আমি পরম ভাগ্যবান, কারণ কিছু অসাধারণ মুহূর্ত স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজীর সঙ্গে অতিবাহিত করেছি। যদিও ছয় দশক অতিক্রান্ত হয়ে গেছে, তবুও সেই স্মৃতিগুলি আমার হৃদয়ে এখনো একইভাবে সজীব।

১৯০৬ সালে স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজীকে প্রথম দর্শন করি। আমি তখন তিরুনেলভেলিতে হিন্দু কলেজে পড়ছি। একজন অবসরপ্রাপ্ত পোস্টমাস্টার যিনি শ্রীরামকৃষ্ণ- ভাবাদর্শে অনুরাগীও বটে, হঠাৎ একদিন আমাকে বলেন—একজন সন্ন্যাসী ভান্নারপেট লিটারারি ক্লাবে এক সন্ধ্যায় ভাষণ দেবেন। তিনি আমাকে তাঁর সঙ্গে যেতে বলায় আমি সানন্দে রাজি হই। সন্ধ্যার সময় আমরা হেঁটে ওখানে পৌঁছে যাই। সেদিন খুব একটা জনসমাগম হয়নি। ওখানে উপস্থিত কয়েকজন আইনজীবী ও কিছু উৎসাহী ভদ্রলোকের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়।

এর মধ্যে দরজা খুলে গেল, দুজন সন্ন্যাসী হলঘরে প্রবেশ করলেন। শুনলাম, তাঁরা হলেন স্বামী অভেদানন্দজী এবং স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজী। প্রথম জনকে স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকায় বেদান্তবার্তা প্রচারে নিযুক্ত করেছিলেন। পাশ্চাত্যে এক দশক সেবাকার্যে অতিবাহিত করে স্বামী অভেদানন্দজী তখন সদ্য ভারতবর্ষে ফিরেছেন। তিনি তামিলনাড়ুর তুতিকোরিনে স্টিমার থেকে নেমে তিরুনেলভেলিতে আসেন। শুনেছিলাম, মাদ্রাজে কর্মরত স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজী তাঁর গুরুভাইকে স্বাগত জানাতে কলম্বোয় গিয়েছিলেন। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজী নিজে অবশ্য এদিন কোনো ভাষণ দেননি।

স্বামী রামকৃষ্ণানন্দ

স্বামী অভেদানন্দজী যে প্রেরণাদায়ক বক্তৃতাটি দেন, তার মুখ্য দুটি বিষয় আজও আমার মনের মধ্যে গেঁথে আছে়। প্রথমটি হিন্দুধর্মের নৈর্ব্যক্তিক বৈশিষ্ট্য। তিনি বলেন—যখন অন্য কোনো ধর্মে দাবি করা হয় যে, সেই ধর্ম কোনো একজন মহান ব্যক্তি বা সিদ্ধপুরুষ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, তখন হিন্দুধর্মে ঐরকম কোনো প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকা নেই, সে তিনি যত বড় ব্যক্তিত্ব বা যত মহানই হোন না কেন! তিনি আরো বলেন, যখন ঐসকল ধর্মের প্রতিষ্ঠাতাদের ঐতিহাসিক প্রামাণিকতার অভাব হয়, তখনি ঐ ধর্মের প্রভাব নিম্নগামী হয়, তার অস্তিত্বের সংকট উপস্থিত হয়। হিন্দুধর্মে এই সমস্যা নেই, কারণ অনাদি কাল থেেক এই ধর্ম পরম সত্যের ওপর দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত। দ্বিতীয়ত, তিনি বলেন—বিভিন্ন ধর্মের প্রার্থনার জন্য সপ্তাহে কোনো একটি দিন নির্দিষ্ট থাকে, যেদিন ধর্মালম্বী ব্যক্তি উপাসনালয়ে গিয়ে প্রার্থনা করার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু হিন্দুদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি কর্মই প্রার্থনা বা পূজায় পর্যবসিত হয়। তাই প্রকৃত হিন্দুর প্রত্যেকটি কর্ম—যেমন স্নান করা, কথা বলা, হাঁটাচলা, জীবনধারণ করা, মৃত্যু সবই অধ্যাত্মচেতনায় সর্বদা সম্পৃক্ত। দুর্ভাগ্যবশত এদিন আমি তাঁদের সঙ্গে কোনো কথা বলতে পারিনি। শুধু দূর থেকে তাঁদের দর্শন ও ভাষণ শুনে আপ্লুত হয়েছিলাম।

