শ্রীরামকৃষ্ণের সান্নিধ্যে আগত ভক্তিমতী মহিলাদের অন্যতমা হলেন কালীপদ ঘোষ ওরফে দানাকালীর কনিষ্ঠা ভগিনী মহামায়া মিত্র। বিশ্বচেতনায় শ্রীরামকৃষ্ণ গ্রন্থে শ্রীরামকৃষ্ণের স্ত্রীভক্তমণ্ডলীর আলোকচিত্র সমাহারের মধ্যে মহামায়াদেবীর চিত্র ল‌ক্ষিত হয়। নির্মলকুমার রায় তাঁর শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ-সংস্পর্শে গ্রন্থে মহামায়াদেবীর শ্রীরামকৃষ্ণ-সান্নিধ্য প্রসঙ্গ সং‌ক্ষেপে বিবৃত করেছেন। বস্তুত, মহামায়াদেবীর সঙ্গে ঠাকুর ও মায়ের নিবিড় সংযোগ ছিল, উপযুক্ত সংর‌ক্ষণের অভাবে তাঁদের পারস্পরিক কথোপকথনের বিস্তৃত বিবরণ পাওয়া যায় না। নানা উৎস থেকে প্রাপ্ত তথ্যের আলোকে মহামায়াদেবীর শ্রীরামকৃষ্ণ ও মাতৃ-সান্নিধ্য চিত্রিত করার প্রয়াস গ্রহণ করা হয়েছে এই আখ্যানে।


মহামায়াদেবীর প্রথম শ্রীরামকৃষ্ণ-দর্শন বড় বিচিত্র। ১৮৮৪ সালের নভেম্বর মাসের কোনো একদিন ঠাকুর অযাচিতভাবে কালীপদ ঘোষের সঙ্গে তাঁর শ্যামপুকুরের বাড়িতে (২০ শ্যামপুকুর স্ট্রিট) উপস্থিত হয়েছিলেন। কালীপদ যে-ঘরে ঠাকুরকে উপবেশন করান, সেই ঘরের দেওয়ালে বিভিন্ন দেবদেবীর তৈলচিত্র টাঙানো ছিল। ঠাকুর সেগুলি দেখে আনন্দিত হন এবং ভাবতন্ময় হয়ে তাঁদের স্তবগান করতে থাকেন। দেখতে দেখতে সেগুলি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। কিছু‌ক্ষণ কথাবার্তার পর ঠাকুর দ‌ক্ষিণেশ্বরে ফিরে যান। কালীপদ গাড়িতে তাঁর ফেরার ব্যবস্থা করেন। এই কালে তাঁর পরিবার-পরিজন শ্রীরামকৃষ্ণকে দর্শন এবং তাঁর চরণে প্রণিপাত করেন।১ বস্তুত, মহামায়াদেবীর এটি শ্রীরামকৃষ্ণকে দ্বিতীয়বার দর্শন।


এর কিছুকাল আগে শ্রীরামকৃষ্ণ একদিন শ্যামপুকুর স্ট্রিট দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চেপে দ‌ক্ষিণেশ্বরে ফিরছিলেন। হঠাৎ কালীপদ ঘোষের বাড়ির কাছে তিনি চালককে কিছু‌ক্ষণ থামতে বলেন এবং গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে কালীপদর বাড়িটি দেখেন। সেসময় ঘরের বারান্দায় কালীপদর বিধবা ভগিনী মহামায়াদেবী দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি এর আগে শ্রীরামকৃষ্ণকে দেখেননি। তিনি দেখলেন, এক ব্যক্তি ঘোড়ার গাড়ির জানলা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে তাঁদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে আছেন আর সেই ব্যক্তির চারদিক থেকে এক অস্বাভাবিক জ্যোতি বিচ্ছুরিত হচ্ছে। এ-সংবাদ তিনি তৎ‌ক্ষণাৎ বাড়ির লোকদের জানান। অবশেষে ১৮৮৪ সালের নভেম্বর মাসে ঠাকুর স্বয়ং সে-গৃহে পদার্পণ করলে মহামায়াদেবী বুঝতে পারেন, কিছুকাল আগে ঘরের বারান্দা থেকে যাঁকে দর্শন করেছেন তিনিই ইনি। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসদেব যে সাধারণ মানুষ নন—এই প্রত্যয় তাঁর সেদিনই জন্মেছিল।২ দ্বিতীয় দর্শনকালে তিনি ঠাকুরের শ্রীচরণে মাথা রেখে প্রণিপাত জানান। পরবর্তিকালে বহুবার শ্রীরামকৃষ্ণের দর্শন-প্রত্যাশায় দ‌ক্ষিণেশ্বর, বলরাম বসুর গৃহ, শ্যামপুকুরবাটী এবং কাশীপুর উদ্যানবাটীতে তিনি ছুটে গেছেন।


