গৃহত্যাগ করিয়া সিদ্ধার্থ চলিয়াছেন নির্বাণলাভের উদ্দেশ্যে। তাঁহার পিতা শুদ্ধোদন যথাশক্তি চেষ্টা করিয়াছিলেন সিদ্ধার্থকে জগতের দুঃখ-ব্যথা হইতে দূরে সরাইয়া রাখিতে; যাহাতে সংসার-বিতৃষ্ণা না আসিতে পারে। কিন্তু এত করিয়াও শেষরক্ষা হয় নাই। জরা, রোগ ও মৃত্যুর রূপ ধরিয়া মানুষের ত্রিবিধ দুঃখ সিদ্ধার্থের সম্মুখে আসিল। জীবন-মৃত্যুর চিন্তায় মগ্ন হইলেন রাজকুমার সিদ্ধার্থ। স্থির করিলেন, সংসার ত্যাগ করিবেন। সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করিয়া তিনি চলিলেন। পথে তাঁহার কত না বিচিত্র অভিজ্ঞতা হইল!

দীর্ঘকাল কঠোর তপস্যার পর একদিন তিনি বোধিবৃক্ষের তলে গভীর ধ্যানমগ্ন হইলেন। অন্ধকারের আবেষ্টনীর মাঝে নবীন তাপস গভীর স্তব্ধতার সহিত মিশিয়া গেলেন। রাত্রির এক এক প্রহরে তাঁহার এক এক ভাবের অনুভূতি হইতে লাগিল। সেদিন ছিল বৈশাখী পূর্ণিমার রাত। শেষ প্রহরে যখন বোধিলাভ করিলেন সিদ্ধার্থ, তখন রাত্রির অবসান হইয়া অরুণোদয় হইয়াছে। প্রভাতী সূর্যের ন্যায় রঙিন, স্নিগ্ধ জ্যোতির্ময় তাপস সিদ্ধার্থ হইলেন বুদ্ধ। জরা, ব্যাধি, মৃত্যু—সর্বোপরি দুঃখের কারণ ও তাহা হইতে নিস্তারের উপায় কী তাহা বুদ্ধের সম্মুখে তখন স্পষ্ট।

বুদ্ধত্ব লাভের পর সকলেই তাঁহার কথা শুনিবার জন্য আগ্রহী। তাঁহার প্রচার-জীবন আরম্ভ হইল। তিনি বলিলেন—দুঃখ রহিয়াছে, তাহার উৎপত্তির কারণ রহিয়াছে, দুঃখের নিবৃত্তি রহিয়াছে এবং দুঃখ নিবৃত্তির পথও রহিয়াছে।

আসলে দুঃখ এমন এক মহাসত্য যাহাকে অস্বীকার করিবার উপায় নাই। জীবনের সহিত সে ওতপ্রোতভাবে রহিয়াছে বলিয়া জীবনকে মহা দুঃখের মনে হয়। দুঃখ কোনোদিন আমাদের ত্যাগ করে না। সমগ্র দৃষ্টি লইয়া না দেখিলে দুঃখ সর্বাঙ্গীণরূপে আমাদের নিকট ধরা পড়ে না। দুঃখের স্বরূপ কী, কেন দুঃখ আসে, তাহা হইতে বাঁচিবার উপায় কী—এসম্বন্ধে আমরা গভীরভাবে চিন্তা করিয়া দেখি না এবং জীবনে দুঃখের দান বা তাত্পর্য কিছু আছে কি না তাহাও বুঝিতে পারি না।

দুঃখের মূল কারণ হইল আমাদের তৃষ্ণা বা বাসনা। অভাববোধ হইতেই দুঃখের উৎপত্তি। সেই অভাব ও তৃষ্ণা মিটাইবার জন্য আমরা ইন্দ্রিয়ের পিছনে ছুটিতেছি। এই তৃষ্ণার সীমা নাই, তাই আমাদের ছুটিয়া চলিবার কোনো বিরাম নাই। আমাদের বহির্মুখী মনে সর্বদাই সুখের আশা ও কল্পনা চলিতে থাকে। সব আশা পূরণ হয় না, তাই দুঃখও আমাদের ছাড়িয়া যায় না।

