“হে ভারত, ভুলিও না—তোমার নারীজাতির আদর্শ সীতা, সাবিত্রী, দময়ন্তী…।”—স্বামী বিবেকানন্দ

এ এক বহুশ্রুত প্রাচীন কাহিনি। বহু লেখক এর সাথে নিজ মনের মাধুরী মিশিয়ে এক অপূর্ব কাহিনি রচনা করে গিয়েছেন, যা আমাদের কাছে অবিস্মরণীয়। বৈদিক সাহিত্যের ‘শতপথ ব্রাহ্মণ’-এ নিষধরাজ নলের উল্লেখ আছে। নিষধ একটি ছোট রাজ্য। এছাড়া মৎস্যপুরাণ, লিঙ্গপুরাণ, পদ্মপুরাণ ও ব্রহ্মাণ্ডপুরাণে এই নল-দময়ন্তীর ভাগ্যবিড়ম্বিত জীবন নিয়ে অপূর্ব কাহিনির সৃষ্টি রয়েছে। মহাভারতের বনপর্বে বিশেষভাবে এটি উল্লিখিত।

পাশাখেলায় পরাজিত পাণ্ডবগণ যখন দ্বৈতবনে বাস করছিলেন, তখন পাশাখেলার বিষময় পরিণতির কথা বোঝাতে গিয়ে বৃহদশ্ব মুনি এই কাহিনি শুনিয়েছিলেন। এই কাহিনি উত্তরকালের কবিদের উপজীব্য হয়ে উঠেছে। কালিদাসের রচনায় ‘নলোদয়’ কাব্যের উল্লেখ আছে। দ্বাদশ শতকের কবি শ্রীহর্ষ রচনা করেন নৈষধচরিত। সংস্কৃতে রচিত অগস্ত ভট্টের নলকীর্তি কৌমুদী, বামন ভট্টের নলাভ্যুদয়, কৃষ্ণকবির নৈষধপারিজাত, চক্রকবির দময়ন্তী পরিণয় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

পাণ্ডবগণ যখন দ্বৈতবনে বসবাস করছেন, তখন অর্জুন অস্ত্রলাভের জন্য দেবলোকে যান। বহুদিন গত হলেও অর্জুন ফিরে না আসায় ভীম ও বৃহদশ্ব মুনির কাছে মনের দুঃখ প্রকাশ করে যুধিষ্ঠির বলেন : “আমার মতো হতভাগ্য ব্যক্তি আর কেউ নেই।” তখন বৃহদশ্ব মুনি যুধিষ্ঠিরকে বলেন : “আপনার চেয়েও হতভাগ্য আরেক মহারাজের কথা বলি শুনুন।” যুধিষ্ঠির উক্ত রাজকাহিনি শোনার জন্য ব্যস্ত হয়ে অন্য ভাইদেরও ডাকলেন, কাহিনি আরম্ভ করলেন বৃহদশ্ব মুনি।

নিষধ রাজ্যে চন্দ্রবংশ-জাত বীরসেন নামে এক রাজা ছিলেন, নল হলেন এঁর পুত্র। রূপবান, গুণবান, মহাপরাক্রমশালী, যুদ্ধবিশারদ, রথচালনায় নিপুণ বলে নলের খ্যাতি ছিল। কিন্তু তিনি ছিলেন দ্যূতক্রীড়াসক্ত। ঐ সময় বিদর্ভ দেশে এক রাজা ছিলেন, তাঁর নাম ভীম। ভীম নিঃসন্তান ছিলেন। একদিন দমন নামে এক ব্রহ্মর্ষি এসে ভীমের রাজ্যে উপস্থিত হন। রাজা ও রাজমহিষী ব্রহ্মর্ষির সেবায় মনোনিবেশ করেন। সন্তানলাভের আকুতি দেখে ব্রহ্মর্ষি দমন খুশি হয়ে তাঁদের তিন পুত্র ও এক কন্যা লাভের বরদান করেন। যথাসময়ে দম, দান্ত ও দমন নামে তিন পুত্র ও দময়ন্তী নামে এক কন্যা জন্মগ্রহণ করে। রাজকন্যা অসামান্যা রূপবতী, তেজস্বিনী, যশস্বিনী ও সৌভাগ্যশালিনী হয়ে ওঠে। একারণে দেবতা, য‌ক্ষ, র‌ক্ষ, গন্ধর্বরাও দময়ন্তীর রূপের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হন। তৎকালীন প্রথা হিসাবে কন্যার বিবাহের জন্য রাজা রাজকন্যার গুণাবলি প্রচারে চারণকবিদের দায়িত্ব দেন। এই চারণ কবিগণ রাজা নলের সভায় প্রচার করে যান দময়ন্তীর রূপগুণের কাহিনি। অপরদিকে নলরাজার কাহিনিও প্রচারিত হলো রাজা ভীমের রাজসভায়। এইভাবে দূতের মুখে নল ও দময়ন্তী উভয়ের গুণকীর্তন শুনে পরস্পরের প্রতি আকৃষ্ট হলেন।

