দুই প্ল্যাটফর্মের ছোট্ট একটা স্টেশন, নাম বরাভূম। ট্রেন থেকে নেমে উলটোদিকে গিয়ে দাঁড়ালেই রাঙাডি গ্রাম। যারা ‘মুখোশ গ্রাম’ দেখার জন্য আসে, তাদের বেশির ভাগই নামে এই স্টেশনে। তারপর ছোটবড় হরেক রকমের গাড়ি চড়ে সরাসরি আসা যায় মুখোশ গ্রাম চড়িদাতে। রাঙাডি থেকে চড়িদার দূরত্ব সাতাশ কিলোমিটার। আগে ছিল বালি-কাঁকর বিছানো লালমাটির মায়াবী পথ। কিন্তু পলাশের প্রান্তর এখন সেজে উঠেছে নীল-কালো পিচ রাস্তায়। ফলে দুপাশে জারুল, মহুয়া, শাল, পলাশের রূপ দেখতে দেখতে কখন যে কেটে যাবে সময়, তা বোঝার উপায় নেই! বসন্তে আগুন-রঙা পলাশ ও আচ্ছন্ন করে রাখার মতো মহুয়া ফুলের মাদক গন্ধ যাত্রীকে বিমোহিত করে রাখে সারা রাস্তা। পথে পড়ে পাখি পাহাড়, মাঠা রেঞ্জ ফরেস্ট, উঁচু-নিচু টিলা ও টাড় ভূমি। পুরুলিয়ার প্রকৃতি দেখার মতোই বটে। সেই প্রকৃতিতে লেগে থাকে শিমুল, জারুল, রাধাচূড়ার রং, সোনাঝুরি আর গুঁড়ো গুঁড়ো ধাদকির ফুল ফুটে থাকে থরে থরে। এই ফুলগুলি থেকেই শিল্পীরা শিখে নেয় রং চেনার প্রাথমিক পাঠ। মুখোশ-শিল্পীদের কাছে রঙের কদর চিরকাল। রূপ ফোটাতে বাহারি রং চেনা জরুরি।
মুখোশ-শিল্পী পার্থ সূত্রধর
চড়িদাতে পৌঁছানোর ঠিক দেড় কিলোমিটার আগে বাঘমুণ্ডি। এর প্রান্তসীমায় বইছে হিকিমডি নদী। এই নদীর মাটিতে রয়েছে সেই প্রসাদগুণ। যেন অনুপম সৌন্দর্য আলুথালু ছড়িয়ে রয়েছে নদীর কিনারে! শিল্পীরা এখান থেকে নিয়ে আসে মাটি। প্রায় বুজে আসা, সামান্য এই অনিত্যবাহী নদীটির কাছে চিরঋণী হয়ে থাকতে হবে শিল্পকে। এই নদীর মাটি দিয়েই তৈরি হয় প্রতিমার ছাঁচ। তারপর সেই ছাঁচ ভেঙে উঠে আসে ঐতিহ্যবাহী আন্তর্জাতিক মানের মুখোশ।
বাঘমুণ্ডির রাজা মদনমোহনের বাড়ি থেকে চড়িদার দূরত্ব মাত্র দুই মাইল। রাজা মদনমোহন ছিলেন শিল্পের অসামান্য পৃষ্ঠপোষক। তিনি শিল্পীদের কদর করতে জানতেন। এখন না আছেন রাজা, না আছে রাজ্যপাট। কিন্তু রাজার অসামান্য পৃষ্ঠপোষকতায় ছড়িয়ে পড়তে থাকা ছৌশিল্প আজ দুনিয়া জুড়ে প্রসারলাভ করেছে।
পুরুলিয়া জেলার দক্ষিণ-পশ্চিম সীমান্তে অযোধ্যা পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে ওঠা গ্রাম চড়িদা। গ্রামে সব মিলিয়ে প্রায় তিন হাজার মানুষের বাস। এর মধ্যে প্রায় দেড়শো পরিবার সরাসরি মুখোশ-শিল্পের সঙ্গে জড়িত। বাকিরা করে চাষবাস অথবা কাজ করতে চলে যায় রাঁচি, ধানবাদ, জামশেদপুরে। চাষিরা পালং, পিয়াজ, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমেটোর