অতুলপ্রসাদ সেন প্রত্যক্ষ রাজনীতি করলেও তাঁদের রচিত কাব্য রাজনীতির রঙে রঞ্জিত ছিল না। অতুলপ্রসাদ রচিত ‘বল বল বল সবে, শত বীণা বেনু রবে’, ‘হও ধরমেতে বীর’ গানগুলি বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় বিশেষ জনপ্রিয় হয়েছিল। স্বদেশি আন্দোলনের সময় ১৯০৮ সালে অতুলপ্রসাদের ‘ওঠ গো ভারতলক্ষ্মী’ গানটিও জনগণমনে গভীরভাবে আদৃত হয়।
অতুলপ্রসাদের কাব্যগীতিগুলি অধিকাংশ শিরোনামহীন। ‘অর্ঘ্য’, ‘সাগর-বক্ষে জ্যোৎস্নাসুন্দরী’ ও ‘প্রত্যাবর্তন’ ছাড়া আর কোনো কাব্য রচনায় তিনি শিরোনাম দেননি। অতুলপ্রসাদ তাঁর কাব্যগীতিগুলিকে ‘দেবতা’, ‘প্রকৃতি’, ‘স্বদেশ’, ‘মানব’ ও ‘বিবিধ’ পর্যায়ে বিন্যস্ত করেছিলেন। তবে অনেকসময় তাঁর রচনার লক্ষ্য বিস্তৃততর হয়ে সেই সীমারেখা বারবার মুছে দিয়ে যায়। ‘মানব’ পর্যায়ের কাব্যগীতিগুলি সম্পর্কে শোভন সোম মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন : “‘ওগো নিঠুর দরদি, একি খেলছ অনুক্ষণ/ তোমার কাঁটায় ভরা বন, তোমার প্রেমে ভরা মন’, ‘সে ডাকে আমারে/ বিনা সে সখারে রহিতে মন নারে’, ‘এসো গো একা ঘরে একার সাথি/সজল নয়নে বল রব কত রাতি’, ‘আমার পরাণ কোথা যায় উড়ে/ কে যেন ডাকিছে মোরে দূর সাগর পারে/ বিরহবিধুর সুরে’, ‘আর কতকাল থাকব বসে দুয়ার খুলে/ বঁধু আমার’ ইত্যাদি ‘দেবতা’ পর্যায়ভুক্ত রচনায় ‘দেবতা’ যে লক্ষ্য নন, এই কথা ঐ রচনায় প্রবেশমাত্র বোঝা যায়। নিজের ব্যক্তিগত দুঃখকে তিনি ছদ্মবেশ পরিয়ে আড়াল করতে পারেননি। দেবতার উদ্দেশে বলা কথা দয়িতার উদ্দেশে বারবার চলে গিয়েছে। কোথাও ‘হরি’, ‘বঁধু’, ‘বন্ধু’, ‘নাথ’, ‘দীনবন্ধু’, ‘প্রভু’ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার করলেও এগুলির লক্ষ্য যে দেবতা নয়, তা গোপন থাকেনি। তিনি যখন বলেন, ‘ওগো নিঠুর দরদি/… তোমার সাথে আছে আমার অনেক কথন’, তখন স্পষ্টই বোঝা যায়, এই সকল রচনা বন্দন নয়, এই সকল রচনা তাঁর অন্তরের কথন বহন করছে।” অবশ্য তাঁর মন্তব্যের শেষ অংশের সঙ্গে অন্য গবেষকগণ সহমত পোষণ নাও করতে পারেন।
অতুলপ্রসাদ সেনের ‘বিবিধ’ পর্যায়ের ‘আজ আমার শূন্য ঘরে আসিল সুন্দর/ ওগো অনেকদিনের পর’, ‘শ্রাবণ ঝুলাতে বাদল রাতে/ তোরা আয় গো কে ঝুলিবি আয়’, ‘ডাকে কোয়েলা বারে বারে/ হা মোর কান্ত কোথা তুমি হা রে’, ‘তুমি কবে আসিবে মোর আঙিনায়/ কত বেলি কত চামেলি যায় বৃথা যায়’, ‘বঁধুয়া নিদ নাহি আঁখিপাতে/ আমিও একাকী তুমিও একাকী আজি এ বাদল রাতে’, ‘কে যেন আমারে বারে বারে চায়/ আমি তো চিনিনে তারে সে চেনে আমায়’, ‘ওগো দুঃখী কাঁদিছ কি সুখ লাগি/ সুখের যাতনা জান না কি’, ‘ঝুমক