এতৎ অঞ্চলের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় ঐতরেয় মহিদাস মহামুনি বিরচিত ‘ঐতরেয় আরণ্যক’-এ—
“প্রজাতি তিস্রঃ অত্যায়র্মীয়ুরিতি যা বৈ তা ইমাঃ প্রজাঃ তিস্রঃ।
অত্যায়নাং স্তানীমানী বয়াংসি বঙ্গ বগধাশ্চের পাদাঃ॥”
বঙ্গ, বগধ বা মগধ আর চেরপাদ দেশকে বলা হতো পক্ষীর দেশ। আসলে চেরপাদ বা পালামৌয়ের চেরো জাতি, মগধ ও বঙ্গের সাঁওতাল-হো-মুণ্ডারা ‘খেরওয়াড়’। ‘খের’ বা পাখির বংশধর। মহামুনি মহিদাসই এই ভূখণ্ডটিকে বলেছেন : “কীকটা নাম দেশ অনার্য নিবাসঃ।” ‘সংকীর্ণ যোনি’র দেশ। ‘কোল’ বা ‘হো’রা এই দেশের নাম রেখেছিলেন ‘বাংলো’। ‘বাং’ মানে ‘না’, ‘লো’ মানে ‘সেচ দিয়ে জল তোলা’। তাহলে একুনে দাঁড়াল—যে-দেশে জলসেচের দরকার হয় না, সে-দেশ ‘বাংলো’। ‘বাংলো দিশম’ বা বাংলাদেশ।
ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি প্রথম যখন ১৭৫৭ সালে বাণিজ্য করতে এল ভারতে বিশেষত বাংলায়, তখন তারা জঙ্গলমহলেও চাষিদের দিয়ে নীলচাষ করাত। মোল্লাহাটি যেমন, তেমন জঙ্গলমহলের দুই তীরবর্তী অববাহিকায়, দাঁতনে হাতিবাঁধি কুস্তুড়িয়া মুঢ়াকাটি রুখনীমারায়ও বাধ্য হয়ে চাবুক খেয়ে নীল বুনত চাষিরা। তার প্রত্নচিহ্ন, ভাঙাচোরা চাতাল ইত্যাদি এখনো বিদ্যমান। সময়ের ফেরে একদা বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে। অতঃপর জঙ্গলে শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে তারা নাস্তানাবুদ হতে লাগল। বিদ্রোহী চাষি ও বুনোদের কবজা করতে ১৮০৫ সালে লেফটেন্যান্ট ফার্গুসনের নেতৃত্বে গঠিত হলো সেই প্রথম ‘জঙ্গলমহল’ জেলা। তৎকালীন বিহারের মানভূম থেকে বীরভূম, বর্ধমানের কিয়দংশ, বিস্তীর্ণ বাঁকুড়া আর অখণ্ড মেদিনীপুর এর অন্তর্গত। আর আজ, ‘জঙ্গলমহল’ কোনো জেলা বা তার চেহারা-চৌহদ্দি সুনির্দিষ্ট না হলেও মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও বীরভূমের অরণ্যবেষ্টিত ‘মহল’ মাত্রই ‘জঙ্গলমহল’।
মহাভারতেও একটি কাহিনি বর্তমান। অসুররাজ বলির অনুমতিক্রমে ঋষি দীর্ঘতমসের ঔরসে বলিরানি সুদেষ্ণার গর্ভে ‘অঙ্গ’, ‘বঙ্গ’, ‘কলিঙ্গ’, ‘সুহ্ম’ ও ‘পুণ্ড্র’ নামে পাঁচ পুত্রের জন্ম হয়। এঁদের প্রত্যেকেরই নামানুসারে গড়ে ওঠে একেকটা স্বতন্ত্র জনপদ। বলাই বাহুল্য, অনুলোম পদ্ধতিতে আর্য ঋষি দীর্ঘতমসের ঔরসে শূদ্রারানির গর্ভে শূদ্রপুত্র উৎপাদনহেতু তামাম অঙ্গ-বঙ্গ-কলিঙ্গ-সুহ্ম-পুণ্ড্রই হয়ে গেল শূদ্রদেশ!
