অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীতে যে-কয়েকজন শাক্ত পদকার শাক্ত গীতিসাহিত্য ও শাক্ত সাধনাকে জনপ্রিয় করেছিলেন, তাঁদের মধ্যে কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য বিশিষ্টতার আসন লাভ করেছেন। অনেকে মনে করেন, বৈষ্ণব গুরুবাদ ও বৈষ্ণবদের রহস্যময় সাধনার প্রতিষেধক হিসাবে সমাজে শাক্ত পদচর্চার বিশেষ বাহুল্য দেখা যায়। আমরা জানি, ষোড়শ শতাব্দীতে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার জন্য উৎপীড়িত জনমানসে সর্বশক্তিময়ী মঙ্গলকাব্যের দেবীগণ আবির্ভূত হয়েছিলেন। অন্যদিকে অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রায় মাঝামাঝি সময় থেকে অবিভক্ত বাংলায় পুনরায় রাষ্ট্রসংকটের সূচনা হয়। রাষ্ট্রের পেষণ যন্ত্রে ধনী-দরিদ্র, প্রজা-ভূস্বামী সকলেই সমবেতভাবে পিষ্ট হয়েছিলেন। সেই যন্ত্রণার উপশমের জন্য শ্যামামাতার স্নেহাঞ্চলে ভক্তের দল শিশুর আকুতি নিয়ে মিলিত হয়েছিলেন। অধ্যাপক অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সেই প্রসঙ্গে লিখেছেন : “…মধ্যযুগের বৈষ্ণব পদাবলী অপেক্ষা অষ্টাদশ-ঊনবিংশ শতাব্দীর শাক্তপদাবলীতে তদানীন্তন জীবনের বাতাবরণ অধিকতর স্পষ্ট হইয়াছে। কারণ গৌড়ীয় বৈষ্ণবসাধনা একপ্রকার সূক্ষ্ম সাঙ্কেতিক রসের লীলা, যাহার সঙ্গে পরিপার্শ্বের বিশেষ যোগ নাই।… অপর দিকে শাক্ত পদসাহিত্যের মাতাপুত্রের লীলা একেবারে প্রাকৃত স্নেহ-রসের দ্বারা পরিবেষ্টিত; আদিম পৃথিবীর বুকে চোখ চাহিয়া মানুষ, কে জানে, কাহার কাছে বরাভয় চাহিয়াছিল।”১ অষ্টাদশ শতাব্দীর উপদ্রুত বাঙালি আদ্যাশক্তির অঞ্চলতলে আশ্রয় চেয়েছিল। তাই খড়্গ-খর্পরধারিণী মহাকালী সব ঐশ্বর্য লুকিয়ে মাটির মায়ের স্নেহে সাধকদের কোলে তুলে নিয়েছিলেন। শাক্ত পদাবলিতে বাৎসল্যরস প্রধান। আর মর্তচেতনাই বাৎসল্যরসের প্রাণ।
কমলাকান্ত রচিত শ্যামাসংগীত শাক্ত সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। তাঁর কোনো কোনো পদ কবিত্বের প্রেক্ষিতে রামপ্রসাদ অপেক্ষাও উৎকৃষ্ট। তাঁর রচিত শাক্ত পদাবলিতে আবেগ, শিল্পরূপ তাত্ত্বিকতা, নিখুঁত ছন্দ ও প্রতীকের ব্যবহার সাধক এবং রসিক-পাঠকের কাছে পরম আদরের বস্তু। এছাড়াও কমলাকান্ত বৈষ্ণব ও শাক্তের দ্বন্দ্ব দূর করতে গিয়ে শ্যাম-শ্যামাকে যেভাবে এক করেছেন, তার ফলে তাঁর উদার মনোধর্ম ও সূক্ষ্ম বাকরীতির পরিচয় বহন করে। প্রথম জীবনে কমলাকান্ত বোধহয় বৈষ্ণব গোস্বামীর শিষ্য ছিলেন। কারণ, তাঁর রচিত তন্ত্রসাধনা সম্পর্কে বাংলা পয়ার ত্রিপদী ছন্দে সাধকরঞ্জন শীর্ষক একটি তত্ত্বগ্রন্থের সমাপ্তি পর্বে তিনি লিখেছেন : “প্রভু চন্দ্রশেখর গোস্বামী মহাধন।