রাজা নল একবার দময়ন্তীকে পাওয়ার জন্য নির্জন কাননে ভারাক্রান্ত মনে দিন কাটাচ্ছেন, এমন সময় কতকগুলি স্বর্ণবর্ণের হাঁস কোথা থেকে উড়ে এল। রাজা একটি হাঁসকে ধরে ফেললেন। ভীত হাঁসটি রাজাকে বলল : “হে রাজন, আপনি আমাকে হত্যা করবেন না, আমি আপনার প্রিয়কার্য করব। আমি দময়ন্তীর কাছে আপনার (রূপ, গুণ, কর্ম‌ক্ষমতা, অস্ত্রশস্ত্রবিদ্যার পারদর্শিতা) বর্ণনা এমনভাবে করব, যাতে তিনি অন্য কোনো পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট না হয়ে আপনারই অনুরক্ত হন।”

একইভাবে দময়ন্তীর প্রমোদকাননে যেখানে তিনি তাঁর সখীদের সঙ্গে ক্রীড়ারতা, সেখানেও সেই রাজহংসের দলটি উড়ে এসে ইতস্তত চরে বেড়াতে লাগল। দময়ন্তী-সহ সখীগণ এই অপূর্ব সোনার বরণ হাঁস দেখে তাদের ধরার চেষ্টা করতে লাগলেন। সহসা একটি হাঁস মানুষী কণ্ঠে রাজকন্যাকে বলল : “হে দময়ন্তী! নিষধ দেশে নল নামে এক রাজা আছেন। তোমার জীবন ধন্য হয়ে যাবে যদি তুমি তাঁর পত্নী হতে পার। তুমি নারীগণের মধ্যে রত্নস্বরূপা এবং নল হলেন মনুষ্যগণের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ।”

বিদর্ভরাজ ভীম তাঁর কন্যার স্বয়ংবরের সংবাদ জানিয়ে দেশ-বিদেশের রাজাদের আমন্ত্রণ জানালেন। দময়ন্তীর রূপের কথা শুনে ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ, যম—এঁরাও বিদর্ভ রাজ্যের দিকে যাত্রা করলেন। পথে নলের সঙ্গে এই দেবতা চতুষ্টয়ের দেখা। দেবতারা নলকে বললেন : “তুমি ধর্মপরায়ণ ও ন্যায়পরায়ণ, তাই তোমাকে দূতের কর্ম করতে হবে। দময়ন্তীর কাছে গিয়ে বলতে হবে—দেবতারা তোমাকে বিবাহ করতে ইচ্ছুক।” ইন্দ্র নলকে এমন এক বিদ্যা শিখিয়ে দিলেন যাতে নল বিনা বাধায় দময়ন্তীর কাছে পৌঁছে গেলেন ও সমস্ত সংবাদ জানালেন। দময়ন্তী বললেন, ইতিমধ্যেই তিনি নলকে বিবাহ করার জন্য মনস্থির করে ফেলেছেন। যদি তাঁকে  প্রত্যাখ্যান করেন তাহলে তিনি বিষপানে বা অগ্নিতে আত্মাহুতি দিয়ে প্রাণত্যাগ করবেন।

