শিব ও দুর্গার মতো বাঙালি আর কোনো দেবদেবীকে এতখানি আপন করে নেয়নি। এই দম্পতিকে প্রায় সর্বত্র স্থাপন করেছে। মন্দির করতে না পারলে কোনো বেলগাছের তলায় জায়গা দিয়েছে। গাছের পাতা প্রাকৃতিক নিয়মে শিবলিঙ্গের ওপর ঝরে পড়েছে। কখনো আবার বেলফল নিজে থেকে পড়ে দেবতার অর্ঘ্য হয়ে উঠেছে। তারপর একসময়ে বেলতলা ও মন্দির থেকে পর্বতের দেবদম্পতি বাংলার ঘর-সংসারেও ঢুকে পড়েছে। বাঙালি ছেলেরা কেউ শিব, হর, মহাদেব, মহেশ্বর, শান্তিনাথ, ভোলানাথ, শম্ভুনাথ, বিশ্বনাথ, তারকনাথ আর মেয়েরা পার্বতী, গৌরী, উমা, চণ্ডী, অভয়া, দুর্গা প্রমুখ। বাঙালি মায়েদের জামাতার চেয়ে কন্যাটির প্রতি টান একটু বেশি। তাই মূল নামের সঙ্গে চরণ, পদ, প্রসাদ, প্রসন্ন ইত্যাদি যোগ করে দুর্গাপ্রসাদ, পার্বতীচরণ, গৌরীপ্রসন্ন ইত্যাদি পুংলিঙ্গ শব্দের নির্মাণ। এমনকী শিব বা বিশ্বনাথ বললে যা সরাসরি কৈলাসপতির কাছে পৌঁছে দেয়, তাকে বদল করে উমাপতি, গিরিজাপতি করেছে। যেন কৈলাসের নৃপতির চেয়ে উমার পতি হ‌ওয়া বাঙালি গৃহস্থের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ! নৃপতি শাসন করে, কিন্তু পতি পালন করে। ‘পালন’ শব্দের একটি অর্থ হলো ভরণ-পোষণ, আরেকটি অর্থ হচ্ছে মান্যকরণ বা নিষ্পাদন। দক্ষকন্যার আত্মাহুতিতে যে-শিব তাণ্ডব চালান তিনি পোষক, আর হিমাদ্রিদুহিতার ইচ্ছায় যে-শিব ত্রিশূলটিকে লাঙল করে কৃষিকর্ম করেন তিনি নিষ্পাদক।

হিমালয়কন্যা পার্বতী আর কৈলাসরাজ হরের বাঙালিকরণ কবে থেকে শুরু হলো তা আঁক কষে বলা কঠিন। বাঙালি সমাজ ও সংসারের হাজার-বারোশো বছরের ইতিহাসে তা কোথাও পুঙ্খানুপুঙ্খ নথিবদ্ধ নেই। তবে বাংলা কাব্যে সাতশো বছরেরও আগে শিব ও দুর্গার বাঙালিকরণ ঘটে যায়। মধ্যযুগের কবি মুকুন্দ চক্রবর্তীর জন্ম আনুমানিক ১৫২২ থেকে ১৫২৪ সালের মধ্যে আর চণ্ডীমঙ্গল কাব্যের রচনাকাল ১৫৪৯ থেকে ১৫৫৬ সাল। কাব্যটিতে একটি বন্দনা অংশ এবং তিনটি পৃথক কাহিনিখণ্ড আছে। কাহিনির প্রথমটি দেবখণ্ড—যেখানে মূল চরিত্রগুলি হলো সতী, গৌরী, মেনকা এবং শিব। দ্বিতীয়টি আখেটিক বা ব্যাধখণ্ড—যেখানে কালকেতু, ফুল্লরা এবং দেবী অভয়ার কাহিনি মেলে। বণিকখণ্ডে ধনপতি, লহনা, খুল্লনা এবং দেবী চণ্ডী মূল চরিত্র। এই যে কৈলাসবাসিনী দেবী, তাঁর দৈনন্দিন জীবনের এক চমৎকার ছবি মেলে চণ্ডীমঙ্গল কাব্যে। সেটি হলো—


