বেশ কয়েক বছর আগের কথা। শ্রীশ্রীমায়ের একটি বাণীর তাৎপর্য ঠিকভাবে ধরতে পারছিলাম না বলে পূজনীয় স্বামী প্রভানন্দজীর নির্দেশে আমি বারাণসী অদ্বৈত আশ্রমে স্বামী সত্ত্বানন্দজীকে (সত্যেন মহারাজ) এক পত্র লিখি। তিনি শ্রীশ্রীমায়ের মন্ত্রশিষ্য রাসবিহারী মহারাজ অর্থাৎ স্বামী অরূপানন্দজীর সঙ্গ করেছেন। শ্রীশ্রীমায়ের কথায় স্বামী অরূপানন্দজীর লেখাতেই আমি ঐ বাণীটি পাই। আমার জিজ্ঞাসার উত্তরে স্বামী সত্ত্বানন্দজী যা লিখেছিলেন তা বাস্তবিক আমাদের সকলের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। তার থেকে প্রাসঙ্গিক কিছু অংশ ‘উদ্বোধন’-এর পাঠকদের ভাল লাগবে বলে এখানে নিবেদন করছি। স্বামী সত্ত্বানন্দজী লিখেছিলেন : “প্রথমত জানাই যে, আমি আক্ষরিকভাবে যদিও রাসবিহারী মহারাজের (স্বামী অরূপানন্দ) সেবক ছিলাম না তবু তাঁর একান্ত স্নেহধন্য ছিলাম। আমি তো সেবাশ্রমের কর্মী ছিলাম। তিনি কাশী অদ্বৈত আশ্রমে বৃদ্ধ ও পূজনীয় সাধু হিসাবে বাস করছিলেন। সেসময়ে পূজনীয় শান্তানন্দ মহারাজও ছিলেন। ওঁদের কাছে—বিশেষত রাসবিহারী মহারাজের কাছেই আমি বেশি যেতাম শ্রীশ্রীমায়ের কথা শোনার জন্য।
“শ্রীশ্রীমায়ের যে-কথাটি সম্বন্ধে আপনার প্রশ্ন অর্থাৎ ‘পাবে পাবে, তুমি সব পাবে। যা ভাব সব পাবে। স্বামীজী পেয়েছিলেন না?’ সে-সম্বন্ধে বলি—স্বামীজী বলতে বিবেকানন্দ, এবিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে বাকি অংশের সঠিক উত্তর দেওয়া মুশকিল। কারণ, মা বলেছেন—‘যা ভাব সব পাবে।’ এখন রাসবিহারী মহারাজ কী কী ভেবেছেন তা তো আমার জানা ছিল না, আর তাঁকে জিজ্ঞাসা করার ব্যাপারেও আমার দ্বিধা ছিল—তা তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত বলে। ব্যক্তিগত বিষয় তিনি অনেক সময় ব্যক্ত করতে চাইতেন না। একবার প্রশ্ন করেছিলাম—‘মা তো আপনাকে বলেছিলেন, আমি থাকতেই তুমি তৈরি হয়ে যাবে, তোমার কোন ভয় নেই, তিনিই রক্ষা করবেন। তা আপনি তৈরি হয়ে গেছেন?’ উত্তরে তিনি ব্যঙ্গ করে বললেন—‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখতেই তো পাচ্ছ ব্রহ্মজ্ঞানী চলে ফিরে বেড়াচ্ছি।’ সেজন্য খুব ব্যক্তিগত ব্যাপারে আমি ইতস্তত করতাম। তবে একবার জোর করে একটি কথা আদায় করতে পেরেছিলাম। তিনি বলেছিলেন—‘কিরকম জানিস? যেন কোন প্রভুর কুকুর। সে কুকুর হতে পারে, কিন্তু সে প্রভুর কোলে বসার অধিকার পায় এবং প্রভুর বিশেষ স্নেহ ও আদর পায়।’ খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে আবার বলতে লাগলেন—‘শেষের দিকে মায়ের খুব কাছে থেকে তাঁর অনেক সেবা করতে হতো। প্রায় প্রত্যহই তাঁর খাটের ওপরে উঠে মশারি খাটাতে হতো। সেসময়ে মা বিছানাতেই শুয়ে থাকতেন। হয়তো কোনো সময়ে তাঁর শরীরে পাও লেগে গেছে, কিন্তু মায়ের এমন কৃপা—তাতে মনে কোনোপ্রকার প্রতিক্রিয়া একটুও হয়নি। মা তো মা-ই। সেই বোধের কোনো বাধা হয়নি।’ বলতে বলতে রাসবিহারী মহারাজের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল দেখলাম। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনছিলাম আর মনে হচ্ছিল, সর্বদা ব্যাকুল হয়ে তিনি প্রার্থনা করছিলেন মাকে একান্ত আপনার জনের মতো পেতে। ঠাকুর ও মা যে এক—সেই বোধ তাঁর পাকা ছিল।
“নিজের ব্যক্তিগত ব্যাপারে রাসবিহারী মহারাজ শক্ত হয়ে থাকলেও অন্য ব্যাপারে কিছু জানতে চাইলে অতি সহজেই তা বলতেন, তার একটি উদাহরণ দিচ্ছি। শ্রীশ্রীমায়ের কথায় আছে, একদিন রাসবিহারী মহারাজ একজনের প্রসঙ্গে মাকে বলেছিলেন—‘তাঁর প্রাণটা তোমার জন্য কেমন ব্যাকুল হয়েছে তিন-চার মাস ধরে।’ মা শুনে বলেন—‘সে কি! সাধু সব মায়া কাটাবে।… আমি ওসব ভালবাসি না।’ ইত্যাদি। আমি এবিষয়ে রাসবিহারী মহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তিনি উত্তরে বললেন—“উনি মাঝে মাঝে আমার কাছে এসে বলতেন, তোমরা কত ভাগ্যবান! শ্রীশ্রীমার কত স্নেহ পাচ্ছ, কাছে থেকে সেবা করার সুযোগ পাচ্ছ ইত্যাদি, ইত্যাদি।” মা এসব জানতেন। শুধু তাই নয়, উনি নিজে মাছ না খেলেও রাধুদির বিড়ালের জন্য মাছ কিনে আনতেন—মা খুশি হবেন ভেবে। সবই মা জানতেন। যাই হোক, ওঁদের (ঐ সন্ন্যাসীদের) রাস্তা আলাদা, স্বামীজীর হাতে গড়া তাঁরা। মুখ্যত ওটা জ্ঞান-বিচার এবং নির্বাণ মুক্তির পথ। ওতে emotion-এর স্থান খুবই কম—নেই বললেই চলে। মা চাইতেন—যার যেটা পথ সে নিষ্ঠাপূর্বক সেই পথেই চলুক এবং এগিয়ে যাক।’ এখানে মা বলছেন—তোমরা ঠাকুরের সেবা করবে। দুটি থাক আছে। একটি এখানকার মতো ভগবানের সেবাদি নিয়ে থাকে, অপরটি ঐরকম পুতুলের মতো যুগ-যুগান্তর ধরে ধ্যানমগ্ন।
“পূজনীয় রাসবিহারী মহারাজ আমাকে বলেছিলেন, ‘আমাদের স্কুলের দুজন শিক্ষক একদিন স্কুলের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাতে একটি ফটো নিয়ে চুপি চুপি কিছু কথা বলছিলেন। আমি হঠাৎ সেখানে গিয়েছিলাম। এটা ১৯০৭ সালের পূর্বের কথা। ওদের কথা শুনে বুঝতে পারলাম—ফটোটি শ্রীশ্রীমার। তখনকার দিনে তাঁর ফটো দুষ্প্রাপ্য ছিল। তাঁরা বলাবলি করছিলেন যে, মায়ের দর্শন কোনো পুরুষভক্তের ভাগ্যে হয় না। তিনি সর্বাঙ্গ মোটা চাদরে ঢেকে রাখেন—কেবল পা-দুখানি ছাড়া। আমার কিন্তু তক্ষুণি মনে হয়েছিল—যদি কখনো তাঁর কাছে পৌঁছাতে পারি, দেখব কেমন করে আমার সঙ্গে কথা না বলেন বা দেখা না দেন। আমার কিন্তু তখন থেকেই মনে হতো, তিনি সাক্ষাৎ জগন্মাতা। তুই শ্রীশ্রীমায়ের কথায় আমার লেখাটি ভাল করে পড়বি। তাতে দেখবি, তাঁকে আমি বহু প্রশ্ন করেছি নানা বিষয়ে আর তিনি খুব সহজভাবে সব কথার উত্তর দিয়েছেন। কখনো বিরক্ত হননি। বুঝিয়ে সব বলেছেন। তাঁর নিজের বিষয়েও সহজ জবাব দিয়েছেন।’
