সুখ ও দুঃখ—পরস্পরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সংলগ্ন এই দুটি অবস্থা থেকে আমাদের মুক্তি নেই৷ বেদনার বার্তাবহ হয়ে যাকিছু আমাদের কাছে আসে, তাদের সঙ্গে আনন্দের স্পর্শও কিন্তু সংযুক্ত হয়ে থাকে৷ এরা উভয়েই আমাদের পৃথিবীর উপাদান৷ এদের থেকে আমাদের মুক্তি নেই, জীবনের প্রতিটি স্পন্দনে এরা বিদ্যমান৷ এদের বৈপরীত্যের মধ্যে সামঞ্জস্যবিধানের প্রচেষ্টায় ব্যস্ত হয়ে আছে সমগ্র পৃথিবী৷ মহাজ্ঞানী ব্যক্তিরাও অন্বেষণ করে যাচ্ছেন এই দুই বিপরীত বিষয়ের পারস্পরিক আলিঙ্গন থেকে সৃষ্ট সমস্যার সমাধানের সূত্রটি৷ মাঝে মাঝে বিশ্রামের অবসর এসে যন্ত্রণার জ্বালা প্রশমিত করে ক্ষণকালের জন্য—যেমন বিদ্যুতের শিখা অন্ধকারের আবরণ ভেদ করে মুহূর্তের জন্য এবং পরক্ষণেই অন্ধকার যেন আরো গভীরতর রূপ ধারণ করে ফিরে আসে!
আশাবাদী হয়েই জন্মগ্রহণ করে শিশু৷ কিন্তু জীবনের পরবর্তী অধ্যায়গুলি যেন মোহভঙ্গের এক নিরবচ্ছিন্ন কাহিনি! এমন কোনো আদর্শ নেই যার পরিপূর্ণ রূপায়ণ করা যেতে পারে, এমন কোনো বাসনা নেই যার নির্বাপণ সম্ভব৷ মানুষ এই প্রহেলিকার সমাধান এভাবেই খুঁজে বেড়ায় এবং কালে এই কর্মের দায়ভার নিজস্কন্ধে তুলে নেয় ‘ধর্ম’৷
ধর্মের দ্বৈত-উপাসনা পদ্ধতিতে, যেমন পারসিদের ধর্মে, এক ছিলেন ঈশ্বর এবং তাঁর বিপরীতে আসীন ছিল এক শয়তান৷ ইহুদিদের মাধ্যমে এই ধারণা ক্রমশ ইউরোপ এবং আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে৷ সহস্র বর্ষ পূর্বে এটি সাময়িকভাবে কার্যকরী এক তত্ত্ব হয়ে থাকতে পারে, কিন্তু আজ আমরা জানি—এই তত্ত্ব যুক্তিগ্রাহ্য নয়৷ অবিমিশ্র ভাল অথবা সম্পূর্ণ মন্দ বলে কিছু হতে পারে না৷ যা একের জন্য ভাল, অপরের জন্য তা মন্দ হতেই পারে৷ আজ যা ভাল, কাল তা মন্দ হয়ে উঠতে পারে, অথবা এর বিপরীতও হতে পারে।…
ঈশ্বর শুরুতে অবশ্যই এক গোষ্ঠী-দেবতারূপে বিদ্যমান ছিলেন৷ তারপর একসময় তিনি হয়ে উঠলেন সকল ‘দেবতার দেবতা’৷ প্রাচীন মিশর ও ব্যাবিলনের অধিবাসিগণ এই তত্ত্বটিকে (দ্বৈত বা যুগ্মভাবে ঈশ্বর ও শয়তানের অবস্থিতি) অত্যন্ত নিপুণভাবে প্রায়োগিক রূপ দিয়েছিলেন৷ তাঁদের মলোক হয়ে উঠলেন দেবতাদের ঈশ্বর এবং পরাজিত দেবতাদের বাধ্য করা হলো মন্দিরে সশ্রদ্ধভাবে তাঁর আনুগত্য স্বীকার করতে৷
তবুও প্রহেলিকার অন্ত হয় না! অশুভের ওপর আধিপত্য কার? অনেকেই আশার বিপরীতে পাদচারণা করে আশা পোষণ করেন যে, যা ঘটে তা ভালর জন্যই ঘটে! কিন্তু আমরা সেটা অনুধাবন করতে পারি না৷ এ যেন বালিতে মাথা গুঁজে একখণ্ড তৃণ আকর্ষণ করে বাঁচার চেষ্টা! তবুও আমরা প্রত্যেকেই নীতির অনুসরণ করে চলি, যার সারমর্ম শুধুমাত্র একটি শব্দে প্রকাশ করা যায়—আত্মত্যাগ—আমি নই, শুধু তুমি—‘নাহং নাহং, তুঁহু তুঁহু’৷ আর কী আশ্চর্যভাবেই না প্রতিনিয়ত এই নীতির বিরোধ পরিলক্ষিত হয় বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তা সেই মহান ঈশ্বরের কার্যকলাপে! মহামারী, অনাবৃষ্টি, যুদ্ধ—এই সবকিছুর পশ্চাতে দণ্ডায়মান সেই মহানের চেয়ে বেশি স্বার্থপর ও সবচেয়ে প্রতিহিংসাপরায়ণ আর কে আছে এই বিশ্বসংসারে?
