লোকমুখে জলের ধারাটির নাম ‘মায়ের গঙ্গা’। আসল নাম ‘আমোদর নদ’। আমোদর ‘নদী’ হলো না কেন? সর্বজনগ্রাহ্য মত—পুরুষবাচক শব্দের প্রবহমান জলের ধারা নদ, আর স্ত্রীবাচক শব্দের প্রবহমান জলের ধারা নদী। আমোদর পুরুষবাচক, তাই সে নদ।

নামের খোঁজে

বেশ, আমোদর পুরুষবাচক শব্দ, তা তো বোঝা গেল। আমোদর নদের এমন নাম হলো কেন? অনেকে বলেন—আমোদ উদরে যার, সেই আমোদর নদ। ‘আমোদ’ শব্দের অর্থ হলো আনন্দ। আমোদ যার পেটের মধ্যে রয়েছে, সেই হলো আমোদর। কিংবা আমোদ যার পেটের মধ্যে বিলুপ্ত হয়, সেও আমোদর। একটা লোকগল্প প্রচলিত আছে—যদিও তা ক্রমশ হারিয়ে যেতে বসেছে। সে হবে অনেক দিন আগের কথা। দিনক্ষণের ঠিক-িঠকানা নেই। আকাশ থেকে টপ করে পড়ল আমন আর আমোদ। এরা দুজনেই ছিল বরুণ দেবতার সেবক। একদিন বরুণ দেবতা একটা বড় মণ্ডা (একপ্রকারের মিষ্টি, যার গায়ে চিনি মাখানো থাকে) এনে রেখে দিয়েছিলেন তাঁর রন্ধনশালাতে। এদিকে আমোদ আর আমনের খুব খিদে পেয়েছিল। আমোদ চুপি চুপি রন্ধনশালাতে গিয়ে একটা কামড় দিয়ে কিছু মিষ্টি খেয়ে আসে, আর মনে মনে ভাবে—বরুণদেব জিজ্ঞাসা করলেই সে আমনের নামে দোষ দেবে। ওদিকে আমনও লুকিয়ে লুকিয়ে রন্ধনশালাতে গিয়ে একটা কামড় দিয়ে মিষ্টি খেয়ে আসে। সে ভাবে, বরুণদেব জিজ্ঞাসা করলে দোষ দিয়ে দেবে আমোদের ওপর।


যেমন ভাবা তেমনই হলো। খিদে পেলে বরুণদেব মিষ্টি খেতে বসে দেখেন—কে যেন দু-কামড় দিয়ে মিষ্টিটা খেয়ে রেখে দিয়েছে। বাড়িতে তো আমোদ আর আমন ছাড়া কেউ নেই, কাজেই তারা ছাড়া তো আর কেউ খাবে না। বরুণদেব ডেকে পাঠালেন দুজনকে। কে মিষ্টি খেয়েছে জিজ্ঞাসা করতেই আমোদ আর আমন দুজন একে অন্যের ওপর দোষ চাপিয়ে দেয়। কাজেই বরুণদেব রেগে গিয়ে দুজনকে আকাশ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেন। আমোদ পড়ে জলের মধ্যে। আর আমন পড়ে মাটিতে। আমন মাটি থেকে গড়িয়ে গিয়ে জলের মধ্যে ঝাঁপ দেয়। আমোদ আর আমন একসঙ্গে জলের মধ্যে থাকতে পারছিল না। আমন তখন ডাঙাতে বাস করতে থাকে। যে-জলে আমোদ থাকে, সেই জলধারার নাম হলো ‘আমোদর’। আর মাটিতে আমন থাকায় জন্ম হলো আমন ধানের। এই লোকগল্পটার পিছনে আসলে লুকিয়ে আছে ঐ এলাকার ভৌগোলিক বৃত্তান্ত। অনেকের মতে—আমোদরে বন্যা এলে সে হতো ভয়ংকর। উত্তাল হতো তার চেহারা। সে বয়ে আনত নরম পলি, ছড়িয়ে দিত প্লাবন ভূমিতে। বন্যার পরে দুধের সরের মতো রেখে যাওয়া পলিতে চাষ হতো খুব ভাল। আর চাষ ভাল হলেই কৃষকের মুখে হাসি ফুটত।