দুবছর পরে সেন্ট জোসেফ কলেজে স্নাতক স্তরের পড়াশোনা শেষ করে ১৯০৮ সালের শেষ দিকে আমি মাদ্রাজে যাই বিশ্ববিদ্যালয়ের পরী‌ক্ষায় বসার জন্য। ঐ সময় আমি এক আত্মীয়ের সঙ্গে ট্রিপ্লিকেনে ছিলাম। তখনি এক বন্ধু মারফত জানতে পারি, মায়লাপুরের খুব কাছেই রামকৃষ্ণ মঠ। একদিন আমি সেখানে যাই। এর পর একদিন বিকেলে মনে মনে যথেষ্ট সাহস সঞ্চয় করে গেরুয়া রঙের সেই বাড়িতে আবার আসি। রামকৃষ্ণানন্দজী তখন একটি হলঘরে বসেছিলেন। কোনো সন্ন্যাসীর সঙ্গে দেখা হলে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাবশত যে আভূমি প্রণত হতে হয়—এই ব্যাপারটি আমার জানা ছিল না। আমি হাতজোড় করে তাঁকে নমস্কার জানিয়ে তাঁর সামনে বসলাম। “তুমি কোথা থেকে আসছ?”—তিনি আমায় প্রশ্ন করলেন। উত্তরে বললাম : “আমি ট্রিপ্লিকেন থেেক আসছি।” “ওখানে যে পার্থসারথির মন্দির আছে, তুমি কি সেখানে গিয়েছ?”—তিনি প্রশ্ন করেন। উত্তরে তাঁকে জানাই : “হ্যাঁ, আমি মাঝে মাঝেই সেখানে যাই।” তখন তিনি যেকথা বলেন, আজও তা গভীরভাবে অনুভব করি। তিনি বলেন : “জেনো, পার্থসারথি শুধুমাত্র মূর্তি নন। মহান সাধকেরা ঐ মন্দিরের গর্ভগৃহে ঈশ্বরের জীবন্ত উপস্থিতি উপলব্ধি করে ধন্য হয়েছেন।”

মহারাজ আরো বলেন : “এখানে একজন আমেরিকান ভদ্রমহিলা আছেন যিনি পার্থসারথির বিশেষ ভক্ত। আমি তাঁর সঙ্গে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব।” এর পরে একদিন আমি সেই ভদ্রমহিলাকে দর্শন করি। তিনি সিস্টার দেবমাতা, Days in an Indian Monastery গ্রন্থের প্রণেতা। ভারতবর্ষ ও ভারতবর্ষের সকল বিষয়ের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাশীলা এক অতি পবিত্র চরিত্রের মহিলা।

মহারাজ জানতে চান আমি বিবাহিত কি না? উত্তরে জানাই : “হ্যাঁ, আমি বিবাহিত।” স্মিতহাস্যে তিনি মন্তব্য করেন : “এখানকার অনেক ছেলেরই অল্প বয়সে বিবাহ হয়ে যায়।” আমার প্রতি তাঁর পরবর্তী উপদেশ ছিল—“তোমার স্ত্রীকে ঈশ্বরের কন্যা বলে জানবে। তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তার মনোবাসনা পূর্ণ করে সদাসর্বদা তাকে সুখী রাখার চেষ্টা করবে।” তাঁর এই উপদেশ আমার অন্তস্তল স্পর্শ করেছিল, আমি অনুভব করেছিলাম—গৃহী আদর্শের মূল ভাবটি এই কথার মধ্যে নিহিত। মানুষের কন্যা একজন মানবী ভিন্ন অন্য কিছু হতে পারে না, যেমন পশুর সন্তান পশুই হয়। তেমনই ঈশ্বরের কন্যা ঈশ্বরী ছাড়া আর কিছু হতে পারে না। সুতরাং একজন স্ত্রী ঈশ্বরী হলে তার যথাযথ সমাদর অবশ্য প্রয়োজন। গার্হস্থ জীবনের এই উচ্চ আধ্যাত্মিক আদর্শ আর কীভাবেই বা বর্ণনা করা সম্ভব? তাছাড়া এটি (একজন স্বামী তার স্ত্রীকে ঈশ্বরের প্রতিরূপ বলে সম্মান জানাবে) কি পাতিব্রত্য আদর্শের (একজন স্ত্রী তার স্বামীকে ঈশ্বরের প্রতিরূপ বলে জানবে) পরিপূরক নয়? মানবের কল্যাণের জন্য যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণ কি এই আদর্শ নিজ জীবনে প্রদর্শন করেননি?

