বেশ কয়েক বছর যাবৎ পূজ্যপাদ স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজের সেবা করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সেই সুবাদে তাঁর সঙ্গে দেশ-বিদেশের বহু আশ্রমে ও বিভিন্ন স্থানে যাওয়ার সুযোগ হয় এবং ফলত বর্ণময় নানান স্মৃতিসঞ্চয়ন হয়। অপূর্ব সব ঘটনা! তেমনি কয়েকটি ঘটনার কথা বলব।


দীক্ষার বিষয়ে বলা হয়, প্রত্যেকেরই গুরু নির্দিষ্ট থাকেন। সময় হলেই সব বাধা-বিপত্তি দূর হয়ে যায়। একবার মহারাজ অসমে গিয়েছেন সেখানকার বিভিন্ন প্রাইভেট আশ্রমে দীক্ষা দিতে। সেই উদ্দেশ্যে এসেছেন ডিগবয় আশ্রমে। পূজনীয় দেবেশ মহারাজ ঐ আশ্রমে থাকতেন। একদিন বিকালে মহারাজ হাঁটতে গেছেন চা-বাগানে। ফেরার পথে দেখা গেল, এক মাতাল গাড়ির ডিকির ওপর বেহুঁশ হয়ে পড়ে আছে, কিছুতেই নড়ছে না! ওদিকে সন্ধ্যা হয়ে আসছে, আশ্রমে ফিরে আসতে হবে। ড্রাইভার গাড়ির হর্ন বাজালে সে আরো ক্ষেপে উঠে বলতে থাকে : “পিঁ পিঁ করলে কেন?” সে সরবে না, কারণ তার সম্মানে আঘাত করা হয়েছে। আমরা অন্য একটা গাড়িতে মহারাজকে নিয়ে আশ্রমে চলে এলাম, বাকিরা মাতালকে সামলে একটু দেরিতে আশ্রমে ফিরে আসে। যিনি গাড়ির মালিক, তিনি স্থানীয় কলেজের অধ্যাপক। তাঁর একরত্তি ছোট্ট একটি মেয়ে ছিল। মহারাজের কাছে অবাধ তার আসা-যাওয়া। একদিন সে মহারাজকে ধরে বসল দীক্ষা নেবে বলে। মহারাজ তাকে বোঝালেন : “তুমি এখন অনেক ছোট, বড় হও; তারপর দীক্ষা নেবে। এখন তুমি দীক্ষার মন্ত্র মনে রাখতে পারবে না, ভুলে যাবে।” সে বলে বসল : “তবে বল, আমি বড় হলে আমায় দীক্ষা দেবে।” মহারাজ ‘তাই হবে’ বলায় সে তখন নিরস্ত হলো। অদৃষ্টের এমন খেলা, সেই মেয়ে বড় হয়ে কলকাতায় এসেছে বাবার সঙ্গে এক পারিবারিক অনুষ্ঠানে। তার বাবা দীক্ষিত ভক্ত, স্বাভাবিকভাবেই তিনি মঠে এসেছেন ঠাকুর, মা, স্বামীজী এবং মহারাজকে প্রণাম করতে। সঙ্গে তাঁর কন্যাও। মহারাজের কাছে এসে সে দীক্ষার কথা মনে করিয়ে দেয়। এমনই কপাল তার, পরদিনই ছিল দীক্ষার দিন। সেদিন তারও দীক্ষা হয়ে গেল।


কত সহজে মেয়েটির দীক্ষা হয়ে গেল, অথচ যার হওয়ার নয় তাকে সাধাসাধি করেও দীক্ষার জন্য রাজি করানো যায় না! তেমন একটি ঘটনা মনে পড়ছে। একবার শান্তিনিকেতন থেকে একটি মেয়ে এসেছে তার দীক্ষা কবে হবে তা জানার জন্য। তখন মহারাজের শরীর প্রায়ই খারাপ থাকত। অনেকদিন হয়ে গেল অথচ দীক্ষার দিন পাচ্ছে না বলে সে মঠে খবর নিতে এসেছে। আমি বললাম—তোমার দীক্ষার ফর্ম ফিলাপ করা আছে? সে ‘হ্যাঁ’ বলাতে আমি নাম ইত্যাদি জিজ্ঞেস করে দেখলাম, সব ঠিকই আছে। তাকে বললাম—আগামিকালই দীক্ষা আছে, চাইলে তোমার কালই দীক্ষা হয়ে যাবে। সে বলল—না, সে প্রস্তুত হয়ে আসেনি, সঙ্গে টাকা-পয়সাও বেশি নেই এবং এখানে তার থাকার জায়গাও নেই ইত্যাদি। আমি বললাম—তোমাকে ওসব ভাবতে হবে না, সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। সে বলল—আলাদা কাপড় আনেনি। আমি আবারও বললাম—তারও ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তখন বলল—বাড়িতে বলে আসেনি। আমি বললাম—তুমি এখান থেকে ফোন করে বলে দাও, দীক্ষার জন্য যা যা লাগবে আমি তার ব্যবস্থা করছি। তুমি শ্রীশ্রীমায়ের প্রসাদি শাড়ি পরে দীক্ষা নেবে, প্রণামির টাকা ইত্যাদি যা লাগবে এখান থেকে দেওয়া হবে, বাড়ি ফিরে গিয়ে সুবিধামতো তা ফেরত দিলেই চলবে। এতসব বলার কারণ, পূজনীয় মহারাজের শরীর প্রায়ই খারাপ থাকে বলে দীক্ষাও বন্ধ হয়ে যায়। যেহেতু সে দূর থেকে এসেছে আর সব তৈরি আছে, তাই তাকে একটা সুযোগ করে দেওয়া। কিন্তু এতসব বলার পরও সে দীক্ষা নিতে রাজি হলো না, বাড়ি চলে গেল। তার আর মহারাজের কাছে দীক্ষা নেওয়া হয়নি।


আরেকটা ঘটনা। ডিগবয় আশ্রমে গেছেন পূজনীয় মহারাজ। ওখানে এক ক্যান্সারের রোগীকে উনি দীক্ষা দিয়েছিলেন হাসপাতালে। তিনি টেলিফোন এক্সচেঞ্জে কাজ করতেন। তাঁর এক সহকারী, থাকেন ডিব্রুগড়ে, আমাকে বারবার বলছেন—মহারাজকে উনি দেখতে চাইছেন, যদি মহারাজকে হাসপাতালে আনা যায়। আমি বললাম—না। হাসপাতালে গিয়ে আবার কোনো সংক্রমণ নিয়ে আসবেন না কি? এখন হবে না। ভদ্রলোক কিন্তু নাছোড়বান্দা! প্রণামের সময় মহারাজকে তিনি অনুরোধ করে বসলেন। মহারাজ এককথায় রাজি হলেন। আমাকে ডেকে বললেন : “একটি রোগী আছে, আমাকে দেখতে চাইছে। কখন যাব বল।” আমি তো কটমট করে ভদ্রলোকের দিকে তাকাচ্ছি। মনে মনে বলছি—না করে দিলাম আর তুমি গিয়ে ওখানে বলে দিয়েছ?


পরের দিন বিকালে যাওয়া হলো। তাঁর গলায় ক্যান্সার। পুরো গলাটার প্রায় কিছুই নেই, একটা পাইপ ঢুকিয়ে রেখেছে। কোনোমতে খসখস করে শব্দ হচ্ছে, শ্বাস নিচ্ছেন। চেহারা খুব খারাপ, কিন্তু সেন্স আছে। তিনি বোঝাতে চাইছেন যে, এখন দীক্ষা নিতে চান। আমি তো মহাবিপদে পড়ে গেলাম! এখন মহারাজ কী করবেন কে জানে! তারপর দেখি উনি গুটি-গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছেন রোগীর কাছে। আমি তাঁর হাত ধরে রেখেছি। উনি বললেন : “ধরে রেখেছ কেন? ধরে রাখার কিছু নেই। আমি যাচ্ছি ওর কাছে।” আমি তখন বুঝে নিলাম—মহারাজ তাঁকে দীক্ষা দিয়েই ছাড়বেন! আমার কাছে গঙ্গাজল চাইলেন এবং রোগীর গায়ে-মাথায় নিজেই গঙ্গাজল ছিটিয়ে ঠাকুরের মন্ত্র দিলেন। দেখলাম, রোগীর মুখটি আনন্দে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠেছে। মহারাজ তাঁর মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে আশ্রমে চলে এলেন। রাস্তায় কোনো কথা হলো না। পরে মহারাজ বললেন : “দেখ, এর ভাগ্যে ঠাকুরের কৃপা ছিল, তাই এভাবে তার দীক্ষা হয়ে গেল।” মহারাজকে বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিল। আমার মনে হলো, ভদ্রলোককে দীক্ষা দিতে পেরে মহারাজ খুব তৃপ্তি অনুভব করেছেন।