এই জীবনেই আমাদের অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে নিতে হবে৷ তিক্ত অভিজ্ঞতার হাত থেকে বাঁচতে আমরা পালানোর চেষ্টা করতেই পারি, কিন্তু ভবিষ্যতে—তা সে নিকট হোক বা সুদূর—ধরা আমাদের দিতেই হবে তাদের কাছে৷ এবং যে-ব্যক্তি এই পরিপূর্ণ অভিজ্ঞতা লাভ করতে অসমর্থ, তার প্রতি আমার দয়ার উদ্রেক হয়৷
বেদের মনু পারস্যদেশে পরিবর্তিত হয়ে অহৃমানরূপে পরিচিত হলেন—এভাবেই এই প্রশ্নের পৌরাণিক ব্যাখ্যার পরিসমাপ্তি ঘটে৷ কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়—যার কোনো উত্তর পাওয়া যায় না, কোনো সমাধান হয় না৷
দেবীর প্রতি উচ্চারিত সেই প্রাচীন বৈদিক স্তোত্রে কিন্তু ধারণার প্রকারান্তর ছিল—“আমি জ্যোতি; সূর্য ও চন্দ্রের যে-জ্যোতি, সে আমিই; সকল প্রাণীতে প্রাণসঞ্চারী যে-বায়ু, আমি সেই৷” এই ধারণার বীজ থেকেই কালে মাতৃপূজার বিকাশ হয়৷ মাতৃপূজার অর্থ এই নয় যে-পিতা থেকে মাতা ভিন্নতর৷ এই শব্দের তাৎপর্য নির্ণয়ে সর্বপ্রথম যে-অর্থের উপপত্তি হয় তা হচ্ছে—শক্তি—আমি সর্বজীবের অন্তর্নিহিত শক্তি৷
শৈশবে মানুষ স্নায়ুসর্বস্ব৷ তার বৃদ্ধি ও অগ্রগতি অব্যাহত থাকে যতক্ষণ না সে শক্তিশালী হয়ে ওঠে৷ আদিতে ভাল ও মন্দের ধারণা পৃথগ্রূপে বিকশিত হয়নি৷ বিকাশমান চেতনা থেকে উন্মেষিত হয় শক্তির প্রাথমিক রূপ৷ প্রতি পদে বাধা এবং সেই অনুযায়ী সংঘর্ষ—এটাই জগতের নিয়ম৷ প্রতিবন্ধকতা এবং শক্তি—এই দুইয়ের সংঘর্ষের ফল হলো আমাদের সত্তা। এবং শক্তি বলতে আভ্যন্তরীণ ও বাহ্য—উভয়ই৷ প্রতিটি মানসিক ভাবনার বিরোধিতায় সর্বদা ব্যস্ত হয়ে আছে এক-একটি পরমাণু৷ আমরা যাকিছু দেখি এবং যাকিছু আমাদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করে, তা এই দুইয়ের সমাহার ভিন্ন কিছু নয়৷
ঈশ্বর সম্পর্কিত এই ধারণা একেবারেই নতুন৷ বৈদিক স্তোত্রে আমরা দেখি, বরুণ ও ইন্দ্র তাঁদের ভক্তবৃন্দের প্রতি উপহার ও কৃপা বর্ষণ করছেন, যা কি না অত্যন্ত মনুষ্যজনোচিত ব্যবহার৷ বলা যায়, এটি মানবের চেয়েও বেশি মানবোচিত ভাবনার ফসল৷