“একটা বিষয়ে বিশেষ লক্ষ্য করেছি, রাসবিহারী মহারাজ একেবারে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত শ্রীশ্রীঠাকুর এবং শ্রীশ্রীমাকে—বিশেষ করে মাকে একান্ত আপনজনের মতো করে পেতে চেয়েছিলেন। আমার নিজের অনুভব এই যে, মায়ের বিশেষ কৃপা এবং স্নেহে মহারাজের সেই প্রার্থনা ও বাসনা পূর্ণ হয়েছিল। একটি ঘটনা এখানে লিপিবদ্ধ করছি, পড়লে কতকটা বুঝতে পারবেন।
“আগেই বলেছি যে, আমি সেবাশ্রমের কর্মী ছিলাম। পূজনীয় রাসবিহারী মহারাজ অদ্বৈত আশ্রমে বাস করলেও প্রত্যহ তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হতো। সেসময়ে গরমের দিনে সাধারণত আমি সেবাশ্রমের তয়খানাতে (Underground room) দুপুরে বিশ্রাম করতাম। বিকালের দিকে ওপরে উঠে আসতাম। একদিন একটু দেরি হওয়াতে রাসবিহারী মহারাজ আমাকে খুঁজতে খুঁজতে তয়খানাতে গিয়ে হাজির! এসেই সোজা আমার মাদুরেই শুয়ে পড়লেন। আমি উঠে বসতে দু-একটা কথা বলার পরেই বললেন—‘দ্যাখ, দীর্ঘকাল শ্রীশ্রীমায়ের কাছে থেকে দেখেছি—তাঁর কাছে কত মুনি এলেন, ঋষি এলেন; বড় বড় সাধুও এলেন। আর মাও তাঁদের মর্যাদা অনুযায়ী যাঁর যেটুকু মান প্রাপ্য, সেটুকু দিয়ে বিদায় করেছেন। কিন্তু কাউকে কাউকে তিনি কৃপা করে স্নেহের মাধ্যমে একেবারে কাছে টেনে নিয়েছেন। এঁরা কেউ মুনি-ঋষি বা বড় মহাত্মা ছিলেন না।’ এখানে মহারাজ বহুবচন ব্যবহার করলেও আমি স্পষ্ট বুঝেছিলাম, তিনি নিজের কথাই বলছেন।
শ্রীশ্রীমায়ের কথা’য় আছে, স্বামী অরূপানন্দজী লিখেছেন—‘একদিন বৈকালে দর্শনার্থীদের প্রণামের পরে দেখি, মা বারাণ্ডায় আসিয়া হাঁটু অবধি পা কেবল ধুইতেছেন। জিজ্ঞাসা করায় বলিলেন, “আর কাউকে পায়ে মাথা দিয়ে প্রণাম করতে দিও না। যত পাপ এসে ঢোকে, আমার পা জ্বলে যায়; পা ধুয়ে ফেলতে হয়। এইজন্যই তো ব্যাধি। দূর থেকে প্রণাম করতে বলবে।” বলিয়াই আবার বলিতেছেন, “এসব কথা শরৎকে বলো না। তাহলে প্রণাম করা বন্ধ করে দেবে।”’ এবিষয়ে রাসবিহারী মহারাজকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম—‘মহারাজ! শ্রীশ্রীঠাকুরেরও এরূপ হতো পড়েছি। এর অর্থ কী একটু বলবেন কি?’ তিনি বললেন—‘দ্যাখ, অসৎ সঙ্গের স্পর্শে সাধারণ মানুষের মনের ক্ষতি হয়। কিন্তু অবতারপুরুষদের মনের কিছু হয় না, শরীরের কিন্তু কষ্ট হয়।’”
পূর্বা সেনগুপ্ত
নীলাচল কমপ্লেক্স, নরেন্দ্রপুর,
কলকাতা-৭০০১৩৩
এই বিভাগে প্রকাশিত মতামত পত্রলেখকগণের নিজস্ব