নভেম্বর মাসের ঐ সা‌ক্ষাতের অল্পদিন পরই তিনি প্রতিবেশী কয়েকজন মহিলা-সহ দ‌ক্ষিণেশ্বরে আসেন। উদ্দেশ্য—মা কালীর পূজা দেওয়া এবং পরমহংসদেবকে দর্শন করা। যেহেতু মা কালীর পূজা দেওয়ার উদ্যোগ ছিল, সেই কারণে তাঁরা সকলে উপবাস করে মন্দিরে পূজা দেন এবং তারপর ঠাকুর-সন্নিধানে আসেন। অন্তর্যামী ঠাকুর জানতে পারেন, আগত মহিলারা সকলে সকাল থেকে উপবাসী। তিনি তাঁদের দেখেই তাঁর সেবককে বলেন তাঁদের ফল-মিষ্টি দিতে। ঠাকুরের কথা শুনে তাঁরা বিস্মিত হন। বুঝতে পারেন, ঠাকুর অন্তর্যামী। ঠাকুর তাঁদের বলেন : “দেখ, ঠাকুর-থানে আস বা বাড়িতেই পূজাদি কর, নিরম্বু উপবাস করে থাকবে না। থাকতে নেই। অন্তত চিনির পানা বা একটু মিঠাই মুখে দিয়ে জল খাবে। জান তো, মেয়েদের আমি উপবাসী দেখতে পারি না।” তারপরই তিনি ‘জয় মা, জয় মা, জয় মা’ বলে পায়চারি করতে লাগলেন। ফল-মিষ্টি ও জল গ্রহণ করে ঠাকুরের চরণে প্রণিপাত জানিয়ে তাঁরা কলকাতায় ফিরেছিলেন।৩


সম্ভবত ১৮৮৫ সালের প্রথমদিকের কোনো একদিন মহামায়াদেবীর ইচ্ছা হলো ঠাকুরকে কড়াইশুঁটির কচুরি আর আলুর দম খাওয়ানোর। সকালে উঠেই স্নান-আহ্নিক সেরে তিনি বাড়ির বৌদের সঙ্গে নিয়ে কড়াইশুঁটির কচুরি আর আলুর দম তৈরি করে একজন সঙ্গিনীকে নিয়ে দ‌ক্ষিণেশ্বর অভিমুখে যাত্রা করেন। পথে তাঁর খেয়াল হলো—তিনি তো জানেন না, ঠাকুর দ‌ক্ষিণেশ্বরে আছেন নাকি কলকাতায় এসেছেন! চিন্তায় পড়লেন—যদি ঠাকুর দ‌ক্ষিণেশ্বরে না থাকেন, তাহলে তাঁর সমস্ত পরিশ্রমই ব্যর্থ হবে। এরকম নানা ভাবনার মধ্য দিয়ে তিনি এসে পৌঁছালেন দ‌ক্ষিণেশ্বর মন্দিরের গেটের সামনে। দেখতে পেলেন, ঠাকুর মন্দিরের প্রধান ফটকের কাছে ত্রস্তপদে পদচারণা করছেন। গাড়ি থেকে নেমে তাঁকে প্রণাম করতে উদ্যত হলে তিনি বললেন : “আমি তখন থেকে দূরে চেয়ে দেখছি—তোমরা এখনো পৌঁছাচ্ছ না কেন? এসে যখন গেছ, ঘরে চল।” শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁদের তাঁর ঘরে নিয়ে এলেন।


