উপক্রমণিকা

কোনো কোনো বিশেষজ্ঞ কৈবল্যোপনিষৎকে কৃষ্ণযজুর্বেদীয় শাখার অন্তর্গত বলে মনে করলেও সাধারণত এটিকে অথর্ববেদীয় উপনিষদ বলেই মনে করা হয়। বহু অণু-উপনিষদের মধ্যে কৈবল্যোপনিষৎ তার কাব্যিক ধ্বনিমাধুর্য, তাত্ত্বিক কাঠামোর শৃঙ্খলাবদ্ধ সুনিপুণ নির্মাণ, দার্শনিক গভীরতা তথা আভিজাত্য এবং নির্দেশের স্পষ্টতা ও অবক্রতার জন্য বিশিষ্টতার দাবি রাখে। এই উপনিষদে পুনরুক্তি দোষ প্রায় নেই বললেই চলে এবং এটি জটিল দার্শনিক তত্ত্বে কণ্টকিতও নয়। এই উপনিষদে কোনোরকম ভণিতা ছাড়াই কাজের কথাটি সরাসরি বলা হয়েছে। বেশ কয়েকটি উপনিষদে পৃথক প্রকরণে ভাগ করে যে যে তত্ত্ব পৃথক পৃথক ভাগে পরিবেশিত হয়েছে, এই অণু-উপনিষদে সেসব তত্ত্বের সারসংক্ষেপ একত্রে বিধৃত। সাধ্যবস্তুর সঙ্গে সঙ্গে তা প্রাপ্তির সাধন ও প্রাপ্তির ফলের কথাও সংক্ষেপে উল্লেখ করতে শ্রুতি এখানে কোনো কার্পণ্য করেননি। অন্যান্য উপনিষদের মতো এখানেও দেখা যায় যে, শিষ্য (বা ছাত্র) চরম এবং পরম জ্ঞানপ্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা নিয়ে গুরু বা আচার্যের কাছে যাচ্ছেন। এখানে শিষ্য হলেন ঋগ্বেদাচার্য, সাধনচতুষ্টয়সম্পন্ন মহর্ষি আশ্বলায়ন এবং আচার্য হলেন সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা স্বয়ং। এই উপনিষদে আচার্য স্পষ্ট করে বলেছেন যে, গৃহস্থাশ্রমে ভোগের মধ্য থেকে কর্ম করে মুক্তিলাভ করা যায় না। এষণাসমূহের ত্যাগ অর্থাৎ সন্ন্যাসই হলো মোক্ষের সাধন। সাধককে নিভৃতে ধ্যানাভ্যাসের মধ্য দিয়ে আত্মসাক্ষাৎকারের জন্য প্রযত্ন করতে হবে। জীবাত্মা ও পরমাত্মার অভিন্নতা দর্শনের সাধনার সিদ্ধিতেই এই উপনিষদের প্রকৃত তাৎপর্য।

শান্তিপাঠ

ওঁ ভদ্রং কর্ণেভিঃ শৃণুয়াম দেবা
ভদ্রং পশ্যেমাক্ষভির্যজত্রাঃ।।
স্থিরৈরঙ্গৈস্তুষ্টুবাংসস্তনূভি-
র্ব্যশেম দেবহিতং যদায়ুঃ।।

অন্বয়—[হে] দেবাঃ (দেবগণ অথবা আমার দেহেন্দ্রিয়-মনের অধিপতি দৈবী শক্তিসমূহ, [তোমাদের অনুগ্রহে আমরা যেন]) কর্ণেভিঃ* ([আমাদের] শ্রবণেন্দ্রিয়ের দ্বারা) ভদ্রম্ (কল্যাণ বচন [ব্রহ্ম-প্রতিপাদক বেদান্তবাক্যসমূহ, কল্যাণময়ী ভাগবতী কথাসকল]) শৃণুয়াম (শুনতে যেন সমর্থ হই, আমরা যেন কখনো বধির হয়ে না যাই); [হে] যজত্রাঃ (যজনীয় দেবগণ) [ভাগবতী কথা শ্রবণ করে, ভগবানের ধ্যানে নিরত হয়ে আমরা যেন] অ‌ক্ষভিঃ (চ‌ক্ষুসমূহের দ্বারা) ভদ্রম্ (শোভন বিষয় [পরমেশ্বরকে]) পশ্যেম (দর্শন করতে সমর্থ হই [অন্ধ না হয়ে গিয়ে পরমেশ্বরকে অন্তরে-বাহিরে দর্শন করতে সমর্থ হই]); স্থিরৈঃ (দৃঢ়-অচঞ্চল, সুস্থ-সবল) অঙ্গৈঃ (হস্ত-পদাদি অবয়ববিশিষ্ট) [এবং] তনূভিঃ (শরীরের সঙ্গে [যুক্ত হয়ে আমরা যেন]) তুষ্টুবাংসঃ (ব্রহ্মানুসন্ধানমূলক স্তুতি ও ধ্যান করতে করতে [এবং]) দেবহিতম্ (দেবগণের হিতকর বা ভগবৎ-নির্দিষ্ট) যৎ (যে) আয়ুঃ (জীবনকাল) [তা] ব্যশেম (প্রাপ্ত হই, যাপন করি)।

অনুবাদ ও বিবৃতি—হে দেবগণ, [তোমাদের অনুগ্রহে] আমরা যেন [আমাদের] শ্রবণেন্দ্রিয় দিয়ে কল্যাণজনক অর্থাৎ ব্রহ্ম-প্রতিপাদক বেদান্তবাক্যসমূহ শ্রবণ করি [এবং] চক্ষু দিয়ে শোভন বিষয় অর্থাৎ [অন্তরে-বাহিরে] পরমেশ্বরকে দর্শন করি; সুস্থ-সবল অঙ্গবিশিষ্ট শরীরে [আমরা যেন] ব্রহ্মানুসন্ধানমূলক স্তুতি ও ধ্যান করতে করতে ভগবৎ-নির্দিষ্ট আয়ু যাপন করতে সমর্থ হই।

স্বস্তি ন ইন্দ্রো বৃদ্ধশ্রবাঃ স্বস্তি নঃ পূষা বিশ্ববেদাঃ।
স্বস্তি নস্তার্ক্ষ্যো অরিষ্টনেমিঃ স্বস্তি নো বৃহস্পতির্দধাতু।।

অন্বয়—বৃদ্ধশ্রবাঃ (বৃদ্ধ অর্থাৎ মহৎ ও বৃহৎ এবং শ্রবঃ মানে যশ, মহৎ কীর্তি, সর্বোৎকৃষ্ট ও মহিমময়), ইন্দ্রঃ (ইন্দ্রদেবতা বা চৈতন্যস্বরূপ পরমেশ্বর) নঃ স্বস্তি (আমাদের কল্যাণ বিধান করুন বা আমাদের পরিপূর্ণ ব্রহ্মানন্দ প্রদান করুন); পূষা (নিখিল জগতের পরিপোষক) বিশ্ববেদাঃ (সর্বজ্ঞানাধার সূর্য) নঃ স্বস্তি (আমাদের কল্যাণ বিধান করুন), অরিষ্টনেমিঃ (অপ্রতিহত গতি বা অমোঘসংকল্প বা সংসারের ত্রিতাপহরণকারী অহিংসার পরিপালক) তার্ক্ষ্যঃ (অমৃতপ্রদাতা গরুড়) নঃ স্বস্তি (আমাদের মঙ্গল বিধান করুন) বৃহস্পতিঃ (দেবপুরোহিত বৃহস্পতি) নঃ স্বস্তি দধাতু (আমাদের কল্যাণ বিধান করুন)।

অনুবাদ ও বিবৃতি—মহৎ কীর্তি, সর্বোৎকৃষ্ট মহিমময় ইন্দ্র বা চৈতন্যস্বরূপ পরমেশ্বর আমাদের কল্যাণ বিধান করুন বা আমাদের পরিপূর্ণ ব্রহ্মানন্দ প্রদান করুন, সর্বজ্ঞানাধার সূর্য আমাদের মঙ্গল করুন, হিংসানিবারক গরুড় আমাদের কল্যাণ বিধান করুন।

ওঁ শান্তিঃ শান্তিঃ শান্তিঃ।।

আধিভৌতিক, আধিদৈবিক ও আধ্যাত্মিক—এই ত্রিবিধ দুঃখের শান্তি হোক।
।।প্রথমঃ খণ্ডঃ।।
মন্ত্র, অন্বয় ও অনুবাদ
অথাশ্বলায়নো ভগবন্তং পরমেষ্ঠিনমুপসমেত্যোবাচ।
অধীহি ভগবন্‌ ব্রহ্মবিদ্যাং বরিষ্ঠাং
সদা সদ্ভিঃ সেব্যমানাং নিগূঢ়াম্‌।
যয়াঽচিরাৎ সর্বপাপং ব্যপোহ্য
পরাৎপরং পুরুষং যাতি বিদ্বান্‌।।

