।।২।।
শ্রীরামকৃষ্ণের স্বরূপের অন্যান্য বৈশিষ্ট্য
আমরা মহিমময় শ্রীরামকৃষ্ণ–চরিত্রের অন্তরঙ্গ দিকগুলি সম্বন্ধে যত অবহিত হই ততই তাঁকে আরো নিবিড়ভাবে জানতে ও ভালবাসতে পারি। পরিণামে তা আমাদের রামকৃষ্ণ–চেতনার উন্মেষ ও বৃদ্ধিতে পরম সহায়ক হয়।
সর্বদেবদেবীস্বরূপতা
শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন সর্বদেবদেবীস্বরূপ। তিনিই শিব, বিষ্ণু, দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী—সবকিছু। তাই শ্রীরামকৃষ্ণের পূজার সময় এই মন্ত্রটি বারংবার উচ্চারিত হয়—‘ওঁ ঐঁ সর্বদেবদেবীস্বরূপায় শ্রীরামকৃষ্ণায় নমঃ’।
লীলাপ্রসঙ্গ-এ স্বামী সারদানন্দজী বর্ণনা করেছেন— একদিন মথুরবাবু দক্ষিণেশ্বরে কুঠিবাড়িতে বসে আছেন আর শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর ঘরের উত্তর-পূর্বের বারান্দায় পায়চারি করছেন। মথুরবাবু দেখলেন, যখন ঠাকুর সামনের দিকে আসছেন তখন মন্দিরের মা কালী আর যখন পিছন ফিরে হাঁটছেন তখন সাক্ষাৎ শিব।
স্বামী বাসুদেবানন্দ লিখেছেন : “১৯১৪ খ্রীস্টাব্দে আত্মারামের কৌটায় কালীপুজো ও জগদ্ধাত্রীপুজো হয়। এবার (১৯১৫) জয়রামবাটীতে জগদ্ধাত্রীপুজোর সময় মাকে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আত্মারামের কৌটায় এঁদের পুজো হয়? “গুহ্যাতিগুহ্যগোপ্ত্রী ত্বং গৃহাণাস্মৎ কৃতং জপম্।/ সিদ্ধির্ভবতু মে দেবি তৎপ্রসাদাৎ মহেশ্বরী।।” বলে ঐ কৌটাতেই জপ সমর্পণ করি, তাতে দোষ হয় না?’ মা বললেন, ‘তা হবে কেন? তুমি কী বেদান্ত পড়? ঠাকুরই মহেশ্বর, ঠাকুরই মহেশ্বরী। শুদ্ধসত্ত্ব যোগমায়া তাঁর শরীর—তিনি সশক্তিক ব্রহ্ম। শিব ও শক্তি এক। ঠাকুরের অসুখের সময় একদিন দেখলাম, মা-কালী ঘাড় বেঁকিয়ে রয়েছেন। জিজ্ঞেস করলাম, “মা, অমন করে রয়েছ কেন?” বললেন, “ওর ঐটের জন্য। আমারও গলায় বড় ব্যথা”।’”১৭
শ্রীশ্রীমা একসময় এও মন্তব্য করেন : “তিনি (ঠাকুর) সর্বদেবময়, তিনি সর্ববীজময়।”১৮ “ঠাকুরের ভিতর সব দেবদেবী আছেন—এমন কি, শীতলা, মনসা পর্যন্ত।”১৯
শ্রীশ্রীচণ্ডীর পঞ্চম অধ্যায়ে ‘যা দেবী সর্বভূতেষু বিষ্ণুমায়েতি শব্দিতা’ বলে শুরু করে পরবর্তী অনেকগুলি শ্লোকে বিভিন্ন বস্তু ও ভাবের মধ্যে জগন্মাতার অধিষ্ঠানের বর্ণনা আছে, আবার ভগবদ্গীতার দশম অধ্যায় ‘বিভূতিযোগ’-এ বর্ণনা করা হয়েছে—জগতের সব বিশিষ্ট বস্তু ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বিশেষ প্রকাশস্থল। আমরা ঐগুলি পাঠ করার সময় শ্রীচণ্ডী ও শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন বিভূতি শ্রীরামকৃষ্ণে আরোপিত করতে পারি এবং তাতে কোনো প্রত্যবায় হয় না। কারণ, তাঁরা তো স্বরূপত এক ও অভিন্ন। এইভাবে রামকৃষ্ণ-চেতনাকে আমরা আরো সম্প্রসারিত করতে পারি।
সর্বাবতারস্বরূপতা
শ্রীরামকৃষ্ণ যেমন ছিলেন সর্বদেবদেবীস্বরূপ, তেমনি আবার সর্বাবতারস্বরূপ। তিনি স্বয়ং অন্তরঙ্গ ভক্তদের একাধিকবার বলেছিলেন, যিনি পূর্বে রাম ও কৃষ্ণ-রূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন তিনিই এবার এদেহে রামকৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ। আবার শ্রীচৈতন্য, যিশুখ্রিস্ট ও তিনি এক। শ্রীম জানাচ্ছেন : “একদিন তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘ক্রাইস্ট, চৈতন্য আর আমি, এই তিনই এক অবিভাজ্য সত্তা’।”২০