যথাসময়ে স্বয়ংবরসভার আয়োজন হলো। অনেক রাজার সঙ্গে চারজন দেবতাও উপস্থিত—নলের রূপ ধারণ করে। দময়ন্তী স্বয়ংবরসভায় উপস্থিত হলে রাজকর্মচারিগণ রাজাদের নাম, ধাম, গুণাবলি বলে যেতে লাগলেন। দময়ন্তী দেখলেন পাঁচজন দেবপুরুষ সভায় উপস্থিত। সকলকে একইরকম দেখতে, তাই কে নল তা চিনতে পারলেন না। অবশেষে দময়ন্তী দেবতাদের শরণাপন্ন হয়ে মনে মনে বললেন : “আমি হংসমুখে নলের গুণাবলির পরিচয় পাওয়ার পরই তাঁকে  পতিত্বে বরণ করেছি। যাতে আমি আমার শরীর ও মনের পবিত্রতা র‌ক্ষা করতে পারি, দ্বিচারিণী না হই সেবিষয়ে আপনারা আমাকে সাহায্য করুন।” তখন দেবতারা তাঁদের নিজ নিজ চিহ্ন ধারণ করলেন। ঐ পাঁচজনের মধ্যে একজনের চোখের পাতা পড়ছে এবং গলার মালা প্রায় শুকিয়ে গিয়েছে দেখে দময়ন্তী সিদ্ধান্ত নিলেন, ইনিই নল। কারণ, দেবতাদের চোখের পাতা পড়ে না, শুকিয়ে যায় না তাঁদের গলার মালা। মানুষের ছায়া পড়ে, দেবতাদের পড়ে না। বুদ্ধিমতী দময়ন্তী ধীরে ধীরে অগ্রসর হয়ে নলের গলায় বরমাল্য দান করে তাঁকে  পতিত্বে বরণ করলেন। হতাশ রাজারা হাহাকার করলেন এই দৃশ্য দেখে। দেবতারা স্তুতিবাক্য প্রদান করে সাধুবাদ জানালেন এবং আটটি বরদান করলেন—তাঁদের দেবদর্শন ও পরমগতি লাভ হবে, তাঁরা যেখানে আত্মপ্রকাশ করার ইচ্ছা করবেন, সেখানেই আবির্ভূত হতে পারবেন, ধর্মরাজের বরে ধর্মনিষ্ঠায় অবিচলিত থাকবেন, যেমন খুশি রন্ধন করলে তা সুস্বাদু হবে ইত্যাদি।

দেবতারা যখন স্বর্গরাজ্যে ফিরে যাচ্ছিলেন, পথে দেখা হলো কলি ও দ্বাপরের সঙ্গে। কথাবার্তায় দেবতারা বুঝলেন, এঁরা স্বয়ংবরসভায় যোগ দিতে যাচ্ছেন। দেবতারা তাঁদের বললেন, স্বয়ংবরসভা হয়ে গিয়েছে, দময়ন্তী নলকে পতিত্বে বরণ করেছেন। তখনি কলি স্থির করলেন নলকে সুখে থাকতে দেবেন না।

বিবাহের পর কয়েক বছর এই দম্পতি সুখে জীবনযাপন করলেন, ধর্মানুসারে রাজকার্য পরিচালনা ও প্রজানুরাগী হয়ে উঠলেন, এরপর অশ্বমেধ যজ্ঞও করলেন। ইতিমধ্যে তাঁদের এক পুত্র ও এক কন্যার জন্ম হয়—ইন্দ্রসেন ও ইন্দ্রসেনী।

কিন্তু কলির কুপ্রভাবে নলের জীবনে এল দুঃসময়। জীবনের প্রথম থেকেই ইনি দ্যূতক্রীড়ায় আনন্দ পেতেন। স্নেহের ভ্রাতার সঙ্গে এবার পাশাখেলায় প্রবৃত্ত হয়ে ধীরে ধীরে রাজকার্য, এমনকী পুত্র-কন্যার প্রতি অবহেলা করতে লাগলেন। দময়ন্তী ছেলেমেয়েকে তাঁর পিতৃগৃহে পাঠিয়ে দিলেন। রাজা নল পত্নী ও মন্ত্রীদের উপদেশ, অনুরোধ উপে‌ক্ষা করলেন, রাজ্যের ধনসম্পদ প্রায় নিঃশেষ হলেও তিনি পাশাখেলায় মত্ত রইলেন। পাশাখেলার শর্ত হিসাব ভাই পুষ্কর প্রথমে রাজ্য ও পরে দময়ন্তীকে পণ হিসাবে রাখতে বললেন। ভাইয়ের দময়ন্তীকে পণ রাখার কথায় নলের মোহভঙ্গ হলো। রাজ্যহীন, সহায়সম্পদহীন রাজা নল রাজবেশ পরিত্যাগ করে, সাধারণ বস্ত্র পরিধান করে নগ্নপদে  রাজপ্রাসাদ থেকে বের হলেন। পতিব্রতা দময়ন্তী ছায়ার মতো স্বামীকে অনুসরণ করলেন। ‌ক্ষুধায়, পিপাসায় কাতর হয়ে তাঁরা গভীর বনে প্রবেশ করলেন, দেখলেন সোনার পালকযুক্ত বেশ কিছু পাখিকে। কলির প্রভাবে হিতাহিত জ্ঞানবর্জিত নল পাখি ধরার জন্য একমাত্র বস্ত্রখণ্ড ছুঁড়ে পাখি ধরতে চেষ্টা করলেন। বস্ত্রখণ্ড সমেত উড়ে গেল প‌‌ক্ষিকুল। উলঙ্গ নল স্তম্ভিত হয়ে নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে রইলেন। দময়ন্তী নিজের বস্ত্রের অর্ধেক নলকে দিয়ে তাঁর লজ্জা নিবারণ করলেন।