এর মধ্যে সুহ্ম-রাঢ় বা লাঢ়। ভবিষ্যপুরাণের ব্রহ্মখণ্ডে ‘রাঢ়ীখণ্ড জাঙ্গলভূমি’ নামে এক দেশ আছে। সেই দেশ অজলা, ঊষর ও জঙ্গলময়। রাজা হরিবর্মদেবের মন্ত্রী ভবদেব ভট্টও তাঁর একাদশ শতকের শিলালিপিতে অনুরূপ একটা দেশের কথা লিখেছেন, যার তিন ভাগ জঙ্গল, এক ভাগ গ্রাম ও জনপদ—যা ‘য়ুয়ান চোয়াঙ-রামচরিত-বৌদ্ধধর্মগ্রন্থাদিকথিত’ সেই ‘কয়ঙ্গল–কজঙ্গল- কজাঙ্গল’। এই সেই ‘আচারঙ্গসুতত’-এর ‘বজজভূমি’ আর ‘সুববভূমি’। অর্থাৎ উত্তর রাঢ়, দক্ষিণ রাঢ়, প্রান্ত রাঢ়। মহাভারতের টীকাকার নীলকণ্ঠও বলেছেন—রাঢ়দেশই সুহ্মদেশ। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে মহাবীর এদেশে ধর্মপ্রচারে এলে তাঁর পিছনে ‘ছু-ছু’ করে কুকুর লেলিয়ে দিয়েছিল রাঢ়বাসীরা।
অনেক পরে, ষোড়শ শতকে কৃষ্ণদাস কবিরাজ তাঁর শ্রীশ্রীচৈতন্যচরিতামৃত গ্রন্থে লিখছেন—
“মথুরা যাবার ছলে আসি ঝারিখণ্ড।
ভিল্লপ্রায় লোকসব পরম পাষণ্ড॥”
এ কোন ঝারিখণ্ড? এই কি সেই ‘রাঢ়ীখণ্ড জাঙ্গলভূমি’—যাকে মোগল আমলে বাদশাহরা নাম দিয়েছিলেন ‘কোকরা’ বা ‘ঝাড়খণ্ড’? কর্কটরেখা বরাবর অবস্থানহেতু বলা হতো ‘কর্কখণ্ড’? পুঁথিপত্রেও লেখা হচ্ছিল শ্লোক—
“অয়ঃ পাত্রে পয় পানম্।
শালপত্রে চ ভোজনম্॥
শয়নম্ খর্জ্জুরী পত্রে।
ঝাড়খণ্ডৌ বিধিয়তে॥”
শালপাতার থালায় খাওয়া, মাটির ভাঁড়ে জল পান করা, খেজুরপাতার চাটাই পেতে শোওয়া—এই ছিল ঝাড়খণ্ডের মানুষদের জন্য বিধান! তুরকি, পাঠান, এমনকী গোটা মোগল যুগ ধরে এই জঙ্গলাবৃত ভূখণ্ডটিকে বলা হতো—‘আঠার গড়জাত’, ‘কোকরা’ বা ঝাড়খণ্ড। বাবরের কন্যা গুলবদনের ‘হুমায়ূননামা’ এবং ‘জাহাঙ্গীরনামা’তেও ঝাড়খণ্ডের উল্লেখ আছে।
“ডহর ডহর রে দাদা ডহর কত দূর।/ আমফুল জামফুল দেশ কতদূর॥” তখনো, এখনো সে-দেশে কত না মানুষ! সাঁওতাল ভূঁইয়া ভূমিজ হো ওঁরাও বীরহড় মাহাত হাড়ি বাগদী ডোম মুচি লোধা মাহালী কামহার কুমহার ঘাসী বাউড়ি শুঁড়ি তেলী তামলী খেড়িয়া অসুর, ধোপা রাজু করণ সদ্গোপ ছুতার বাগাল, আরো কতশত তথাকথিত শূদ্র! বামুন কায়স্থ মাহিষ্য বৈশ্য রাজওয়ার। ভিল্লপ্রায় লোক, চুয়াড়। কবিকঙ্কণ মুকুন্দরাম চক্রবর্তী তৎকালীন মেদিনীপুরের আড়রায় বাস করে লিখেছিলেন চণ্ডীমঙ্গল কাব্য। সেখানে উল্লেখ আছে—“কৃতাঞ্জলি বীর কহে হই গো চুয়াড়।/ সবে না পরশ করে লোকে বলে রাঢ়॥” ১৭৬৭ থেকে ১৭৮৩ পর্যন্ত সত্যি সত্যিই ঘড়ুই-খয়রা-চুয়াড় বিদ্রোহ। চুয়াড় কোনো জাতির নাম নয়, চলতি কথায় অসভ্য, অচ্যুত, ইতর লোক। আরো আছে—“ফুল্লরা বেসাতি করে নগর বাহিরে।