মহামায়াদেবী ঠাকুরের সামনে তাঁর স্বহস্তে প্রস্তুত কচুরি ও আলুর দম নিবেদন করলেন। বললেন : “আমি সকাল থেকে আপনার জন্য এগুলি তৈরি করেছি, আপনি গ্রহণ করলে কৃতার্থ হব।” ঠাকুর বললেন : “আমারও আজ সকাল থেকে মনে হচ্ছে, একটু কচুরি আর ঝাল ঝাল আলুর দম হলে বেশ হয়! তা বেশ, তোমরা তৈয়ের করে এনেছ—খাব।” এই বলে তিনি তাঁদের হাতে একটু প্রসাদ দিলেন। তাঁদের খুশি করতে ঠাকুর একটুকরো কচুরি আর একটুকরো আলুর দম মুখে দিয়ে বললেন : “খুব ভাল হয়েছে গো!” মহামায়াদেবীর চোখ থেকে আনন্দাশ্রু ঝরে পড়ল।৪


১৮৮৫ সালের ৬ নভেম্বর (২২ কার্তিক ১২৯২) শুক্রবার, অমাবস্যা। ঠাকুর তখন শ্যামপুকুরবাটীতে চিকিৎসাধীন। সেটি কালীপূজার রাত্রি। ঠাকুরের নির্দেশমতো সকাল থেকেই ভক্তগণ মা কালীর পূজার যাবতীয় উপকরণ সংগ্রহে ব্যস্ত। সন্ধ্যার পূর্বেই সব আয়োজন তাঁরা সম্পূর্ণ করেছেন। পরবর্তী ঘটনাবলি বিষয়ে স্বামী প্রভানন্দের বিবরণ এইরূপ—“সন্ধ্যা সাতটা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ হলঘরে তাঁর বিছানায় উপবিষ্ট। ঠাকুরের আদেশ-অনুসারে তাঁর সম্মুখে পূজার আয়োজন করা হয়েছে়। নানারকমের ফুল, বেলপাতা, নানাবিধ ফল, মিষ্টি ও পায়েস সামনে রাখা হয়েছে। ধূপধুনার সৌরভে ঘরের হাওয়া আমোদিত। ভক্তেরা চারিদিকে ঘিরে বসে আছেন। ঠাকুর জগন্মাতাকে সব উপকরণ নিবেদন করলেন। তারপর ঠাকুরের নির্দেশে সকলে ধ্যান করতে থাকেন। চারিদিক নীরব, নিথর। অকস্মাৎ গিরিশচন্দ্র এগিয়ে গিয়ে দুহাত ভরে ফুল নিয়ে ‘জয় মা’ বলে ঠাকুরের পাদপদ্মে পুষ্পাঞ্জলি দিলেন। পুষ্পপাত্র থেকে একগাছি মালা নিয়ে ঠাকুরের পাদপদ্ম সাজালেন। ঠাকুরের মধ্যে দেখা দিল আকস্মিক পরিবর্তন। প্রথমে শিহরন, তারপরই তাঁর দেহ নিস্তব্ধ হয়ে গেল, মুখে দিব্যামৃতবর্ষী হাসি। তাঁর হাত দুটিতে বরাভয়-মুদ্রা। ভক্তগণ দেখেন ‘ঠাকুরের শরীরাবলম্বনে জ্যোতির্ময়ী দেবীপ্রতিমা সহসা তাহাদিগের সম্মুখে আবির্ভূতা।’ জীবন্ত শ্যামাপ্রতিমাকে নিয়ে ভক্তগণ দিব্যানন্দে মেতে ওঠেন। অন্যতম প্রত্যক্ষদর্শী অ‌ক্ষয়কুমার সেন লিখেছেন,