নল দময়ন্তীকে বারবার অনুরোধ করতে লাগলেন তাঁর পিতৃগৃহে ফিরে যাওয়ার জন্য। কিন্তু দময়ন্তী বললেন : “এ কি স্ত্রীর ধর্ম? তুমি ক্লান্ত, ‌ক্ষুধার্ত, বিষণ্ণ, রাজ্যহীন—এই সময়ে তোমাকে ছেড়ে কীভাবে আত্মসুখের দিকে চেয়ে পিতৃগৃহে গমন করব? তোমাকে সত্য বলছি, দুঃখের সময় পত্নীর সমান অন্য কোনো ওষুধ নেই।”

দময়ন্তী নলকে অনুরোধ করলেন উভয়েই তাঁর পিতৃগৃহে যাওয়ার জন্য। রাজি হলেন না নল। সারারাত্রি স্বামীকে খুশি রাখার জন্য দময়ন্তী পরিচর্যায় নিরত থাকলেন এবং নিজেকে সৌভাগ্যশালিনী ভাবতে লাগলেন। তাঁর ক্লান্ত দেহ সহসা গভীর নিদ্রায় মগ্ন হয়ে গেল। এসবই কলির প্রভাব। কলি নলের চরিত্রে একটি ত্রুটি ধরে ফেললেন। নল অশুদ্ধ অবস্থায় সন্ধ্যাবন্দনায় নিরত হওয়ায় কলির বিশেষ সুযোগ এল নলকে বিভ্রান্ত করার। ঘুমন্ত দময়ন্তীর পরিধেয় বস্ত্রের অর্ধাংশ কেটে পরিধান করে নল বেরিয়ে গেলেন। নিদ্রা থেকে উঠে দময়ন্তী উন্মত্তের ন্যায় উচ্চ চিৎকারে কেঁদে কেঁদে শেষে ‌ক্ষোভে দুঃখে সংজ্ঞা হারালেন। সংজ্ঞাপ্রাপ্তির পর কিন্তু নলের প্রতি একবারও ভর্ৎসনা বা অপ্রিয় বাক্য প্রয়োগ করলেন না।

একাকিনী শোকাকুলা দময়ন্তী ইতস্তত বনমধ্যে ঘুরতে ঘুরতে এক ঋষির আশ্রম দেখতে পেলেন। দময়ন্তীকে দেখে ঋষিগণ নিজ কন্যার মতো তাঁকে  খাদ্য, বস্ত্র ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করে দিলেন। দময়ন্তী বললেন : “যদি আমি আমার স্বামী নলকে কিছুদিনের মধ্যে দেখতে না পাই, তাহলে আমার এই বিড়ম্বিত জীবন বিসর্জন দিয়ে অন্য একটি শ্রেয়োতর জীবন লাভ করব। স্বামী কর্তৃক পরিত্যক্ত এই জীবনের কোনো সার্থকতা নেই। তাঁর বিরহ-বেদনায় কাতর এই জীবন আমি কীভাবে ধারণ করব?”