/ তার পদরেণু যার মস্তকভূষণ॥”২ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রামপ্রসাদ ও কমলাকান্ত বিপুল আয়তন শাক্ত পদসাহিত্যের মধ্যে আপন আপন স্বাতন্ত্র্য রক্ষা করেছেন। রামপ্রসাদের গান সুরের আশ্রয় না পেলে যেন দাঁড়াতে পারে না। কিন্তু কমলাকান্তের গানের অনেক স্থানে বিশুদ্ধ লিরিক (Lyric) রূপটি রক্ষিত হয়েছে। তাঁর পদ গান না করেও শুধু আবৃত্তিতে তার রসাস্বাদন করা যেতে পারে। সে যাই হোক, সাধনা ও কবিত্বে রামপ্রসাদ-কমলাকান্ত ভক্তির আকাশে যুগ্মতারা হিসাবে বিরাজ করছেন।৩
কমলাকান্তের আদি নিবাস কালনার অন্তর্গত অম্বিকা গ্রাম। পিতার নাম মহেশ্বর ভট্টাচার্য, মায়ের নাম মহামায়া দেবী। তাঁদের পরিবারের কৌলিক উপাধি সম্ভবত ‘বন্দ্যোপাধ্যায়’। কিন্তু কমলাকান্তের পিতা ও তিনি ভট্টাচার্য উপাধিতে পরিচিত ছিলেন। কবি বাল্যকালে স্থানীয় টোলে সংস্কৃত অধ্যয়ন করেন। বাল্যকালে পিতৃবিয়োগ হয়। ফলে তিনি মায়ের সঙ্গে মাতুলালয় চান্নাগ্রামে (বর্ধমান জেলার খানা জংশনের নিকটবর্তী একটি ছোট গ্রাম) আশ্রয়গ্রহণ করেন। কালনায় থাকার সময় তিনি বৈষ্ণব প্রভাবে প্রভাবিত ছিলেন, কিন্তু মাতুলালয়ে আসার পর শাক্ত মত গ্রহণ করে সিদ্ধিলাভ করেন। অবশ্য বৈষ্ণব মত তিনি সম্পূর্ণ ত্যাগ করেননি। কারণ, কয়েকটি শাক্ত পদে কবি কমলাকান্ত কালী ও কৃষ্ণকে অভিন্ন বলেছেন।৪
কমলাকান্তের সঙ্গে বর্ধমান রাজবংশের শ্রদ্ধাপ্রীতির সম্পর্ক ছিল। তাঁর কালনায় বসবাস করার সময় মহারাজাধিরাজ তেজচন্দ্র বর্ধমানের নিকটবর্তী কোটালহাটে কবির জন্য একটি বাড়ি নির্মাণ করে দিয়েছিলেন। শ্রীমৎ চিদানন্দ সাধকাষ্টক গ্রন্থে কমলাকান্তের বীরভূম জেলার তারাপীঠে গিয়ে সস্ত্রীক কৌলমন্ত্রে দীক্ষাগ্রহণের সংবাদ দিয়েছেন। তারপর কমলাকান্ত গৃহে প্রত্যাবর্তন করে পঞ্চবটী বনে পঞ্চমুণ্ডি আসনে কুলাচারপদ্ধতিতে সস্ত্রীক সাধনা করে সিদ্ধিলাভ করেন। তিনি পঞ্চমুণ্ডি আসনে সাধনা করলেও শবসাধনা করেননি। শুধু জপধ্যানের দ্বারা তিনি দেবীর কৃপালাভ করেন।৫ বর্ধমান রাজসরকারের তরফ থেকে কবিকে সেযুগে মাসিক দুশো টাকা বৃত্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। মহারাজ তেজচন্দ্র কমলাকান্তকে সভাপণ্ডিতের গৌরবজনক পদ দিয়েছিলেন। তাঁর পুত্র প্রতাপচন্দ্রের শিক্ষাদীক্ষার ভারও তিনি কমলাকান্তের হাতে অর্পণ করেন। ফলে রাজা প্রতাপচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ১৮২০ সালে রাজা প্রতাপচন্দ্রের মৃত্যুর পর কমলাকান্ত বেশিদিন জীবিত ছিলেন না। ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়-তৃতীয় দশকের মধ্যে প্রায় পঞ্চাশ বছর বয়সে কোটালহাটের আশ্রমে কমলাকান্ত নশ্বর দেহ পরিত্যাগ করেন। জীবিতকালে কবি সাধকরূপে বর্ধমান অঞ্চলে সর্বত্র স্বীকৃত হয়েছিলেন। তিনি বিবাহিত জীবনযাপন করেও তন্ত্রসাধনার মাধ্যমে শ্যামাপদে তাঁর মনপ্রাণ সম্পূর্ণভাবে অর্পণ করেন এবং প্রার্থিত সিদ্ধিলাভ করেছিলেন। এছাড়াও তিনি একটি টোল প্রতিষ্ঠা করে ছাত্রদের সংস্কৃত শিক্ষাদান করেছিলেন। তিনি বহু শ্যামাসংগীত ও পদ রচনা করেছিলেন, যার মূল্য অপরিসীম। কিন্তু সেই সম্পদ রক্ষা করার ক্ষেত্রে তিনি বিশেষ যত্নবান ছিলেন না। সেক্ষেত্রে বর্ধমান রাজবংশ কমলাকান্তের সৃষ্টি ও স্মৃতিকে ভক্তিভরে রক্ষা করেছিলেন। বর্ধমান রাজবংশের পরবর্তী বংশধর মহারাজাধিরাজ বিজয়চন্দ্ মহাতাব বাহাদুর কমলাকান্ত ও রাজা প্রতাপচন্দ্রের আন্তরিক সম্পর্ককে অবলম্বন করে ‘কমলাকান্ত’ শীর্ষক একটি নাটিকা রচনা করেছিলেন।
দেবী কালিকা যেমন রামপ্রসাদের কন্যারূপে বেড়া বাঁধতে সাহায্য করেছিলেন, তেমনি কমলাকান্তের মাহাত্ম্য বর্ণনার জন্য অনুরূপ ঘটনা প্রচলিত আছে। একবার নাকি দেবী কালিকা বাগদিনিরূপে উপস্থিত হয়ে সাধক-কবি কমলাকান্তকে মাছ জুগিয়েছিলেন। আরেকবার রাত্রিবেলায় তিনি চান্নাগ্রামের নিকটবর্তী ডাকাত-অধ্যুষিত বিস্তীর্ণ প্রান্তর ‘ওড়গাঁয়ের ডাঙ্গা’ অতিক্রম করে অগ্রসর হওয়ার সময় ডাকাতের সম্মুখীন হন। ডাকাতেরা তাঁর টাকাকড়ি কেড়ে নিয়ে তাঁকে হত্যা করতে উদ্যত হলে তিনি উচ্চকণ্ঠে শ্যামামায়ের নামগান আরম্ভ করেন। কমলাকান্ত গেয়েছিলেন : “আর কিছু নাই শ্যামা তোমার কেবল দুটি চরণ রাঙা।/ শুনি তাও নিয়েছেন ত্রিপুরারি, অতেব হলাম সাহস ভাঙ্গা॥” কমলাকান্তের সংগীতের আকুলতা দস্যুদের অন্তরকে স্পর্শ করে। তারা দস্যুবৃত্তি পরিত্যাগ করে কমলাকান্তের শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। কমলাকান্তের মাতৃভজনা তাঁকে আশ্চর্যভাবে প্রত্যয়ী করে তুলেছিল। তাঁর মৃত্যুকাল উপস্থিত হলে তেজচন্দ্র বাহাদুর তাঁকে গঙ্গাতীরে নিয়ে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে তিনি অসম্মত হয়ে বলেছিলেন : “কি গরজ কেন গঙ্গাতীরে যাব।/ আমি কেলে মায়ের ছেলে হয়ে বিমাতার কি স্মরণ লব॥”৬