‘কেবা কালী কেবা প্রভু না পারি বুঝিতে।
কালীতে কেবল তিনি মা-কালী তাহাতে॥’


“অশ্রুতপূর্ব এই শ্যামাপূজা ও উৎসব শেষ হয় দুঘণ্টার মধ্যেই। শ্রীরামকৃষ্ণ-লীলাবিলাসে সংযোজিত হয় নূতন একটি অধ্যায়।”৫


সংশ্লিষ্ট ঘটনার বাড়তি তথ্য পাই ব্রহ্মচারী অ‌ক্ষয়চৈতন্যের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ গ্রন্থে—“কালীপদের বাড়ী ছিল শ্যামপুকুরে; তিনি ঠাকুর ও তাঁহার সেবকদের তত্ত্বাবধান করিতেন বলিয়া ঠাকুর তাঁহাকে ম্যানেজার বলিতেন। আর নরেন্দ্র তাঁহার নাম দিয়াছিলেন ‘দানা’। দানাকালী কালীপূজার যাবতীয় দ্রব্য যোগাড় করিয়া আনিয়াছিলেন।


‘ফুলুকা ফুলুকা লুচি সুজির পায়েস।
নূতন খেজুরগুড়ে গোলালো সন্দেশ॥
সাদা সন্দেশাদি আর মিষ্টান্ন বহুল।
বিল্বপত্র গঙ্গাজল ধূপদীপ ফুল॥
যাবতীয় দ্রব্যাদি যোগাড় করি ঘরে।
শুভ‌ক্ষণে দিলা আনি প্রভুর গোচরে॥
অপর দ্রব্যাদি কালী আিনলা আপনি।
সুজির পায়েস আনে তাঁহার গৃহিণী॥’


“সুজির পায়েস প্রস্তুত করিয়া আনিয়াছিলেন দানাকালীর কনিষ্ঠা ভগিনী মহামায়া। গৃহিণীর মাথাগরম ছিল বলিয়া তাঁহার প‌ক্ষে এই কাজ সম্ভব ছিল না। শ্রীমতী মহামায়া মিত্রের সঙ্গে এক সময়ে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল।”৬


কালীপদ ঘোষের পারিবারিক সূত্রে জানা যায় যে, সেদিন পূজার সমস্ত উপচারই জোগাড় করেছিলেন মহামায়াদেবী। ঠাকুরের পূজার জন্য তিনি নিজেই গোলাপ ও রজনিগন্ধা ফুল দিয়ে মালা গেঁথেছিলেন। পূজার বেলপাতা, তুলসীপাতা এবং দূর্বা সংগ্রহও করেছিলেন তিনিই। ঠাকুরের ভোগের জন্য লুচি, বেগুনভাজা, আলুর দম ও সুজির পায়েস—যা রাঁধা হয়েছিল সবই তাঁর হাতে করা। তবে বাড়ির অন্য মহিলারাও তাঁকে সাহায্য করেছিলেন। তিনি ও কালীপদ দু্জনে মিলে ঐ সমস্ত জিনিস বহন করে নিয়ে গিয়েছিলেন শ্যামপুকুরবাটীতে ঠাকুরের কাছে। সেই মহাদিনের মহাসন্ধিক্ষণে ঠাকুরের মাতৃমূর্তিতে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁরও। মহামায়া দেবী বলতেন, তিনি বাল্যবিধবা ছিলেন এবং রামায়ণ-মহাভারত নিত্য পাঠ করতেন বলে ঠাকুর তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। তাঁর বাড়িতে ঠাকুর পদধূলি দিয়ে কালীপদকে বলেছিলেন : “আমার মায়া-মা কোথায়? ও বড় ভক্তিমতী! জগদম্বা ওর কল্যাণ করবেন।”৭