পতিব্রতা এই রমণীর নিখাদ ভালবাসায় ঋষিদের হৃদয় বিগলিত হলো। তাঁরা বললেন : “হে কল্যাণি, আমরা দিব্যদৃষ্টিতে দেখতে পাচ্ছি তোমার সুখের ভবিষ্যৎ শীঘ্রই সমাগত, তুমি অচিরেই নলকে দেখতে পাবে। তুমি দেখতে পাবে, তিনি সকল পাপমুক্ত ও সর্বপ্রকার অলংকারে ভূষিত হয়েছেন। তিনি পুনরায় তাঁর রাজ্য শাসন করছেন, তাঁর শত্রুগণকে দমন করছেন, তাঁর শুভার্থী অনুগত জনকে সান্ত্বনা, সুখ দিচ্ছেন ও সর্বপ্রকার মঙ্গলকর সুখ সম্ভোগ করছেন।”   

মুনিদের এই মধুর আশ্বাসবাক্যে দময়ন্তীর হৃদয় আনন্দে অভিভূত হলো। তাঁর বিভ্রান্ত মন শান্ত সংযত হলো। চ‌ক্ষু মুদ্রিত করে তিনি সেইসব কথা ভাবতে লাগলেন। চোখ খোলার পর তিনি অবাক হলেন, কোথায় ঋষির আশ্রম! তাঁর এটি দৈবদর্শন মাত্র।

পতিবিরহে দময়ন্তী বিলাপ করে বলতে লাগলেন : “হে ধর্মজ্ঞ, হে সত্যাশ্রয়ী নল! যদি তুমি অরণ্যের মধ্যে কোথাও থাকো, তবে তোমার স্নিগ্ধমধুর কণ্ঠে আগের মত একবার আমায় বৈদর্ভী বলে আহ্বান কর।”১০ তিনদিন তিনরাত্রি হাঁটতে হাঁটতে দময়ন্তী এক দিব্য কাননে উপস্থিত হলেন। সেখানে বশিষ্ঠ, ভৃগু, অত্রির মতো মুনি-ঋষিরা বাস করেন। দময়ন্তী নিজের পরিচয় দিলে তাঁরা আশ্বাস দিলেন যে, অবিলম্বে নলের সঙ্গে সা‌ক্ষাৎ হবে। পথে একদল বণিকের সা‌ক্ষাৎ পেলেন দময়ন্তী। বণিকরা বলল যে, তারা চেদিরাজ সুবাহুর রাজ্যে যাবে। দময়ন্তী তাদের সঙ্গে পৌঁছাল চেদিরাজ সুবাহুর রাজধানীতে।

মলিনবসনা এই অপূর্ব সুন্দরীকে রাজমাতা দর্শন করলেন প্রাসাদ থেকে। ধাত্রীকে আদেশ করলেন তাঁকে  ডেকে নিয়ে আসতে। রাজমাতার কাছে দময়ন্তী তাঁর পরিচয় এবং সমস্ত ঘটনার বিবরণ দিলেন। রাজমাতা দময়ন্তীকে প্রাসাদে থাকার অনুমতি দিয়ে আশ্বাস দিলেন : “তুমি তোমার স্বামীকে এখান থেকেই ফিরে পাবে।” দময়ন্তী উত্তরে বললেন : “আমি এই প্রাসাদে থাকতে রাজি আছি, কিন্তু কয়েকটি শর্ত আছে। প্রথমত, আমি কারো উচ্ছিষ্ট ভোজন করব না; দ্বিতীয়ত, কোনো পুরুষের সঙ্গে কথা বলব না; তৃতীয়ত, যদি কোনো পুরুষ আমাকে প্রার্থনা করে আপনি তাকে শাস্তি দেবেন—আমার সতীত্ব র‌ক্ষা করবেন।”১১ রাজমাতা শুনে খুশি হয়ে শর্তে রাজি হলেন। শুধু রাজি হলেন তা নয়, নিজ কন্যা সুনন্দাকে ডেকে বললেন এই নারীকে সখীরূপে গ্রহণ করতে। সুনন্দা মায়ের ইচ্ছায় দময়ন্তীকে অন্তঃপুরে নিয়ে গেলেন।