“সুমেরু উপর আছে কুমুদ ভূধর
তাহার উপরে আছে বট তরুবর।
এগার যোজন সেই তরুবর বট
জার সুখে হর নাহী ছাড়েন নিকট।
তাহার কোঠরে আছে পাঁচখানি নদী
তথি বহে গুড় দুগ্ধ ঘৃত মধু দধি।
তাহে ঝালি খেলে চণ্ডী সহ সখীগণে
হেনকালে খুল্লনা পড়িআ গেল মনে।”১


ধর্ম, দর্শন ও সাহিত্যের অভিনব রসায়নে পঙ্‌ক্তিগুলি রচিত, কিন্তু সবচেয়ে চমকপ্রদ হচ্ছে ‘ঝালি’ শব্দটির ব্যবহার। এটি সংস্কৃত শব্দ নয়। ‘ঝালি’ একটি মুন্ডারি শব্দ, যার অর্থ হচ্ছে ঝুলি। চণ্ডী এখানে গাছের ডাল ধরে ঝুলির মতো নিচে ঝাঁপানোর খেলায় মেতেছেন। মুন্ডারি থেকে বাংলায় ঝাইল, ঝাল, ঝালি হয়েছে। কবিকঙ্কণ মুকুন্দের আদি নিবাস ছিল বর্তমান বর্ধমান জেলার রায়না থানার দামিন্যা গ্রামে। সেখানকার তালুকদার ও মুকুন্দের সুহৃদ গোপীনাথ নন্দী রাজরোষে পড়ে বন্দি হলে কবি মুকুন্দ নতুন জীবিকা ও বাসভূমের সন্ধানে দীর্ঘ পথ পাড়ি দেন। সঙ্গে ছিলেন স্ত্রী, পুত্র এবং ভ্রাতৃপ্রতিম একজন ব্যক্তি। শেষে বর্তমান মেদিনীপুর জেলার শালবনির কাছে আরড়া গ্রামে উপস্থিত হন এবং সেখানকার রাজা বাঁকুড়াদেবের পুত্র রঘুনাথের শিক্ষকতায় নিযুক্ত হন। পায়ে হেঁটে দীর্ঘ পথ অতিক্রমের সময় তিনি নানা গ্রামের মধ্য দিয়ে এসেছেন। তখন বটগাছের ঝুরি ধরে ছোট ছেলেমেয়েদের ঝালি বা ঝালঝাল খেলা তাঁর চোখে পড়ে থাকবে। হয়তো দামিন্যা ও আরড়াতেও দেখে থাকবেন। সেটাই চণ্ডীমঙ্গল লেখার সময় জুড়ে নিলেন।‌ হিমালয়কন্যা ও কৈলাসঘরনি বাংলার সঙ্গে খেলার ভিতর দিয়ে যুক্ত হয়ে গেলেন।


আরো নানা উদাহরণ আছে। ‘গণেশের মা’কে শূলপাণি দ্বিপ্রাহরিক আহারের জন্য কয়েকটি পদ রাঁধতে বলছেন। পদগুলির মধ্যে আছে নিমপাতা দিয়ে শিম ও বেগুন ভাজা, কুমড়ো ও বেগুন দিয়ে শুক্তো, নটে শাক‌ ও কাঁঠালবিচির সঙ্গে বড়ি ভাজা, সরষে শাক ভাজা, কটু বা সরষের তেলে ভাজা বেথুয়া শাক। এগুলি প্রথম পাতের খাওয়া। মাঝের পাতের জন্য লাগবে—


“রান্ধিবে মুসুরি সুপ দিআ টাবাজল
খণ্ডে মিসাইয়া রান্ধ করঞ্জার ফল।”২


‘সুপ’ হলো পাতলা ডাল আর ‘খণ্ড’ হচ্ছে চাপ গুড়। মধ্য পদে এ-দুটি ছাড়াও ঘিয়ে ভাজা বড়ি, ছোলার ডাল, মানকচু বাটা এবং ঘি ও জিরে দিয়ে সাঁতলানো পালং শাক থাকবে। শেষ পাতে কাসুন্দি ও জামিরের রস থাকবে। মোট দশটি ব্যঞ্জন রাঁধতে হবে, তবে গণেশের মা ইচ্ছে করলে শেষ পাতে আরেকটি পদ যোগ করতে পারেন। শিব বলছেন—