ঝুমক ঝুমঝুম নুপূর বাজে/ বিরহী পরাণ মম সে দুটি চরণ যাচে’ গানগুলি তাঁর অন্তরের বেদন-কথা। ‘বিবিধ’ শিরোনামের নির্লিপ্তি দিয়ে সেই বেদনাকে আবৃত করা যায় কি? সংস্কৃতি নির্মাণে তিনি যতই বহির্মুখী, ব্যক্তিগত কথায় তিনি ততই অন্তর্মুখী। সেই দুয়ের টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে তাঁর রচনার বুনন বোধকরি তাঁকে রোম্যান্টিক কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে।
ভারতের শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিস্তারে অতুলপ্রসাদ যত্নবান ছিলেন। নবাব নাসিরুদ্দিনের ‘বিলাসকুঞ্জ’ সংস্কার করে তিনি অন্যতম সদস্য হিসাবে ১৯২১ সালে লখনৌ বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেন। ১৯২২ সালে আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ স্থাপিত হয়। ১৯২৫ সালে অতুলপ্রসাদ ‘হরিমতী গার্লস স্কুল’-এর সভাপতি হন। পরে সেই বিদ্যালয় ‘জুবিলি গার্লস স্কুল’ নামে পরিচিত হয়। অতুলপ্রসাদ তাঁর নিজের গ্রামের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শিক্ষাবিস্তারের জন্য প্রায় তিন হাজার টাকা ব্যয় করে ‘গুরুপ্রসাদ রামপ্রসাদ হাইস্কুল’ নির্মাণ করে দেন। লখনৌ শহরে ১৯২৫ সালে অতুলপ্রসাদ এবং আরো কয়েকজন উদ্যমী ব্যক্তির আগ্রহে নিখিল ভারত সংগীত সম্মেলন আয়োজিত হয়। অতুলপ্রসাদের আমন্ত্রণে রবীন্দ্রনাথ সেই সম্মেলনের উদ্বোধন করেন। পরবর্তী সময়ে রবীন্দ্রনাথের আহ্বানে ১৯২৭ সালে অতুলপ্রসাদ শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। অবশ্য তার বহু পূর্বে ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথের নোবেল পুরস্কারকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য অতুলপ্রসাদ ‘মোদের গরব মোদের আশা’ গানটি রচনা করেন।
১৯১৫ সালে লখনৌতে গোমতী নদীর ভয়াবহ বন্যায় বন্যাকবলিতদের সাহায্যে আত্মনিয়োগ করেন অতুলপ্রসাদ। এছাড়াও ১৯২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে লখনৌ শহরে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে অতুলপ্রসাদের হস্তক্ষেপে শান্তি স্থাপিত হয়। এভাবেই নানা সময় সমাজকল্যাণে অতুলপ্রসাদ নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন।