/ হাঁড়িয়া চামর বেচে চারি পাই দরে॥” কবিকঙ্কণ তাঁর ‘আখোটিয়া’ পর্বে আক্কুটি শবর ফুল্লরা ও কালকেতুকে নিয়ে লিখেছেন কালকেতু-ফুল্লরা উপাখ্যান। এখনো জঙ্গলমহলে শবরমানুষদের তিনটি প্রজাতি—‘লোধা’, ‘খেড়িয়া’ আর ‘আক্কুটি’। চলতি কথায় ‘আক্কুটি’ হলো লোভী।
যাহোক, সে-দেশেও বারো মাসে তেরো পরব। বিশেষত শারদীয়ার দিনগুলোয় তো উপর্যুপরি উৎসবের ছড়াছড়ি! বাইশাখ-ঝেট-আষাঢ়-শরাবণ, অর্থাৎ বৈশাখ জ্যৈষ্ঠ আষাঢ় শ্রাবণের ঝড়িয়া-বৃষ্টির শেষে ভাদ্র, ভাদরের গাদর মকাই বা ভুট্টা আর ডাহি-ডুংরিতে আউশধান পেকে গেলেই তো শরৎকালীন উৎসবের ক্যালেন্ডার কে যেন দেওয়ালে টাঙিয়ে দেয়! জঙ্গলমহলে বনঝাড়ে বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা বা পাঁজি আর তেমন কৈ! বেশির ভাগই তো দিন-মাস সন-তারিখের আঁক কষা হয় ঘরের দেওয়ালে ‘রেখ’ কেটে। ভাদ্রের ‘পহলা’ অর্থাৎ প্রথম দিনটাতেই ‘লইতনে-পুন্না’য় নতুন-পুরানো খাওয়া, ‘রাঁধাবাড়া’ উৎসব। নতুন ও পুরানো চাল মিশিয়ে রান্না করা। রাতে খাওয়া-দাওয়ার পর গোটা সেদ্ধ-কলাই আর সজনে শাকভাজা রেখে দেওয়া হয় পরের দিন সকালের জন্য। কারণ পরের দিনই তো অরন্ধন! জিতা পরব বা ‘জিতাষ্টমী’ ভাদ্র মাসের কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমীতে।
‘জিতা’ পাততে হয় ঘটিতে নয়, পিতলের ঘড়া বা গাগরায়। কোথায় পাবে পিতলের ঘড়া-গাগরা? মাটি তো, মাটির হাঁড়িতেই সই। হাঁড়িতে ভেজানো বুট কিংবা ছোলার দানা। সিঁদুরের টিপ, শালুক ফুলের মালা, ধূপ-ধুনা। হাঁড়ির মুখ চাপা দেওয়া গামলায় রাখা হয় মেহা-মাদাল—যাকে বলে আতা, ভেলাফল, আমলকী, আরো কত জংলি ফল! হাঁড়ির চারধারে কাঁকুড়। এ তো গেল রাতের আয়োজন, পরের দিন ভোরে দইচিঁড়ে, কিংবা যাহোক তাহোক খেয়ে সারাদিন উপোস। ঘড়া-গাগরা, কী হাঁড়ির নৈবেদ্য নিয়ে পূজাচার। পূজা শেষে দীপের কালি-কাজল গেল সন্তান-সন্ততির চোখে, ভেলা টিপ গেল কপালে। ভেজানো বুট কী ছোলার দানা খেয়ে উপোস ভাঙা হলো। এরপর দই চিঁড়ে কলা মেখে পুকুরঘাটে ফলাহার, হৈ-হল্লা! অতঃপর মাটির শিয়াল, শকুন বা শুগনি বানিয়ে তুমুল হৈচৈ! তাদের পূজা করা, ‘কাঁকুড়ের আড়াই কামড়’ বা পুকুরের জলে ‘শশা ডুবানো’ সেরে শিয়াল-শকুনের বিসর্জন! শূদ্রাচার! ছা-ছানাদের ছিছিক্কার—
“শেয়াল গেল খালকে,
শুগনি গেল ডালকে।”
