অনসরপটি ও পুরীর জগন্নাথ-সংস্কৃতি

ভারতের প্রতিটি রাজ্য নিজস্ব সংস্কৃতি, শিল্প ও ঐতিহ্যের এক বিশিষ্ট পরিচয় বহন করে, যা বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত। এই বৈচিত্রের মাঝে আমাদের প্রতিবেশী রাজ্য ওড়িশা একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে নিয়েছে, বিশেষ করে জগন্নাথ-সংস্কৃতি ও তার সঙ্গে যুক্ত শিল্পধারা—পটচিত্র। পুরীর জগন্নাথ-মন্দিরে একটি রীতি প্রচলিত—স্নানযাত্রা শেষ হওয়ার পর থেকে রথযাত্রা পর্যন্ত গর্ভগৃহে স্থাপিত দারুমূর্তি পূজিত হন না। পরিবর্তে, জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রাকে পূজা করা হয় পটচিত্রে। এই শিল্পধারা ও পূজার্চনার মধ্যে রয়েছে এক দীর্ঘ ও নিবিড় সম্পর্ক। পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই এমন নজির মেলে, যেখানে কোনো চিত্রকলার ধারা একটি মন্দির-সংস্কৃতির সঙ্গে এত ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এই ওড়িয়া শিল্পরীতির সুদীর্ঘকালের চর্চা ও তাৎপর্যকে বোঝার প্রয়োজনে চলে আসে একটি শিল্পগ্রামের কথা—রঘুরাজপুর। এই গ্রামে বহু প্রতিভাবান শিল্পী প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ভগবান জগন্নাথের লীলা, কৃষ্ণকথা ও পুরাণকে চিত্রে রূপ দিয়ে চলেছেন। তাঁদের শিল্প শুধু নৈপুণ্যের নিদর্শন নয়, বরং একটি ধর্মীয় সাধনার অভিব্যক্তি। শিল্পী, আচার, পূজাবিধি—সব মিলিয়ে এক অপূর্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এ যেন এক অতল ধ্যানমগ্নতার শিল্পরূপ, যেখানে দেবতা শুধু মূর্তিতে নয়—পটচিত্রেও প্রকাশমান। সেই চিত্রকর, যিনি রঙে রঙে রচেন দেবতার প্রতিরূপ, তিনি কেবল শিল্পী নন—তিনি যেন এক আরাধক, তাঁর তুলিতে আছে সাধনার স্পর্শ। স্নানযাত্রার পর জগন্নাথের অন্তর্ধানের ক্ষণে এই চিত্র যখন প্রত্যক্ষীভূত হয়, তখন মন্দিরের স্তব্ধ বাতাসে ধ্বনিত হয় এক অতিপ্রাকৃত আখ্যান—যেন সেই পটে লুকানো পুরাকালের কণ্ঠস্বর। ধর্ম আর শিল্প যেখানে একসূত্রে গাঁথা, সেখানেই জন্ম নেয় ‘অনসরপটি’র অপার মহিমা। স্নানযাত্রা এক মনোহর অধ্যায়। এই দিনের বিশুদ্ধ আচারপর্বে জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার পুণ্যস্নান সম্পন্ন হলে তাঁদের বিগ্রহে প্রয়োজন হয় নবরঞ্জনের। দারুব্রহ্মের এই রূপ তখন স্নানান্ত ক্লান্তিতে যেন অন্তর্হিত হয় লোকচক্ষুর আড়ালে। রত্নবেদি থেকে তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয় একান্ত বিশ্রামে, অন্তঃপুরের অনবসর-গৃহে। সেথায় চলে তাঁর যত্ন, ওষধি পথ্য ও চিকিৎসার আচারপর্ব। এই অনুপস্থিতির সময়টি জুড়ে, প্রাচীন রীতির অনুসরণে, দেবগণের প্রতিরূপরূপে অঙ্কিত বিশেষ পটচিত্র অনসরপটিই অধিষ্ঠিত থাকেন গর্ভগৃহের সিংহাসনে—দর্শনীয় হয়ে ওঠেন...