[পূর্বানুবৃত্তি : চৈত্র সংখ্যার পর]

।।৩।।

কঠোর পরিশ্রমের ফলে অত্যন্ত ভগ্নস্বাস্থ্য হওয়া সত্ত্বেও স্বামীজী পূর্ণ উদ্যমে গুরুভাইদের সাহায্যে মঠের জন্য উপযুক্ত জমির সন্ধান করতে থাকেন। ২৬ মার্চ মিসেস বুলকে তিনি লিখলেন : “আমি শুধু আমার মঠটি চালু করতে দৃঢ়সংকল্প এবং সে কাজ সারা হওয়া মাত্র আমি আবার আসব।” ইতিমধ্যে জমির দাম অনেক বেড়ে গিয়েছিল, আবার তখনো গঙ্গার ধারে বড় জমি কেনার মতো পর্যাপ্ত অর্থও হাতে আসেনি। তাই দ্রুত মঠস্থাপনের অসফলতার দুঃখ তিনি শ্রীশ্রীমায়ের কাছে নিবেদন করেছিলেন। শ্রীশ্রীমা আশ্বাস দিয়েছিলেন : “চিন্তা করো না। তুমি যা করেছ, আর যা করবে সবই চিরকালের জিনিস। এই কাজের জন্যই তুমি এসেছ, হাজার হাজার মানুষ তোমাকে পৃথিবীর সেরা আচার্য বলে গ্রহণ করবে। স্থির জেন, ঠাকুর শীঘ্রই তোমার ইচ্ছা পূরণ করবেন। দেখবে অল্পদিনের মধ্যে তোমার ভাব কার্যকরী হচ্ছে।”৩২ ঘটনাটি ঘটেছিল বিদেশ থেকে ফেরার পর শ্রীশ্রীমায়ের সঙ্গে তাঁর প্রথম সাক্ষাতের দিন—২৩ মার্চ ১৮৯৭। আবার শ্রীশ্রীমায়ের মুখে এই সংক্রান্ত আরেকটি ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি বলেছেন : “একদিন নরেন এসে বললে, ‘মা, এই ১০৮ বিল্বপত্র ঠাকুরকে আহুতি দিয়ে এলুম, যাতে মঠের জমি হয়। তা কর্ম কখনো বিফলে যাবে না। ও হবেই একদিন।’”৩৩

স্বামী যোগানন্দজীকে সঙ্গে নিয়ে ১৮৯৭ সালের ৬ মে স্বামীজী উত্তর-পশ্চিম ভারতের উদ্দেশে রওনা দেন। ২০ মে আলমোড়া থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে তিনি লিখলেন : “টাকাকড়ি এখনও যেন জলে ভাসছে… যোগাড় নিশ্চিত হবে। হল, বিল্ডিং, জমি ও ফণ্ড—সব ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু না আঁচালে তো বিশ্বাস নেই।… একবার tour (ভ্রমণ) করে টাকা যোগাড় করব নিশ্চিত। এ বিধায় যদি তুমি বোধ কর যে, ঐ আট কাঠা frontage (সামনে খোলা জমি) না হয়…, তাহলে… দালালের বায়না জলে ফেলার মত দিলে ক্ষতি নাই। এসব বিষয় নিজে বুদ্ধি করে করবে, আমি অধিক আর কি লিখব? তাড়াতাড়িতে ভুল হওয়ার বিশেষ সম্ভব।”

