কৃত্রিম মেধা বা ‘আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ (AI) যে-গতিতে এগচ্ছে, তাতে কি মানুষের কর্মহীন হওয়ার শঙ্কা বাড়ছে? অন্তত হালফিলের চলচ্চিত্র, সাহিত্য এবং সংবাদমাধ্যমে এই উদ্বেগ স্পষ্ট। এবিষয়ে বিশদে আলোচনার আগে সংক্ষেপে কৃত্রিম মেধার সামাজিক এবং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বুঝে নেওয়া জরুরি৷
AI চর্চার বিস্তার উত্তর-আধুনিক সমাজে৷ জঁ ফ্রাঁসোয়া লিওতার The Postmodern Condition-এ উত্তর-আধুনিক সমাজের সামাজিক-ঐতিহাসিক রূপ নিয়ে আলোচনা করেছেন৷১ সেই আলোচনার গুরুত্বপূর্ণ দুটি বৈশিষ্ট্য হলো—প্রথমত, উত্তর-আধুনিক সমাজে আধুনিক পুঁজিবাদী সমাজের মতো অর্থনীতির কেন্দ্রস্থলকে পণ্য-উৎপাদনকারী শিল্পগুলি দখল করে রাখে না৷ এই বৈশিষ্ট্য নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে প্রদীপ বসু বলছেন, উত্তর-আধুনিক যুগে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায় শেয়ার বাজার, অনুৎপাদক ক্ষেত্র, ‘সার্ভিস সেক্টর’ কিংবা ফাটকা বাজার৷ দ্বিতীয় বৈশিষ্ট্য, এই যুগে তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের বিপুল উন্নতি৷ এই উন্নতি অবশ্যই নির্ভর করে কম্পিউটারের ব্যাপক ব্যবহারের ওপর৷২
বস্তুত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ অ্যালান ম্যাথিসন ট্যুরিঙের তত্ত্ব দেখিয়ে দেয়, কীভাবে নির্দিষ্ট উপাত্ত (‘ইনপুট’) থেকে সীমিত সংখ্যক ধাপে সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে একটি উত্তর (‘আউটপুট’)-এ পৌঁছানো সম্ভব৷৩ ট্যুরিঙের বছর খানেক আগে আলোন্সো চার্চ হিলবার্টের দশম সমস্যার সমাধানে পৌঁছেছিলেন ল্যামডা ক্যালকুলাসের সাহায্যে৷ কম্পিউটার বিজ্ঞানে তাই এই তত্ত্ব ‘চার্চ-ট্যুরিং থিসিস’ নামে প্রচলিত, যাকে আসলে আধুনিক কম্পিউটারের ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়৷৪ এই তত্ত্ব কাজে লাগিয়ে তাকে সময়ের সঙ্গে পরিবর্ধন এবং পরিমার্জন করে ধীরে ধীরে কম্পিউটার বর্তমানের রূপ নিয়েছে। এই যুগে তথ্যই সবকিছুর নিয়ন্তা৷ তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্র, সুতরাং তা প্রসারলাভ করেছে উত্তর-আধুনিক সমাজে—যে-যুগ বহুবর্ণ-রঞ্জিত হয়ে বেরতে চেয়েছে আধুনিকতার দ্বিমাত্রিক রাজনীতি থেকে৷৫ তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রের মতো এই যুগে কম্পিউটার বিজ্ঞানের অগ্রগতি পথ করে দিয়েছে নতুন গবেষণাক্ষেত্রের৷ কৃত্রিম মেধার চর্চা কালের নিয়মে এসে হাজির—রোবট থেকে হালফিলের চ্যাটজিপিটি যার নিদর্শন। প্রাযুক্তিক সুনামির এই লীলাখেলার মধ্যে প্রায়ই প্রশ্ন উঠছে—গাড়ির চালকের আসন থেকে কি এবার সরে যেতে চলেছে মানুষ? তার জায়গায় কি সেই দায়িত্ব নেবে কৃত্রিম মেধা?
