মেঘ জমিয়াছে ঈশান কোণে। চতুর্দিকে নামিয়া আসিল অন্ধকার। কী এক আসন্ন তাণ্ডবের অপেক্ষায় প্রকৃতি আজ নিথর! আচম্বিতে তুমুল ঝঞ্ঝাবাত-সহ ভারি বর্ষণ শুরু হইল। প্রবল জলস্রোতে সব ভাসাইয়া লইয়া গেল বুঝি! সেই প্রকোপে ভয়ভীত ভূ–চরাচর আশ্রয় খোঁজে। প্রকৃতি মায়ের কোলে গড়িয়া ওঠা এজগতের স্থাবর–জঙ্গম সবই আজ আসন্ন প্রলয়নাচনে দিগ্ভ্রান্ত। খড়কুটোর মতো ভাসিয়া যাওয়া যখন একমাত্র গতি, তখনি যেন প্রসন্ন হইলেন মহাকাল। একচিলতে আলো পড়িল ঐ দোয়াত–কলমের জলচৌকি রাখা দাওয়াটিতে। সেই দিবালোকে আগমনিকার লিখিলেন—অবিশ্রান্ত বর্ষার পর শরৎকাল আসিয়াছে, ভগবতীর আবাহনে আগমনির সুর উঠিবে আকাশে–বাতাসে। অন্ধকার ঘুচাইয়া আলোর জ্যোতিতে ভাসিবে ভবন–ভুবন।
অবিশ্রান্ত বর্ষার পর যখন শরৎ আসে, প্রচণ্ড শীতের পর আসে বসন্ত; ভারতবাসী তখন পূর্ণ উদ্যম আর উৎসাহে জাগিয়া উঠে। এই দুই ক্ষেত্রেই প্রকৃতির রোষের পর তাহারা বিশেষভাবে স্মরণ করিয়া থাকে করুণাময়ী জগজ্জননীকে। অন্তর এবং বাহিরের সব দুর্যোগ-দুর্গতি যিনি দূর করেন—সেই দুর্গতিনাশিনী দুর্গার আরাধনা করে তাহারা এই দুইটি ঋতুতে। প্রকৃতি যেমন রুদ্রা আবার কল্যাণী—এই দুই রূপ ধরিয়াই আমাদের নিকট আসিয়া থাকে, তেমনি এই জগৎ আমাদের নিকট জীবন-মৃত্যু, হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ, ক্রোধ-প্রসন্নতা, ভয়-আশ্বাসের ন্যায় বিবিধ বৈপরীত্যের ডালি লইয়া প্রতিনিয়ত আমাদের নিকট হাজির হইয়া থাকে। মধুরকে সহজে গ্রহণ করিতে পারিলেও ভীষণের ঝড়-ঝাপটা অনেক সময়ই আমরা সহজে সামলাইতে পারি না। তবে ভীষণের মধ্যে যে কল্যাণের বীজ নিহিত, ভয়ংকর ভ্রুকুটিকরাল রূপের নেপথ্যে যে সুন্দর শিবসত্য আসীন আর মৃত্যুর মধ্যেই যে অমৃতপথের দিশা—এ তত্ত্ব আবিষ্কারের কৃতিত্ব ভারতবর্ষের।
মার্কণ্ডেয়পুরাণের অন্তর্গত ‘শ্রীশ্রীচণ্ডী’ দেবীকে যেমন ‘সদাভ্যুদয়দা ভবতী প্রসন্না’ বলিয়া উল্লেখ করেন, পাশাপাশি তাঁহার ‘সদ্যো বিনাশয়সি কোপবতী কুলানি’—পরাক্রমের কথাও স্বীকৃত। একদিকে তিনি কুপিতা–ভীষণা আবার অন্যদিকে তিনি প্রসন্না–বরদা। চণ্ডীতে রহিয়াছে—“চিত্তে কৃপা সমরনিষ্ঠুরতা চ দৃষ্টা ত্বয্যেব দেবি বরদে ভুবনত্ৰয়েঽপি” অর্থাৎ বরদে, হৃদয়ে মুক্তিপ্রদ কৃপা এবং যুদ্ধে মৃত্যুপ্রদ কঠোরতা ত্রিভুবনে একমাত্র আপনাতেই পরিদৃষ্ট হয়। এ যেন সগুণ–নির্গুণ, সাকার–নিরাকারের ন্যায় এক দ্বান্দ্বিক সমাপতন! এক যে আদিশক্তি, তিনিই দ্বৈতরূপে মধুরা-ভীষণা, কঠোরা–কোমলা এবং তুষ্টা–রুষ্টা। ফলত তাঁহার মায়ার কথা কহনে না যায়!
