ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে ১৮৬৪ সালের ৫ অক্টোবর (১৯ আশ্বিন ১২৭১ বঙ্গাব্দ) এক ভয়ংকর সংকট উপস্থিত হয়েছিল ভারতবাসীর জীবনে—‘আশ্বিনের ঝড়’রূপে। কলকাতা ও উপকূলবর্তী অঞ্চলে এই ঝড়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয় দুর্গাপুজোর প্রাক্কালে পঞ্চমীর দিন, ঝড় থেমেছিল পরদিন সন্ধ্যায়। তৎকালীন কিছু পুস্তিকার সূত্রে জানা যায়, ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল রাশিয়া, রেঙ্গুন, মুলতান (পাকিস্তান), নেপাল, দেপাল (ভুটান), সৌরাষ্ট্র (গুজরাট), মথুরা, শিখ (পাঞ্জাব), কাশী, কাঞ্চি (তামিলনাড়ু), অবন্তী, অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ (বিহার-বাংলা-ওড়িশা), মানভূম, বরা (পুরুলিয়া), ডায়মন্ডহারবার, গঙ্গামণ্ডল, মুড়াগাছা, কাশীপুর, মাহেশ, চাঁদপাল বন্দর প্রভৃতি বহু স্থান।
এই আশ্বিনের ঝড়ের প্রসঙ্গ আমরা পাই শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-এ। শ্রীরামকৃষ্ণ একদা শ্রীমকে জিজ্ঞেস করেছিলেন : “তোমার আশ্বিনের ঝড় মনে আছে?” উত্তরে শ্রীম বলেন : “আজ্ঞা, হাঁ। তখন খুব কম বয়স—নয়-দশ বছর বয়স—একঘরে একলা ঠাকুরদের ডাকছিলাম।” সেদিনটার কথা স্মরণ করে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেন : “দক্ষিণেশ্বরে অনেক বেলায়—তবে কি কি রান্না হল। গাছ সব উলটে পড়েছিল!”১
আশ্বিেনর এই ঝড়ের কারণে বহু মানুষ ঘরছাড়া হয়। বহু গবাদি পশু মারা যায়। জলে ভেসে যায় বহু জীব, ‘কোন কালে এমন না হয় অত্যাচার’। প্রাকৃতিক দুর্যোগে কলকাতা ও উপকূলবর্তী অঞ্চলগুলিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়। আসন্ন দুর্গাপুজো উপলক্ষে সরকারি ছুটি চলছিল। চারদিকে ছিল খুশির পরিবেশ। ঝড়ের পূর্বেই যারা প্রতিমা এনেছিল, তারাই কেবলমাত্র বিষণ্ণমনে পূজা করেছিল এবং সংক্ষেপে। বহু জায়গায় প্রবল বৃষ্টিতে, বন্যায় দুর্গামূর্তি ভেসে গিয়েছিল।
এই আশ্বিনের ঝড়ের কোনো পূর্বাভাস ছিল না। সমকালীন ইংলিশম্যান, হরকরা, বেঙ্গলি প্রভৃতি ইংরেজি পত্র-পত্রিকাগুলি ইংরেজ সরকারের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিয়ে কথা বললেও সাধারণ ভারতবাসীর ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে নীরব ছিল। ইংল্যান্ডের বহু ইংরেজি পত্রিকায় এই ঝড়ের খবর প্রকাশিত হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ১৮৬৪ সালের ১৬ নভেম্বর ফ্রান্সের ভার্সাই শহর থেকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে একটি চিঠিতে লিখেছেন : “গত ৫ই অক্টোবর যে-ভয়াবহ ঝড় আপনাদের উপর দিয়ে বয়ে গিয়েছে তার বিবরণ জেনে আতঙ্কে আমার মনপ্রাণ ভরে গিয়েছে।”২