সুখের আশায় আমরা বাহ্য বিষয়ের উপর নির্ভর করি। একাধিক আশাজালে আবদ্ধ হইয়া ভবিষ্যতের সুখ কল্পনা করি। এসবই অনেক সময় দুঃখ লইয়া আসে। আবার দুঃখ আসিবার ভয়ে শঙ্কিত হইয়া আমরা অনেক বেশি দুঃখ পাই। দুঃখ, বিপদ, ব্যর্থতা যখন চরম সীমায় পৌঁছায় তখন মনে হয়—মৃত্যুই একমাত্র সমাধান। কিন্তু এসব জাগতিক সুখ-দুঃখের পারেও যে এক স্থান আছে, যেখানে শুধু আনন্দ আর শান্তি—তাহার খোঁজ পাইলে কোনো কিছুই আমাদের বিচলিত করিতে পারে না। সেই স্থান আমাদের স্বরূপ। মনকে এই জগতের ঊর্ধ্বে লইয়া যাইতে পারিলে, সেই পূর্ণকে স্পর্শ করিতে পারিলে কোনো কিছুই আমাদের চিত্তচাঞ্চল্য ঘটাইতে পারে না। গীতার ষষ্ঠ অধ্যায়ে শ্রীভগবান বলিয়াছেন, আত্মতত্ত্বে অবস্থিত হইলে মহাদুঃখেও মনে বিচলিত ভাব কখনো আসে না।

দুঃখকে শুধু নিজের বলিয়া ভাবিলে দুঃখের তীব্রতা বেশি হইয়া থাকে। তাই উপায় হইল দুঃখের ব্যাপকতাকে অনুভব করা। তাহা হইলে তাহা হালকা হইয়া যায়। পুত্রশোকে কাতর হইয়া জনৈকা মহিলা বুদ্ধদেবের নিকট আসিয়া বলিলেন : “আপনি অনুগ্রহ করিয়া সেই ঔষধটি দিন, যাহাতে আমার মৃত পুত্র বাঁচিয়া উঠিবে।” তখন বুদ্ধদেব শোকগ্রস্ত মহিলাটিকে এমন গৃহ হইতে সরিষা আনিতে বলিয়াছিলেন, যে-গৃহে কখনো কাহারো মৃত্যু হয় নাই। তেমন গৃহ পাওয়া যাইল না, তখন সেই মহিলার অন্তরে সত্য প্রকাশিত হইল, ফলে তাঁহার দুঃখের বোঝা হালকা হইল। আমরা নিজেদের লইয়া ব্যস্ত, তাই অল্প দুঃখেও আমরা আচ্ছন্ন হইয়া পড়ি। পরের ভাবনা ভাবিলে, পরের দুঃখ-কষ্টকে নিজের বলিয়া অনুভবের চেষ্টা করিলে নিজের দুঃখ লঘু হইয়া যায়।

