সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের পরিবর্তন যেমন ঘটেছে, তেমনি বিলুপ্তও হয়েছে অনেক আবেগ, সংস্কার। নগর সভ্যতায় সেসব সংস্কারের মৃদু আলোটুকুও তেমন আর দেখা যায় না, গ্রাম-গঞ্জে এখনো তার কিছু কিছু লক্ষ্য করা যায়।

বাংলা নববর্ষের আবেগকে ধরতে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভূমিকাকে স্বীকার করতেই হয়। বলা চলে, উনিশ শতকে পয়লা বৈশাখকে আনুষ্ঠানিকতার রূপদানে তাঁর ভূমিকাই সর্বাগ্রে গণ্য। নববর্ষ উপলক্ষে তাঁর লেখা ‘নববর্ষে’, ‘এসো হে বৈশাখ’, ‘পুরাতন’, ‘নববর্ষ এল আজি’, ‘বৈশাখ’ ইত্যাদি কবিতার কথা মনে পড়ে। ১২৯০ বঙ্গাব্দের ১ বৈশাখ মহর্ষিভবনে নববর্ষের উপাসনা দিয়ে বর্ষবরণের সূচনা হয়। রবীন্দ্রনাথের দুটি ব্রাহ্মসংগীত সেদিন গীত হয়—‘সখা তুমি আছ কোথা’ এবং ‘প্রভু এলেম কোথায়’। পরের বছরের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের জন্য লিখেছিলেন চারটি গান। ১২৯৩ বঙ্গাব্দের বর্ষবরণের অনুষ্ঠান হয় সিটি কলেজে। উদ্যোক্তা সাধারণ ব্রাহ্মসমাজ। রবীন্দ্রনাথ সেদিন ‘সত্য’ নামক ভাষণটি পাঠ করেন।

আসলে এই বর্ষবরণের সূচনা উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে। বাঙালি সংস্কৃতি বেশির ভাগই কৃষিকেন্দ্রিক। ফলে পুণ্যাহ উৎসব হিসাবে নববর্ষকে সূচিত করা হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “সেদিন ছিল যাকে বলে জমিদারি সেরেস্তার ‘পুণ্যাহ’, খাজনা-আদায়ের প্রথম দিন। কাজটা নিতান্তই বিষয়-কাজ। কিন্তু, জমিদারি মহলে সেটা হয়ে উঠেছে একটা পার্বণ। সবাই খুশি—যে খাজনা দেয় সেও, আর যে খাজনা বাক্সতে ভর্তি করে সেও। এর মধ্যে হিসেব মিলিয়ে দেখার গন্ধ ছিল না। যে যা দিতে পারে তাই দেয়, প্রাপ্য নিয়ে কোনো তক্‌রার করা হয় না। খুব ধুমধাম, পাড়াগেঁয়ে সানাই অত্যন্ত বেসুরে আকাশ মাতিয়ে তোলে। নতুন কাপড় পরে প্রজারা কাছারিতে সেলাম দিতে আসে।” তাঁর কাছে বাংলা নববর্ষ বিশেষ তাৎপর্যবাহী। তিনি লিখেছেন : “মানুষের নববর্ষ আরামের নববর্ষ নয়;… আবরণের পর আবরণকে ছিন্ন বিদীর্ণ করে তবে তার অভ্যুদয় ঘটে।”

ফলে নববর্ষকে আলাদা করে দেখার, আলাদা করে ভাবনার অবকাশ ছিল নগর কলকাতার শিক্ষিত সম্প্রদায়ের। রবীন্দ্রনাথও বিষয়টি ভেবেছিলেন নব আঙ্গিকে। পুণ্যাহ কেবল কৃষিতে নয়, যুক্ত মানুষের মননেও। তাই প্রভাতে ঘুম থেকে উঠে প্রার্থনা ও অঙ্গীকার করার মতোই তিনি সারা বছরের জন্য বছরের প্রথম দিনটিতেও সেইরূপ প্রার্থনা ও অঙ্গীকারে শামিল করতে চেয়েছিলেন সকলকে একসঙ্গে। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকার ১৮৯৪ সালের চৈত্র সংখ্যায় রবীন্দ্রনাথ ও ক্ষিতীন্দ্রনাথ ‘বিজ্ঞাপন’ দিয়েছিলেন। তাতে লেখা ছিল—“১ বৈশাখ শনিবার নববর্ষ। এ দিনে সকলকেই অনন্ত জীবনের আর একটি নূতন সোপানে উঠিতে হইবে। যখন রাত্রি অবসন্ন এবং দিবা আসন্নপ্রায় সেই সন্ধিক্ষণে শুভ ব্রহ্মমুহূর্তে অর্থাৎ ৫ ঘটিকার সময় শ্রীমৎ প্রধান আচার্য্য মহাশয়ের ভবনে ব্রহ্মের বিশেষ উপাসনা হইবে।”