শাক্ত পদাবলির রচয়িতাগণ আপন আপন ভাবে জগন্মাতার বন্দনা করেছেন। তাঁদের অনুভবে জগন্মাতা কখনো ইচ্ছাময়ী, কখনো করুণাময়ী, কখনো লীলাময়ী, কখনো ব্রহ্মময়ী, আবার কখনো বা কালভয়হারিণী। একই জগজ্জননীর অনন্ত গুণ, অনন্ত ঐশ্বর্য। কিন্তু এক-একটি পদে এক-একটি ভাব-দৃষ্টির পরিচয় পাওয়া যায়। সেগুলির মধ্যে ‘মাতৃপূজা’ পর্যায়ের পদগুলি গভীর দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ভাবে পূর্ণ। আমরা অনেক সময় আড়ম্বর সহযোগে মাতৃপূজা করে থাকি, কিন্তু আমাদের অনুরাগের অভাবে জগন্মাতা হয়তো সেই পূজা গ্রহণ করেন না। কোনো কোনো পদকর্তার মতে—মনো-বিল্বদল, ভক্তি-গঙ্গাজল ও প্রজ্বলিত জ্ঞান-দীপ সহকারে পূজা সম্পাদন করতে পারলে ব্রহ্মময়ী প্রসন্না হন। যে-সাধক মাতৃচরণে স্বার্থ ও বিলাস-বাসনা বলিদান করেন এবং ভেদবুদ্ধি বিসর্জন দিতে পারেন, তিনি মহাশক্তির কৃপালাভ করেন। ‘নাম-মহিমা’ পর্যায়ের অন্তর্ভুক্ত পদগুলিতে কালীনামের মহিমা কীর্তন রয়েছে। সাধক অবগত আছেন যে, কালীনামের গুণেই ভববন্ধন ছেদ করা সম্ভব। প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসের সঙ্গে যিনি মাতৃনাম জপ করতে পারেন, তাঁর কাছে তীর্থদর্শন বা বাহ্যপূজা নিষ্ফল মনে হয়। বাস্তবিক, বৈষ্ণব সাধকদের মতোন শক্তি-সাধকগণও নাম-মাহাত্ম্যে বিশ্বাস করেন।৭
কমলাকান্ত রচিত শ্যামাসংগীতগুলির মধ্যে উচ্চ আধ্যাত্মিক ভাব মিশ্রিত হয়ে রয়েছে। তাঁর পদাবলি একইসঙ্গে সুমধুর ও চিত্তাকর্ষক। রামপ্রসাদের মতোন তিনিও আগমনি ও বিজয়া সংগীত রচনা করেছেন। কমলাকান্তের আগমনি সংগীতে মানবিক রসের নিবিড়তা সহজেই অনুভূত হয়। তাঁর শ্যামাসংগীতে লোকপ্রিয় তত্ত্ব তো আছেই, সেইসঙ্গে রয়েছে ভক্তির নিবিড়তা।৮
শাক্ত দর্শন কালক্রমে অতি সূক্ষ্ম আকার ধারণ করেছে। সেই দর্শনের মূল ভিত্তি ষট্ত্রিংশৎ তত্ত্ব। সেই তত্ত্বগুলির মধ্যে পরমতত্ত্ব ও সৃষ্টিরূপে তার অভিব্যাপ্তির বিষয় বর্ণনা করা হয়েছে। শিবই শাক্তের পরম তত্ত্ব। এই শিব নিরীহ, নিস্পন্দ, গুণাতীত কিন্তু সচ্চিদানন্দস্বরূপ। ইনি শক্তির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। অদ্বৈত হলেও শক্তিবিশিষ্টাদ্বৈত—ইনি নির্বিশেষ শিব। শাক্ত দর্শনে শক্তি হলেন শিবের স্বাতন্ত্র্যশক্তি, অর্থাৎ সৃষ্টি বিষয়ে শিবের ইচ্ছাশক্তি। শক্তি শিবের প্রকাশ—যেমন সূর্যের প্রকাশ তেজ, অগ্নির দাহিকাশক্তি, মণির মণিদ্যুতি। এই শক্তি থেকেই