নীলাচলবিভূষণ

ভারতবর্ষ পুণ্যক্ষেত্র, আধ্যাত্মিকতার পীঠভূমি। প্রাকৃতিক সম্পদে ভূষিত হইলেও নানা স্থান জুড়িয়া বিরাজমান তীর্থরাজি ভারতবর্ষের ভূষণ। এইসব তীর্থের এমনই মাধুরী যে, তাহার প্রাণস্পর্শী আহ্বান অগ্রাহ্য করিয়া অধ্যাত্মপথযাত্রী থাকিতে পারে না, তীর্থ হইতে সে ছুটিয়া চলে তীর্থান্তরে। তীর্থে উপস্থিত হইয়া সে তাহার প্রাণনাথকে প্রাণ ভরিয়া দেখিতে চাহে, তাহার পর হৃদয়কন্দরে তাঁহার ধ্যানে তন্ময় হইয়া যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ বলিয়াছেন : “…দেবস্থান, তীর্থস্থান দেখবার পর সেখানে যে সব পবিত্র ঈশ্বরীয় ভাব মনে জেগে ওঠে সেই সব নিয়ে একান্তে বসে ভাবতে হয় ও তাইতে ডুবে যেতে হয়…।” তীর্থ সাধারণত তিন প্রকার—স্থাবর, জঙ্গম এবং মানস। স্থাবর তীর্থ হইতেছে এমন ক্ষেত্র, যেখানে অনেক কাল ধরিয়া আধ্যাত্মিক ভাব ঘনীভূত হইয়া রহিয়াছে। এই রকম স্থানে মন আপনা হইতেই ভগবদ্‌ভাবে রঞ্জিত হয়। সাধু, অবতারপুরুষ প্রমুখ জঙ্গম বা সচল তীর্থ বলিয়া কথিত হন। দূরের তীর্থে যাইতে না পারিলেও সদ্‌গুণের বিকাশের মাধ্যমে মানুষ নিজেই তীর্থস্বরূপ হইয়া উঠে, ইহাই মানস তীর্থ। হিমাদ্রিকিরীটশোভিত সমুদ্রমেখলাবেষ্টিত ভারতবর্ষে সপ্ততীর্থ ও চারধামের মধ্যে পুরী যেন মহামানবের সাগরসঙ্গম তীর্থ। ত্যাগ-তপস্যার কঠোরতার দহন এখানে প্রেম-অনুরাগের অবিরল ধারায় সিক্ত। পুরীর কেন্দ্রবিন্দুতে রহিয়াছেন সর্বলোকৈকনাথ, মন্নাথ শ্রীজগন্নাথ। কথিত রহিয়াছে, বদরীনারায়ণে জগন্নাথদেব নারায়ণরূপে স্নান করেন, দ্বারকায় করেন বেশভূষা, রামেশ্বরে নিদ্রাভিভূত হইবার পূর্বে পুরীতে অন্নভোগ গ্রহণ করেন। সেই অন্ন রন্ধন করেন স্বয়ং মা ল‌ক্ষ্মী। শ্রীল সনাতন গোস্বামিপাদ শ্রীবৃহদ্ভাগবতামৃত-এ তাহাই লিখিয়াছেন। জগন্নাথের প্রসাদ তীর্থাধিষ্ঠাত্রী দেবী বিমলা গ্রহণ করিবার পর বিতরণ করা হয়। এই অন্নই ‘মহাপ্রসাদ’ বলিয়া পরিচিত। বলা হয়, শ্রীবিষ্ণুর ধাম বা ‘পুর’ বলিয়া এই তীর্থ ‘পুরী’ নামে প্রসিদ্ধি লাভ করিয়াছে। তবে একই তীর্থের এত বিভিন্ন নামে প্রসিদ্ধিলাভ বড় একটা দেখা যায় না। শ্রীজগন্নাথধাম, পুরুষোত্তমক্ষেত্র, শঙ্খক্ষেত্র, শ্রীক্ষেত্র, উচ্ছিষ্টক্ষেত্র, দশাবতারক্ষেত্র, উড্ডীয়ান পীঠ, জমনিক তীর্থ, অন্তরবেদি, পাদপীঠ, মর্তবৈকুণ্ঠ বা ভৌমবৈকুণ্ঠ, নীলাদ্রি বা নীলাচল এবং পুরী। বঙ্গোপসাগরের উত্তর-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত এই প্রাচীন তীর্থের নামবৈচিত্রই জানান দেয়—ভক্ত, ভগবান এবং ভাস্কর্য এই তিন লইয়া গড়িয়া উঠিয়াছে আজকের ওড়িশার পুরী তীর্থ। জগন্নাথ একদিকে...