নতুন তত্ত্ব হচ্ছে এই যে, সর্বপ্রকার ক্রিয়া-বিক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পশ্চাতে একই শক্তি বিদ্যমান৷ বিশ্বের ত্রাতারূপে অথবা মূর্তিমান শয়তানের রূপে—ক্ষমতার প্রকাশ যে-রূপেই হোক না কেন—পশ্চাতে তার একই শক্তি সর্বদা ক্রিয়াশীল৷ এই হচ্ছে নব্য ভাবনা৷ প্রাচীন ধারণায় ঈশ্বরে আরোপিত হয়েছিল মনুষ্যপ্রকৃতি৷ কিন্তু এই পর্যায়ে মানুষের মনোজগতে একমেবাদ্বিতীয়ম্ জগদ্ব্যাপী শক্তির অঙ্কুরোদ্গম দেখতে পাই৷
“দুষ্টের বিনাশের জন্য রুদ্র যখন ধনুক উত্তোলন করেন, আমিই তখন তার জ্যা আকর্ষণ করি।” (ঋগ্বেদ, ১০।১২৫, দেবীসূক্ত)
ক্ষণিক কালান্তরেই গীতায় (৯।১৯ এবং ১০।৪-৫) আমরা শুনতে পাই—“হে অর্জুন! সৎ এবং অসৎ, ভাল ও মন্দ উভয়ই একাধারে আমি, মহানের মহত্ত্ব ও দুর্জনের দুর্বৃত্তি আমারই শক্তির প্রকাশ৷” কিন্তু শীঘ্রই বক্তা সত্যের সঙ্গে আপস করে নিলেন, আর এই ধারণা সুষুপ্তির গর্ভে অন্তর্হিত হলো৷ ভাল যতক্ষণ সৎকর্মরূপে প্রকাশিত, ততক্ষণই সেখানে আমার শক্তি (এই ধারণা তার স্থলে অভিষিক্ত হলো)৷
পারস্যের ধর্মে শয়তানের কল্পনা ছিল৷ কিন্তু ভারতবর্ষীয় ধর্মে এমন কোনো ধারণা ছিল না৷ পরবর্তিকালের গ্রন্থগুলিতে এই নতুন ধারণার অভ্যুদয় দেখা যায়৷ অশুভের উপস্থিতি নিয়ে সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই৷ এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড একটি ঘটনা; আর এ যদি সত্য হয়, তাহলে এই বিশাল সৃষ্টি ভাল ও মন্দের যৌগিক সমন্বয়ে সংঘটিত৷ এর শাসনের ভার যাঁরই ওপর ন্যস্ত হোক না কেন, তাঁকে ভাল ও মন্দ উভয়েরই শাসনভার গ্রহণ করতে হবে৷ সেই শক্তির অঙ্গুলিহেলনে যদি আমাদের জীবন নিয়ন্ত্রিত হয়, তাহলে আমাদের মৃত্যুর জন্যও তিনিই দায়ী৷ হাসি ও কান্না একে অপরের সঙ্গে আত্মীয়তার বন্ধনে বদ্ধ এবং এই জগতে হাসির চেয়ে কান্নার পরিমাণই বেশি৷
ফুলের শোভা কার তৈরি, হিমালয়ের স্রষ্টা কে?
—এক অতি সজ্জন ঈশ্বর৷
আমার পাপ, আমার দুর্বলতার সৃষ্টি কার থেকে?