সেদিনের সেই ধর্মপ্রসঙ্গ এবং মহারাজের দর্শন আমার মনে গভীর রেখাপাত করে। তাঁর কাছে বিদায় চাইলে তিনি আমাকে নারকেল নাড়ু প্রসাদ দেন। মধু সহযোগে তিনি এই নারকেল নাড়ু তৈরি করেছিলেন বলে অত্যন্ত সুস্বাদু হয়েছিল। তাঁর কাছে শুনলাম, বাল্যকালে শ্রীরামকৃষ্ণের অত্যন্ত প্রিয় ছিল এই নাড়ু। তাই মঠে আগত কোনো ভক্তের এই প্রসাদ না নিয়ে মঠত্যাগের অনুমতি ছিল না। প্রসাদের ব্যাপারে এত গুরুত্ব আরোপ করার কারণ জিজ্ঞাসা করায় রামকৃষ্ণানন্দজী বলেন : “শত শত ব্যক্তি প্রতিদিন আশ্রমের সামনে দিয়ে সময়ে অসময়ে কতবার যাতায়াত করছে, কিন্তু তাদের মধ্যে কয়েকজন মাত্র এখানে আসে। তাই যারা এখানে আসে তাদের অবশ্যই কিছু প্রসাদ পাওয়া উচিত।” কোনো মানুষের অধ্যাত্মপথে সামান্য এগিয়ে যাওয়াকেও তিনি কী গভীরভাবে শ্রদ্ধা করতেন!

স্বামী বিবেকানন্দের রাজযোগ পাঠ করতে গিয়ে একবার ল‌ক্ষ্য করি, স্বামীজী বলেছেন—কুলকুণ্ডলিনীর জাগরণ দিব্যজ্ঞান লাভের এক এবং একমাত্র পথ। কথাটি আমাকে উদ্বুদ্ধ করে। একদিন আমি রামকৃষ্ণানন্দজীকে জিজ্ঞাসা করি—তাহলে সমস্ত মুমু‌ক্ষু ব্যক্তিরই তো রাজযোগের সাধনা করা উচিত? উত্তরে তিনি বলেন—স্বামীজী কিন্তু আরো বলেছেন, কুণ্ডলিনীর জাগরণ অন্যান্য পথেও হতে পারে। যেমন ভগবৎপ্রেম (ভক্তিযোগ), সাধুব্যক্তির করুণা (কৃপা) বা জ্ঞানপথে (জ্ঞানযোগ)।

আরেকদিন আমি মঠে গিয়ে দেখি—রামকৃষ্ণানন্দজী একজন ভক্তকে বলছেন, বিগত কয়েকদিন যাবৎ তিনি অত্যন্ত তৃষ্ণার্ত বোধ করছেন। তাঁর মনে হচ্ছে, এটি তাঁর জ্বর হওয়ার পূর্বল‌ক্ষণ। তারপর তিনি অতি বিনয় ও অনুরাগের সাথে প্রভুর কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করলেন শিশুর বিশ্বাস ও ভগবানে পূর্ণ শরণাগতির ভাব নিয়ে। বললেন : “আমার চরম বিপদের দিনেও শ্রীগুরুমহারাজ আমাকে পরিত্যাগ করবেন না।” আমি তাঁর শ্রীমুখ-কথিত প্রতিটি শব্দ এখানে উদ্ধৃত করলেও তাঁর প্রকৃত ভাব ও আর্তি ভাষায় প্রকাশ করার ‌ক্ষমতা আমার নেই।