তরুণ নরেন্দ্রনাথ সেসময় সাধারণ ব্রাহ্মসমাজে যাতায়াত করছেন এবং ব্রাহ্মদের মতোই তাঁরও প্রতিমাপূজা, গুরুবাদ এবং ঈশ্বরের অবতারত্বে বিশ্বাস নেই। উপরন্তু পাশ্চাত্যের যুক্তিবাদ ও অজ্ঞেয়বাদের দ্বারা তিনি তখন বিশেষভাবে প্রভাবিত। এই পরিপ্রেক্ষিতে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাৎ এবং তাঁর ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শে আসা। এর পরিণামে তাঁর এযাবৎ অভিজ্ঞতা ও বিশ্বাসের ভিত্তিতে তীব্র আঘাত লাগলেও শ্রীরামকৃষ্ণের সব বক্তব্য তখনো তিনি মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। এই সময়ে ঠাকুর একদিন যখন তাঁকে বললেন, তিনি পূর্বে নদিয়াতে গৌরাঙ্গরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন তাঁর সামনে কোনো মন্তব্য না করলেও কলকাতায় ফিরে কথামৃতকার শ্রীমর কাছে এসে মন্তব্য করেছিলেন : “পরমহংস মশায় আমায় বললেন, ‘নবদ্বীপে যে গৌরাঙ্গ হয়েছিলেন, আমিই সেই গৌরাঙ্গ।…’ আচ্ছা, এ লোকটা কি পাগল হয়েছে নাকি?”২১ সেই নরেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে আরো কিছুদিন গভীরভাবে দেখার ও জানার পর বন্ধু শরৎ (স্বামী সারদানন্দজী) ও শশীর (স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজীর) কাছে মন্তব্য করেছিলেন : “…জ্ঞান বল, মুক্তি বল, (এ) গোরা রায় যাহাকে যাহা ইচ্ছা তাহাকে তাহাই বিলাইতেছেন! কি অদ্ভুত শক্তি!… দক্ষিণেশ্বরের গোরা রায় সব করিতে পারেন।”২২ এর আরো পরে রচনা করেছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ সম্বন্ধে সেই বিখ্যাত স্তোত্র ‘আচণ্ডালাপ্রতিহতরয়ো যস্য প্রেমপ্রবাহ’ এবং তার মধ্যে দ্বিধাহীনভাবে এবং গভীর প্রত্যয়ের সঙ্গে ঘোষণা করেছিলেন, পূর্ব পূর্ব অবতার শ্রীরামচন্দ্র ও শ্রীকৃষ্ণ এযুগে শ্রীরামকৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হয়েছেন—‘সোঽয়ং জাতঃ প্রথিতপুরুষো রামকৃষ্ণস্ত্বিদানীম্’।
আরো স্মরণ করা যেতে পারে, সাধনকালে শ্রীরামকৃষ্ণ ভগবান যিশুখ্রিস্ট এবং পয়গম্বর হজরত মহম্মদের দিব্যদর্শন লাভ করেন,সুতরাং আমরা যেমন সর্বদেবদেবীজ্ঞানে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রণামমন্ত্র উচ্চারণ করি ‘ওঁ ঐঁ সর্বদেবদেবীস্বরূপায় শ্রীরামকৃষ্ণায় নমঃ’, তেমনি তাঁকে সর্বাবতারজ্ঞানে এই মন্ত্রেও প্রণাম করা যায়—‘ওঁ ঐঁ সর্বাবতারস্বরূপায় শ্রীরামকৃষ্ণায় নমঃ’।
শ্রীরামকৃষ্ণ ও শ্রীমায়ের অভিন্নতা
শ্রীরামকৃষ্ণের স্বরূপের আরেকটি অন্যতম জ্ঞাতব্য বিষয় হলো শ্রীরামকৃষ্ণ ও তাঁর লীলাসঙ্গিনী শ্রীমা সারদাদেবীর মধ্যে অভিন্নতা-বোধ। ‘যথাগ্নের্দাহিকাশক্তী রামকৃষ্ণে স্থিতা হি যা’। স্বামীজী এই অভিন্ন সত্তাকে প্রণাম জানিয়েছিলেন এই বলে—‘সশক্তিক নমি তব পদে’। শ্রীমাও ভক্তদের কখনো ইঙ্গিতে কখনো স্পষ্টভাবে শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে তাঁর অভিন্নতার কথা বলেছেন। যোগীন-মার মনে শ্রীমায়ের ব্যাপারে একবার সংশয় আসে। কারণ, শ্রীরামকৃষ্ণ ছিলেন ত্যাগীশ্বর আর মাকে দেখছেন ঘোর সংসারীর মতো; ভাই, ভাইপো, ভাইঝিদের জন্য অস্থির। একদিন গঙ্গার ঘাটে ধ্যান করতে বসে যোগীন-মা দেখলেন, ঠাকুর সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন : “দেখ, গঙ্গায় কি ভাসছে।” যোগীন-মা দেখলেন একটি সদ্যোজাত শিশু নাড়িভুঁড়ি-জড়ানো অবস্থায় গঙ্গায় ভেসে যাচ্ছে। ঠাকুর বললেন : “গঙ্গা কি কখনো অপবিত্র হয়? না তাকে কিছু স্পর্শ করে? ওকে (শ্রীমা) তেমন জানবে। ওর উপর সন্দেহ এনো না, ওকে একে (নিজেকে দেখাইয়া) অভেদ জানবে।”২৩ মাও এক ভক্তকে বলেছিলেন : “আমাকে ও ঠাকুরকে অভিন্ন ভাববে।”২৪
