পূজা
শাস্ত্রে পূজার অনেক প্রকার সংজ্ঞা পাওয়া যায়। ভাবনোপনিষদ-এ রয়েছে—পূজকের নিজেকে দেবতার কাছে সমর্পণ-সম্বন্ধই পূজা। আবার মহানির্বাণতন্ত্র-এ সেবক এবং ঈশ্বরের ঐক্যকে পূজা বলা হয়েছে।১
পূজার উদ্দেশ্য
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীভগবান বলেছেন—দ্রব্যময় যজ্ঞ থেকে জ্ঞানযজ্ঞ শ্রেয়স্কর। সকল কর্মই ব্রহ্মজ্ঞানে পরিসমাপ্ত হয়। যোগিনীতন্ত্র-এ বলা হয়েছে—পূজা প্রভৃতি কর্মের দ্বারা ভক্তিলাভ হয়। ভক্তির দ্বারা জ্ঞান অর্থাৎ ব্রহ্মজ্ঞান লাভ হয় এবং ব্রহ্মজ্ঞানেই মুক্তি হয়।২
পূজার প্রকারভেদ
বিভিন্ন শাস্ত্রে অধিকারী, উদ্দেশ্য ইত্যাদির কারণে পূজার বিভিন্ন প্রকারভেদ লক্ষ্য করা যায়। দেবী ভাগবত-এ বাহ্য ও আভ্যন্তর—এই দুই প্রকার পূজার কথা বলা হয়েছে। বাহ্য পূজা আবার দুই প্রকার—বৈদিক এবং তান্ত্রিক। আভ্যন্তর পূজা দুই প্রকার—সাধারা এবং নিরাধারা। রুদ্রযামল বচনে দেখা যায় যে, তান্ত্রিক পূজার তিনটি বিভাগ করা হয়েছে। সেগুলি হলো নিত্য, নৈমিত্তিক এবং কাম্য। গন্ধর্বতন্ত্র-এ আবার নিত্য, নৈমিত্তিক এবং কাম্য পূজাকে যথাক্রমে সাত্ত্বিক, রাজসিক ও তামসিক পূজা বলা হয়েছে। রুদ্রযামলে পূজার তিনটি ভেদ হলো—মানস, সাক্ষাৎ এবং বচোময়। মুণ্ডমালাতন্ত্র বচনে তিন প্রকার পূজা হলো—মানসী, অন্তর্যাগাত্মিকা এবং বাহ্যা।
কেন পূজা করা উচিত
স্মৃতিচিন্তামণি গ্রন্থে দেবীপুরাণ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে—
“কৃত্বৈবং পরমামাপুর্নির্বৃতিং ত্রিদিবৌকসঃ। এবমন্যৈরপি সদা দেব্যাঃ কার্য্যং প্রপূজনম্॥
বিভূতিমতুলাং লব্ধুং চতুর্বর্গপ্রদায়িকাম্।”
—“দেবগণ এই ভাবে দেবীর পূজা করিয়া, পরম সুখ (নিবৃত্তি) লাভ করিয়াছিলেন। এই ভাবে মনুষ্যগণও ধর্ম্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ এই চতুর্ব্বর্গ ফলপ্রদ এবং অতুল ঐশ্বর্য্য লাভের কারণে দেবীর পূজা করিবে।”৩
নিত্য ও কাম্য পূজা
বিভিন্ন বাৎসরিক পূজানুষ্ঠানের মধ্যে নানা ব্যবস্থাপনার প্রয়োজন হয় পূজা ঠিক ঠিক শাস্ত্রবিহিতভাবে সম্পন্ন করার জন্য। তার জন্যই প্রয়োজন সর্বতোভদ্রমণ্ডল-এর। সবার বিশেষ করে দৃষ্টি আকর্ষণ করে দুর্গাপূজায় যখন ঘটস্থাপন করা হয় এক-এক তিথিতে পূজার জন্য। স্মৃতিচিন্তামণি গ্রন্থে বলা হয়েছে—‘দুর্গাপূজা নিত্যা কাম্যা চ’৪—অর্থাৎ দুর্গাপূজা নিত্য ও কাম্য পূজা। গন্ধর্বতন্ত্র-এ বলা হয়েছে, যে-পূজা প্রতিদিন করতে হয়, তাকে বলে নিত্যপূজা। ঐ একই তন্ত্রে বলা হয়েছে—শ্রুতি-স্মৃতিবিহিত বিশেষ বিশেষ ফলপ্রাপ্তির জন্য যে-পূজা করা হয়, তাকে বলে কাম্যপূজা।৫