আঁকাবাঁকা পথ চলা

আমোদর নদের জন্ম বাঁকুড়া জেলার জয়পুরের রাজগ্রামের কাছে। তারপর কোতুলপুর থানার গোপীনাথপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের বালিহারপুর গ্রামের কাছে হুগলি জেলার ভিতরে প্রবেশ করেছে। হুগলির গোঘাট থানার উত্তর-পশ্চিম অংশ দিয়ে প্রবাহিত হয়ে দলকার জলাকে অতিক্রম করে জয়রামবাটীর পাশ দিয়ে গিয়ে আমোদর ঢুকে পড়ে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায়। তারপর তারাজলি ও ঝুমঝুমি নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়ে দ্বারকেশ্বর নদের সঙ্গে মিলিত হয়। আমোদরের প্রবাহপথে দেওয়ানচকের কাছে তারাজলি নদী এসে মিলিত হচ্ছে। আমোদরের চলার পথে রয়েছে অনেক বাঁক। এই বাঁকগুলোকে স্থানীয় ভাষায় ‘দহ’ বলে, আর নদীবিজ্ঞানের ভাষায় বলে ‘মিয়েন্ডার’। নদীর কতটা বাঁকা তাও মাপা হয়—যাকে বলে নদীর ‘বক্রতা সূচক’ বা ‘সায়নোসিটি ইনডেক্স’। আমোদর নদের বক্রতা সূচক ৩.৩৪—যা থেকে বোঝা যায় এর দুটো বাঁক, একে অন্যের খুব কাছাকাছি। নদটির দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার।

কত দিনের তুমি?

আমোদর খুব প্রাচীন নদ। কতটা পুরােনা? কার্টোগ্রাফার রেনেল সাহেবের আঁকা মানচিত্রে উল্লেখ না থাকলেও মুকুন্দরামের চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের আখেটিক খণ্ডে আমোদরের উল্লেখ পাওয়া যায়। নদ-নদীর কলিঙ্গদেশ যাত্রা প্রসঙ্গে লেখা হচ্ছে—
“আমোদর দামোদর ধাইল দারিকেশ্বর


শিলাই চন্দ্রভাগা।”


আমোদরের উল্লেখ মঙ্গলকাব্যে থাকলেও ওম্যালি সাহেবের লেখা গেজেটিয়ারে এই নদের কোনো উল্লেখ নেই।


মায়ের আমোদর

কামারপুকুরের একেবারে পাশ দিয়েই বয়ে গেছে আমোদর। শ্রীমা সারদাদেবীর স্মৃতির সঙ্গে এই নদের বন্ধন খুব দৃঢ়। মায়ের স্মৃতিকথাগুলিতে এই নদের বারবার অনুষঙ্গ এসেছে। বলছেন : “ভাইদের নিয়ে গঙ্গায় নাইতে যেতুম, আমোদর নদই ছিল যেন আমাদের গঙ্গা। গঙ্গাস্নান করে সেখানে বসে মুড়ি খেয়ে আবার ওদের নিয়ে বাড়ি আসতুম। আমার বরাবরই একটু গঙ্গাবাই ছিল।”


