ধর্ম ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান অঙ্গ। অতীন্দ্রিয় সত্তা, ঈশ্বর-অনুসন্ধানের পথ হিসাবে ধর্মকে বিবেচনা করা হলেও এর মূলত তিনটি দিক আমরা লক্ষ্য করে থাকি—পৌরাণিকতা (Mythology), দর্শন (Philosophy) এবং আচার (Rituals)। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্ম, যা মূলত চৈতন্যদেবের দ্বারা প্রবর্তিত হওয়ার পর থেকে দীর্ঘ পাঁচশো বছরেরও অধিক সময়ব্যাপী বাংলা তথা ভারতীয় ধর্মীয় সংস্কৃতিতে গুরুত্বপূর্ণ ধারা হিসাবে বিদ্যমান, সেটিও এই প্রচলিত ত্রিমাত্রিক অর্থবহতার মধ্য দিয়ে প্রবাহিত। ভক্তিবাদী এই ধর্মের অনুরাগীরা পৌরাণিকতা ও দার্শনিকতার পাশাপাশি আচারপালনকেও বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বলা যেতে পারে, বৈধী ভক্তির অংশরূপে আচারপালনের প্রতি তাঁরা অনেকটাই আগ্রহী। আর এই পালনের যে উপকরণ বা ধর্মীয় অনুষঙ্গ, তাকে কেন্দ্র করে এক বিরাট অর্থনীতির প্রকাশ ঘটেেছ। ধর্মকে ভিত্তি করে এই লোকসংস্কৃতি এবং তার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত অর্থনৈতিক কাঠামো একে এক অভিনবত্ব দান করেছে। বাংলার সংস্কৃতিতে ধর্মপালনের অনুষঙ্গ হিসাবে যে বৈধী ভক্তির অনুশীলন আজও বিদ্যমান, তা নিয়ে সাহিত্যচর্চা হলেও এর আড়ালে অপ্রকাশিত অবস্থায় থেকে গিয়েছে এই ধর্মীয় সংস্কৃতি- নির্ভর ক্ষুদ্রশিল্প ও শিল্পভিত্তিক অর্থনীতির এক বিরাট অংশের মানুষের আর্থ-সামাজিক জীবনের ইতিহাস। এর সঙ্গে জড়িত জনগোষ্ঠীর জীবনযাত্রা।
ধর্মের সঙ্গে আর্থিক ব্যবস্থার যে সুগভীর পারস্পরিক নির্ভরশীলতার সম্পর্ক রয়েছে—এই বাংলাতেই রয়েছে, তা অনেক সময় আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের দার্শনিক বার্তা আছে, কিন্তু সাধারণ মানুষ ধর্মের বহিরঙ্গের প্রতি বেশি আকৃষ্ট হয় এবং আচারপালনকে কেন্দ্র করে ঐ দর্শনের পারে গিয়ে তার উপাস্যকে অনুভব করতে চায়।
পর্যটনশিল্পকে আমরা এই আলোচনাতে আনতে চাইছি না। বৈধী ভক্তি ও তার অনুষঙ্গ হিসাবে তুলসীর মালা, ভাগবত পাঠ, তিলকমাটি প্রভৃতির ব্যাপক প্রচলন গৌড়ীয় বৈষ্ণব সমাজে রয়েছে। কেবল কীর্তনের অনুষঙ্গ হিসাবে প্রয়োজন খোল, করতাল, মন্দিরা প্রভৃতি বাদ্যযন্ত্র, যা ধর্মীয় আনন্দকে পূর্ণতা দেয়। কিন্তু এগুলি পরিবেশনায় ও বাদ্যযন্ত্রগুলি নির্মাণের সঙ্গে যে জনগোষ্ঠী এবং ক্ষুদ্রশিল্পের অর্থনীতি জড়িত, তা আমাদের দৃষ্টি এড়িয়ে যায়। উত্তরাধিকারসূত্রে ঐ জনগোষ্ঠী কেবল অর্থোপার্জন নয়, এই শিল্প ও ধর্মীয় সংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখার েচষ্টাও করে চলেছে। কারণ, এই আচারপালন বেঁচে থাকলে