বাঙালি হিন্দুর জীবনে মৃত্যুর পর দেহকে ঘিরে যে ঘটনা ঘটে তার ইতিহাস রচনা বিশেষ প্রয়োজন। অলোক সরকারের শ্মশান : মিথ পুরাণ ইতিহাস বইটি সেই প্রয়োজনের একটা বড় অংশকেই পূরণ করেছে, নতুন দিশা দেখিয়েছে।

কলকাতা শহরে সংগঠিতভাবে শ্মশান গড়ে ওঠা খুব পুরানো ঘটনা নয়। আঠারো শতকের শেষের দিকে কাশীশ্বর মিত্র বাগবাজারে গঙ্গার তীরে একটি শবদাহের ঘাট এবং বিশ্রামালয় নির্মাণ করেছিলেন। এই শহর যত বিস্তারিত হচ্ছিল, বাড়ছিল লোকসংখ্যা ও বাজার, ততই শহরের দুর্ভোগের চেহারাটা সামনে উঠে আসছিল। স্বাভাবিকভাবেই বিশুদ্ধ জল, নগর পরিকল্পনা, শ্মশানঘাট নির্মাণ প্রভৃতি বিষয়গুলি অাবশ্যক হয়ে পড়েছিল।

শ্মশান : মিথ পুরাণ ইতিহাস
লেখক ও প্রকাশক : অলোক সরকার
বাসন্তী, দঃ ২৪ পরগনা-৭৪৩৩২৯
৪৯৯.০০

শুধু উনিশ শতক নয়, শ্মশানের সন্ধানে মধ্যযুগের সাহিত্যের অন্দরেও প্রবেশ করেছেন লেখক। দ্বিজ মাধবের মঙ্গলচণ্ডীর গীত গ্রন্থে শ্মশানের বিশেষ চিত্র ফুটে উঠেছে। এছাড়া বিপ্রদাস পিপিলাইয়ের মনসা বিজয়, নারায়ণ দেবের মনসামঙ্গল, ঘনরাম চক্রবর্তীর ধর্মমঙ্গল প্রভৃতি গ্রন্থে প্রাপ্ত শবদাহ প্রসঙ্গ নিয়ে বিস্তারে আলোচনা করেছেন লেখক। তবে উনিশ শতকের শ্মশান-চিন্তা এবং প্রাগাধুনিক যুগের শ্মশান-চিন্তার মধ্যে পার্থক্য তেমনভাবে উঠে আসেনি আলোচনার মধ্যে। স্থানের সঙ্গে শ্মশান-মাহাত্ম্যও বদলে যায়। বদলে যায় ইতিহাসের ধারা। কালীঘাট শ্মশানের আলোচনা প্রসঙ্গে লেখক খুব সহজে শ্মশানকে আধুনিকীকরণ বনাম অতীতের গা-ছমছমে আবহের বিভাজনে বিভাজিত করেছেন। কিন্তু এই ধরনের বিভাজনে ইতিহাসের বহুরৈখিক স্বর হারিয়ে যায়। আধুনিকীকরণের মধ্যেও তথাকথিত অতীত বসে থাকে।

পশ্চিমের সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে মৃতদেহ, গোরস্থান, দার্শনিক বিতর্ক, ইতিহাসের আশ্চর্য গল্প ইত্যাদি সমস্ত কিছুই ঠাঁই পেয়েছে গ্রন্থের মধ্যে। বইটি নিশ্চিতভাবেই অনেক মূল্যবান সম্ভাবনা এবং প্রতর্কের জন্ম দিয়েছে। খুব অল্প আলোচিত শ্মশানের মতো একটি বিষয় নিয়ে লিখতে গিয়ে লেখকের গবেষণার ব্যাপ্তি বিশেষ প্রশংসার দাবি রাখে। স্মৃতিমন্দির, স্মৃতিসৌধ কিংবা অনুদান-ফলক অধ্যায়টি গবেষণা-ঋদ্ধ এবং সুলিখিত। যথার্থ গবেষকের মন নিয়েই লেখক শিশুসন্তানের উদ্দেশে নির্মিত স্মৃতিফলক এবং বৈষ্ণবের স্মৃতিতে নির্মিত ফলকের ভাব ও ভাষার পার্থক্যগুলি তুলে ধরেছেন। আবার ‘ডোম—শিবের অভিশপ্ত বরপুত্র’ অধ্যায়টিও একইভাবে শ্মশান প্রতর্কে উজ্জ্বল সংযোজন। শ্মশানের দেওয়াল অলংকরণ, ছবি এবং গান সংক্রান্ত অধ্যায়ের মধ্যেও নতুন গবেষণা এবং অনুসন্ধানের ছাপ মেলে। লেখকের বড় গুণ সহজ করে লিখতে পারার ক্ষমতা। তাই পড়তে কোথাও কষ্ট হয় না, বরং কয়েক স্থানে একধরনের কাব্যিক মেজাজের পরিচয় মেলে। বাঙালি সংস্কৃতির ইতিহাস বুঝতে অবশ্যপাঠ্য এই বইখানি।