সদাশিব, ঈশ্বর, বিদ্যাতত্ত্বের আবির্ভাব। এই তত্ত্বগুলি শিব-শক্তির অতিশুদ্ধ, অতিস্বচ্ছ প্রকাশ অর্থাৎ শক্তির অন্তর্মুখী পরিণাম। অন্যদিকে জীব শিবেরই অংশ। কিন্তু আচ্ছন্ন, মলাকীর্ণ। জীব মায়া, অবিদ্যা, কলা, রাগ, কাল ও নিয়তির অধীন। তাই জীবের স্থূলদেহ ভোগদেহ। অতএব তন্ত্রমতে শিব থেকে জীব বা সৃষ্টি পর্যন্ত সমস্ত কিছুই শক্ত্যাত্মক। ফলে কোথাও শক্তির প্রকাশ সুপ্ত, কোথাও স্থূলভাবে ক্রিয়াশীল। জীবদেহে এই শক্তি কুণ্ডলীশক্তিরূপে মূলাধারে অবস্থান করেন। শক্তি সেখানে জটপাকানো। তাই তিনি কুণ্ডলীরূপা। অবিদ্যায় জীবের শিবভাব আবৃত, তাই জীবের দুঃখের অন্ত নেই। দুঃখের কবল থেকে মুক্ত করে তাকে শিবস্বরূপে প্রতিষ্ঠা করাই শক্তিসাধনার লক্ষ্য। সাধনায় জগন্মাতা প্রসন্না হলে তা অবশ্যই সম্ভব।৯
কমলাকান্তের শাক্ত পদে আন্তরিক ভালবাসা মূর্ত হয়েছে। তাঁর সংগীতে একদিকে যেমন রয়েছে শান্ত সমাহিত নমনীয় ভাব, তেমনি অন্যদিকে তিনি শ্যামামায়ের প্রতি কখনো কখনো অভিমানের বার্তা প্রকাশ করেছেন। শাক্ত পদাবলি ও শ্যামাসংগীত রচনায় কমলাকান্ত ছাড়াও রামপ্রসাদ সেন, ঈশ্বর গুপ্ত, রতিকান্ত রায়, রামদুলাল নন্দী, নীলকণ্ঠ মুখোপাধ্যায়, রসিকচন্দ্র রায়, কালীদাস চট্টোপাধ্যায়, গিরিশচন্দ্র ঘোষ প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আধুনিক যুগে কাজী নজরুল ইসলামও শক্তিতন্ত্রের নবভাষ্যকাররূপে যথার্থ মর্যাদালাভ করেছেন।১০
১৮৫৭ সালে মহারাজাধিরাজ মহাতাবচাঁদ বাহাদুর শ্যামাসঙ্গীত নামক কাব্যগ্রন্থে কমলাকান্তের যাবতীয় পদাবলি মুদ্রিত আকারে প্রকাশ করেন। পরবর্তিকালে কমলাকান্তের যত পদসংগ্রহ প্রকাশিত হয়েছে, তার সবই শ্যামাসঙ্গীত গ্রন্থ অবলম্বনে সংকলিত হয়েছে। ১৮৫৭ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের ভূমিকায় লেখা হয়েছে : “…অনন্তর বর্দ্ধমানান্তঃপাতি কোটালহাটস্থিত উক্ত ভট্টাচার্য্যের আবাস গৃহ হইতে সুজীর্ণ অতি মলিন বর্ণ গীত পুস্তকদ্বয়, যাহা তিনি প্রথমাবস্থাবধি রচনা করিয়াছিলেন, অনুসন্ধান পূর্ব্বক তাঁহার ভ্রাতৃবধূর সমীপে তাহা প্রাপ্তানন্তর শ্রীযুক্ত বিপ্রদাস তর্কবাগীশ ভট্টাচার্য্য মহাশয় দ্বারা সংশোধন করাইয়া শ্রীনবীন চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতি মুদ্রাঙ্কিত করণের অনুমতি করেন, তদনুসারতঃ গভীর রত্নাকর গত বহ্বায়াসসাধ্য রত্নসমূহ সংগ্রহের ন্যায় সেই প্রাচীন পুস্তক হইতে গীত সকল একত্র সঙ্কলন ও শ্রীল-শ্রীযুক্ত বর্ধমানাধিপতির নিয়োজিত গায়কগণের দ্বারা রাগ রাগিণী তাল প্রভৃতি পরীক্ষা করিয়া মুদ্রাঙ্কিত করণে প্রবৃত্ত হইলাম, ইহাতে সঙ্গীত রসজ্ঞ ব্যক্তিব্যুহের আহ্লাদ ও উপকার দর্শিলে পরিশ্রমের সার্থকতা হইবেক।