শান্তিনিকেতনে প্রথম নববর্ষ উৎসব পালিত হয় ১৩০৯ বঙ্গাব্দে। রবীন্দ্রনাথ নববর্ষের দিন যেখানেই থাকতেন, সেখানেই বন্ধু-বান্ধব নিয়ে দিনটি পালন করতেন। আসলে তাঁর কাছে নববর্ষের গুরুত্ব ছিল প্রভাতে সূর্য ওঠার মতো জীবনের আরেকটা সোপানে ওঠার দিন। ফলে সেদিনেই আগামীর পরিকল্পনা করা উচিত। আত্মসমীক্ষার মধ্য দিয়ে নিজেকে সম্মুখপানে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করার দিন। সেই ভাবনাই তিনি ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন সকলের মধ্যে। তাই জীবনের শেষপর্বেও তিনি নববর্ষ উপলক্ষে গান রচনা করেছেন—“ওই মহামানব আসে;/ দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে/ মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে।”

তবে কেবল অনুষ্ঠান বা গান-কবিতা রচনাই নয়, আলপনা দেওয়াও এই সংস্কৃতির একটি অঙ্গ হয়ে উঠেছিল। শান্তিনিকেতনের উপাসনা মন্দিরে বছরের চারটি দিনে আলপনা দেওয়া হতো—চৈত্রের শেষদিন, বৈশাখের প্রথম দিন, ২৫ ডিসেম্বরের খ্রিস্টোৎসবের দিন, পরে যুক্ত হয় ২২ শ্রাবণ।

নববর্ষের খাওয়া-দাওয়ার রীতিটিও সমানভাবে প্রচলিত ছিল ঠাকুরবাড়িতে। কাঁচা ইলিশের ঝোল, চিতল মাছ আর চালতা মুগের ডাল, নারকেল চিংড়ি, মাছের পোলাও, আম দিয়ে শোল মাছ, পাঁঠার হাড়ের অম্বল, আরো কত কী! নববর্ষের জনপ্রিয় মিষ্টি তৈরি করতেন মৃণালিনী দেবী, নাম রেখেছিলেন ‘এলোঝেলো’। রবীন্দ্রনাথ সেই নাম পালটে রাখেন ‘পরিবন্ধ’।

রবীন্দ্রনাথ যে-ভাবনা নিয়ে এই অনুষ্ঠানের প্রচলন করেছিলেন, সেই ভাবনা শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়লেও বর্তমানে রবীন্দ্র-চিন্তনটুকু আগের মতো খুঁজে পাওয়া যায় না। তবুও যতটা রয়েছে সেটুকুই বাঙালির ঐতিহ্য, বাঙালির শক্তি।

বাঙালির নববর্ষ বলতে আর যে-কথাটি সবার প্রথমে আসে, তা হলো ‘হালখাতা’। বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি তাদের আয়-ব্যয়ের হিসাবের নতুন খাতা উদ্বোধন করে। এই খাতাই ‘হালখাতা’। লাল শালুতে মোড়া বা লাল মলাটের খাতার প্রথম পাতাতেই স্বস্তিকচিহ্ন আঁকা হয়। লাল কালিতে লেখা হয় বিভিন্ন দেবদেবীর নাম। কেউ কেউ লেখে ‘এলাহী ভরসা’। প্রতিষ্ঠানগুলিতে সেদিন গণেশ ও লক্ষ্মীর আরাধনা করা হয়। ঐদিন দোকানদার ক্রেতাদের মিষ্টিমুখ করায়। সেইসঙ্গে হাতে তুলে দেয় বাংলা ক্যালেন্ডার। ব্যবসায়ীরা খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে মন্ত্রপাঠের মধ্য দিয়ে স্নান সেরে দেবদেবীকে পুজো নিবেদন করে নিজের প্রতিষ্ঠানে এসে হাজির হয় একেবারে বাঙালির পোশাকে। তারপরই হালখাতার কাজ। কোথাও কোথাও আবার ক্রেতাদের সকল দেনা মিটিয়ে দেওয়ায় দিন হিসাবেও পরিগণিত হয় এদিনটি। দীনেন্দ্রকুমার রায় তাঁর পল্লীচিত্র গ্রন্থে হালখাতা উপলক্ষে একটি দোকানে জলযোগের এক বিরাট খাদ্যতালিকা দিয়েছেন। সেখানে বহুরকমের মিষ্টান্নের সঙ্গে বিভিন্ন ফল, শরবত ও লুচি-কচুরির উল্লেখ পাওয়া যায়।
যেহেতু নববর্ষ সেকালে একটা উৎসবে পরিণত হয়েছিল, তাই সময় কাটানোর আরেকটি উপকরণ ছিল ঘুড়ি-লাটাই। ছোটদের সঙ্গে বড়রাও নেমে পড়ত ঘুড়ি ওড়াতে। চলত প্রতিযোগিতাও। এখন অবশ্য নববর্ষের আকাশে তেমন ঘুড়ি দেখা যায় না। গ্রামীণ খেলা বা বিভিন্ন প্রতিযোগিতা যেমন নৌকা বাইচ ইত্যাদিও আর চোখে পড়ে না।