দীক্ষার প্রসঙ্গে কালীদা মহারাজের (স্বামী আদিনাথানন্দ) কথা মনে পড়ছে। তিনি মায়ের কাছ থেকে মন্ত্রদীক্ষা পেয়েছিলেন। মা তাঁকে দুখানা মন্ত্র দিয়েছিলেন। মা যতদিন স্থূলদেহে ছিলেন, ততদিন তাঁর মনে কোনো প্রশ্ন ওঠেনি, কিন্তু যখন মায়ের শরীর চলে গেল, তার বেশ কিছুদিন পরে শরৎ মহারাজের সঙ্গে তিনি দেখা করলেন। বললেন : “মহারাজ, মা আমাকে দুটো মন্ত্র দিয়েছিলেন। তা আমি এখন দুটো মন্ত্র জপ করতে পারছি না। আপনি ঠিক করে দিন কোনটা জপ করব।” শরৎ মহারাজ স্বাভাবিকভাবেই বললেন : “মা মন্ত্র দিয়েছেন যেখানে, সেখানে আমি ঠিক করব? এটা কখনোই সম্ভব নয়। তুমি মাকে জিজ্ঞেস করলে না কেন? আমি কিছু করতে পারব না।” কালীদা মহারাজ কী করবেন, চলে গেছেন। কদিন পরে আবার এসেছেন। ঐ একই কথা। এরকম দু-তিনবার হওয়ার পরে শরৎ মহারাজ একদিন বললেন : “তোমার মন্ত্র-দুটি কী বল শুনি।” শুনে অনেকক্ষণ চুপ থেকে বললেন : “তুমি এই মন্ত্রটা জপ করবে।” কালীদা মহারাজ জানতে চাইলেন : “অন্য মন্ত্রটা বিসর্জন দিয়ে দেব?” মহারাজ বললেন : “না, কোনো দরকার নেই। যদি মনে হয় যে, ওটা জপ করতে পার জপ করবে। কিন্তু এটা বাদ দেওয়ার কোনো প্রশ্ন নেই। তুমি এটাকেই জপ কর।” সেই হিসাবে উনি শরৎ মহারাজকেও গুরু বলে মনে করতেন।


একবার আমি স্বামী ভূতেশানন্দজীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম—কামাখ্যায় গেলে পাণ্ডারা বলে মায়ের স্থানে স্পর্শ করে প্রণাম করতে। তীর্থস্থান হিসাবে মায়ের ওখানে জননেন্দ্রিয় পড়েছিল। আমরা সন্তানের মতো যাচ্ছি, সেখানে হাত দেব কী করে! মহারাজ এর ব্যাখ্যা দিলেন। তিনি বললেন : “দেখ, যারা যাচ্ছে—গড্ডালিকার মতো যাচ্ছে। গিয়ে ভাবছে, ওখানে হাত দিলেই তাদের যাওয়ার উদ্দেশ্য সার্থক হয়ে গেল! কিন্তু কী করল, কেন করল তার যদি মানেটা জানা না থাকে তাহলে যাওয়ার সার্থকতা থাকে না। হাত দেওয়া, জল তোলা, মুখে দেওয়া, মাথায় দেওয়া—এই পর্যন্ত হয়ে থাকবে! তাহলে মানেটা কী? মানেটা হচ্ছে এই যে, তাঁর কাছে তখন প্রার্থনা করতে হয় যাতে যে-পথে আমাদের জন্ম, এই পথে যেন আমাদের আর আসতে না হয়; তিনি কৃপা করে আমাদের এই যাওয়া-আসা বন্ধ করুন। এই উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করা। এর জন্য আগে প্রস্তুতি চাই। কিন্তু ওখানে যাওয়ার পরেই তো তোমাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবে! প্রার্থনা করবে কখন? কাজেই তোমাকে আগে থেকে জিনিসটা ভেবে নিতে হবে।”


