এই সেই জয়রামবাটীর চন্দন-সমান মাটি, যেখানে মায়াপারনেত্রী মহামায়া মানবীয় কায়ায় ভূমিষ্ঠা হয়েছেন ও আপনার ছন্দে আপনি পরিভ্রমণ করেছেন। আর মাঝে মাঝে মৃদুস্বরে বলে উঠেছেন : “ছেলেরা, তোরা আয়।” সন্তানের জন্য তাঁর এই কাতর অপেক্ষায় দ্রবীভূত হয়ে গিয়েছে পল্লির শাঁওল নিসর্গ। শত শত জনের ত্রিতাপদহন নিমেষে কেমন করে শান্ত হয়ে গেছে, তার সাক্ষী থেকেছে এখানকার সোঁদা মাটির ঘ্রাণ।

তৃষিত মরু যেমন বারিবিন্দুর প্রতীক্ষায় উন্মনা চেয়ে থাকে, তেমনই নারীত্বের মান মাতৃত্বে লালিত হতে যাঁর জন্য দিন গুনেছিল, তিনি হলেন শ্রীমা সারদাদেবী। করুণাপ্লুত অবতারবরিষ্ঠের লোকহিত-শক্তিরূপে তিনি অবতীর্ণা হয়েছিলেন। তাঁর সত্তায় নিখিল-মাতৃত্বের আভাস কখনো জননী হয়ে, কখনো বা দেবীরূপে তাঁকে  চির-আদরিণী করে রেখেছে। আধ্যাত্মিক ও ঐহিক প্রার্থনা পূরণ করে এই মুহূর্তে যিনি দেবী হয়ে ধরা দেন, পরক্ষণেই সন্তানের সাময়িক বিচ্ছেদেও ভারাক্রান্ত মনে অতি সাধারণার ন্যায় ডুকরে কেঁদে ওঠেন। অথচ সেই ক্রন্দনে স্বার্থক্লিষ্ট কোনো পিছুটান নেই। গর্ভধারিণীর মতো নাড়ির যোগটুকু প্রবলভাবে থাকে, বাৎসল্যধারা উৎসারিত হয়। আবার মানবী-জননী আপন সন্তানাদির প্রতি স্বার্থশূন্য স্নেহদান করে কেবল কয়েকজনের মনে মা বা মাতৃতুল্যা হয়ে থাকেন; এই দেবী-জননী কিন্তু কয়েকজনের গণ্ডি ভেঙে সর্বজনের ও প্রতিজনের প্রতিপালনে কোল পেতেছেন। তাঁর ভেদশূন্য ভালবাসা ও ভয়শূন্য আপনবোধ জীবকে শঙ্কাহীন করে তোলে। কৃতকর্মের গ্লানিতে বা সামাজিক বৈষম্যের কারণে কেউ হীনমন্যতা অনুভব করলে মায়ের সর্বব্যাপী মন সহজেই তা টের পেত; তখন এমন এক সর্বগ্রাসী আন্তরিকতায় তাকে কাছে ডেকে নিতেন যে, ক্ষণমাত্রে সে নিজেকে দিব্য আনন্দের উত্তরাধিকারী বলে উপলব্ধি করত। ইতর বিড়াল পর্যন্ত শাসিত হলে এই সব-ভাসানো ভালবাসায় তাঁর অভয়পদে আশ্রয় খুঁজে ফিরত। তাঁর সেই অভয়পদ হৃদয়ে ধারণ করে সার্ধশতাব্দাধিক সময় পূর্বে জয়রামবাটীতে মহাপূজার কল্পারম্ভ সূচিত হয়েছিল; সে-উৎসবের মঙ্গলধ্বনিতে আপ্যায়িত সকল জগদ্বাসীর প্রাণ জুড়াতে জগজ্জননী আজও শান্তিবারি বর্ষণ করে চলেছেন। ভৌত শরীর না থাকলেও মায়ের সঘন উপস্থিতি অনুভব করে জয়রামবাটী আপন বিধৃতিতে সজীব হয়ে রয়েছে। তিনি যে ছেড়ে যাননি, তার ভূয়োভূয় প্রমাণ আমাদের মুগ্ধ করে রাখে। স্থূলশরীরে মায়ের শেষবার জগদ্ধাত্রীপুজোয় স্বামী পরমেশ্বরানন্দ মায়ের অন্তর্মুখ ভাব লক্ষ্য করে বিস্মিত হয়েছিলেন। অন্যান্য বার মা পুজোর সমস্ত আয়োজন স্বয়ং দাঁড়িয়ে তত্ত্বাবধান করতেন; এবার কিন্তু স্বামী পরমেশ্বরানন্দকে দূর থেকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন মাত্র। কথার ভঙ্গিতেও ছিল ভবিষ্যতে এইসব কর্ম কীভাবে করতে হবে—সেই দায়িত্ব অর্পণের সুর। কোন বাটিতে কী নৈবেদ্য নিবেদন করা হবে, সেইসব খুঁটিনাটি পর্যন্ত বুঝিয়ে যেতে লাগলেন।...

Read the Digital Edition of Udbodhan online!

Subscribe Now to continue reading

₹100/year

Start Digital Subscription

Already Subscribed? Sign in