‘মধ্যবিত্তের বৈশাখ’ প্রবন্ধে আহমদ ছফা লিখেছেন : “আমরা ছোটবেলায় দেখেছি—বেলা আট-নয়টা বাজার সাথে সাথে বাড়িতে আচার্য বামুন আসতেন। তিনি পাঁজি খুলে অনেকটা আবৃত্তির ঢঙয়ে বলে যেতেন—এই বছরের রাজা কোন গ্রহ, মন্ত্রী কোন গ্রহ, এ বছরে কত বৃষ্টি হবে, কত ভাগ সাগরে আর কত ভাগ স্থলে পড়বে, পোকা-মাকড়, মশা-মাছির বাড় বৃদ্ধি কত। তারপর আমাদের কোষ্ঠি দেখে দেখে গণক ঠাকুর বলে যেতেন—এ বছরটি কার কেমন যাবে।” এখন অবশ্য আর গণকঠাকুরের প্রয়োজন হয় না—বেশ কয়েকটি দৈনিক পত্রিকা বছরের রাশিফল প্রকাশ করে থাকে। পঞ্জিকাও এই ভূমিকা পালন করে। ফলে ঐদিন বাড়িতে গণকঠাকুরের আসার দিন শেষ।

ঐ প্রবন্ধেই আহমদ ছফা লিখেছেন : “(হিন্দু পরিবারগুলিতে) নাড়ু, মুড়ি-মুড়কি, মোয়া এসব ভালোভাবে তৈরি করত। মুসলমান পরিবারে এসবের বিশেষ চল ছিল না।… আমাদের পরিবারের সাথে যে সমস্ত হিন্দু পরিবারের সম্পর্ক ছিল সেসব বাড়ি থেকে মুড়ি-মুড়কি, মোয়া, নাড়ু এগুলোর হাঁড়ি আসতে থাকত।… এ হাঁড়িগুলোও ছিল চিত্রিত।” বলা বাহুল্য, এই খাতির-যত্ন বর্তমানে আর তেমন দেখা যায় না। কিছু বাঙালি ঘরে অবশ্য পিঠে-পুলি ও পায়েসের প্রচলন এখনো ল‌ক্ষ্য করা যায়। আগে চৈত্র সংক্রান্তিতে গ্রামে গ্রামে চলত ঢেঁকিতে চাল কোটার পর্ব। এই গুঁড়ো চাল দিয়েই হতো পিঠে। সেই ঢেঁকি এখন আর দেখা না গেলেও প্রথাটি রয়ে গেছে অনেক জায়গায়। বর্ধমানের বেশ কিছু স্থানে নয়রকম তরকারি সহযোগে মধ্যাহ্নভোজনের ব্যবস্থা থাকে। কোথাও কোথাও আবার পান্তাভাতেরও প্রচলন আছে।