এরপর নলও বন থেকে বনান্তরে গমন করতে করতে দাবানলে পুড়ে প্রায় ছারখার হয়ে যাওয়া একটি বনে পৌঁছালেন। একটি প্রাণী আত্মর‌ক্ষার জন্য চিৎকার করছে শুনে তিনি সেখানে হাজির হয়ে দেখলেন, এক বৃহদাকার সর্প কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। নিষধরাজকে দেখে সেই সাপ বলল : “আমার নাম কর্কোটক। মহর্ষি নারদের সঙ্গে প্রবঞ্চনা করায় তাঁর অভিশাপে আমার এই অবস্থা। আপনার আগমনে আমার শাপমুক্তি ঘটবে—এটাই নারদের কথা ছিল।”১২ নাগরাজের এমন কথা শুনে নল অভয় দিয়ে দাবানল থেকে তাকে বাঁচালেন। নল নাগরাজের সঙ্গে যেতে লাগলেন। পথে সহসা নাগরাজ নলকে দংশন করল, সঙ্গে সঙ্গে নলের রূপ পরিবর্তিত হলো, কর্কোটকের রূপও পরিবর্তিত হলো। রাজাকে সান্ত্বনা দিয়ে কর্কোটক বলল : “আপনাকে যাতে কেউ চিনতে না পারে, তার জন্যই আমি আপনার রূপ পরিবর্তন করে দিয়েছি। এছাড়া যে ক্রূর কলি আপনার দেহকে আশ্রয় করে আপনাকে চরম দুঃখের অতল সাগরে ভাসিয়ে দিয়েছে, সেই দুরাত্মা আমার বিষে জর্জরিত হয়ে আপনার শরীরে বাস করবে। আপনি সব সময়েই যে কোনো সংগ্রামে আপনার শত্রুদের পরাজিত করতে স‌ক্ষম হবেন।… এখন আপনি অযোধ্যায় ই‌ক্ষ্বাকু বংশের রাজা ঋতুপর্ণের কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় গোপন করে সেখানে বাহুক নাম ধারণ করে রাজার সারথিরূপে থাকবেন। সেখানে মহারাজ ঋতুপর্ণের পাশাখেলা এবং আপনার অশ্বচালনা বিদ্যা পরস্পর বিনিময় করে পরবর্তিকালে আপনি সুখী হবেন। তারপর যখন আপনার নিজস্ব পূর্বরূপ ধারণ করার ইচ্ছা হবে, তখন আমাকে স্মরণ করে আমার দেওয়া এই বসন পরিধান করে কোনো সতী রমণীর স্পর্শলাভ করলে আপনার পূর্বের রূপ ফিরে পাবেন।”১৩

মহারাজা নল দশদিন পর অযোধ্যায় মহারাজ ঋতুপর্ণের রাজসভায় এসে ‘বাহুক’ নাম নিয়ে, সুদ‌ক্ষ অশ্বপরিচালক বলে নিজের পরিচয় দিলেন। এছাড়া তিনি রন্ধনবিদ্যায় পারদর্শী—একথাও বলতে ভুললেন না। রাজা ঋতুপর্ণ তাঁর সব কথা শুনে বিশ্বাস করলেন এবং নলকে অশ্বাধ্যক্ষরূপে নিযুক্ত করলেন, ঘোড়াগুলি যাতে দ্রুতগামী হয় তারও ব্যবস্থা নিতে বললেন। আপাতত নিদারুণ মনকষ্টের মধ্যে রাজা নল অযোধ্যায় ঋতুপর্ণের প্রাসাদে এবং দময়ন্তী চেদিরাজ সুবাহুর প্রাসাদে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে দিন কাটাতে লাগালেন।

এদিকে বিদর্ভরাজ ভীম বহু অর্থ দিয়ে দিকে দিকে শত শত ব্রাহ্মণ প্রেরণ করলেন, ঘোষণা করলেন— নল-দময়ন্তীকে সশরীরে আনতে পারলে পুরস্কারস্বরূপ এক হাজার গাভী ও একখানি গ্রাম দান করা হবে। কিন্তু ব্রাহ্মণেরা কোনো সংবাদ আনতে স‌ক্ষম হলেন না। ইতিমধ্যে ‘সুদেব’ নামে এক ব্রাহ্মণ বহু দেশ ঘুরতে ঘুরতে চেদিরাজ্যে উপস্থিত হলেন ও রাজকন্যা সুনন্দার সঙ্গে দময়ন্তীকে দেখতে পেলেন। সুদেব দময়ন্তীর দাদা ইন্দ্রসেনের বন্ধু ছিলেন, তাই তাঁকে  চিনতে অসুবিধা হলো না। তিনি দময়ন্তীকে তাঁর মা-বাপ ও পুত্র-কন্যার কুশল সংবাদ দিলেন। দময়ন্তীও সুদেবকে চিনতে পারলেন। রাজমাতা মহাত্মা দশার্ণরাজ সুদামার কন্যা। রাজমাতা দময়ন্তীকে বললেন : “দশার্ণরাজ তোমার মাকে বিদর্ভরাজ ভীমের হাতে এবং আমাকে চেদিরাজ বীরবাহুর হাতে অর্পণ করেছিলেন।”১৪ অর্থাৎ রাজমাতা দময়ন্তীর মাসি। তিনি রাজকীয় ব্যবস্থায় দময়ন্তীকে তাঁর পিতৃগৃহে প্রেরণ করলেন।

