বিবেক-দ্যুতিতে উদ্ভাসিত সুভাষচন্দ্র গ্রন্থটি স্বামী বিবেকানন্দের ভাবশিষ্য হিসাবে সুভাষচন্দ্র বসুকে তুলে ধরার তাগিদ থেকেই পরিকল্পনা। ৯৩২ পৃষ্ঠার এই গ্রন্থে প্রবন্ধ আছে মোট ৪৬টি। কলম ধরেছেন বাংলার বিভিন্ন ক্ষেত্রের কৃতী মানুষেরা। প্রবন্ধগুলিকে পাঁচটি পর্যায়ে বিভক্ত করে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে স্বামীজী ও সুভাষচন্দ্র বসুকে পাঠকের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
গ্রন্থটি পাঁচটি পর্বে বিভক্ত। প্রথম পর্বে আছে এযাবৎ অপ্রকাশিত অধ্যাপক শঙ্করীপ্রসাদ বসুর একটি মনোজ্ঞ লেখা। আমাদের কাছে এ এক অমূল্য প্রাপ্তি। তিনি লিখেছেন : “সুভাষচন্দ্র কোনদিন জ্যান্ত ঈশ্বরের দেখা পাননি, সন্ধান পেয়েছিলেন জীবনসত্যের—দেহময় বিবেকানন্দ নয়, বাণীময় বিবেকানন্দ হয়ে উঠেছিলেন তাঁর জীবনসত্য। বিবেকানন্দের কর্মযোগের বৈপ্লবিক আদর্শকে গ্রহণ করেছিলেন সুভাষচন্দ্র, নিস্পৃহ বৈরাগ্যের আদর্শকে নয়।” স্বামী সুবীরানন্দ সুভাষচন্দ্রের ছাত্রজীবনে স্বামীজীর প্রভাব নিয়ে সুন্দর আলোচনা করেছেন। স্বামী সুপর্ণানন্দ ‘বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্র : বীর যোদ্ধা’ প্রবন্ধে ঘরে-বাইরে দুই দেশনায়কের লড়াই ও যোদ্ধৃরূপের যে-পরিচয় তুলে ধরেছেন তা তাঁর পাণ্ডিত্য ও গবেষণার ফসল। অধ্যাপক সবুজকলি সেনের ‘বিবেকানন্দের আলোয় সুভাষচন্দ্রের নারী-ভাবনা’ প্রবন্ধটিতে একটি ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি ধরা পড়েছে। প্ৰব্ৰাজিকা সত্যব্রতপ্রাণার ‘বিবেক-চেতনায় নেতাজীর অখণ্ড মাতৃভাবনা’ প্রবন্ধটি সুলিখিত ও প্রেরণাপ্রদ। স্বামীজী ও নেতাজীর দৃষ্টিতে ঝাঁসির রানি বিষয়ে রাইকমল দাশগুপ্তের লেখাটি বাস্তবিক অনবদ্য।
গ্রন্থের দ্বিতীয় পর্যায়ে স্বামী বলভদ্রানন্দ, স্বামী চৈতন্যানন্দ, তপন বন্দ্যোপাধ্যায়, শক্তিপ্রসাদ মিশ্র প্রমুখ গুণিজন কলম ধরেছেন। ‘সুভাষচন্দ্রের জীবনে ও কর্মে বিবেকানন্দের প্রভাব’ বিষয়ে লিখেছেন স্বামী বলভদ্ৰানন্দ। দীর্ঘ এই প্রবন্ধটিতে সুভাষচন্দ্র কীভাবে বিবেকানন্দের মানসপুত্র হয়ে উঠেছিলেন সেই যাত্রাপথের বিবরণ ও বিশ্লেষণ আছে।
গ্রন্থটির তৃতীয় পর্যায়ে ‘শিক্ষা, সাহিত্য, শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও ধর্ম’ বিষয়ে প্রবন্ধ রচনা করেছেন মনোতোষ দাশগুপ্ত, দিলীপ নাহা, গৌতম হালদার, অমিয়কুমার মজুমদার প্রমুখ। ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে লেখা প্রবন্ধগুলি এই গ্রন্থের অমূল্য সম্পদ।
চতুর্থ পর্যায়ে ‘ইতিহাস, সমাজ ও অর্থনীতি’ বিভাগে গীতশ্রী বন্দ্যোপাধ্যায়, রাধারমণ চক্রবর্তী, স্বামী কৃষ্ণনাথানন্দ প্রমুখ বিভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি থেকে আলোচনা করেছেন। রাধারমণ চক্রবর্তীর ‘কৃষি ও শ্রমজীবী শ্রেণির সমুন্নতি : স্বামীজীর ভাবসংযোগে নেতাজীর কর্মযোগ’ প্রবন্ধে সমাজে কৃষক ও শ্রমজীবীদের গুরুত্ব ও অবস্থান প্রভৃতি বিষয় নিয়ে স্বামীজী ও সুভাষচন্দ্রের চিন্তাধারার পরিচয় পাওয়া যায়। স্বামী কৃষ্ণনাথানন্দের ‘বিবেকানন্দ ও সুভাষচন্দ্রের ভাবনায় ভারতীয় অর্থনীতি’ প্রবন্ধটিও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা কেউ অর্থনীতিবিদ ছিলেন না, কিন্তু দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তাঁদের দূরপ্রসারী ভাবনার পরিচয় রয়েছে প্রবন্ধটির ছত্রে ছত্রে।
গ্রন্থটির শেষ পর্যায়ে শুধুমাত্র সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়ে আছে চারটি প্রবন্ধ। প্রবন্ধগুলি সুভাষচন্দ্রকে জানার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। সব মিলিয়ে পরাধীন ভারতের দুই বীর সন্তানের ভাবনাকে স্বাধীন ভারতে নতুন করে মূল্যায়ন বিশেষ প্রয়োজন। সেক্ষেত্রে এই গ্রন্থটি সার্বিকভাবে সফল বলা যেতেই পারে।
সঙ্কলক ও সম্পাদক :
স্বামী চৈতন্যানন্দ
প্রকাশক :
স্বামী সুপর্ণানন্দ
রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার, কল-২৯
৫০০.০০