লখনৌ শহরে ১৯১৪ সালে রামকৃষ্ণ সেবাশ্রমের সূচনা হয়। উক্ত প্রতিষ্ঠান ১৯২৫ সালে বেলুড় রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের শাখাকেন্দ্র হিসাবে স্বীকৃত হয়। প্রাথমিক পর্বে সম্ভবত ১৯২১-১৯২২ সালে সেবাশ্রমে কর্মরত ব্রহ্মচারী বীরেশচৈতন্য মহারাজের সঙ্গে অতুলপ্রসাদের পরিচয় হয়। অতুলপ্রসাদ সক্রিয়ভাবে সেবাশ্রমের জন্য আমিনাবাদে জমি সংগ্রহ করে সেবাশ্রমের প্রসারে বিশেষভাবে সহযোগিতা করেন। রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমের নতুন জমিতে একটি হলঘর নির্মাণের সমগ্র ব্যয়ভার বহন করে অতুলপ্রসাদ সেই হলঘরটি পিতা রামপ্রসাদ সেনের নামে উৎসর্গ করেন। ১৯২৬ সালে স্বামী দেবেশানন্দ আশ্রমের দায়িত্বভার গ্রহণ করলে অতুলপ্রসাদ তাঁর মাতা হেমন্তশশীর স্মৃতিতে আরো একটি শুশ্রূষালয় (চিকিৎসালয়) স্থাপন করেন। প্রতি রবিবার বিকালে অতুলপ্রসাদ আশ্রমে আসতেন এবং ধর্মালোচনা শ্রবণের পর নিজকণ্ঠে সংগীত পরিবেশন করতেন।
হেমন্তশশী শুশ্রূষালয়ে রোগীর সংখ্যা দিন দিন বর্ধিত হওয়ায় রোগীদের রামপ্রসাদ হলঘরে রাখার ব্যবস্থা হয়। কিন্তু রোগীর সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাওয়ায় অতুলপ্রসাদ স্বামী দেবেশানন্দকে বহির্বিভাগে (outdoor) রোগীর শয্যার (bed) ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেন। শুধু পরামর্শ দিয়েই অতুলপ্রসাদ ক্ষান্ত হননি, ‘Outdoor dispensary with two beds’ নির্মাণ করতে সেইসময় পাঁচ হাজার টাকা আর্থিক সাহায্য দিয়েছিলেন। আদালতে যাওয়ার পথে প্রায় দিনই অতুলপ্রসাদ সেবাশ্রমে যেতেন এবং রোগীদের চিকিৎসা বিষয়ে খোঁজখবর নিতেন। স্বামী দেবেশানন্দের সঙ্গে আলোচনার সময় অতুলপ্রসাদ যখন জানতে পারলেন, ওষুধের ব্যয় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে তখন তিনি তার প্রতিকার হিসাবে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসারও ব্যবস্থা করেন এবং প্রতিমাসে খরচ বাবদ ব্যয়ভার সানন্দে বহন করতেন। অতুলপ্রসাদ তাঁর উইলে সেবাশ্রমের হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার জন্য প্রতিমাসে পঁচিশ টাকা বরাদ্দ করে যান। এছাড়াও অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার ওষুধের জন্য Bengal Chemical-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে বিনামূল্যে ওষুধ সংগ্রহের ব্যবস্থা করেছিলেন। অতুলপ্রসাদ তাঁর কর্মব্যস্ততার মধ্যেও সেবাশ্রমে আয়োজিত নরনারায়ণসেবায় প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে ভক্তদের পাতে পায়েস পরিবেশন করতেন।
হেমকুসুমের তীব্র প্রত্যাখ্যান অগ্নিশিখা হয়ে অতুলপ্রসাদের হৃদয়কে দগ্ধ করেছিল। সেই পীড়ন হয়তো বা তাঁর জীবনাদর্শকে বৃহত্তর জীবনের পরিসরে পরিচালিত করেছিল। তাই সেই বিশ্বাসে ভর করে তিনি রচনা করেছিলেন—“সবারে বাসরে ভালো,/ নইলে মনের কালো ঘুচবে না রে।”