যুগের হাওয়ার সঙ্গে তাল রেখে AI চর্চাও প্রথাগত ভাবনা-চিন্তাকে ওলটপালট করে দিয়েছে অনেক ক্ষেত্রে, যেভাবে উত্তর-আধুনিক চিন্তকরা ‘এনলাইটেনমেন্ট রিজন’-এর বাইরে বেরিয়ে নতুন বাতাস আমদানি করেছিলেন সমাজের ভিন্ন ক্ষেত্রে, দুমড়ে-মুচড়ে দিয়েছিলেন যুক্তির সর্বগ্রাসী প্রাধান্যকে—অনেকটা তেমনই৷ আবেগ, বুদ্ধির বৃত্তি, বংশবৃদ্ধি—যা কি না প্রাণিজগতের একান্ত নিজস্ব বলে অভিহিত ছিল, তা যেন আর শুধু তাদের একার নয়! AI যেন এই সবকিছুকে তার ‘সন্তান’ রোবটের মধ্যে প্রোগ্রামের মাধ্যমে পুরে ফেলতে পারে—কট্টরপন্থী AI বিজ্ঞানীদের (Strong AI) এই ভাবনাও তো আসলে ছক-ভাঙা, যুগের ভাবনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ৷ নিত্যনতুন পরিস্থিতি জন্ম দিচ্ছে নতুন কর্তব্যের সংঘাত। ‘বসন্ত জাগ্রত দ্বারে’ রচনা কি পুেরাটাই লিখে দেবে চ্যাটজিপিটি এবং তা মুখস্থ করে পরীক্ষায় ভাল ফল করবে ছাত্ররা? চালকহীন গাড়িচালক অপর একটি চালকহীন গাড়ির সঙ্গে দুর্ঘটনায় জড়াল, প্রাণ গেল পথচারীর—দায় তবে কার? ব্যক্তিগত ‘তথ্য’-এর নিয়ন্ত্রক কে হবে—আমরা, নাকি যে-সংস্থার কাছে তথ্য গচ্ছিত রাখা হয়েছে, সেই সংস্থা? এইসব কূট প্রশ্নের মুখোমুখি প্রায়ই হতে হয়। এই কৃত্রিম মেধা বর্তমান দুনিয়ার অন্যতম নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করেছে। আমরা জেনে বা না-জেনে হররোজ এই প্রযুক্তির সহায়তা নিই। পরীক্ষাও দিই কৃত্রিম মেধার কাছে।
এই প্রবন্ধের মূল প্রশ্নের দুটি উত্তর দেওয়া সম্ভব—একটি সংক্ষিপ্ত এবং অন্যটি প্রলম্বিত। সংক্ষিপ্ত উত্তরটি হলো—মানুষকে মেধার স্থান থেকে AI পুরোপুরি সরাতে পারবে না। পরের প্রশ্ন—কেন? এর উত্তরটি দীর্ঘতর, যা পরবর্তী পর্যায়ে আলোচনা করা হলো।
দুই
১৯৫০ সালে অ্যালান ট্যুরিং একটি প্রবন্ধ লেখেন৷৬ AI চর্চায় এই প্রবন্ধকে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসাবে ধরা হয়৷ এই প্রবন্ধে তিনি মানুষের বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে যন্ত্রগণকের ক্ষমতার তুলনা টানেন৷ ট্যুরিং দেখিয়েছেন, কখন একটি যন্ত্রকে যুক্তিসংগতভাবে বুদ্ধিমান বলা যেতে পারে৷ প্রবন্ধ শুরু হয় একটি প্রশ্ন দিয়ে—‘মেশিন কি চিন্তা করতে পারে?’ এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে কখন কোন মেশিনকে বুদ্ধিমান বলা যায়, নিজেই তার নিদান দিয়েছেন এই ব্রিটিশ গণিতজ্ঞ৷ তাঁর বক্তব্য হলো—ধরা যাক, বন্ধ ঘরে একটি যন্ত্র এবং এক ব্যক্তি রয়েছে৷ ঘরের বাইরে থেকে লিখে আরেক ব্যক্তি তাদের সঙ্গে কথোপকথন চালাচ্ছে৷ যদি বাইরের ব্যক্তি ঘরের ভিতর থেকে আসা উত্তর পাঠ করে বুঝতে না পারে ঐ উত্তর যন্ত্র দিচ্ছে, না মানুষ এবং এই ঘটনা যদি