মা তাঁহার অতি কর্মব্যস্ত জীবনের মাঝেও নিরাশ্রয় রোগীর আশ্রয় হইয়া উঠিয়াছিলেন। জয়রামবাটীতে মায়ের বাড়িতে গোরু-বাছুরের দেখভাল করিবার জন্য গোবিন্দ নামে দশ-এগারো বৎসরের একটি বালক ছিল। একসময় তাহার সারা গায়ে খোস দেখা দিল। যন্ত্রণায় ঘুমাইতে না পারিয়া সারা রাত্রি কাঁদিল। মা পরদিন সকালে নিজহাতে নিম-হলুদ বাটিলেন। শরীরের কোথায় কীভাবে লাগাইতে হইবে তাহা গোবিন্দকে দেখাইয়া দিলেন।
তপস্যা বলিতে সাধারণত কায়িক ক্লেশ, অনশন-অর্ধাশন, ব্রত-উপবাস, কৃচ্ছ্রতা-স্বীকার প্রভৃতিকে বোঝায়। তপস্যা তাহাকেই বলে যাহা তাপ উৎপন্ন করে। নিঃসন্দেহে তাহা এক ঈশ্বরোপাসনা পদ্ধতি, কিন্তু সেই ভগবদুপাসনার প্রণালী-পদ্ধতি অনন্ত। যাঁহার ইতি করা যায় না, তাঁহাকে পাইবার পথেরও তো ইতি হয় না। এই ঈশ্বরপথের পথিকের জন্য নবতম সংযোজন ‘সেবারূপ তপস্যা’র পথ। শ্রীরামকৃষ্ণ এই সেবাপথের প্রেরণার উৎস। ‘দয়া নয় সেবা, শিবজ্ঞানে জীবের সেবা’র উদ্গাতা তিনি। স্বামী বিবেকানন্দ, তখনো নরেন্দ্রনাথ, সেদিন ঠাকুরের কথায় বুঝিয়াছিলেন—“শুষ্ক কঠোর নির্মম বলিয়া প্রসিদ্ধ বেদান্তজ্ঞানকে ভক্তির সহিত সম্মিলিত করিয়া কি সহজ সরল ও মধুর আলোকই প্রদর্শন করিলেন।… বনের বেদান্তকে ঘরে আনা যায়, সংসারের সকল কাজে উহাকে অবলম্বন করিতে পারা যায়।… কর্ম বা রাজযোগ অবলম্বনে যেসকল সাধক অগ্রসর হইতেছে, তাহারাও ঐ কথায় বিশেষ আলোক পাইবে।… এই অদ্ভুত সত্য সংসারে সর্বত্র প্রচার করিব—সকলকে শুনাইয়া মোহিত করিব।” ফলে সেবা—জ্ঞান, ভক্তি, কর্ম ও যোগ অবলম্বনে রূপান্তরিত হলো ‘সেবাযোগ’-এ এবং বিবেকানন্দ স্বীয় প্রতিশ্রুতি অনুসারে এর প্রচারক-ব্যাখ্যাতা। বিচারে জীবের মাঝেই শিববুদ্ধি আনয়নের জন্য জীব-শিবের অভেদত্ব-প্রসূত জ্ঞানদৃষ্টি আবশ্যক। কিন্তু তাহার জন্য গিরিগুহায় প্রত্যাবর্তনের প্রয়োজন নাই, নাই কেবলমাত্র শুষ্ক বিচারের—কেননা সেই শিবই জীবরূপে সেবা লইতে সম্মুখে সংসার-সমুদ্রে আসীন। তঁাহাকে পরম অনুরক্তির সহিত ভক্তিভাবে, যথোপযোগী উপচারে অর্চনা কর্তব্য; তবে তাহার জন্য মন্দির নির্মাণ, বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা, আনুষ্ঠানিক আড়ম্বর বা ভাবুকতা বৃদ্ধির প্রয়োজন নাই। প্রয়োজন অখণ্ড মনোযোগে তাঁহার আশু প্রয়োজনের প্রতিবিধান। তবে এ মনঃসংযমে যোগবিভূতি লাভে বিপথগামী হইবার ভয় নাই; বরং ইহাতে আবশ্যক নিঃস্বার্থপরতা—আসনে আসীন থাকিয়াও তীব্র সেবারূপ কর্ম। ইহাতে রহিয়াছে নিঃস্বার্থ, নিঃশর্ত আত্মনিবেদনের তপস্যা। তাই শিববুদ্ধিতে জীবসেবা আসলে সেবাযোগ এবং তাহা তপস্যার সার। শ্রীশ্রীমায়ের জীবন অনুরূপ। তিনি এই সেবাযোগের একই সাথে প্রেরণা, প্রবর্তন ও প্রচার—তিনেরই প্রতিভূ। শ্রীরামকৃষ্ণের ভাবানুযায়ী সেবাযোগের মূল কথা—সকল জীবে ঈশ্বরবুদ্ধি। মায়ের জীবনের একটি ঘটনা এপ্রসঙ্গে উল্লেখ্য। জনৈক সন্ন্যাসী সন্তান মাকে একদিন প্রশ্ন করিলেন : “আপনি আমাদের কি ভাবে দেখেন?” মা উত্তর দিলেন : “নারায়ণভাবে দেখি।” সন্তান পুনরায় প্রশ্ন...
Read the Digital Edition of Udbodhan online!
Subscribe Now to continue reading
₹100/year
Start Digital SubscriptionAlready Subscribed? Sign in