ধর্ম-সংস্কৃতি ও অর্থনীতির যুগলবন্দি বহুকাল ধরেই বিদ্যমান। আরো সুস্পষ্টভাবে বললে বলা যেতে পারে যে, ধর্ম-সংস্কৃতি নানাভাবে অর্থনীতির গতিপথকে প্রভাবিত করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, একদিকে যেমন বহু স্থানে—ভারতে ও বিদেশে—পর্যটনশিল্প ধর্মস্থানকেন্দ্রিক, তেমনি অনেক ক্ষেত্রে পর্যটনশিল্প ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপ সাংস্কৃতিক উৎসব, রীতিনীতির ওপর নির্ভরশীল। বারাণসী, রোম ও মক্কার মতো পবিত্র ধর্মস্থানগুলি যেমন সেখানকার অর্থনৈতিক জীবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব বা জার্মানির মিউনিখ শহরের ‘অক্টোবর ফেস্ট’-এর অর্থনৈতিক গুরুত্বও অস্বীকার করার উপায় নেই।
কথায় আছে—বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ। নিন্দুকরা বলেন—বাঙালি উৎসবপ্রিয়। সমালোচকরা যাই বলুন না কেন, শিল্প, সাহিত্য, চারুকলা ও সংস্কৃতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাঙালি ও বাংলা, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ যে এক অগ্রণী স্থান অধিকার করে আছে তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। ব্যক্তিগতভাবে একদিকে যেমন রবীন্দ্রনাথ, মাদার টেরেসা, সত্যজিৎ রায়, অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়েরা আন্তর্জাতিক সম্মান ও পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন, অন্যদিকে আবার রাজ্য হিসাবেও পশ্চিমবঙ্গের জুটেছে কিছু জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই রাজ্যের দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে বা দাির্জলিং টয়ট্রেন, সুন্দরবনের জীবপরিমণ্ডল ইউনেস্কোর ঐতিহ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়েছে; পূর্ব কলকাতার জলাভূমি আন্তর্জাতিক রামসার তালিকাভুক্ত হয়েছে, বাঁকুড়ার আরাবারি বন সংরক্ষণ ব্যবস্থা পেয়েছে আন্তর্জাতিক পুরস্কার। আর অতি সম্প্রতি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও পুরস্কারের তালিকায় যুক্ত হয়েছে কলকাতা তথা বাঙালির দুর্গোৎসব। ইউনেস্কো এই উৎসবকে দিয়েছে মানব-ঐতিহ্যের শিরোপা। বাঙালির দুর্গাপূজা বা শারদোৎসব নিঃসন্দেহে বাঙালির বৃহত্তম ও শ্রেষ্ঠ উৎসব, যার জন্য রাজ্যবাসী সারাবছর অপেক্ষা করে থাকে অধীর আগ্রহে। এবার ইউনেস্কোর স্বীকৃতি এই উৎসবে এক নতুন মাত্রা যোগ করবে, যার গুরুত্ব শুধুমাত্র সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ থাকবে না, তার ব্যাপ্তি অর্থনৈতিকভাবেও অনুভূত হবে।