দুঃখের ইতিবাচক দিক রহিয়াছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সুন্দর ব্যাখ্যা করিয়া বলিয়াছেন : “মানুষের এই দুঃখকে আমরা ক্ষুদ্র করিয়া বা দুর্বলভাবে দেখিব না।… দুঃখই জগতে একমাত্র সকল পদার্থের মূল্য। মানুষ যাহা কিছু নির্মাণ করিয়াছে তাহা দুঃখ দিয়াই করিয়াছে। দুঃখ দিয়া যাহা না করিয়াছে তাহা তাহার সম্পূর্ণ আপন হয় না। সেইজন্য ত্যাগের দ্বারা দানের দ্বারা তপস্যার দ্বারা দুঃখের দ্বারাই আমরা আপন আত্মাকে গভীররূপে লাভ করি—সুখের দ্বারা আরামের দ্বারা নহে। দুঃখ ছাড়া আর কোনো উপায়েই আপন শক্তিকে আমরা জানিতে পারি না। এবং আপন শক্তিকে যতই কম করিয়া জানি আত্মার গৌরবও তত কম করিয়া বুঝি যথার্থ আনন্দও তত অগভীর হইয়া থাকে।” তাই মহৎ হইতে গেলে, অনাবিল আনন্দকে অনুভব করিতে হইলে দুঃখের মধ্য দিয়াই আমাদের সকলকে যাইতে হইবে। স্বামীজীকে খেতড়িরাজ অজিত সিংহ জিজ্ঞাসা করিয়াছিলেন : “জীবন মানে কী?” স্বামীজী উত্তর দিলেন : “প্রতিকূল পারিপার্শ্বিক অবস্থাগুলি চেষ্টা করছে জীবকে দাবিয়ে রাখতে, আর তাদের গ্রাহ্য না করে অন্তঃশক্তি স্বীয় আবরণোন্মোচন বা ক্রমবিকাশ করে চলেছে—তাকেই বলে জীবন।” তাই জীবনের বিস্তারে ভিতরের শক্তিকে উন্মোচিত করিতে হইলে প্রতিকূল অবস্থার সহিত যুঝিতে হইবে, আর তাহা কিন্তু আপাত দুঃখের।

সাধকজীবনে দুঃখ-শোকের আলাদা গুরুত্ব রহিয়াছে। সাধক দুঃখকে বরণ করিতে পারিলে নিজ জীবনে দ্রুত অগ্রসর হইতে পারে। দুঃখ না আসিলে অনেক সময়ই বোধ জাগরিত হয় না। আমরা ভগবানকে ভুলিয়া থাকি। ভাবি, এই জগৎ-সংসারেই সকল আনন্দ। দুঃখ-কষ্ট তাই মঙ্গল লইয়া আসে, আমাদের মনকে অন্তর্মুখী হইতে সহায়তা করে এবং স্মরণে আনিয়া দেয় যে, এখানকার কোনো জিনিসই নির্ভরযোগ্য নহে। দুঃখ-আঘাত আমাদের এই ঠুনকো নির্ভরতাকে সরাইয়া দেয়। ভগবান যখন ভক্তকে কাছে টানিতে চাহেন, তখন তাঁহাকে দুঃখের পরীক্ষায় ফেলেন। ভগবান-নির্ভর সাধক তাহাতে বিচলিত হন না। যিনি প্রকৃত ভক্ত তিনি তাহাই সাদরে গ্রহণ করিয়া থাকেন, ভগবান তাঁহাকে কোলে তুলিয়া লন। শ্রীমা সারদাদেবী তাই বলিতেন যে, দুঃখ হইতেছে ভগবানের দয়ার দান। ভাগবতে দেখিতে পাই, দেবী কুন্তী শ্রীকৃষ্ণের নিকট দুঃখ-বিপদ প্রার্থনা করিতেছেন। বলিতেছেন : “বিপদঃ সন্তু তাঃ শশ্বৎ তত্র তত্র জগদ্‌গুরো।/ ভবতো দর্শনং যৎ স্যাদপুনর্ভবদর্শনম্।।” অর্থাৎ, হে জগদ্‌গুরো! আমার সকল কার্যে সেই সমস্ত বিপদ যেন সর্বদা হয়, যেসমস্ত বিপদ হইলে তোমার দর্শনলাভ হইবে। তোমার দর্শন হইলে আর কখনো সংসারকে দর্শন করিতে হয় না। বস্তুত, মহৎপ্রাণ সকলকেই দুঃখের পরীক্ষা দিতে হইয়াছে।