ঝড়ের পরেই উদ্ধারকাজ শুরু হয়। স্থানীয় ইংরেজ প্রশাসন ও দেশীয় জমিদারেরা সাহায্যে তৎপর হয়ে ওঠে। তিন মাস পরে বন্যার জল কমে। সমকালে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের সহ-সভাপতি রাজা কালীকৃষ্ণ দেব সাইক্লোন-পীড়িতদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন।
দুই
১৮৬৪ সালের এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে ঘিরে পরবর্তী সময়ে ঝড়-বৃষ্টির বর্ণনা ও বিপর্যস্ত জনজীবনের অসহায় অবস্থা নিয়ে লেখা হয় একাধিক ছোট ছোট পুস্তিকা। কলকাতার চিৎপুর, গরানহাটা, বটতলার ‘হরিহর যন্ত্র’, ‘শীল এণ্ড ব্রাদার্স যন্ত্র’, ‘অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্ৰ’ থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়—মহেশচন্দ্র দের হায় রে আশ্বিনে ঝড় (১৮৬৪), মহেশচন্দ্র দাস দের হায় কি অদ্ভুত ঝড় (১৮৬৪) মহেশচন্দ্র দাস দের হায় কি অদ্ভুত শীলাবৃষ্টি (১৮৬৪), কৈলাশচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাপরে কি ভয়ানক আশ্বিনে ঝড় (১৮৬৪), ঈশ্বরচন্দ্র সরকারের মন্বন্তরের বৃত্তান্ত (১৮৬৫) প্রভৃতি পুস্তিকা।
এই পুস্তিকাগুলিতে ধরা পড়েছে সেই ভয়াবহতার কথা। আজ থেকে প্রায় একশো ষাট বছর পূর্বে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়া বাঙালি জনজীবনের অসহায়তাকে ঘিরে লেখা এই পুস্তিকাগুলিতে আসন্ন আধুনিক সভ্যতাগামী বিপন্ন পৃথিবীর পদধ্বনি শুনতে পাওয়া যায়। কবি মহেশচন্দ্র দে তাঁর হায়রে আশ্বিনে ঝড় পুস্তিকায় লিখেছেন :
“বারসত্ত একাত্তর সনে, তারিখ মাহতার বিশে আশ্বিনে, বুধবারের দিনে, বিষম তুফানে, গেল২ প্রাণ হলো তত প্ৰায়।”৩
ঝড়ে বিপর্যস্ত অবস্থা সম্পর্কে ‘মহাঝড় আরম্ভ’ কবিতায় কৈলাশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন :
“হাহাকার করি লোক ক্রন্দন করিছে। প্রাণ রক্ষা হেতু কত স্থানেতে ছুটিছে।। কেহ ঘরচাপা কেহ গাছচাপা পড়ে। দেয়াল চাপায় কেহ যমপুরে নড়ে।।”৪
ঝড় ও শিলাবৃষ্টির ভয়াবহতা সম্পর্কে কবি মহেশচন্দ্ৰ দাস দে লিখেছেন :
“শীলাঘাতে যায় প্রাণ, নাহি আর পরিত্রাণ, পড়ে যেন ভাদ্র মেসে তাল। শীল নয় নড়ামত, ধুপ২ পড়ে যত, তত পড়ে ভাঙ্গি ঘরের চাল।।”৫
‘ঝড়’-পরবর্তী সময়ের বর্ণনা করেছেন কবি কৈলাশচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায় :
“সন্ধ্যার সময় ঝড় হৈল নিবারণ। বাহির হইয়া লোকে করিছে দর্শন।। গৃহ নাই বৃক্ষ নাই সকলি আকাশ। অন্তঃকরণেতে চিন্তা হইল আকাশ।।… নিজ পল্লী দেখি লোকে চিনিতে নারয়। মাঠের সমান সেই হেন জ্ঞান হয়।”৬
প্রবল ঝড়-বৃষ্টি ও বজ্রপাতে ঠিক কত লোকের মৃত্যু হয়েছিল তার যথার্থ হদিশ পাওয়া যায়নি। তবে কৈলাশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন :
“কতঘর চাপা পড়ে মানুষ কত মরে। গণনা করিয়া ফিরে নগরে নগরে।। পঁচিশ হাজার আসিখানা খোলার ঘর। কলিকাতার মধ্যে পড়িয়াছে নিরন্তর।। পাঁচ হাজার মানুষ মারা পড়েছে তাহায়। গণনা করিয়া পাইয়াছে কলিকাতায়।।”৭
এই সাইক্লোনে শিশু ও নারীর মৃত্যু ঘটেছিল সর্বাধিক। বটতলার পুস্তিকাগুলিতে সেই করুণ হৃদয়বিদারক চিত্রের পরিচয় পাওয়া যায়—
“স্ত্রীলোকেরা ক্ষুদ্র২ পুত্র কন্যা ধরি। চালেতে বান্ধিয়াছিল অতি যত্ন করি।। যেমন আছিল বান্ধা তেমন রয়েছে। মৃত মাতা ক্রোড়ে শিশু পঞ্চত্ব পেয়েছে।।”৮
আশ্বিনের ঝড়ের প্রকোপে পূর্ববঙ্গীয় মাঝিরা তাদের জীবন-জীবিকার প্রধান অবলম্বন নৌকা, হাল, পাল হারিয়ে আক্ষেপে-দুঃখে ‘খেদের গান’ গেয়েছে। এই গানে লক্ষ্য করা যায় পূর্ববঙ্গীয় উনিশ শতকের ভাষাছাঁদের বিশেষ দৃষ্টান্ত। মাঝিদের বিষাদসংগীতে ধরা পড়েছে বিপর্যয়-পরবর্তী সাধারণ মানুষের ক্রন্দনরোল—
“আয়২ কুমুকায় ডিঙ্গাডিঙ্গি বাসেহেল ফিকরি উপায়। বাইরে হম্বল নাহিক মোদের ডিঙ্গা হেকহানি, হত্যা পীর হলা করি নিলেক তাহায়।। পোলা পুলি কি হইবে বাবি তাই মনে, হাত্তা বিনে অবে তাদের প্রাণে বাঁচাদায়।।”৯
সাইক্লোনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল গ্রামজীবন। নদীসংলগ্ন গ্রামগুলি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল। কলকাতা-সংলগ্ন নাকালী ও নারায়ণী নামে দুটি গ্রামে ব্যাপক ক্ষতি হয়। লক্ষ্মীনারায়ণপুর, শিবপুর, ধলবালিখালি, ভৈরবীতলা প্রভৃতি গ্রাম প্লাবিত হয়। জলে ভেসে যায় গৃহপালিত গবাদি পশু—
“ধলবালিখালী আদি সে ভৈরবীতলা। প্লাবিত হইয়া বোধ হৈল যেন জলা। লোকের প্রাঙ্গণে চারি পাঁচ হাত জল। গবাদি ভাসিয়া গেল হইয়া বিকল৷৷ তদন্তর মহাস্রোতে দক্ষিণ হইতে। কত শত মৃতদেহ ভাসিতে ভাসিতে।। কত স্থানে কত যায় কে করে গণন। তাহা দেখি জীবিতেরা হরষে চেতন।।”১০
ঝড়-পরবর্তী সময়ে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাল দেখা দেয়। বাজারে যে-খাদ্য পাওয়া গিয়েছিল, তার মূল্য বেড়ে দাঁড়ায় চারগুণ। কাঁচাকলা ছাড়া বাকি তরি-তরকারি অপ্রতুল হয়ে উঠেছিল। সব কলাগাছ পড়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বাজারে কলাপাতা মেলা দুষ্কর হয়। কৈলাশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন :
“বাজারের গতি দেখি লোকে চমৎকার। ঝড়ো কাঁচাকলা পড়ে আছরে অপার।। আর কোন তরকারি মেলা হৈল ভার। যদি মেলে বহুমূল্য মূল্য হয় তার।। সহরেতে কলাপাতা খুঁজিয়া না পায়। শারদীয়া পূজাকর্ত্তা তাহাতে ডরায়।। মনে ভাবে এবারেতে বুঝি মান যায়। কলাপাতা না পাইলে লোকে কিসে খায়।। যদি কেহ পায় পাতা বহু অন্বেষিয়া। টাকায় দুকুড়ি করি লইল কিনিয়া।।”১১