চাষ করে। দু-চারটি পরিবার কাঠের ব্যবসা অথবা মনোহারী দোকান খুলে বসে রয়েছে। বাকি সবাই হয় মুখোশ-শিল্পী অথবা কোনো না কোনোভাবে সরাসরি এই শিল্পকর্মের সাথে জড়িত। চড়িদার শিল্পীরা প্রায় সারা বছর ধরে মুখোশ তৈরি ও বিক্রি করে থাকে। এরা জাতিতে ছুতোর, পদবি হলো সূত্রধর। একসময় ভৌগোলিক ও সামাজিকভাবে এরা বিচ্ছিন্ন ছিল। বিয়ের জন্য এদের বাঁকুড়া, বর্ধমান প্রভৃতি জেলায় যাওয়া-আসা করতে হতো। তবে এখন এই অবস্থার অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। শিল্পীরা সামাজিক মূল্য পায় আর শিল্পমূল্য পেয়ে আসছে প্রায় দেড়শো বছর ধরে।
চড়িদা ছাড়াও পুরুলিয়ার জয়পুর, ডুমুরডি, বান্দোয়ান ও জোড়দাতে কিছু কিছু শিল্পী আছে, যারা মুখোশ তৈরির কাজ করে থাকে। তবে চড়িদার শিল্পকর্ম বাকি শিল্পীদের তুলনায় বিশিষ্টতা অর্জন করেছে। শুধু বিশিষ্ট হয়ে ওঠাই নয়, তা বিশ্বজনীন স্বীকৃতি পেয়েছে। এই অসম্ভব কীভাবে সম্ভবপর হয়েছে সেকথা শোনা গেল জাতীয় পুরস্কার-জয়ী এক শিল্পীর কাছে। গল্প আড্ডার মাঝে তাঁর সাথে অনেক কথা হয়, জানা হয়ে যায় মুখোশ তৈরির প্রকৌশলটি।
মুখোশ তৈরির উপকরণ অনেক। ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো, আঠালো মাটি, বাতিল কিংবা পুরানো কাগজ, আঠা, ময়দা, গর্জন তেল, পাখির পালক, শন বা পাট, নকল চুল, পুঁতি, রাংতা, সলমা, চুমকি, বিভিন্ন রং, ময়ূরের পালক, থুপি, তার ও ছোটখাটো সাধারণ যন্ত্রপাতি। এগুলোর সাহায্যেই একজন শিল্পী মুখোশ তৈরি করে। একসাথে অনেকগুলো মুখোশের কাজে হাত দেওয়া যায়, তবে একটি মুখোশকে পূর্ণরূপে সাজিয়ে তুলতে শিল্পীর ব্যয় হয় পনেরো দিন থেকে এক মাস। ৬৫তম প্রজাতন্ত্র দিবসে দিল্লির রাজপথে পুরুলিয়ার ঐতিহ্যবাহী ছৌ-মুখোশকে থিম হিসাবে সাজিয়েছিলেন যিনি, প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থানাধিকারী চড়িদার সেই ফাল্গুনী সূত্রধর জানালেন মুখোশ তৈরির পদ্ধতি : “প্রথমে কাঁচামাটি দিয়ে আমরা মুখোশের আদল বা মুখমণ্ডলের ছাঁচ তৈরি করি। তারপর সেটা শুকানোর পর সেই ছাঁচের ওপর ছাই ছড়িয়ে দিই। ছাইয়ের ওপর আঠা-ভেজানো পাতলা কাগজ পর পর মাপ অনুযায়ী সেই আদলের সঙ্গে মিলিয়ে সাঁটতে হয়। এইভাবে ধীরে ধীরে মূর্তির গড়ন স্পষ্ট হতে থাকে। তারপর তাতে পাতলা কানি কাপড় মাটির সঙ্গে মাখিয়ে অবয়বটিকে আরো স্পষ্ট রূপ দিতে হয়। পাতলা মিহি কাপড়ের মণ্ড জড়ানোর ফলে মূর্তিগুলো অনেক শক্তপোক্ত হয়, ভেঙে যাওয়ার ভয় থাকে না। মিহি মাটিতে চোখ, কান, নাক, ভ্রু, থুতনি, ঠোঁট সবকিছুকেই সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা যায়। মুখোশ তৈরির প্রাথমিক কাজটা এভাবেই শেষ হয়। বাকি থাকে রং ও পালিশ এবং মুকুট সজ্জার কাজ।”