“অনন্তর ঐ ভট্টাচার্য্যের রচিত সন ১২১৮ সালের লিখিত অন্য গ্রন্থদ্বয় পুনঃপ্রাপ্ত ও লোক প্রমুখাৎ প্রচলিত অনেক গীত অবগত হইয়া আহ্লাদ পূর্ব্বক সংগ্রহ করা গেল, ঐ সকল গীতের মধ্যে কতকগুলি গানের রাগ রাগিণী প্রভৃতি অপ্রকাশিত ছিল, এবিধায় যথাযোগ্য রাগাদি সংযোজিত হইল, এবং সে পুস্তক সন্দর্শন পূর্ব্বক এই সংগীত গ্রন্থ সংগৃহীত হইতেছে তাহার জীর্ণতার জন্য অনেক শব্দের পরিবর্ত্তন ও নিতান্ত দেশ্য ভাষার কতিপয় শব্দ রূপান্তরীকৃত হইল, কিন্তু তাহাতে রচকের প্রকৃত ভাবের বৈলক্ষণ্য হইবার সম্ভাবনাই নাই।
“ঐ প্রসিদ্ধ কবি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য্য পরমজাপক ছিলেন, তজ্জন্য তাঁহার নাম সর্ব্বত্র বিখ্যাত হইয়াছে, বিশেষতঃ এতদ্দেশের বহুতর ব্যক্তিগণ তাঁহার কৃত গীত গান করিয়া থাকেন, কিন্তু সম্যকরূপে কেহ অবগত নহেন, সুতরাং এই গীত পুস্তক দর্শন তাঁহাদের বিশেষ সন্তোষের কারণ হইবেক…।” ভূমিকার শেষের দিকে লিখিত হয়েছে : “অনন্তর বর্ত্তমান বর্দ্ধমানের শ্রীলশ্রীযুক্ত মহারাজাধিরাজ মহতাব্চন্দ্ বাহাদুর প্রাগুক্ত মহোদয় ঁকমলাকান্ত ভট্টাচার্য্যের কীর্ত্তি রক্ষার্থে শ্যামা পূজার বার্ষিক বৃত্তি ও তাঁহার ভ্রাতৃবধূর গ্রাসাচ্ছাদনার্থ বৃত্তি নিরূপণ করিয়া দিয়াছেন, এবং ঐ মহাত্মার মহৎকীর্ত্তি ও যশঃ সর্ব্বত্র সংঘোষণাবশ্যক বিধায় তাঁহার কৃত গীত সকল মুদ্রিত করিলেন, ইহাতে বিচক্ষণ বিজ্ঞ মহাশয়েরা এই গ্রন্থের প্রতি দৃষ্টিপাত করিলে তাঁহার দৈবশক্তি ও ঈশ্বর ভক্তির প্রকৃষ্ট পরিচয় প্রচুরতা প্রাপ্ত হইবেন।”১১ (প্রাচীন বাংলা ভাষার শব্দপ্রয়োগ, বানান ও বাক্যরীতি অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে।)।
১২৬৪ বঙ্গাব্দের ২২ ভাদ্র তারিখের (ইংরেজি ১৮৫৭ সাল) পর কমলাকান্ত রচিত শ্যামাসঙ্গীত শীর্ষক গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ ১৩৩২ বঙ্গাব্দে (ইংরেজি ১৯২৫ সাল) প্রকাশিত হয়। বস্তুতপক্ষে এই সংস্করণ পূর্ব গ্রন্থটির পুনর্মুদ্রণ। বর্ধমান রাজবাটী থেকে শারদীয় উৎসব উপলক্ষে বর্ধমানাধিপতি শ্রীযুক্ত বিজয়চন্দ্ মহতবের আদেশ অনুসারে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ আত্মপ্রকাশ করে। দ্বিতীয় সংস্করণের ভূমিকার শেষ ছত্রে সুরেন্দ্রকুমার বসু লিখেছেন : “ছাপার ভুল ব্যতীত অন্য কোনও কিছু সংশোধন বা পরিবর্ত্তন করা হইল না।”১২