দুঃখ আমাদের বিক্ষিপ্ত মনকে একাগ্র করে। সেই একাগ্র মনে অনন্তের ভাব জাগ্রত হয়। সঠিক মনোভাব লইয়া দুঃখকে গ্রহণ করিতে পারিলে অধ্যাত্মজীবনে অগ্রসর হওয়া যায়। প্রকৃত শান্তির পথটি উন্মোচিত হয়। দুঃখ জীবনে আশীর্বাদ হইয়া উঠে। দুঃখ তাই আমাদের জীবনে তপস্যাস্বরূপ। সে-তপস্যা আনন্দের তপস্যা। এই তপস্যার ভাবটি জাগরূক রাখা বড় প্রয়োজন। প্রেমেন্দ্র মিত্র এক পত্রে ভারি সুন্দর এই ভাবটি ব্যক্ত করিয়া লিখিয়াছেন : “দুঃখের তপস্যায় সবই অমৃত, পথেও অমৃত, শেষেও অমৃত। সফল হও ভালোই, না হও ভালোই। আসল কথা সফল হওয়া না-হওয়া নয়—তপস্যা আছে কিনা সেইটেই আসল কথা। সৃষ্টি তো স্থিতির খেয়ালে তৈরী নয়, গতির খেয়ালে। যা পেলুম তাও অহরহ সাধনা দিয়ে রাখতে হয়, নইলে ফেলে যেতে হয়।… দুঃখের ভয়ে যারা কঠিন তপস্যা থেকে বিরত হয়ে সহজ পথ খোঁজে আরামের, তাদের আরামই জোটে, আনন্দ নয়।”

দুঃখকে জীবনসাধনার অঙ্গ হিসাবে বরণ করিয়া লইতে হয়। বসন্তের প্রারম্ভে পত্রশোভিত এক বৃক্ষের সম্মুখে দাঁড়াইয়া একজন একটি পত্রকে জিজ্ঞাসা করিল : “তোমার দুঃখ-ভয় হইতেছে না? অন্য পত্রগুলি যে ঝরিয়া পড়িতেছে!” সে উত্তর দিল : “না। গত কয়েক মাস ধরিয়া আমি সুন্দরভাবে ছিলাম। খুব চেষ্টা করিয়াছি গাছকে পুষ্ট রাখিতে। এখন আমার বেশির ভাগটি গাছে মিশিয়া আছে। আমি আবার মাটিতে ফিরিয়া যাইব। সেখান হইতে গাছকে পুষ্ট রাখিবার চেষ্টা করিব, আর তাহাকে বলিব, ‘তোমার সঙ্গে আমার আবার শীঘ্র দেখা হইবে।’ আমার আবার দুঃখ কীসের?” ঠিক ঠিক দৃষ্টিভঙ্গি লইয়া চলিলে দুঃখ-ভয় আমাদের বিচলিত করিতে পারে না, বরং তৃপ্তির কারণ হইয়া থাকে। দুঃখই এই জীবনসমুদ্র পার হইবার তরি হইয়া উঠিতে পারে।

স্বামী বিবেকানন্দ ১৮৯৮ সালের ২৫ মার্চ মার্গারেট এলিজাবেথ নোব্‌লকে দী‌ক্ষা দিলেন। স্বামীজী মার্গারেটকে দিয়া প্রথমে শিবপূজা করাইয়া তাঁহাকে ব্রহ্মচর্যব্রতে দী‌ক্ষিত করিলেন। তাহার পর ভগবান বুদ্ধের চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়াইলেন এবং আবেগভরে বলিলেন : “যাও, যিনি বুদ্ধত্বলাভের পূর্বে পাঁচশত বার অপরের জন্য জন্মগ্রহণ ও প্রাণ বিসর্জন করেছিলেন, সেই বুদ্ধকে অনুসরণ কর।” বস্তুত, বুদ্ধদেবের ন্যায় মহৎপ্রাণ মানব বিশ্ববাসীর মঙ্গলচিন্তা লইয়া নিরন্তর কর্ম করিয়া গিয়াছেন। প্রেমই তাঁহার প্রেরণা, প্রেমেই তাঁহার স্থিতি। তাঁহার মধ্যে আজও আমরা খুঁজিয়া পাই নব জীবনের
বাণী।