বছরের প্রথম দিনটিতে বাঙালির পুজো দেওয়ার রেওয়াজ অনেক আগে থেকেই। সেটি অবশ্য সময়ের প্রবাহে ক্রমশ বিস্তারলাভ করেছে। এর মূল কারণ—বাঙালির অন্যতম আশ্রয়স্থল ধর্মীয় ক্ষেত্রগুলি। তাই গ্রামগুলিতে যেমন গ্রামদেবতার পুজোর প্রচলন আছে, তেমনি কলকাতাকে কেন্দ্র করে দক্ষিণেশ্বর, কালীঘাট, বেলুড় মঠ যাওয়ার রীতিটি বর্তমানে বিশেষ ল‌ক্ষ্য করার। ১৮৮৬-এর ১৩ এপ্রিল ছিল ‌১ বৈশাখ। কথামৃততে দেখি, সেদিন সুরেন্দ্রনাথ শ্রীরামকৃষ্ণের কাছে গিয়ে বলছেন : “আজ ১লা বৈশাখ, আবার মঙ্গলবার; কালীঘাটে যাওয়া হল না। ভাবলাম যিনি কালী—যিনি কালী ঠিক চিনেছেন, তাঁকে দর্শন করলেই হবে।”

এ তো গেল বাঙালির শহুরে নববর্ষ পালনের কথকতা। গ্রামে অবশ্য নববর্ষ মানা হয় ১ মাঘ। কারণ, ঐদিন কৃষি-বর্ষের সূচনা হয়ে যায়। অনেকে বলেন, এটি কেবল কুড়মি সমাজের বর্ষগণনায় প্রথম মাস হয়েই থাকেনি, বরং সকল কৃষকের কাছে বছর শুরুর মাস হিসাবে পরিগণিত হয়েছে। তাই বছরের প্রথম দিনে নতুন করে আরেকটি পর্ব শুরু করতে গিয়ে সাধারণ চাষি মানুষ তাদের দেবতার কাছে প্রার্থনা নিয়ে হাজির হয়। গ্রামদেবতা, কুলদেবতা ইত্যাদি নানান দেবতা যাঁরা সেই এলাকার মানুষকে বিপদে-আপদে রক্ষা করেন বলে মানুষের বিশ্বাস—তাঁদের মণ্ডপটি ঐদিন লোকে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। মানত বা মানসিক থাকলে দেবতার মণ্ডপে পাঁঠা, হাঁস, মুরগি ইত্যাদি প্রাণী বলি দেওয়া হয়।

সেদিন শুদ্ধাচারে গৃহকর্ত্রী ও গৃহকর্তা নতুন বছরের মঙ্গলকামনায় দেবতার কাছে হাজির হয়। গ্রামবাসীরা উপস্থিত হয় ‘গেরাম থান’-এ। গ্রামের প্রান্তে বেশ পুরানো কোনো বৃক্ষের নিচে বেদি করা উঁচু স্থানে কিংবা মাটিতেই রাখা থাকে হাতি-ঘোড়ার মূর্তি। তবে সর্বত্রই গ্রামদেবী বা গ্রামদেবতা না বলে এঁদের বিশেষ কিছু নাম আছে। সাধারণত, এক গ্রামদেবতার সঙ্গে অন্য গ্রামদেবতার নাম সেভাবে মেলে না। তবে এক-একটি বিভাগ করা যেতে পারে। যেমন—গরাম ঠাকুর, ধর্মঠাকুর, সিনিদেবী, চণ্ডীদেবী, মাদানা, সন্ন্যাসী বাবা, বাসলী, মনসা প্রমুখ। গ্রামদেবতার থানটিকে ঐদিন পরিষ্কার করে গোবরজল দিয়ে শুদ্ধ করা হয়। তারপর গ্রামবাসীরা আসে। সঙ্গে নৈবেদ্য, চাঁদমালা, হাতি-ঘোড়া। টেরাকোটার হাতি-ঘোড়া দিয়ে থানগুলি ভর্তি থাকে। পূজারি সাধারণত গ্রামেরই কোনো বাসিন্দা। তবে ইদানীং ব্রাহ্মণের প্রচলন হয়েছে কোথাও কোথাও। নৈবেদ্য বলতে ফলমূল, গুড়, মধু, মিষ্টি, বাতাসা। ব্রাহ্মণ পূজারি হলে মন্ত্র থাকে, নচেৎ ভক্তিভরে মঙ্গলকামনা করে পূজা করে সেই গ্রামের বাসিন্দা বা লায়া। এরপর স্নানজল বিতরণ। সবাই মাথা নুইয়ে প্রণাম করে এবং পূজারি স্নানজল ছিটিয়ে দেয় পুণ্যার্থীদের মাথায়। পূজার শেষে বলিদান। এই সময়ে কোথাও কোথাও লায়া বা পূজারির মাথায় দেবতা ‘ভর’ করেন, যাকে বলা হয় ‘ঝুঁপার’।