আশ্বিনের ঝড়ে বিশেষত ধানচাষে ব্যাপক ক্ষতি হয়। সব ধান নষ্ট হয়ে যায়। সবজিচাষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বাধ্য হয়ে সাধারণ মানুষ ঘূর্ণিঝড়ে পড়ে যাওয়া ফলমূল, গাছ-পাতা খেয়ে কিছুদিন অতিবাহিত করে। ক্রমে তার জোগানও ফুরিয়ে যায়। এরপর বাংলায় দেখা দেয় খাদ্যের আকাল, শুরু হয় হাহাকার। চালের দাম হয় দ্বিগুণ। যে-চালের মূল্য দেড় টাকা মন ছিল, তা গিয়ে দাঁড়ায় তিন টাকায়৷ অগ্নিমূল্য হয় মাছের দাম। তেঁতুলের দাম হয় চার আনা কিলো। ভোজ্য তেল ও ঘি সমান দরে উন্নীত হয়। কাপড়ের দাম বাড়ে বহুগুণ। ময়দার দাম হয় আকাশছোঁয়া। এই বহুমূল্যের বাজারে ধনীরা দুর্ভিক্ষের কষ্ট তেমন অনুভব করেনি, কিন্তু দরিদ্র ও মধ্যবিত্তের জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল—
“কোন দ্রব্য নাহি ছিল সুমূল্য তখন। ঝড়ের কৃপায় এত ঘটে অঘটন।।”১২
যেকোনো বিপর্যয়ে এক শ্রেণির মানুষ লুণ্ঠনে প্রবৃত্ত হয়, ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সম্পদ সংগ্রহে লিপ্ত থাকে। এক্ষেত্রেও দেখা যায়, জলে ভেসে আসা মূল্যবান সামগ্রী সংগ্রহে এবং উন্মুক্ত ভাঙা ঘরে মূল্যবান সামগ্রী চুরি করে রাতারাতি কেউ কেউ অর্থবান হয়ে উঠেছে।
আশ্বিনের এই ঝড় দেশীয় অর্থনীতিতে ধস নামিয়েছিল। সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ জীবনরক্ষার্থে জীবিকার পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিল। চাষি লাঙল ছেড়ে অন্য জীবিকায় অগ্রসর হতে বাধ্য হয়—
“কত বেটা চাসা চলে লাঙ্গল ছাড়িয়া। ঘরামি হইতে যায় হাতে দা করিয়া।।”১৩
সেকালের গ্রাম-মফস্সলে ও কলকাতায় আশি-নব্বই শতাংশ বাড়ি ছিল মাটির দেওয়াল ও খোলার ছাউনি দেওয়া। এই প্রবল ঝড়ে এইসব বাসস্থানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। ফলে ঘর ছাউনির টালির চাহিদা বেড়ে যায়। খোলার দাম বেড়ে হয়েছিল—দশ হাজার টাকা। ঘর পুনর্নির্মাণের জন্য শ্রমিকেরা তাদের মজুরি বহুগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল। কবি কৈলাশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন—
“নিপুণ আছিল যারা ঘরামি কর্ম্মেতে। গুমরি মরে তাদের পদ না পড়ে ভূমেতে।।”১৪
আশ্বিনের ঘূর্ণিঝড়ে শহরের বহু ইমারতের ক্ষয়-ক্ষতি হয়। তার মধ্যে কলকাতার ব্রাহ্ম সমাজের উপাসনালয় অন্যতম। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্ববোধিনী পত্রিকায় প্রকাশিত ‘বিজ্ঞাপন’ অংশে এর সাক্ষ্য মেলে—
“আশ্বিন মাসের প্রবল ঝড়েতে কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজ গৃহ এরূপ ভগ্ন হইয়াছে যে, সংস্কার না করিলে আর ব্যবহারের উপযোগী হইতে পারে না। এবার সংস্কার করিতে ন্যূনাধিক ২৫০০ টাকা লাগিবে। অতএব বিজ্ঞাপন দিতেছি যে কলিকাতা ব্রাহ্মসমাজের প্রতি যাঁহাদের স্নেহ আছে, ও ইহাকে রক্ষা করা যাঁহারা কর্ত্তব্য বোধ করেন; এই সময়ে তাঁহারা সাহায্য করিবেন।”১৫