কমলাকান্ত রচিত শ্যামাসঙ্গীত গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ গ্রন্থটি বর্তমান লেখক বাগবাজার-নিবাসী প্রদীপকুমার পাইনের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছেন। গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণ বাস্তবিক বর্তমানে দুষ্প্রাপ্য। এছাড়াও গ্রন্থে বাগবাজার লক্ষ্মীনিবাসের ‘বিবেকানন্দ পরিকর’ কিরণচন্দ্র দত্তের স্বাক্ষর রয়েছে। স্বাক্ষরের উপরিভাগে কিরণচন্দ্র লিখেছেন : “বর্দ্ধমানাধিপতি প্রদত্ত পরিষদ হইতে প্রাপ্ত ১১/১১/৩২।” গ্রন্থটি ১৯৩২ সালের ১১ নভেম্বর সম্ভবত কিরণচন্দ্র দত্তের হস্তগত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বাগবাজারে অবস্থিত লক্ষ্মীনিবাস শ্রীমা সারদার পদধূলিধন্য।
১৯২৫ সালে গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণে সর্বমোট ২৬৯টি পদ সংকলিত হয়েছে, তার মধ্যে ২৪৫টি শ্যামা বিষয়ক এবং ২৪টি রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক পদ। সেকালে সংগীত মুদ্রণের একটি বিশেষ ভঙ্গি পরিলক্ষিত হয়। নমুনা হিসাবে সর্বপ্রথম১৩ ও সর্বশেষ১৪ সংগীত-দুটি পর্যায়ক্রমে উপস্থাপিত হলো—
রাগিণী—পরজ।
তাল—জলদ তেতালা।
(১) বামার বয়স নবীন। না জানি এমন মেয়ে সমরে প্রবীণ। (স্থায়ী) আস্থাই।
সুচারু অঙ্গেরি শোভা কটিতট ক্ষীণ। সুরাসুরগণ মাঝে বসন বিহীন। ১। অন্তরা।
বুঝি এলো দয়াময়ী হইয়ে কঠিন। চরণে ত্যজিব তনু আজি শুভদিন। ২। তনু দিয়া তরে কত শত ক্রিয়াহীন। কমলাকান্তের হরে মনের মলিন। ৩। অভোগ।
রাগিণী—খাম্বাজ বাহার।
তাল—কাওয়ালির ঠেকা।
(২৬৯) কার সঙ্গে রজনী জাগিয়ে অঙ্গ তোমার হৃদি নখ ছিন্ন ভিন্ন তনু অতি, হেরি মনভ্রান্তি আমার॥ আস্থাই॥
কার নয়নের অঞ্জন বয়ানে পরেছ হে, রসিকের এই ব্যবহার। পীতাম্বর পরিহরি, পর পরিধেয় পরি, বাসনা পূরাইলে কার॥ ১॥ অন্তরা॥
তোমার ললাটে যাবক, পাবক নিন্দিত খণ্ডিত গজমতি হার। কমলাকান্ত এসেছ নিশি বঞ্চিয়ে, নিজগুণ করিয়ে প্রচার॥ ২॥ অন্তরা॥