কোথাও কোথাও ছোট মেলা বসে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে মহিলাদের সাজগোছের দ্রব্যও বিক্রি হয় এই মেলায়। খাবারের দোকান তো থাকেই। ঐদিন রাত্রে কোথাও কোথাও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়। দক্ষিণবঙ্গে ছৌ, ঝুমুর, সাঁওতালি নাচ ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। বিকালে হয় মুরগির লড়াই। দক্ষিণবঙ্গ-সহ কৃষিকেন্দ্রিক এলাকাগুলি মাঘ মাসের প্রথম দিনটিতে মেতে ওঠে নিজস্বতায়, মঙ্গলকামনায়।

কৃষির সূচনাও ঐদিন করা হয়, যেটিকে বলা হয় ‘হাল পুণ্যাহ’। ঐদিন সকালে বাড়ির মেয়ে-বউরা ঘরদোর পরিষ্কার করে গোবরজল দিয়ে সব শুদ্ধ করে। তারপর আলপনা দেওয়া হয়, আঁকা হয় দেবী লক্ষ্মীর পদচিহ্ন। বাড়ির বড় ছেলে লাঙল নিয়ে নিকটবর্তী খেতে যায়। সেখানে পূর্বদিকে মুখ করে আড়াই পাক বা আড়াই বেড় লাঙল চালায়। এরপর মোষ বা গোরুগুলিকে জলাশয়ে ভাল করে স্নান করিয়ে বাড়িতে নিয়ে আসা হয়। বাঁদনা পরবের মতোই দেবী ভগবতীস্বরূপ গোরুগুলিকে বাড়ির মেয়ে-বউরা ধান-দূর্বা-সিঁদুর দিয়ে বরণ করে। তাদের শিঙে তেল-সিঁদুর মাখিয়ে দেওয়া হয়। তারপর গলায় আঁচল জড়িয়ে তাকে প্রণাম। প্রার্থনা করা হয় এই বছর যেন ভাল চাষবাস হয়, সংসারে যেন শান্তি অটুট থাকে। বাড়ির সেই বড় ছেলে, যে খেতে হাল চালায়, সে সারাদিন উপবাসে থাকে। এরপরে বাড়ির যেটি গোবর-কুঁড় অর্থাৎ যেখানে গোবর জমা করে রাখা হয়, সেখানে কোদাল দিয়ে আড়াইবার কোপ মারে। সব শেষে সে দই-চিঁড়ে-গুড় খেয়ে উপবাস ভাঙে।

একদিকে যেমন উৎসব-মেলায় সাধারণ মানুষ মেতে ওঠে, অন্যদিকে বছরের প্রথম দিনটি সবাই দায়বদ্ধ বা চুক্তিবদ্ধ হয় নতুন বছরটির জন্য। চাষিরা তার গোলাঘর বা মনিব-ঘরে গিয়ে সেই বছরের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়, নাপিত তার গ্রাম ঠিক করে নেয়—কোন কোন গ্রাম তার দায়িত্বে থাকবে উৎসব অনুষ্ঠানে নখ-চুল কাটার জন্য। এমনিভাবে বাগাল গোরু চরানোর জন্য, মাইনাদার চাষবাস দেখাশোনার জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়।

তবে মাঘ মাসের প্রথম দিন যেরকম কৃষিবর্ষের সূচনা হিসাবে সাধারণ কৃষক-পরিবারে মান্যতা দেওয়া হয়, প্রায় একইরকম ১ বৈশাখেও হয়। এই অনুষ্ঠান কৃষিজীবী মানুষগুলির কাছে ‘ভগবতী যাত্রা’ নামে পরিচিত। দীনেন্দ্রকুমার রায় তাঁর পল্লীচিত্র গ্রন্থে লিখেছেন : “বেলা দশটা বাজিতে না বাজিতে প্রত্যেক গৃহস্থবাড়ীতে আজ ভগবতী-যাত্রার আয়োজন আরম্ভ হইয়াছে। গোয়ালঘরে ‘ভগবতী-পূজা’ হইবে, তাই গোয়াল হইতে আজ সকাল সকাল গরু বাহির করিয়া গৃহিণীরা সযত্নে সেই ঘরখানি ‘নিকাইয়া’ রাখিয়াছেন। স্নান করিয়া আসিয়া তাঁহারা পূজার জোগাড় করিতে লাগিলেন। ছোট একখানা রেকাবীতে চাট্টি ভিজে আতপ চাউল, একটা মণ্ডা ও কয়েকখানি বাতাসা দিয়া একখানি নৈবেদ্য সাজান হইল। একটা সাজিতে গোটাকত অতসী, বেলা, সাদা বা লাল করবীর ফুল ও গোটাকত তুলসীপত্র সংগ্রহ করা ছিল…।”১০ বিকালের পর গোয়ালঘরে ‘দুধ উতলানো’ পর্ব চলে। সেখানে একটি ছোট অস্থায়ী উনুনে গৃহকর্ত্রী একটা নতুন মালসা রেখে তাতে দুধ, একমুঠো আতপচাল এবং কয়েকটা গুড়ের বাতাসা দিয়ে বাঁশের ‘চোঁচালি’ বা পাঁকাটি দিয়ে জ্বাল দিতে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেটি পায়েসে পরিণত হয়, একেই দুধ উতলানো বলে। সেই পায়েস বাড়ির সকলে মিলে ভাগ করে খায়। এর পরের পর্ব হলো গোরুর যত্ন নেওয়া। গোরুর শিঙে তেল মাখিয়ে সেদিন স্নান করানো হয়, সন্ধেবেলায় ধূপ-দীপ দিয়ে অর্চনা করা হয়। তবে সবটুকু উপচার বর্তমানে তেমন পরিলক্ষিত হয় না। কারণ কৃষকদের ধ্যান-ধারণার অনেকখানি পরিবর্তন হয়েছে।