স্মরণ করিব সেই চিরন্তন কাহিনি—প্রজাবৎসল আদর্শ নৃপতি সুরথ। কিন্তু ভাগ্যবিড়ম্বনায় সে হারাইয়াছে নিজের রাজ্য ও পরিজনকে। শুধু তাহাই নহে, প্রতিকূল সাংসারিক পরিবেশে প্রাণধারণ অসম্ভব বুঝিয়া অরণ্যচারী হইয়াও সে শান্তি পায় নাই। চিন্তাগ্নি ছাপাইয়া যায় জঠরাগ্নিকেও। এমনই সময় আগন্তুক এক ধনাঢ্য বৈশ্যের সহিত তাহার আলাপ। নাম সমাধি—কিন্তু সেও চিত্তবিক্ষুব্ধ, শোকাকুল। পরিচয়ে ব্যক্ত হয়—সংসার-বিতাড়িত গৃহহারা হইয়া তাহারই ন্যায় সেও আজ বনবাসী। একই পরিণতি হেতু সমব্যথী দুইজনে; কিন্তু সান্ত্বনাদাতা সে-অরণ্যে কোথায়? শুধু হাহাকার নয়, এক গভীর অনুসন্ধিৎসাই যেন তাহাদের উপনীত করিয়াছিল নিবিড় অরণ্যের ‘মুনি–শিষ্য–উপশোভিতম্’ এক আনন্দ–নীড়ে—মেধা ঋষির আশ্রমে। মেধা ঋষি উভয়কেই সেই দেবী মহামায়ার তত্ত্ব সবিস্তারে শুনাইয়াছিলেন। এই মহামায়া—মহামায়ী, তিনি জগদ্বিধাত্রী—ঈশ্বরেরও ঈশ্বরী। তাঁহার ইচ্ছাতেই মানব সংসার-ক্রীড়ায় বদ্ধ, আবার তাঁহার প্রসন্নতাতেই ভক্তি–মুক্তি। তাই সংসারে শান্তিলাভের পথ সম্পর্কে ঋষি বলিলেন—হে মহারাজ, সেই পরমেশ্বরীরই শরণাগত হও। তাঁহাকে ভক্তিপূর্বক আরাধনা করিলে তিনিই ইহলোকে অভ্যুদয় এবং পরলোকে স্বর্গসুখ ও মুক্তি প্রদান করিবেন। সুরথ ও সমাধি অরণ্যমাঝে খুঁজিয়া পাইল পরিত্রাণের পথ।
তবে কাহিনি তো পুরাতন নহে, শাশ্বত। আধুনিক কালেও এই সংসার–অরণ্যে পথহারা মানবকুলের উপায় কী? জীবনের কক্ষচ্যুত দিগ্ভ্রান্ত রাজা বা রোজগারি বণিকের ন্যায় কত–শত পথচ্যুতকে পথ দেখাইবে কে? পুরাকালের মহামায়ার পুনরাগমন পর্ণকুটিরে—রক্তমাংসের শরীরে। মহামানবী-রূপ ধরিয়া দেবী অগণিত জনকে অকাতরে কৃপাশ্রয় প্রদান করিয়াছেন। কত দিগ্ভ্রান্ত অশান্ত চিত্তকে শান্তির আস্বাদন করাইয়াছেন। সন্তানের রুচি ও যোগ্যতা-ভেদে তাহাকে প্রবৃত্তি কিংবা নিবৃত্তির পথে প্রেরণ করিয়াছেন। পরমা প্রকৃতির অভয়া-বরদা রূপটির সাক্ষ্য শ্রীশ্রীমায়ের পূতপবিত্র জীবনালেখ্যে বহুলাংশে পাই। পুরাণে যিনি বরাভয়দাত্রী—তিনিই আবার নৃমুণ্ড, খর্পর ও অসি-ধারিণী। দশমহাবিদ্যার অন্যতমা ভুবনেশ্বরী, ত্রিপুরভৈরবীর কথা ভাবিতে পারি। বিদ্যাশক্তি দেবী ভুবনেশ্বরীর চার হস্তে বর ও অভয় মুদ্রা এবং পাশ ও অঙ্কুশ। আর বরাভয়দাত্রী ত্রিপুরভৈরবীর দুই হস্তে বর ও অভয় মুদ্রা, আর অপর দুই হস্তে জপমালা ও পুস্তক। জপমালা যেন ঈশ্বরভক্তির উপকরণ আর পুস্তক তো বিদ্যা বা জ্ঞানের প্রতীক। আর এইবারের মানবলীলায় দেবী-সন্তানের ধ্যানচিত্রে তিনি—‘স্বক্রোড়ন্যস্তহস্তাঞ্চ জ্ঞানভক্তি প্রদায়িনীম্’, তবে ‘দ্বিভুজাং স্থিরলোচনাম্’। শ্রীশ্রীমা দুই হাতে জ্ঞান–ভক্তি বিলাইয়াছেন আর তাঁহার দৃষ্টিতে কী অদ্ভুত স্নেহনির্ঝর ও নির্লিপ্ততা! শত-সহস্র কাজে লিপ্ত থাকিয়াও আসলে তিনি নির্লিপ্ত। “যখন মনে হচ্ছে তিনি বস্তুমগ্ন, তখন যথার্থত তিনি আত্মমগ্ন।” তিনি পার্থিব বিধানদাত্রী ও পারমার্থিক ফলদাত্রী। তাঁহার জীবনেও জনৈক সন্তান দেখিয়াছেন—সংসক্তি ও বৈরাগ্যের অদ্ভুত মিশেল! সেই গ্রামবাংলার মাটির দাওয়াতে ‘মা’রূপে যাঁহার স্নেহ–অভিসিঞ্চন, তাঁহারই আবার ‘জগন্মাতা’রূপে রাজপথের ইমারতে অধিষ্ঠিতা থাকিয়া কঠোর অনুশাসন। দুইটি জীবনচিত্র তুলিয়া ধরা যাক।
দৈব-দুর্বিপাকে একজন ভক্তসন্তানকে সংঘ ছাড়িয়া যাইতে হইতেছে। বিদায়কালে সে কাঁদিতেছে। সংঘজননীরূপে শ্রীশ্রীমা কঠোরা। ব্রতভঙ্গকারীর স্থান হইবে না কোনোমতেই—এ অবস্থানে তিনি অনড়। যেন পাশ ও অঙ্কুশে রক্ষা করিতেছেন বিধি–ব্যবস্থাকে। পাশাপাশি তাঁহার করুণার্দ্র মাতৃহৃদয়ে উৎসারিত ‘মরণ-হরণ বাণী’—“মা কখনও [ছেলেকে] ভুলতে পারে? জেনো, আমি সবসময় তোমার কাছে আছি। কোন ভয় নেই।” সন্তান অনিশ্চিত পথে নামিলে অশ্রুসিক্তা জননী জানালায় দাঁড়াইয়া যতক্ষণ দেখা যায় চাহিয়া রহিলেন। সুদূরপ্রসারী যে- দৃষ্টি—তাহাতে আকস্মিক স্খলনের পঙ্কিলতার মাঝেই ভাবী কল্যাণের বীজ নিহিত। একবার কলকাতার বাগবাজারে শ্রীশ্রীমায়ের বাড়িতে কী এক কারণে যোগীন-মা জনৈক ব্রহ্মচারীর উপর অসন্তুষ্টা হইয়া তাহাকে বিতাড়নের জন্য মায়ের কাছে জিদ ধরিয়াছিলেন। করুণাময়ী শ্রীশ্রীমা মৃদু অথচ সুকঠিন দৃঢ়স্বরে বলিয়াছিলেন : “কেন মা যোগীন! ও কথা কি বলতে আছে মা? অলুক্ষণে কথা। অবুঝ হয়োনি, মা। ঠাণ্ডা হও, ঠাকুরের পেসাদী মিছরীর পানা খাও। ভুলে যাও ওর কথা। ও যা অন্যায় করেছে, আর করবে নি। আমি তার জামিন। তাড়ানোর কথা কি তোলে? ও ঘরবাড়ি ছেড়ে, আত্মীয় স্বজন ছেড়ে, ঠাকুরের কাছে আমার কাছে এসেছে; ওকে তো তাড়াতে আমি কোনকালে পারবোনি মা।”দৃষ্টি—তাহাতে আকস্মিক স্খলনের পঙ্কিলতার মাঝেই ভাবী কল্যাণের বীজ নিহিত। একবার কলকাতার বাগবাজারে শ্রীশ্রীমায়ের বাড়িতে কী এক কারণে যোগীন-মা জনৈক ব্রহ্মচারীর উপর অসন্তুষ্টা হইয়া তাহাকে বিতাড়নের জন্য মায়ের কাছে জিদ ধরিয়াছিলেন। করুণাময়ী শ্রীশ্রীমা মৃদু অথচ সুকঠিন দৃঢ়স্বরে বলিয়াছিলেন : “কেন মা যোগীন! ও কথা কি বলতে আছে মা? অলুক্ষণে কথা। অবুঝ হয়োনি, মা। ঠাণ্ডা হও, ঠাকুরের পেসাদী মিছরীর পানা খাও। ভুলে যাও ওর কথা। ও যা অন্যায় করেছে, আর করবে নি। আমি তার জামিন। তাড়ানোর কথা কি তোলে? ও ঘরবাড়ি ছেড়ে, আত্মীয় স্বজন ছেড়ে, ঠাকুরের কাছে আমার কাছে এসেছে; ওকে তো তাড়াতে আমি কোনকালে পারবোনি মা।”