মণ্ডল
কুলার্ণবতন্ত্র গ্রন্থে দীক্ষা সম্পর্কিত একটি শ্লোকে বলা হয়েছে—
“মণ্ডলং কলসদ্রব্যশুদ্ধিগন্ধাষ্টকাদিকম্ ।
দীক্ষাকামপ্রদানাদি জ্ঞাত্বা দীক্ষাং সমাচরেৎ॥”৬
‘মণ্ডলং’—দীক্ষার সময়ে আত্মশুদ্ধি প্রভৃতি পঞ্চশুদ্ধির পর যথাবিধি মণ্ডল অঙ্কন করে সেই মণ্ডলে পূজা করার বিধি তন্ত্রে নির্দিষ্ট হয়েছে। এখানে ‘মণ্ডল’ অর্থে তন্ত্রবিহিত পদ্মভূয়িষ্ঠ চিত্র বিশেষ। সর্বতোভদ্রমণ্ডল, নভোমণ্ডল ইত্যাদি মণ্ডলের কথা শাস্ত্রে বিবৃত হয়েছে।
শ্রীশ্রীহরিভক্তিবিলাস গ্রন্থে পূজাতে মণ্ডল নির্মাণবিধি সম্বন্ধে বলা হয়েছে—
“মণ্ডপস্য চ নৈঋত্যাং বিধিবদ্বাস্তুমণ্ডলম্।
মধ্যে চ দেবতার্চার্থং সর্ব্বতোভদ্রমালিখেৎ।
সকর্ণিকঞ্চ তন্মধ্যে পদ্মং বিরচয়েত্তথা।
স্বস্তিকং চোত্তরে কৃত্বা তত্র শয্যাং নিবেশয়েৎ॥”৭
অর্থাৎ, মণ্ডপের নৈঋত কোণ বিধানে বাস্তুমণ্ডল, মধ্যস্থলে দেবপূজার্থ সর্বতোভদ্রমণ্ডল, তার মধ্যে সকর্ণিক পদ্ম এবং উত্তরদিকে স্বস্তিক রচনাপূর্বক তাতে শয্যাবিন্যাস করবে।
বিশ্বকোষ গ্রন্থে বলা হয়েছে—“দেবপ্রতিষ্ঠা, ব্রতপ্রতিষ্ঠা প্রভৃতিতে পঞ্চবর্ণ গুঁড়ি দ্বারা যে-মণ্ডল প্রস্তুত করা হয়, তাহাকে সর্বতোভদ্রমণ্ডল কহে। ইহা এক প্রকার পূজাধার যন্ত্র। এই মণ্ডলের উপর ঘটাদি স্থাপন করিয়া তদুপরি দেবপূজা করিতে হয়। এই মণ্ডল অঙ্কন করিলে একখানি সুন্দর আসনের ন্যায় প্রতীয়মান হয়।… সর্বতোভদ্রমণ্ডল অঙ্কন করিতে না পারিলে স্বল্পসর্বতোভদ্রমণ্ডল এবং তাহাও অঙ্কন করিতে না পারিলে তদভাবে অষ্টদল পদ্ম অঙ্কন করিয়া পূজাদি করিবে।”৮
মণ্ডল ও যন্ত্রের পার্থক্য
এই বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া রয়েছে কুলার্ণবতন্ত্র গ্রন্থে—
“মঙ্গলত্বাচ্চ ডাকিন্যা যোগিনীগণসংশ্রয়াৎ।
ললিতত্বাচ্চ দেবেশি মণ্ডলং পরিকীর্তিতম্॥”
অর্থাৎ, হে দেবেশি, মঙ্গলত্বের জন্য ডাকিনীর অধিষ্ঠান হেতু, যোগিনীদের সংশ্রয় হেতু এবং লালিত্যের জন্য মণ্ডল বলা হয়।
এই গ্রন্থে যন্ত্রের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে—
“যমভূতাদিসর্বেভ্যো ভয়েভ্যোঽপি কুলেশ্বরি।