১ সব মিলিয়ে একটি মুখোশ তৈরিতে শিল্পীকে যথেষ্ট শ্রম ও সময় দিতে হয়। কাজের প্রতি ভালবাসা না থাকলে মূর্তিনির্মাণে নানারকম ত্রুটি-বিচ্যুতি ঘটে যায়। ত্রুটিপূর্ণ মুখোশ কখনো ছৌ-নাচে ব্যবহার করা যায় না। তরুণ শিল্পীদের হাতে তৈরি এরকম মুখোশ তখন সস্তায় বাজারে বিক্রি করা হয়।
একজন সুদক্ষ শিল্পী ‘কাবিজ লেপা’ পালিশ করা মুখোশটিকে সম্পূর্ণ শুকিয়ে যাওয়ার পর আরো নিখুঁত রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে। মাটির ছাঁচ থেকে মুখোশের অবয়বটিকে আলাদা করা হয়। তারপর মুখোশের চরিত্র অনুযায়ী তাতে বাহারি রঙের ব্যবহার শুরু হয়। লাগানো হয় নকল চুল, পুঁতি, রাংতা, কাকসা, পাখির পালক, ময়ূরপুচ্ছ, চকমকি ইত্যাদি। সবশেষে গর্জন তেল দিয়ে মুখোশের অবয়বটিকে ঝলমলে করে তোলা হয়। রাম, সীতা, লক্ষ্মণ, রাবণ, গণেশ, কার্তিক, দুর্গার মুখোশগুলি যেন শিল্পীর তুলির আঁচড়ে জীবন্ত হয়ে ওঠে!
আগেকার দিনে এই শিল্পের নামকরা শিল্পী ছিলেন অনিল সূত্রধর, নেপাল সূত্রধর, গণেশ সূত্রধর, শম্ভুনাথ সূত্রধর, গোপাল সূত্রধর, হীরালাল সূত্রধর, স্বরূপ সূত্রধর, ধনঞ্জয় সূত্রধর, বিনয় সূত্রধর, জয়ন্ত সূত্রধর প্রমুখ। এঁদের মুখোশ বিক্রির বাজার ছিল বিশ্বজুড়ে। ছৌয়ের মুখোশ কোনো প্রদর্শনীতে গেলে তা আর ফিরে আসেনি, বিক্রি হয়েছে চড়া দামে।
বড় বড় মাটির মূর্তির পাশাপাশি সারা বছর ধরে তৈরি করা মুখোশ চলে যায় ঝালদা, বরাবাজার, মানবাজার, কেন্দা, কালিমাটি, বান্দোয়ান, সেরাইকেলা, ময়ূরভঞ্জ, বারিপদা, ধানবাদ ও আরো দূর-দূরান্তে—রাজ্যের সীমানা ছাড়িয়ে দিল্লি, মুম্বাই, দেরাদুনে। তাছাড়া গুণমানের বিচারে দাম অতি অল্প হওয়ার কারণে বহুবার মুখোশ গেছে দুবাই, প্যারিস, বার্লিনে। মুখোশের এই বাজার ও শিল্পীদের শ্রমের হিসাব-নিকাশ করতে গিয়ে যেন তারই খানিকটা নাগাল পাওয়া গেল এই সময়ের শিল্পীদের মধ্যে যাঁর দক্ষতা প্রশ্নাতীত, সেই জগদীশ সূত্রধরের কাছে।