শ্রীশ্রীমা পশু–পক্ষী, কীট–পতঙ্গেরও মা—বিশ্বজননী। স্বামী অরূপানন্দকে বলেন—তিনি ইতর জীবজন্তুরও মা। মায়ের এই জীবকুলের প্রতিও ছিল স্নেহ–শাসনের যৌথ প্রকাশ। তাঁহার বিশেষ স্নেহের পাত্রী রাধুর একটি পোষা বেড়াল ছিল। মা একদিন বলিতেছেন : “বেড়ালটাকে আমি লাঠি দিয়ে মারছি, তবু ভয় করছে না।” সাধারণ দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা, কিন্তু বলিতে বলিতে তাঁহার মুখে এক বেদনার ভাব ফুটিয়া উঠিল! একদিন রাত্রে জয়রামবাটীতে আহারের সময় একটি জোনাকি পোকা প্রদীপের চারদিকে ঘুরিয়া বেড়াইতেছিল। একটি ভক্ত সেটিকে ধরিয়া বাইরে ছাড়িয়া দিলে মা বিরক্ত হইয়া বলিলেন : “ওকে অত দয়া করতে হয় না। ওটা মেরে ফেল, এখনি প্রদীপে পড়লে খারাপ হবে।” বস্তুত, এই অধ্যাত্ম ও আধিভূত সচেতন মাতৃমূর্তি সেই সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশিনী রূপেরই এক সার্বিক মঙ্গলময় প্রকাশ।
নারায়ণীস্তুতিতে ‘সর্বমঙ্গলমঙ্গল্যে…’ অংশটি ছাড়াও রহিয়াছে—“রোগান্ অশেষান্ অপহংসি তুষ্টা।/ রুষ্টা তু কামান্ সকলান্ অভিষ্টান্।” অর্থাৎ মা, তুমি তুষ্ট হইয়া অশেষ রোগ দূর কর, আবার রুষ্ট হইয়া সকল অভীষ্টকে বিনাশ কর। শ্রীশ্রীমা শেষবার জয়রামবাটীতে রহিয়াছেন। এমন সময় অপ্রকৃতস্থা রোগগ্রস্তা পাগলী মামি অযথা ঝগড়া, গালাগালি ও দোষারোপ করিতেছেন তাঁহাকে। উগ্রতা চরম সীমায় পৌঁছিল। শ্রীশ্রীমাকে মারিতে সে এক জ্বালানি কাঠ লইয়া আসিল। বরদা মহারাজ শ্রীশ্রীমায়ের চিৎকারে ছুটিয়া আসিয়া দেখিলেন—কাঠখানি প্রায় মায়ের মাথায় পড়িতে চলিয়াছে! তাঁহার তৎপরতায় মামিকে নিরস্ত করা যাইলেও শ্রীশ্রীমা উত্তেজনার মুখে যেন অন্য মানুষ হইয়া অকস্মাৎ বলিয়া ফেলিলেন : “পাগলী, কি করতে বসেছিলি? ঐ হাত তোর খসে পড়বে।” পরক্ষণেই তিনি জিব কাটিয়া শিউরিয়া উঠিলেন এবং ঠাকুরের দিকে চাহিয়া জোড়হস্তে বলিলেন : “ঠাকুর, একি করলুম? এখন উপায় কি হবে?” ইত্যাদি। তাঁহার করুণামূর্তি দেখিয়া বরদা মহারাজ স্তম্ভিত। কেননা শ্রীশ্রীমায়ের চোখে তখন জল ঝরিতেছে! আসলে ইহা বিনাশ নহে, রক্ষা। ধুলাকাদা-মাখা সন্তানকে কোলে তুলিয়া লইবার এক পথ।