এদিকে দময়ন্তী স্বামীর সংবাদ পাওয়ার জন্য ব্যাকুল। অনেক অনুসন্ধানের পর জানা গেল, বাহুক নামে এক রাজপুরুষ—দেখতে অতীব কুৎসিত, কিন্তু কর্মে দ‌ক্ষ—ঋতুপর্ণের সারথি হিসাবে নিযুক্ত।

দময়ন্তী এক ব্রাহ্মণকে দায়িত্ব দিলেন অযোধ্যায় পৌঁছে মহারাজ ঋতুপর্ণকে জানাতে যে, বিদর্ভরাজ ভীমের কন্যা দময়ন্তী বহু দিন গত হলেও নলের কোনো সংবাদ না পাওয়ায় পুনরায় স্বয়ংবরের ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। ঋতুপর্ণ অশ্ব-বিশারদ বাহুককে ডেকে ঐ সভায় একদিনের মধ্যে পৌঁছানোর দায়িত্ব দিলেন। সংবাদ শুনে বাহুক অর্থাৎ নলের হৃদয় বিদীর্ণ হলো। তিনি রাজি হলেন যথাসময়ে ঋতুপর্ণকে স্বয়ংবরসভায় পৌঁছে দিতে।

ঋতুপর্ণের রথ সন্ধ্যার সময় বিদর্ভ নগরীতে পৌঁছাল। পূর্বে যেমন ঘোড়াগুলি উল্লসিত হতো এবারে তারা সেইভাবেই উল্লসিত হয়ে উঠল। রথের শব্দ আকাশ-বাতাস মুখরিত করল। দময়ন্তীর উপলব্ধি হলো—এ তাঁর বহু পরিচিত শব্দ, মনে আনন্দের জোয়ার আসছে, মনে হচ্ছে নলই এখানে এসেছেন। দময়ন্তী এক দূতীকে আদেশ করলেন : “ঐ যে বিকৃতদেহ, ছোট ছোট হস্তপদ—ওঁর পরিচয় জিজ্ঞাসা করে এস। মনে হচ্ছে উনিই নল।” সত্যই উনি নল। নল দময়ন্তীকে বললেন : “তোমার মতো পতিব্রতা ধর্মপত্নীকে পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি—তা শুধুমাত্র দুরতিক্রমণীয় কলির দুষ্ট প্রভাবে।” দময়ন্তী নলের সামনে এসে যুক্তকরে বললেন : “আমি আপনার পাদস্পর্শ করে বলছি—এই দ্বিতীয়বার স্বয়ংবরা হওয়া শুধু আপনাকে এখানে আনার জন্য। যদি আমি কখনো শরীরে বা মনে পাপাচরণ করে থাকি তাহলে এই সময়েই আমার দেহত্যাগ হবে।” এমন সময় অন্তরী‌ক্ষ থেকে পবনদেব বললেন : “হে ধর্মজ্ঞ রাজা নল! দময়ন্তী কখনো কোনোরকম পাপাচরণ করেন না।”১৫ এই সময়ে নল পূর্বে প্রাপ্ত কর্কোটক-প্রদত্ত বস্ত্র পরিধান করলেন ও তাঁকে  স্মরণমাত্রই তিনি তাঁর পূর্বের দেহকান্তি ফিরে পেলেন।

নল তাঁর ধর্মপত্নীর সঙ্গে মিলিত হয়েছেন জেনে অযোধ্যারাজ ঋতুপর্ণ খুশি হয়ে তাঁর কাছে এসে ‌ক্ষমা প্রার্থনা করলেন অজ্ঞাতসারে করে ফেলা অপরাধের জন্য। উত্তরে রাজা নল বললেন : “আপনার কোনো অপরাধ হয়নি। আপনার কাছে থাকাকালীন আমার কোনো অসম্মান হয়নি।”১৬ এই বলে নল ঋতুপর্ণকে অশ্ববিদ্যা এবং ঋতুপর্ণ নলকে পাশাতত্ত্ব বিষয়ে জ্ঞান দান করলেন।