“আপনি উজ্জোগ যদি কর তুমি গৌরী
ভোজন করিয়া খাই হাঁড়ি দশ খীরি।”৩

কবিকঙ্কণ যে-সময়ে কাব্যটি রচনা করছেন সেটা বাঙালির প্রথম নবজাগরণের কাল। জাহাজ নির্মাণ করে সমুদ্রযাত্রা করছে দূর বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে। সুপরিকল্পিত নগর নির্মাণ করছে। মঙ্গলকাব্যের মতো একটি নতুন সাহিত্যরূপ তৈরি হচ্ছে। ধর্মসংস্কার ঘটেছে। কৃষির‌ও প্রভূত উন্নতি হয়েছে। হাতে এসেছে অর্থ আর তাই বাঙালির রান্নায় নানা বৈচিত্র আসছে। শস্যশ্যামল বঙ্গভূমির নানা ব্যঞ্জনে বঙ্গের কবি কৈলাসবাসী শিবের মধ্যাহ্নভোজনের থালাটি ভরতে চেয়েছেন। কিন্তু শিবের আলস্যে ভিক্ষায় প্রাপ্তি সামান্যই আর তাই পতির নানা পদের ব্যঞ্জনের ইচ্ছে গৌরী পূর্ণ করতে পারেন না। কিন্তু ভিক্ষায় শিবের প্রাপ্তি বেশি হলেও কি কৈলাসে নটে শাক, মানকচু, বেগুন, মুসুর ডাল, ছোলার ডাল, নিমপাতা ইত্যাদি জিনিস গৌরী সংগ্রহ করতে পারতেন? কৈলাস এবং তার চারপাশের একটা বৃত্ত জুড়ে যা মেলে তা হলো ঘাস আর পাহাড়ের গায়ের শ্যাওলা থেকে তৈরি ছত্রাক। খাদ্যপদ বলতে চমরি, ভেড়া এবং পাহাড়ি ছাগলের দুধ, মাখন, ঘি আর মাংস। কিন্তু কবিকঙ্কণ মুকুন্দ তাঁর লেখনীতে বঙ্গের শস্যে কৈলাসগিরিকে ভরিয়ে তুললেন। যেন গৌরী ইচ্ছে করলেই বাড়ির আশপাশ খুঁজলে আর রান্নাশালার পিছনের বাগান ও মেঘজলের পুকুর-পল্বলের পাড়ে গেলে সব‌ সবজিই খুঁজে পেতেন!


শিব ও পার্বতীকে নিয়ে বাংলায় দ্বিতীয় যে-কাব্যটি গুরুত্বপূর্ণ, তা হলো রামেশ্বর চক্রবর্তীর লেখা শিবায়ন। কবির জন্ম আনুমানিক ১৬৭৭ সালে বর্তমান মেদিনীপুর জেলার যদুপুরে। রাজপরিবারের সঙ্গে বিবাদের কারণে ১৬৯৭ সালে কেশপুর অঞ্চলের কাপাসটোপারি গ্রামে চলে যেতে তিনি বাধ্য হন। তার‌ই সামান্য পরে কর্ণগড়রাজ রাম সিংয়ের রাজসভায় পুরাণপাঠক হিসাবে নিযুক্ত হন এবং কেশপুরের অযোধ্যানগরে বাসস্থান গড়ে তোলেন। এখানেই ১৭১১ সালে শিবায়ন রচনা সম্পূর্ণ করেন। কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গল রচনার প্রায় দেড়শো বছর পরে রামেশ্বরের শিবায়ন রচিত হলো। সেখানে ‘ধুলাখেলা’র অন্তর্গত ‘পুত্তলী বর-কন্যা বিদায়’ অংশে জামাতাকে শাশুড়ি বলছেন—


