।।১৮।।
আত্মজ্ঞান লাভের উপায়
প্রতিবোধবিদিতং মতমমৃতত্বং হি বিন্দতে।
আত্মনা বিন্দতে বীর্যং বিদ্যয়া বিন্দতেঽমৃতম্‌।।২।৪।।

অন্বয়—[জ্ঞানীদেরও নিকট যদি ব্রহ্ম অবিজ্ঞাত থাকেন, তবে জ্ঞানী ও জ্ঞানহীনে প্রভেদ কী? বিশেষত ‘জ্ঞানীর নিকট অজ্ঞাত’—এ তো স্ববিরোধী কথা। এইরূপ আশঙ্কার নিবৃত্তির জন্য শ্রুতি বলছেন—] প্রতিবোধবিদিতম্‌ (প্রত্যেক বোধে বা বুদ্ধিপ্রত্যয়ে ব্রহ্ম সা‌ক্ষিরূপে অনুভূত বা বিদিত হন; সেই প্রত্যেক বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশক ব্রহ্মকে বুদ্ধিবৃত্তি থেকে পৃথগ্‌ভাবে জানাই) মতম্‌ (যথার্থ জ্ঞান, প্রকৃত জ্ঞান) হি (কেননা [ঐ জ্ঞানের ফলেই মুমুক্ষু]) অমৃতত্বম্‌ (মুক্তি, স্বরূপাবস্থান) বিন্দতে (লাভ করেন)। [উক্ত আত্মবিদ্যা দ্বারা কীরূপে অমৃতত্ব লাভ হয়?]—[যেহেতু মুমুক্ষু] আত্মনা (আত্মস্বরূপের দ্বারাই) বীর্যং (সামর্থ্য, অমৃতত্বলাভের যোগ্যতা) বিন্দতে (লাভ করেন), [সুতরাং] বিদ্যয়া (আত্মজ্ঞানের দ্বারা) [সে] অমৃতম্‌ (অমৃত অর্থাৎ মোক্ষ) বিন্দতে (লাভ করেন)।

মূলানুবাদ—যখন বুদ্ধি-বৃত্তিসমূহের আত্মারূপে ব্রহ্ম বিদিত হন, তখনি প্রকৃত জ্ঞান হলো, কেননা উক্ত জ্ঞানের ফলে মো‌ক্ষলাভ হয়। কেবল আত্মার শরণ নিলেই অমৃতত্বলাভের যোগ্যতা হয় (অন্যরূপে হয় না), এজন্যই আত্মবিদ্যার ফলে মুক্তিলাভ ঘটে।

ব্যাখ্যা—‘প্রতিবোধবিদিতম্‌’—প্রত্যেক বোধের সঙ্গে, ইন্দ্রিয়বৃত্তির সঙ্গে জ্ঞাত হয় আত্মতত্ত্ব (প্রত্যেক বুদ্ধিপ্রত্যয়ের সা‌ক্ষিরূপে)—এই হলো ‘মতম্‌’, এই হলো আমাদের অভিপ্রেত সিদ্ধান্ত। এই ‘প্রতিবোধবিদিতম্‌’-রূপে যখন [ব্রহ্ম] জ্ঞাত হন (প্রত্যেক বুদ্ধিবৃত্তি থেকে ভিন্ন অথচ প্রত্যেক বুদ্ধিবৃত্তির সা‌ক্ষিরূপে ব্রহ্ম যখন জ্ঞাত) তখন [মুমুক্ষু] ‘অমৃতত্বং হি বিন্দতে’—অমৃতত্ব লাভ করেন। মুমুক্ষু ‘আত্মনা বিন্দতে বীর্যম্‌’—আত্মার দ্বারাই বীর্য, বল অর্থাৎ অমৃতত্বলাভের যোগ্যতা লাভ করে (অন্য কোনো উপায়ে নয়)। সুতরাং ‘বিদ্যয়া বিন্দতেঽমৃতম্‌’—[আত্মবিষয়ক] বিদ্যার দ্বারাই সে অমৃত লাভ করে, অমরত্ব লাভ করে।