আবার শ্রীরামকৃষ্ণও এই নদ একাধিকবার পেরিয়েছেন। তাঁর ভাগনে হৃদয়ের বাড়ি ছিল শিহড় গ্রামে। এই বাড়িতে কথকতা শুনতে এলে পেরতে হতো আমোদর নদ। আবার মায়ের বিয়ের সময় জয়রামবাটী আসতে শ্রীরামকৃষ্ণকে পেরতে হয়েছিল এই নদ। আমোদর নিয়ে এরকম আরো ঘটনা রয়েছে। মায়ের সময়কালে একবার আমোদর নদে কুমির দেখা গিয়েছিল। আবার একবার এখানে জোয়ারের জল এসেছিল। সময়টা ১৯১৯ সাল। তখন মা ছিলেন কোয়ালপাড়ার জগদম্বা আশ্রমে। এক ব্যক্তি আমোদর সাঁতার কেটে পার হয়ে মায়ের কাছে এসে খবর দেন যে, নদে জোয়ার এসেছে, কাজেই অত জল পেরিয়ে মা ফিরতে পারবেন না। কোয়ালপাড়া হয়ে বিষ্ণুপুর যাওয়ার পথে ডোঙাঘাটা বা মুরোর খালের কাছে মা আমোদর নদ পেরতেন। তারপর দেশড়া ও আনুড়ে বিশালাক্ষী মন্দির হয়ে বেঙ্গাইয়ের কালীমন্দিরে পৌঁছাতেন।


আমোদরের ঘাটে দশহরা উৎসব পালন হতো। আমোদরের পাশে ছিল একটা বড় বটগাছ। সারদাদেবীর মা শ্যামাসুন্দরীদেবী এই বটগাছটি নদীর ধারে পুঁতেছিলেন। শ্রীমা নদীর পাড়ে এই বটগাছের ছায়াতে বসতেন। অনেক সময় সন্ধ্যার দিকে এই গাছতলায় বসে তিনি ধ্যানও করতেন।
মায়ের মহাসমাধির পর ১৯২৬-২৭ থেকে ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত অন্নপূর্ণাপুজো ও অষ্টমী স্নানতিথি জয়রামবাটীতে আমোদর নদে পালন করা হতো। মা ও তাঁর ভাইদের আমোদরে স্নানের কথা স্মরণে রেখে শোভাযাত্রাটি হতো মাতৃমন্দির থেকে আমোদরে মায়ের স্নানের ঘাট পর্যন্ত। সেই অনুষ্ঠানে শুকনো চাল ও দুর্গা ময়রার জিলাপি বিতরণ করা হতো।
আমোদর নদের ধারে একটা আমলকী গাছও ছিল। এই গাছের নিচে স্বামী সারদানন্দজী, যোগীন-মা, গোলাপ-মা প্রমুখ সাধনা করেছিলেন। স্বামী সারদানন্দজী আমলকী গাছের নিচে বসে গীতাপাঠ করতেন। মা বলতেন, আমলকী গাছে লক্ষাধিক দেবতা বাস করেন, এই গাছের নিচে ধ্যান করলে উপকার অনেক বেশি হয়। মা আমলকী পাতাকে শিবপূজায় বেলপাতার মতো ব্যবহার করতে বলেছিলেন।


২০০৮-০৯-েত আমোদরে মায়ের ঘাটের কাছে গড়ে ওঠে ‘শ্রীমা সারদা কানন’। এর কাছেই রয়েছে ‘মণিকর্ণিকা’ শ্মশান। এই শ্মশানকে জয়রামবাটীর গ্রামের মানুষেরা ব্যবহার করেন। মায়ের ঘাটের কাছেই রয়েছে মায়ের বাবা ও মায়ের সমাধি।

জয়রামবাটীতে মা প্রতিবছর জগদ্ধাত্রীপুজো করতেন। পুজো শেষ হলে বিসর্জনের আগে তিনি দেবীর একটা কানের দুল খুলে রেখে দিতেন, আর তাঁর কানে কানে বলতেন আগামী বছর আবার আসার কথা। এই বিষয়ে শ্রীশ্রীমা সারদামণি দেবী গ্রন্থে মানদাশঙ্কর দাশগুপ্ত লিখছেন : “জানা যায়, প্রতি বৎসর প্রতিমা বিসর্জনের পূর্বে দেবীর কানের একটি গহনা খুলিয়া রাখিবার প্রথা মার বাড়ীতে প্রচলিত আছে। তিনি ভক্তদের বলিয়াছেন, ‘কানের গহনা একটি খুলে রাখবে, মা সেইটি মনে করে আসবেন।’ মার শেষ পূজার বৎসরে (১৯১৯), ঐ গহনা মা নিজেই খুলিয়া লইয়া প্রতিমার কানের কাছে আস্তে আস্তে বলেন, ‘মা, আবার এসো।’”৩ জগদ্ধাত্রীপুজো শেষ হওয়ার পর প্রতিমা আমোদরে বিসর্জন দেওয়া হতো।