“আঁটু ঢাক্যা বস্ত্র দিয় পেট ভরা ভাত।
প্রীত কব়্য যেমন জানকী রঘুনাথ॥”৪


এখানে জামাতার কাছে যে চাওয়া, তা অষ্টাদশ শতকের বাংলার গ্রামীণ সাধারণ পরিবারের একজন মায়ের চাওয়া। এর মধ্যে হিমাদ্রিজায়া মেনকা নেই। কন্যার জন্য জামাতার কাছে হিমাদ্রিজায়ার চাহিদা অনেক বেশি। রামেশ্বর বাংলার চাষের জমিতে যেসব মেয়েদের ধান রোপণ করতে বা ফসল তুলতে দেখেছেন, তাদের মতো করেই গৌরীকে ভেবেছেন ও গড়েছেন। ঐ রূপ সেসময়ের একজন সাধারণ গ্রাম্য কৃষক রমণীর রূপ। এছাড়াও রামেশ্বর কৈলাসের কথা বললেও বাংলার জলহাওয়ার মধ্যেই পৌরাণিক কাহিনিটিকে উপস্থাপন করতে চেয়েছেন। তাই হাঁটুঢাকা কাপড়ে কৈলাসে পার্বতীর কীভাবে শীত কাটবে সে-চিন্তা তাঁর নেই। আবার কাব্যটি যেখানে শেষ হয়, সেখানে শতাধিক ধানের একটি নামাবলি মেলে। এগুলি একান্ত‌ই বাংলার ধান, যা নাম থেকেই বোঝা যায়। যেমন—


“ছত্রশালি জটাশালি জগন্নাথ-ভোগ।
জামাঞিলাড়ু জলারাঙ্গী জীবন সংযোগ॥
ঝিঙ্গাশালি বলাইভোগ ধূল্যা বিলক্ষণ।
নিমাঞি নন্দনশালি রূপনারায়ণ॥”৫


নানা ধানের কথা মধ্যযুগের অনেক কবির‌ লেখাতেই মেলে, কিন্তু শুধু ভাতের উপায় করে রামেশ্বর চক্রবর্তী থামেননি। ভাত খেতে তরকারি লাগে। তাই কবি রামেশ্বর পর্বতের ঝিয়ের হাতে পাসুনি ধরিয়ে মাটি খুঁড়িয়েছেন। তাতে যা ঘটেছে সেটি হলো—


“পাসু ধব়্যা পার্ব্বতী পশ্চাৎ কৈল কি।
প্রকাশিল পঞ্চ শস্য পর্ব্বতের ঝি॥”৬


এই পঞ্চ শস্য থেকে মেদিনী শস্যশ্যামলা হলো বলে কবি লিখেছেন। এই মেদিনীর পিছনে যে বনজঙ্গলময় মেদিনীপুর জেলা ছিল তা অনুমান করা যায়। দক্ষিণ-পশ্চিম রাঢ়ের অরণ্যভূমিতে হলকর্ষণের মাধ্যমে কৃষিকাজ শুরু হচ্ছে এবং নানা কৃষিযন্ত্রের ব্যবহারে বিভিন্ন প্রজাতির ধান ও শস্য ফলছে।


শিব-দুর্গা মঙ্গলগাথার শেষ মহাজন হলেন ভারতচন্দ্র রায়। ভারতচন্দ্রের জন্ম ১৭১২ সালে আর মৃত্যু ১৮৬০-এ। মৃত্যুর আটবছর আগে অন্নদামঙ্গল কাব্যটি রচনা করেন।‌ ভারতচন্দ্রের জন্ম তৎকালীন বর্ধমান জেলার অন্তর্গত ভুরসুট পরগনার পেঁড়ো গ্রামে। একসময় বর্ধমানের মহারানি কোনো কারণে রুষ্ট হ‌ওয়ায় পরিবারটি নিঃস্ব হয়ে যায় বলে শোনা যায়। ভারতচন্দ্র তখন মণ্ডলঘাট পরগনার গাজিপুরের কাছে ন‌ওয়াপাড়া গ্রামের মামাবাড়িতে চলে যান। পাশেই তাজিপুর গ্রামে সংস্কৃত ব্যাকরণ ও অভিধানের পাঠ নেন। পাশের গ্রামের এক আচার্যের মেয়ের সঙ্গে কাছাকাছি সময়ে তাঁর বিয়ে হয় এবং সে-কথা শুনে দাদারা এসে তাঁকে উপার্জনের আগেই বিয়ে করার জন্য বকাবকি করেন। আঘাত পেয়ে ভারতচন্দ্র বাঁশবেড়িয়ার কাছে দেবানন্দপুরে গিয়ে রামচন্দ্র মুনশির কাছে ফারসি শেখেন। ফারসি শিক্ষা শেষে ভারতচন্দ্র বাড়িতে ফেরেন এবং ভাইরা বর্ধমানরাজের কাছ থেকে ইজারা পাওয়া জমির খাজনা জমা দেওয়ার ভার ভাইকে দেন। কিন্তু সে-খাজনা ভাইরা ঠিক সময়ে সংগ্রহ করতে না পারার কারণে রাজকর্মচারীদের চক্রান্তে ভারতচন্দ্রের জেল হয়। জেলে থাকার সময় জেলকর্মীকে প্রজাদের কাছ থেকে বাকি খাজনা আদায়ের উপায় বলে দেন এবং ব্রাহ্মণপীড়নে পাপের ভয় দেখান। তাতে রক্ষীর সহায়তায় গোপনে ছাড়া পান এবং দূর কটকে পালিয়ে যান। তারপর বৈষ্ণব গেঁাসাই হ‌ওয়া, বৃন্দাবন যাওয়ার পথে খানাকুলে এক আত্মীয়ের চোখে পড়া, সবার চাপে সংসারে ফেরা এবং ফরাসডাঙায় ফরাসি সরকারের দেওয়ান ইন্দ্রনারায়ণ চৌধুরীর কাছে চাকুরির প্রার্থনা। ভারতচন্দ্রের পারিবারিক পরিচয় পেয়ে এবং যুবকটির বিদ্যা ও কাব্যপ্রতিভার কথা জেনে ইন্দ্রনারায়ণ তাঁকে কৃষ্ণনগরের রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের কাছে পাঠান। কৃষ্ণচন্দ্রের পরামর্শে কবিকঙ্কণ মুকুন্দের মতো তিনি আরেকটি দেবীকাব্য লেখায় হাত দেন।