ভারতবর্ষে তান্ত্রিক বিশ্বাস ও ক্রিয়া এতই জনপ্রিয় যে, ভারতবর্ষের অনেকগুলি ধর্মসম্প্রদায় কোনো-না-কোনো আকারে তান্ত্রিকতাকে নিজেদের ধর্মে-কর্মে আত্মসাৎ করেছে। শিব ও শক্তি বেদপূর্ব প্রাগৈতিহাসিক দেবতা। আর্য সাহিত্যে তাঁদের স্থান ছিল নগণ্য, তন্ত্রাচারও ছিল বহু-নিন্দিত। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয়, বৈদিক সাহিত্যে তাঁরা কালক্রমে নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন। ঋগ্বেদে, অথর্ববেদে, ব্রাহ্মণসাহিত্যে, উপনিষদে, পুরাণে এবং মহাকাব্যে, এমনকী বৌদ্ধধর্মেও শক্তিবাদের প্রভাব কম নয়।১৫ কবি কমলাকান্ত সেই সাধনধারার যোগ্য উত্তরসূরি। ঊনবিংশ শতাব্দীতে শ্রীরামকৃষ্ণ তন্ত্রসাধনার অপ্রয়োজনীয় বিষয়গুলি পরিত্যাগ করে তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধিলাভ করেন। শ্রীমা সারদাদেবীর অনুমতি ও আশীর্বাদক্রমে শ্রীরামকৃষ্ণ-পার্ষদ স্বামী সারদানন্দজী পরবর্তিকালে তন্ত্রসাধনায় সিদ্ধ হয়েছিলেন। শ্রীরামকৃষ্ণের দেবদুর্লভ কণ্ঠে এবং স্বামী সারদানন্দজী পরিবেশিত ভক্তিগীতিতে কমলাকান্ত রচিত অনেকগুলি সংগীত জগন্মাতা কালিকার চরণে অনেকবার নিবেদিত হয়েছে। সাধক-কবি কমলাকান্তের বিস্মৃতপ্রায় গ্রন্থটির পুনরাবির্ভাব জানি না কোন ইঙ্গিত বহন করছে! বোধকরি, ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছাই তার প্রথম ও শেষ কথা।
তথ্যসূত্র
১. বন্দ্যোপাধ্যায়, অসিতকুমার, বাংলা সাহিত্যের ইতিবৃত্ত, মডার্ণ বুক এজেন্সি প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ২০১৯-২০, ৩য় খণ্ড, ২য় পর্ব, পৃঃ ৩৫২,
২. দ্রঃ ঐ, পৃঃ ৩৪০
৩. দ্রঃ ঐ, পৃঃ ৩৫১
৪. দ্রঃ ঐ, পৃঃ ৩৪০
৫. দ্রঃ ঐ, পৃঃ ৩৪২
৬. দ্রঃ ঐ, পৃঃ ৩৩৯
৭. দ্রঃ সেনশাস্ত্রী, ত্রিপুরাশঙ্কর, শাক্ত পদাবলী, এস্ ব্যানার্জি এণ্ড কোং, কলিকাতা, ১৩৬৯, পৃঃ ৫৩-৫৪
৮. দ্রঃ গোস্বামী, প্রভাতকুমার, ভারতীয় সঙ্গীতের কথা, বুকসিন্ডিকেট প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৬১, পৃঃ ১১০
৯. দ্রঃ চক্রবর্তী, জাহ্নবীকুমার, প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও বাঙ্গালীর উত্তরাধিকার, ডি. এম. লাইব্রেরী, কলিকাতা, ১৩৭১, পৃঃ ১৯১-১৯২
১০. দ্রঃ ঘোষাল, ডঃ অনুপ, গানের ভুবনে, দেবব্রত কর, কলকাতা, ১৪০৮, পৃঃ ৯৬
১১. ভট্টাচার্য্য, কমলকান্ত, শ্যামাসঙ্গীত, বর্দ্ধমান রাজবাটী, বর্দ্ধমান শারদীয়োৎসব ১৩৩২, ১৯২৫, শ্রীশ্রীকালী শরণং, অথ ভূমিকা
১২. ঐ, ভূমিকার প্রথম পৃষ্ঠা
১৩. দ্রঃ ঐ, পৃঃ ১
১৪. দ্রঃ ঐ, পৃঃ ১৪৭
১৫. দ্রঃ প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্য ও বাঙ্গালীর উত্তরাধিকার, পৃঃ ১৯৭
‘স্বামী বীরেশ্বরানন্দ স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।
সম্পাদক, রামকৃষ্ণ মিশন বিদ্যাপীঠ, পুরুলিয়া