অন্বয়—অথ ([নিত্য-অনিত্য বস্তু বিবেক, ইহলোক ও পরলোকে বিরাগ, শম-দম প্রভৃতি ছয়টি সম্পত্তি ও মুক্তিলাভের ইচ্ছা—এই চারটি হলো সাধনচতুষ্টয়। এই] সাধনচতুষ্টয়-সম্পন্ন হয়ে ওঠার পর) আশ্বলায়নঃ (অশ্বল মুনির পুত্র ঋগ্বেদাচার্য আশ্বলায়ন) ভগবন্তম্ (পূজনীয় [ধর্ম, জ্ঞান, বৈরাগ্য, ঐশ্বর্য, যশ এবং শ্রী—এই ছয়টি ভগ যাঁতে সমগ্ররূপে বর্তমান তিনিই ভগবান; ভগবান পূজনীয়; এখানে ভগবান শব্দটি প্রজাপতি ব্রহ্মার বিশেষণ]) পরমেষ্ঠিনম্ (যিনি সমস্ত লোকের থেকে উৎকৃষ্ট অর্থাৎ পরমলোক বা ব্রহ্মলোক-নিবাসী—তিনি হলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা অর্থাৎ তাঁর বা ভগবান ব্রহ্মার) উপসমেত্য (সমীপে বা কাছে যথাবিধি উপনীত হয়ে বা এসে) উবাচ (বললেন)।

[হে] ভগবন্‌ (ভগবান)! [যে] ব্রহ্মবিদ্যাম্ (ব্রহ্মবিদ্যা) সদা (নিত্য) সদ্ভিঃ (দেহাদিতে আত্মবুদ্ধিশূন্য সাধুগণের দ্বারা) সেব্যমানাম্ (পরিষেবিত অর্থাৎ হৃদয়ে নিত্য অনুধ্যাত) [এবং] বরিষ্ঠাম্ ([যে-বিদ্যা] সর্বশ্রেষ্ঠ) [অথচ] নিগূঢ়াম্ ([সর্বভূতে বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও অবিদ্যাপ্রভাবে] প্রচ্ছন্নভাবে অবস্থিত [অজ্ঞানীর কাছে প্রকাশিত নয়]), যয়া (যার দ্বারা [যে-ব্রহ্মবিদ্যার দ্বারা]) বিদ্বান (জ্ঞানবান বা তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তি) সর্বপাপম্ (সকল পাপ অর্থাৎ দুঃখের কারণীভূত মূলসহ অজ্ঞান) ব্যপোহ্য (পরিত্যাগ করে, নষ্ট করে, ধ্বংস করে) অচিরাৎ (অবিলম্বে, শীঘ্রই) পরাৎ ([মহৎ বা হিরণ্যগর্ভ থেকে শুরু করে] সমস্ত জগতের কারণীভূত অব্যাকৃত বা মায়া বা প্রকৃতির থেকেও) পরম্ (সর্বোৎকৃষ্ট) পুরুষম্ (পরমপুরুষকে, পরমেশ্বরকে) যাতি (প্রাপ্ত হন [পরিপূর্ণস্বভাব পরমাত্মার সঙ্গে স্বস্বরূপের অভিন্নতার অপরোক্ষানুভূতি হয়]) [সেই ব্রহ্মবিদ্যা আপনি আমাকে কৃপা করে] অধীহি (উপদেশ করুন [আমার প্রতি অনুগ্রহ করার জন্য আপনি স্মরণ করুন])।