ত্রায়তে সততঞ্চৈব তস্মাদ্ যন্ত্রমিতীরিতম্॥”৯
অর্থাৎ, হে কুলেশ্বরি, যমভূতাদি সমস্ত ভয় থেকে সর্বদা ত্রাণ করে, এইজন্য বলা হয় যন্ত্র।
সর্বতোভদ্রমণ্ডল
মহালয়া থেকে বিজয়া পুস্তকে সর্বতোভদ্রমণ্ডলের একটি সুন্দর ব্যাখ্যা পাওয়া যায়—“‘সর্বতোভদ্রমণ্ডল’ কথাটির অর্থ সর্ববিষয়ে কল্যাণের জন্য যে মণ্ডল। ‘ভদ্র’ শব্দটি ‘ভদ্’ ধাতুতে ‘রক্’ প্রত্যয় করে নিষ্পন্ন হয়েছে। আচার্য পাণিনি বলেছেন ‘ভদি কল্যাণে সুখে চ’। অতএব ‘ভদ্র’ শব্দের অর্থ কল্যাণ। বৈদিক সাহিত্যেও কল্যাণ অর্থেই ইহার প্রয়োগ দেখা যায়। ঋগ্বেদের বিশ্বদেব সূক্তে বলা হয়েছে—‘হে দেবগণ, আমরা কান দিয়ে যেন কল্যাণকর কথা শুনি।—ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবাঃ’। ‘সর্ব’ শব্দে সপ্তমী বিভক্তির অর্থে ‘তসিল্’ প্রত্যয় করে সর্বতো শব্দের অর্থ হয় সর্বত্র, সর্বস্থানে বা সর্ববিষয়ে। শুক্লযজুর্বেদের রুদ্রস্তুতিতেও এ অর্থেই শব্দটির প্রয়োগ দেখা যায়—‘যে ব্রহ্মের হাত, পা, চোখ, মাথা ও মুখ সর্বত্র রয়েছে—সর্বতঃ পাণিপাদং তৎ সর্বতোঽক্ষিশিরোমুখম্’। আর মণ্ডল শব্দের অর্থ হল পূজার আধার। বলা হয়েছে শব্দকল্পদ্রুমে—‘পূজাধারঃ মণ্ডলবিশেষঃ’। অতএব সর্বতোভদ্রমণ্ডলের আরেকটি অর্থ হল, যে আধারে পূজা করলে সর্ববিষয়ে কল্যাণ হয়।”১০ দুর্গাপূজায় সর্বতোভদ্রমণ্ডলের ওপর ঘটস্থাপনা করেই মহাপূজা সম্পন্ন করা হয়।
সর্বতোভদ্রমণ্ডল প্রস্তুত করার পদ্ধতি
এবিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ জানা যায় তন্ত্রসার, আগম-তত্ত্ব-বিলাস এবং সারদাতন্ত্র-এ। আগম-তত্ত্ব-বিলাস গ্রন্থে উপস্থাপিত হয়েছে এই সম্বন্ধীয় বিস্তারিত নির্দেশ—“অনন্তর সর্বতোভদ্রমণ্ডল কথিত হইতেছে। শারদাতিলক তন্ত্রে বলিয়াছেন—প্রথমে চারিটি কোষ্ঠ যুক্ত একটি চতুরস্র মণ্ডল করিবেন। সেই চারিটি কোষ্ঠে চারিটি কোণ সূত্রপাত করিবেন। সেই চারিটি কোষ্ঠে এমনভাবে কোণ সূত্রপাত করিবেন যাহাতে মধ্যে মধ্যে মৎস্যসমূহ উৎপন্ন হয়। তাহার পর মন্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ গুরু সেই মৎস্যসমূহে পূর্ব পশ্চিম দীর্ঘ দুইটি ও উত্তর দক্ষিণ দীর্ঘ দুইটি সম সূত্রপাত করিবেন। ইহাতে চতুরস্র মণ্ডলে ১৬টি কোষ্ঠ উৎপন্ন হইবে। সেই মৎস্যসমূহে পুনরায় সমান চারিটি সূত্রপাত করিবেন। পূর্ববৎ কোণ কোষ্ঠ চারিটিতে