—কর্ম, শয়তান, জীবাত্মা৷
এই যুক্তির ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি একটিমাত্র পায়ের ওপর দণ্ডায়মান এক খঞ্জ মহাবিশ্ব৷ স্বাভাবিকভাবেই এই মহাবিশ্বের নিয়ন্তারূপে পেয়েছি একপদী এক ঈশ্বরকে৷
ঈশ্বর ও শয়তান একে অন্যের থেকে সম্পূর্ণ পৃথক, দুটি খণ্ডে কর্তিত এবং তদনন্তর শুষ্ক করে রাখা বস্তুর ন্যায় আলাদা এদের অস্তিত্ব—এই দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের হৃদয়হীন ও সহানুভূতিশূন্য পশুতে পর্যবসিত করে৷ পথে [মন্দ কোনো মহিলাকে দেখলে] ভদ্রগৃহের মহিলারা পাশে সরে যান ত্বরিত গতিতে৷ কেন? এমন কোনো গুণ তো থাকতেই পারে সেই মহিলার—যেখানে সে আপনার তুলনায় অনেক উন্নত! বস্তুত, এই দৃষ্টিভঙ্গি পৃথিবীতে নিয়ে আসে চিরস্থায়ী ঘৃণা ও বিদ্বেষ, মানুষে মানুষে সৃষ্টি করে অনন্ত বিভেদ৷ সৎ ব্যক্তি ও তার চেয়ে ন্যূনতর সততার অধিকারী ব্যক্তির মধ্যে এবং একইভাবে মধ্যম ব্যক্তি ও তার তুলনায় যে অসৎ—এমন মানুষের মধ্যে পর্যায়ক্রমে সারি সারি প্রতিবন্ধক গড়ে তোলে এই মতবাদ৷ এই পাশবিক দৃষ্টিভঙ্গি বিশুদ্ধ অশুভ ছাড়া কিছু নয় এবং মূর্তিমান শয়তানের চেয়েও বেশি শয়তানিতে পূর্ণ৷ আসলে, ভাল ও মন্দের পৃথক অস্তিত্ব নেই, যা আছে তা হচ্ছে শুভর বিকাশ এবং যাকিছু অপেক্ষাকৃত কম ভাল, তাকেই আমরা মন্দ বলে অভিহিত করে থাকি৷
কেউ মহাত্মা, কেউ আবার দুরাত্মা৷ কিন্তু সূর্য উভয়েরই ওপর সমানভাবে আলোক বিকিরণ করে৷ সেখানে কি কোনো পক্ষপাতিত্ব দেখা যায়?
ঈশ্বরকে পিতৃপুরুষরূপে অভিহিত করার প্রাচীন ধারণাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে একটি সুমধুর কল্পনা—ঈশ্বর শুধুমাত্র সুখের অধিকর্তা৷ যা ঘটনা, তাকে আমরা অস্বীকার করতে চাই৷ অশুভের অস্তিত্ব এক শূন্য ব্যতীত কিছুই নয়৷ এই ‘আমি’ই হচ্ছে অশুভ৷ এবং এই ‘আমি’র অস্তিত্ব আবার মাত্রাতিরিক্ত৷ আমি কি কিছুই নই? প্রতিদিন আমি নিজেকে খুঁজে ফিরি এভাবেই, এবং বিফল হই৷
এইপ্রকার সকল ধারণাই হলো অশুভকে অস্বীকার করার একটা প্রচেষ্টা৷ কিন্তু আমাদের তো এর মুখোমুখি হতেই হবে৷ সম্পূর্ণ সত্যের সম্মুখীন হতে হবে৷ শুধুমাত্র সুখ ও স্বস্তি বজায় থাকলে তবেই আমার ভালবাসার একাংশ ঈশ্বরকে দেওয়া যাবে—এমন কোনো চুক্তিতে কি আমি স্বাক্ষর করেছি? দুঃখ-দুর্দশায়, অশুভের কালে আমার ভালবাসা কি ঈশ্বরকে প্রদেয় নয়?