অনুবাদ ও বিবৃতি—অশ্বল মুনির পুত্র আশ্বলায়ন বিবেক-বৈরাগ্যাদি সাধনচতুষ্টয়-সম্পন্ন হয়ে সর্বলোকশ্রেষ্ঠ অর্থাৎ ব্রহ্মলোক-নিবাসী বা ব্রহ্মলোকের অধিপতি পূজনীয় ব্রহ্মার কাছে শাস্ত্রীয় বিধি অনুসরণ করে (সমিৎপাণি হয়ে) উপনীত হয়ে বললেন—হে ভগবান! দেহাত্মবুদ্ধি-রহিত মহাত্মারা [নিজ নিজ হৃদয়ে] যে-ব্রহ্মবিদ্যার ধ্যানে নিত্য নিরত, যে-ব্রহ্মতত্ত্ব সর্বশ্রেষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও [অজ্ঞানান্ধকারে নিমজ্জিত মানুষের কাছে] প্রকাশিত নয় অর্থাৎ প্রচ্ছন্ন, তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিরা যে-ব্রহ্মবিদ্যা সহায়ে সকল দুঃখের কারণীভূত অজ্ঞানকে ধ্বংস করে অচিরেই প্রকৃতির থেকেও সর্বোৎকৃষ্ট পরমাত্মার সঙ্গে স্বস্বরূপের অভিন্নতার অপরোক্ষানুভূতি লাভ করেন, আপনি কৃপা করে আমাকে সেই ব্রহ্মবিদ্যা উপদেশ করুন (ব্রহ্মার কথা উল্লেখ করে এখানে গুরুর প্রয়োজনীয়তার কথা মনে করিয়ে দেওয়া হলো)। [প্রসঙ্গত স্মর্তব্য স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর উক্তি—“চুরি করতে পর্যন্ত একজন গুরুর দরকার হয়, আর এত বড় ব্রহ্মবিদ্যা লাভ করতে গুরুর দরকার নেই?”]

তস্মৈ স হোবাচ—পিতামহশ্চ
শ্রদ্ধাভক্তিধ্যানযোগাদবৈহি।
ন কর্মণা ন প্রজয়া ধনেন
ত্যাগেনৈকে অমৃতত্বমানশুঃ।।

অন্বয়—সঃ (সেই [অর্থাৎ সেই সর্বজ্ঞ ব্রহ্মা]) পিতামহশ্চ (পিতামহ ব্রহ্মা) তস্মৈ ([প্রশ্নকর্তা] সেই আশ্বলায়নকে) হ উবাচ (বলেছিলেন)—শ্রদ্ধা (গুরুবাক্য এবং শাস্ত্রবাক্যে একমুখী আস্তিক্যবুদ্ধি)-ভক্তি (পূর্বোক্ত আস্তিক্যবুদ্ধি-পরায়ণ তাৎপর্যবুদ্ধি বা একমুখী তত্ত্বচিন্তা) -ধ্যানযোগাৎ ([শ্রদ্ধা ভক্তি ও] ধ্যানের দ্বারা পরিশীলিত হয়ে;) [বিজাতীয় ভাব বা প্রত্যয়শূন্যতা এবং সমজাতীয় ভাব বা প্রত্যয়ের নিরন্তর প্রবাহরূপ ধ্যানের দ্বারা উৎপন্ন যোগের মাধ্যমে] অবৈহি (অবগত হও বা জান।) [এভাবে শ্রদ্ধা, ভক্তি, ধ্যান প্রভৃতি ব্রহ্মবিদ্যালাভের সাধন বলার পর সন্ন্যাসের সাধন সম্পর্কে ব্রহ্মা বলছেন] একে (অনেকে, ব্রহ্মবিদ্যা-সম্প্রদায়ভুক্ত মহাত্মাগণ) ত্যাগেন ([একমাত্র] ত্যাগের দ্বারা [শ্রৌত এবং স্মার্ত কর্ম পরিত্যাগের মধ্য দিয়েই অর্থাৎ যাবতীয় লোকপ্রাপ্তির অর্থাৎ বিবিধ লোকে ভোগসুখ প্রাপ্তির এষণা পরিপূর্ণরূপে পরিত্যাগের মধ্য দিয়ে]) অমৃতত্বম্‌ (মোক্ষরূপ পরম—অমৃতত্ব) আনশুঃ (লাভ করে থাকেন [অর্থাৎ ব্রহ্মস্বরূপতা প্রাপ্ত হন, অমৃতস্বরূপ হয়ে যান]) [কিন্তু এই অমৃতত্ব] ন কর্মণা ([অগ্নিহোত্রাদি] শ্রৌতকর্ম [বা পঞ্চমহাযজ্ঞাদি] স্মার্তকর্মের দ্বারা প্রাপ্ত হওয়া যায় না), ন প্রজয়া (সন্তানসন্ততির মাধ্যমে বংশধারা অক্ষুণ্ণ রাখার মধ্য দিয়েও প্রাপ্ত হওয়া যায় না), ন ধনেন (বিত্তের দ্বারাও [মানুষী বিত্ত বা দৈব বিত্তের দ্বারাও] প্রাপ্ত হওয়া যায় না) [শারীর কর্মের দ্বারা প্রাপ্তব্য বিষয় হলো মানুষী বিত্ত ও উপাসনা বা মানসকর্মের দ্বারা প্রাপ্তব্য বিষয় হলো দৈব বিত্ত]।