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক বৃদ্ধি ও প্রসার নানাবিধ কারণে বাধাপ্রাপ্ত হয়েছে। যে-রাজ্য একদা দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক দিক থেকে অন্যতম অগ্রণী ছিল, কালক্রমে তা ক্রমশ পিছিয়ে পড়েছে। যদিও কৃষিক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ সামগ্রিকভাবে দেশের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ফল প্রদর্শন করেছে বলে অনেকে দাবি করেন, তবুও শিল্প ও কর্মসংস্থানের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের অর্থনৈতিক চিত্র আশাব্যঞ্জক নয়। এক বেহাল অর্থনীতির পরিপ্রেক্ষিতে শারদীয়া দুর্গোৎসবের অর্থনৈতিক গুরুত্ব ও প্রভাব নিঃসন্দেহে প্রণিধানযোগ্য। এখানে একটা বিষয়ের উল্লেখ করা প্রয়োজন, শারদীয়া দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে যে অর্থনীতি ও অর্থনৈতিক কার্যকলাপ আবর্তিত হয় তা প্রকৃতপক্ষে শুধুমাত্র দুর্গাপূজাতে সীমাবদ্ধ থাকে না; তার পরিধি দুর্গাপূজা ছাড়িয়ে লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজা ও জগদ্ধাত্রীপূজা পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। তবে এই পূজানির্ভর অর্থনীতির প্রাথমিক ও মূল চালিকাশক্তি হলো অবশ্যই দুর্গাপূজা।
দুর্গাপূজার মরশুমে রাজ্যজুড়ে অর্থনৈতিক কার্যকলাপ বিশেষত বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যবসা-বাণিজ্য সাময়িকভাবে বৃদ্ধি পায়। দুর্গাপূজা বঙ্গের অর্থনীতিতে এক বাড়তি অক্সিজেন নিয়ে আসে। পূজা উপলক্ষে ঠিক কত হাজার কোটি টাকার কারবার সৃষ্ট হয় তার সঠিক পরিমাপ হয়তো নেই। তবে ঠিক কী কী ক্ষেত্রে পূজাজনিত অর্থনীতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে তার আন্দাজ করা যেতে পারে। পূজা মরশুমে যে বিপুল পরিমাণে আর্থিক লেনদেন ঘটে ও সেই কারণে যে-পরিমাণ নিয়োগ বা শ্রমদিবস সৃষ্ট হয়, তার বৃহদংশই অসংগঠিত বা ‘informed’ ক্ষেত্রভুক্ত। এর ফলে উৎপাদন, নিয়োগ ও আর্থিক লেনদেনের প্রকৃত হিসাব পাওয়া সম্ভব নয় বা সেই বিষয়ে সঠিকভাবে পরিমাপ করা শক্ত কাজ। অর্থনীতির তত্ত্বানুসারে সঠিক আর্থিক নীতি প্রণয়ন ও রূপায়ণ সহজতর হয়—যেমন আর্থিক লেনদেন সংগঠিত বা ‘formed’ ক্ষেত্রভুক্ত হয়, কারণ তখন লেনদেনের প্রকৃত বা সঠিক তথ্য নীতিনির্ধারকগণের হাতে থাকে। পূজানির্ভর অর্থনৈতিক কার্যকলাপের ব্যাপকতা কিছুটা আন্দাজ করা যেতে পারে পূজা-উদ্যোক্তাদের বা বিভিন্ন সার্বজনীন পূজার বাজেট থেকে। বাঙালির দুর্গাপূজা সারা বাংলার ও বাঙালির মেনে নিয়েও বলা যেতে পারে যে, এই উৎসবের ভরকেন্দ্র অবশ্যই কলকাতা তথা বৃহত্তর কলকাতা। এই শহরে একাধিক বারোয়ারি দুর্গাপূজা কমিটি আছে, যাদের পূজার বাজেট কয়েক কোটি টাকা। শুধুমাত্র কলকাতা শহরেই আনুমানিক ১০০০ সার্বজনীন দুর্গাপূজা অনুিষ্ঠত হয় (এছাড়া আছে বিভিন্ন