‘প্রতিবোধবিদিতম্‌’-এর অর্থ

শাঙ্করভাষ্য—অবিজ্ঞাতং বিজানতামিত্যবধৃতম্‌। যদি ব্রহ্মাত্যন্তমেবাবিজ্ঞাতং, লৌকিকানাং ব্রহ্মবিদাং চাবিশেষঃ প্রাপ্তঃ। ‘অবিজ্ঞাতং বিজানতামি’তি চ পরস্পরবিরুদ্ধম্‌। কথং তু তদ্ব্রহ্ম সম্যগ্‌বিদিতং ভবতীত্যেবমর্থমাহ- প্রতিবোধবিদিতং বোধং বোধং প্রতি বিদিতম্‌। বোধশব্দেন বৌদ্ধাঃ প্রত্যয়া উচ্যন্তে। সর্বে প্রত্যয়া বিষয়ীভবন্তি যস্য স আত্মা সর্ববোধান্‌ প্রতিবুধ্যতে, সর্বপ্রত্যয়দর্শী চিচ্ছক্তিস্বরূপমাত্রঃ প্রত্যয়ৈরেব প্রত্যয়েষ্ববিশিষ্টতয়া লক্ষ্যতে। নান্যদ্দ্বারমাত্মনো বিজ্ঞানায়।

ব্যাখ্যা—‘অবিজ্ঞাতং বিজানতামিত্যবধৃতম্‌’—‘অবিজ্ঞাতং বিজানতাম্‌’-এর দ্বারা নিশ্চিত করা হয়েছে যে, যারা বলে ব্রহ্মকে জেনেছি তারা জানে না। ‘যদি ব্রহ্ম অত্যন্তমেব অবিজ্ঞাতম্‌’—যদি ব্রহ্ম একান্তই অজ্ঞাত হন, তাহলে ‘লৌকিকানাং ব্রহ্মবিদাং চ অবিশেষঃ প্রাপ্তঃ’—লৌকিক অর্থাৎ সাধারণ মানুষ আর ব্রহ্মজ্ঞের মধ্যে কোনো পার্থক্য থাকে না। [ব্রহ্মকে] সাধারণ লোকেরাও জানে না আবার ব্রহ্মজ্ঞেরাও জানে না, সুতরাং তারা সমান হয়ে গেল। ‘অবিজ্ঞাতং বিজানতাম্‌ ইতি চ পরস্পরবিরুদ্ধম্‌’ —এবং ‘যারা জানে না তাদের দ্বারা জ্ঞাত’ এই কথাটিও পরস্পরবিরোধী।

যদি অবিজ্ঞাত হয় তাহলে তা জ্ঞাত হয় না, আর যদি জ্ঞাত হয় তাহলে তা অবিজ্ঞাত হয় না। ‘কথং তু তদ্ব্রহ্ম সম্যগ্‌বিদিতং ভবতি’—কিপ্রকারে তাহলে সেই ব্রহ্ম সম্পূর্ণরূপে জ্ঞাত হন? ‘ইতি এবমর্থমাহ’—এই অর্থ এখানে বলছেন—‘প্রতিবোধবিদিতং বোধং বোধং প্রতি বিদিতম্‌’! ‘প্রতিবোধবিদিতম্‌’ মানে ‘বোধং বোধং প্রতি বিদিতম্‌’—প্রত্যেক বোধের সঙ্গে বিজ্ঞান অর্থাৎ বোধে বোধে যিনি বিদিত হচ্ছেন। বোধ মানে অন্তঃকরণের বৃত্তি, তার দ্বারা সব জানা হয়। ‘বোধশব্দেন বৌদ্ধাঃ প্রত্যয়া উচ্যন্তে’—‘বোধ’ শব্দের দ্বারা বৌদ্ধপ্রত্যয়, বুদ্ধিসম্বন্ধীয় যে-প্রত্যয় (প্রত্যয় মানে বৃত্তি) অর্থাৎ বুদ্ধির বৃত্তিরূপ জ্ঞানসমূহকে বলা হয়েছে।