বর্তমান সময়ে চড়িদার মুখোশ-শিল্পের কথা বলতে গেলে সবার আগে উঠে আসে জগদীশ সূত্রধরের নাম। এখনকার শিল্পীদের মধ্যে ‘জগী’র (প্রচলিত ডাকনাম) দক্ষতাই সবচেয়ে বেশি। মুখোশ যেন তাঁর হাতে জীবন্ত প্রতিমা হয়ে ওঠে! মুখোশকে তিনি শুধু বিখ্যাতই করেননি, দেশের সীমানা ছাড়িয়ে দূরদেশে বিক্রি হয়েছে তাঁর মুখোশ। চড়িদার বাজারে জগদীশের নিজস্ব একটি দোকান রয়েছে। বিক্রিবাটার জন্য ছৌ-মুখোশের সমগ্র বাজারটি চড়িদাতেই তৈরি হয়েছে। এর বাইরে বাহান্ন কিলোমিটার দূরে পুরুলিয়া শহরে নাগের দোকান, পুরুলিয়া মুখোশ ঘর—এরকম হাতে গোনা দু-একটি দোকান রয়েছে। চড়িদা থেকে পাইকারি হারে মুখোশ নিয়ে গিয়ে দোকানে সাজিয়ে রাখা থাকে।
মুখোশের বিক্রি কমেনি কোনোকালে। যত দিন গেছে মুখোশের প্রতি মানুষের চাহিদা ও আকর্ষণ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে। জগদীশ সূত্রধরের ছিল অভাবের সংসার। অনেক কষ্টে মুখোশ বিক্রি করে কোনোরকমে দিনাতিপাত করতেন। আয়ের দ্বিতীয় কোনো উৎস তাঁর ছিল না। এখন রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারের তরফ থেকে প্রায়শই মুখোশের অর্ডার আসে তাঁর কাছে। আর যখন আসে তখন একসঙ্গে প্রায় চারশো-পাঁচশো মুখোশ বানিয়ে ডেলিভারি দিতে হয় তাঁকে। এর বাইরে নাচের জন্য বিক্রি হয়ে যাওয়া ছৌ-মুখোশের ক্ষয়ক্ষতি আছে। সেখানে তৈরি হয় ‘রিপিট কাস্টমার’। জগদীশবাবু জানালেন : “মুখোশের ব্যাপার-স্যাপার অমনিই বঠে। এখনকার লাচে লাফালাফি, চুড়পা-চুড়পিটা একটু বেশি। লাফঝাঁপ, ডেগাডেগি যত হয় মুখোশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও তত বাড়ে। ক্ষয়ক্ষতি যত বাড়ে, ততই বাড়ে মেরামতি ও মুখোশের বিক্রি। প্রফিট উখান থেকেই বেরাই আসে।”২ একসময় হা-পিত্যেশ করে বসে থাকা জগদীশবাবুর মতো শিল্পীরা আজ লাভের মুখ দেখছেন।
“গম্ভীর সিং একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছিলেন— ছৌনাচে যদি মুখোশ না থাকত তবে তা এমন বর্ণময় হয়ে উঠত না। আগে (প্রায় ৩/৪ দশক আগের) মুখোশের এত চাকচিক্য হত না, ছিল ম্যাড়মেড়ে, রঙও এত উজ্জ্বল ছিল না। মুখোশ ছাড়া—অভিব্যক্তি ফুটে উঠত না। ধামসার গুরুগম্ভীর আওয়াজের মধ্যে মুখোশের নড়াচড়ায় তাকানোর ভঙ্গিতে শ্রোতা-দর্শকদের মধ্যে এক ধরনের উদ্দীপনা ছড়িয়ে পড়ে। চড়িদার মুখোশ শিল্পীরা যে অসাধারণ কারিগরি দক্ষতায় নানা ব্যঞ্জনাময় মুখোশ তৈরি করেছেন তাতে ছৌনাচ অন্য মাত্রা পেয়েছে। গম্ভীর সিং নিজেই মুখোশ নির্মাতাদের মুখোশ তৈরির বিষয়ে পরামর্শ, অনুপ্রেরণা দিতেন।”