মহামায়া মিত্র


শ্রীরামকৃষ্ণ শ্যামপুকুরবাটীতে অবস্থানকালে মহামায়াদেবী তাঁর চরণে প্রণাম করে শ্রীশ্রীমায়ের সঙ্গে দেখা করতেন। তাঁর সঙ্গে কিছু‌ক্ষণ কথাবার্তা বলে তারপর বাড়ি ফিরতেন। ঠাকুর কাশীপুর উদ্যানবাটীতে থাকাকালেও তিনি সেখানে কয়েকবার গিয়েছিলেন। যখন তিনি তাঁর দাদা কালীপদ ঘোষের মুখে শুনলেন, ঠাকুরের গলার ঘা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তিনি আর কিছুই খেতে পারছেন না, তখন দাদার সঙ্গে আলোচনা করে তিনি একদিন সাবুর পায়েস তৈরি করে নিয়ে ঠাকুরকে দর্শন করতে কাশীপুর উদ্যানবাটীতে আসেন। শ্রীশ্রীমায়ের সঙ্গে দেখা করে পায়েসের পাত্রটি তাঁর হাতে দিয়ে তিনি তাঁর মনোবাসনা ব্যক্ত করেন। পরে তিনি শ্রীশ্রীমায়ের সঙ্গেই ঠাকুরের কাছে আসেন। সব শুনে ঠাকুর বললেন : “মায়া-মা এনেছে, একটু দাও।” তিনি সামান্য একটু গ্রহণ করেছিলেন।৮