প্রদীপ কিন্তু জানে না তার আলোতে কে জালিয়াতি করে এবং কেই বা দুর্ভিক্ষপীড়িতের সাহায্যার্থে হাজার ডলারের অনুদান লিখে দেয়৷ কোনো বৈষম্য না করেই প্রদীপ সমভাবে আলোকবিতরণ করে যায় উভয়কেই৷ তার কোনো অশুভজ্ঞান নেই৷ তুমি ও আমি শুভ বা অশুভ বলে অভিহিত করি বলেই শুভাশুভ বিদ্যমান৷
এই তত্ত্বটির এক নতুন নাম অবশ্যই প্রয়োজন৷ একে অভিহিত করা হয়েছে ‘মা’ বলে; কেননা আক্ষরিক অর্থে বলতে গেলে, প্রাচীনকালে এর উন্মেষ ঘটেছিল এক লেখিকার সৃষ্টিকার্য থেকে, যিনি পূজিত হয়েছিলেন ঈশ্বরীরূপে৷ অতঃপর সাংখ্যযোগের আবির্ভাব ঘটে, যেখানে শক্তি অভিহিত হয়েছেন স্ত্রীরূপে৷ চুম্বক স্থির, লৌহচূর্ণ কিন্তু সক্রিয়৷
ভারতবর্ষে স্ত্রীজাতির সর্বোচ্চ সম্মানীয়া রূপ হচ্ছে মাতৃরূপ, যাঁর স্থান সহধর্মিণীর চেয়েও ঊর্ধ্বে৷ স্ত্রী পতিকে অথবা সন্তান পিতাকে ত্যাগ করে যেতে পারে, মাতা কিন্তু কখনো সন্তানকে পরিত্যাগ করতে পারেন না৷ মাতার প্রতি সন্তানের ভালবাসার তুলনায় হয়তো সন্তানের প্রতি মাতার স্নেহ অধিকতর তীব্র৷ সর্বপ্রকার আদান-প্রদানের ঊর্ধ্বে সর্বতোভাবে নির্মল প্রেম, যার কখনো মৃত্যু হয় না—এমন স্নেহের মূর্তিমান রূপই হচ্ছেন মা৷ এমন প্রেম বক্ষে ধারণ করতে কে পারেন? কেবলমাত্র মা—পুত্র নয়, কন্যা নয়, স্ত্রীও নয়৷
মাতা বলেন : “সর্বত্র যে-শক্তির প্রকাশ, সেই আমি৷” এই মাতাই জগৎ প্রসব করেন এবং তারপর যে প্রলয় আগত হয়, তার মূলেও তিনি৷ ধ্বংস যে নতুন সৃষ্টিরই প্রস্তুতি, তা তো বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই৷ পর্বতের শীর্ষদেশ এক মালভূমির সূচনা ভিন্ন তো কিছু নয়৷
যাকিছু ঘটেছে বা ঘটছে, সাহসের সঙ্গে তাকে ঘটনা হিসাবেই গ্রহণ করতে হবে৷ অশুভের তাড়নায় বিশ্বব্রহ্মাণ্ড চষে বেড়ানোর প্রয়োজন নেই৷ যা মন্দ তা মন্দই৷ তাতে কী আসে যায়!
সার কথা এই যে, এসমস্ত কিছুই মায়ের খেলা মাত্র, বিশেষ গুরুতর কোনো বিষয় নয়৷ সর্বশক্তিমানকে অপসৃত করবে কে? কিসের জন্য জগন্মাতা প্রণোদিত হলেন এই বিশ্বসংসার সৃজন করতে? নিজস্ব কোনো উদ্দেশ্য তো তাঁর থাকতে পারে না৷ কেন? কেননা, উদ্দেশ্য হয় সেটাই—যা প্রাপ্ত হয়নি এখনো৷ সুতরাং এই সৃষ্টি কেন সংঘটিত হলো?—নির্মল আনন্দের জন্য৷ আমরা এই সহজ সত্য ভুলে বিবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং পরিণামে দুর্গতি ভোগ করি৷ বস্তুত, আমরা মায়ের খেলার সঙ্গী ভিন্ন কিছুই নই৷
সার কথা এই যে, এসমস্ত কিছুই মায়ের খেলা মাত্র, বিশেষ গুরুতর কোনো বিষয় নয়৷ সর্বশক্তিমানকে অপসৃত করবে কে? কিসের জন্য জগন্মাতা প্রণোদিত হলেন এই বিশ্বসংসার সৃজন করতে? নিজস্ব কোনো উদ্দেশ্য তো তাঁর থাকতে পারে না৷ কেন? কেননা, উদ্দেশ্য হয় সেটাই—যা প্রাপ্ত হয়নি এখনো৷ সুতরাং এই সৃষ্টি কেন সংঘটিত হলো?—নির্মল আনন্দের জন্য৷ আমরা এই সহজ সত্য ভুলে বিবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ি এবং পরিণামে দুর্গতি ভোগ করি৷ বস্তুত, আমরা মায়ের খেলার সঙ্গী ভিন্ন কিছুই নই৷