কবিকঙ্কণের চণ্ডীমঙ্গল-এর রচনাকাল থেকে মোটামুটি দুশো বছর পরে ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গল রচনা করেন। সময়, সমাজ, রাজনৈতিক পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক অবস্থা ততদিনে বদলে গেছে অনেকখানি। মধ্যযুগের বাঙালির নবজাগরিত বাংলা নয়, এটা হলো দুর্যোগের কাল। ১৭০৭-এ ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মোগল সাম্রাজ্যের ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে আর বাংলার শাসক আলিবর্দির শাসন‌দণ্ডও মুষ্টি থেকে শিথিল হয়ে গেছে। ছলে-বলে-কৌশলে অধিকার করা ক্ষমতা আলিবর্দি আর সামলাতে পারেন না। ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ পর্যন্ত বর্গি আক্রমণে বাংলায় ত্রাহি ত্রাহি রব। ওদিকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির থাবাও শক্ত হচ্ছে। এমন এক যুগ-সন্ধিক্ষণে ভারতচন্দ্র অন্নদামঙ্গল রচনা করছেন। তিনি পুরানো কথাই শোনাতে চাইছেন, কিন্তু ভিন্ন ভাষা ও ভিন্ন ভাবে। সেকথা নিজে‌ই জানালেন—


“নিত্য তুমি খেল যাহা নিত্য ভাল নহে তাহা
আমি যে খেলিতে চাহি সে খেলা খেলাও হে।
তুমি যে চাহনি চাও সে চাহনি কোথা পাও
ভারত যেমত চাহে সেইমত চাও হে।”৭


ভারতচন্দ্র ঝকঝকে কৌতুকময় বুদ্ধিদীপ্ত একটি কাব্যশৈলী তৈরি করলেন—যেখানে তৎসম, তদ্ভব, ফারসি, আরবি ও দেশজ শব্দ পাশাপাশি এসে গেল।


অন্নদামঙ্গল কাব্যের শিব ও গৌরী অংশের প্রথম দিকে ভারতচন্দ্র কৈলাসের কথায় এসেছেন এবং তার প্রাকৃতিক রূপ অনেকটাই বঙ্গের মতো। তিনি ‘কৈলাসবর্ণন’ অংশে লিখছেন—


“তরু নানা জাতি লতা নানা ভাতি
ফলে ফুলে বিকসিত।
বিবিধ বিহঙ্গ বিবিধ ভুজঙ্গ
নানা পশু সুশোভিত॥”৮


কিন্তু বাকি অংশে গাছপালা প্রসঙ্গে বিশেষ কিছু বলেননি। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি কৈলাসের প্রাকৃতিক পরিচয় তিনি বোধহয় অনেকটাই পেয়েছেন। তাই কাব্যে গৌরী যখন অন্নপূর্ণা-মূর্তি ধারণ করে অন্নের পর্বত তৈরি করছেন, সেখানে কোনো ব্যঞ্জনের কথা নেই। যা আছে তা হলো—