তাদের অর্থনীতি বেঁচে থাকবে, জীবন বেঁচে থাকবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এই উপকরণ (আচার-অনুষ্ঠানে যা প্রয়োজনীয়) কেবল উৎপাদনকারীকেই নয়, ব্যবহারকারীকেও আর্থিক সুবিধা প্রদান করে। যেমন খোল (বাদ্যযন্ত্র বিশেষ) তৈরির ক্ষেত্রে কেউ মাটির আধার বা পাত্র তৈরি করছে, কেউ পাত্রটিকে চামড়া দিয়ে বেঁধে ব্যবহারের উপযোগী করে তুলছে, আবার কেউ ঐ তৈির খোল ব্যবহার করে কীর্তন পরিবেশন করছে। করতাল, মন্দিরার ক্ষেেত্রও একই কথা প্রযোজ্য।
তুলসীর মালা তৈরির ক্ষেত্রেও এরকম নানা পর্যায় আছে। তুলসী গাছের চাষ করে, তাকে শুকিয়ে সুন্দরভাবে হাতে কেটে মালা গাঁথা এবং বাজারে বিক্রি করা—প্রতিটি পর্বেই অর্থনীতির সম্পর্ক রয়েেছ। আবার কাঠের তৈরি বা ধাতুর তৈরি বিভিন্ন বিগ্রহও উৎপাদককে অর্থ উপার্জনে সাহায্য করে। এই লোকশিল্পগুলিতে যে সূক্ষ্মতা রয়েেছ, তা নির্মাণকারীদের শৈল্পিক দক্ষতাকে প্রকাশ করে। আবার মালা জপের থলি তৈরিতে যে সুতোর কাজ, তাও অনন্য। এভাবে অর্থনীতির পরিভাষায় শ্রমবিভাজন বা ‘division of labour’-কেন্দ্রিক পণ্য উৎপাদন ও অর্থনৈতিক কাঠামো নির্মিত হয়। আরো উল্লেখ্য, এই জনগোষ্ঠীর বেশির ভাগ মানুষই ধর্মীয় মূল্যবোধের তাগিদে এই উৎপাদনকে পবিত্র কর্তব্য বলে মনে করে। পারিবারিক পরম্পরা মেনে ধর্মীয় আনুগত্য ও ব্যবসায়িক কৌশল কোথায় যেন সম্পৃক্ত হয়ে যায়।
এই বিষয়টি নিয়ে পূর্বে কোনো ক্ষেত্রসমীক্ষা নজরে আসেনি। ফলে আকরগ্রন্থ, পুঁথি, প্রবন্ধ পর্যালোচনা করার সুযোগ হয়নি। তাই গবেষণাটি মূলত সমীক্ষানির্ভর। গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের সঙ্গে জড়িত প্রধান স্থান হিসাবে এক্ষেত্রে নবদ্বীপ, শান্তিপুরকেই বিবেচনা করা হয়েছে। এছাড়াও তুলসীর মালার ক্ষেেত্র বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের অন্তর্গত আকুঞ্জীপাড়া, মৃদঙ্গ বা শ্রীখোলের ক্ষেত্রে নদিয়ার মাজদিয়ার অন্তর্গত চন্দননগর এবং তিলকমাটি ও জপমালার থলির ক্ষেত্রে নবদ্বীপকে ক্ষেত্র হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছে। নবদ্বীপ গৌড়ীয় বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান কেন্দ্র হওয়ায় তথ্য অাহরণ অনেক সুবিধাজনক ও যুক্তিসংগত। শিল্পীদের বৈষ্ণবীয় ভাবাবেগকে অনুধাবন করা এখানে অনেক বেশি সহজসাধ্য। সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ করে প্রয়োজনীয় উপাদান সহযোগে এই প্রবন্ধটি রচিত হয়েছে।
তুলসীর মালা