এরপর নিষধরাজ নল নিজ রাজ্যে ফিরে গিয়ে ভাই পুষ্করকে পাশাখেলায় আমন্ত্রণ জানালেন। এবার অর্থ ছাড়া নিজ ধর্মপত্নীকেও পণ রাখতে রাজি। পুষ্কর আগেকার ধারণা নিয়ে বলল : “এবার দময়ন্তীকে পণ রাখতে হবে—তাকে দাসীরূপে নিযুক্ত করব।” আরম্ভ হলো পাশাখেলা, নল পুষ্করের যথাসর্বস্ব জয় করে নিলেন—এমনকী প্রাণ পর্যন্ত।১৭

কনিষ্ঠ ভ্রাতার প্রতি কর্তব্যজ্ঞানে নল পরাজিত পুষ্করকে হৃত ধনসম্পত্তি সব ফিরিয়ে দিলেন। ভাইকে আশীর্বাদ করলেন শতবর্ষ পরমায়ু নিয়ে সুখে কালযাপন করার। পুষ্করেরও মোহ দূর হয়ে গিয়েছে। বড় ভাইয়ের কাছে নিজের দোষত্রুটি স্বীকার করে ‌ক্ষমাপ্রার্থনা করলেন।

যতদিন ভারতবর্ষ বেঁচে থাকবে ততদিন দময়ন্তীর পতিপ্রেম হিন্দুনারী স্মরণ করবে।

“পুণ্যশ্লোকো নলোরাজা পুণ্যশ্লোকো যুধিষ্ঠিরঃ।
পুণ্যশ্লোকা চ বৈদেহী পুণ্যশ্লোকো জনার্দনঃ।।
কর্কোটকস্য নাগস্য দময়ন্ত্যা নলস্য চ।
ঋতুপর্ণস্য রাজর্ষেঃ কীর্তনং কলিনাশনম্।।”১৮

তথ্যসূত্র

১   স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ২০১৫, ৬ষ্ঠ খণ্ড, পৃঃ ১৯৪

২   ‘বনপর্ব’, মহাভারতম্, বিশ্ববাণী প্রকাশনী, কলিকাতা, ১৩৮৪, ৪৪।৫০—৫২

৩   ঐ, ৪৫।২০-২১

৪   দ্রঃ ঐ, ৪৫।২৮—৩১

৫   দ্রঃ ঐ, ৪৬।৩১—৩৭

৬   দ্রঃ ঐ, ৪৭।১৭—২১

৭   দ্রঃ ঐ, ৫১।২৭—২৯

৮   দ্রঃ ঐ, ৫৩।৮৮-৮৯

৯   দ্রঃ ঐ, ৫৩।৯১—৯৪

১০  হালদার, সুজিতকুমার, নল-দময়ন্তী-কথা, সংস্কৃত পুস্তক ভাণ্ডার, কলিকাতা, ১৯৯৮, পৃঃ ২০

১১  দ্রঃ ‘বনপর্ব’, মহাভারতম্, ৫৩।১৯৪—১৯৮

১২  দ্রঃ ঐ, ৫৪।৪—৬

১৩  নল-দময়ন্তী-কথা, ৫৪।১৪—২৫

১৪  দ্রঃ ‘বনপর্ব’, মহাভারতম্, ৫৬।৫৩-৫৪

১৫  দ্রঃ ঐ, ৬০।৩৯—৪১; ৬২।১৭, ২৯—৩৯

১৬  দ্রঃ ঐ, ৬৩।১৪

১৭  দ্রঃ ঐ, ৬৪।৪—১৯

১৮ তন্ত্র জ্যোতিষশাস্ত্রী, রত্নেশ্বর (সংকলক), ‘পুণ্যশ্লোকো-নামকীর্তনম্’, বিশুদ্ধ স্তব-কবচমালা, ওরিয়েন্ট লাইব্রেরী, কলিকাতা, ১৪০৮, পৃঃ ৮

প্রবীণ সন্ন্যাসী, বেলুড় মঠ