মহামায়াদেবীর জীবন ঠাকুর ও মায়ের সান্নিধ্যধন্য। নয় বছর বয়সে তাঁর বিবাহ এবং এগারো বছর বয়সে বিধবা হন। জীবনের শেষ পর্বে বিবাহ বা স্বামীর কথা কিছুই তাঁর স্মৃতিতে ছিল না। পিতৃগৃহেই তিনি আজীবন অবস্থান করেছেন। কৈশোরে কিছুকাল পাঠশালায় পাঠ নিয়েছেন। রামায়ণ-মহাভারত পড়ে বাড়ির মহিলাদের শোনাতেন। তাঁর গর্ভধারিণী অল্প বয়সে দেহত্যাগ করেছিলেন। দৃঢ় ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী মহামায়াদেবী অত্যন্ত শৃঙ্খলাপরায়ণ এবং কুসংস্কারমুক্ত মনের অধিকারী ছিলেন। বাড়ির ছোটদের কোনো উপদেশমূলক কথা বলতে গেলেই তিনি হয় ঠাকুরের নয়তো মায়ের উদ্ধৃতি তুলে ধরতেন। যেকোনো কাজকে যত্নের সঙ্গে এবং পূজা-জ্ঞানে করতে বলতেন। বাড়ির পরিজন ও আত্মীয়বর্গকে তিনি মাতৃসমীপে হাজির করে তাঁদের কল্যাণের কথা ভেবে আনন্দিত হতেন। তাঁর উদ্যোগ ও সাহচর্যেই ঘোষ-পরিবারের সকলে শ্রীরামকৃষ্ণ-ভাবাদর্শে আপ্লুত হন। তাঁরই ব্যবস্থাপনায় সন্ধ্যার সময় সকলে সমবেত হয়ে কথামৃত পাঠ শুনতেন। কালীপদ কথামৃত পাঠের দায়িত্ব দিয়েছিলেন তাঁর দুই যমজ পুত্র হরেন্দ্রকৃষ্ণ ও ধরেন্দ্রকৃষ্ণকে। পরিবারের যেসমস্ত প্রতিনিধি শ্রীশ্রীমায়ের কাছে মহামন্ত্র লাভ করে কৃতার্থ হয়েছেন, তাঁরা হলেন—মহামায়াদেবী স্বয়ং, সরযূবালাদেবী (হরেন্দ্রকৃষ্ণের স্ত্রী), মৃণালিনীদেবী (ধরেন্দ্রকৃষ্ণের স্ত্রী), সুবর্ণবালাদেবী (কালীপদর ভ্রাতা তারাপদর জ্যেষ্ঠ পুত্র হরিপদর স্ত্রী) এবং হিরণ্ময়ীদেবী (তারাপদর তৃতীয় পু্ত্র ডাক্তার উপেন্দ্র ঘোষের স্ত্রী)।৯ হিরণ্ময়ী ঘোষের দী‌ক্ষা প্রসঙ্গে ব্রহ্মচারী অ‌ক্ষয়চৈতন্য উল্লেখ করেছেন : “মহামায়া মিত্র তাঁহার বালিকা ভ্রাতুষ্পুত্রবধূ হিরণ্ময়ী ঘোষকে দী‌ক্ষিত করিবার জন্য সঙ্গে লইয়া আসিতেন। তিনি ঠাকুরের সময়কার লোক, নূতন সাধুদের বাধানিষেধ তেমন মান্য করিতেও চাহিতেন না। শ্রীশ্রীমা যেন উভয় দিক্‌ র‌ক্ষা করিতে গিয়াই বলিলেন, তা ল‌ক্ষ্মীর কাছে নিলেই হবে। কিন্তু হিরণ্ময়ী ভূলুণ্ঠিত হইয়া প্রণাম করিবামাত্র তাহার মস্তকে করপদ্ম স্থাপন করিয়া অন্যের অশ্রুতভাবে তাহার ইষ্টমন্ত্র উচ্চারণ করিলেন।”১০ এছাড়াও শ্রীশ্রীমায়ের নিকট মন্ত্রদী‌ক্ষা লাভ করেন মৃন্ময়ীদেবী (কালীপদর কন্যা এবং গড়পার-নিবাসী হরনাথ চৌধুরীর স্ত্রী)।১১ তারাপদর দ্বিতীয় পুত্র ভূপেন্দ্রনাথ ঘোষ (ডাকনাম ভোলা, তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী) প্রায়শই উদ্বোধন-গৃহে পিসিমার সঙ্গে মাতৃসমীপে আসতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ-মণ্ডলীতে মহামায়াদেবীর পরিচিতি ছিল ‘বরেনের পিসি’ নামে। শ্রীশ্রীমায়ের কথা গ্রন্থে তাঁর সঙ্গে মায়ের কথোপকথন বর্ণিত আছে—“একদিন পূর্ণবাবুর (পূর্ণচন্দ্র ঘোষ) স্ত্রী দী‌ক্ষার কথা উত্থাপন করিয়া মাকে বলিলেন, ‘মা, আপনি তো শীঘ্রই দেশে চলে যাচ্ছেন, আর আমরাও সিমলা পাহাড়ে যাব। আবার কবে দেখা হবে। মন্ত্র নেবার ইচ্ছা, কিন্তু আমার জাতাশৌচ হয়েছে।’ গোলাপ-মা ও যোগেন-মা নিকটে ছিলেন। তাঁহারা বলিলেন, ‘অশৌচে কি দী‌ক্ষা হয়? এখন কি করে নেবে?’ মাও তাঁহাদের কথায় সায় দিয়া বলিলেন, ‘তাই তো, কি করে হবে তা হলে?’ সেই সময় বরেনবাবুর পিসিও সেখানে ছিলেন। একদিন তিনি মাকে একা পাইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মা, আপনি কি জাতাশৌচ মানেন?’ মা বলিলেন, ‘কায়াপ্রাণে ন সম্বন্ধ, আবার জাতাশৌচ! কালীপূজার দিন ওকে গঙ্গাস্নান করিয়ে নিয়ে এসো।’ পরে পূর্ণবাবু নিজেই নির্দিষ্ট দিনে তাঁহাকে মায়ের নিকট লইয়া যান।”১২


ভগিনী নিবেদিতার স্নেহধন্যা এবং নিবেদিতা স্কুলের শি‌ক্ষিকা সুধীরাদি একবার গুরুতর অসুস্থ হন। শ্রীশ্রীমা সুধীরাদির চিন্তায় অধীর। তাঁর পূর্বাশ্রম শ্যামপুকুরে মহামায়াদেবীর বাড়ির কাছে। মহামায়াদেবী মাতৃদর্শনে উদ্বোধনে এলে মা তাঁকে বললেন : “তুমি একবার সুধীরার খবরটা এনে দিতে পার, মা? আহা, তার বড় অসুখ।” তিনি স্বীকৃতা হলে মা তাঁর হাতে ঠাকুরের চরণামৃত, বেদানা ইত্যাদি দিয়ে বললেন : “এগুলি তাকে দিও; আর খবরটা আমাকে এনে দেবে, কেমন আছে। আমি ঠাকুরের কাছে তার জন্য তুলসী দিচ্ছি।”১৩