“অন্নের পর্ব্বত পরমান্নসরোবর।
ঘৃত মধু দুগ্ধ দধি সাগর সাগর॥”৯


তারপর একসময় কৈলাস থেকে শিবদুর্গা কাহিনিকে ‘পুণ্যভূমি বারাণসী’তে স্থানান্তরিত করলেন। সেখানে অন্নপূর্ণার দেউল তৈরি হলো। তারপরে দেবতারা‌ও ‘চল কাশী মাঝে সবে যাব’ বলে সেখানে চলে এলেন। অন্যদিকে অন্নদার অভিশাপে বসুন্ধর ও বসুন্ধরা স্বর্গচ্যুত হলেন আর তাঁদের নবজন্ম হলো গৌড়ের একটি গ্রামে। ভারতচন্দ্র লিখলেন—


“বাঙ্গালায় ধন্য পরগণা বাগুয়ান।
তাহে বড়গাছি গ্রাম গ্রামের প্রধান॥”১০


তারপর হরিহোড়ের সংসার-বৃত্তান্তে সেদিনের বঙ্গদেশের হা অন্ন কথা এবং শেষে হরিহোড়কে দেবীর বরদান।
অন্নদামঙ্গল-এর যে দ্বিতীয় অংশ, সেটি শুরুই হচ্ছে রাজা মানসিংহের বাংলায় আগমন দিয়ে। এখানেই বিদ্যা ও সুন্দরের কাহিনি মেলে, যা প্রায় দু-শতক ধরে বাঙালির পাঠকের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। এই কাহিনির ভৌগোলিক প্রেক্ষিত বর্ধমান জেলা। কাহিনির শেষদিকে দেবী অভয়ার যে দর্শন মেলে তাও বর্ধমানের মশানে।


অন্নদামঙ্গল-এর তৃতীয় অংশে যশোর, জগন্নাথপুরী, দিল্লি, অযোধ্যা, কাশী ইত্যাদি জায়গার কথা আছে। তবে শেষপর্যন্ত ভবানন্দ মজুন্দারের মাধ্যমে ভারতচন্দ্র কাহিনিকে স্বদেশে ফিরিয়ে দিয়েছেন। লিখেছেন—


“বনভূমি এড়াইয়া রাঢ়ে উপনীত।
দেখিয়া দেশের মুখ মহা হরষিত॥”১১


বঙ্গভূমে পৌঁছে ভবানন্দ যতটা হরষিত, ততটাই ভারতচন্দ্র‌ও বোধহয় আনন্দিত। হিমালয়, কৈলাস বা দিল্লি নয়, বঙ্গের রাঢ় অঞ্চলে ভবানন্দ ও কবি ভারতচন্দ্র দুজনেই বেশ স্বচ্ছন্দ। যে ‘দেশের মুখ’-এর কথা এখানে বলা হয়েছে তা রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ ভারতবর্ষ নয়, জীবনানন্দের রূপসী বাংলাও নয়, সেটি ভারতচন্দ্রের রাঢ়বঙ্গ। সেখানে অন্নদাকেও এনে হাজির করেছেন। কাব্যের শেষদিকে চৈত্র মাসে অন্নপূর্ণাপূজা ও এয়োজাতের একটি বিবরণ আছে। সেটি বড় আকর্ষণীয়। কত বয়সের কত নারীর সমাগম সেখানে! বুড়া আধবুড়া যুবা নবোঢ়া গর্ভিণী—সবাই আছে। দু-আড়াইশো নারীর নাম উল্লেখ করেছেন ভারতচন্দ্র। সেখানে অপর্ণা অম্বিকা ভগবতী হরিপ্রিয়া রুদ্রাণী যেমন আছে, তেমনি বাঙালি সংসারে পরিচিত মুখ—চাঁপী ফুলী নিমী ছকী সকী হেলী ফেলী বারী কুড়ানী টিকা ও টুনীও আছে। পুরাণ আর দৈনন্দিনকে এভাবেই জুড়েছেন ভারতচন্দ্র।