তুলসী ও তুলসীর মালা বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বীদের নিকট একপ্রকার ‘পরিচিতিপত্র’ হিসাবে কাজ করে। তুলসী মূলত পবিত্রতাস্বরূপিণীর ভূমিকা নিয়ে থাকে। এর মালা ধারণ বা জপমালা গ্রহণ বৈষ্ণবদের কাছে গভীর আগ্রহের। এহেন মালা তৈরি ও বাজারে বিক্রির ক্ষেত্রে এক বিপুল ক্ষুদ্রশিল্পের অর্থনীতি ও শ্রমিকের অবস্থান লক্ষ্য করা যায়। বাজারচলতি তুলসীর মালা ও অন্যান্য সামগ্রীর দুটি রূপ দেখতে পাওয়া যায়। প্রথমত, একপ্রকার মালা তুলসীর মতো হলেও তুলসীর নয়, সেগুলি বেল থেকে তৈরি হয়। এই শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকদের ব্যাপকতা বেশি। অন্যদিকে রয়েছে খাঁটি তুলসীর মালা। শিল্পীর দ্বারা তৈরি এই মালার কদর থাকলেও বহু মানুষ না জেনে নকল তুলসীর মালা ব্যবহার করে থাকে।
বৃন্দাবন থেকে আনীত তুলসীর মালা নবদ্বীপে বিক্রি হয়, তবে তার দাম বেশি। নবদ্বীপের বিভিন্ন পণ্যবিপণিতে তুলসীর মালা বিক্রির পরিমাণ (উৎসব ব্যতীত) ২০/২৫টি বলে এক ব্যবসায়ী জানিয়েছেন। বিভিন্ন দামে এই মালা বিক্রি হয়, তবে ৭/৮ টাকা দামের বিক্রি বেশি। বর্তমানে বিভিন্ন ডিজাইনের ব্রেসলেট, নেকলেস, পুঁতি-লাগানো তুলসীর মালা বিক্রি হচ্ছে, যা আধুনিক রূপসজ্জা বা ফ্যাশনকে গুরুত্ব দেয়। বহু যুবক-যুবতী এই নব্য ঘরানার তুলসীর মালা ধারণ করছে। সবচেয়ে সুবিধা হলো—ধাতুর মতো তুলসীর কোনো ক্ষতিকারক দিক নেই। সম্পূর্ণ পরিবেশবান্ধব বা ‘বায়ো-প্রোডাক্ট’ বললে একে ঠিক বলা হবে।
নবদ্বীপে রয়েছেন কয়েকজন বৃদ্ধ, যাঁরা বিগ্রহ উপাসনার পাশাপাশি তুলসীর মালা তৈরি করে চলেছেন। কেন জীবিকা হিসাবে এটি বেছে নিয়েছেন—এর উত্তরে তাঁদের একজনের বক্তব্য ছিল—“বাজারে নকল মালায় ভর্তি। তাই নিজের দক্ষতাকে কাজে লাগিয়ে এই মালা তৈরি করি। সামান্য লাভ পেট বাঁচানোর জন্য করতে হয় ঠিকই, কিন্তু তুলসীর মালা নিয়ে প্রতারণা কেন থাকবে? বৈষ্ণবীয় ভাবাপন্ন মানুষের হাতে তাদের সাধনের আবশ্যিক এই মালা তুলে দিতে পেরে আমি ধন্য।” সাধারণত ৩/৪ বছর বাঁচে এমন তুলসীর গাছ থেকেই মালা তৈরি সম্ভব। সেটি আসে মুর্শিদাবাদ থেকে, কিনতে হয় প্রতি কেজি ১৫ টাকায়। নবদ্বীপের গঙ্গার বিভিন্ন ঘাটে ফাল্গুন ও চৈত্র মাসে শুকিয়ে যাওয়া তুলসীর গাছ ফেলে রাখা থাকে। তিনি ঐ তুলসীর গাছগুলো সংগ্রহ করে রাখেন এবং পরে নিজস্ব যন্ত্রপাতি দিয়ে সেগুলিকে মালায় পরিণত করেন। বহু বিশিষ্ট বৈষ্ণব তথাকথিত বাজারি তুলসীর মালার পরিবর্তে খাঁটি তুলসীর মালা সংগ্রহ করেন এখান থেকে। অর্থের জন্য ব্যবসা নয়, সেবার মনোভাব নিয়ে শিল্পী অর্থোপার্জন করে চলেছেন। ধর্মের সঙ্গে অর্থনীতির এই অপূর্ব মেলবন্ধন—এককথায় অনবদ্য।
শ্রীখোল
“হাসিয়া কাঁদিয়া, প্রেমে গড়াগড়ি, পুলকে ব্যাপিল অঙ্গ।
চণ্ডালে ব্রাহ্মণে, করে কোলাকুলি, কবে বা ছিল এ রঙ্গ।।