বারবার ঘটতে থাকে, তবে বলা যেতে পারে যন্ত্রটি প্রতারণা করতে সক্ষম৷ অতএব, মেশিনটি ‘বুদ্ধিমান’৷ সুতরাং, তার মন (মেধা) থাকা সম্ভব৷ AI গবেষণা যেদিকে এগচ্ছে, তাতে অনেক স্বয়ংক্রিয় রোবটের পক্ষে এই পরীক্ষায় পাশ করা সম্ভব বলে এক শ্রেণির বিজ্ঞানীরা দাবি করেছেন। আপত্তি থাকলেও ট্যুরিঙের তত্ত্বের দার্শনিক ভিত্তির ওপর নির্ভর করেই এগিয়ে চলেছে AI চর্চা৷৭
ট্যুরিং-টেস্ট নিয়ে বস্তুত আরো বিশ্লেষণ জরুরি৷ ড্যানিয়েল ডেনেটের Brainchildren : Essays on Designing Minds৮ বইটি নিয়ে যে-কারণে এই পরিসরে আলোচনার প্রয়োজন৷ ডেনেট দেখাচ্ছেন, ট্যুরিং-টেস্ট নিয়ে AI চর্চায় যত আলোচনা, তা অনেক ক্ষেত্রেই যথাযথ নয়৷ ট্যুরিঙের মূল প্রতিপাদ্য ব্যাখ্যা করতে অধিকাংশ সময় মানুষের ভুল হয়েছে৷ তাঁর প্রশ্ন—কেউ যদি ট্যুরিং-টেস্টে পাশ না করতে পারে, তাহলে কি বলা হবে যে, সে বুদ্ধিমান নয়? তাঁর বক্তব্য—এটা একমুখী একটি পরীক্ষা, যাতে পাশ না করতে পারলে কিছুই প্রমাণিত হয় না৷ ডেনেটের মতে, আসলে ট্যুরিং বলতে চেয়েছিলেন
পুরুষ, নারী বা কম্পিউটার প্রত্যেকে আলাদা আলাদা ভাবে চিন্তা করতে পারে৷ যে যেভাবেই চিন্তা করুক না কেন, সে তার মতো করে যদি অপরকে নকল (‘ইমিটেট’) করতে পারে, তাহলে বলতে হবে সে চিন্তা করতে সক্ষম৷
ডেনেটের বক্তব্য—ট্যুরিং যা চাননি, সেভাবেই পরবর্তিকালে তাঁর পরীক্ষা নিয়ে আলোচনা হয়েছে৷ বলতে গেলে, তাঁর এই কল্প-পরীক্ষণের বিপরীত প্রভাব পড়েছে পরবর্তিকালের গবেষকদের ওপর৷ ট্যুরিঙের উদ্দেশ্য এটা ছিল না যে, ‘সায়েন্টিফিক সাইকোলজি’র অগ্রগতির জন্য বিজ্ঞানসম্মত একটি পরীক্ষাপদ্ধতি তৈরি করা, অথবা কোনো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ঠিক বা ভুল তার নিরূপণ৷ আসলে তিনি চেয়েছিলেন একধরনের দার্শনিক আলোচনার সমাপ্তি৷ ট্যুরিঙের প্রতিপাদ্য ছিল—চিন্তা সংক্রান্ত এই পরীক্ষায় পাশ করলে চিন্তা করা বা ‘থিঙ্কিং’ সংক্রান্ত আলোচনায় সবথেকে বড় ‘স্কেপটিক’ও নিঃসন্দিগ্ধ হতে পারে৷ ট্যুরিঙের নিজের ভাষায়—“চিন্তার ধর্ম কী, সেই নিয়ে এত প্রশ্ন কেন? এই পরীক্ষায় যে পাশ করবে, তার বুদ্ধি আছে বলে স্বীকার করে নিতে হবে৷ এর পর আমাদের ভাবতে হবে, কীভাবে এমন যন্ত্র তৈরি করা যায়, যা এই পরীক্ষায় পাশ করতে পারে৷” ডেনেট মনে করছেন, ট্যুরিঙের এই কথার ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছে বছরের পর বছর ধরে৷ ট্যুরিঙের মূল প্রতিপাদ্যের অন্তর্গত এই বক্তব্য ছিল আসলে একটি ‘কাউন্টার-একজাম্পল’ বা প্রতি-তুলনা৷৯