অন্নদার এয়োজাত শেষে রন্ধন প্রসঙ্গ। ভবানন্দ মজুন্দারের পত্নী পদ্মমুখী আর হাস্যমুখী রান্না চড়িয়েছে। সে-রান্নায় অধিষ্ঠান করলেন স্বয়ং অন্নদা। নিরামিষ তে‌ইশটি পদ রান্না হলো—যার মধ্যে শাক ভাজা, শুক্তানি, নানা ডাল, দুধথোড়ের ডালনা, বড়া, বড়ি, কলা, মুলো ও নারকেল ভাজা ছিল। কিন্তু বাঙালির ভোজন শুধু নিরামিষে হয় না, তাই কাতলা চিতল ফলুই ক‌ই মাগুর সোনাখড়কি চিংড়ি রুই শোল ইত্যাদি মাছের ঝোল ঝাল চচ্চড়ি ও অম্বল হলো। মাছ ও কাছিমের ডিমের বড়াও হলো। তারপর মাংসের পদ। ভারতচন্দ্র লিখছেন—


“কচি ছাগ মৃগ মাংসে ঝাল ঝোল রসা।
কালিয়া দোলমা বাগা সেকচী সমসা॥
অন্ন মাংস সীকভাজা কাবাব করিয়া।
রান্ধিলেন মুড়া আগে মসলা পূরিয়া॥”১২


কবিকঙ্কণ মুকুন্দ ও রামেশ্বর নিরামিষ পদের কথা বলেছিলেন, কিন্তু ভারতচন্দ্র নানা আমিষ পদের আমদানি করলেন। তার মধ্যে মোগলাই খানাও যুক্ত হলো। ‘সমসা’ হচ্ছে মাংসের পুর দেওয়া ত্রিকোণ আকারের রুটি আর ‘সীকভাজা কাবাব’ হলো শিককাবাব। ঈশ্বর পাটনি অন্নদার কাছে বর চেয়েছিল সন্তান যেন দুধে-ভাতে থাকে। ভারতচন্দ্র বাঙালির এয়োবতীদের জন্য নিরামিষ ও আমিষ সব পদের‌ই ব্যবস্থা করলেন। সেইসঙ্গে ‘সুধারুচি মুচমুচি লুচি’, বেশ কয়েক রকমের অম্বল, পায়েস আর পিঠেও ছিল। প্রায় সাড়ে তিন পাতা জুড়ে রন্ধনের বিবরণ—যেখানে অন্নদাপূজার অংশটি দেড় পাতার‌ও কম। ভারতচন্দ্র অবশ্য কোথাও ফাঁক রাখেননি। আগেই বলেছেন—‘অন্নপূর্ণা রন্ধনে করিলা অধিষ্ঠান’। খাদ্যপদগুলি বাঙালি সন্তানদের জন্য মা অন্নদা নিজেই ব্যবস্থা করেছেন। ভারতচন্দ্র লিখছেন—


“তুমি অন্ন দেহ যারে অমৃত কি মিঠা তারে
সুধাতে কে করে সাধ এ সুধা ছাড়িয়া।
পরশিয়া অন্ন সুধা ভারতের হর ক্ষুধা
মা বিনা বালকে অন্ন কে দেয় ডাকিয়া॥”১৩


কবিকঙ্কণ মুকুন্দ চক্রবর্তী, রামেশ্বর চক্রবর্তী এবং ভারতচন্দ্র রায় এভাবেই শিব ও গৌরীকে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিতে নবরূপ দিয়েছিলেন। পৌরাণিকের সঙ্গে লৌকিক, অতীতের সঙ্গে সমকাল, দেবতার সঙ্গে মানবকে জুড়ে নিয়েছিলেন। বাংলার ঘরসংসারে কৈলাসদম্পতিকে আসন পেতে বসিয়েছিলেন। তার মধ্যে ভক্তি আছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি আছে ভালবাসা।


হর ও গৌরীর সঙ্গ পেতে বাংলা কাব্যের এই পথ ছাড়াও আরেকটি পথ খোলা আছে। সেটি হলো গিরিপথ অতিক্রম করে কৈলাসে যাওয়া। বহু মানুষ আগে গেছেন এবং এখনো যান। সবাই শেষপর্যন্ত পৌঁছাতে পারেন এমন নয়, কিন্তু খণ্ড যাত্রার মধ্যেও হিমাদ্রিলোকের কিছু চিরস্মরণীয় অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। হিমালয় ও কৈলাসযাত্রার কিছু মূল্যবান কাহিনি বাংলায় লেখা হয়েছে। তার মধ্যে দুটি ভ্রমণবৃত্তান্ত এককথায় অমূল্য। এর একটি হলো স্বামী অখণ্ডানন্দজীর তিব্বতের পথে হিমালয়ে আর অন্যটি হলো স্বামী রামানন্দ ভারতীর হিমারণ্য। এ‌ই দুই পরিব্রাজকের যাত্রা ছিল অনেকটাই একলা মানুষের। বিপদে পড়েছেন, আবার সামলেও দিয়েছেন। স্থানীয় মানুষদের সাহায্যে তাঁদের দুর্গম গিরিপথ অতিক্রম।