বেশ কয়েকজন পশ্চিমি ভক্ত ভারতবর্ষে কাজের জন্য স্বামীজীকে অর্থদানে সম্মত হয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে আমেরিকার মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড, মিসেস সারা বুল (বিখ্যাত বেহালাবাদক ওলি বুলের স্ত্রী) ও ইউরোপের মিস হেনরিয়েটা মূলার ছিলেন প্রধান। অক্টোবরের মধ্যেই মিসেস বুল তাঁর প্রতিশ্রুত অর্থ পাঠিয়ে দিয়েছিলেন।৩৪ আর নভেম্বরে মিস মূলারের অর্থের কিছুটা চলে এসেছিল। বাকিটা শীঘ্রই আসার সম্ভাবনা ছিল।৩৫ এই ভ্রমণকালে তিনি মঠের জন্য অর্থসংগ্রহের ওপরে জোর দেন। ১০ অক্টোবর মরী (বর্তমানে পাকিস্তানে) থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে লিখলেন : “আমি এখান হইতেই মঠের জন্য collection (অর্থসংগ্রহ) আরম্ভ করিলাম। যেখান হতে তোমার নামে টাকা আসুক না, তুমি মঠের ফণ্ডে জমা করিবে ও দুরস্ত হিসাব রাখিবে। দুটো ফণ্ড আলাদা—একটা কলকাতার মঠের জন্য, আর একটা famine work etc. (দুর্ভি‌ক্ষে সেবাকার্য ইত্যাদি)।” পরের দিন তিনি জগমোহনলালকেও এই বিষয়ে লিখলেন  : “এখন চুপচাপ ঘুরে বেড়াচ্ছি। এই বছর বেশি বক্তৃতাও করব না। এই সমস্ত হট্টগোলে আমার আর কোনো আস্থা নেই, এতে কার্যক্ষেত্রে কোনো কল্যাণই সাধিত হয় না। কলকাতায় আমার প্রতিষ্ঠানটি গড়ে তোলার জন্য আমাকে নীরবে চেষ্টা করতে হবে; আমি তাই অর্থসংগ্রহের জন্য বিভিন্ন কেন্দ্রে চুপচাপ ঘুরে বেড়াচ্ছি।”

স্বামীজীর বিদেশ থেকে ফেরার পরে মঠের জন্য ভারতবর্ষের মানুষদের কাছ থেকে অর্থ পাওয়ার সম্ভাবনা আরো ক্ষীণ হয়ে গিয়েছিল। তবে রাজস্থানের ভক্ত-অনুরাগীদের ওপর তাঁর বিশেষ আস্থা ছিল। লাহোর থেকে ইন্দুমতী মিত্রকে লিখলেন : “আমার উদ্দেশ্য যে, কলিকাতায় একটি মঠ হয়—তাহার কিছুই করিতে পারিলাম না। কলিকাতায় এক মঠ হইলে আমি নিশ্চিন্ত হই। এত যে সারা জীবন দুঃখে-কষ্টে কাজ করিলাম, সেটা আমার শরীর যাওয়ার পর নির্বাণ যে হইবে না, সে ভরসা হয়।”৩৬ ভক্তদের প্রেরিত অর্থের ঠিক ঠিক হিসাব রাখা এবং দাতাদের কাছে প্রাপ্তিস্বীকার প্রভৃতি কাজ নিখুঁতভাবে করার জন্য তিনি স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে নির্দেশ দিলেন।৩৭ কাজের দ্রুত অগ্রগতির জন্য তাঁকে টাকা তোলার ব্যাপারে power of attorneyও দিলেন। আবার যেকোনো সংকটময় পরিস্থিতিতে কাজ যাতে থেমে না যায়, সেজন্য স্বামীজী এই সময় তাঁকে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য লিখলেন : “পত্রপাঠ উকিলের পরামর্শ নিয়ে এই মর্মে উইল রেজিস্ট্রী করে নিয়ে এস যে, in case (যদি) আমি তুমি মরে যাই তো হরি এবং শরৎ আমাদের মঠের যা কিছু আছে, সব পাবে।”৩৮ এর পরে ১১ ও ৩০ নভেম্বরের পত্রেও তিনি স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে এই উইল করার জন্য তাগাদা দিয়েছেন।৩৯ তাঁর কলকাতায় ফেরার আগেই স্বামী ব্রহ্মানন্দজী উইল তৈরি করে ফেলেন। উইলের বাংলা প্রতিলিপি হলো এইরকম—

“লিখিতং স্বামী ব্রহ্মানন্দ—দক্ষিণেশ্বর নিবাসী পরমহংস রামকৃষ্ণদেবের শিষ্য, সন্ন্যাসী, সাকিম আলমবাজার মঠ, আলমবাজার, জেলা চব্বিশ পরগণা কস্য চরমপত্রমিদং—আমি এতদ্দ্বারা নির্দেশ করিতেছি যে, আমার ত্যক্ত আমার স্বনামী বা বেনামী নগদ অর্থ, গভর্নমেন্ট সিকিউরিটি এবং অন্যান্য স্থাবর অস্থাবর সম্পত্তি আমার অভাবে উক্ত রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের শিষ্য উক্ত আলমবাজার মঠ-নিবাসী তুরীয়ানন্দ স্বামী ও সারদানন্দ স্বামী সন্ন্যাসীদ্বয় পাইবেন এবং তাঁহাদের সম্পূর্ণ আয়ত্তে ও অধীনে থাকিবে এবং আমি তাঁহাদিগকে এই উইলের একজিকিউটর নিযুক্ত করিলাম এতদর্থে স্বেচ্ছায় এই শেষ উইল বা চরম সম্পাদন করিলাম।