ডাকিয়া হাঁকিয়া, খোল করতালে, গাহিয়া ধাইয়া ফিরে।
দেখিয়া শমন, তরাস পাইয়া, কপাট হানিল দ্বারে।।
এ তিন ভুবন, আনন্দে ভরিল, উঠিল মঙ্গল-সোর।
কহে প্রেমানন্দ, এমন গৌরাঙ্গে, রতি না জন্মিল তোর।।”১
(প্রেমানন্দের মনঃশিক্ষা)
কীর্তনের আনন্দে শ্রীখোলের উপস্থিতি অনেকটা রান্নায় নুনের মতো। নুন ছাড়া তরকারি আর শ্রীখোল ছাড়া কীর্তন প্রায় সমগোত্রীয়। দীর্ঘ পাঁচশ বছর ধরে শ্রীখোলের ব্যবহার আজও প্রায় অপরিবর্তিত আছে—শব্দে ও ছন্দে। বিষয়টি অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, একটি বাদ্যযন্ত্র নির্মাণের সঙ্গে জড়িত কমপক্ষে তিনটি জনগোষ্ঠী এর দ্বারা উপকৃত হচ্ছে আর্থিকভাবে। প্রথমেই কাঁরি প্রস্তুতকারক অর্থাৎ মাটির আধার তৈরি করছে যারা; দ্বিতীয়ত, ছাউনি দিচ্ছে যারা এবং তৃতীয়ত, যারা আনন্দের সঙ্গে কীর্তন পরিবেশন করছে। এরা প্রতিটি স্তরে তাদের উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাচ্ছে এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের ওপর নির্ভরশীল।
প্রথমে আসা যাক প্রস্তুতকারকের কথায়। পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র এই শ্রীখোলের মাটি ও শিল্পী পাওয়া যায় না বা কৌশল সবার আয়ত্তাধীন নয়। বংশপরম্পরায় দুটি জায়গায়, মূলত নদিয়ার মাজদিয়ার চন্দননগরে ও গাজনায় কাঁরি প্রস্তুত হয়। মাজদিয়ার স্বদেশ পাল ও সত্য পালের বংশানুক্রমিক উৎপাদনের ইতিহাস প্রায় ১৮০ বছরের প্রাচীন। এঁরা শ্রীখোল বিক্রি করে প্রতি বছর প্রায় ৭০ থেকে ৭৫ হাজার টাকা লাভ করেন। প্রধানত, এঁটেল মাটি ও পরিমাণমতো সাদা বালি মিশিয়ে ঘূর্ণায়মান চাকাতে হাতের কৌশলে প্রস্তুত হয় খোলের আদল, দুটি মুখ বাঁশের কাঠির মাধ্যমে তৈরি হয়। তারপর রোদে শুকিয়ে (হালকা করে) ধীরে ধীরে পিটিয়ে খোলের আকার দেওয়া হয়। পাটের আঁশ দিয়ে ভিতর ও বাহির মসৃণ করা হয়, পরে শুকিয়ে পুড়িয়ে পরিপূর্ণ আকৃতি পাওয়া যায়। মহিলারা নয়, পুরুষেরাই এই কাজে যুক্ত থাকে। মাসে প্রায় ৮০ থেকে ৮৫টি কাঁরি বিক্রি হয়। নবদ্বীপ ও মায়াপুরের মূলত দাসেরা (এটি আঞ্চলিক উপাধি, এরা ছাউনি দেয়) এই খোল কেনে। তবে জ্বালানি ও মাটির দাম ক্রমশ বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং সরকারি সাহায্য না পাওয়ায় এই শিল্প একেবারেই অলাভজনক হয়ে উঠছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই পেশায় উৎসাহিত হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় সমস্যা বাজারের অনিশ্চয়তা, ফলে বিনিয়োগে ঝুঁকি থাকছে।