ডিব্রুগড় আশ্রমে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল। সেসময় একটা লম্বা ঘর ছিল, ঘরটার ভিতরে পার্টিশন করা। আমরা এই পার্টিশনের ভিতরে থাকতাম। মহারাজের আলাদা একটা ঘর ছিল। ঐ ঘরেরই আরেকটা অংশে দীক্ষা হতো। সেখানে ইঁদুরের খুব উপদ্রব, সেটা আমরা জানতাম না। মহারাজের ওষুধ সেবকরা গুছিয়ে ড্রয়ারে রেখেছে, হার্টের ওষুধ সব। কী করে ড্রয়ারের ভিতরে একটা ইঁদুর ঢুকে গেছে। কিছু না পেয়ে সে যত ওষুধ ছিল সব খেয়েছে। পরের দিন মহারাজ যখন ব্রেকফাস্টে বসেছেন, ড্রয়ার খুলে ওষুধটা বের করতে গিয়ে দেখি—কোনো ওষুধের চিহ্ন নেই। মহারাজ শুনে বললেন : “ও তাই নাকি! সে যাই হোক, আমি তো এখনো বেঁচে আছি, কিন্তু যে-ইঁদুরটা এই হার্টের ওষুধ খেল—সে বেঁচে আছে কি? তার কী হলো?” তারপর কলকাতা থেকে দ্রুত ওষুধ আনানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

একবার ইটানগরের প্রীতি মহারাজ আমন্ত্রণ করেছিলেন। তিনি যখন আমন্ত্রণ করলেন, তখন মহারাজ বললেন : “একটা শর্তে যাব। আমাকে মিথুন (পাহাড়ি স্তন্যপায়ী পশু-বিশেষ) দেখাতে হবে। মিথুনের নাম শুনেছি কিন্তু দেখিনি।” উনি জানালেন—হয়ে যাবে। কিন্তু মহারাজ তো উঠেছেন ইটানগরে, সেখানে মিথুন কোত্থেকে আসবে? মিথুন থাকে গ্রামের দিকে। মিথুন দেখার জন্য মহারাজকে একটা গ্রামে নিয়ে যাওয়া হলো। সেখানে আদিবাসীরা থাকে। তারা মহারাজকে খুব ভাল করে সংবর্ধনা দিল। মিথুন ধরেও নিয়ে এল, তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আলোর ব্যবস্থা পর্যাপ্ত না থাকায় মহারাজ ওটিকে ভাল করে দেখতে পেলেন না। প্রীতি মহারাজকে বললেন যে, অন্তত একটা হ্যাজাক রাখলে এটা দেখা যেত। কিছুই বোঝা গেল না। কী এটা? একটা প্রাণী—এই পর্যন্ত। কী আর করবেন, বারে-বারে মহারাজ এটাই বলছেন : “ধুর, কী দেখালে তুমি একটা! মিথুনটা দেখতে পেলাম না।”


এরপর স্বামী গৌতমানন্দজী পূজনীয় মহারাজকে আমন্ত্রণ করলেন আলং মঠে। তখন বায়ুদূত সার্ভিস ছিল। বায়ুদূত আঠারো সিটের ছোট বিমান। একসময় বায়ুদূত খুব চলছিল উত্তর-পূর্ব ভারতে। এটা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের একটা শাখা। এখন এটা উঠে গেছে। মহারাজ বলেছিলেন : “ঐ রাস্তা ভেঙে আমি যেতে পারব না, অন্য কোনো উপায় হলে তখন দেখা যাবে।” তারপর বায়ুদূতের ব্যবস্থা করা হলো, কিন্তু সাত দিন আলঙে থাকতে হবে। বায়ুদূত সাতদিনে একদিন। নামিয়ে দিয়ে সে চলে গিয়ে আবার সাত দিন পরে এসে নিয়ে যাবে। মহারাজ রাজি হয়ে গেলেন—উপায় যেহেতু নেই। এত দূরে আশ্রম হচ্ছে, আশ্রমটা দেখার ইচ্ছে হয়েছে। আমি শুধু ভাবছিলাম যে, মহারাজকে এতদিন কীভাবে বসিয়ে রাখব? প্রোগ্রাম তো কিছু নেই!