পরিবারের নিজস্ব পূজা)। আর কলকাতা-হাওড়া মিলে এই সংখ্যা আরো বাড়বে। কলকাতা-হাওড়া ও শহরতলি বাদ দিলেও পড়ে থাকে বিভিন্ন জেলা ও জেলার সদর শহরগুলোর অসংখ্য পূজা। যদি এসমস্ত বারোয়ারি পূজার বাজেট হিসাবের মধ্যে আনা হয়, তাহলে সেই অঙ্কটা নিঃসন্দেহে এক বিরাট আকার নেবে। সুতরাং শুধুমাত্র সার্বজনীন দুর্গাপূজা কমিটিগুলোই যে বিপুল অঙ্কের অর্থ পূজার বাজেটে রাখে, তার আর্থিক গুরুত্ব অসীম। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, কোনো ক্লাব যদি ২ লক্ষ টাকার বাজেট নির্ধারণ করে, তাহলে তার অর্থ হলো—উক্ত সংগঠকরা ২ লক্ষ টাকা পূজার আয়োজনে ব্যয় করবে এবং এর জন্য প্রাথমিকভাবে অন্তত ২ লক্ষ টাকার আর্থিক লেনদেন সংঘটিত হবে। কেইনসীয় গুণক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে এই প্রাথমিক ব্যয় পরবর্তী পর্যায়ে আরো কয়েকগুণ আয় (ও নিয়োগ) সৃষ্টি করবে।
এখন এই মরশুমি অর্থনীতিকে ক্ষেত্রগত দিক থেকে অনুধাবন করা প্রয়োজন। আগেই বলেছি, এই অর্থনীতির সংগঠিত ও অসংগঠিত দিক আছে—যার মধ্যে দ্বিতীয় অংশটি বৃহত্তর। পূজা উপলক্ষে একদিকে যেমন বিভিন্ন বস্তু, সেবা (service) ও শ্রমিকের চাহিদা সৃষ্টি হয়, অন্যদিকে তেমন বিভিন্ন ক্ষেেত্র জোগানেরও বৃদ্ধি ঘটে। চাহিদা-জোগানের ক্রিয়াকলাপ তথা বাজার-অর্থনীতি পূজার মরশুমে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। আর্থিক লেনদেন কী কী কারণে বা কোন ক্ষেত্রে উদ্ভূত হয়, সেই বিষয়টার দিকে নজর দেওয়া যাক। পূজা উপলক্ষে বাঙালিরা নতুন পোশাক ও জুতো ক্রয় করে থাকে। প্রকৃতপক্ষে প্রয়োজনীয় পরিধেয় বস্ত্রের বার্ষিক চাহিদার একটা বড় অংশ এই মরশুমেই কেনা হয়। এর সঙ্গে যুক্ত হয় ঘর-গৃহস্থালির প্রয়োজনীয় বিভিন্ন জিনিসপত্রের চাহিদা মেটানো। পোশাক ও জুতোর ক্ষেেত্র যে বিশাল পরিমাণ ও অর্থমূল্যের ব্যবসা-বাণিজ্য চলে, তার একটা বড় অংশ অসংগঠিত বাজারে ঘটে; এই বাজার রাস্তায় বসে এবং হাজার হাজার হকার রাজ্যজুড়ে সেই বিক্রিতে অংশ নেয়। অসংগঠিত বাজারের বিপুল বস্ত্রসম্ভার যা হকাররা বিক্রি করে, তা তৈরি হয় অসংখ্য ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পপ্রতিষ্ঠানে এবং ঘরোয়া বা কুটির শিল্পে। স্বাভাবিকভাবেই বোঝা যাচ্ছে যে, অসংখ্য মানুষ, পরিবার ও শ্রমিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উৎপাদন, উৎপাদিত দ্রব্যের পরিবহণ, মালপত্র ওঠানো-নামানো ও দ্রব্যাদি বিক্রয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকে। বস্ত্র ও পোশাকের বাজারের এই লেনদেনে আরেকটি শ্রেণিও অংশগ্রহণ করে; এরা হলো দরজি ও এই কাজের সঙ্গে যুক্ত শ্রমিক। এপ্রসঙ্গে একথাও বলা প্রয়োজন যে, তৈরি বা ‘রেডিমেড’ পোশাকের