দুর্গাপুরী দেবী প্রণীত সারদা-কথামৃত গ্রন্থেও মহামায়াদেবীর প্রসঙ্গে আছে—“ঠাকুরের ভক্ত কালীপদ ঘোষের বাটীর মহিলাগণ মাতাঠাকুরাণীকে একদিন নিমন্ত্রণ করিলেন। তদনুযায়ী মা, সারদানন্দজী এবং আরও কতিপয় সাধু তাঁহাদের গৃহে গিয়াছিলেন। তথায় কীর্তনাদির অনুষ্ঠান হয়,… ল‌ক্ষ্মীদিদি পালাকীর্তন গাহিয়াছিলেন।”১৪ শ্রীশ্রীমায়ের সেবিকা সরলাদি (পরবর্তিকালে প্রব্রাজিকা ভারতীপ্রাণা এবং শ্রীসারদা মঠের প্রথম অধ্যক্ষা) তাঁর জীবনের প্রথম পর্বে সুধীরাদির ব্যবস্থাপনায় এবং মায়ের সম্মতিক্রমে বেশ কিছুকাল মহামায়াদেবীর নিকট অবস্থান করেছেন। সেই কালে তিনি মহামায়াদেবী ও বাড়ির অন্য মহিলাদের সঙ্গে মাতৃদর্শনে উদ্বোধনে আসতেন। মহামায়াদেবীর কাছে থাকতেই তিনি স্থায়িভাবে মায়ের কাছে এসে অবস্থান করেন।১৫


স্বামী ভূমানন্দ জানিয়েছেন : “সম্প্রতি ভক্ত কালীপদ ঘোষের কনিষ্ঠা সহোদরা শ্রীমতী মহামায়া মিত্র কথা প্রসঙ্গে এই লেখককে বলিয়াছেন—‘কলকাতায় মার বাড়ীতে মা একদিন বলেছিলেন, জানো বরেনের পিসি (কালীপদবাবুর পুত্রের নাম বরেন), একদিন ঠাকুর কাশীপুরের বাগানে আমায় বলেছিলেন—“হেম করের ঘর বড় অন্ধকার। তার ঘরে তোমায় আলো জ্বালতে হবে।’” এই হেম করের পুত্র পলটু কর এটর্নি। তিনি বাল্যকালে ঠাকুরকে দেখিয়াছিলেন। উত্তরকালে তিনি বার কয়েক কলিকাতায় মায়ের বাড়ীতে আসিয়া শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করিয়া গিয়াছেন। মনে হয় মায়ের কৃপায় পলটুবাবু আলো দেখিয়াছিলেন। অন্যথায় তাহার ন্যায় পুরোদস্তুর সাহেবী মেজাজের লোক কখনই শ্রীশ্রীমাকে প্রণাম করিতে আসিতেন না।”১৬


১৮২৫ সালে সরলাদি যখন শরৎ মহারাজ ও অন্য মহারাজদের সঙ্গে কাশীগমন করেন, তখন মহামায়াদেবী কাশীবাস করছিলেন। মহারাজের ব্যবস্থাপনায় সরলাদির বসবাসের জন্য কাশীর ল‌ক্ষ্মীনিবাস নির্ধারিত হয়। শরৎ মহারাজ মহামায়াদেবীকে সরলাদির নিকট আনান, ফলে সরলাদি কাশীতেও শ্রীরামকৃষ্ণ-সান্নিধ্যধন্যা মহিলার সংস্পর্শে বসবাস করার আনন্দলাভ করেন।১৭ কেবল ঠাকুর ও মা-ই নন, ঠাকুরের ত্যাগী সন্তানদের সঙ্গেও মহামায়াদেবীর বিশেষ সৌহার্দের সম্পর্ক ছিল এবং ঠাকুরের সন্তানগণ তাঁকে ‘দিদি’ বলে সম্বোধন করতেন। শ্রীরামকৃষ্ণ-পরিমণ্ডলের এই ভক্তিমতী মহিলা ১৯৪৭ সালে প্রায় ৯২ বছর বয়সে ধরাধাম ত্যাগ করে রামকৃষ্ণলোকে যাত্রা করেন।