রামকৃষ্ণানন্দজী একজন সন্ন্যাসী। সাধুত্বই তাঁর চরিত্রের প্রধান ভূষণ। সন্ন্যাসজীবনের বীজ তাঁর ধমনিতে দৃঢ়ভাবে উপ্ত এবং কোনো অবস্থাতেই কঠিন ত্যাগব্রতের প্রতি তাঁর আনুগত্যের বিচ্যুতি ঘটেনি। একদিন আশ্রমের এক নবীন সন্ন্যাসী দুপুরে প্রসাদ নেওয়ার সময় অনুপস্থিত থাকায় মহারাজ তাঁর খোঁজ করেন এবং দেখা হলে এর কারণ জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে সেই সন্ন্যাসী, তিনি জন্মসূত্রে বাঙালি, জানান—ঐ দিনটি বঙ্গভঙ্গের দিন যা একজন বাঙালির প‌ক্ষে অত্যন্ত দুঃখের। একজন দেশপ্রেমিক হিসাবে প্রতিবাদস্বরূপ ঐদিন তিনি অনশন করেছেন। কিন্তু মহারাজ তাঁকে বলেন, যখন তিনি সন্ন্যাস নিয়েছেন তখন তাঁর পূর্বাশ্রমের সমস্ত সাংসারিক দায়িত্ব-কর্তব্য এবং অনুভূতির বন্ধন ও আসক্তি ত্যাগ করে এসেছেন। তাই পূর্বাশ্রমের কোনোকিছুর বাধ্যবাধকতা মান্য করা তাঁর প‌ক্ষে অনুচিত। কিন্তু সেই তরুণ সন্ন্যাসী রামকৃষ্ণানন্দজীর সঙ্গে একমত হতে পরেননি। তিনি তাঁর মতের সমর্থনে বলতে থাকেন—এই প্রতিজ্ঞা তিনি মঠে েযাগদানের পূর্বে করেছিলেন, তাই এখন ঐ প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা তাঁর প‌ক্ষে আত্মপ্রবঞ্চনার সমতুল। তখন রামকৃষ্ণানন্দজী অত্যন্ত কঠোরভাবে তাঁকে বলেন : “যদি তুমি আমার কথা না শোন এবং দুপুরের আহার গ্রহণ না কর তাহলে এই মুহূর্তে আশ্রম ত্যাগ কর।” তাঁর কথামতো সেই তরুণ সন্ন্যাসী তৎ‌ক্ষণাৎ আশ্রম ত্যাগ করে চলে যান। তবে তিনি অত্যন্ত দায়িত্বসচেতন ছিলেন, তাই অতি শীঘ্রই বুঝতে পারেন—তাঁর যুক্তি আদৌ যথার্থ নয়, কারণ সন্ন্যাসব্রতের পরিধি অসীম ও অনন্ত। রাজনৈতিক প্রতিজ্ঞা সেই তুলনায় যৎসামান্য মাত্র। আহ্বান একজন দেশপ্রেমিকের তুলনায় বৃহত্তর আঙ্গিকে ব্যক্তিত্ব প্রদর্শনের জন্য। তিনি তাঁর ভুল বুঝতে পারেন এবং মহারাজকে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করে প্রসাদগ্রহণ করতে বসেন।