বাজারে অত্যাধুনিক বিপণি বা ‘শপিং মল’ বর্তমানে খুবই জনপ্রিয়। এক বিশেষ শ্রেণির ক্রেতা, যাদের এক বড় অংশই অল্পবয়স্ক এবং বহুজাতিক সংস্থায় কর্মরত, তারা এই নতুন ও অত্যাধুনিক বিপণি থেকেই কিনতে বেশি আগ্রহী। এক্ষেত্রে পোশাকের বাজার সংগঠিত ক্ষেত্রভুক্ত এবং এসকল বিপণি মূলত ‘branded’ বস্ত্রের বাজারভুক্ত। বস্ত্র ও পোশাকের মতো জুতোর ক্ষেত্রেও প্রায় একই ধরনের বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। তবে, বস্ত্রের ক্ষেত্রে অসংগঠিত ও কুটিরশিল্পের যে ব্যাপকতা বিদ্যমান, চর্মশিল্পের ক্ষেত্রে তার ব্যাপ্তি তুলনায় অনেকটাই কম (এখানে উল্লেখ্য, বর্তমানে জুতো-চপ্পলের উৎপাদনের মূল উপকরণ শুধুমাত্র চর্মেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং উৎপাদনের কাঁচামাল হিসাবে অন্যান্য উপকরণও যথেষ্ট ব্যবহৃত হয়)। অতএব দুর্গাপূজা তথা পূজা মরশুম উপলক্ষে বস্ত্র, পোশাক ও পাদুকা শিল্পের উৎপাদন ও তাদের কেন্দ্র করে ব্যবসা-বাণিজ্যের এক বিশাল বাজার ও লেনদেন সংগঠিত হয়, যার মাধ্যমে এক বিরাট জনগোষ্ঠীর আয় ও নিয়োগ সাময়িকভাবে নিশ্চিত হয়।
এবার আসা যাক বিভিন্ন বারোয়ারি ও পারিবারিক পূজার ক্ষেত্রে। সার্বজনীন পূজাতে মণ্ডপ তৈরির কাজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ইদানিং ‘থিমের পূজা’র সংখ্যা বেড়েছে এবং সেইসঙ্গে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তরফ থেকে একাধিক বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে অনেকগুলি পুরস্কারের প্রচলন হয়েছে। মণ্ডপসজ্জা, আলোকসজ্জা ও প্রতিমার নিরিখে পুরস্কার প্রদানের চল বেেড়ছে। এর ফলে স্বভাবতই মণ্ডপ ও আলোক সজ্জার সঙ্গে যুক্ত বিভিন্ন ছোট, মাঝারি ও বৃহৎ প্রতিষ্ঠান বা ডেকরেটর ও ব্যক্তির আর্থিক স্বার্থ জড়িয়ে থাকে। থিমের পূজার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধির জন্য মণ্ডপসজ্জার ক্ষেত্রে বিভিন্ন শিল্পী, কারিগর ও কলাকুশলীদের চাহিদা বৃদ্ধি পায়।
দুর্গাপূজা মরশুমের সঙ্গে মৃৎশিল্প ও কুমোরপাড়ার আর্থিক সম্পর্ক গভীর। কুমারটুলির মৃৎশিল্পীরা সারাবছর এই মরশুমের দিকে তাকিয়ে থাকে। শুধুমাত্র মৃৎশিল্পীরাই নয়, প্রতিমা তৈরির কাজের সঙ্গে জড়িয়ে থাকে আরো অনেকের জীবন-জীবিকা। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মূর্তি বা প্রতিমার অঙ্গসজ্জার সরবরাহকারী, শোলাশিল্পী, প্রতিমাবাহক ও অন্যরা। প্রকৃতপক্ষে পূজার আয়োজনে বিভিন্ন উপচার ও দশকর্মা-ভাণ্ডারগুলির প্রয়োজনীয়তারও উল্লেখ করা উচিত। এর সঙ্গে অবশ্যই যোগ করতে হবে পূজার প্রয়োজনে ফল-মূল ও ফুলের ব্যাপক চাহিদার। আর এই চাহিদা পূরণ করতে হলে হর্টিকালচার ক্ষেত্রের ভূমিকা অস্বীকার করা