বটতলার পুস্তিকা সূত্রে জানা যায়, কলকাতার জোড়বাংলার জোড়া মন্দির ঝড়ে পড়ে যায়। সেই মন্দিরে চাপা পড়ে বেশ কিছু মানুষের মৃত্যু ঘটে। ঝড়ের তীব্রতায় গ্যাসের বাতি, টেলিগ্রাফ, টেলিফোনের খুঁটি উপড়ে পড়ে, রেলগাড়ি লাইনচ্যুত হয়—
“কোন শকটের ছাদ উড়িয়া পড়িল। কোন শকটের কোন অংশ যে ভাঙ্গিল।। ইছাপুর সন্নিকটে যখন আসিল। মহা ঝড়ে আপনা আপনি বন্ধ হৈল।। রেলের বাহিরে গাড়ী ঝড়েতে পড়িল। কত লোকে কত রূপে আঘাত লাগিল।। ভয় পায়ে কত লোকে ছুটিয়া পলায়। তাহাদের কষ্ট যত কহনে না যায়।। কেহ অচৈতন্য হয়ে গাড়ী মধ্যে রয়। চাপরাসি আসি শেষে বাহির করয়।।”১৬
আশ্বিনের ঝড়ের তাণ্ডবে কলকাতা বন্দরের বহু জাহাজ নোঙর ছিঁড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ব্যাপক ক্ষতি হয় কাশীপুর, চাঁদপাল বন্দর এলাকায়। চাঁদপাল বন্দর ছিল কলকাতা নগরীর শোভা। নাট্যকার দীনবন্ধু মিত্র এই বন্দরের বর্ণনায় লিখেছেন : “এই চাঁদপালঘাট সোপান সুন্দর,/ দেখ দেখ নগরীর শোভা মনোহর।”১৭ আশ্বিনের ঝড়ে এই বন্দর ক্ষতিগ্রস্ত হয়। মাঝগঙ্গায় ভরাডুবি হয় একাধিক জাহাজ ও নৌকার—
“কলিকাতা রাজধানী খ্যাত ত্রিসংসার। জাহাজ থাকয়ে তথা হাজার হাজার।। মহাঝড়ে নোঙ্গরাদি সকল ছিঁড়িয়া। ঘূর্ণমানে ঝড়ে-ভরে চলিল ভাসিয়া।। কত তেজে যায় সেই কহনে না যায়। সম্মুখেতে কত নৌকা চূর্ণ হয়ে যায়।।”১৮
কলকাতা বন্দরের একাধিক পণ্যবাহী ও যাত্রিবাহী জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ডুবে গিয়েছিল বহু জাহাজ। ঝড়-পরবর্তী সময়ে উদ্ধারকার্যে নেমেছিল বহু ইংরেজ—
“ভীষ্মজননীর তীরে, গৌরাঙ্গেরা ধীরেখ, আসে যায় অসংখ্য গণন। যথা জাহাজ ডুবিল, কিম্বা কোথা আট্কাইল, সদা তাঁরা করে অন্বেষণ।।”১৯
বঙ্গোপসাগরের উপকূল-বর্তী বন্দর-শহর ডায়মন্ডহারবার অঞ্চলে প্রচুর ক্ষতি হয়েছিল। এখানকার ফৌজদারি আদালত, মোক্তারের ঘর, আমলাদের থাকার ঘর, ডিস্পেন্সারি, জেলখানা, টেলিগ্রাফ অফিস, ডাকঘর এবং বহু ইংরেজ কোয়ার্টার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুর্যোগের সুযোগে পালিয়ে গিয়েছিল বন্দি কয়েদি। খালে থাকা ছোট নৌকা সব ডুবে গিয়েছিল। সেকালের প্রসিদ্ধ জাহাজ ‘বেন্টিং’ নোঙর ছিঁড়ে মাঝগঙ্গায় চলে যায়। পাঁচশো কুলি নিয়ে একটি জাহাজ কলকাতা থেকে অন্যত্র যাত্রা করছিল। কুলপি বন্দরে এসে জাহাজটি জলমগ্ন হয়ে ডুবে যায়। এই দুর্ঘটনায় তিনজন মাত্র প্রাণে রক্ষা পায়। এছাড়া করঞ্জলি, চাঁদনগর, জয়নগর প্রভৃতি অঞ্চলে ব্যাপক ক্ষতি হয়। কৈলাশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন :
“চোরমল্ল করঞ্জলী কুলপী যে খ্যাত। প্যাঁচাকুলী পরগণা দেরে সবে জ্ঞাত।। আদি সে চাঁদনগর জলমগ্ন হয়। বহু লোক পশু পক্ষী পরাণ ত্যজয়।। জয়নগরের এক যোজন দক্ষিণ। এ পর্য্যন্ত জল এসেছিল সেই দিন।”২০
আশ্বিনের ঝড় থেমে যাওয়ার তিন-চারদিন পর থেকে দেখা দেয় অন্য এক সংকট। পথে-ঘাটে, নর্দমায়, খালে-বিলে জমা জলে লতা-পাতা, পশুপাখির পচাগলা দেহ দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। নর্দমা ও খাল-বিলের জমা জল দূষণসংকটকে ঘনীভূত করে তোলে—
“ডায়মণ্ড হারবার, আদি যতেক নগর, বানেতে যে প্লাবিত হইল। ক্রমে জল শুকাইল, ভূমি সব প্রকাশিল, নিম্নস্থানে কিঞ্চিৎ রহিল।। সেই জল যেই জন, ভাঙিয়া করে গমন, পশ্বাদির চর্ব্বি লাগে পায়। হড় হড় করে পদ, সে ভাবে এ কি বিপদ, জর জর হয় সে ঘৃণায়।। জীবিতাবশিষ্ট লোকে, ক্ষুধায় তৃষ্ণায় শোকে, হইয়া আছিল মৃত প্রায়।”২১
জলদূষণ ও মশার প্রকোপে সাধারণ মানুষের জীবন জেরবার হয়ে যায়। রোগে শোকে কাতর হয়ে ওঠে সাধারণ মানুষ—
“তিন চারি দিন ঝড় হইলে বিগত। দুর্গন্ধ হইল অতি সলিল তাবত।। লতা পাতা জলে পড়ি এমন পচিল। জল সব কালিবৰ্ণ হইয়া উঠিল।। বায়ুভরে পচাগন্ধ চতুৰ্দ্দিকে ধায়। তিষ্ঠিতে না পারে কেহ দুর্গন্ধের দায়।। পচা জল পানে কেহ অসুস্থ হইল। কেহ রোগ ভোগে কেহ পঞ্চত্ব পাইল।।… মশক জন্মিল কত না হয় নির্ণয়। বোধ হয় পূর্ব্বাপেক্ষা শতগুণ হয়।।তাদের কামড়ে লোকে ছটফট করে। দ্বিজ কহে কেন দুর্গে এত দুঃখ নরে।।”২২
এই ঝড়ের প্রাদুর্ভাবকে সাধারণ মানুষের জীবনাচরণজনিত পাপের ফল বলে মনে করেছেন কবিরা। এই কালে লাম্পট্য, ব্যভিচার, অখাদ্য ভক্ষণ, মদ্যপান, ধর্মান্তরণ প্রভৃতি বিষয়কে অবলম্বন করে লেখা একাধিক প্রহসনে কবিরা বাঙালির অধঃপতনকে চিহ্নিত করেছিলেন। সমাজপতিরা একে সমাজ-অধঃপতনের সূচক হিসাবে দেখেছিলেন। এই উচ্ছৃঙ্খলতাকে কলির পাপ বলে বিবেচনা করেছেন বটতলার লেখকেরা।
কবিরা পৌরাণিক অনুষঙ্গে শিব-দুর্গার কথোপকথনের মধ্য দিয়ে মর্তবাসীর পাপাচারের কথা বলেছেন। পৃথিবীর বুকে সৃষ্ট ঝড়-সাইক্লোনকে তাঁরা হর-গৌরীর কলহ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। কবি কৈলাশচন্দ্ৰ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন :
“হর কন শুন দুর্গে আমার বচন। এবারেতে অনুমতি না দিব কখন।।”২৩
এর কারণ—
“আরো দেখ পৃথিবীতে নরগণ যত।/ ধর্ম্মেতে বিরত হয়ে অধর্ম্মেতে রত।।/ কর্ম্ম কাণ্ড করে পণ্ড কিছুই না মানে৷/ লজ্জা নাহি হয় তব যাইতে সেখানে।।/ এইরূপে কলহ হইল দুই জনে।/ ঈশ্বর ঈশ্বরী বার্ত্তা দ্বিজবর ভণে।।”২৪