শ্রীরামকৃষ্ণের কৃপা ও স্বামীজীর আশীর্বাদ-ধন্য পুঁথিকার অক্ষয়কুমার সেন ঠাকুর ও মায়ের এই অভেদত্ব তথা একাত্মতা ষোড়শীপূজার বর্ণনা উপলক্ষে ছন্দে রূপ দিয়েছেন : “পূজ্য পূজকেতে দু’য়ে ভাবরাজ্য তেয়াগিয়ে,/ভাবাতীতে একত্র মিলন।”২৫
সর্ব ভাব, মত ও পথের সমন্বয়
সাধারণত দেখা যায় যে, কোনো ধর্মের সিদ্ধপুরুষ কোনো একটি সাধনমার্গ যেমন জ্ঞান, ভক্তি বা যোগ অবলম্বন করে সাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন এবং তাঁদের ধর্মপ্রচার ও উপাসনায় সেই বিশেষ সাধনমার্গ প্রাধান্য পায়। অবতার বা অবতারকল্প মহাপুরুষদের জীবনে বিভিন্ন ধর্মসাধনার কথা তেমন জানা যায় না। শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে আমরা প্রথম দেখলাম, সেখানে মিলিত হয়েছে ‘বহু সাধকের বহু সাধনার ধারা’। তার মধ্যে যেমন হিন্দুধর্মের বিভিন্ন সাধনা আছে, তেমন আছে অন্য ধর্মের সাধনাও। কিন্তু ধর্মসমন্বয়ের আদর্শ প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য নিয়ে যে তিনি বিভিন্ন ধর্মের সাধনা করেছিলেন তা নয়। এপ্রসঙ্গে শ্রীমার মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। কেদার মহারাজ (স্বামী কেশবানন্দ) একদিন মাকে জিজ্ঞাসা করলেন : “মা, এবার কি ঠাকুর একটা নতুন জিনিস দিয়ে যাবার জন্যেই এসেছিলেন যে সর্বধর্মসমন্বয় করে গেলেন?” মা উত্তরে বললেন : “দেখ, বাবা, তিনি যে সমন্বয়-ভাব প্রচার করবার মতলবে সব ধর্মমত সাধন করেছিলেন তা কিন্তু আমার মনে হয়নি। তিনি সর্বদা ভগবদ্ভাবেই বিভোর থাকতেন। খ্রীস্টানরা, মুসলমানরা, বৈষ্ণবরা যে যেভাবে তাঁকে ভজনা করে বস্তুলাভ করে, তিনি সেই সেইভাবে সাধনা করে নানা লীলা আস্বাদন করতেন ও দিনরাত কোথা দিয়ে কেটে যেত, কোন হুঁশ থাকত না। তবে কি জান, বাবা, এই যুগে তাঁর ত্যাগই হলো বিশেষত্ব। ওরকম স্বাভাবিক ত্যাগ কি আর কখনো কেউ দেখেছে? সর্বধর্মসমন্বয়-ভাবটি যা বললে, ওটিও ঠিক। অন্যান্য বারে একটা ভাবকেই বড় করায় অন্য সব ভাব চাপা পড়েছিল।”২৬
শ্রীরামকৃষ্ণের সাধনার উদ্দেশ্য ছিল মূলত চারটি। এক, বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থে যে-ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা বলা হয়েছে, সিদ্ধপুরুষেরা যে-ঈশ্বরকে উপলব্ধি করেছেন বলে শোনা যায়, ভক্তেরা যে-ভগবানের অস্তিত্বে বিশ্বাস করেন এবং সেই বিশ্বাস অনুযায়ী প্রতিমাপূজা করেন—সেই ঈশ্বর কি কাল্পনিক না তাঁর যথার্থ অস্তিত্ব আছে, সেসম্বন্ধে নিঃসন্দিগ্ধ হওয়া। দুই, ঈশ্বর-উপলব্ধির যে বিভিন্ন সাধনমার্গ আছে সেসম্বন্ধে তাঁর কৌতূহল অর্থাৎ সেইসব সাধনমার্গের প্রক্রিয়াগুলি কী এবং সেই প্রক্রিয়া অবলম্বন করে ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা যায় কি না তা যাচাই করা। তিন, এইভাবে বিভিন্ন সাধনমার্গকে অবলম্বন করে যে-ঈশ্বরকে উপলব্ধি করা যায় সেই ঈশ্বর কি ভিন্ন ভিন্ন, না এক তা পরীক্ষা করা। চার, ঈশ্বরের আনন্দ নানাভাবে সম্ভোগের তীব্র অভীপ্সা।