সুখ অবশ্যম্ভাবী—সে তো ভালই; কে তাকে নিবৃত্ত করবে? দুঃখও অবশ্যম্ভাবী; আহ্বান করুন তাকেও৷ একটি মশা বসেছিল এক ষাঁড়ের শিঙের ওপর৷ হঠাৎ তার বিবেক জাগ্রত হয়ে উঠতে সে দুঃখিতস্বরে বলে উঠল : “ষণ্ডমশাই! অনেকক্ষণ ধরে আমি এখানে বসে আছি৷ বোধহয় আপনি বিরক্ত হচ্ছেন৷ আমি দুঃখিত। বিদায় নিচ্ছি৷” কিন্তু ষাঁড় উত্তরে বলল : “না, না, তুমি এ নিয়ে মোটেই ভেবো না৷ তোমার সম্পূর্ণ পরিবারকে নিয়ে এস এবং আমার শিঙে বসবাস কর৷ তুমি আমার কীই বা করতে পার!”—দুঃখের উদ্দেশে এই বাক্যটি কেন আমরা উচ্চারণ করতে পারি না? সাহসী হওয়ার অর্থই হচ্ছে মায়ের ওপর বিশ্বাস অবলম্বন করে থাকা৷
“আমিই জীবন, আমিই মৃত্যু৷” জীবন ও মৃত্যু তাঁর ছায়ামাত্র৷ সকল আনন্দের মূলে তিনি আনন্দস্বরূপ৷ তিনিই আবার দুঃখস্বরূপ—সকল দুঃখের মাঝে৷ জীবনের আগমনে তাঁর আগমন, মৃত্যুর পদধ্বনিতেও তিনিই এগিয়ে আসেন৷ স্বর্গলাভে তাঁকেই পাওয়া যায়, নরকগতিতেও তাঁকেই প্রাপ্তি ঘটে৷ সুতরাং ঝাঁপিয়ে পড়৷ আমাদের বিশ্বাস নেই, ধৈর্যও নেই এর পরিণতি দেখার৷ পথে দেখা ব্যক্তির প্রতি আমরা যাও বা বিশ্বাস স্থাপন করি, বিশ্বসংসারে একজনের প্রতিই আমরা কিন্তু বিশ্বাস স্থাপন করতে পারি না—তিনি ঈশ্বর৷ যখন তিনি আমাদের বাসনার অনুকূলে কাজ করেন, তখন তাঁর প্রতি আমাদের অশেষ বিশ্বাস! কিন্তু এমন সময়ও আসে, যখন আঘাতের পর আঘাত আমাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ মানসের মৃত্যু ঘটায়৷ সর্বপ্রকার কর্মে আমাদের অহংকার বা ‘ego’ সর্পবৎ ফণা উত্তোলন করে দাঁড়িয়ে ওঠে৷ আমাদের পথ কণ্টকাকীর্ণ বলে আমরা হর্ষান্বিত, কেননা তাতে ঐ বিষধর সর্পের ফণা ক্ষতবিক্ষত হয়৷
সর্বশেষ পর্যায়ে আসে শরণাগতি৷ একমাত্র তখনি মাতৃপদে সর্বস্ব নিবেদন করতে আমরা সক্ষম হই৷ সুখ আসুক, আসুক দুঃখ—সমভাবে আমরা তাদের স্বাগত জানাতে পারব৷ যখন আমরা সেই প্রেমের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হব, সর্বপ্রকার বক্রতা তখন দূর হয়ে যাবে, সংসার সরল রূপ ধারণ করে আমাদের কাছে আবির্ভূত হবে৷ ব্রাহ্মণ, অস্পৃশ্য, এমনকী একটি কুকুরের সঙ্গেও সেই একত্ব অনুভূত হবে৷ সমগ্র বিশ্বসংসারের প্রতি সমত্ববুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে যতদিন না আমরা তাকে পরিপূর্ণরূপে ভালবাসতে পারছি—ততদিনৗ বারবার আমরা লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে থাকব৷ [যখন সেই একত্বের অনুভব হবে] তখন কিন্তু সবকিছু বিলুপ্ত হবে এবং সর্বত্র আমরা সেই অসীম মাতৃমূর্তিকেই প্রত্যক্ষ করব৷
Complete Works of Swami Vivekananda-এর ষষ্ঠ খণ্ডের অন্তর্ভুক্ত ‘Mother-Worship’ এযাবৎ বাংলায় অপ্রকাশিত। নিউ ইয়র্কের এক শ্রেণিকক্ষে স্বামী বিবেকানন্দ প্রদত্ত বক্তৃতার বিচ্ছিন্নভাবে লিপিবদ্ধ বিবরণ থেকে সংকলিত এই রচনার অনুবাদ করেছেন
স্বামী দিব্যবিভানন্দ।