দুর্গা শিবের আজ্ঞা অমান্য করে মর্তে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলে শিব-জটায় ঝড় এবং মেঘের উৎপত্তি হয়। সেই মেঘ পৃথিবীতে ঝড়-বৃষ্টি, সাইক্লোন ঘটায়। যেভাবে অতীতে পৃথিবীর বহু দেশে, বিশেষত গ্রিস দেশের পুরাকথায়, নাটকে, আখ্যানে মড়ক ও প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে দেবতার ক্রোধ হিসাবে দেখানো হয়েছিল, অনুরূপভাবে বাংলার কবিরা দেবতার ক্রোধ হিসাবে এই ঝড়কে প্রতীকায়িত করেছেন।
কবিতায় দেখা যায়, গৌরীর কাতর স্তবে সন্তুষ্ট হয়ে মহাদেব মর্তে উপনীত হয়েছেন এবং ঝড় নিবারণ করেছেন—
“হরিষেতে দিগম্বর, আরোহিয়া বৃষোপর, তারিণীরে দেন দরশন।। শিবে দেখি হৈমবতী, করিয়া পদে প্রণতি, কহিছেন ওহে দয়াময়। ক্ষমা করি মম প্রতি, হর মহীর দুর্গতি, নরে রক্ষ হইয়া সদয়।। শুনি বাণী যায় রোষ, আশুতোষ আশু তোষ, তখনি নাশেন দুঃখচয়। ঝড় হৈল নিবারণ, বাঁচিল মানবগণ, নাশ পায় মরণের ভয়।।”২৫
অপর এক কবি মহেশচন্দ্র দাস হায় কি অদ্ভুত শীলাবৃষ্টি পুস্তিকায় জানিয়েছেন, শিবের প্ররোচনায় মর্তে ঝড়ের প্রাদুর্ভাব ঘটেছে—
“কোপ মতি, কলির নরগণ প্রতি, ঝড়ে আজ্ঞা দিলেন শঙ্কর। দেবী পূজার পূর্ব্ব দিনে, আজ্ঞা দিলেন পবনে, ঝড় করিবারে নিরন্তর।। লয়ে শত কোটি সৈন্য, অবনীতে অবতীর্ণ, ঝড়ারম্ভ করিল পবন। প্রলয় করেন ঝড়, বৃক্ষ ভাঙ্গে মড় মড়, কত জীবের বধিল জীবন।।”২৬
এছাড়া কবিরা কাহিনি পরম্পরায় ব্রহ্মা ও নারদ প্রসঙ্গকে টেনে এনেছেন। ব্রহ্মলোকে নারদ মুনি ব্রহ্মাকে জিজ্ঞাসা করেন—কী কারণে এই ঝড়? ঝড়ের কারণ হিসাবে এখানে মানুষের অনাচারকে দায়ী করা হয়েছে।
ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্রে বলা হয়েছে, যে-বছরে শূন্য আছে সেই বছরে মহাজাগতিক বিপর্যয় সংঘটিত হতে পারে। কিন্তু তা সত্ত্বেও শূন্যহীন ১২৭১ বঙ্গাব্দে এই প্রাকৃতিক বিপর্যয় উপস্থিত হয়েছিল—
“ছিল আশা শূন্যনাশা এ সাল সুন্দর। দুঃখরাশি সর্ব্ব নাশি সুখী হবে নর।।”২৭
কবিরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন—আগামী দিনেও এমন বিপদ আসতে পারে। সাধারণ মানুষকে সতর্ক করে দিয়ে বটতলার কবিরা লিখেছেন :
(ক) “কেহ বলে পুনর্ব্বার, হইবে ঝড় দুব্বার, গণকেতে বলিল গণিয়া। কার্ত্তিক মাসের ষষ্ঠে সে দিন কাটিলে কষ্টে, তবে সবে যাইবে বাঁচিয়া।। আরো কর নিরীক্ষণ, কোদালে কুড়ুলে ঘন, আকাশেতে হয়েছে উদয়। অব্যর্থ এ মেঘচয়, ইহাতে প্রলয় হয়, এই বাক্য কভু মিথ্যা নয়।।”২৮
(খ) “আরো শুনা যাইতেছে অপূৰ্ব্ব কথন। ভয়ানক ধূমকেতু উঠিবে গগণ।। সূর্য্যের অপেক্ষা তেজঃ হইবে প্রচণ্ড৷ সেই মহাতেজে পৃথ্বী হবে লণ্ডভণ্ড।। সত্য মিথ্যা ধৰ্ম্ম জানে হৈল জনরব। বৎসরের গতি দেখি হয় যে সম্ভব।।”২৯