এক যুবক প্রায় প্রতিদিনই মঠে আসত। সে ঈশ্বরবিশ্বাস নিয়ে তর্ক করত। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজী তার বালকসুলভ তর্ক ও ভ্রান্ত ধারণা যেভাবে ধৈর্যসহকারে শুনতেন তা সত্যিই অসাধারণ! তার কথা শেষ হলে তিনি কোনো মন্তব্য বা প্রতিপ্রশ্ন করে তার ব্যঙ্গাত্মক আচরণ নিরসনে সচেষ্ট হতেন এবং তাকে বাধ্য করতেন প্রকৃত সত্য দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি বুঝতে। ঐ তরুণ পরবর্তিকালে মহারাজের একান্ত অনুগত এক ভক্তে পরিণত হয়।
একদিন জনৈক ভক্ত এক অনিয়মিত দর্শনার্থীর কঠোর মন্তব্যের কথা মহারাজকে জানান। সে কোনো এক সাধুর ঘরে বিলাসবহুল খাট ও গদি দেখে মন্তব্য করেছে : “এটা কি তাঁর তপস্যার নিদর্শন?” ভক্তটি ঐ কথা শুনে স্বভাবতই ক্ষুব্ধ এবং মহারাজ কী বলবেন তা জানতে বিশেষভাবে আগ্রহী। স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজী উত্তরে বলেন : “তাকে বলবেন যে, শ্রীগুরুমহারাজ আমাদের সকলের জন্য নিরন্তর কঠোর তপস্যা করে গেছেন। তাই আমাদের আর কিছুই করার প্রয়োজন নেই।” পিতার অগাধ সম্পত্তির এক এবং একমাত্র উত্তরাধিকারী যে পুত্রই তা তাঁর এই কথার মাধ্যমে প্রকাশিত। অধিকন্তু তাঁর গভীর আধ্যাত্মিক অনুভূতি যে শ্রীরামকৃষ্ণের শিষ্য হওয়ার সুবাদেই—এটি তাঁর কথার মাধ্যমে প্রতিভাত। অবশ্য তাঁর সম্পূর্ণ জীবন একান্ত অনুরাগ সহকারে অক্লান্ত তপস্যারই ফলশ্রুতি।

রামকৃষ্ণানন্দজীর অন্তর্দৃষ্টি কোনো ব্যক্তির আধ্যাত্মিক অবস্থা নির্ণয়ে ছিল অভ্রান্ত। একবার এই শহরে এক সাধুর আগমন হয়। কিছু উৎসাহী ব্যক্তি কৌতূহলবশত তাঁর চারপাশে ভিড় জমায় এবং হালকা চালে তাঁর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে থাকে। রামকৃষ্ণানন্দজী একদিন সেই রাস্তার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় ঐ সাধুকে দর্শন করেন। সেখানে জড়ো হওয়া ব্যক্তিদের তিনি বলেন : “ইনি একজন আত্মদর্শী পুরুষ। এনার সঙ্গলাভের যে দুর্লভ সৌভাগ্য আপনাদের হয়েছে তার সদ্ব্যবহার করুন।” সাধুটি এই কথাগুলি শুনতে পেয়ে তার প্রতিবাদ করে বলেন : “কেন আপনি আমার প্রশংসা করছেন?” উত্তরে রামকৃষ্ণানন্দজী বলেন : “আমি শুধু এই মানুষদের আপনাকে সঠিকভাবে মূল্যায়নের অপারগতার কথাই ব্যক্ত করেছি মাত্র, যাতে তারা প্রকৃত সাধুসঙ্গলাভের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করতে পারে।” সাধুর সাধারণ ব্যবহারের পশ্চাতে যে আত্মবোধের গভীরতা বিদ্যমান তা উপস্থিত জনসাধারণকে বোঝাতে পেরেছিলেন রামকৃষ্ণানন্দজী; কেননা তারা ঐ সাধুকে একজন উদ্দেশ্যহীন ভবঘুরে বলে ধারণা করেছিল।