উপরি-উক্ত উদ্দেশ্যগুলি নিয়ে দীর্ঘ বারো বছর তিনি কঠোর ও অবিরাম সাধনা চালিয়ে গিয়েছিলেন। এর পরিণামে তিনি যে-সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিলেন সেগুলি হলো : এক—ঈশ্বর আছেন, তিনি সাকার, নিরাকার এবং সাকার-নিরাকারেরও পারে। দুই—ঈশ্বরকে দেখা যায়, তাঁর সঙ্গে আলাপ করা যায়। তিন—সব ধর্মই ঈশ্বর-উপলব্ধির এক-একটি পথ। চার—বিভিন্ন পথ অবলম্বন করলেও পরিণামে সাধকেরা এক ঈশ্বরকে উপলব্ধি করেন। পাঁচ—ঈশ্বরলাভই মানবজীবনের উদ্দেশ্য, কারণ তার ফলে আত্যন্তিক এবং চিরস্থায়ী সুখ, শান্তি ও পরা জ্ঞান লাভ করা যায়; মানুষ জন্ম–মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্তিলাভ করে পরমানন্দের অধিকারী হয়। ছয়—ঈশ্বরলাভের প্রধান পথ দুটি : জাগতিক তথা ক্ষণস্থায়ী, সসীম ও সদা পরিবর্তনশীল বিষয়ের প্রতি আসক্তি ত্যাগ এবং ঈশ্বরের প্রতি অনুরাগ বৃদ্ধি।
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে যে বিভিন্ন সাধনমার্গের সমন্বয় দেখা যায়, তার একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল—তিনি গোঁড়ামি, সংকীর্ণতা বা একঘেয়েমি ভাব একেবারেই পছন্দ করতেন না। তিনি বলতেন : “আমি একঘেয়ে কেন হব? আমি পাঁচরকম করে মাছ খাই। কখন ঝোলে, কখন ঝালে অম্বলে, কখন বা ভাজায়। আমি কখন পূজা, কখন জপ, কখন বা ধ্যান, কখন বা তাঁর নামগুণগান করি, কখন তাঁর নাম করে নাচি।”২৭ আরো বলেছেন : “আমি সবরকম করেছি—সব পথই মানি। শাক্তদেরও মানি, বৈষ্ণবদেরও মানি, আবার বেদান্তবাদীদেরও মানি। এখানে তাই সব মতের লোক আসে। আর সকলেই মনে করে, ইনি আমাদেরই মতের লোক। আজকালকার ব্রহ্মজ্ঞানীদেরও মানি।”২৮ তাঁর সিদ্ধান্ত হলো : “যে সমন্বয় করেছে, সেই-ই লোক।”২৯ অর্থাৎ সেই মানুষই পূর্ণতা প্রাপ্ত হয়েছে—যার সর্বশ্রেষ্ঠ উদাহরণ ছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং।
শ্রীরামকৃষ্ণ চাইতেন তাঁর শিষ্যদের মধ্যেও যেন গোঁড়ামি বা একঘেয়েমির ভাব না থাকে। তিনি তাঁদের জীবনকে এমনভাবে গঠিত করেছিলেন যাতে তাঁদের মধ্যেও ভাবসমন্বয় ঘটে, যাতে তাঁরাও বিভিন্নভাবে ঈশ্বরের আনন্দ সম্ভোগ করতে পারেন। উদাহরণ হিসাবে স্বামীজীর কথা উল্লেখ করা যায়। সপ্তর্ষির অন্যতম ঋষি স্বামীজী বাল্যকাল থেকেই ধ্যানসিদ্ধ তথা ধর্মজগতে উচ্চ অধিকারী হলেও দেহধারণ করায় প্রাকৃতিক কারণে তাঁর সুপ্ত আধ্যাত্মিক শক্তির পূর্ণ বিকাশ লাভের একটি ক্রম ছিল। যৌবনে তিনি প্রথমে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের সভ্য হিসাবে নিরাকার সগুণ ব্রহ্মের উপাসক ছিলেন। এরপর ‘আচার্যানাং মহাচার্যম্’ শ্রীরামকৃষ্ণের দিব্য সংস্পর্শে এসে এবং তাঁর বিশিষ্ট শিক্ষার গুণে, সর্বোপরি তাঁর কৃপায় স্বামীজীর নির্বিকল্প সমাধিরূপ চরম আধ্যাত্মিক অবস্থা লাভ হয় তথা নিরাকার নির্গুণ ব্রহ্মের উপলব্ধি হয়। আবার মা কালীকে মানার ফলে তাঁর ব্রহ্মের সাকার সগুণ সত্তার উপলব্ধি এবং যিনিই ব্রহ্ম তিনিই আদ্যাশক্তি মহামায়া—এই উপলব্ধিও তাঁর হয়। বিভিন্ন দেবদেবী ও অবতারের দর্শনও তাঁর হয়েছিল। শ্রীরামকৃষ্ণ স্বামীজীকে এমনভাবে তৈরি করেছিলেন, যাতে স্বামীজীর মধ্যে কোনো একদেশদর্শিতা ছিল না এবং তিনিও ঈশ্বরের আনন্দ বিভিন্নভাবে সম্ভোগ করছিলেন। এর ফলে তিনি দেশ–বিদেশের বিভিন্ন ভাবের ও বিভিন্ন স্তরের বিপুলসংখ্যক ভক্তকে তাদের রুচি ও অধিকার অনুযায়ী সঠিক আধ্যাত্মিক পথ প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অন্যান্য অন্তরঙ্গ পার্ষদের জীবনেও যাতে বিভিন্ন সাধনার সমন্বয় ঘটে, যাতে তাঁদের ধর্মীয় মত ও পথের ব্যাপারে একদেশদর্শিতা না থাকে, তাঁরাও যাতে সার্থকভাবে ধর্মাচার্যের ভূমিকা পালন করতে পারেন সেইভাবে তাঁদের তৈরি করেছিলেন। গুরু হিসাবে এটা ছিল তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য। স্বামী অখণ্ডানন্দজীর একটি প্রাসঙ্গিক স্মৃতিচারণা—“এক সময় ভাব ভক্তি ভাল লাগত না—অদ্বৈততত্ত্ব ভাবছি। হঠাৎ দেখলাম দক্ষিণেশ্বরের ঘরে ঠাকুর যশোদা ও গোপালের দিকে তাকিয়ে ভাবস্থ, অপলক। গদগদভাবে আমায় ডেকে বলছেন—‘দেখ্ দেখ্ কি ভাব!’ দেখলাম গোপাল হামা দিয়ে পালাচ্ছে, আর যশোদা ননী হাতে পিছু পিছু যাচ্ছেন আর ডাকছেন, দেখতে দেখতে ঠাকুর তন্ময়, আর অস্ফুট স্বরে এক একবার বলছেন, ‘দেখ্ দেখি কি ভাব!’”৩০
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে ছিল জ্ঞান ও বিজ্ঞানের সমাহার—যেমন তিনি বলতেন, নিত্যে পৌঁছে তারপর লীলাতে থাকা। “এই ব্রহ্মজ্ঞানলাভ করে তারপর লীলা আস্বাদন করে বেড়াও।”৩১
তাঁর দৈনন্দিন জীবনেও অহরহ দেখা যেত ভাব ও সমাধি—সবিকল্প ও নির্বিকল্প উভয় প্রকারের সমাধি। একটি অপূর্ব ও ব্যঞ্জনাময় ভক্তিগীতি থেকে উদ্ধৃতি দিয়ে মাস্টারমশাই কথামৃত-এ শ্রীরামকৃষ্ণের সমাধির অবস্থা বর্ণনা করেছেন : “উপেক্ষিয়া মহত্তত্ত্ব, ত্যজি চতুর্বিংশ তত্ত্ব, সর্বতত্ত্বাতীত তত্ত্ব দেখি আপনি আপনে।”৩২ হৃষীকেশের এক সাধু সমাধিকালীন শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখে মন্তব্য করেছিলেন : “কি আশ্চর্য! তোমাতে পাঁচপ্রকার সমাধি দেখলাম!” এই সমাধিগুলি ঠাকুর নিজেই বর্ণনা করেছেন : “কখনো কপিবৎ—দেহবৃক্ষে বানরের ন্যায় মহাবায়ু যেন এ-ডাল থেকে ও-ডালে একেবারে লাফ দিয়ে উঠে, আর সমাধি হয়।”
“কখন মীনবৎ—মাছ যেমন জলের ভিতরে সড়াৎ সড়াৎ করে যায় আর সুখে বেড়ায়, তেমনি মহাবায়ু দেহের ভিতর চলতে থাকে আর সমাধি হয়।
“কখন বা পক্ষীবৎ—দেহবৃক্ষে পাখীর ন্যায় কখনও এ-ডালে কখনও ও-ডালে।
“কখন পিপীলিকাবৎ—মহাবায়ু পিঁপড়ের মতো একটু একটু করে ভিতরে উঠতে থাকে, তারপর সহস্রারে বায়ু উঠলে সমাধি হয়। কখন বা তির্যক্বৎ—অর্থাৎ মহাবায়ুর গতি সর্পের ন্যায় আঁকা-ব্যাঁকা; তারপর সহস্রারে গিয়ে সমাধি।”৩৩
এছাড়া তাঁর স্থিতসমাধি ও উন্মনাসমাধিও হতো। শ্রীরামকৃষ্ণ ব্যাখ্যা করে বলেছেন : “একেবারে বিষয়বুদ্ধি ত্যাগ হলে স্থিতসমাধি হয়।” আর ‘ছড়ানো মন হঠাৎ কুড়িয়ে আনা’—এর নাম উন্মনাসমাধি।৩৪ চৈতন্যদেবের মতো তাঁরও বাহ্যদশা, অর্ধবাহ্যদশা এবং অন্তর্দশা হতো।
ভক্তিশাস্ত্রে উল্লিখিত শান্ত, দাস্য, সখ্য, বাৎসল্য ও মধুর—এই পাঁচটি ভাবও তাঁর লাভ হয়েছিল। বিবিধ ভাব যথা হাস্য, ক্রন্দন, অশ্রু, কম্প, পুলক, স্বেদ, মূর্ছা ইত্যাদি যা মধুরভাবের পরাকাষ্ঠা তা একাধারে প্রকাশিত হলে তাকে ‘মহাভাব’ বলে। শাস্ত্র অনুযায়ী মহাভাবের সেই লক্ষণগুলি শ্রীরামকৃষ্ণের মধ্যে প্রকাশিত দেখে ভৈরবী ব্রাহ্মণী ও বৈষ্ণবচরণ গোস্বামী সিদ্ধান্তে এসেছিলেন যে, মহাভাবের উপলব্ধি একান্ত দুর্লভ, যা কেবলমাত্র শ্রীরাধিকার ও শ্রীচৈতন্যদেবের হয়েছিল, তা হয়েছিল শ্রীরামকৃষ্ণেরও।
শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে জ্ঞানযোগ, ভক্তিযোগ, কর্মযোগ ও রাজযোগের সমাহার ঘটেছিল। স্বামীজী তাঁর রচিত ‘আচণ্ডালাপ্রতিহতরয়ো’ স্তোত্রে শ্রীরামকৃষ্ণের জীবনে জ্ঞান, ভক্তি ও কর্ম—এই তিনটি যোগের সমন্বয়ের কথা বলেছেন : “অদ্বয়তত্ত্বসমাহিতচিত্তং প্রোজ্জ্বলভক্তিপটাবৃতবৃত্তং।/কর্মকলেবরমদ্ভুতচেষ্টং যামি গুরুং শরণং ভববৈদ্যং।।”৩৫ আর রাজযোগের সাধনা ও সিদ্ধি তো তাঁর ছিলই। উপরন্তু ঠাকুর হঠযোগের সাধনাও করেছিলেন।