১৮৬৪ সালের প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি ও ভয়াবহ দুঃখ-বেদনার স্মৃতি কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই ১৮৬৬ সালের নভেম্বর মাসে (১৬ কার্তিক, শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে) কলকাতা ও উপকূলবর্তী মেদিনীপুর, ওড়িশা অঞ্চলে আবার অনুরূপ ঝড়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিয়েছিল। তাতে আবারও আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয় বহু মানুষকে। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে লেখা হয় বেশ কিছু ছোট ছোট গদ্য-পদ্য পুস্তিকা। বস্তুতপক্ষে বটতলার এই পুস্তিকাগুলিতে প্রায় একশো ষাট বছর পূর্বের ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষের সাইক্লোন-জনিত প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে যেমন চিত্রিত করা হয়েছিল, তেমনি আগামী পৃথিবীর গভীর অসুখকে চিহ্নিত করতেও কবিরা সক্ষম হয়েছিলেন। এই পূর্বাভাস আমাদের মনে বিস্ময় জাগায়।
তথ্যসূত্র
১ শ্রীম-কথিত, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৯৭, অখণ্ড, পৃঃ ৮৬০-৮৬১
২ রায়, সুশীল (অনুবাদ ও সম্পাদনা), মাইকেল মধুসূদন দত্তের পত্রাবলী, এম সি সরকার এণ্ড সন্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, পৃঃ ১৪৭-৪৮
৩ দে, মহেশচন্দ্র, হায় রে আশ্বিনে ঝড়, হরিহর যন্ত্রে মুদ্রিত, চিতপুর রোড বটতলা, কলিকাতা, ১৭৮৬ শকাব্দ, পৃঃ ১
৪ বন্দ্যোপাধ্যায়, কৈলাশচন্দ্র, বাপরে কি ভয়ানক আশ্বিনে ঝড়, নৃত্যলাল শীল, কলিকাতা, ১২৭১, পৃঃ ৬
৫ দাস দে, মহেশচন্দ্র, হায় কি অদ্ভুত শীলাবৃষ্টি, হরিহর যন্ত্রে মুদ্রিত, চিৎপুর রোড বটতলা, ১৭৮৬ শকাব্দ, পৃঃ ৫
৬ বাপরে কি ভয়ানক আশ্বিনে ঝড়, পৃঃ ১৭
৭ হায় রে আশ্বিনে ঝড়, পৃঃ ৯-১০
৮ বাপরে কি ভয়ানক আশ্বিনে ঝড়, পৃঃ ১২
৯ হায় রে আশ্বিনে ঝড়, পৃঃ ২
১০ বাপরে কি ভয়ানক আশ্বিনে ঝড়, পৃঃ ১৪
১১ ঐ, পৃঃ ১৮-১৯
১২ ঐ, পৃঃ ২০
১৩ দাস দে, মহেশচন্দ্র, হায় কি অদ্ভুত ঝড়, গরাণহাটা স্ট্রীটে ৯২ নং ভবনে অ্যাংলো ইণ্ডিয়ান ইউনিয়ন যন্ত্রে মুদ্রিত, কলিকাতা, ১২৭১ বঙ্গাব্দ, পৃঃ ১১
১৪ বাপরে কি ভয়ানক আশ্বিনে ঝড়, পৃঃ ১৮
১৫ তত্ত্ববোধিনী পত্রিকা, ১৮৬৪, পৃঃ ২০২
১৬ বাপরে কি ভয়ানক আশ্বিনে ঝড়, পৃঃ ৭
১৭ দীনবন্ধু রচনা সংগ্রহ, সাক্ষরতা প্রকাশন, পশ্চিমবঙ্গ নিরক্ষরতা দূরীকরণ সমিতি, কলকাতা, ১৯৭৩, পৃঃ ৪৯১
১৮ বাপরে কি ভয়ানক আশ্বিনে ঝড়, পৃঃ ৮
১৯ ঐ, পৃঃ ২২
২০ ঐ, পৃঃ ১৩
২১ ঐ, পৃঃ ২২
২২ ঐ, পৃঃ ১৯-২০
২৩ ঐ, পৃঃ ৩
২৪ ঐ, পৃঃ ৪
২৫ ঐ, পৃঃ ১৬
২৬ হায় কি অদ্ভুত শীলাবৃষ্টি, পৃঃ ২-৩
২৭ বাপরে কি ভয়ানক আশ্বিনে ঝড়, পৃঃ ২৩
২৮ ঐ
২৯ ঐ, পৃঃ ২৪
ভ্রম সংশোধন
গত ফাল্গুন ১৪২৯ সংখ্যার ১৭৩ পৃষ্ঠার ১ম স্তম্ভের ১৮ পঙ্ক্তিতে ‘১৯২৮’-এর পরিবর্তে ‘১৯১৮’ হবে।