‘সর্বে প্রত্যয়া বিষয়ীভবন্তি যস্য স আত্মা সর্ববোধান্‌ প্রতিবুধ্যতে’—‘সর্বে প্রত্যয়া’—সমস্ত প্রত্যয়ের জ্ঞান ‘বিষয়ীভবন্তি যস্য’—যার বিষয় হয়, সমস্ত বৌদ্ধপ্রত্যয় যার বিষয় হয় মানে সকল প্রত্যয়কে আত্মা প্রকাশ করে, সুতরাং আত্মার বিষয় হলো সকল প্রত্যয়; আত্মপ্রকাশ্য তারা। সেই সমস্ত প্রত্যয় যে-আত্মার বিষয় ‘স আত্মা সর্ববোধান্‌ প্রতিবুধ্যতে’—সেই আত্মা সর্ববোধের অর্থাৎ সকল প্রত্যয়ের সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞাত হয়। কীভাবে? বলছেন—‘সর্বপ্রত্যয়দর্শী চিচ্ছক্তিস্বরূপমাত্রঃ প্রত্যয়ৈরেব প্রত্যয়েষ্ববিশিষ্টতয়া লক্ষ্যতে’। ‘সর্বপ্রত্যয়দর্শী’—সকল প্রত্যয়ের দর্শী মানে সাক্ষী, ভাসক ‘চিচ্ছক্তিস্বরূপমাত্রঃ’—চৈতন্যস্বরূপমাত্র আত্মা ‘প্রত্যয়ৈরেব প্রত্যয়েষ্ববিশিষ্টতয়া লক্ষ্যতে’—প্রত্যয়ের দ্বারাই প্রত্যয়ের ভিতরে অবিশিষ্ট, অভিন্নরূপে লক্ষিত হয়। অর্থাৎ চৈতন্য তার স্বরূপমাত্ররূপে চৈতন্যের দ্বারা উদ্ভাসিত বস্তুর সঙ্গে অভিন্ন হয়ে রয়েছে। তাকে যদি বস্তু থেকে পৃথক করা হয় তাহলে সে কী হয়?—চৈতন্যস্বরূপমাত্র হয়। উদাহরণস্বরূপ, এই বইটাকে আমি জানছি। বইটা হলো আমার প্রত্যয়—জ্ঞাতবস্তু; জ্ঞানের বিষয় হচ্ছে। এই বইটাকে যদি সরিয়ে দেওয়া হয় তাহলে কী রইল?—শুধু জ্ঞান রইল। জ্ঞানের বিষয় হলো বইটা। বইটাকে যখন জানছি, তখন কী হচ্ছে?—বইটারও জ্ঞান হচ্ছে, চৈতন্যেরও জ্ঞান হচ্ছে। আমি চেতন, বইটাকে আমি যখন জানছি তখন আমার বুদ্ধির বৃত্তি—এই বোধাকার, পুস্তকাকার বৃত্তি রয়েছে; তার ভিতর থেকে যখন বৃত্তিটাকে সরিয়ে দেওয়া হলো তখন কী রইল?—কেবলমাত্র চৈতন্যই রইল যে ভাসক। তাই বলছেন—সর্বপ্রত্যয়ের সাক্ষী অর্থাৎ সকল বুদ্ধিবৃত্তির দ্রষ্টা, ভাসক, চিচ্ছক্তিস্বরূপমাত্র আত্মা সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তিতে যেন বুদ্ধিবৃত্তির সহিত অবিশিষ্ট হয়ে গেছেন। যেমন লৌহপিণ্ডকে যখন আগুনে দগ্ধ করা হয়, আগুনে সেটি লাল হয়ে যায়; তখন লৌহপিণ্ড আর আগুনকে বিশেষ অর্থাৎ আলাদা করা যায় না। সমস্ত লৌহপিণ্ডে আগুন যেমন ওতপ্রোত হয়ে যায়, সেইরকম বুদ্ধির যে প্রত্যয় অর্থাৎ বৃত্তি তাতে চৈতন্য এক হয়ে যায়, ওতপ্রোত হয়ে যায়। আত্মাকে এই বুদ্ধিবৃত্তির দ্বারাই জানা যায়। ‘নান্যদ্দ্বারমাত্মনো বিজ্ঞানায়’—আত্মাকে জানার অন্য কোনো দ্বার নেই, অন্য কোনো পথ নেই, অন্য কোনো উপায় নেই।