যায় না। বাঙালির এই শারদোৎসব উপলক্ষে কিছু কিছু পেশায় সাময়িকভাবে শ্রমিকের চাহিদা সৃষ্টি হয়, যার অন্যতম হলো বিভিন্ন মণ্ডপে ও পারিবারিক পূজায় ঢাকিদের আগমন। এই ঢাকিরা মূলত গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকে এবং বছরের এই বিশেষ মরশুমে গ্রাম থেকে শহরে সাময়িক পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে উপস্থিত হয় কিছু বাড়তি রোজগারের সন্ধানে। একইসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় পূজারি সম্প্রদায়ের কথাও। দরজিদের মতো পুরোহিতদেরও দম ফেলার সময় থাকে না।
দুর্গাপূজার প্রাক্কালে যদি কেনাকাটার বাজার তেজি হয় ও হরেকরকম পশরা ও উৎপাদিত পণ্যের চাহিদা বৃদ্ধি পায়, পূজা শুরুর কালে সেই বাজারে লেনদেন কমে আসে। পরিবর্তে পূজার দিনগুলিতে নতুন ধরনের চাহিদা সৃষ্টি হয়। পূজার দিনগুলিতে খাবারের হোটেল বা রেস্তরাঁয়, ফুটপাতে ও অন্যত্র এবং খাবারের ভ্রাম্যমাণ স্টলগুলোতে ভোক্তার ভিড় উপচে পড়ে। রেস্তরাঁগুলোতে চোখে পড়ে অপেক্ষারত মানুষের দীর্ঘ লাইন। পূজার মরশুমে, বিশেষত দুর্গাপূজার দিনগুলোতে খাবারের ব্যবসা দারুণভাবে ফুলে-ফেঁপে ওঠে। বহু বেকার মানুষ এমনকী গৃহবধূরাও খাবারের সাময়িক স্টল তৈরি করে পূজার কটা দিনে কিছু বাড়তি অর্থ রোজগারের আশা রাখে। অবশ্য শুধুমাত্র তৈরি খাবারের ব্যবসাই নয়, পূজার দিনগুলোতে সুরা ও পানীয় দ্রব্যের চাহিদাও সাংঘাতিক বৃদ্ধি পায় এবং সুরা বিক্রয়ের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে ইদানীং বিপুল আর্থিক লেনদেন সংঘটিত হয়।
দুর্গোৎসবকে কেন্দ্র করে একাধিক বৃহৎ বারোয়ারি মণ্ডপের নিকটে বিভিন্ন পণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয় চলে, যার মধ্যে পুস্তক বিক্রয়ও হয়ে থাকে। এই প্রদর্শনী ও বিক্রয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংস্থা, এমনকী রাজনৈতিক দলগুলোও কিছু বাড়তি লেনদেন তথা কেনাকাটার সুবিধা অর্জনে সচেষ্ট হয়। পূজা মরশুমের প্রত্যক্ষ প্রভাব আর যে বিশেষ কয়েকটি ক্ষেত্রে লক্ষ্য করা যায় সেগুলো হলো বিজ্ঞাপন ও মুদ্রণ শিল্প, পর্যটনশিল্প এবং মিষ্টান্নশিল্প। ইদানীং কলকাতার রাস্তাঘাট ও একাধিক বৃহৎ পূজামণ্ডপ বিভিন্ন দ্রব্যের বা প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপনে ছেয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে শহর জুড়ে ফ্লেক্স ও ব্যানারের সর্বব্যাপী উপস্থিতি নজর কাড়ে। এই বিষয়টার জন্য যেমন দৃশ্যদূষণ হয় ঠিকই, কিন্তু বিজ্ঞাপনশিল্পে পূজা উপলক্ষে ফ্লেক্স উৎপাদনের পরিমাণ প্রভূত বৃদ্ধি পায় এবং এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত মানুষের রোজগার বৃদ্ধি নিশ্চিত হয়।