ডেনেটের কাছে ট্যুরিং-টেস্ট আসলে চিন্তা সংক্রান্ত একটি কল্প-পরীক্ষণ৷ তাঁর বক্তব্য—ট্যুরিং অন্তত এভাবেই ভেবেছিলেন। তাই এই পরীক্ষাকে কেউ আরো উন্নততর করার চেষ্টা করলে তা যথাযথ হবে না৷ বিগত কয়েক দশক ধরে ট্যুরিং-টেস্ট যেভাবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, তা ঠিক নয় বলে মনে করছেন ডেনেট৷ বেশির ভাগ গবেষকই ট্যুরিং-টেস্টের এই দিকটি উপেক্ষা করে গিয়েছেন৷ ডেনেট মনে করছেন, এর ফলে ট্যুরিং-টেস্টকে ভুল বুঝে কাজে লাগানো হয়েছে৷ ফলস্বরূপ কম্পিউটারের ক্ষমতা যা, তার থেকে অনেক বড় আকারে তা প্রতিভাত হয়েছে৷১০
এই প্রবন্ধে ডেনেটের প্রদর্শিত পথ এবং এই বিভাজিকার কথা স্মরণ রাখা প্রয়োজন। ডেনেট মনে করছেন, ট্যুরিং যখন এই পরীক্ষার কথা ভেবেছিলেন, তখন কোনোভাবে হয়তো তাঁর মাথায় ছিল রনেঁ দেকার্তের সেই উক্তি৷ Discourse on Method বইয়ে দেকার্ত বলতে চেয়েছিলেন, বুদ্ধিদীপ্ত কথোপকথনই সেই পরীক্ষা, যা দিয়ে ‘হিউম্যান মেন্টালিটি’ বা মানুষের মানসদশার যথাযথ নিরীক্ষা সম্ভব৷১১ দেকার্ত যখন এই মন্তব্য করেছিলেন সপ্তদশ শতকে, তখন সাধারণ বিজ্ঞানের তত অগ্রগতি হয়নি। কম্পিউটার নামক যন্ত্রটির ভাবনারই জন্ম হয়নি৷ অথচ, দেকার্ত ভাবতে পেরেছিলেন—“একদিন এমন যন্ত্র আবিষ্কৃত হবে, যে হয়তো শব্দ উচ্চারণ করতে পারবে কিন্তু ভিন্ন পরিস্থিতিতে সে তার শব্দকে বদলাতে পারবে না বা তার উপস্থিতিতে কোনো কথা বলা হলে তার প্রত্যুত্তর করতে পারবে না—যেমন একজন অত্যন্ত বোকা লোকও করতে পারে৷”১২ দেকার্তের এই ভাবনা—সাধারণ কথোপকথন কৃত্রিমভাবে বুদ্ধিমান মেশিনের বুদ্ধি নিয়ে প্রশ্ন তুলে দেবে—হয়তো প্রভাবিত করেছিল ট্যুরিংকে, এমনটাই মনে করছেন ডেনেট৷ ট্যুরিং যে-অনুসিদ্ধান্তে আসতে চেয়েছিলেন তা এই—আরো অনেক বুদ্ধিদীপ্ত কাজ না করতে পারার মতো কোনো যন্ত্র তাঁর প্রস্তাবিত ‘ইমিটেশন গেম’ পরীক্ষাতেও পাশ করতে পারবে না৷ এই প্রতিপাদ্যকে ডেনেট বলছেন ‘কুইক প্রোব অ্যাজামশন’৷১৩ যারা ঐ পরীক্ষায় পাশ করতে পারবে না, তারা অন্য বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা কাজ না করতে পেরে আমাদের হতাশ করবে৷ ডেনেট এখানে কিছু পরিস্থিতির কল্পনা করতে বলেছেন যেখানে কম্পিউটার যথেষ্ট বুদ্ধিদীপ্ত কাজ করতে পারে৷ কিন্তু তবু নিশ্চিত হয়ে বলা যায় না যে, সে ‘কুইক প্রোব অ্যাজামশন’-এ পাশ করতে পারে। বিভিন্ন উদাহরণ দিয়ে ডেনেট দেখান, উন্নততর প্রোগ্রামিঙের সাহায্যে নানা কাজ করতে পারে কম্পিউটার, কিন্তু তা সত্ত্বেও বলা যায় কি—সে ট্যুরিং-টেস্টে পাশ করল? ডেনেটের সিদ্ধান্ত—
(১) ট্যুরিং যেভাবে তাঁর পরীক্ষাটিকে ভেবেছিলেন সেই অকৃত্রিম, অপরিবর্তিত অবস্থায় কিন্তু ভীষণ শক্ত একটি পরীক্ষা—ঠিকভাবে সেই পরীক্ষা করা হলে তাতে পাশ করা কঠিন। তবে, ডেেনট একথা স্বীকার করেছেন—তত্ত্বগতভাবে কোনো কম্পিউটারের এই পরীক্ষায় পাশ করা সম্ভব। তাঁর মতে, যদি ‘আনরেসট্রিকটেড ট্যুরিং-টেস্ট’ কোনো কম্পিউটার পাশ করতে পারে, তাহলে বলতে হবে—তা চিন্তা করতে পারে।