‘সম্যগ্‌দর্শনম্‌’-এর অর্থ

শাঙ্করভাষ্য—অতঃ প্রত্যয়প্রত্যগাত্মতয়া বিদিতং ব্রহ্ম যদা তদা তন্মতং তদা তৎসম্যগ্‌দর্শনমিত্যর্থঃ।

ব্যাখ্যা—‘অতঃ প্রত্যয়প্রত্যগাত্মতয়া বিদিতং ব্রহ্ম যদা’—অতএব [সকল] প্রত্যয়ের, বুদ্ধিবৃত্তির অন্তরাত্মারূপে যখন ব্রহ্মকে জানা হয়, ‘তদা তন্মতং তদা তৎসম্যগ্‌দর্শনমিত্যর্থঃ’—সেইটি হলো [ব্রহ্মের] ‘মত’ অর্থাৎ যথার্থ জ্ঞান, এবং সেইটিই হলো সম্যগ্‌দর্শন। সম্যগ্‌দর্শন মানে যথার্থ জ্ঞান—যেইটি যা তাকে সেই ভাবে জানা।

প্রত্যয়ের সা‌ক্ষিরূপে ব্রহ্মের অভেদ প্রতিপাদন

শাঙ্করভাষ্য—সর্বপ্রত্যয়দর্শিত্বে চোপজননাপায়-বর্জিতদৃক্‌স্বরূপতা নিত্যত্বং বিশুদ্ধস্বরূপত্বমাত্মত্বং নির্বিশেষতৈকত্বং চ সর্বভূতেষু সিদ্ধং ভবেৎ, লক্ষণভেদাভাবাদ্ব্যোম্ন ইব ঘটগিরিগুহাদিষু। বিদিতাবিদিতাভ্যামন্যদ্ব্রহ্মেতি আগমবাক্যার্থ এবং পরিশুদ্ধ এবোপসংহৃতো ভবতি। “দৃষ্টের্দ্রষ্টা শ্রুতেঃ শ্রোতা, মতের্মন্তা বিজ্ঞাতের্বিজ্ঞাতা” (বৃহদারণ্যকোপনিষদ, ২।৪।১২) ইতি হি শ্রুত্যন্তরম্‌।