চারটি যোগের সমন্বয়সাধনকে একটি আদর্শ সাধনমার্গ হিসাবে তুলে ধরা শ্রীরামকৃষ্ণের মৌলিক অবদান। স্বামী বিবেকানন্দ শ্রীরামকৃষ্ণের সেই যোগসমন্বয়ের আদর্শকে রূপ দিয়েছেন রামকৃষ্ণ সংঘের প্রতীক-কল্পনায় এবং সংঘের সদস্যদের দৈনন্দিন জীবনচর্যার পরিকল্পনায়, যার মধ্যে যোগ, ভক্তি, জ্ঞান ও কর্মের সুসামঞ্জস্য আছে। একে ‘যোগসমন্বয় যোগ’ বলা যায়—যা সাধনমার্গ হিসাবে অভিনব, সহজসাধ্য এবং যুগোপযোগী। জ্ঞানমিশ্রা ভক্তির সাধনকে অবলম্বন করে, তার পরিপুষ্টির জন্য ধ্যানযোগ ও স্বাধ্যায়ের চর্চা এবং বাস্তবজীবনে তার প্রতিফলনের জন্য কর্মযোগ সহায়ে শ্রীরামকৃষ্ণজ্ঞানে জীবসেবা। রামকৃষ্ণ সংঘে পালিত বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানের মধ্যে হিন্দুধর্মের বিভিন্ন উৎসব যেমন আছে, তেমনি এখানে বুদ্ধদেব এবং যিশুখ্রিস্টের জন্মজয়ন্তীও পালন করা হয়।
সাধনার চরম অবস্থায় উপনীত হয়ে যে পরমহংস অবস্থা, তিনি শ্রীরামকৃষ্ণ প্রাপ্ত হয়েছিলেন। তার ফলে তাঁর মধ্যে কখনো বালকবৎ, কখনো উন্মাদবৎ, কখনো জড়বৎ, কখনো বা পিশাচবৎ অবস্থা দেখা যেত। “বালকের অবস্থার ভিতর আবার বাল্য, পৌগণ্ড, যৌবন! পৌগণ্ড অবস্থায় ফচকিমি। উপদেশ দিবার সময় যুবার ন্যায়।”৩৬
ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র রামলাল চট্টোপাধ্যায় একদা দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরের পূজারি ছিলেন। তিনি ঠাকুরের সঙ্গে বেশ কয়েক বছর থেকে তাঁর সেবাও করেছেন। তিনি জানিয়েছেন : “ঠাকুর অধিকাংশ সময়ে দুরকম ভাবে থাকতেন। কোন কোন দিন বিধিবৎ সমস্ত শুদ্ধি ক্রিয়া করতেন। আবার কোন কোন দিন কিছুই করতেন না। এমন কি প্রক্ষালনও ভাল করে করতেন না। সকালে পুকুর থেকে এসেই খাবার চাইতেন এবং খাওয়ার পরে অনিচ্ছার সঙ্গে হাত ধুতেন। একদিন তিনি বলেছিলেন, ‘দেখ, মা আমাকে কখনো শিশুর ভাবে, কখনো উন্মত্তের ভাবে এবং কখনো মুক্ত আত্মার ভাবে রাখেন।’”৩৭
হিন্দুধর্মের লোকায়ত সাধনার ধারাগুলি, যেমন আউল-বাউল, কর্তাভজা, সহজিয়ার সঙ্গেও তাঁর বিশেষ পরিচিতি ছিল। খ্রিস্টধর্ম ও ইসলামধর্ম সাধনা করা ছাড়াও বৌদ্ধধর্ম ও শিখধর্ম সম্বন্ধেও তিনি অবহিত ছিলেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ বিবাহিত ছিলেন, তবুও ছিলেন সন্ন্যাসীর রাজা। সমাধি অবস্থায় আরূঢ় হয়ে যেমন তিনি বাহ্যজগৎ সম্পূর্ণ বিস্মৃত হতেন, তেমনি সহজ অবস্থায় যখন ফিরে আসতেন তখন বাহ্যপরিবেশ তথা সংসারের খুঁটিনাটি বিষয়ে সম্পূর্ণ সচেতন থাকতেন, যেমন—পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা, লোকব্যবহারে নিপুণতা, বিবেচনাবোধ, কর্মকুশলতা ইত্যাদি। বস্তুত, তাঁর মধ্যে একাধারে সর্বপ্রকার সম ও বিষম ভাবের সমন্বয় ঘটেছিল, এর দ্বিতীয় উদাহরণ আর পাওয়া যাবে না। স্বামীজী কথাপ্রসঙ্গে বলেছিলেন—ঠাকুর সর্বভাবের সাক্ষাৎ সমন্বয়মূর্তি। শ্রীরামকৃষ্ণের সমস্ত উক্তি ও তদনুযায়ী সাধনার মধ্যে উপ্ত ছিল বিবেকানন্দ-প্রচারিত ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত সংঘে আচরিত সর্বযোগের সমন্বয় এবং আরো বহুবিধ সমন্বয়ের আদর্শের বীজ।
‘ডাইলিউট’ হয়ে যাওয়া