লোধাশবর খেড়িয়াশবররাও আখুডাল আর ডুমুরডাল মাটিতে গেড়ে ‘জিতুয়া’ বা ‘জিতা’ করে। সাত রকমের ফুল, সাত রকমের ফল দিয়ে তারা বড়ামথানে পূজা দেয়। চালের গুঁড়ি আর আখের গুড় দিয়ে তেলে ছাঁকা গুড়পিঠা খায়।
এরপর আসা যাক ‘গমহা পুনোই’ বা ‘গমা পূর্ণিমা’র কথায়, যাকে বলে রাখিপূর্ণিমা। রাখিবন্ধন উৎসব। হাতে হাতে রাখি বাঁধে, মৃদঙ্গ মুরলী করতাল সহযোগে নাম-কীর্তন হয় হরিবাসরে। হরিমন্দিরে। লোধা খেড়িয়ারা তাদের বড়ামথানে, গরাম-থানে জড়ো হয়ে বনদুর্গার পূজা দেয়। নাকি অত্যাচারী ও উপদ্রবকারী গমহা-অসুরকে এদিনই হত্যা করেন তাদের বনদুর্গা! এ তল্লাটে সেদিন আরেকটা জিনিসও দেখা যায়—কুলপুরোহিতরা, পূজারি ব্রাহ্মণরা হাতে গোছা গোছা নতুন ধবধবে পৈতা নিয়ে আচণ্ডালশূদ্রজনজাতিদেরও সমন্ত্র পৈতা পরায়। অবশ্য বিনিময়ে পয়সা পায়।
ভাদ্র মাসের একাদশীতে সাঁওতাল মুণ্ডা ভূঁইয়া ভূমিজ মাহাত কামহার কুমহার লোধা খেড়িয়া হো বিরহড় মাহালীকে না ‘করম’ করে! সাঁওতালদের করম একটু অন্যরকম। মাহাত কামহার কুমহারদের করমে ‘জাওয়া’ পাতার একটা ব্যাপার আছে। নতুন ঝুড়িতে নদী থেকে বালি তুলে এনে যুবতী ও কিশোরী মেয়েরা ছোলা মুগ কুরথি সরিষার বীজ হলুদ মাখিয়ে তার মধ্যে পুঁতে দেয়। সেসব বীজ অঙ্কুরিত হলে মেয়েরা সেই ‘জাওয়া ডালা’কে ঘিরে গান গেয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলা জাগায়। সাঁওতালদের করম’-এ ‘জাওয়া’ নেই। আর বাকি সব একইরকম। ‘করম’-এর দিনটায় নদী থেকে স্নান করে আসে পূজারি ‘লায়া’। তারপর জাহেরথানে ফুল-জল দিয়ে ‘গেঁাসাই’ আর ‘কারামগেঁাসাই’-এর পূজা করে। সাঁওতাল যুবতীরা সাঁওতাল কিশোরীরা তখন বন-বাদাড়ে যায় ফুল তুলতে, ভেলা-বহেড়া-আমলকী-হরীতকী, ধানের পাতা তুলতে। সন্ধ্যা হলে ‘ডাঙুয়া’রা—মানে যুবকরা যায় জঙ্গলে, করমগাছের ডাল-দুটি গড়জহার করে এককোপে কেটে আনতে। মাদল বাজিয়ে গাইতে গাইতে যাওয়া, গাইতে গাইতে আনা।
“উনদিন দ কারাম গঁশায়—
বাহরে রে তাঁহে কানা বিন—
তেহেঞ দ কারাম গঁশায়—
অড়াঃ তেলে ইদিয়ে বিন।”
“এতদিন বাইরে ছিলে কারাম
আজ তোমাকে ঘরের দুয়ারে নিয়ে এলাম।”
গৃহস্থের আঙিনায় কারাম অর্থাৎ করমডাল-দুটিকে পোঁতা হলো। একটা ডাল করমরাজা, আরেকটা ডাল করমরানি। এবারে যে-গৃহস্থের করণতলার বিলে মরা করমডালে পাতা গজিয়েছে, তার আঙিনায় করম গাড়া হয়েছে।