উৎসবপ্রিয় বাঙালির একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো ভ্রমণলিপ্সা। পূজার মরশুম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কয়েক লক্ষ রাজ্যবাসী দূরবর্তী গন্তব্যে ভ্রমণে বেরিয়ে পড়ে। অনেকে যেমন রাজ্যের বিভিন্ন পর্যটনস্থলগুলোতে যায়, অন্যদিকে এক বড় অংশ রাজ্যের বাইরে বা অন্য রাজ্যগুলিতে দর্শনীয় ও নানা পর্যটনকেন্দ্রের উদ্দেশে রওনা হয়। পর্যটন-অর্থনীতির বাড়বাড়ন্ত দুর্গাপূজা ও পূজা মরশুমের ওপর অত্যন্ত নির্ভরশীল। তাই পূজা ও পর্যটনশিল্প ওতপ্রোতভাবে জড়িত।
পূজা-অর্থনীতির ক্ষেত্রগত প্রভাবের আলোচনা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি মিষ্টান্নশিল্পের কথা উল্লেখ না করা হয়। বিজয়া দশমীতে মিষ্টিমুখের রীতি সর্বজনবিদিত। এর সঙ্গে অবশ্যই মনে রাখতে হবে পূজাতে নিবেদিত হরেক প্রকারের মিষ্টি। পূজার দিনগুলোতে মিষ্টি প্রস্তুতকারকরা বছরের অন্য সময়ের তুলনায় অনেকটাই বেশি মিষ্টি উৎপাদন করে। তাই দুধের কারবারি ও মিষ্টি উৎপাদকগণ দুর্গাপূজার মরশুমে সাময়িক ব্যবসাবৃদ্ধির জন্য প্রস্তুত থাকে।
দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যে বিশাল আর্থিক লেনদেন ও অর্থনীতি গড়ে ওঠে তা নিঃসন্দেহে বহু মানুষের রুজি ও আয় নিশ্চিত করে বা বাড়তি অর্থ হাতে নিয়ে আসে। কিন্তু একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, এই বিপুল আর্থিক লেনদেনের দীর্ঘকালীন প্রভাব সীমিত। কেইনসীয় গুণক তত্ত্বানুযায়ী কোনো ব্যক্তি যে-ব্যয় করে তা অন্য কোনো বা কিছু ব্যক্তির কাছে আয় সৃষ্টি করে; আবার সেই ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ ঐ আয়ের কিছুটা অংশ ব্যয় করলে তা অন্যের কাছে আয় সৃষ্টি করে। এইভাবে অর্থনীতিতে আয়ের একটা চক্রাকার প্রবাহ সৃষ্টি হয়। প্রাথমিক পর্বে যদি ১০০ টাকার চাহিদা বা ব্যয় বৃদ্ধি পায়, কালক্রমে তার থেকে অর্থনীতিতে মোট আয়বৃদ্ধির পরিমাণ ১০০ টাকার কয়েকগুণ হবে। কোনো পুকুর বা জলাশয়ে ঢিল নিক্ষেপ করলে যেমন একটা ‘ripple effect’ সৃষ্টি হয়, এটা অনেকটা সেরকম। পূজা মরশুমে বঙ্গীয় অর্থনীতির বিভিন্ন ক্ষেত্রে এই যে চাহিদার সৃষ্টি হয়, তার আর্থিক সুফল সাময়িক। পূজা উপলক্ষে রাজ্যের অর্থনীতিতে লেনদেনের যে প্লাবন বা জোয়ার আসে তা দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে বা সারাবছর ধরে মানুষের কর্মসংস্থান ও রোজগার সুনিশ্চিত করতে পারে না। এর মূল কারণ হলো উন্নয়নশীল অর্থনীতিতে দীর্ঘকালীন আর্থিক বৃদ্ধি ও কর্মসংস্থানের প্রসার ঘটাতে হলে প্রয়োজন মূলধন গঠন। দুর্ভাগ্যবশত দুর্গাপূজার সময় যে ব্যাপক চাহিদার বৃদ্ধি ঘটে বা চাহিদার সৃষ্টি হয় তা মূলত ভোগব্যয়জনিত