আবার যারা এই খোল ছাউনি দিচ্ছে ও বাজারে বিক্রির উপযুক্ত করে তুলছে, তারাও কিছু অর্থের সংস্থান করছে। এদের মতে, খোল তৈরিতে খরচ পড়ে মোটামুটি ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা, সময় লাগে ৪/৫ দিন। এর সঙ্গে রয়েছে পরিশ্রম। শ্রীখোল বিক্রি হয় ৩০০০ থেকে ৩৫০০ টাকায়। মাসে ২/৩টি শ্রীখোল বিক্রি হয়। বড় বৈষ্ণবীয় অনুষ্ঠানে অর্ডার সাপ্লাই করা হয়।
মৃদঙ্গ বা শ্রীখোল বাদক বিভিন্ন কীর্তনে দক্ষতা প্রকাশ করে অর্থোপার্জন করে। নবদ্বীপে প্রায় ১৫—১৭ জন আছে, যারা শ্রীখোল বাজিয়ে তাদের সংসার প্রতিপালন করছে। তবে খুব সচ্ছলভাবে নয়, বরং বহু প্রতিকূলতার সঙ্গে। বাস্তবে বিষয়টি থেকে অর্থ উপার্জন গৌণ বিষয়, শিল্পীর কাছে আনন্দপ্রদানই আসল কথা। নবদ্বীপের পুরানো ভজনকুঠির বৃদ্ধ কীর্তনীয়া নিমাই দাস ৪৫ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে জড়িত। তিনি ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত উপার্জন করেছেন এক-একটি অনুষ্ঠানে। আবার শ্রীখোল বাজানোর তালিম বা প্রশিক্ষণ দিয়ে মাসিক কিছু বেতনও পেয়েছেন। অরুণাচলপ্রদেশ, মণিপুর, মেঘালয় এমনকী বাংলাদেশেও গিয়েছেন। তবে বর্তমান প্রজন্মের আকর্ষণ ক্রমশ কমছে এই পেশায়।
করতাল
আমাদের দেশীয় বাদ্যযন্ত্রগুলির মধ্যে করতালের ভূমিকা স্বতন্ত্র। খোল ও করতাল একে অপরের পরিপূরক হয়ে কীর্তনকে শ্রুতিমধুর করে তোলে। নবদ্বীপে করতাল তৈরির ইতিহাস ঐতিহ্যমণ্ডিত, কারণ নবদ্বীপ কাঁসা শিল্পের শক্তিশালী ঘাঁটি। নবদ্বীপের তৈরি করতাল কলকাতা, বৃন্দাবন, ত্রিপুরা, মণিপুর এবং বিদেশিদের হাত ধরে বহির্বিশ্বেও পাড়ি দেয়। করতাল কাঁসা এবং পিতল উভয়েরই হয়। তবে পিতলের করতাল যেখানে প্রতি কেজি ৪৫০ টাকা পাইকারি, সেখানে কাঁসার করতাল প্রতি কেজি ৭৭০ টাকা। প্রতি কেজিতে কারিগরের পারিশ্রমিক ২০—৩৫ টাকা। তবে একসঙ্গে ৪/৫ জন শ্রমিকের প্রয়োজন হয়। একদিনে গড়ে ৩০ কেজি করতাল তৈরি করা যায়। শ্রমিকের গড়ে দিনপ্রতি আয় ৬০০ টাকা। আবার যে বিক্রি করে, তারও মুনাফা হয়। নবদ্বীপে এইরকম ১৫টি কারখানায় করতাল তৈরি হয়—হিসাব করে দেখা যায়, গড়ে ৩০০ কেজি প্রতি মাসে ও বছরে ৩৬০০ কেজি।
আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার করতাল তৈরিতে চালু হলেও শ্রমের চাহিদা কোনো অংশে কমেনি। তবে দক্ষ শ্রমিকের জোগান ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। শিক্ষিত বেকারেরা এই অর্থ রোজগারের ক্ষেত্রটিতে মনোনিবেশ না করলেও পুরানো শ্রমিকরাই প্রধানত এর সঙ্গে যুক্ত। বাদ্যযন্ত্রটি তৈরিতে যে বিশিষ্টতা বা মৌলিকতা, তা এই শিল্পকে আজও বাঁচিয়ে রেখেছে। সর্বোপরি বৈষ্ণবীয় আদর্শ প্রতিপালনের ক্ষেত্রে বাদ্যযন্ত্র হিসাবে করতালের জুড়ি মেলা ভার।