আমোদরের দলকা

আগেই বলা হয়েছে, আমোদর হুগলি জেলার গোঘাট থানা এলাকায় উত্তর-পশ্চিম অংশ দিয়ে দক্ষিণবাহিনী হয়ে দলকার জলা অতিক্রম করে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলায় প্রবেশ করেছে। কীভাবে তৈরি হলো দলকার জলা? অনেকে মনে করেন, এটি আমোদরের ছেড়ে যাওয়া পুরানো চলার পথ, যা জলাভূমিতে পরিণত হয়েছে। এই জলা দৈর্ঘ্যে ১৫ কিলোমিটার আর প্রস্থে ৬ কিলোমিটার। দলকার জলার চারপাশের গ্রামগুলো হলো গোঘাট ১ ব্লকের কৌটা, দামোদরপুর, চন্দ্রকোণা ১ ব্লকের মাংরুল, আগড়া ও ইড়পালা। দলকার জলা নিয়ে রয়েছে নানা লোকশ্রুতি। কোনো একসময় শালিবাহন রাজাকে দেবী ‘দলকেশ্বরী’ দর্শন দিয়েছিলেন। তবে রাজা শালিবাহনের কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। লোকশ্রুতি হলো, দেবী দলকেশ্বরী হলেন দলকার জলার অধীশ্বরী। তবে শাস্ত্রে এই দেবীর কোনো উল্লেখ নেই। অনেকের মতে—মঙ্গলকাব্যে উল্লেখিত কমলেকামিনীর সঙ্গে দেবী দলকেশ্বরীর মিল রয়েছে। আরো একটি লোককাহিনি দলকার জলা নিয়ে আশপাশের এলাকায় ঘুরে বেড়ায়। সে বহু দিন আগের কথা, সময়টা ঠিকঠাক বলা যাবে না। শালিবাহন রাজার এক কূপ ছিল। সেই কূপের জল কোনো মৃতব্যক্তির ওপর ছিটিয়ে দিলেই সে জীবিত হয়ে উঠত, সেই কারণে আশপাশের এলাকার কোনো রাজা শালিবাহন রাজাকে আক্রমণ করত না। একদিন এক বিধর্মী সম্রাট ব্রাহ্মণের বেশে শালিবাহন রাজার রাজত্বে প্রবেশ করে, তারপর সেই কূপের জলের মধ্যে গোমাংস ফেলে দেয়। কাজেই কূপটি অপবিত্র হয়ে ওঠে। যবনেরা এই সুযোগে রাজাকে আক্রমণ করে। শালিবাহন রাজা পরিবার-সহ কোনোরকমে পালিয়ে নৌকা নিয়ে দলকার জলাতে ভাসতে শুরু করেন। বাঁচার আর কোনো পথ নেই দেখে রাজা শালিবাহন পরিবার-সহ দলকার জলে ঝাঁপ দেন।