ব্যাখ্যা—‘সর্বপ্রত্যয়দর্শিত্বে’—আত্মা যখন সর্ব-প্রত্যয়ের দ্রষ্টা, সর্বপ্রত্যয়ের প্রকাশক; সর্বপ্রত্যয়কে যিনি জানছেন সেইভাবে যখন আত্মা সর্বপ্রত্যয়দর্শী হলেন তখন তিনি ‘উপজননাপায়বর্জিত’—উৎপত্তি ও বিনাশ-বর্জিত হলেন (‘উপজনন’ মানে উৎপত্তি, ‘অপায়’ মানে নাশ)। ‘দৃক্‌স্বরূপতা’—দৃক্‌ মানে দর্শন, দৃষ্টি। তার সেইরূপতা অর্থাৎ চৈতন্যস্বরূপতা হলো। বৃত্তিগুলির উৎপত্তি ও বিনাশ হচ্ছে, কিন্তু বৃত্তিগুলির যে-দ্রষ্টা তার বিনাশ হচ্ছে না, সে একস্বরূপেতে রয়েছে। সে বৃত্তির পরিবর্তনগুলি লক্ষ্য করছে। কেন?—কারণ, সে এক। সে যদি এক না হতো তাহলে বৃত্তিগুলির মধ্যে কোনো ধারাবাহিক সম্বন্ধ থাকত না, পৃথক পৃথক হয়ে যেত। আত্মা বৃত্তি নয়, বৃত্তির ভাসকরূপে আত্মা রয়েছে। বৃত্তি নাশের সঙ্গে আত্মার নাশ হচ্ছে না, বৃত্তির সঙ্গে তার প্রকাশ হচ্ছে। এইভাবে বৃত্তিগুলির উৎপত্তি বিনাশ যে দেখছে, তার উৎপত্তি বিনাশ হলে তো বৃত্তিগুলিকে দেখা আর সম্ভব হতো না। এইজন্য ‘উপজননাপায়বর্জিতদৃক্‌স্বরূপতা’ বলা হয়েছে। ‘দৃক্‌স্বরূপতা’ মানে চৈতন্যস্বরূপতা। ‘নিত্যত্ব’—সে স্থায়ী রয়েছে বলে। এই পরিবর্তনগুলিকে লক্ষ্য করছে বলে তার বিনাশ বৃত্তির বিনাশের দ্বারা হবে না, সুতরাং সে নিত্য। তার ‘বিশুদ্ধস্বরূপত্ব’ রয়েছে। অশুদ্ধি হচ্ছে তার বৃত্তিগুলি; সে বৃত্তিগুলি থেকে পৃথক, কাজেই সে বিশুদ্ধস্বরূপ। ‘আত্মত্ব’ মানে সর্বব্যাপিত্ব। সমস্ত বৃত্তির পিছনে যে রয়েছে, ব্যাপক রূপে সে হলো আত্মা। ‘নির্বিশেষতা’—বিশেষতার পার্থক্যগুলি হচ্ছে বৃত্তির; তাহলে চৈতন্যের আর কোনো বিশেষ রইল না, সর্ববিশেষশূন্য এইজন্য নির্বিশেষতা। ‘একত্ব’—বহুত্ব রয়েছে বৃত্তিতে; তার দর্শী যে, সে এক। ‘সর্বভূতেষু সিদ্ধং ভবেৎ’—এইভাবে সর্বভূতে এইপ্রকার যে আত্মার স্বরূপ সেটা সিদ্ধ হলো, নিশ্চিত করা হলো। অর্থাৎ তাঁকে সকল প্রত্যয়ের সাক্ষিরূপে বুঝতে পারলেই তাঁর উৎপত্তি ও ধ্বংসরাহিত্য, দৃক্‌স্বরূপতা, নিত্যত্ব, বিশুদ্ধস্বরূপত্ব, আত্মরূপতা, নির্বিশেষতা এবং সকল ভূতে একত্ব অবধারিত হয়।

প্রশ্ন : ‘সর্বভূতেষু’ কেন বললেন?

উত্তর : ‘আমি’ আর ‘তুমি’ ভেদ কিসের জন্য হচ্ছে?—বৃত্তির দ্বারা ভেদ হচ্ছে। যখন বৃত্তিগুলি সব সরিয়ে দেওয়া হলো, তখন ‘আমি’ আর ‘তুমি’—এরূপ কোনো ভেদ রইল না। এইজন্য একত্ব, এইজন্য আত্মত্ব সর্বভূতে। কারণ, ভূতগুলি পৃথক হলেও তার পিছনে যে চিৎস্বরূপ রয়েছে তা এক রইল, তার ভেদক রইল না। তার ভেদক যদি না থাকে সে তখন সর্বব্যাপী হবে। সুতরাং সর্বভূতে সেই দৃক্‌স্বরূপ রয়েছে।