পোশাক
শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত-এ শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেন, ভক্ত, ভগবান ও ভাগবত—তিনই এক। রাগানুরাগা ভক্তিকে আশ্রয় করে ভক্ত সর্বদাই ভগবানকে তার মনের সৌন্দর্য দিয়ে সাজাতে চায়। দ্বৈতভাবের সাধনার এটি একটি বৈশিষ্ট্য। ভক্তরা তাদের আরাধ্য দেবদেবীর বিগ্রহকে বিভিন্ন পোশাক পরিয়ে অনাবিল আনন্দ উপভোগ করে। বর্তমানে বিগ্রহের ছোট ছোট পোশাক ভক্তসমাজে বেশ জনপ্রিয়। পূর্বে বৃন্দাবন থেকে এই পোশাক আমদানি করা হলেও বর্তমানে এটি নবদ্বীপে তৈরি হয়। নবদ্বীপ ছাড়াও এই ক্ষুদ্র কুটিরশিল্প গড়ে উঠেছে ইছাপুর, জামুরিয়া, কেষ্টপুর প্রভৃতি স্থানে। এর কাপড় আসে সুরাট থেকে। এছাড়াও লাগে অরগেন্ডি, জরি, সুতার সেলাইমেশিন-সহ অন্যান্য উপকরণ। পোশাক তৈরিতে মহিলাদের অংশগ্রহণ বেশি। তবে বাজারে বিপণনের বিষয়টি প্রধানত পুরুষেরাই করে থাকে। কাপড় কাটা থেকে শুরু করে সেলাই এবং তৈরি পোশাক বাজারে বিক্রি করা পর্যন্ত সর্বস্তরে শ্রমিক এবং ব্যবসাদার অর্থোপার্জন করে। সাধারণ এবং শৌখিন উভয় পোশাকের চাহিদা নবদ্বীপে অত্যন্ত বেশি। একজন কারিগর ১২০ টাকা পর্যন্ত আয় করতে পারে একদিনে পোশাক সেলাই বাবদ। সবচেয়ে আশ্চর্যজনক, বাড়ির মহিলারা অন্যান্য কাজ করেও এই পোশাক তৈরির কাজটিকে স্বচ্ছন্দে বেছে নেয়। নবদ্বীপে ধীরে ধীরে কারখানার সংখ্যাও বাড়ছে। এখান থেকে বৃন্দাবন ও উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে পোশাক রপ্তানিও হচ্ছে।
জপমালার থলি
“দেবতামন্দিরমাঝে ভকত প্রবীণ/ জপিতেছে জপমালা বসি নিশিদিন।”২ জপমালার ঐতিহ্য বৈষ্ণবীয় সংস্কৃতিতে বহু প্রাচীন। একদিকে ভগবানের নাম, অন্যদিকে বৈধী ভক্তির শর্তপূরণ—উভয়কে একসঙ্গে যুক্ত করে এই জপমালা। তবে আধুনিক মনস্তত্ত্ব অবশ্য মনে করে—মনঃসংযোগের এক মোক্ষম হাতিয়ার হলো এই জপমালা। তবে আমরা জপের মালা নিয়ে নয়, মালার থলি নিয়ে এখানে আলোচনা করব। আগেকার দিনে সাদামাটা থলিতে মালা রাখা হতো। কিন্তু এখন থলির ওপরে বিভিন্ন দেবদেবীর চিত্র অঙ্কিত হচ্ছে। থলির গঠন-প্রকৃতি একইরকম থাকলেও বাইরে নকশা দেওয়া তৈরি থলির চাহিদা ক্রমবর্ধমান। এই কাজ সম্পন্ন করতে এমব্রয়ডারি যন্ত্রের সাহায্য লাগে। শিল্পীর দক্ষতা এবং মালিকের বিনিয়োগ ও বিপণন একে অন্য মাত্রা দিয়েছে। থলি তৈরির শিল্প সাম্প্রতিককালের। নবদ্বীপে এই শিল্পের সঙ্গে জড়িত শিল্পীর সংখ্যা প্রায় ৫০ জন। বিভিন্ন নকশার থলি পাওয়া যায়—১১ টাকা থেকে ৩০ টাকায় বিক্রি হয়। এই থলিতে রঙিন সুতা দিয়ে এমব্রয়ডারির মাধ্যমে কখনো গোপাল, কখনো জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা, আবার কখনো রাধাকৃষ্ণের মূর্তি অঙ্কিত হয়। শিল্পী বা শ্রমিক নিজে বাজারে বিক্রি করতে পারলে বা বাজার ধরতে পারলে লাভ অনেক বেশি। কিন্তু এখানে মালিকের ওপরে নির্ভরতা আজও বর্তমান। আর্থিক সাহায্য নেই বলেই শিল্পীর পক্ষে বিনিয়োগ সম্ভব নয়, তাই মালিকের ওপর নির্ভর করতে হয়। মায়াপুরে এই মালার থলির ব্যাপক প্রচলন চোখে পড়ার মতো। ভারতের বাইরে যেখানেই বৈষ্ণবদের অবস্থান, জপমালার থলি প্রায় সেখানে আবশ্যিক সঙ্গী। বিশ্বায়নের হাত ধরে পণ্যটি আজ আন্তর্জাতিক মাত্রা পেয়েছে। চাহিদাও ক্রমবর্ধমান। এই শিল্পের প্রধান সমস্যা হলো কম্পিউটার নকশার প্রচলন এবং দক্ষ শ্রমিক ও সরকারি সাহায্যের অভাব। নবদ্বীপে জন্ম, কিন্তু পৃথিবী-বিখ্যাত এই শিল্পের পরিসর তৎসংলগ্ন বহু স্থানে সম্প্রসারিত হচ্ছে। নিত্যনতুন নকশা এই শিল্পকে আরো অভিনবত্ব দান করবে, শিল্পীকে এনে দেবে অর্থ উপার্জনের সুযোগ।
তিলকমাটি
তুলসীর মালার মতো ভক্ত-অঙ্গে তিলকমাটি চিত্তশুদ্ধির পাশাপাশি বৈধী ভক্তির চিহ্ন বহন করে। আচারনিষ্ঠার অঙ্গীভূত হলেও এই তিলকমাটি বৈষ্ণব সমাজে এক স্বতন্ত্র অলংকরণের পরিচায়ক। তিলকমাটি দিয়ে অঙ্কিত বিভিন্ন চিহ্ন তাদের অঙ্গের শোভাবৃদ্ধি ও দেহশুদ্ধিতে সাহায্য করে। বৃন্দাবনে প্রচলিত প্রথা নবদ্বীপেও ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়েছে। অতিরিক্ত রোজগারের ক্ষেত্র হিসাবে দেখা গেলেও কেবল তিলকমাটি তৈরি করে সংসার প্রতিপালন করা সম্ভব নয়। চলতি বাজারে প্রতি কেজি তৈরির মজুরি ৫ টাকা। ঢেলা তিলকমাটি বিক্রি হয় কেজি প্রতি ৮০ টাকায়। দ্বারকাতে অবস্থিত গোপীতালাওয়ের একটি দিঘি থেকে প্রয়োজনীয় মাটি সংগৃহীত হয়। একটি বড় পাত্রে তিলকের তাল ভিজিয়ে রেখে প্রথমে তাকে পরিশুদ্ধ করা হয় অর্থাৎ এর মধ্যে থাকা পাথরের টুকরোগুলিকে পৃথক করা হয়। এরপর ময়দার লেচির মতো গোলাকৃতি করে কাঠের ছাঁচে ঢালা হয়—যার আকৃতি শঙ্কুর মতো। এই ছাঁচে ঢালার পূর্বে পলিথিন পেপার রাখা হয়। তাই শুকনো ২৫ গ্রাম করে প্রায় ৪০ পিস তৈরি করা হয় ১ কেজি থেকে। বাড়ির মহিলারা এই কাজে যুক্ত। কিছু উদ্বৃত্ত আয় এই ক্ষুদ্রশিল্প থেকে অনায়াসে আসে। নবদ্বীপের বিভিন্ন উৎসবে যেমন দোলপূর্ণিমায় এর চাহিদা সীমাহীন। গৌরবর্ণ ইউরোপীয় ভক্তবৃন্দের কাছে তিলকমাটির আকর্ষণ বেশি। পাশ্চাত্যকে অনুসরণ করে আমাদের সমাজে যে ‘ট্যাটু’ অঙ্কনের প্রচলন আছে—যা চামড়ার পক্ষে ক্ষতিকারক, সেখানে তিলকমাটি অঙ্গসজ্জায় পরিবেশ-বান্ধব শুধু নয়, একইসঙ্গে আধ্যাত্মিকতার পরিবেশে মনকে নিবিষ্ট করতে সাহায্য করে। ইদানিং বাংলাদেশে এই তিলকমাটি রপ্তানি বৃদ্ধি পেয়ছে।