বছর কয়েক আগে এই ব‌ই-দুটি সহায় করে হর ও পার্বতীর আরেক মঙ্গলকথা লিখতে শুরু করি। কবিকঙ্কণ, রামেশ্বর ও ভারতচন্দ্রের সমান্তরাল ছিল ঐ দুই তিব্বতযাত্রী স্বামীর পথ। সে-পথ‌ই অনুসরণের চেষ্টা করেছি। কাহিনির শুরু পার্বতী পরিণয়ে হিমাদ্রির জ্ঞাতি নিমন্ত্রণে আর শেষ পার্বতীর অন্নযজ্ঞ ও হরের অন্নভিক্ষা দিয়ে। তেতাল্লিশ পর্বের মাঝের অংশে আছে নববধূ পার্বতীকে নিয়ে নানা গিরিগ্রাম অতিক্রম করে হরের কৈলাসযাত্রা। প্রয়াগ থেকে শুরু করে ঢাকগ্রাম, কশ্যপ আশ্রম, মলহারী, মরগঁাও, গোধূমশালী, কালাজাবর, হোতি ইত্যাদি ছোট ছোট জনপদের মধ্য দিয়ে চলা। সেসব গ্রামের মানুষ‌ নবদম্পতিকে বরণ করেছে, আহার দিয়েছে, আদর দিয়েছে, আশ্রয়‌ও দিয়েছে। কাহিনিটি লেখার সময় মনে হয়েছিল, জনপদের ভিতর দিয়ে চলতে চলতে রাজনন্দিনী পার্বতীর যোগসূত্র গড়ে উঠবে লোকবৃত্তের সঙ্গে। বৈভবে লালিত পার্বতী দীর্ঘযাত্রায় কৈলাসনাথের বৈরাগ্যের স্পর্শ পাবে। আবার অন্যদিকে পার্বতীর অন্নদা রূপ হরের‌ মধ্যেও রূপান্তর আনবে। বাংলার শস্যশ্যামল প্রকৃতিতে নয়, তিব্বতের তুষারাবৃত গিরিশিখর আর তৃণময় উপত্যকায় হর-পার্বতীর গার্হস্থকে বুঝতে চেয়েছিলাম। সে-প্রচেষ্টার উপার্জন হয়তো কানাকড়ি, তবুও হর-পার্বতী কথার কথকদের মধ্যে আমিও আছি, তথ্যের সত্যতা ও পূর্ণতার প্রয়োজনে শুধু এই উল্লেখটুকু করা।

তথ্যসূত্র
১. মুকুন্দ, কবিকঙ্কণ, চণ্ডীমঙ্গল, সাহিত্য অকাদেমি, নতুন দিল্লি, ১৯৯৩, পৃঃ ১৫৯
২. ঐ, পৃঃ ২৬
৩. ঐ
৪. চক্রবর্তী, রামেশ্বর, রামেশ্বর রচনাবলী, বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, কলকাতা, ১৯৯৭, পৃঃ ৩৭৬
৫. ঐ, পৃঃ ৫০৪
৬. ঐ
৭. রায়, ভারতচন্দ্র, ভারতচন্দ্র রচনাবলী, বঙ্গীয়-সাহিত্য-পরিষৎ, কলকাতা, ভাদ্র ১৩৫০, পৃঃ ২১৫
৮. ঐ, পৃঃ ৭৮
৯. ঐ, পৃঃ ৮৯
১০. ঐ, পৃঃ ১৭৮
১১. ঐ, পৃঃ ৪১১
১২. ঐ, পৃঃ ৪৩০
১৩. ঐ, পৃঃ ৪২৯

সাহিত্য অকাদেমির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় শাখার প্রাক্তন সম্পাদক, সাহিত্যিক ও গবেষক।