শুরু হলো ‘কারামকে রাতি’। শুরু হলো ‘কারাম বিনতি’—মানে কার্মু আর ধার্মুর উপকথা। তারপর তো ‘তুমুদাঃ’ অর্থাৎ মাদল বাজিয়ে সারারাত ধরে পাঁতা নাচ আর সেরেঙ। কাল সকালে ‘দামু দাঃ’ নদীজলে করমডাল-দুটির ভাসান।
“আজ রে করমরাজা ঘরে দুয়ারে।
কাল রে করমরাজা সবনন্নেখার পারে॥”
“তেঁহে দ কারাম গঁশায় অড়াঃ দুয়ার রে
খঃঅনা গাড়িয়া রে।
গাপাঃ দ কারাম গঁশায়
অড়াঃ তে রুয়ঢ় চালা বিন॥”
“আজ রে করমরাজা খানাডোবা রে।
কাল রে করমরাজা ঘরে দুয়ারে॥”
বাইশাখ, ঝেটে অর্থাৎ বৈশাখ জ্যৈষ্ঠে বনঝাড় কেটে যে ‘আশ’ বা আউশধান বোনা হয়েছে, তা ভাদ্র মাসে এসে পাকতে শুরু করেছে। ডাহি-ডুংরিতে যে বোনা হয়েছে ইড়ি-গুঁদলি, কদো—তাও পেকে ঝুনো হলুদ হয়েছে। ডাহিময় এখন উড়ছে ঘুরছে বনটিয়া-হরিয়াল, বনি-চটি। ঝাঁকে ঝাঁকে নেমে আসছে খেতিতে। বিশেষ করে আউশধানের ডাহিতে। অতএব—কাটো রে, আনো রে। কিন্তু তার আগে তো ‘নাওয়াই’ বা নবান্ন, ‘ইড়ি-গুঁদলি’। উৎসব, উৎসব! ডাহি থেকে কেটে আনা হয় গোছা গোছা ধানশিষ, ভেলাগাছের ডাল। ভেলা পাতায় বানানো হয় ‘ফুড়ুঃক’—তার মানে ভেলাপাতার বাটি। ঢেঁকিতে ছেঁটে তৈরি করা হয় নতুন ধানের চিঁড়ে। নতুন কুলোয় চিঁড়ে-গুড় একসঙ্গে মাখামাখি করে তৈরি করা হয় ভোগ। তারপর তো ভেলাপাতার দোনায় ভরে জাহেরথানে, গরামথানে ঘরের থানে বোঙাদের নামে নামে ভোগ দেওয়া। নতুন চাউলের গুড়দাকা, গুড়ভাত। কদো-গুঁদলির হাঁড়িয়া। খাও রে! নাচো রে! গাও রে!
ওদিকে ততদিনে ‘বাবুঘর’-এ—জমিদারবাড়িতে, রাজবাড়িতে, ক্লাবে ক্লাবে, শহরে বাজারে দুর্গাপূজার ঢাকে কাঠি পড়েছে। ষষ্ঠী সপ্তমী অষ্টমী নবমী দশমী। দেবী দুর্গার ভাসানও হয়ে গেল। ভাসানের সঙ্গে সঙ্গে ধানবিলের গোড়ায় গোড়ায় যত ‘ধানাহুলু’ মাছ ছিল—সব ভেসে গেল! ঐ দিনে, ঐ দশমীর দিনেই সাঁওতাল, অসুরদের ‘ভুঙ-চুঙ-সারেঙা’ করে ভুয়াঙও বেজে উঠল। শুরু হয়ে গেল ‘দাঁশায়’, দাঁশায়, দাঁশায়। ‘ভুয়াঙ’ হলো লাউয়ের একটি বাদ্যযন্ত্র। প্রায় দু-তিন হাতের একটা লম্বা লাউকে কুরে কুরে শাঁস বের করে তার জুড়ে জুড়ে তৈরি করা যন্ত্র। তার সঙ্গে ‘রে-এ-এ-এ চঁ-অ-অ-অ’, ‘রে-এ-এ-এ চঁ-অ-অ-অ’ করে কেঁদরা-কেঁদরির বাজনা। ভুয়াঙ বা দাঁশায় নাচ। পুরো আশ্বিন মাসটার নামও তো দাঁশায়! মেয়েরা না, ছেলেরাই শাড়ি-সায়া-ব্লাউজ পরে মেয়ে সেজে নাচে। হাতে চুড়-বালা, মাথায় ময়ূরপালক। ভুয়াঙ, কেঁদরির সুর কেমন করুণ করুণ, উদাস উদাস! মাথা ঝুঁকিয়ে পিছিয়ে গাইছে—
“হায় রে! হায় রে! অকারেদ হো গুরু হো ভুয়াঙ
জানাম লেন—