পার্থসারথি মন্দিরের প্রাচীন চিত্র

কোনো সমস্যা সমাধানের ‌ক্ষেত্রে রামকৃষ্ণানন্দজী উপদেশমূলক গল্প বলায় বিশেষ পারদর্শী ছিলেন। তিনি একটি গল্প বলেছিলেন, যাতে আমরা আমাদের মধ্যে দৃঢ়মূল হওয়া অসৎ বা অশুভ প্রবণতার মূলোচ্ছেদ করতে সচেষ্ট হই। গল্পটি এই—একটা লোক আফিম খেত, কিন্তু এর পরিণাম ভাল নয় বুঝে এই বদভ্যাস থেকে মুক্ত হতে সচেষ্ট হয়। সে তার গুরুর কাছে পরামর্শ চাইলে গুরু তাকে নিষেধ না করে বরং জানতে চান যে, সে প্রতিদিন কতটা আফিম খায়? লোকটি সেকথা জানালে গুরু তাঁর ঘরে গিয়ে ঐ পরিমাণের একটুকরো চক নিয়ে আসেন এবং শিষ্যকে দিয়ে বলেন : “আফিম খাওয়া বন্ধ করতে হবে না, বরং এই চকটির সমপরিমাণ আফিম প্রতিদিন খাবে—তার বেশিও না, কমও না। তবে আফিম খাওয়ার পরে এই চক দিয়ে দেওয়ালে একটা ছোট দাগ কেটে রাখবে। আর তোমায় কিছু করতে হবে না।” লোকটি বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে গুরুবাক্য যথাযথভাবে পালন করতে শুরু করল। অচিরেই সে এটি আবিষ্কার করে বিস্মিত হলো যে, ঐ চকের ওজন ক্রমাগত কমেই চলেছে এবং সেইসঙ্গে তার নিজের অগোচরে আফিমের পরিমাণও দিনদিন কমে যাচ্ছে! অবশেষে সে এই কু-অভ্যাস থেকে চিরতরে মুক্ত হলো। তার দেহ-মন কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই এই চিকিৎসায় সাড়া দিয়েছিল। রামকৃষ্ণানন্দজীর কথায়—শিষ্যের মঙ্গলময় পরিবর্তনের জন্য একজন প্রতিভাবান গুরুর এ এক বিচিত্র নিদান! প্রকাশ্যে নিন্দা অথবা গঞ্জনা না করে নিঃশব্দে অথচ কার্যকরীভাবে কোনো ব্যক্তির যথার্থ রূপান্তরের এ এক সার্থক পদ্ধতি।

একবার মহারাজ ত্রিবান্দ্রামে গিয়েছিলেন। সেখানে এক ভক্ত মহিলা তাঁকে রাত্রে আহারের জন্য আমন্ত্রণ জানান। তিনি মহারাজকে পরিতৃপ্তি সহকারে খাওয়ানোর জন্য খুব ব্যগ্র ছিলেন। তাই নিজের হাতে অনেক পদ রান্না করেন। ভোজনের পূর্বে একটি বড় কলাপাতা তাঁর সামনে বিছিয়ে দেওয়া হয়। কারণ, মহারাজ ঐ মহিলাকে অনুরোধ করেছিলেন, তিনি যাকিছু খাওয়াতে চান, তা বারে বারে পরিবেশন না করে একবারেই যেন ঐ কলাপাতার ওপর দিয়ে দেন। সমস্ত পদ ঐ পাতার ওপর দেওয়া হলে নিশ্চিন্ত মনে রামকৃষ্ণানন্দজী আহারে বসেন এবং মন্ত্রোচ্চারণের মাধ্যমে ভোজন শুরু করেন। অকস্মাৎ ঐ মহিলার স্মরণে আসে যে, তিনি মহারাজকে ঘি দিতে ভুলে গেছেন। অত্যন্ত লজ্জিত হয়ে তিনি তৎ‌ক্ষণাৎ ঘিয়ের বাটি নিয়ে দৌড়ে আসেন। কিন্তু মহারাজ তাঁকে সেটি দিতে বারণ করে শান্তভাবে বলেন : “মাফ করবেন মা, আমি প্রভুকে নিবেদন না করে কোনো কিছু গ্রহণ করি না। আহার শুরু করার আগে যা যা দেওয়া হয়েছিল সবই আমি প্রভুকে নিবেদন করেছি। যেহেতু ঘি ছাড়াই সমস্ত কিছু নিবেদিত হয়েছে, তাই এখন আমি আর ওটা নিতে পারব না। যদি তিনি তাঁর অপার করুণায় ঘি ছাড়াই এই আহার গ্রহণ করে সন্তুষ্ট থাকেন, তাহলে আমি কীভাবে এখন তা গ্রহণ করি? এটা আমার প‌ক্ষে উচিত হবে না।” তিনি বোঝাতে চাইলেন, একজন ভৃত্যের কাছে প্রভু হলেন তার সর্বস্ব।

ত্রিবান্দ্রামে মহারাজ একবার পদ্মনাভস্বামীর মন্দির দর্শনে যান। যখন তিনি গর্ভমন্দিরে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন, তখন একজন পুরোহিত তাঁকে জিজ্ঞাসা করেন—তিনি ব্রাহ্মণ কি না? মহারাজ একথার কোনো উত্তর না দিয়ে ভাবগম্ভীর স্বরে স্তোত্রপাঠ করতে শুরু করেন :