পূজনীয় মহারাজের সাথে স্বামী গৌতমানন্দজীর চুক্তি হলো—তিনি পূজ্যপাদ মহারাজকে মিথুন দেখাবেন। ওখানে পৌঁছে মহারাজ রোজ জিজ্ঞেস করেন—মিথুন কোথায়? কবে যাব? ঠিক হলো, বেনে বলে একটি গ্রামে সবাই মিলে যাওয়া হবে। মহারাজ বললেন—সন্ধ্যার আগে যেতে হবে। সেবার সন্ধ্যার সময় গিয়ে কিছুই দেখা হয়নি। সেখানে মিথুনদের জন্য নিয়ে যাওয়া হলো দু-বস্তা নুন। গিয়ে দেখা গেল, মহা আড়ম্বরে উৎসব হচ্ছে আদিবাসীদের। তাদের নাচের কোনো ঢঙ নেই। যাই হোক, মহারাজের তো এইসবে একেবারে মন নেই। ওদের যে সরদার, সে একটা টঙের মতো তৈরি করে তার ওপরে মহারাজের বসার ব্যবস্থা করে দিল। সে আবার মহারাজকে তাদের মুকুট পরিয়েছে, পোশাক পরিয়েছে। মহারাজের কিন্তু এগুলোতে তেমন আগ্রহ নেই। মিথুনটা কোথায়? আসলে তারা মিথুন খুঁজেই পায়নি! এত মিথুন তাদের, সর্দার নিজেই বলেছে—তাদের প্রত্যেক ঘরেই মিথুন আছে! তারা মিথুনের কানে চিহ্ন দিয়ে দেয়। একজনের মিথুন অন্যের মিথুনের সঙ্গে যদি যায়, ওরা ফেরত দিয়ে দেয়। কাজেই প্রত্যেকের ঘরেই মিথুন আছে। কিন্তু মিথুনগুলি সেদিন ঘাস খেতে বা চরতে জঙ্গলের ভিতর চলে গেছে। প্রতিদিন তাদের ঘরে ফিরিয়ে আনতে হয়। কিন্তু তারা লজ্জায় মহারাজকে বলতে পারছে না যে, মিথুন তো আনা যায়নি।


ওদিকে মিথুন আশ্রম ক্যাম্পাসের মধ্যেই ঘুরে বেড়ায়। মধ্যে একদিন মহারাজের ঘরের সামনে থেকে ঘুরেও গেছে। মহারাজ তখন জপ করছিলেন। তারপর তো মর্নিং ওয়াক করতে বেরতেন। জপ করে ঘর থেকে বেরনোর পর মহারাজকে বললাম—আপনার ঘরের সামনে তো মিথুন এসেছিল। মহারাজ বললেন : “আমাকে ডাকলে না কেন?” বললাম—আপনি জপ করছিলেন বলে ডাকিনি।—“জপ তো আমি রোজই করি। মিথুন কি রোজ আসবে? মিথুন এল, আমাকে ডাকলে না?” ব্যাস, মন পুরো খারাপ হয়ে গেল। মর্নিং ওয়াকে তিনি বেশ হাসি-ঠাট্টা করতেন। সেদিন একেবারে চুপ। মিথুন এসে চলে গেল, আর দেখা হলো না—এইটাই ওনার আপশোস।


তার একদিন কী দুদিন পরে মহারাজ সবে দরজা খুলেছেন, এমন সময় মিথুন এসে হাজির! ঘরের বারান্দাটা কাঠের রেলিং দিয়ে ঘেরা। তার সামনে এসে মুখটা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বলে উঠলাম—ঐ দেখুন মহারাজ, মিথুন। ঐ তো সামনে। মহারাজ অবাক হয়ে বললেন : “আরে এটা মিথুন?”—হ্যাঁ মহারাজ, এটা মিথুন। তারপর উনি অনেকক্ষণ ভাল করে দেখলেন। স্বামী গৌতমানন্দজীকে ডাকলেন। নুন আনা হলে তিনি মহারাজের হাতে নুন দিলেন। মহারাজের হাত থেকে মিথুনটা নুন চেটেপুটে খেল। খুব আনন্দ করলেন উনি, গায়ে হাতও দিলেন। মিথুনটা কিছু করল না, খুব আরামে মহারাজের হাত থেকে নুন খেল। হঠাৎ একটা ছেলে এসে কী একটা আওয়াজ করায় ফস করে সে চলে গেল। মুহূর্তের মধ্যে হাওয়া! গৌতমানন্দজী বললেন : “আপনার আলঙে আসার যেটা উদ্দেশ্য ছিল সেটা হয়ে গেল।”