চারিটি কর্ণ সূত্রপাত করিবেন। তাহাতে যে মৎস্যসমূহ উৎপন্ন হইবে, সেই মৎস্যসমূহে পূর্বের ন্যায় পূর্ব-পশ্চিম দীর্ঘ ও উত্তর-দক্ষিণ দীর্ঘ দুই দুইটি করিয়া চারিটি সমসূত্র পাত করিবেন। এই চারিটি সূত্রপাতের দ্বারা অন্তরাল কোষ্ঠের চারিটি মৎস্য হইবে। সেই মৎস্যসমূহে পুনরায় সমসূত্রপাত করিবেন। মন্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ আচার্য্য যাবৎ দুই শত ষট্পঞ্চাশৎ (২৫৬) কোষ্ঠ উৎপন্ন না হয়, তাবৎ পর্যন্ত সেই বিধি অনুসারে পূর্বোক্ত প্রকারে সেই মৎস্যসমূহে সূত্রপাত করিবেন। দৈর্ঘ্য ও বিস্তারে ষোড়শ কোষ্ঠ করা হইলে সেই ২৫৬ কোষ্ঠ হইবে। কোষ্ঠসমূহের তুল্য পরিমাণের জন্য কোষ্ঠসমূহে কর্ণ সূত্রপাত করিতে হয়, ইহা জানিবেন। মধ্যে ছত্রিশটি কোষ্ঠের দ্বারা একটি সুলক্ষণ পদ্ম হইবে। পদ্মের বাহিরে চারিদিকে আঠাইশটি কোষ্ঠরূপ একটি পঙ্ক্তি দ্বারা পীঠ হইবে। তাহার বাহিরের চারিদিকে আশিটি কোষ্ঠরূপ দুইটি পঙ্ক্তি দ্বারা বিথীকা হইবে। তাহার বাহিরের চারিদিকে একশত বারটি কোষ্ঠরূপ অবশিষ্ট দুইটি পঙ্ক্তি দ্বারা দ্বার, শোভা, উপশোভা ও কোণ কল্পনা (রচনা) করিবেন। তাহার পর মন্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ আচার্য্য শাস্ত্রোক্ত বিধি অনুসারে পদ্ম অঙ্কন করিবেন। ষট্ত্রিংশৎ (৩৬) কোষ্ঠাত্মক পদ্মক্ষেত্রের চারিদিকে বহির্ভাগে দ্বাদশ অংশ ত্যাগ করিয়া সুধী সাধক তাহার মধ্যবর্তী দশটি অংশকে সমানভাগে তিনটি বৃত্তের দ্বারা বিভাগ করিবেন। এই তিনটি বৃত্তের মধ্যে সাদা বৃত্তটি কর্ণিকার স্থান অর্থাৎ প্রথম বৃত্তের স্থানে পদ্মের কর্ণিকা হইবে। দ্বিতীয় বৃত্তটি পদ্মের কেশরের স্থান—প্রথম বৃত্ত হইতে দ্বিতীয় বৃত্তের মধ্যবর্তী স্থানে কেশর করিবেন। তৃতীয় বৃত্তটি পদ্মের পত্রের স্থান—দ্বিতীয় বৃত্ত হইতে তৃতীয় বৃত্তের মধ্যবর্তী স্থানে পত্রসমূহ করিবেন। মুক্ত অংশের দ্বারা অর্থাৎ দ্বাদশ অংশের স্থানে দলের অগ্র করিবেন। বাহ্য পত্র বৃত্তের অন্তরালের যে মান, সেই মানে সুধী সাধক কেশর বৃত্তের অগ্রে সূত্রের আদি (মূল) রাখিয়া যথাবিধানে পদ্ম মধ্য সূত্রের উভয় দিকে অর্দ্ধচন্দ্র লিখিয়া সেই অর্দ্ধচন্দ্রে তাহার সন্ধি সংস্থান চারিটি সূত্রপাত করিবেন। দলাগ্রের যে পরিমাণ অর্থাৎ বাহিরে যে দ্বাদশাংশ ত্যাগ করা হইয়াছে, তাহার যে পরিমাণ, সেই পরিমাণ চতুর্থ বৃত্ত লিখিবেন। দলাগ্র বৃত্তের অন্তরালে সুধী সাধক তাহার মধ্য সূত্রের উভয় দিকে বাহ্য হস্তের দ্বারা চারি দিকে অর্থাৎ দিক্ ও বিদিকে দলাগ্র লিখিবেন। দলের মূলসমূহে দুই দুইটি করিয়া কেশরসমূহ অঙ্কন করিবেন। তন্ত্রবিদ্গণ কর্ত্তৃক ইহা সাধারণ পদ্ম বলিয়া কথিত হইয়াছে। পীঠ পঙ্ক্তির কোণ কোষ্ঠ ও তাহার দুই পার্শ্বের দুই কোষ্ঠকে পাদের জন্য মুছিয়া দিবেন। সুধী সাধক বাকি চারিটি কোষ্ঠের দ্বারা পীঠ-গাত্র রচনা করিবেন। বিথীর জন্য রক্ষিত দুইটি পঙ্ক্তির কোষ্ঠগুলি এক আকারে মুছিয়া ফেলিবেন অর্থাৎ এক পঙ্ক্তি করিবেন। তাহার পর চারি দিকে ভিতরে পঙ্ক্তির মধ্য সূত্রের উভয় পার্শ্বের দুইটি কোষ্ঠ এবং সর্ব বাহিরের শেষ পঙ্ক্তির মধ্য সূত্রের উভয় পার্শ্ববর্ত্তী কোষ্ঠ দুই-দুইটি করিয়া চারিটি কোষ্ঠ মুছিয়া চারিটি দ্বার রচনা করিবেন। অনন্তর দ্বারের দুই পার্শ্বে ভিতরের তিন-তিনটি কোষ্ঠ এবং বাহিরের এক একটি কোষ্ঠকে মুছিয়া দ্বারের দুই পার্শ্বে দুই দুইটি শোভা হইবে। অনন্তর চারি দিকের উপরের পঙ্ক্তির শোভা সংলগ্ন এক একটি কোষ্ঠ এবং সর্বনিম্ন পঙ্ক্তির তিন তিনটি কোষ্ঠ মুছিয়া এক করিয়া চারিদিকে আটটি উপশোভা হইবে। কোণের অবশিষ্ট ছয় ছয়টি কোষ্ঠ দ্বারা চারিটি কোণ হইবে।… এই মণ্ডলের বাহিরে চারি দিকে এক এক অঙ্গুলি পরিমাণ উচ্চতা ও বিস্তার যুক্ত মনোহর শুক্লবর্ণ সীমারেখা করিতে হইবে। মন্ত্রজ্ঞ সাধক এই পদ্মের কর্ণিকাকে পীতবর্ণ চূর্ণের দ্বারা এবং কেশরগুলিকে অরুণবর্ণ চূর্ণের দ্বারা রঞ্জিত করিবেন। মন্ত্রজ্ঞ সাধক ঐ পদ্মের পত্রগুলিকে শুক্লবর্ণ চূর্ণ দ্বারা এবং পত্রের সন্ধিগুলিকে শ্যামলবর্ণ চূর্ণ দ্বারা রঞ্জিত করিবেন। অথবা কর্ণিকা পীতই হইবে। (ইহা রক্তপদ্ম পক্ষে বুঝিতে হইবে।) ঐ রক্তপদ্মের কেশরগুলি পীতরক্ত, দলগুলি অরুণবর্ণ এবং সন্ধিগুলি কৃষ্ণবর্ণ হইবে। সিত (শুক্ল) বর্ণ চূর্ণ দ্বারা অথবা কৃষ্ণবর্ণ চূর্ণ দ্বারা পীঠগর্ভগুলিকে (পদ্মক্ষেত্রের কোণগুলিকে) রঞ্জিত করিবেন। পাদগুলি অরুণবর্ণ, তাহার গাত্রগুলি শুক্লবর্ণ হইবে। চারিটি বিথীতে নানাবিধ বর্ণের দ্বারা ও চিত্র বর্ণের দ্বারা সকলের দৃষ্টিমনোহর পত্র, পুষ্প ও ফলযুক্ত কল্পলতাগুলি করিবেন। দ্বারগুলি শ্বেতবর্ণ, শোভাগুলি রক্তবর্ণ, উপশোভা পীতবর্ণ এবং কোণগুলি কৃষ্ণবর্ণ বলিয়া কথিত হইয়াছে। সীমারেখার বাহিরে যথাক্রমে শুক্ল, রক্ত ও অসিত (শ্যাম) বর্ণের তিনটি রেখা করিবেন। এই সর্বতোভদ্রমণ্ডল পূজা, হোম, যাগ প্রভৃতি সকল কার্য্যে সাধারণ বলিয়া কথিত হইয়াছে।”১১
এবিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ জানা যায় তন্ত্রসার, আগম-তত্ত্ব-বিলাস এবং সারদাতন্ত্র-এ। আগম-তত্ত্ব-বিলাস গ্রন্থে উপস্থাপিত হয়েছে এই সম্বন্ধীয় বিস্তারিত নির্দেশ—“অনন্তর সর্বতোভদ্রমণ্ডল কথিত হইতেছে। শারদাতিলক তন্ত্রে বলিয়াছেন—প্রথমে চারিটি কোষ্ঠ যুক্ত একটি চতুরস্র মণ্ডল করিবেন। সেই চারিটি কোষ্ঠে চারিটি কোণ সূত্রপাত করিবেন। সেই চারিটি কোষ্ঠে এমনভাবে কোণ সূত্রপাত করিবেন যাহাতে মধ্যে মধ্যে মৎস্যসমূহ উৎপন্ন হয়। তাহার পর মন্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ গুরু সেই মৎস্যসমূহে পূর্ব পশ্চিম দীর্ঘ দুইটি ও উত্তর দক্ষিণ দীর্ঘ দুইটি সম সূত্রপাত করিবেন। ইহাতে চতুরস্র মণ্ডলে ১৬টি কোষ্ঠ উৎপন্ন হইবে। সেই মৎস্যসমূহে পুনরায় সমান চারিটি সূত্রপাত করিবেন। পূর্ববৎ কোণ কোষ্ঠ চারিটিতে চারিটি কর্ণ সূত্রপাত করিবেন। তাহাতে যে মৎস্যসমূহ উৎপন্ন হইবে, সেই মৎস্যসমূহে পূর্বের ন্যায় পূর্ব-পশ্চিম দীর্ঘ ও উত্তর-দক্ষিণ দীর্ঘ দুই দুইটি করিয়া চারিটি সমসূত্র পাত করিবেন। এই চারিটি সূত্রপাতের দ্বারা অন্তরাল কোষ্ঠের চারিটি মৎস্য হইবে। সেই মৎস্যসমূহে পুনরায় সমসূত্রপাত করিবেন। মন্ত্রশাস্ত্রজ্ঞ আচার্য্য যাবৎ দুই শত
সর্বতোভদ্রমণ্ডল প্রস্তুতিতে কী কী রং ব্যবহৃত হয়
আগম-তত্ত্ব-বিলাস গ্রন্থে এবিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—
“রঞ্জয়েৎ পঞ্চভির্বর্ণৈর্মণ্ডলং তন্মনোহরম্।
পীতং হরিদ্রাচূর্ণং স্যাৎ সিতং তণ্ডুল-সম্ভবম্॥
কুসুম্ভচূর্ণমরুণং কৃষ্ণং দগ্ধপুলাকজম্।
বিল্বাদি-পত্রজং শ্যামমিত্যুক্তং বর্ণপঞ্চকম্॥”১২
অর্থাৎ, সেই মনোহর মণ্ডলকে পাঁচটি বর্ণের চূর্ণ দ্বারা রঞ্জিত করবে। হলুদ রং—হলুদের (হরিদ্রা) গুঁড়া (চূর্ণ), সাদা (শুক্ল) রং—আতপচালের (তণ্ডুল) গুঁড়া, লাল রং—কুসুম্ভ (কুসুম) ফুলের গুঁড়া, কালো রং—ধানের তুষ বা চিটা পুড়িয়ে (দগ্ধ-পুলাকের) গুঁড়া, আর সবুজ (শ্যাম অর্থাৎ হরিৎ) রং—বেলপাতার গুঁড়া।
পূজাতে মণ্ডলের প্রয়োজনীয়তা ও কল্যাণকর মণ্ডল
কুলার্ণবতন্ত্র গ্রন্থে বলা হয়েছে—
“মণ্ডলেন বিনা পূজা নিষ্ফলা কথিতা প্রিয়ে।