“নাহং মনুষ্যো ন চ দেব য‌ক্ষ ন ব্রাহ্মণ ‌ক্ষত্রিয় বৈশ্য শূদ্রঃ। /ন ব্রহ্মচারী ন গৃহী বনস্থ ভি‌ক্ষুর্ন চাহং নিজ বোধরূপ।।”

অর্থাৎ, না আমি কোনো মানুষ, না দেবতা, না য‌ক্ষ। আমি ব্রাহ্মণও নই, ‌ক্ষত্রিয়ও নই, বৈশ্যও নই, শূদ্রও নই। না আমি ব্রহ্মচারী, না গৃহী, না বনবাসী, না ধ্যানরত সন্ন্যাসী। আমি সেই পরমজ্যোতির অংশ।

তাঁর সুরেলা মন্ত্রধ্বনি এবং পবিত্র উপস্থিতি মন্দির-প্রাঙ্গণে আগত মানুষের মধ্যে এমন শিহরন সৃষ্টি করে যে, ঐ পুরোহিত তাঁর মাহাত্ম্য স্বীকার করতে বাধ্য হন এবং বাধাদানে বিরত থাকেন।

ঈশ্বরের কোনো চিত্র বা মূর্তি মহারাজের কাছে কেবলমাত্র কাগজ বা প্রস্তরখণ্ড বিবেচিত না হয়ে জীবন্ত প্রতিমূর্তিরূপে প্রতিভাত হতো। মাদ্রাজে তাঁর প্রথম পদার্পণের সময় স্বামীজী শ্রীরামকৃষ্ণের যে-ছবিটি সঙ্গে করে নিয়ে আসেন—সেটি বহন করার সময় তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিল যেন একজন মা তাঁর শিশুকে কোলে করে নিয়ে যাচ্ছেন! উপস্থিত ভদ্রমণ্ডলী এই দিব্য দৃশ্য দর্শন করে ঠাকুরের ঐ আলোকচিত্রটির প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়।

একদিন মহারাজ মঠের এক তরুণ সন্ন্যাসীকে আশ্রম-প্রাঙ্গণে পথের ধারে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কাঁটাগাছ সাফ করতে বলেন। তিনি সাধারণত একটি ছোট তোয়ালেতে সাফ করা কাঁটাগুলি জড়ো করে রাখতেন। সন্ন্যাসীটি যখন এই কাজটি করছে তখন বিস্ময়াবিষ্ট এক শিষ্যকে (যে তাঁকে এই কাজটি করতে দেখে হতাশা প্রকাশ করেছিল) মহারাজ গভীর বিশ্বাসে বলেন যে, তাঁর একটি দর্শন হয়েছিল—শ্রীরামকৃষ্ণ যখন এই পথ দিয়ে বেড়াচ্ছিলেন তখন হঠাৎ তাঁর পায়ে কাঁটা ফুটে রক্তপাত হচ্ছে। শিষ্যটি বুঝতে পারে, রামকৃষ্ণানন্দজীর কাছে স্বর্গ ও মর্তের মাঝে আরো বিশেষ কিছুর অস্তিত্ব আছে, যা সাধারণ মানুষ কল্পনাও করতে পারে না। সত্যি কথা বলতে কী, যদিও মহারাজ একজন মানবদেহধারী এবং সাধারণ কর্মে ব্যাপৃত, তবুও তাঁর মধ্যে অনাসক্তি, বৈরাগ্য, অতীন্দ্রিয় জগতে তাঁর অনায়াস বিচরণ ছিল সহজসাধ্য।