১৯৩০ সালের ৩০ মে অতুলপ্রসাদ সেন ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় তাঁর দানপত্র প্রকাশ করেন। সেই দানপত্রে সহধর্মিণী হেমকুসুম, পুত্র দিলীপকুমার ছাড়াও নববিধান ব্রাহ্মসমাজের দাতব্য কর্মে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, মমতাজ পার্কের মুসলমান এতিমখানায়, হিন্দু ও আর্যসমাজ পরিচালিত অনাথ আশ্রমে তাঁর সমগ্র সঞ্চয় দান করে যান, যা অতুলপ্রসাদের হৃদয়বত্তা ও উদারতাকেই প্রকাশিত করেছে।
জীবনের প্রান্তলগ্নে অসুস্থ অতুলপ্রসাদ স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য পুরীধামে গিয়েছিলেন। অর্থাভাবে পুরীতে বেশিদিন থাকা সম্ভব হলো না। অতুলপ্রসাদ ফিরে এলেন হেমন্তনিবাসে। হেমকুসুম সংবাদ পেলেও দ্বিধাদ্বন্দ্বের প্রাচীর অতিক্রম করতে পারেননি। অসুস্থ অতুলপ্রসাদ পুত্রের সঙ্গে কিছু জরুরি কথা সেরে খাবার টেবিলেই মূর্ছা যান। অবশেষে ১৯৩৪ সালের ২৬ অগস্ট রাত্রি ১টা ৪৫ মিনিটে কোমলপ্রাণ অতুলপ্রসাদ শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। গোমতী নদীর তীরে মহাশ্মশানে তাঁর শেষকৃত্যে উপস্থিত ছিলেন অগণিত মানুষজন। হিন্দু, মুসলমান, বস্তিবাসী, ভিখারি, নবাবের লোকজন, ধনী ও উচ্চবর্ণের ব্যক্তিবর্গ এবং রামকৃষ্ণ মিশনের সন্ন্যাসিগণের উপস্থিতিতে শেষকৃত্য অনুষ্ঠান মহামিলনের জনসমুদ্রে পরিণত হয়।
অতুলপ্রসাদ সেনের শতবর্ষ উপলক্ষে প্রকাশিত অতুলপ্রসাদ সেন গ্রন্থ সম্পাদনা করেন অতুলপ্রসাদ সেনের উদ্যোগে প্রকাশিত ‘উত্তরা’ পত্রিকার সম্পাদক সুরেশ চক্রবর্তী। সেই গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত একটি কবিতা ছাড়াও সংকলিত হয়েছে অনেক বিশিষ্টজনের রচনা। তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে দিলীপকুমার রায়, রাজ্যেশ্বর মিত্র, সাহানা দেবী, অমল হোম, ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রাধাকমল মুখোপাধ্যায়, সুরেশ চক্রবর্তী প্রমুখের রচনা উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও উক্ত গ্রন্থে অতুলপ্রসাদকে লিখিত রবীন্দ্রনাথের পত্রাবলিও সংযোজিত হয়েছে।
১৯৭২ সালে অতুলপ্রসাদের শতবর্ষপূর্তি উদ্যাপন উপলক্ষে পুরুলিয়া রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠে আয়োজিত অনুষ্ঠানে তৎকালীন সম্পাদক স্বামী প্রমথানন্দের উদ্যোগে প্রখ্যাত অভিনেতা ও সংগীতশিল্পী পাহাড়ী সান্ন্যাল অতুলপ্রসাদের দীর্ঘ স্মৃতিচারণা এবং অনেকগুলি অতুলপ্রসাদী (অতুলপ্রসাদ রচিত সংগীত) পরিবেশন করেন।