অনুবাদ ও বিবৃতি—আশ্বলায়ন কর্তৃক এভাবে জিজ্ঞাসিত হয়ে পিতামহ ব্রহ্মা [উত্তরে] বললেন : [হে আশ্বলায়ন!] শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ধ্যানের দ্বারা যথাযথভাবে পরিশীলিত হয়ে এই ব্রহ্মবস্তুকে অবগত হও। শাস্ত্রনির্দিষ্ট শ্রৌত বা স্মার্ত কর্ম, সন্তানসন্ততির মাধ্যমে বংশধারা সচল রাখার মধ্য দিয়ে বা দৈব বিত্ত বা মানুষী বিত্তে বলীয়ান হয়ে এই অমৃতত্ব বা ব্রহ্মস্বরূপতা লাভ করা যায় না; কিন্তু বিদ্বান মহাত্মাগণ একমাত্র সকল লোকপ্রাপ্তির এষণা পরিত্যাগের দ্বারাই অর্থাৎ একমাত্র সন্ন্যাসের দ্বারাই এই পরম অমৃতত্ব লাভ করে থাকেন। [প্রসঙ্গত স্মর্তব্য, কী করে ভগবানলাভ করতে হয়—এই প্রশ্নের উত্তরে শ্রীশ্রীমায়ের উক্তি : “শুধু তাঁর কৃপাতে হয়। তবে ধ্যানজপ করতে হয়। তাতে মনের ময়লা কাটে। পূজা, জপ, ধ্যান—এসব করতে হয়। যেমন ফুল নাড়তে চাড়তে ঘ্রাণ বের হয়, চন্দন ঘষতে ঘষতে গন্ধ বের হয়, তেমনি ভগবৎতত্ত্ব আলোচনা করতে করতে তত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয়। নির্বাসনা যদি হতে পার, এক্ষুণি হয়।”]

পরেণ নাকং নিহিতং গুহায়াং
বিভ্রাজতে যদ্‌যতয়ো বিশন্তি।
বেদান্ত-বিজ্ঞান-সুনিশ্চিতার্থাঃ
সন্ন্যাসযোগাদ্‌যতয়ঃ শুদ্ধসত্ত্বাঃ।।
তে ব্রহ্মলোকেষু পরান্তকালে
পরামৃতাৎ পরিমুচ্যন্তি সর্বে।।