চৈতন্যের স্বরূপ মানে প্রকাশকস্বরূপ। জড়পদার্থের যদি প্রকাশ হয় তাহলে চৈতন্যের দ্বারাই প্রকাশিত হবে। যখন আমরা দেখি ঘটের প্রকাশ, মঠের প্রকাশ, ভিন্ন ভিন্ন বস্তুর প্রকাশ—তখন যদি ভিন্ন ভিন্ন বস্তুকে বাদ দেওয়া হয় তাহলে কী রইল?—শুধু প্রকাশ রইল। সর্বভূতে যে একত্ব আত্মার, তা সর্বভূতে পৃথক করছি কীভাবে?—তাদের দেহাদি ধর্ম দিয়ে। যখন সেই উপাধিগুলি সব বাদ পড়ে যাচ্ছে, তখন কেবল ভাসক থাকছে। সেই ভাসক সর্বভূতে একই রইল, তার আর ভেদক কিছু নেই। ভেদ দেহাদি উপাধি দিয়ে করা হচ্ছে। সেই দেহাদি উপাধিকে সরিয়ে দিলে থাকবে সেই একবস্তু—যে আমাদের সকলের মধ্যে, তোমার-আমার সকলের মধ্যে এক, কোনো পৃথকত্ব নেই। কেন? বলছেন, ‘লক্ষণভেদাভাবাদ্ব্যোম্ন ইব ঘটগিরিগুহাদিষু’ অর্থাৎ ‘লক্ষণভেদাভাবাৎ’—লক্ষণের ভেদ না থাকায়। কী দিয়ে ভেদ করব? ভেদক লক্ষণ তো কিছু নেই। উদাহরণ দিচ্ছেন ‘ব্যোম্ন ইব ঘটগিরিগুহাদিষু’—যেমন আকাশের একত্ব রয়েছে; কিন্তু ঘটাকাশ, গিরি-আকাশ, গুহাকাশ প্রভৃতি যে বিভিন্ন জায়গায় আকাশ রয়েছে সেই আকাশের ভেদক হচ্ছে ঘট, গিরি, গুহা ইত্যাদি। সেগুলোকে বাদ দিলে একই আকাশ রইল—নির্বিশেষ আকাশ।

‘বিদিতাবিদিতাভ্যামন্যদ্ব্রহ্মেতি আগমবাক্যার্থ এবং পরিশুদ্ধ এবোপসংহৃতো ভবতি’—‘বিদিত এবং অবিদিতর থেকে ভিন্ন ব্রহ্ম’—এই যে আগমবাক্যের অর্থ, শাস্ত্রবাক্যের অর্থ সেই অর্থ এইপ্রকারে ‘পরিশুদ্ধ এব’—পরিশুদ্ধ হয়ে (‘প্রতিবোধবিদিতং মতম্‌’ ইত্যাদি মন্ত্রে), সর্বসন্দেহমুক্ত হয়ে ‘উপসংহৃতো ভবতি’—এখানে উপসংহৃত হচ্ছে অর্থাৎ উভয় মন্ত্রের একই তাৎপর্য—তা প্রতিপাদিত হচ্ছে। “‘দৃষ্টের্দ্রষ্টা, শ্রুতেঃ শ্রোতা, মতের্মন্তা, বিজ্ঞাতের্বিজ্ঞাতা’ ইতি হি শ্রুত্যন্তরম্‌”—এইপ্রকার অন্য শ্রুতিতেও আছে যে, তিনি দৃষ্টের দ্রষ্টা, শ্রুতের শ্রোতা, মতের মন্তা, বিজ্ঞাতের বিজ্ঞাতা ইত্যাদি।

[এইভাবে ‘প্রতিবোধবিদিতং মতম্‌’ ইত্যাদি মন্ত্রে সমস্ত বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশকরূপে ও সা‌ক্ষিরূপে ব্রহ্মের অদ্বিতীয়ত্ব প্রতিপাদনের দ্বারা ব্রহ্ম ‘বিদিত এবং অবিদিতর থেকে ভিন্ন’—পূর্বে বর্ণিত এই উপক্রমস্থানীয় শ্রুতিবাক্যের উপসংহার সিদ্ধ হয়। এক্ষেত্রে সকল বুদ্ধিবৃত্তির সাক্ষী বা দ্রষ্টা এক না হলে উপক্রম (‘বিদিতাবিদিতাভ্যামন্যদ্ব্রহ্ম’) ও উপসংহারের (‘প্রতিবোধবিদিতং মতম্‌’) একবিষয়তা, একরূপতা সিদ্ধ হয় না।] [ক্রমশ]

দ্বাদশ অধ্যক্ষ, রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশন
শাঙ্করভাষ্যানুযায়ী পরম পূজ্যপাদ স্বামী ভূতেশানন্দজী মহারাজ-কৃত কেনোপনিষদের এই ব্যাখ্যা ক্যাসেট থেকে অনুলিখনের পর পাঠোপযোগী করে পরিবেশিত হলো।