ইতি ১৮৯৮ খৃঃ ১৯শে জানুয়ারী
(স্বাক্ষর) স্বামী ব্রহ্মানন্দ”

বেলুড় মঠে স্বামীজীর বাড়ির একটি প্রাচীন চিত্র

এই উইলের সাক্ষী ছিলেন সলিসিটার প্রমথনাথ কর (শ্রীরামকৃষ্ণের ভক্ত পল্টু) এবং ডাক্তার বিপিনবিহারী ঘোষ।৪০

আলমবাজার মঠে পায়রার খোপের মতো ছোট ছোট ঘর স্বামীজীর পছন্দের ছিল না।৪১ এখানকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ সম্পর্কে স্বামী ব্রহ্মানন্দজী এক পত্রে জানাচ্ছেন : “মঠে প্রায় উপস্থিত যাহারা আছে তাহাদের শরীর তত ভাল নহে। এস্থানের climate বড় সুবিধা নয়। একটা গঙ্গাতীরে স্থান না হইলে সুবিধা হইতেছে না। জানি না শ্রীশ্রীগুরুদেব কবে আমাদের বাসনা পূর্ণ করিবেন।”৪২ ১৮৯৭ সালের ১২ জুন এক ভয়ানক ভূমিকম্পে এই মঠবাড়ি বিশেষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং তা বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে পড়ে।৪৩ এর ফলে নতুন জায়গায় মঠ স্থানান্তরের প্রয়োজনীয়তা আরো বৃদ্ধি পায়।

স্বামীজীর প্রবল আগ্রহ ছিল শ্রীশ্রীঠাকুরের পুণ্যস্মৃতি-বিজড়িত কাশীপুরের বাগানবাড়িতে মঠস্থাপনে। তাই স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে আলমোড়া থেকে ১৩ জুলাইয়ের (১৯৯৭) চিঠিতে লিখছেন : “মঠের নাম কি হইবে একটা স্থির তোমরাই কর।… টাকা সাত সপ্তাহের মধ্যে পৌঁছিবে; জমির তো কোন খবর নাই। এ বিষয়ে কাশীপুরের কেষ্টগোপালের বাগানটা নিলে ভাল হয় না? পরে বড় কার্য ক্রমে হবে। যদি মত হয়, এ বিষয় কাহাকেও—মঠস্থ বা বাহিরের—না বলিয়া চুপি চুপি অনুসন্ধান করিও। দুই-কান হইলেই কাজ খারাপ হয়। যদি ১৫/১৬ হাজারের ভিতর হয় তো তৎক্ষণাৎ কিনিবে (যদি ভাল বোঝ)। যদি কিছু বেশী হয় তো বায়না করিয়া ঐ সাত সপ্তাহ অপেক্ষা করিও। আমার মতে আপাততঃ ওটা লওয়াই ভাল। বাকী ধীরে ধীরে হবে। ও বাগানের সহিত আমাদের সমস্ত association (স্মৃতি জড়িত)। বাস্তবিক এটাই আমাদের প্রথম মঠ। অতি গোপনে।…

“কাশীপুরের বাগানের অবশ্য জমির দাম বেড়ে গেছে; কিন্তু কড়ি তেমনি কমে গেছে। যা হয় একটা ক’রো ও শীঘ্র ক’রো। গয়ং গচ্ছ করতে করতে যত কাজ মাটি হয়। ওটাও তো নিতেই হবে, আজ না হয় কাল—আর যত বড়ই গঙ্গাতীরে মঠ হউক না। অন্য লোক দিয়ে কথা পাড়লে আরও ভাল হয়। আমাদের কেনা টের পেলে লম্বা দর হাঁকবে।”৪৪

মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড

আরো কিছু জমির সন্ধান

অন্য কয়েকটি জায়গায় জমি-বাড়ির সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। বিভিন্ন কারণে সেগুলি বাতিল হয়। যেমন স্বামী যোগানন্দজী বাগবাজারে হরিবল্লভ ঘোষের বাড়ি কেনার জন্য স্বামীজীকে জানিয়েছিলেন। সেবিষয়ে স্বামীজী স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে অমৃতসর থেকে ২ সেপ্টেম্বর (১৮৯৭) জানালেন : “যোগেন এক পত্রে লিখিতেছে যে, বাগবাজারের… হরিবল্লভবাবুর বাটী ২০,০০০ টাকায় বিক্রি (হচ্ছে) এবং যোগেন কিনিতে বলেন। ঐ বাড়ি কিনিলে ঢের হাঙ্গামা আছে; যথা, ভেঙেচুরে বৈঠকখানাটিকে একটি হল করা এবং অন্যান্য বন্দোবস্ত করা। আবার ঐ বাটী অতি প্রাচীন ও জীর্ণ। যাহা হউক গিরিশবাবু ও অতুলের সঙ্গে পরামর্শ করিয়া যাহা ভাল হয় করিবে।”৪৫ আলমবাজার মঠ থেকে সাধু-ব্রহ্মচারিগণ ঐদিনই কোন্নগরে জমি দেখতে যান।৪৬ শ্রীনগর থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর স্বামীজী স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে লিখছেন : “গোপাল-দাদার এক পত্রে অবগত হইলাম যে, তোমরা কোন্নগরে জমি দেখিয়া আসিয়াছ। জমি নাকি ষোল বিঘা নিষ্কর এবং দাম আট-দশ হাজারের কম। স্বাস্থ্য ইত্যাদি সকল বিবেচনা করিয়া যেমন ভাল হয় করিবে।”

স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজীকে লেখা স্বামী প্রেমানন্দজীর পত্র থেকে জানা যায়, কামারহাটির এক বাগান দূর বলে অনেকে আপত্তি করেন।৪৭ এমনকী দক্ষিণেশ্বরেও কোনো এক জমির বিষয়ে কথা শুরু হয়েছিল, কিন্তু মালিক ত্রৈলোক্যবাবুর শর্তের সঙ্গে একমত না হওয়াতে সেটাও আর এগয়নি।৪৮
পানিহাটির গোবিন্দকুমার চৌধুরীর বাগানটিও একসময় মঠের জন্য ভাড়া করার প্রস্তাব হয়েছিল। পরবর্তিকালে বাগানটি দেখে স্বামীজী বলেছিলেন : “বাগানটি বেশ, কিন্তু কলকাতা থেকে অনেক দূর, ঠাকুরের শিষ্য (ভক্ত)-দের যেতে আসতে কষ্ট হত; এখানে মঠ যে হয়নি, তা ভালোই হয়েছে।”৪৯
শোনা যায়, কাশীপুরে ১৫ নং রতনবাবু রোডে ভূকৈলাসের রাজাদের বাড়ি-সংলগ্ন জমিটিও লিজ নেওয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।৫০

মিসেস সারা বুল

বেলুড়ে জমির সন্ধান ও ক্রয়

ইতিমধ্যে ১৮৯৭ সালের জুলাই মাসের মধ্যেই প্রথম বেলুড়ের জমির সন্ধান পেয়েছিলেন স্বামী বিজ্ঞানানন্দজী ও স্বামী নিরঞ্জনানন্দজী। একদিন তাঁরা যখন নৌকায় করে গঙ্গার পশ্চিম কূল বেয়ে দক্ষিণদিকে যাচ্ছিলেন তখন বর্তমান বেলুড় মঠের জমিটি তাঁদের নজরে আসে।৫১ উঁচু-নিচু সামান্য কয়েকখানা একতলা ঘর ও একখানা বারান্দা দেখে তাঁরা জমিতে উঠলেন। দেখলেন জঙ্গলপূর্ণ জমিটিতে একটা খালের মতো খানিকটা রয়েছে, তাতে নৌকা ও গাধাবোট মেরামত হয়। খুঁজে দেখলেন জন-মানব নেই। পাশেই বড় বড় কাঠের আড়ত। সেখানে জায়গাটির সন্ধান করায় একজন জায়গাটির মালিকের নাম-ঠিকানা বলে দিল, আর বলল—চেষ্টা করলে পাওয়ার আশা আছে।৫২ জমির মালিক ভাগবত নারায়ণ সিং (পিতা—রামপ্রসাদ সিং)। তিনি পাটনা শহরের খাজকাল্লা থানার অন্তর্গত বাকসি মহল্লার বাসিন্দা। কিন্তু সেসময় স্বামীজী শ্রীরামকৃষ্ণের স্মৃতিবিজড়িত কাশীপুর উদ্যানবাটীটি কেনার জন্য অধিক আগ্রহী ছিলেন। তাই বেলুড়ের জমি ছেড়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।৫৩ আবার শোনা যায়, মিস মূলারের এই জমি কেনার ব্যাপারে আপত্তি ছিল—যেহেতু এই জমিটি খুবই অসমতল, খানাখন্দে ভরা।৫৪