১৯৩১ সালে অতুলপ্রসাদের জীবিতকালে তাঁর গীতিসংকলনগীতিগুঞ্জ প্রথম প্রকাশিত হয়। অতুলপ্রসাদ সেনের পরলোকগমনের পর তাঁর স্মরণে লিখিত রবীন্দ্রনাথের কবিতা, অতুলপ্রসাদ সেনের প্রতিকৃতি ও তাঁর হস্তাক্ষরে একটি গান-সহ তৃতীয় সংস্করণ সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ কর্তৃক ১৩৬৪ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়।
মডার্ন আর্ট প্রেস পাবলিশার্স কলকাতা থেকে অতুলপ্রসাদ সেনের কয়েকটি গান শীর্ষক একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন, যে-গ্রন্থটি তিনি তাঁর মা হেমন্তশশীকে উৎসর্গ করেছেন। এছাড়াও রবীন্দ্রনাথের আগ্রহে ও অতুলপ্রসাদ সেনের ইচ্ছানুসারে দুই খণ্ডে প্রকাশিত ও সত্তরটি সংগীত-সম্বলিত কাকলি গ্রন্থের স্বরলিপি প্রস্তুত করেন প্রখ্যাত সংগীতশিল্পী সাহানা দেবী। তাঁকে এই কাজে সহযোগিতা করেন দ্বিজেন্দ্রলাল-পুত্র দিলীপকুমার রায়। পৌষ ১৩৩৬ বঙ্গাব্দে কলকাতার গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সনস্ কাকলি গ্রন্থ প্রকাশ করেন।
অতুলপ্রসাদের প্রয়াণের পর অনেক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। তবু তাঁর জীবনদেবতার চরণে নিবেদিত সংগীত-অর্ঘ্য আজও অম্লান। বাংলা গীতিকাব্যে তাঁর অবদান বাঙালি সমাজ আনতমস্তকে চিরকাল স্মরণ করবে। তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত সংগীতের অমৃতধারায় বাঙালি সমাজ সঞ্জীবিত হবে, সন্দেহ নেই।
বর্তমান বছরটি অতুলপ্রসাদ সেনের জন্মের সার্ধশতবর্ষের প্রেক্ষিতে তাঁর উদ্দেশে রচিত রবীন্দ্রনাথের ‘অতুলপ্রসাদ সেন’ কবিতার প্রথম ছত্রটি আমরা স্মরণ করি। রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন :
“বন্ধু তুমি বন্ধুতার অজস্র অমৃতে
পূর্ণপাত্র এনেছিলে মর্ত্ত্য ধরণীতে।
ছিল তব অবিরত
হৃদয়ের সদাব্রত,
বঞ্চিত করোনি কভু কারে
তোমার উদার মুক্তদ্বারে।।…”
সহায়ক গ্রন্থ :
১ ঘোষ, সুনীলময়, অতুলপ্রসাদ, ‘গ্রন্থতীর্থ’, কলকাতা, ২০০৩
২ সোম, শোভন (সম্পাদিত), অতুলপ্রসাদ সেনের শ্রেষ্ঠ কবিতা , ‘ভারবি’, কলকাতা, ২০০২
৩ সরকার, সুধীরচন্দ্র (সংকলিত), জীবনী অভিধান, এম.সি. সরকার অ্যান্ড সন্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৩৭৩
৪ দাশগুপ্ত, বিনয়েন্দ্রনাথ, অতুলপ্রসাদ (অতুলপ্রসাদ সেন প্রসঙ্গে), ‘বাগর্থ’, কলকাতা, ১৩৬৩
৫ সেন, অতুলপ্রসাদ, গীতিগুঞ্জ, সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ, কলকাতা
৬ সেন, অতুলপ্রসাদ, কয়েকটি গান, মডার্ন আর্ট প্রেস পাব্লিশার্স, কলিকাতা
৭ সেন, অতুলপ্রসাদ, কাকলি, গুরুদাস চট্টোপাধ্যায় এন্ড সন্স্, কলিকাতা, ১৩৩৬
৮ চক্রবর্তী, সুরেশ (সম্পাদিত), অতুলপ্রসাদ সেন, বাক্ সাহিত্য প্রাইভেট লিমিটেড, কলিকাতা, ১৯৭১-১৯৭২