রামকৃষ্ণানন্দজী বিপদগ্রস্ত মানুষের আশাভরসার স্থল ছিলেন। হতাশাগ্রস্ত মানুষের জীবনে তিনি নব আশার সঞ্চার করতেন। একজন অল্পবয়সি ব্যক্তি পত্নীবিয়োগে ব্যথিত হয়ে সান্ত্বনালাভের আশায় রামকৃষ্ণানন্দজীর কাছে আসেন। তাঁর স্ত্রী মৃত্যুকালে দুই সন্তানের জননী ছিলেন। মহারাজ যথারীতি তাঁর এই সাংসারিক বিপর্যয়ে গভীর সমবেদনা ব্যক্ত করেন। কারণ, ঐ ব্যক্তির ওপর এখন অতিরিক্ত সাংসারিক দায়িত্ব। পর‌ক্ষণেই মহারাজের ভাবের পরিবর্তন হয়, তিনি বলতে থাকেন : “ভেবে দেখুন, ভগবান একজনকে নিয়েছেন কিন্তু পরিবর্তে দুজন—দুটি আত্মাকে পাঠিয়েছেন আপনার কাছে। তাই ভগবানের কাছে আপনার কৃতজ্ঞ থাকা উচিত।” এই ছোট্ট উপদেশটি ঐ দুঃখী মানুুষটির জীবনদর্শনে পরিবর্তন এনে দিল। তখন থেকে তিনি ভাবতে শুরু করলেন, তিনি পত্নীকে হারিয়ে কোনো দুঃখী মানুষ নন, বরং আশীর্বাদপ্রাপ্ত এক পিতা, যাঁর কাছে ঈশ্বর পাঠিেয়ছেন দুটি শিশুকে তাদের মানুষ করার দায়িত্ব দিয়ে।

আরেকদিনের ঘটনা, একজন বয়স্ক ভদ্রলোক মহারাজের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। কথাবার্তার মধ্যে ভদ্রলোক বললেন—সমগ্র আধ্যাত্মিক পরিমণ্ডলে নারীকে কামনার উৎসরূপে চিহ্নিত করা হয় এবং পুরুষকে সতর্ক করা হয় তাদের ছলনায় আত্মসমর্পণ না করতে। তাই তাঁর মতে—এসব কথা যেহেতু শাস্ত্রে পুরুষরা লিখেছে, তাই এমন ধারণার সৃিষ্ট হয়েছে। যদি একই গ্রন্থ কোনো নারী লিখত, তাহলে পুরুষকেই শয়তানের প্রতিমূর্তিরূপে নির্দেশ করা হতো। রামকৃষ্ণানন্দজী সম্মতিসূচক স্মিতহাস্যে যোগ করলেন—সেইজন্য শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর পুরুষ ভক্তদের যেমন কামিনীকাঞ্চন সম্বন্ধে, তেমনি নারী ভক্তদের পুরুষকাঞ্চন সম্বন্ধে সতর্ক করতেন।

একদিন এক ভক্ত মহারাজকে ইংরেজ ঔপন্যাসিক স্যার ওয়াল্টার স্কটের উপন্যাস পড়তে দেখে অবাক হয়ে যায়। এই ভক্তের ধারণা ছিল, মহারাজ সর্বদা অন্তর্মুখী অবস্থায় ধ্যানে নিমগ্ন থাকেন। তার প‌ক্ষে বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে, রামকৃষ্ণানন্দজী উপন্যাস পড়ে সময় নষ্ট করছেন! মহারাজ তাঁর মনোভাব বুঝতে পেরে বলেন : “দেখ, আমি তোমার এই অবাক হওয়ার কারণ বুঝতে পারছি। একথা সত্যি যে, শ্রীরামকৃষ্ণের আহ্বানে কলেজে পড়া অসমাপ্ত রেখেই তাঁর শরণাগত হই এবং তখন থেকেই তাঁর সেবা-পূজায় নিমগ্ন আছি। কিন্তু প্রভু এখন আমায় আরো একটি নতুন কর্ম সমাধা করার জন্য আহ্বান করেছেন। সেই কর্মটি হলো বক্তৃতার মাধ্যমে তাঁর ভাবপ্রচার। তাই সেটি যথাযথভাবে পালন করার জন্য আমি ইংরেজি ভাষার ওপর দ‌ক্ষতা বাড়ানোর চেষ্টা করছি। এক আকর্ষণীয় উপন্যাস পাঠের মাধ্যমে এ আমার ইংরেজি ভাষায় সমৃদ্ধ হওয়ার আন্তরিক প্রয়াস মাত্র।” 

‘স্বামী সারদানন্দ স্মারক রচনা’রূপে প্রকাশিত হলো।

শুদ্ধানন্দ স্মারক রচনা’রূপে প্রকাশিত হলো।