নববর্ষের আগের দিন চৈত্র সংক্রান্তিতে গ্রামে গ্রামে গাজন চলে। নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত মানুষগুলির অন্যতম আনন্দ-উৎসব এই গাজন। সারাদিনের উপবাস ভাঙে ঠিক পরের দিন অর্থাৎ নববর্ষের প্রথম দিন। ফলে খেটে খাওয়া মানুষগুলি গাজন-জনিত ত্যাগস্বীকারের পরীক্ষায় সফল হয়ে পুনর্বার কৃষিকার্যে নেমে পড়ে। এই নেমে পড়ার দিনটি তাদের কাছে ‘পুণ্যাহ’। সেদিন ১ বৈশাখ বলে সারা বছর যাতে কৃষিকাজ ভাল হয়, সেজন্য নিজের হাতে বা পুরোহিত দিয়ে পুজোর ব্যবস্থাও করে গৃহকর্তা। পরিষ্কৃত পোশাক পরার বিধিও রয়েছে। তবে বর্তমানে এইসব উপচার, সংস্কারে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে। মনে রাখা দরকার, বাঙালির শিকড় নিহিত আছে তার প্রাচীন সংস্কৃতিতেই। তার সত্যটুকু গ্রহণ করে আমাদের এগিয়ে চলতে হবে আগামীর দিকে।  

তথ্যসূত্র

১ রবীন্দ্র-রচনাবলী, বিশ্বভারতী, কলিকাতা, ১৪০২, ১৩শ খণ্ড, পৃঃ ৪৯৭
২ ঐ, ১৩৯১, ১৬শ খণ্ড, পৃঃ ৩৯৬
৩ ঐ, ১৩শ খণ্ড, পৃঃ ১১৮
৪ দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘গুম্ফ-আক্রমণ’ কাব্যের দ্বিতীয় সর্গে লিখেছেন : “বৃহৎ রুপার থালে/ পাচক ব্রাহ্মণ ঢালে,/ মাংসের পোলাও গাদা-গাদা।/ কি গুণ পাঁঠার হাড়ে,/ অম্বলের তার বাড়ে,/ কে বুঝিবে ইহার মর্যাদা।।”, দ্রঃ সোম, শোভন (সম্পাদিত), দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্রেষ্ঠ কবিতা, ভারবি, কলকাতা, ১৪০৮, পৃঃ ৯৯
৫ দ্রঃ অধিকারী, শ্রাবণী, ‘বাসনার সেরা বাসা রসনায়’, এই সময়, ৯ মে ২০২১
৬ দ্রঃ রায়, দীনেন্দ্রকুমার, পল্লীচিত্র (ভগবতী যাত্রা অংশ), রায় এন্ড রায়চৌধুরী, কলকাতা, ১৯০৪, পৃঃ ৩৭—৪০
৭ আহমদ ছফা রচনাবলী, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা, ২০১৭, ৪র্থ খণ্ড, পৃঃ ২৫১
৮ ঐ, পৃঃ ২৫২
৯ শ্রীম-কথিত, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০১১, অখণ্ড, পৃঃ ১০৩৬
১০ পল্লীচিত্র, পৃঃ ৪০-৪১