৩ গম্ভীর সিং মুড়া, পীতাম্বর সিং, সুচাঁদ মাহাতো, কলেবর কুমার, এমনকী হাল আমলের বাঘাম্বর, সূর্য হাড়ি, হেমসিং মাহাতো, জাগরু মাহাতো, দিলীপ মাহাতো, লাল মাহাতো প্রমুখ ছৌ-নাচকে যাঁরাই জনপ্রিয়তার উত্তুঙ্গ স্তরে নিয়ে গেছেন, প্রত্যেকেই স্বীকার করেছেন মুখোশের অসামান্য রূপ-জৌলুসের কথা। তবে এই জৌলুস নব্বই-একশো বছর আগে ছিল না। তখন মুখোশ তৈরি হতো বটে, নাচতেনও ভিখু লায়া, জীপা সিং মুড়া, বাবুলাল মিস্ত্রির মতো বিখ্যাত সব ছৌ-শিল্পীরা, কিন্তু তাঁদের মুখোশ এতটা চটকদার ছিল না। তখন “মুখোশ ছিল, কিন্তু আড়ম্বর ছিল না। শুধু মুখটাই ঢাকত, এত বাহারী ছিল না।”৪ “চড়িদার মিস্ত্রিরা হৃদয়নাথের সময় থেকেই ছিল। কাঠের মুখোশ শোনা কথা। প্রথমে মলাটের পীজবোর্ড, পরে কাগজের তৈরি। গোটা মুখটা ঢাকা থাকত। চূড়াটুড়া, সলমাকাঠি, কিরণগোখরি, জামিরপাতা ছিল। এখন অনেক রঙচটকা হয়েছে। গঠন তখনকারই ভালো ছিল।”৫ মুখোশের এই বিবর্তনগুলিকে যথাযথভাবে ধরে রাখার জন্য না তৈরি হয়েছে মুখোশ সংগ্রহালয় (Mask Museum), লিখে রাখার জন্য না আছে সারস্বত সমাজের আগ্রহ। আলোর মাঝে, আশার মাঝে যেন মৃদু মৃদু সন্ধ্যা নেমে আসে মুখোশ-শিল্পের আঙিনায়।
চড়িদার সান্ধ্য রূপ দেখার মতো। কানে আসে সানাইয়ের সুর। দূর থেকে ভেসে আসে ঢাক গুড় গুড় আওয়াজ। একটু পরেই শুরু হবে ছৌয়ের মহড়া। ছৌ-নাচ সহজ নয়, রীতিমতো দিন-প্রতিদিন তালিম নেওয়ার ব্যাপার থাকে এতে।
ফিরে যাই ইতিহাসের গহিন ভাঁজে, যেখানে বিন্দু বিন্দু বর্ণছায়ায় লেখা হয়ে আছে মুখোশের আদিম অক্ষরমালা। সারা পৃথিবী জুড়েই আদিম জনগোষ্ঠীর মানুষজন তাদের নৃত্য পরিবেশনের তাগিদে মুখোশের ব্যবহার করত। ফলে যেখানেই আমরা প্রাচীন সভ্যতার বিকাশ দেখি, সেখানেই লক্ষ্য করি মুখোশের ব্যবহার। ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাসের দিকে চোখ ফেরালে দেখা যায় হিমালয়ের লাদাখ ও হিমাচল থেকে পূর্ব-ভারতের মোঙ্গলয়েড শাখার নানা জনগোষ্ঠীর মানুষ মুখোশ ব্যবহার করেছে। তাছাড়া নেপাল, ভুটান, চীন, জাপান, জাভা, সুমাত্রা, বলিদ্বীপ, থাইল্যান্ড এবং আফ্রিকা মহাদেশের প্রায় সর্বত্র মুখোশের ব্যবহার হয়ে আসছে। মুখোশের ব্যবহার দেখা যায় প্রাচীন ইউরোপের গ্রিক ও রোমান রাজত্বে, দক্ষিণ আমেরিকার পশ্চিমে পেরু অঞ্চলে, উত্তর আমেরিকার মেক্সিকো ও অন্যান্য অঞ্চলে। এছাড়াও প্রাচীন সুমেরু সভ্যতা কিংবা ইনকা সভ্যতাতেও মুখোশের ব্যবহার ছিল লক্ষ্য করার মতো। কমবেশি সকল সভ্যতায়, সমস্ত দেশেই মুখোশকে ব্যবহার করা হয়েছে প্রতীকরূপে। সেই প্রতীকের ব্যবহার হয়েছে পূজা-অর্চনায়, উৎসব-পার্বণে, অলৌকিক বিশ্বাস ও সাংস্কৃতিক নৃত্যানুষ্ঠানে।