তস্মান্মণ্ডলমালিখ্য বিধিবত্তত্র পূজয়েৎ॥”
—প্রিয়ে, মণ্ডল ব্যতীত পূজা নিষ্ফল হয়। সেজন্য, যথাবিধি মণ্ডল অঙ্কন করে সেখানে পূজা করতে হবে।
“অখণ্ডমণ্ডলাকারং বিশ্বং ব্যাপ্য ব্যবস্থিতম্।
ত্রৈলোক্যং মণ্ডিতং যেন মণ্ডলং তৎ সদা শিবম্॥”১৩
—যা অখণ্ডমণ্ডলাকার, বিশ্বব্যাপ্ত করে যা অবস্থিত, ত্রৈলোক্য যা দ্বারা মণ্ডিত, তা-ই সদা কল্যাণকর মণ্ডল।
এছাড়া (ক) নবনাভমণ্ডল সম্বন্ধে বৃহৎতন্ত্রসারঃ গ্রন্থে এর বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে—নবনাভমণ্ডল সর্বসিদ্ধিপ্রদ—‘মণ্ডলং সর্বসিদ্ধিদম্’; (খ) পঞ্চাব্জমণ্ডল সম্বন্ধেও উক্ত গ্রন্থে তার প্রস্তুতির বর্ণনা দিয়ে বলা হয়েছে—‘সর্বতন্ত্রানুসারেণ প্রোক্তং সর্বসমৃদ্ধিদম্’১৪ অর্থাৎ সর্বতন্ত্র অনুসারে এই মণ্ডল সর্বসমৃদ্ধি-প্রদানকারী।
তথ্যসূত্র
১. দ্র: দাস, উপেন্দ্রকুমার, শাস্ত্রমূলক ভারতীয় শক্তিসাধনা, রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, কলকাতা, ২০১১, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৮৩১
২. দ্র: ঐ
৩. ভট্টাচার্য, হরিদাসসিদ্ধান্তবাগীশ, স্মৃতিচিন্তামণিঃ, সিদ্ধান্তবিদ্যালয়, কলিকাতা, ১৩৫৫, পৃঃ ৯৭
৪. ঐ
৫. গন্ধর্বতন্ত্রম্, চৌখম্বা সংস্কৃত সীরীজ অফিস, বারাণসী, ২০০৯, ২২।১০, ১২
৬. দাস, উপেন্দ্রকুমার (সম্পাদিত), কুলার্ণবতন্ত্রম্, নবভারত পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৩৮৩, পৃঃ ৪০৭
৭. গোস্বামী, গোপালভট্ট, শ্রীশ্রীহরিভক্তিবিলাসঃ, মহেশ, ১৯৯৮, পৃঃ ৬৬০
৮. বসু, নগেন্দ্রনাথ, বিশ্বকোষ, বিশ্বকোষ প্রেস, কলকাতা, ১৯০৬, ২১ খণ্ড, পৃঃ ৩১৯
৯. কুলার্ণবতন্ত্রম্, ১৭।৫৯, ৬১
১০. আচার্য, ডঃ হরিপদ, মহালয়া থেকে বিজয়া, শান্তি আচার্য (প্রকাশক), নরেন্দ্রপুর, ১৩৯৮, পৃঃ ২৮-২৯
১১. ভট্টাচার্য, রঘুনাথ তর্কবাগীশ, আগম-তত্ত্ব-বিলাসঃ, নবভারত পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৯৮৫, পৃঃ ১৮৪—৮৮
১২. ঐ, পৃঃ ১৮৭
১৩. কুলার্ণবতন্ত্রম্, ৬।২৩-২৪
১৪. আগমবাগীশ, কৃষ্ণানন্দ, বৃহৎ তন্ত্রসারঃ, নবভারত পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৩৩৯, পৃঃ ১২৮-২৯
১৫. ‘স্বামী বিরজানন্দ স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।
রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের অছি পরিষদ ও পরিচালন সমিতির সদস্য