ডেনেটের পরবর্তী বক্তব্য—এই বই লেখা পর্যন্ত ‘আনরেস্ট্রিকটেড ট্যুরিং-টেস্ট’ কোনো কম্পিউটার পাশ না করলেও একথা বলা যাবে না যে, কিছু কিছু মেশিন ইতিমধ্যেই চিন্তার ক্ষেত্রে কিছু বৈশিষ্ট্য দেখায়নি৷ তাহলে এই প্রশ্ন কি করা যায়—তারা সত্যিই চিন্তা করতে পারে? তাঁর উত্তর—কিছু ক্ষেত্রে পারে, কিছু ক্ষেত্রে নয়৷
(২) ডেনেটের দ্বিতীয় সিদ্ধান্ত—ট্যুরিঙের মূল প্রতিপাদ্য ঠিকভাবে অনুধাবন না করতে পেরে অনেকেই ‘ট্যুরিং-টেস্ট ডিজাইন’ করছে৷ কিন্তু ট্যুরিঙের বক্তব্য সঠিকভাবে বুঝতে না পেরে যে টেস্ট করা হচ্ছে, তা থেকে অাসা সিদ্ধান্ত অনেক সময়ই অতিরঞ্জিত৷ হয়তো ঐ কম্পিউটারের প্রকৃত ক্ষমতা সঠিকভাবে না বুঝেই তার সম্পর্কে আমরা বৃহৎ ধারণা করে ফেলি৷ তার ‘কগ্নিটিভ’ ক্ষমতাকে অতিরঞ্জিত করে দেখানো শুধু দার্শনিক সমস্যা নয়, সামাজিক সমস্যাও৷১৪ এসম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকতে হবে এবং তা দূর করতে পদক্ষেপ নিতে হবে। কৃত্রিম মেধার বিকাশের সঙ্গে মানুষের কর্মহীন হয়ে পড়ার উদ্বেগটি অনেকটা এই প্রকারের।
বস্তুত, ট্যুরিঙের যে-তত্ত্ব প্রবন্ধের শুরুতে আলোচনা করা হয়েছে, সেই দর্শনের বিরুদ্ধে যুক্তি সাজিয়েছিলেন জন সার্ল৷১৫ তিনি একটি কল্প-পরীক্ষণের মধ্য দিয়ে দেখিয়েছিলেন, নির্দিষ্ট উপাত্ত (‘ইনপুট’) থেকে সীমিত সংখ্যক ধাপে সুনির্দিষ্ট নিয়ম মেনে একটি উত্তর (‘আউটপুট’)-এ পৌঁছানো সম্ভব হলেও একথা বলা যাবে না যে, যন্ত্রটির যথার্থ বোধ হচ্ছে৷ একইসঙ্গে প্রশ্ন উঠছে—প্রোগ্রামের বাইরে গিয়ে সে আদৌ কাজ করতে সক্ষম কি না, বা পরিবেশের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারে কি না অর্থাৎ সৃজনশীল কোনো কাজ সে করতে পারে কিনা, তা নিয়েও।
সার্ল কল্পনা করতে বলেন এমন একটি পরিস্থিতি, যেখানে একটি ঘরে এক ব্যক্তি বন্দি৷ তার কাছে অপরিচিত চীনা ভাষার নিয়ম-সম্বলিত একটি নথি রয়েছে৷ এর পর ঐ ভাষায় তার কাছে আরো একটি নথি এল, তার পর আরো৷ শেষে ইংরেজিতে একটি নির্দেশিকা, যেখানে প্রথম এবং দ্বিতীয় নথিতে অপরিচিত ভাষণটির সংকেত কীভাবে মিলিয়ে দেখা যাবে তা বলা হয়েছে৷ সেই নির্দেশিকার সাহায্যে তৃতীয় যে নথিটি, যা আদতে কিছু প্রশ্ন—তার উত্তর দিল ঐ ব্যক্তি৷ এখানে সার্লের প্রশ্ন—এর পরও কি বলা যেতে পারে, ব্যক্তিটির অপরিচিত চীনা ভাষা সম্পর্কে কোনো বোধ জন্মাল? ঐ ব্যক্তি তো শুধু ‘সিন্ট্যাক্স’ বা বাক্যগঠন সংক্রান্ত কিছু নিয়ম কাজে লাগিয়েই প্রশ্নের উত্তর দিল৷ কিন্তু ভাষার যে শব্দার্থগত দিক বা ‘বোধ’ (‘সেমেন্টিক্স’), সেবিষয়ে তো তার কোনো ধারণা হলো না৷ সার্লের এই কল্প-পরীক্ষণ পরিচিত ‘চাইনিজ রুম আর্গুমেন্ট’ নামে৷ এর বিরুদ্ধে একাধিক আপত্তি উঠলেও মূল যুক্তিতে সার্ল অনড়ই থেকেছেন।১৬