হায় রে! হায় রে! অকারেদ হো গুরু হো কাঁসা
রাঁও রাঁও লেন—
হায় রে! হায় রে! গুরিচ মাঁদেরে গুরু হো ভুয়াঙ
জানাম লেন—
হায় রে! হায় রে! সেরমা সাড়িম রে গুরু হো কাঁসা
রাঁও রাঁও লেন।”
হায়! হায়! কোথায় জনম নিল ভুয়াঙ হে গুরু—
হায়! হায়! কোথায় প্রথম বাজল কাঁসা হে গুরু—
হায়! হায়! গোবরগাদায় জনম নিল ভুয়াঙ—
হায়! হায়! আকাশ জুড়ে বাজল কাঁসা।
উৎসব তো নয়, যেন শোকের আবহ! কার জন্য সেরেঙে ‘হায় রে’ ‘হায় রে’ বলে শোক-উচ্ছ্বাস? নাকি ‘হুদুড় দুর্গা’ নামে সাঁওতাল-অসুরদের ‘সাঁতভূম’-এ এক রাজা ছিল। রাজা খুব প্রজাবৎসল ছিল। তাদের উপকার ও রক্ষা করত। ‘দিকু’দের দেবী দুর্গা তাকে মেয়ে হয়ে হত্যা করল এই দশমীর দিনেই। তাই সাঁওতালরা, অসুররা এই দশমীর দিনে ভুয়াঙ বাজিয়ে ‘দাঁশায়’ করে, ‘হায় রে’ ‘হায় রে’ বলে শোক-উচ্ছ্বাস করে। তারা দিকুদের দুর্গার মুখ দেখতে চায় না। আজকাল অবশ্য দীর্ঘ, দীর্ঘদিনের সহাবস্থানের ফলে বিভেদ-বৈষম্য কিছুটা হলেও ঘুচে গিয়েছে।
তবে ঐ যে, অভিধানে ‘শূদ্র’ শব্দের অর্থ লিখিত আছে—‘নিকৃষ্টত্ব হেতু শোককারী; বর্ণচতুষ্টয়ের চতুর্থ বর্ণ; অবর বর্ণ, বৃষল, দাস’, তদুপরি জ্বলজ্বল করছে—“পদ্ভ্যাং শূদ্রো অজায়ত; মনু মতে ব্রহ্মার পাদ হইতে ইহাদের জন্ম। ব্রাহ্মণাদি বর্ণত্রয়ের পরিচর্যা ইহাদের বৃত্তি।” ‘শূদ্র’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ নিয়েও মারপ্যঁাচ আছে। বাদরায়ণের ‘বেদান্ত সূত্র’ অনুযায়ী ‘শুক্’ শব্দের অর্থ ‘শোক’ আর ‘দ্রু’ ধাতু থেকে জাত ‘দ্র’ শব্দের মানে ‘ধাবন’ করা। তার মানে শোকের দিকে যাত্রা করা। পাণিনির ‘ঊণাদিসূত্র’-এও আছে—‘শুচ্’ বা ‘শুক্’ ধাতু + ‘র’। র=রুদ্, রোদন করা। বঙ্গীয় শব্দকোষ-এ—শূদ্র পুং৴শুচ্ (শোক) + র (রক্)-ক, নিকৃষ্টত্ব হেতু শোককারী। ‘আর আর্য=বিদ্বান, অনুষ্ঠাতা, মান্য, পূজ্য, সাধু, শ্রেষ্ঠ…।’ ‘অধিকৃত বা অভিজাত’। অর্থাৎ, এক দল লোক শোকের দিকে যাত্রা করবে, শোক-উচ্ছ্বাস করবে, রোদন করবে। আরেক দল অধিকার করতে করতে ক্রমশ অভিজাত হবে।
আর কোথাও থাক বা না থাক, ‘ইহাদের গানগুলির ভিতর কোথাও রোদনধ্বনি রহিয়া গেল’। যেমন ‘দাঁশায়’, যেমনটা ‘সহরায়’—
“অহি রে! কনে ত কাঁদে ভালা জনম জনম যে বাবু হো
কনে ত কাঁদে ছয়মাস।
কনে যে কাঁদে ভালা দেড় প্রহররাতি যে বাবু হো
সিঁদুরে কাজলে টলমল॥”
প্রাবন্ধিক, ঔপন্যািসক ও গল্পকার,
প্রাক্তন আমলা, পশ্চিমবঙ্গ সরকার