প্রাচীন লোকসমাজে ‘টোটেম’-এর বহুল ব্যবহার ছিল। টোটেম হলো গোষ্ঠীর প্রতীক। আদিম লোকসমাজে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মানুষ পশু, পক্ষী, মাছ, বৃক্ষ, আরশোলা, কচ্ছপ ইত্যাদিকে টোটেম আকারে গ্রহণ করত। এইসমস্ত টোটেমের ভিতর অতিলৌকিক শক্তির প্রকাশ ঘটত। তখনকার দিনে নৃত্য কিংবা পার্বণে টোটেমের নিখুঁত অনুকরণের জন্য সেই টোটেমের উপযোগী মুখোশ তৈরি করা হতো। লোকায়ত স্তরে মুখোশের ব্যবহার তাই আজকের নয়, এর চল অনেক আগে থেকে।
গ্রামবাংলায় আমরা যে মুখোশের ব্যবহার দেখি, সাধারণত সেগুলো কাগজ, কাঠ, কাপড়ের মণ্ড, মাটি, বাকল কিংবা শুকনো লাউকুমড়ার খোলা দিয়ে তৈরি করা হয়। উত্তরবঙ্গের এক ধর্মীয় নৃত্য হলো ‘বাকপা’, এতে কাঠের খোদাই করা মুখোশ ব্যবহার করা হয়। আবার ‘জুংবা’ নৃত্যে সরাসরি মুখোশের ব্যবহার না হলেও বিভিন্ন রং ও পরচুলা ব্যবহার করে শিল্পী ভূতের মতো সেজে ওঠে। ‘মাকপল’ নৃত্যে ব্যবহার করা হয় ভালুকের মুখোশ।
আলিপুরদুয়ারের দক্ষিণে কোচাদ্রাও-এর দল ‘চোর খেয়ালী’ নামে একরকম মুখোশ-নৃত্য করে। এই মুখোশগুলি যেমন বিচিত্র তেমনই আকর্ষণীয়। তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে অতুলনীয় হয়ে উঠেছে চড়িদার মুখোশ।
মুখোশ গ্রাম চড়িদায় শিল্পীর শ্রম সমাহিত হয়েছে সৌন্দর্যমণ্ডিত অবয়বে। কত তার রূপের বাহার! যেন প্রকৃতি থেকে কুড়িয়ে পাওয়া জলছবি। কোনো নির্দিষ্ট ছাঁদে এই শিল্পীরা বাঁধা পড়েনি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারাও নিত্যনতুন পরীক্ষার ভিতর দিয়ে গেছে। ভেঙেছে, গড়েছে, আবার তৈরি করেছে নতুন ছাঁদ। তাদের সেই বিচারশক্তি ও ভবিষ্যৎ মানচিত্রটি দেখার মতো।
ছৌ বেঁচে থাকলে বেঁচে থাকবে ছৌ-শিল্পীরা, বেঁচে থাকবে মুখোশ-শিল্প। বর্তমান সময়ে ছৌ-নাচের প্রচার ও প্রসার ঘটছে দুনিয়া জুড়ে। বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠান থেকে রাজনৈতিক মেলা, আই.পি.এল থেকে সিনেমার শ্যুটিং—ছৌ-নাচের আমন্ত্রণ আসে সমাজের প্রায় সর্বস্তর থেকে। আর ছৌ-নাচের আনুষঙ্গিক, অপরিহার্য উপাদান হিসাবে প্রয়োজন পড়ে মুখোশের। তাই বিক্রিবাটা আগের থেকে বেড়েছে বহুগুণ। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তর, আদিবাসী লোকসংস্কৃতি কেন্দ্র, সংগীত নাটক একাডেমি, কেন্দ্রীয় সরকারের ললিত কলা একাডেমি, ন্যাশনাল একাডেমি অব ফাইন আর্টস—এরকম বহু সরকারি, বেসরকারি ও স্বশাসিত সংস্থার সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় মুখোশ-শিল্পীরা আশার আলো দেখছে। আজকাল এদের অনেকে ভাতা পায়। ভাল কাজের পুরস্কারও পায়।