সাংবাদিক প্রণয় রায় ও তাঁর স্ত্রী একবার এসেছিলেন মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে। তিনি তখন বিখ্যাত—নির্বাচনের আগে এগজিট পোল প্রথম উনি করেছিলেন। প্রণয় রায়ের স্ত্রী ছিলেন দীক্ষিত। হঠাৎ কৃষ্ণমূর্তি মহারাজ আমাকে ফোন করে জানালেন যে, তাঁকে সাধারণ সম্পাদক মহারাজ বলেছেন ওঁদেরকে বেলুড় মঠ ঘুরিয়ে দেখানোর জন্য। প্রণয় রায়ের স্ত্রী ভূতেশানন্দজী মহারাজের সাথে দেখা করতে চাইছেন, কিন্তু প্রণয় রায় গররাজি। যাই হোক, স্ত্রীর চাপে এলেন।


দুজনে এলে দুটো চেয়ার দেওয়া হলো। কিন্তু প্রণয় রায়ের স্ত্রী চেয়ারে বসলেন না, মহারাজের পায়ের কাছে গিয়ে বসলেন। প্রণয় রায় চেয়ারে বসলেন। তাঁর স্ত্রী প্রণাম করে মহারাজকে বললেন : “ওকে আশীর্বাদ করুন, ও কিছুই মানে না, কিছুই করে না। শুধু সারাদিন ঐসব নিয়ে চলে!” মহারাজ বললেন : ও খারাপ কিছু করছে না। সাংবাদিকতা খুব ভাল কাজ। যদি এটা সৎ উদ্দেশ্যে করে, তাহলে সাংবাদিকতার মতো ভাল কাজ আর নেই। সমাজকে পরিবর্তন করে দিতে পারে।” মহারাজ ইংরেজিতে বলছেন, প্রণয় রায় শুনছেন কিন্তু কিছু বলছেন না। আসলে মেপে নিচ্ছেন মহারাজকে। প্রথমটা একটু অবাক হয়েছেন যে, সন্ন্যাসী সম্পর্কে তাঁর যে-ধারণা ছিল—তারা কোনো কথা বলবে না, ঝুম মেরে বসে থাকবে; কিন্তু ইনি যে কথা বলছেন, কথা বলার ধরনটাও অন্যরকম! তারপর, ওঁর স্ত্রী বলছেন : “ও সাংবাদিক, ও এইসব করে।” তখন মহারাজ জিজ্ঞেস করলেন : “তুমি কি সাংবাদিক?” মহারাজ তো টিভিও দেখেন না! ভদ্রমহিলা বলছেন : “ও খুব পপুলার হয়েছে একজিট পোল স্ট্র্যাটেজিতে।” মহারাজ বলছেন : “স্টেটসম্যান কাগজে দেখেছি। হ্যাঁ, একজিট পোল ব্যাপারটা শুনেছি। তা ভাল, তোমরা প্রেডিক্ট করতে পার ভাল কিছু।” প্রণয় রায় দেখলেন যে, এ তো মজার লোক! তাঁর একদম আপটুডেট নলেজ। তিনি আর বেরচ্ছেন না, কথা চলছে তো চলছে। ওদিকে লাইন পড়ে গেছে ভক্তদের। আমি তখন বললাম—আপনাদের এবার উঠতে হবে, অনেক ভক্ত অপেক্ষা করছে। বেরিয়ে যাওয়ার সময় প্রণয় রায় একটা ভাল মন্তব্য করেছিলেন : “আজকে আমি একটা খুব বড় মিস করলাম। যদি আমার ক্রু-টিমটাকে নিয়ে আসতাম, তাহলে একটা ভাল প্রেজেন্টেশন দিতে পারতাম! এই যে সাধুদের সম্পর্কে নানারকম কথা হয় চারদিকে, তাদেরকে একজন প্রকৃত সাধু দেখাতে পারতাম।” তিনি খোলাখুলি বললেন : “আমি যে-ধারণা নিয়ে মঠে ঢুকেছিলাম—স্ত্রী নিয়ে এসেছিল, বলতে গেলে জোর করে—সাধু সম্পর্কে আমার ধারণা টোটালি পরিবর্তন হয়ে গেল। অন্তত রামকৃষ্ণ মিশন সম্পর্কে আমার ধারণাটা অন্যরকম হয়ে গেল যে, না তারা অন্য ধাঁচে চলে।”