অন্বয়—[যাঁরা] বেদান্ত-বিজ্ঞান-সুনিশ্চিতার্থাঃ (বেদান্ত-বাক্যের শ্রবণ, মনন ও নিদিধ্যাসনের ফলে বেদান্ত-উপদিষ্ট নিত্যবস্তুর স্বরূপ সম্পর্কে সংশয়রহিত হতে এবং সুনিশ্চিত হতে পেরেছেন) [পরন্তু] সন্ন্যাসযোগাৎ (পুত্রৈষণা, দারৈষণা এবং বিত্তৈষণা তথা বিবিধ লোকের ভোগাকাঙ্ক্ষা কাকবিষ্ঠাবৎ পরিত্যাগ করেছেন বা পরিত্যাগের মধ্য দিয়ে) শুদ্ধসত্ত্বাঃ (রাগাদি-রহিত এবং বিশুদ্ধ সত্ত্বগুণান্বিত হয়েছেন) যতয়ঃ ([দেহ-মন-বুদ্ধিতে আত্মাভিমানশূন্য সমাহিতচিত্ত অকাম, নিষ্কাম, আত্মকাম, আপ্তকাম—এরকম] সন্ন্যাসিগণ) পরেণ ([সেই] সর্বোত্তম) নাকম্ (ক=আনন্দ, অ=অভাব, অক=আনন্দের অভাব অর্থাৎ দুঃখ, নাক=সেই দুঃখের অভাব অর্থাৎ পরম আনন্দময় [সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম]) [যিনি] নিহিতং গুহায়াম্ (হৃদয়রূপ গুহায় স্বয়ং নিশ্চিতভাবে স্থিত [বা উপলব্ধব্য এবং]) বিভ্রাজতে (স্বয়ম্প্রকাশ, চৈতন্যরূপে দীপ্যমান [সেই এক অখণ্ড সত্তা বিবিধ নাম-রূপের মধ্য দিয়ে সৎ, চিৎ এবং আনন্দ-রূপে দীপ্যমান]) যৎ (একমাত্র অখণ্ড সেই সত্তায়) বিশন্তি (প্রবেশ করেন, একাত্ম হয়ে যান [তিনি তখন দেখেন যে অবিভাজ্য, অখণ্ড, জ্যোতির্ময় সত্তাই একমাত্র অস্তিত্ববান—‘দ্রষ্টা’; দৃষ্টবস্তু, দ্রষ্টা এবং দৃষ্টিপাতরূপ প্রক্রিয়া তখন আর ভিন্ন ভিন্ন রূপে পরিদৃষ্ট হয় না])। তে সর্বে (সেই যতিগণ [কিন্তু যাঁরা কোনোরকম প্রতিকূল প্রারব্ধবশত এই জন্মেই আত্মসাক্ষাৎকার অর্থাৎ ব্রহ্মসাক্ষাৎকারে সমর্থ হলেন না]) ব্রহ্মলোকেষু ([শরীরত্যাগের পর তাঁরা] জন, তপ, সত্য নামক লোক বা ব্রহ্মলোকসমূহে বা হিরণ্যগর্ভলোকে অবস্থান করে) পরান্তকালে (পর অর্থাৎ কার্যব্রহ্মের অন্তকালে বা হিরণ্যগর্ভের প্রলয়ের কালে বা কল্পান্তে) পরামৃতাৎ (আপেক্ষিক অমৃতত্ব স্বরূপলক্ষণযুক্ত অনাদি অবিদ্যা বা অব্যাকৃত থেকে) পরিমুচ্যন্তি (সর্বতোভাবে বিমুক্ত হয়ে যান [হিরণ্যগর্ভের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে মুক্ত হয়ে কারণব্রহ্মে বা পরব্রহ্মে বিলীন হয়ে যান বা ক্রমমুক্তি লাভ করেন])।

অনুবাদ ও বিবৃতি—দেহাদিতে আত্মাভিমান-রহিত বিশুদ্ধচিত্ত যতিগণ ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সর্ববিধ কামনা থেকে মুক্ত হয়ে অর্থাৎ সন্ন্যাসগ্রহণাদির মধ্য দিয়ে বেদান্তবাক্যের শ্রবণ, মনন, নিদিধ্যাসনাদির ফলে বেদান্ত-উপদিষ্ট নিত্যবস্তুর স্বরূপ সম্পর্কে সংশয়রহিতভাবে সুনিশ্চিত হন অর্থাৎ জীবাত্মা-পরমাত্মার অভিন্নতা সম্পর্কে অপরোক্ষানুভূতি লাভ করেন এবং শুদ্ধ বুদ্ধিরূপ গুহাস্থিত সর্বোত্তম, আনন্দময়, স্বয়ংজ্যোতি, স্বপ্রকাশ অখণ্ড সত্তায় প্রবেশ করেন বা সেই সত্তার সঙ্গে অভিন্ন হয়ে যান। আর যে-যতিগণের এই শরীরেই কোনো বিঘ্নবশত পরব্রহ্মের সাক্ষাৎকার হয় না—তাঁরা শরীরত্যাগের পর হিরণ্যগর্ভলোক বা ব্রহ্মলোক বা আপেক্ষিক অমৃতত্ব লাভ করেন এবং কল্পান্তে অর্থাৎ হিরণ্যগর্ভের প্রলয়ের সময় হিরণ্যগর্ভের মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে ক্রমমুক্তি লাভ করেন।।৩।।

বিবিক্তদেশে চ সুখাসনস্থঃ শুচিঃ সমগ্রীবশিরঃশরীরঃ।
অত্যাশ্রমস্থঃ সকলেন্দ্রিয়াণি নিরুধ্য ভক্ত্যা স্বগুরুং প্রণম্য।।