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মুখোশের অনেক বদল যেমন হয়েছে, তেমনি বর্তমান বাজার-চাহিদার ওপর নির্ভর করে শিল্পীরাও নতুন ধরনের মুখোশ তৈরি করতেও দুঃসাহস দেখাচ্ছে। আগেকার দিনে ছৌ-নাচের পালাগুলি ছিল পৌরাণিক কাহিনি-নির্ভর, তাই মুখোশও তৈরি হতো অনুরূপ।
‘মহিষাসুরমর্দিনী’, ‘অভিমন্যুবধ’, ‘রাবণবধ’, ‘রাম-লক্ষণ’, ‘শিব-দুর্গা’, ‘কংসবধ’ ইত্যাদি পালার জন্য তৈরি হতো শিব, দুর্গা, গণেশ, কার্তিক, লক্ষ্মী, সরস্বতী, বাঘ, ময়ূর, কিরাত ইত্যাদির মুখোশ। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক ঘটনা, ঐতিহাসিক ও স্বদেশি আন্দোলনের ভিত্তিতে যে ছৌ-পালা তৈরি হচ্ছে, তার অনুরূপে সিধু, কানহু, বীরসা, এমনকী সাধারণ নরনারীর মুখের অবয়বে শিল্পীরা মুখোশ নির্মাণ করছে। শুধুমাত্র শৌখিন মানুষজনের ড্রয়িংরুম সাজানোর জন্য বটপাতার ওপর ভগবান বুদ্ধের মূর্তি, কথাকলির অবয়ব যেমন তারা তৈরি করছে, তেমনই বিভিন্ন গ্রিক বীর ও দৈত্যের আদলে মুখোশও তৈরি হচ্ছে।
করোনা মহামারীর কালে যখন সারাবিশ্ব স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল, তখনো শিল্পীদের প্রচেষ্টায় ভাটা পড়েনি এতটুকু। নিভৃত যাপনের দিনগুলিতে তারা মাস্কের আদলে তৈরি করেছে মুখোশ। সেইসব মুখোশ-মাস্ক বিক্রিও হয়েছে দেদার। কোনো বাধা তাদের কাছে বাধা হয়নি শেষমেশ। এই প্রখর জলকষ্টের দেশে শিল্পীদের চোখ ভরে উঠেছে সৃষ্টির জাদুতে। তারা মগ্ন থেকেছে শিল্পের প্রতি, কৃতজ্ঞ থেকেছে মাটির কাছে আর নতজানু হয়ে স্বীকার করে নিয়েছে সৃষ্টিকর্তার প্রতি তাদের অলৌকিক ঋণ। ঈশ্বর তাই অনিন্দ্যসুন্দর অবয়ব নিয়ে জড়িয়ে গেছেন এদেরই মায়াজালে। মুখোশ-শিল্পীদের সৃষ্টিশীলতা থামার নয়, এই শিল্পের দেশে খরা নামার নয়।
তথ্যসূত্র
১ ফাল্গুনী সূত্রধরের সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
২ জগদীশ সূত্রধরের সঙ্গে লেখকের ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ১০ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
৩ ভট্টাচার্য, নন্দদুলাল, ‘নৃত্যে মুখোশ ও ছৌ মুখোশের শিল্পকলা’, দেবপ্রসাদ জানা (সম্পাদনা), অহল্যাভূমি পুরুলিয়া, দীপ প্রকাশন, কলকাতা, ২০০৩, ১ম পর্ব, পৃঃ ২৬৯
৪ বসুরায়, সুবোধ, ‘পাহাড় জঙ্গলের ছোনাচ এখন বিশ্বময়’, ঐ, পৃঃ ২৪৮
৫ ঐ, পৃঃ ২৫৩