শ্রীম ভক্তদের কাছে বর্ণনা করছেন : “ঠাকুর যার সঙ্গে মিশতেন তারই হয়ে যেতেন। একবার কামারপুকুরে গেলেন। পাড়ায় যত মেয়েরা এসে ঘিরে থাকতো। ঠাকুর বলেছিলেন, ‘আমি যেন তোদের সঙ্গে dilute (বিগলিত) হয়ে গেছি। না গা?’… সকলে মনে করতো, উনি আমাদেরই একজন। মথুরবাবুর বাড়ীর মেয়েরা মনে করতেন, আমাদেরই একজন।… ব্রাহ্ম ভক্তেরা মনে করতেন, পরমহংস মশায় তো আমাদেরই লোক! এদিকে গোঁড়া সনাতনীরা মনে করতেন তাঁদের—মারোয়াড়ী ভক্তরা। শৈব, শাক্ত, খ্রীস্টান, মুসলমান, যে এসেছে সেই মনে করতো আমাদের।”৩৮ এইভাবে শুধু বিভিন্ন ধর্মের মানুষদের সঙ্গে নয়, বালকদের সঙ্গে বালকভাবে, যুবকদের সঙ্গে যুবকভাবে, প্রৌঢ়দের সঙ্গে প্রৌঢ়ভাবে, পুরুষদের সঙ্গে পুরুষভাবে, স্ত্রীলোকদের সঙ্গে প্রকৃতিভাবে, ত্যাগীদের সঙ্গে ত্যাগিভাবে, গৃহীদের সঙ্গে গৃহিভাবে একাত্ম হয়ে মিশতেন; তাদের সুখ–দুঃখ, আনন্দ–বেদনা সমানভাবে অনুভব করতেন এবং কথা, হাসি, গান, গল্পের মধ্য দিয়ে তাদের অগোচরে তাদের আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে দিতেন।
আনন্দময় শ্রীরামকৃষ্ণ
মা ঠাকুরের আনন্দময়তা সম্বন্ধে মন্তব্য করেছিলেন : “তাঁকে কখনো নিরানন্দ দেখিনি। পাঁচ বছরের ছেলের সঙ্গেই বা কি, আর বুড়োর সঙ্গেই বা কি, সকলের সঙ্গে মিশেই আনন্দে আছেন। কখনো বাপু নিরানন্দ দেখিনি।”৩৯ সুস্থ অবস্থায় তো বটেই, অসুস্থ অবস্থাতেও—জীবনের অন্তিম লগ্নে যখন তিনি দুরারোগ্য গলরোগের জন্য তীব্র, দুঃসহ ও নিরন্তর যন্ত্রণা ভোগ করছেন তখনো তাঁর অন্তরে অন্তঃসলিলা ফল্গুধারার মতো আনন্দ নিত্য প্রবহমান ছিল।
জগতের সমস্ত আনন্দের উৎস যিনি, সেই সচ্চিদানন্দ যখন রামকৃষ্ণরূপ ধরে এই ধরাধামে আবির্ভূত হয়েছিলেন তখন সেই অবতীর্ণ পুরুষ যে আনন্দের ঘনীভূত বিগ্রহ হবেন, তা তো স্বাভাবিক। তাই শ্রীরামকৃষ্ণের দেহের প্রত্যেকটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, প্রত্যেকটি রোমকূপ থেকে যেন আনন্দ বিচ্ছুরিত হতো। উপরন্তু তিনি তাঁর মাধুর্যময় হাসি, কথা, গল্প, গান, নৃত্য সহযোগে ভক্তদের নিয়ে নিত্যই যে আনন্দের হাটবাজার বসাতেন তার বর্ণনা আমরা বিভিন্ন সূত্রে পাই। এর একটু আভাস পাওয়া যায় সেই আনন্দমেলার প্রত্যক্ষদ্রষ্টা, নববিধান ব্রাহ্মসমাজভুক্ত, কেশবচন্দ্রের অনুগামী সুগায়ক ত্রৈলোক্যনাথ সান্যালের লেখা ও সুর দেওয়া একটি গানে—“তোমার প্রেমের সুরা পানে কর মাতোয়ারা,/ ও মা ভক্তচিত্তহরা ডুবাও প্রেমসাগরে।।/ তোমার এ পাগলা গারদে, কেহ হাসে কেহ কাঁদে/ কেহ নাচে আনন্দ ভরে।”৪০
এই আনন্দের সঙ্গে জাগতিক কোনো আনন্দের তুলনা হয় না। সেই দিব্যানন্দ, বিমল আনন্দের সংস্পর্শে যাঁরাই আসতেন তাঁদেরকে তা প্রভাবিত করত। সেই প্রভাব হতো যেমন গভীর, তেমন সুদূরপ্রসারী। উপরন্তু তা দুভাবে ক্রিয়াশীল হতো। প্রথমত, তা ভক্তদের জন্মজন্মান্তরের সঞ্চিত শোক-তাপ, দ্বন্দ্ব-মোহ বিদূরিত করত। উপরন্তু তা তাঁদের এক দিব্য ও বিমল আনন্দের অনুভূতি দিত। সেই আনন্দ তাঁদের উৎসাহিত করত, অনুপ্রাণিত করত শোক-মোহবর্জিত সেই আনন্দনগরের সন্ধান করতে যা চিরকালীন—যেখানে ‘দিবানিশি পূর্ণ-শশী আনন্দে বিরাজ করে’। ঠাকুরের আনন্দময় রূপ কল্পনা করে বর্তমান প্রজন্ম আমাদেরও মনে আনন্দের সঞ্চার হয়। তাহলে সেইসব ভাগ্যবান ভক্তেরা যাঁরা সেই আনন্দময়বিগ্রহ শ্রীরামকৃষ্ণের সাক্ষাৎ সংস্পর্শে এসেছিলেন, তাঁদের যে কী অপরিসীম আনন্দ হতো তা আমরা ধারণা করতে পারি না। স্বামী তুরীয়ানন্দজী তারই একটু আভাস দিয়ে বলেছিলেন : “অবতারের সঙ্গে একদিনে যে আনন্দ হয় তা সারা জীবন দুঃখ কষ্ট পেলেও বেশী লোভনীয়; সুতরাং ঐ একদিনের আনন্দেই এত দুঃখভোগ সব পুষিয়ে যায়।”৪১