অন্বয়—[এখন ব্রহ্মজ্ঞানের উপযোগী অবস্থা প্রাপ্তির জন্য উপাসনার স্থান-প্রকরণাদি সম্বন্ধে বলা হচ্ছে] বিবিক্ত দেশে (জনশূন্য দেশে অর্থাৎ কোলাহলমুক্ত নির্জন স্থানে [একান্তে]) সুখাসনস্থঃ (সুখাসনে [অনুদ্বেগজনক কুশাসন, কম্বলাসন প্রভৃতিতে স্বস্তিক, পদ্মাসন বা সুখাসনে উপবিষ্ট যিনি—তিনি সুখাসনস্থ]) শুচিঃ (শারীরিক এবং মানসিক অর্থাৎ অন্তরে-বাহিরে পবিত্রতাসম্পন্ন হয়ে) সমগ্রীবশিরঃশরীরঃ (গ্রীবা, মস্তক এবং শরীর ঋজু বা সরলরেখায় রেখে বা সমরেখায় স্থাপন করে) [যতি সমাহিতচিত্ত হবেন]। অত্যাশ্রমস্থঃ ([ব্রহ্মচর্য, গার্হস্থ্য, বাণপ্রস্থ অপেক্ষা সন্ন্যাস আশ্রম ‘অতি’ অর্থাৎ সর্বোৎকৃষ্ট; সেজন্য সন্ন্যাসাশ্রম অত্যাশ্রম অথবা ‘অতি’ শব্দের অতিক্রমণ অর্থে সমস্ত আশ্রমধর্ম অতিক্রম করে অত্যাশ্রমের অর্থ সন্ন্যাসাশ্রম—‘অতিক্রান্ত আশ্রমান্‌ তদ্বিহিতধর্মান্‌’*] সন্ন্যাসাশ্রম অবলম্বন করে) সকলেন্দ্রিয়াণি নিরুধ্য (মন-সহ সকল ইন্দ্রিয়কে ইন্দ্রিয়ের নিজ নিজ বিষয় থেকে অবরুদ্ধ করে) ভক্ত্যা (অনন্যচিন্তাপরায়ণ হয়ে বা একনিষ্ঠ ভক্তি সহযোগে) স্বগুরুম্ (নিজ গুরুকে [অর্থাৎ যিনি ‘তত্ত্বমসি’—তুমিই ব্রহ্ম—এই মহাবাক্যার্থের জ্ঞানপ্রদাতা]) প্রণম্য (প্রকৃষ্টরূপে নত হয়ে, নমস্কার করে [অসমাপিকা ক্রিয়া ব্যবহার করা হলো—বাকি বক্তব্য পরের মন্ত্রগুলিতে বলা হবে।])।

অনুবাদ ও বিবৃতি—[আত্মজ্ঞানেচ্ছু যতি] নির্জন স্থানে একান্তে বাহ্যাভ্যন্তরের শুচিতা সম্পাদন করে সুখাসনে উপবিষ্ট হয়ে গ্রীবা (ঘাড়), মস্তক ও শরীর সমরেখায় স্থাপন করে সমাহিত হবেন। [তিনি] সন্ন্যাসাশ্রম অবলম্বন করে পঞ্চজ্ঞানেন্দ্রিয় ও পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়কে স্ব-স্ব বিষয় থেকে প্রতিনিবৃত্ত করে ভক্তিসহকারে নিজগুরুকে প্রণাম করে (করবেন)। [নির্জন স্থানে ধ্যানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে শ্রীরামকৃষ্ণ বলছেন : “মাঝে মাঝে নির্জনে গিয়ে তাঁর চিন্তা করা বড় দরকার। প্রথম অবস্থায় মাঝে মাঝে নির্জন না হলে ঈশ্বরে মন রাখা কঠিন। যখন চারাগাছ থাকে, তখন তার চারিদিকে বেড়া দিতে হয়। বেড়া না দিলে ছাগল-গরুতে খেয়ে ফেলে।”] [ক্রমশ]

* বাচস্পত্যম্

ভ্রম সংশোধন

গত চৈত্র ১৪২৯ সংখ্যার ৩৩৮ পৃষ্ঠায় ‘পত্রিকা-প্রসঙ্গ’ বিভাগে ‘দশদিশি’ পত্রিকার পরিচিতি হবে এইরূপ: ‘দশদিশি: নেতাজী সুভাষ স্মরণ’, সম্পা: অতনুশাসন মুখোপাধ্যায়, ৪৮০.০০।