নিউ ইয়র্ক থেকে একজন আমেরিকান ভক্ত আসতেন, তাঁর নাম ব়্যােবরি। তাঁর সঙ্গে খুব ভাল সম্পর্ক ছিল পূজ্যপাদ স্বামী লোকেশ্বরানন্দজীর। গোলপার্কে আমাদের মাঝে-মাঝে যাওয়া হতো মহারাজের চিকিৎসার ব্যাপারে। সে-সুবাদে ওঁকে দেখেছি। গোলপার্কে যে-ঠাকুরঘর আছে, ওপরে সাধুদের জন্য—সেখানে সকালেও দেখছি, গিয়ে জপ-ধ্যান করছেন। মহারাজ তাঁকে অনুমতি দিয়েছিলেন ওখানে যেতে। অন্য সাধুরা যাঁরা জপ করতেন তাঁদের সঙ্গে তিনি বসতেন। সেই সুবাদে ভূতেশানন্দজী মহারাজের সঙ্গেও তাঁর একটু পরিচয় হয়েছিল। মঠেও তিনি যাতায়াত করতেন। একদিন তিনি মঠে এসে আমাকে বলছেন যে, মহারাজের সঙ্গে দেখা করবেন। আমি বললাম—ঠিক আছে বসুন, ভক্তরা ওনাকে প্রণাম করছে। ওটা হয়ে যাক, তারপরে দেখা করিয়ে দেব। দেখলাম, একটা সাদা কাপড় দিয়ে কী একটা বেঁধে নিয়ে এসেছেন। বোধ হয় মহারাজের জন্য কোনো উপহার হবে। অনেকেই তো নিয়ে আসে। তিনি তাঁর মতো বসে আছেন, আমি ভিতরে বলে দিলাম—প্রণাম হয়ে গেলে বলো, ওকে একটু দেখা করিয়ে দিতে হবে। এরপরে মহারাজের সঙ্গে তিনি দেখা করলেন। সেই সময়টায় আমি ছিলাম না। কিছু‌ক্ষণ পর মহারাজ আমাকে ডাকলেন। ঐ যে কাপড় দিয়ে পুটলি বেঁধে নিয়ে এসেছিলেন, দেখলাম মহারাজের পায়ের কাছে পড়ে আছে। আমি যেতে মহারাজ বললেন : “এতদিনে একজন ভাল জিজ্ঞাসু পেলাম।” আমি বললাম—কিরকম? তখন উনি উপনিষদের সেই শ্লোকটা আমাকে শোনালেন—গুরুর কাছে কীভাবে যেতে হবে—সমিৎপাণি হয়ে অর্থাৎ যজ্ঞ বা হোমের কাঠ নিয়ে। মহারাজ বললেন : “সে কতগুলো সমিৎ নিয়ে এসে আমার পায়ের কাছে রেখে বলছে—সমিৎপাণি হয়ে এসেছি, এবার আমাকে ব্রহ্মজ্ঞান দিন। আমি তো থ হয়ে গেছি! এই ধরনের ভক্ত তো কোনোদিন পাইনি! এই ধরনের জিজ্ঞাসুও পাইনি।” সমিৎপাণি তো যজ্ঞকাঠ, কিন্তু এ যা দেখছি, এই কাঠ দিয়ে যজ্ঞ করা যাবে না। সে যাই হোক, ব়্যােবরি তাঁর বুদ্ধিমতো কিছু নিয়ে এসেছেন। মহারাজ তাঁকে বললেন : “খুব ভাল কথা, তুমি সমিৎপাণি হয়ে এসেছ, কিন্তু ব্রহ্মজ্ঞান তো এমনি দেওয়া যাবে না। ব্রহ্মজ্ঞান দিতে হলে শিষ্য এবং গুরু দুজনকেই পবিত্র হতে হবে। তাই যখন তোমাকে উপযুক্ত মনে করা যাবে তখন তুমি নিশ্চয় ব্রহ্মজ্ঞান পাবে।” তারপর তিনি আমেরিকায় চলে যান। এটা তাঁর মতো করে একটা ভাবনা। হয়তো তিনি কোথাও কিছু পড়ে সেটাকে নিজের মতো রপ্ত করেছেন। কিন্তু মহারাজ এটা অন্যভাবে নিলেন যে, অন্তত একজন তো জিজ্ঞাসু পেলাম। এরকম কাউকে এই সাধুজীবনে করতে দেখিনি। সে অন্তত এসে বলেছে, এটাই বা কম কী! মহারাজ তাঁর প্রশংসাই করলেন।