এদিকে শ্রীরাম-কৃষ্ণের জন্মোৎসবের সময় এগিয়ে আসছে। এতকাল দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়িতে এই উৎসব হতো। কিন্তু ১৮৯৭ সালের উৎসবের পর থেকে মন্দির-কর্তৃপক্ষ স্বামী বিবেকানন্দের কালীমন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ করে।৫৫ তাই যত শীঘ্র সম্ভব নতুন জমি কিনে সেখানে শ্রীশ্রীঠাকুরের জন্ম-মহোৎসব করার জন্য স্বামীজী খুব ব্যগ্র হয়ে পড়েছিলেন। এই অল্প সময়ের মধ্যে কাশীপুর উদ্যানবাটীর ক্রয় ও মঠস্থাপন সম্ভব নয় বুঝে কিংবা অন্য কোনো কারণে স্বামীজী বেলুড়ের জমিটি কিনতেই মনস্থ করেন। ১৫ নভেম্বর (১৮৯৭) স্বামীজী লাহোর থেকে স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে লিখলেন : “সেই বড় জায়গাটার উপর চুপিসাড়ে চোখ রাখো। এবার মহোৎসব যাতে সেথায় হয়, তার বিধিমত চেষ্টা করা যাচ্ছে।” পুনরায় দিল্লি থেকে ৩০ নভেম্বরের চিঠিতে স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে বেলুড়ের জমি কেনার ব্যাপারে স্পষ্ট নির্দেশ দিলেন : “মিসেস মূলার যে টাকা দেবেন বলিয়াছিলেন, তাহার কতক কলিকাতায় হাজির। বাকি পরে আসিবে শীঘ্রই। আমাদেরও কিছু আছে। মিসেস মূলার তোমার ও আমার নামে গ্রিণ্ড্‌লে কোম্পানির ওখানে টাকা রাখবেন। তাতে তোমার power of attorney (ক্ষমতাপত্র) থাকার দরুন তুমি একাই সমস্ত draw করতে (তুলতে) পারবে। ঐটি যেমন রাখা, অমনি তুমি নিজে ও হরি পাটনায় সেই লোকটিকে ধর গিয়া—যেমন ক’রে পারো influence কর (রাজী করাও); আর জমিটি যদি ন্যায্য দাম হয় তো কিনে লও। নইলে অন্য জায়গার চেষ্টা দেখ। আমি এদিকেও টাকার যোগাড় দেখছি। নিজের জমিতে মহোৎসব ক’রে তবে কাজ—তাতে বুড়োই মরে আর চেকড়াই ছেঁড়ে। এটি তোমার মনে থাকে যেন।”

স্বামীজীর বারংবার তাগাদাতে৫৬ ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই বেলুড়ের জমির বায়না দেওয়ার কথা শুরু হয়ে যায়।৫৭ শ্রীশ্রীঠাকুরের যুবক ভক্ত হরিপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায় আলমবাজার মঠে যোগদান করেছিলেন ১৮৯৬ সালে। তিনি পেশায় ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। স্বামীজীর রাজপুতানাদি স্থানে ভ্রমণের সময় তিনি কিছুদিন তাঁর সঙ্গে ছিলেন। এই সময় তাঁর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে স্বামী প্রেমানন্দজী লিখলেন : “প্রিয়তম ভাই হরিপ্রসন্নবাবু,… আজ (স্বামীজীর) চিঠি আসিল। তিনি এখনও জয়পুরে আছেন। মঠের জায়গার বায়না হইবে হইবে হইয়াছে। ওপারের সেই জমি। আপনি এ সময়ে থাকিলে মাপ প্রভৃতি অনেক কার্যে আসিবেন। এইজন্য অন্যকে তোষামোদ করিতে হইতেছে। আমাদের ইচ্ছা আপনি শীঘ্রই এখানে আইসেন।”৫৮