চাহিদা। এই চাহিদা মূলধন গঠনের জন্য বর্ধিত চাহিদা নয়। দীর্ঘকালীন ভিত্তিতে চাহিদাবৃদ্ধিজনিত আর্থিক সুফল পেতে হলে প্রয়োজন মূলধন গঠনজনিত চাহিদার বৃদ্ধি। এর অর্থ হলো বিনিয়োগ-ব্যয় বৃদ্ধি করা। পূজাকেন্দ্রিক যে চাহিদা ও ব্যয় বৃদ্ধি ঘটে, তাকে মূলত ভোগব্যয় বৃদ্ধি বলা যেতে পারে। এর থেকে কেইনসীয় গুণক তত্ত্বের কার্যকারিতার কারণে সাময়িক আর্থিক সুফল মিলতে পারে, কিন্তু তার দীর্ঘকালীন সুফল যৎসামান্য।
পূজার মরশুমে রাজ্য সরকার, পুরসভা ও অন্যান্য বিভাগ বেশ কিছু অর্থ খরচ করে; এই খরচের একটা বড় অংশ বিজ্ঞাপন, প্রচার ও সুরক্ষা খাতে ব্যয়িত হয়। সরকার যেমন খরচ করে, তেমনি পূজা উপলক্ষে সরকারি কোষাগারে বেশ কিছু অর্থসমাগমও হয়। আগেই বলেছি, পূজাবাজারের লেনদেনের একটা ভাগ সংগঠিত ক্ষেত্রে হয়ে থাকে। এই সংগঠিত ক্ষেত্রে যে উৎপাদন ও আর্থিক লেনদেন হয়ে থাকে, তার থেকে সরকার জি.এস.টি. বা পণ্য ও সেবা-কর বাবদ রাজস্ব আদায় করে। তবে বর্তমানে সরকারি আয়ের সিংহভাগ আসে সম্ভবত আবগারি রাজস্ব বাবদ। পশ্চিমবঙ্গে সাম্প্রতিককালে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় ও সরকারের উদারনীতির কারণে সুরা উৎপাদন ও ভোগ ভীষণভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। সুরা ক্ষেত্র থেকে আবগারি দপ্তরের রাজস্ব আদায়ের পরিমাণ বাজেটের এক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ। রাজ্য সরকারের আয়ের উৎস হিসাবে আবগারি দপ্তরের অবদান ক্রমবর্ধমান। যদিও বিষয়টি মধ্যবিত্ত বাঙালি সমাজে যথেষ্ট বিতর্ক সৃষ্টি করেছে। সুরা উৎপাদন ও ভোগকে উৎসাহপ্রদানের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় বৃদ্ধির নীতি কতটা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য তা নিয়ে বাঙালি সমাজে দ্বন্দ্ব ও অস্বস্তি দুটোই আছে।
এই প্রবন্ধ শেষ করার পূর্বে দুটো বিষয়ের ওপর আলোকপাত করা জরুরি। পূজার সঙ্গে পর্যটনশিল্পের কথা আগেই উল্লেখ করা হয়েছে। সম্ভবত পূজার ছুটিতে যত জন বা যত পরিবার বাংলার মধ্যেই তাদের পর্যটনসূচি সীমাবদ্ধ রাখে, তার থেকে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ অন্য রাজ্যে ঘুরতে যায়। এর ফলে বাঙালির পূজা অন্য রাজ্যের পর্যটন-ব্যবসাকেও প্রভাবিত করে। যখন এ-রাজ্যের মানুষ রাজ্যের বাইরে ভ্রমণে যায় তখন কেইনসীয় তথা অর্থনৈতিক যুক্তি অনুযায়ী রাজ্যের আয় ও ক্রয় ক্ষমতার নিরিখে একটা ‘leakage’ ঘটে থাকে। রাজ্যের বাইরে বেড়াতে না গিয়ে বাঙালি যদি রাজ্যের মধ্যেই ঘুরে অর্থব্যয় করত তাহলে তা এই রাজ্যের অর্থনীতিকে পুষ্ট করত। ইউনেস্কোর স্বীকৃতি বাঙালির তথা এই রাজ্যের দুর্গাপূজার সামনে এক নতুন সুযোগের সম্ভাবনা সৃষ্টি করেছে। রাজ্য