শেষের কথা
বৃহৎ পুঁজির যখন দেখা নেই, তখন লোকশিল্পের সঙ্গে জড়িত এই অসংগঠিত শ্রমিকদের সমান্তরাল বিকল্প অর্থনৈতিক পরিকাঠামো নির্মাণের প্রচেষ্টা বর্তমান আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এরা সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে একাধিক শিল্পের প্রসার ঘটিয়েছে, অন্যদিকে বৈষ্ণবীয় সংস্কৃতিকে আগলে রাখছে। শুধু ধর্ম নয়, অর্থনীতির সঙ্গেও এর সরাসরি সম্পর্ক আছে। নির্দিষ্ট শ্রেণিচরিত্র না থাকলেও শিল্পীদের ক্ষুদ্র দৃষ্টিতে দেখা সমীচীন নয়; কারণ, একদিকে যেমন জীবিকার প্রয়োজন, অন্যদিকে তেমনি ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে বংশপরম্পরায় এই প্রয়াস আক্ষরিক অর্থেই অভিনব। পরদার আড়ালে থাকা কিছু মূলস্রোত-বিচ্ছিন্ন শিল্পীর নিষ্ঠা এমন এক ক্ষুদ্র কুটিরশিল্পের জন্ম দিয়েছে, যা আজও অনেকের অজানা।
বাংলায় এই শিল্পের দ্বারা নির্মিত পণ্যের চাহিদা থাকলেও এখন ধীরে ধীরে বৃন্দাবন, মথুরা প্রভৃতি স্থানেও চাহিদা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন নতুন অনুষঙ্গ সেখানে যুক্ত হচ্ছে। বিদেশের বাজারে উপকরণগুলির রপ্তানি রীতিমতো আকর্ষণীয়। পর্যটনকে কেন্দ্র করে আগত তীর্থযাত্রীদের (দেশি ও বিদেশি) সৌজন্যে এই শিল্পের বিকাশ ঘটছে। বাজার দখলের প্রতিযোগিতা নেই, কিছু নির্দিষ্ট শিল্পীর একাধিপত্য আছে বললে অত্যুক্তি হবে না। ঐতিহ্যমণ্ডিত এবং সম্পূর্ণ ভারতীয় সংস্কৃতি-নির্ভর এই দেশীয় শিল্পের প্রসার নিঃসন্দেহে এক নিশ্চিত জীবিকার সন্ধান দেয়।
তথ্যসূত্র
১ দাস (ছোট), দীন নরোত্তম (সংগৃহীত ও সম্পাদিত), শ্রীশ্রী-ভজন-দীপিকা, শ্রীশ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু মন্দির, চাকলেশ্বর, গোবর্ধন (মথুরা), ১৪২৮, পৃঃ ৬০
২ রবীন্দ্র-রচনাবলী, বিশ্বভারতী, কলিকাতা, ১৩৯২, ৫ম খণ্ড, পৃঃ ৯
সহায়ক গ্রন্থ
১ Chakraborty, Janardan; Bengal Vaisnavism and Sri Chaitanya, The Asiatic Society, Kolkata, 1975
২ চক্রবর্তী, রমাকান্ত, বঙ্গে বৈষ্ণব ধর্ম, আনন্দ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ১৯৯৬
৩ সান্যাল, হিতেশরঞ্জন, বাংলার কীর্তনের ইতিহাস, কে. পি. বাগচী অ্যান্ড কোঃ, কলকাতা, ১৯৮৯
৪ দাস, হরিদাস, গৌড়ীয় বৈষ্ণব অভিধান, শ্রী হরি বল কুটির, পোড়াঘাট, নবদ্বীপ, ১৯৮৭, ২য় খণ্ড
৫ দশদিশি, শ্রীচৈতন্য সংখ্যা, কলকাতা, ২০০৯
৬ সান্যাল, অবন্তী ও ভট্টাচার্য, অশোক (সম্পাদিত), চৈতন্যদেব: ইতিহাস ও অবদান, সরস্বতী লাইব্রেরি, কলকাতা, ১৯৯৯
৭ চক্রবর্তী, চিন্তাহরণ, হিন্দুর আচার-অনুষ্ঠান, প্যাপিরাস, কলকাতা, ১৯৭০