ঘাটের কথা

জয়রামবাটীর কাছাকাছি তিনটি উল্লেখযোগ্য ঘাট ছিল। স্থানীয় ভাষায় ঘাটগুলোকে ‘ঘাটা’ বলা হয়। প্রথমটি হলো খয়েরঘাটা। হলদির একটু পাশেই এই ঘাটটির অবস্থান ছিল। ঘাটাল থেকে কামারপুকুর যাওয়ার পথে আমোদরের এই ঘাটটি পড়ত। খয়েরঘাটা থেকে প্রায় ৫৪৮ মিটার দূরে ছিল গরুরঘাটা। হলদি গ্রাম থেকে কামারপুকুর যাওয়ার পথে গরুরঘাটাতে নৌকায় পার হতে হতো। এই পথে আমোদরের ওপর দিয়ে গরু- পারাপার হতো বলে এই ঘাটের নামের সঙ্গে গরু জুড়ে যায়। তৃতীয় ঘাটটির নাম ডোঙাঘাটা। পুকুরিয়া থেকে কামারপুকুর যাওয়ার পথে এই ঘাটটি পেরিয়ে যেতে হতো। এই ঘাটে একসময় ডোঙানৌকা চলত বলে ঘাটটির এমন নাম হয়। গরুরঘাটা থেকে ডোঙাঘাটার দূরত্ব ছিল আমোদর পথে প্রায় ৪৫৮ মিটার। আবার ডোঙাঘাটার কাছে আমোদর বেশ প্রশস্ত ছিল। সে-তুলনায় গরুরঘাটার কাছে আমোদর ছিল সংকীর্ণ।


ইতিহাসে আমোদর

আমোদরের সঙ্গে জুড়ে আছে আরেক ইতিহাসের অধ্যায়। পঞ্চদশ শতকের প্রথম অর্ধে হোসেন শাহ গড় মান্দারণে কিছু সময়ের জন্য আশ্রয়গ্রহণ করেন। ১৭১৭ সালে বাংলার নবাব হলেন মুর্শিদকুলি খাঁ। এই সময় গড় মান্দারণের সদর কার্যালয় স্থানান্তরিত হয় চাকলা সপ্তগ্রামে। জমা-ই-কামিল তুমার গ্রন্থ থেকে জানা যায়, ১৭২২ সালে পূর্বতন ‘সরকার’-এর নতুন নামকরণ হয় ‘চাকলা’। এর থেকেই গড় মান্দারণের প্রতি অবহেলা বাড়তে থাকে। মুতাসীন-উল-মুল্কের সময়কালে (সপ্তদশ শতকের প্রথম অর্ধে) মান্দারণ দুর্গের দক্ষিণ-পূর্ব সীমায় আমোদর নদের তীরে দুটি তোরণ তৈরি করা হয়েছিল। উত্তরদিকের তোরণটির নাম ‘সরাই’, আর দক্ষিণদিকের তোরণটি ‘মোবারক মঞ্জিল’ নামে পরিচিত ছিল। সানবাঁধি গ্রামে খুব সামান্য ধ্বংসাবশেষ গড় মান্দারণের স্মৃতি বহন করছে। ঐতিহাসিক ডি. জি. ক্রফোর্ডের বেঙ্গল পাস্ট অ্যান্ড প্রেজেন্ট গ্রন্থে অতীতের গড় মান্দারণ দুর্গের পরিচয় পাওয়া যায়। দুর্গের দুটি অংশ ছিল—উত্তরদিকের অংশটির নাম ছিল ‘গড় মান্দারণ’ আর দক্ষিণের অংশটি পরিচিত ছিল ‘ভিতরগড়’। গড়ের উত্তর কোণ দিয়ে আমোদর নদ প্রবাহিত ছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় আরামবাগে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট থাকার সময় ঐতিহাসিক এই গড় পরিদর্শন করেছিলেন। এই বিষয়ে তিনি লিখছেন : “নগরমধ্যে আমোদর নদী প্রবাহিত; এক স্থানে নদীর গতি এতাদৃশ বক্রতা প্রাপ্ত হইয়াছিল যে, তদ্দ্বারা পার্শ্বস্থ একখণ্ড ত্রিকোণ ভূমির দুই দিক বেষ্টিত হইয়াছিল; তৃতীয় দিকে মানবহস্তনিখাত এক গড় ছিল…।”
আবার ‘দুর্গেশনন্দিনী’ উপন্যাসে প্রথম সংস্করণে ‘অসাবধানতা’ অধ্যায়ে আমোদর নদ সম্পর্কে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় লিখছেন : “দুর্গের যে ভাগে দুর্গমূল বিধৌত করিয়া আমোদর নদী কলকল রবে প্রহবণ করে, সেই অংশে এক ক‌ক্ষবাতায়নে বসিয়া তিলোত্তমা নদীজলাবর্ত নিরীক্ষণ করিতেছিলেন। সায়াহ্নকাল উপস্থিত, পশ্চিমগগনে অস্তাচলগত দিনমণির ম্লান কিরণে যে-সকল মেঘ কাঞ্চনকান্তি ধারণ করিয়াছিল, তৎসহিত নীলাম্বরপ্রতিবিম্ব স্রোতস্বতীজলমধ্যে কম্পিত হইতেছিল,… আম্রকানন দোলাইয়া আমোদর-স্পর্শ শীতল নৈদাঘ বায়ু তিলোত্তমার অলককুন্তল অথবা অংসারূঢ় চারুবাস কম্পিত করিতেছিল।”