নানা প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও কৃত্রিম মেধার অগ্রগতি হয়েছে ঢের অধিক। সাফল্যের সাম্প্রতিক উদাহরণ ইলন মাস্ক স্থাপিত গবেষণা সংস্থা ‘Open AI’-এর তৈরি ‘চ্যাটজিপিটি’ (‘চ্যাট জেনারেটিভ প্রি-ট্রেন্ড ট্রান্সফরমার’)।১৭ ২০২২-এর নভেম্বরে প্রকাশ্যে আসে চ্যাটজিপিটি। কবিতা, নাটক, প্রবন্ধ, রচনা—সবই সে লহমায় তৈরি করতে পারে, নানাবিধ প্রশ্নের উত্তর ঝটিতি দিতে পারে। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক—একবার প্রযুক্তির এই নয়া রূপটিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ২০১৫ সালে কলম্বাস আমেরিকায় এলে কী ঘটে? চ্যাটজিপিটি উত্তর দেয়—প্রশ্নটি কূট, কারণ ক্রিস্টোফার কলম্বাস প্রয়াত হয়েছেন ১৫০৬ সালে। তাই তাঁর পক্ষে ২০১৫-তে মার্কিন মুলুকে পৌঁছানো অবাস্তব। এখানে না থেমে সে আরো বলে—যদি কল্পনাও করি উনি আমেরিকা আসেন ২০১৫ সালে, তাহলে ১৪৯২ সালে তাঁর প্রথম পদার্পণের পরে কী বদল ঘটেছে এই দেশের, তা দেখে তিনি অবাক হয়ে যেতেন।১৮ এমন আপাত সাফল্যের পর প্রশ্ন ওঠে—এই অমিত ক্ষমতাসম্পন্ন মেধা যে তার প্রতিস্পর্ধী গুগল্কেও চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছে, তার প্রভাবে কি কাজ হারাবে বহু মানুষ? এককথায় উত্তরটি হলো—না। তেমনটা হওয়া সম্ভব নয়। কেন সম্ভব নয় তা ডেনেট অনুসরণে দেখানো হয়েছে। দ্বিতীয় যুক্তিতে এবার আসা যাক।
তিন
সম্প্রতি নোম চমস্কি দেখিয়েছেন, চ্যাটজিপিটির এই আপাত সাফল্য আসলে ‘মিথ্যা প্রতিশ্রুতি’ (‘ফলস হোপ’)-র জন্ম দেয়।১৯ তাঁর মতে, চ্যাটজিপিটি বা এই ধরনের কোনো প্রোগ্রাম আসলে রাশিবিজ্ঞান-নির্ভর সম্ভাব্য আউটপুট দিতে পারে। সেসব উত্তর দেখে মনে হতে পারে, তা যেন মানুষ দিচ্ছে! সেখানে ‘প্যাটার্ন’ মেলানো হয় বিপুল তথ্যভাণ্ডার থেকে। কিন্তু মানবমস্তিষ্ক চ্যাটজিপিটির মতো ‘স্যাটিস্টিক্যাল ইঞ্জিন’ নয়, তুলনায় তা অনেক কম তথ্য নিয়ে কাজ করে। সিদ্ধান্তে আসতে সে শুধু ‘কোরিলেশন’-এর ওপর নির্ভর করে না। ‘কজেশন’ বা কারণতার শৃঙ্খলই তার মূল শক্তি। মানুষী চিন্তা শুধু ‘কী হতে পারে’ বা ‘কী হবে’—এরই মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে না, ‘কী হতে পারে না’ বা ‘কী ঘটা সম্ভব নয়’—তারও ব্যাখ্যা দিতে পারে। চমস্কির মতে, মেধার অন্যতম শর্ত এই ‘নেতি’র ধারণা চ্যাটজিপিটির নেই। মেশিন লার্নিঙের মূল উপজীব্য বর্ণনা (‘ডেসক্রিপশন’) এবং ভবিষ্যদ্বাণী (‘প্রেডিকশন’)-র মধ্যে নিহিত। তাই সম্ভাব্যতা এবং অসম্ভবের ফারাক করতে পারে না সে। প্রকৃত মেধা অবাস্তবকে ব্যাখ্যা করতে পারে। তার ব্যাখ্যা হয় অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ। নৈতিকভাবে চিন্তা করাও, চমস্কির মতে, প্রকৃত মেধার অন্যতম লক্ষণ। উদাহরণ দিয়ে তিনি দেখিয়েছেন, চ্যাটজিপিটি গঠনগতভাবে সৃজনশীলতার সঙ্গে সংযমের ভারসাম্য রাখতে ব্যর্থ হয়।