স্বামীজী উত্তর ও পশ্চিম ভারত ভ্রমণ করে জব্বলপুর হয়ে কলকাতায় ফিরলেন ১৮৯৮ সালের ২১ জানুয়ারি সন্ধ্যায়।৫৯ বহুক্ষেত্রে স্বামীজী স্বামী যোগানন্দজীর বিচারবুদ্ধিতে সম্পূর্ণ নির্ভর করতেন। ফিরেই তিনি নিজে জমি দেখতে না এসে পাঠালেন স্বামী যোগানন্দজীকে। স্বামী যোগানন্দজীর সঙ্গে আরো কয়েকজন ভক্ত নৌকাযোগে সেখানে যান এবং জমি দেখে সকলেই খুব তুষ্ট হয়ে নানা কথা বলতে থাকেন। জনৈক ভক্ত বলেন : “দুটি পুকুর আছে, এতে যে পদ্ম জন্মাবে তাতে ঠাকুরের পূজা হবে।” স্বামী যোগানন্দজী কোনো কথায় যোগ না দিয়ে ঘুরে ঘুরে জমি দেখতে থাকেন। তখন তাঁর মুখে একটা সন্তোষ ও দিব্যভাবের স্ফূর্তি ল‌ক্ষ্য করা গিয়েছিল। ভূমি সম্বন্ধে জিজ্ঞাসিত হলে তিনি বলেছিলেন : “সুন্দর জমি।” আলমবাজার মঠে ফিরে তিনি স্বামীজীকে বললেন : “ফলাও জমি, সুন্দর; তুমি একবার দেখে এস।” কিন্তু স্বামীজী তাঁর কথায় বিশ্বাস করে আর জমি দেখতে না গিয়েই তা কেনার সিদ্ধান্ত পাকা করেন।৬০ জমির দলিল থেকে জানা যায়, ১৮৯৮ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি ১০০১ টাকা দিয়ে জমিটি কেনার চুক্তি হয়।

স্বামী নিরঞ্জনানন্দ

এই বিষয়ে স্বামী ব্রহ্মানন্দজী ৫ ফেব্রুয়ারি স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজীকে লিখলেন : “আমাদের মঠনির্মাণের উদ্দেশ্যে নদীতীরস্থ বেলুড় গ্রামে ৪০,০০০্‌ (চল্লিশ হাজার) টাকায় ২০ (কুড়ি) বিঘা জমি ক্রয় করিবার চুক্তি হইয়াছে। যদি সেই জমিসংক্রান্ত দলিলপত্র এটর্নি ও অন্যান্য আইন ব্যবসায়ীগণ অনুমোদন করেন তবে উহা একমাসের মধ্যেই ক্রয় করা হইবে। একথা তুমি গোপন রাখিও এবং যে পর্যন্ত আমরা ক্রয় না করি সে পর্যন্ত উহা প্রকাশ করিও না।” [ক্রমশ]