কেমন আছ আমোদর?

এমনভাবেই আমোদর ইতিহাসের পাশাপাশি স্থান পেয়েছে সাহিত্যেও। তবে নদটির আজ বড্ড করুণ অবস্থা! নদে জল থাকে না বললেই চলে। চাষের সুবিধার জন্য ১৯২০ সালে জয়রামবাটীর কাছে এর বুকে একটা চেক ড্যাম দেওয়ার পরে আমোদরে অনেক জল বেড়েছিল। বর্তমানে মায়ের ঘাটের কাছে সামান্য জল সারা বছর থাকে। নদের নাব্যতা আজ একেবারেই নেই। অনেক জায়গায় এর খাত দখল করে চাষবাস হচ্ছে। এই নদনদীগুলি ছোট হলেও বড় নদী বাঁচাতে এদের অবদান অনস্বীকার্য। বর্ষার জল নিয়ে এই নদ দ্বারকেশ্বরকে পুষ্ট করে। এর প্লাবনভূমিতে ছোট ছোট অনেক পুকুর তৈরি করে বৃষ্টির জল ধরে রাখা প্রয়োজন, যা শুখা মরশুমে একে বাঁচাতে সাহায্য করবে। নদের পাড় বরাবর ভেটিভার বা খসখস ঘাস লাগাতে হবে, যাতে ভূমিক্ষয় কম হয়।

সহায়ক সূত্র

১. ক্ষেত্রসমীক্ষা
২. জয়রামবাটী মাতৃমন্দিরের স্বামী ধ্রুবাত্মানন্দ মহারাজের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য
৩. টোপোসীট, সার্ভে অব ইন্ডিয়া, ১৯৭২, স্কেল ১ : ৫০,০০০ (নম্বর 73N/9)
৪. রায়, নীহাররঞ্জন, বাঙালীর ইতিহাস, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৪২০, আদিপর্ব, পৃঃ ৩৩১
৫. মাইতি, তাপস (সম্পাদিত), মেদিনীপুরের নদ-নদী কথা, ২০১৯, মেদিনীপুর, পৃঃ ৭—৩৫
৬. কর্মকার, সুপ্রতিম, কে হবে ‘নদ’ আর কে ‘নদী’? ‘সংবাদ প্রতিদিন’, ১১.১১.২০২১, পৃঃ ৪

তথ্যসূত্র

১. চক্রবর্তী, কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম, চণ্ডীমঙ্গল, কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ১৯৬৬, পৃঃ ২২২
২. স্বামী গম্ভীরানন্দ, শ্রীমা সারদা দেবী, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০১৯, পৃঃ ১৮
৩. দাশগুপ্ত, মানদাশঙ্কর, শ্রীশ্রীমা সারদামণি দেবী, বিজয়া দাশগুপ্ত ও সান্ত্বনা দাশগুপ্ত (প্রকাশক), কলিকাতা, ১৩৯০, পৃঃ ৩৯২
৪. বঙ্কিম রচনাবলী, দে’জ পাবলিশিং, কলকাতা, ২০১৩, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৩৩
৫. ঐ, পৃঃ ৩৭

‘স্বামী অভয়ানন্দ স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।

নদী-বিজ্ঞানী