কেন ব্যর্থ হয়? সদাপরিবর্তনশীল এই যে ‘জগৎপ্রপঞ্চ’, যাকে এডমন্ড হুসার্ল ‘লাইফ ওয়ার্ল্ড’২০ বা ‘জীবনবিশ্ব’ বলেছেন, সেখানে অ্যলগরিদম-নির্ভর কৃত্রিম মেধা কীভাবে, কত দূর কাজ করতে পারবে তা নিয়ে ধন্দ থাকে। হুসার্লের জীবনবিশ্বের ধারণা হলো স্বতঃসিদ্ধ, কোনো প্রতিফলনশীল চিন্তাধারার বিষয় নয়। এই ‘লাইফওয়ার্ল্ড’ই মানুষের কর্মকাণ্ড এবং চিন্তাধারাকে সংগঠিত করে তার স্বরূপ নির্ধারণ করে। মানুষ নিজেই জানে না পরমুহূর্তে কী অপেক্ষা করে রয়েছে। সে কল্পনা করতে পারে, পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে তা মনে মনে ভেবে রাখতে পারে; কিন্তু বাস্তব অনেক সময় তার সেই ভাবনার জগৎ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন রূপে ধরা দেয়। এই ‘লাইফওয়ার্ল্ড’ই মানুষের বোধের আঁতুড়ঘর, তার সৃজনীশক্তির উৎস। কার্ল মার্ক্সের অনুসরণে বলা যায়, প্রপঞ্চময় বিশ্বে স্থিত মানুষ সৃজনশীলতা (‘ভ্যালু’) তৈরি করতে সক্ষম, আর মেশিন পারে সেই সৃজনশীলতা সঞ্চারিত করতে।২১ সুতরাং, মানুষের সাহায্য ছাড়া নতুন করে সৃজনশীলতা বা ভ্যালু উৎপাদন অসম্ভব। কৃত্রিম মেধা ততটাই ভ্যালু সঞ্চারিত করতে পারে, যতটা সেই যন্ত্র তৈরির সময় তার মধ্যে নিহিত ছিল। চ্যাটজিপিটিও তার অন্তঃস্থ সৃজনশীলতা (ভ্যালু) ততটাই প্রকাশ করতে পারবে, যতটা তা তৈরি করার সময় তার মধ্যে দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ফলে মানুষের ওপর গুরুত্ব কমিয়ে কৃত্রিম মেধার ওপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করলে কখনো শুরুতে ভাল ফল মিলতে পারে—যাকে মার্ক্স বলবেন ‘ভ্রম’ বা ‘ইলিউশন’, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে লাভের হার কমতে বাধ্য। এই সংক্রান্ত মার্ক্সের একটি ‘ইকুয়েশন’ পরে মরিশিমা খানিক পরিমার্জন করে দেখিয়েছেন, কীভাবে অতিরিক্ত যন্ত্রনির্ভরতা দীর্ঘমেয়াদি ক্ষেত্রে কোনো সংস্থার লাভের হার কমাতে পারে।২২ ঘটনাচক্রে, বর্তমানের কিছু গবেষণা থেকেও তেমনই ইঙ্গিত মিেলছে।
তাহলে শেষ বিচারে কী দাঁড়াল? কৃত্রিম মেধা যে মানুষকে তার চালকের আসন থেকে সরিয়ে দেবে—এই সিদ্ধান্তে আসা যায় না৷ আপাতত এটুকুই বলা চলে, সৃজনশীল মানুষকে কিছু স্থূল কাজ থেকে অব্যাহতি দিলেও কৃত্রিম মেধা কখনোই তাকে পুরোপুরি অপ্রাসঙ্গিক করে দিতে পারবে না। কারণ, তাহলে পুঁজিবাদী সমাজের বনিয়াদটিই যে নষ্ট হবে!