একটি ঘটনা বলে এই স্মৃতিচারণ শেষ করব। মহারাজকে ইংল্যান্ড থেকে আগত একজন ডাক্তার একবার দেখতে এসেছেন। লোকেশ্বরানন্দজী তাঁকে পাঠিয়েছেন। তিনি ডাক্তারকে বলে দিয়েছেন : “আমাদের প্রেসিডেন্ট মহারাজকে একটু দেখে আসুন, ওনার অনেক সমস্যা হচ্ছে হাঁটুতে। ওনার হাতেও ব্যথা আছে।” ডাক্তার বক্সীকেও বলা হয়েছিল, কারণ উনি মহারাজের শারীরিক সমস্যাটা জানেন। ডাক্তার গৌরদাস সেই ডাক্তারকে নিয়ে এলেন, মহারাজের ঘরে কথাবার্তা হচ্ছে। এঁদের চিকিৎসাপদ্ধতি তো অন্য রকমের—কথাবার্তার মাধ্যমে রোগী সম্পর্কে মোটামুটি একটা ধারণা করে নেন, দরকার পড়লে চেক করেন। তিনি মহারাজকে জিজ্ঞেস করলেন : “আপনার সমস্যাটা কী?” মহারাজ বললেন : “আমার অবস্থা বুঝতে হলে ভেটেরিনারি ডাক্তার লাগবে।” তখন ডাক্তার বক্সী খুব হাসছেন। তিনি মহারাজের কাছে আসছেন দীর্ঘদিন যাবৎ, মহারাজের ধরনটা জানেন। তিনি ডাক্তারকে বুঝিয়ে বললেন : “ওনার এমন অবস্থা যে, উনি নিজেও জানেন না কী হয়েছে। ওনার সেবক সেটা বলতে পারবে। ঘোড়া যেমন বলতে পারে না, কিন্তু ঘোড়াকে যে পরিচর্যা করে সে জানে ঘোড়ার কী অসুবিধা হচ্ছে। সে-ই ভেটেরিনারি ডাক্তারকে বলে ঘোড়ার কী অসুবিধা হচ্ছে। সেইমতো ডাক্তার চিকিৎসা করে। মহারাজ সেটাই আপনাকে বলতে চাইছেন—ওনার একজন ভেটেরিনারি ডাক্তার দরকার।” ডাক্তার হেসে বললেন যে, উনি মহারাজ সম্পর্কে অন্যরকম ভেবে বসেছিলেন, কিন্তু মানুষটা যে এত হিউমারাস তা তিনি কল্পনাই করতে পারেননি! ডাক্তার বক্সী হেসে বললেন : “সেবকের কাজটা আমিই করি, আপনি ভেটেরিনারির কাজটা করুন।” শুনে সেই ডাক্তার বললেন : “দেখুন, আপনারা তো অনেকদিন ধরে দেখছেন, ওষুধপত্র দিচ্ছেন; আমার আর এর ভিতরে কিছু বলার নেই। আমি তো দুদিনের জন্য এসেছি, এভাবে বলা ঠিক হবে না। তবে ভাল লাগল মহারাজের সঙ্গে কথা বলে।”


গোলপার্কে ফিরে গেলে লোকেশ্বরানন্দজী তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন : “কী ডাক্তার, আমাদের প্রেসিডেন্ট মহারাজকে কেমন লাগল?” ডাক্তার তো একেবারে উচ্ছ্বসিত—“ওয়ান্ডারফুল ম্যান।” লোকেশ্বরানন্দজী বললেন : “ঐজন্যই আপনাকে পাঠিয়েছি। ডাক্তারি করার জন্য নয়, মানুষ দেখার জন্যই পাঠিয়েছি। কেমন জয়ফুল ম্যান—সেখানে যে যাবে সে সেটা পাবে, কোনো না কোনোভাবে পাবেই।”

‘স্বামী ভূতেশানন্দ স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।
অধ্যক্ষ, রামকৃষ্ণ মঠ, শ্রীশ্রীমায়ের বাড়ি