তথ্যসূত্র

৩২ শতরূপে সারদা, পৃঃ ৭৬১
৩৩ শ্রীশ্রীমায়ের কথা, পৃঃ ১৯০
৩৪ পত্রাবলী, পৃঃ ৬০৬। স্বামীজী লিখেছেন : “মিসেস বুল বেশী টাকা দিয়েছেন।”
৩৫ দ্রঃ ঐ, পৃঃ ৬১৪-১৫
৩৬ ঐ, পৃঃ ৬১১-১২
৩৭ দ্রঃ ঐ, পৃঃ ৬০৯
৩৮ ঐ
৩৯ তবে এই ব্যবস্থা বাস্তবায়িত করার প্রয়োজন হয়নি। (দ্রঃ স্বামী প্রভানন্দ, ব্রহ্মানন্দচরিত, পৃঃ ১২৮)
৪০ সরকার, সরলাবালা, স্বামী বিবেকানন্দ ও শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ সংঘ, বেঙ্গল পাবলিশার্স, কলিকাতা, ১৩৬৩, পৃঃ ১১১
৪১ দ্রঃ স্বামী চেতনানন্দ (সংকলক ও সম্পাদক), স্বামী শিবানন্দকে যেরূপ দেখিয়াছি, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৬, পৃঃ ২১০
৪২ স্বামী ব্রহ্মানন্দের পত্রসম্ভার, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৪, পৃঃ ৬৬
৪৩ ১৫ জুন ১৮৯৭ স্বামী অখণ্ডানন্দজীকে স্বামী তুরীয়ানন্দজীকে এক পত্রে লেখেন : “এখানেও গত শনিবার ঠিক পাঁচটার পর অতি ভয়ঙ্কর ভূমিকম্প হইয়া গিয়াছে। আমাদের সম্মুখের বাটীর বহির্দেশের উপরিভাগ একেবারে ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে।” স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর ১৪ জুন ১৮৯৭ তারিখের পত্রেও শীঘ্রই মঠবাড়ি ছাড়ার প্রয়োজনীয়তার উল্লেখ পাওয়া যায়।
৪৪ কাশীপুর উদ্যানবাটী রামকৃষ্ণ মঠের অধীনে আসে ২৭ এপ্রিল ১৯৪৬। (দ্রঃ ব্রহ্মানন্দচরিত, পৃঃ ১২০, পাদটীকা)
৪৫ স্বামী প্রভানন্দ, রামকৃষ্ণ মঠের আদিকথা, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০০১, পৃঃ ১৫৭
৪৬ দ্রঃ ঐ, পৃঃ ১৭০, আলমবাজার মঠের ডায়েরি
৪৭ দ্রঃ ঐ, পৃঃ ১৫৮
৪৮ স্বামী রামকৃষ্ণানন্দজীকে ৫ ফেব্রুয়ারি (১৮৯৮) স্বামী ব্রহ্মানন্দজী লেখেন : “আমরা দক্ষিণেশ্বরের জমিসংক্রান্ত ব্যাপারে ত্রৈলোক্যবাবুর সর্তের সঙ্গে একমত হইতে পারি নাই।” (স্বামী ব্রহ্মানন্দের পত্রসম্ভার, পৃঃ ৬৮)
৪৯ স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৫, ৯ম খণ্ড, পৃঃ ১০৬
৫০ দ্রঃ উদ্বোধন, ৭০তম বর্ষ, ১১শ সংখ্যা, অগ্রহায়ণ ১৩৭৫, পৃঃ ৬২৭
৫১ দ্রঃ ঐ, ৩৭তম বর্ষ, ৫ম সংখ্যা, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪২, পৃঃ ২৩৭। Prabuddha Bharat-এ পাই—উত্তরদিকে যাচ্ছিলেন। (দ্রঃ March 1981, vol. 86, p. 105)
৫২ দ্রঃ ঐ
৫৩ ১৩ জুলাই ১৮৯৭ স্বামীজী স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে লিখেছিলেন : “…কাশীপুরের বিশেষ চেষ্টা দেখ।… বেলুড়ে জমি ছেড়ে দাও।”
৫৪ “Miss Muller had objected to the Belur land as it was uneven and full of pits and ditches.” (Swami Someswarananda, ‘Early Days of Belur Math’, Prabuddha Bharat, March 1981, p. 105)
৫৫ দ্রঃ মুখোপাধ্যায়, অনুপম, পুরাতন বেলুড়, বালি ও কতিপয় সন্নিহিত অঞ্চল, বেলুড় সাধারণ গ্রন্থাগার, হাওড়া, ২০২২, পৃঃ ৮৭
৫৬ দ্রঃ ৮ ও ১৪ ডিসেম্বর ১৮৯৭, স্বামী ব্রহ্মানন্দজীকে লেখা পত্র
৫৭ দ্রঃ রামকৃষ্ণ মঠের আদিকথা, পৃঃ ১৬৯
৫৮ ঐ
৫৯ দ্রঃ A Chronology of Events in the Life of Swami Vivekananda 1897—1902, p. 65
৬০ দ্রঃ স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর ডায়েরি থেকে জানা যায়, স্বামী যোগানন্দজী নতুন মঠের জমিতে অনেকবার বিভিন্ন কাজকর্মে এবং একবার বনভোজন করতেও এসেছিলেন। (দ্রঃ ব্রহ্মানন্দচরিত, পৃঃ ১২৭) কিন্তু গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখানে নতুন বাড়িতে মঠ স্থানান্তরিত হওয়ার পরে তিনি আসতে পারেননি। ১৮৯৯ সালের ২৮ মার্চ তাঁর দেহত্যাগ হয়। এর মধ্যে একদিন নৌকা করে স্বামীজী এই মঠ তাঁকে দেখিয়েছিলেন। (দ্রঃ ভক্তমালিকা, পৃঃ ১২১—১২৩)