তথ্যসূত্র
১ দ্রঃ Lyotard, Jean-Francois, The Postmodern Condition, Manchester University Press, Manchester, England, 1984, pp. 3—6
২ দ্রঃ বসু, প্রদীপ, উত্তর আধুনিক রাজনীতি ও মার্কসবাদ, পুস্তক বিপণি, কলকাতা, ২০০৫, পৃঃ ১১—১৩
৩ দ্রঃ Touring, A. M., ‘Computing Machinery and Intelligence’, Mind, 1950, vol. 49, pp. 433—60
৪ দ্রঃ Copeland, B. Jack, ‘The Church-Touring Thesis’, The Stanford Encyclopedia of Philosophy, Edward N. Zalta (ed.), Summar 2020 Edition, ইউআরএল : http://plato.stanford.edu/archives/sum2015/entries/church-turing/
৫ দ্রঃ উত্তর আধুনিক রাজনীতি ও মার্কসবাদ, পৃঃ ১৪—১৬
৬ দ্রঃ ‘Computing Machinery and Intelligence’, Mind, pp. 433—60
৭ দ্রঃ চ্যাটার্জি, অমিতা, (প্রকাশিতব্য) এবার কথা প্রাণে প্রাণে, প্রবন্ধ সংগ্রহ, একলব্য, কলকাতা
৮ দ্রঃ Dennett, Daniel Clement, Brainchildren : Essays on Designing Minds (Representation and Mind Series), Penguin Books, London, 1998
৯ দ্রঃ Ibid., p. 5
১০ দ্রঃ Ibid., p. 20
১১ দ্রঃ Descartes, Rene, Discourse on Method, LaFleur, Lawrence, trans., New York : Bobbs Merrill, 1960, Descartes, Rene, The Philosophical Writings of Descartes, Translated by John Cottingham, Robert Stoothoff and Dugald Murdoch, vol. 2, Cambridge University Press, Cambridge, 1985
১২ দ্রঃ Discourse on Method, pp. 41-42
১৩ দ্রঃ Brainchildren : Essays on Designing Minds (Representation and Mind
Series)
১৪ দ্রঃ Ibid., pp. 8—10, 19
১৫ দ্রঃ Cole, David, ‘The Chinese Room Argument’, The Stanford Encyclopedia of Philosophy, Edward N. Zalta (Editor), Winter 2020 Edition, ইউআরএল: <http://plato.stanford.edu/archives/win2015/entries/chinese-room
১৬ দ্রঃ Scarle, John. R., ‘Minds, Brains and Programs’, Behavioral and Brain Science 3 (3) : 1980, pp. 417—57, http://cogprints.org/7150/1/10.1.1.83.5248.pdf
১৭ দ্রঃ বিশ্বাস, অতনু, ‘চ্যাটজিপিটি যেন শঙ্কুকাহিনির “কম্পু’’’, আনন্দবাজার পত্রিকা, কলকাতা, ৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৩
১৮ দ্রঃ ঐ
১৯ দ্রঃ Chomsky, Noam, ‘The False Promise of Chatgpt’, The New York Times, 8 March 2023, https:/www.nytimes.com/2023/03/08/opinion/noam-chomsky-chatgpt-ai-html
২০ দ্রঃ Beyer, Christian, ‘Edmund Husserl’, The Stanford Encyclopedia of Philosophy, Edward N. Zalta (ed.), (Winter 2020 Edition), https://plato.stanford.edu/archives/win2020/entries/husserl/
২১ দ্রঃ Marx, Karl, ‘Wage Labour and Capital, What are wages? How are they Determind?’ Capital : A Critique of Political Economy, London, Penguin Classics, 1981, https://www.marxists.org/archive/marx/works/1847/wage-labour/ch02.htm
২২ দ্রঃ Morishima, M., Marx’s Economics : A Duel Theory of Value and Growth, Cambridge University Press, Cambridge, 1973