তথ্যসূত্র
১. Swami Chetanananda, They Lived With God, Advaita Ashrama, Kolkata, 2011, p. 319
২. Ibid.
৩. শুভ্রা দে (মহামায়াদেবীর প্রত্যক্ষদর্শী এবং কালীপদ ঘোষের প্রপৌত্রী) কর্তৃক ২০১৫-এর ২২ সেপ্টেম্বর কথিত
৪. নন্দিনী মিত্র (শ্রীরামকৃষ্ণের অন্তরঙ্গ ডাঃ শশীভূষণ ঘোষের প্রপৌত্রী) কর্তৃক ২০০৬-এর ২০ এপ্রিল কথিত
৫. স্বামী প্রভানন্দ, শ্রীরামকৃষ্ণের অন্ত্যলীলা, উদ্বোধন কার্যালয়, কলিকাতা, ২০০০, ১ম খণ্ড, পৃঃ ১১১
৬. ব্রহ্মচারী অ‌ক্ষয়চৈতন্য, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, ক্যালকাটা বুক হাউস, কলকাতা, ১৪১৫, পৃঃ ৩৯৪, পাদটীকা
৭. প্রভাতী দত্ত (মহামায়াদেবীর প্রত্যক্ষদর্শী এবং কালীপদ ঘোষের প্রপৌত্রী) কর্তৃক ২০১১-এর ১৩, ১৪ জুলাই কথিত
৮. শুভ্রা দে কথিত
৯. দ্রঃ স্বামী পূর্ণাত্মানন্দ (সংকলক ও সম্পাদক), শ্রীশ্রীমায়ের পদপ্রান্তে, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৯৫, ২য় খণ্ড, পৃঃ ৪৬৪
১০. ব্রহ্মচারী অ‌ক্ষয়চৈতন্য, শ্রীশ্রীসারদা দেবী, ক্যালকাটা বুক হাউস, (প্রাঃ) লিমিটেড,১৪১১, পৃঃ ২৩৪
১১. সনৎ ঘোষ ও প্রবীর ঘোষ (কালীপদ ঘোষের প্রপৌত্র) কর্তৃক ১৯৯৪-এর ১ জুন কথিত
১২. শ্রীশ্রীমায়ের কথা, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৯, অখণ্ড, পৃঃ ১৫৯-৬০
১৩. ঐ, ১৯৯০, পৃঃ ৩৭৬
১৪. শ্রীদুর্গাপুরী দেবী, সারদা-রামকৃষ্ণ, শ্রীশ্রীসারদেশ্বরী আশ্রম, কলিকাতা, ১৩৬১, পৃঃ ১৫৮
১৫. দ্রঃ প্রব্রাজিকা নির্ভয়প্রাণা (সম্পাদিকা), ভারতীপ্রাণা স্মৃতিকথা, শ্রীসারদা মঠ, দ‌ক্ষিণেশ্বর, কলিকাতা, ১৯৯৫, পৃঃ ৩৮-৩৯
১৬. স্বামী ভূমানন্দ, শ্রীশ্রীমায়ের জীবন-কথা, পি. কে. দাশ (প্রকাশক), কলকাতা, ১৯৯৭, পৃঃ ৯৬
১৭. দ্রঃ ভারতীপ্রাণা স্মৃতিকথা, পৃঃ ৬১

‘আশুতোষ ভট্টাচার্য ও রেণুবালা দেবী স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।

প্রাক্তন অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ,
রাজা প্যারীমোহন কলেজ, উত্তরপাড়া