সরকার এবং এখানে পর্যটনশিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিরা বাঙালির, বিশেষত কলকাতার দুর্গাপূজা ও চন্দননগরের জগদ্ধাত্রীপূজাকে ঠিকভাবে বিপণন করতে পারলে বহু দেশি ও বিদেশি পর্যটক উৎসব মরশুমে পশ্চিমবঙ্গে আসতে উৎসাহী হবে। এর ফলে শুধু যে এ-রাজ্যের পর্যটনশিল্পই উপকৃত হবে তা নয়, এমনকী বিদেশি পর্যটক এলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও হবে। এখানে উল্লেখ্য, বিগত কয়েকবছর ধরে (করোনার সময়কাল বাদে) রাজ্য সরকারের উদ্যোগে প্রতিমা-বিসর্জন উপলক্ষে রেড রোডে (যা বর্তমানে ইন্দিরা গািন্ধ সরণি) যে ‘কার্নিভাল’ আয়োজিত হয়, সেখানে অনেক বিদেশি অভ্যাগতও আমন্ত্রিত থাকে। সুতরাং বিশ্বের দরবারে, বিশেষত ইউনেস্কো-প্রদত্ত শিরোপার সাহায্যে যদি বাঙালির পূজা ও দুর্গোৎসবকে পরিকল্পনাপূর্বক উপস্থাপন করা যায়, তাহলে এই রাজ্যে পর্যটনশিল্পে এক নতুন গতি আসতে পারে। তাই আমাদের প্রয়োজন দুর্গাপূজার আকর্ষণীয় বিজ্ঞাপন ও বিপণনের ব্যবস্থা করা।
দ্বিতীয় ও শেষ বিষয়টা হলো পূজাকেন্দ্রিক অর্থনীতির কিছুটা নিয়ন্ত্রণ বা সেই আর্থিক লেনদেন বাবদ সরকারের কিছু আয়ের সংস্থান করা। একাধিক বড় পূজা-উদ্যোক্তার বাজেট বেশ কয়েক লক্ষ টাকা বা কোটি টাকার কাছাকাছি থাকে। এই কমিটিগুলো বিভিন্নভাবে—বিশেষত চাঁদা বাবদ ও বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছ থেকে—প্রচুর অর্থ সংগ্রহ করে। এই যে বিপুল পরিমাণে অর্থ আদায় হয়, তার ওপর কোনোভাবে কর আরোপের মাধ্যমে সরকার কিছু রাজস্ব পেতে পারে কি না তা ভেবে দেখা যেতে পারে। পূজার বাজারের কেনাকাটার পরিমাণ ও চিত্র দেখলে আর্থিকভাবে সচ্ছল ও গরিব মানুষের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কিছুটা বোঝা যায়। একথা সত্য যে, বহু কমিটি ও প্রতিষ্ঠান উৎসবের দিনগুলোতে দুঃস্থ মানুষের সাহায্যার্থে নতুন বস্ত্র বিতরণ করে থাকে। কিন্তু ধনী পূজা কমিটিগুলোর ওপর যদি কোনো প্রকারের কর আরোপ করে কিছু রাজস্ব আদায় করা যায় এবং আদায়ীকৃত অর্থ যদি দুঃস্থ মানুষের কল্যােণ ব্যয় করা হয়, তাহলে তাতে সমাজের মঙ্গলসাধন হবে। দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যে আর্থিক লেনদেন ঘটে, তার সম্বন্ধে কিছুটা সঠিক আন্দাজ পেতে হলে পূজা উদ্যোক্তা বা ক্লাব ও কমিটিগুলোর ওপর অধিকতর নজরদারি ও নিয়ন্ত্রণ চাই। এর দ্বারা পূজা-অর্থনীতিতে নিয়ন্ত্রণ হয়তো কিছুটা বাড়বে; কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণের জন্য পূজা-অর্থনীতি অধিকতর সংগঠিত রূপ নেবে, যার দীর্ঘমেয়াদি সুফল রাজ্য-অর্থনীতি ভোগ করবে।
অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ,
মৌলানা আজাদ কলেজ, কলকাতা