যাঁরা অধ্যাত্মজীবনে আগ্রহী কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণের ঘনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন না, তাঁরাও তাঁর কাছে অল্প কয়েকদিন গেলেও তাঁর সংস্পর্শে আসার আনন্দময় অভিজ্ঞতার কথা সারাজীবনেও ভুলতে পারতেন না। এঁদেরই একজন তদানীন্তন বরিশালের অবিসংবাদী নেতা, শিক্ষাবিদ, ধর্মপ্রাণ এবং সেই সময় বহুপঠিত গ্রন্থ ভক্তিযোগ-এর লেখক অশ্বিনীকুমার দত্ত। তিনি ঠাকুরের সঙ্গে তাঁর স্বল্পকালীন সাক্ষাৎকারের একটি অত্যন্ত মনোরম ও জীবন্ত বর্ণনার একস্থলে লিখেছেন : “ঠাকুরের সঙ্গেও মাত্র চার-পাঁচদিনের দেখা… ওই কদিনেই যা দেখেছি ও পেয়েছি তাতে জীবন মধুময় করে রেখেছে। সেই দিব্যামৃতবর্ষী হাসিটুকু, যতনে পেটরায় পুরে রেখে দিইছি। সে যে নিঃসম্বলের অফুরন্ত সম্বল গো! আর সেই হাসিচ্যুত অমৃতকণায় আমেরিকা অবধি অমৃতায়িত হচ্ছে—এই ভেবে ‘হৃষ্যামি চ মুহুর্মুহুঃ, হৃষ্যামি চ পুনঃ পুনঃ’।”৪২ [ক্রমশ]
তথ্যসূত্র
১৭ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ (সংকলক ও সম্পাদক), শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ১৯৯৭, ৩য় খণ্ড, পৃঃ ৫২৯-৩০
১৮ ব্রহ্মচারী অক্ষয়চৈতন্য, শ্রীশ্রীমা সারদাদেবী, ক্যালকাটা বুক হাউস প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৪১৫, পৃঃ ৪৩
১৯ স্বামী গম্ভীরানন্দ, শ্রীমা সারদা দেবী, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৯, পৃঃ ৩৪৪
২০ শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি, পৃঃ ২৬৮
২১ স্বামী নিত্যাত্মানন্দ, শ্রীম–দর্শন, শ্রীম ট্রাস্ট, চণ্ডীগড়, ২০০৯, ৬ষ্ঠ ভাগ, পৃঃ ১৬১
২২ ‘ঠাকুরের দিব্যভাব ও নরেন্দ্রনাথ’, লীলাপ্রসঙ্গ, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ১৫২
২৩ শ্রীশ্রীমায়ের কথা, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৯, অখণ্ড, পৃঃ ৩১৯
২৪ স্বামী চেতনানন্দ (সংকলিত), মাতৃদর্শন, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৯০, পৃঃ ২৪৩
২৫ সেন, অক্ষয়কুমার, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ–পুঁথি, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৯৪, পৃঃ ১৮২
২৬ শ্রীশ্রীমায়ের কথা, পৃঃ ২৭৯
২৭ শ্রীম-কথিত, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৭, অখণ্ড, পৃঃ ৯৩৭
২৮ ঐ, পৃঃ ৫৫২
২৯ ঐ, পৃঃ ৪৯৪
৩০ স্বামী নিরাময়ানন্দ, স্বামী অখণ্ডানন্দের স্মৃতিসঞ্চয়, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০০৫, পৃঃ ৫৯
৩১ কথামৃত, পৃঃ ৮৩০
৩২ ঐ, পৃঃ ৬৫৭; গানটির প্রথম পঙ্ক্তি—‘কবে সমাধি হবে শ্যামা চরণে’, রচয়িতা দেওয়ান নন্দকুমার।
৩৩ ঐ, পৃঃ ১০৩১
৩৪ ঐ, পৃঃ ৩৪১-৪২
৩৫ স্বামী গম্ভীরানন্দ (সম্পাদিত), স্তবকুসুমাঞ্জলি, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৬১, পৃঃ ৩৭৮
৩৬ কথামৃত, পৃঃ ৪৯৯
৩৭ শ্রীরামকৃষ্ণকে যেরূপ দেখিয়াছি, ২০১৫, পৃঃ ২৬
৩৮ শ্রীম–দর্শন, জেনারেল প্রিন্টার্স অ্যান্ড পাবলিশার্স লিঃ, কলিকাতা, ১৩৭৮, ৮ম ভাগ, পৃঃ ৭৪, ৭৮
৩৯ শ্রীশ্রীমায়ের কথা, পৃঃ ১৯২
৪০ সঙ্গীত সংগ্রহ, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ, বৈদ্যনাথ-দেওঘর, ১৩৫০, পৃঃ ১৩৮
৪১ স্বামী চেতনানন্দ (সংকলক ও সম্পাদক), স্বামী তুরীয়ানন্দের স্মৃতিকথা, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০০৬, পৃঃ ২০৪
৪২ কথামৃত, পৃঃ ১১৭০