অসাধারণ জীবনের অধিকারিণী হইয়াও আমাদের মা সাধারণের একজন হইয়াই রহিয়াছেন। নিজের স্বরূপ বা মহিমাকে সর্বদাই প্রচ্ছন্ন রাখিবার চেষ্টা করিয়াছেন। কিন্তু চকিতে তাহা ধরা পড়িয়াছে কলেজে পড়া কলকাতার জনৈক ভক্তযুবকের নিকট। সে অসুস্থ অবস্থাতেও মাস্টার মহাশয়ের নিকট বিধিবৎ চণ্ডীপাঠ শিখিয়াছিল। শ্রীশ্রীমা বাগবাজারে গঙ্গার ঘাটের সর্বনিম্ন সোপানে বসিয়া জপ করিতেছিলেন। সেই যুবক সেখানে দাঁড়াইয়া গভীর ঐকান্তিকতা-সহ গুনগুন সুরে যখন পাঠ করিতেছে—‘সৌম্যাসৌম্যতরাশেষসৌমেভ্যস্ত্বতিসুন্দরী’, তখন সেই লজ্জাপটাবৃতা শ্রীশ্রীমা অকস্মাৎ এক ঝলক ফিরিয়া দুইহাত তুলিয়া সন্তানকে আশীর্বাদ করিয়াছিলেন। এমন ঘটনা আরো কয়েকবার ঘটিয়াছে।
এই জগতে দ্বিবিধ মূর্তিতে তাঁহার প্রকাশ দেখিতে পাওয়া যায়—সৌম্যা ও ঘোরা। মা! তুমিই বিবিধ সুখরূপে উপস্থিত হও, ইহা যেন আমাদের স্মরণে থাকে। আবার যখন রোগ-শোক-লাঞ্ছনায় উৎপীড়িত হইতে থাকি, তখন যেন বুঝিতে পারি—মা, তুমিই ঘোরা মূর্তিতে উপস্থিত হইয়াছ, কল্যাণের নিমিত্ত। আমরা মাতৃহারা—কোনো অবস্থাতেই, এপ্রকার বোধ যেন আমাদের না আসে। কোনো অবস্থাতেই, হে পরমা দেবী, তোমার শুভদৃষ্টি হইতে আমাদের যেন সরাইয়া রাখিও না। অম্বাস্তোত্রে আচার্য বিবেকানন্দের প্রার্থনা—‘মুঞ্চন্তু মাং ন পরমে শুভদৃষ্টয়স্তে।’—এ প্রার্থনা আমাদের সকলেরই! তাই আমরা চাহিয়া থাকি মায়ের মুখপানে। রূপ–লীলা ও তত্ত্ব একত্রে দানা বাঁধে সে-চাহনিতে। দেখি, মা ‘ভীষণা-মধুরা’ ‘বরদা আবার প্রশমনকারী’ এবং একাধারে ‘চিত্তে কৃপা’ ও ‘সমরনিষ্ঠুরতা’য় চাহিয়া আছেন। মেঘমুক্ত সে-দৃষ্টিপাতেই রহিয়াছে রোদ–বৃষ্টির মায়াখেলার নেপথ্য পট—উন্মুক্ত শরৎ–আকাশের আলোকছটা! মনের আকাশ এই শারদীয়ায় তাই হইয়া উঠুক মাতৃ–অভিষিক্ত। মাতৃ-নামে মাতৃ-গানে তাঁহার অগণিত সন্তান হইবে ধন্য, কৃতার্থ, কৃতকৃত্য।
শারদ শুভেচ্ছা
আমাদের মনপ্রাণ আনন্দে আচ্ছন্ন করিয়া করুণাপাথার, শরণাগতবৎসল জগজ্জননী শ্রীশ্রীদুর্গা আসিয়াছেন। দেবী তিনি, তিনি জ্ঞানময়ী, জ্ঞানদাত্রী, তিনি মাতা। দয়া, ক্ষমা ও করুণাঘন এই জননীকে প্রাণ ভরিয়া ডাকিলে, তাঁহার দিকে প্রেমভরে দৃষ্টি রাখিলে অন্তর খুলিয়া যায়। তিনি প্রকাশিতা হন। মাতৃ-আরাধনার এই শুভক্ষণের সদুপযোগ বড় জরুরি। শারদোৎসবের পুণ্যলগ্নে প্রার্থনা করি, যেন তাঁহার প্রসারিত স্নেহ-হস্তের স্পর্শটুকু সদাসর্বদা জীবনপথে অনুভব করিতে পারি। এই শুভলগ্নে ‘উদ্বোধন’-এর সকল লেখক, পাঠক, ভক্ত, স্বেচ্ছাসেবক, বিজ্ঞাপনদাতা ও কর্মীকে আমাদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা, ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করিতেছি।—সম্পাদক