রাষ্ট্রীয় বিকাশের দিক থেকে পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণ-পশ্চিম অংশের ইতিহাসে পঞ্চদশ-ষোড়শ শতক ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সময় বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া জেলার দামোদর, দ্বারকেশ্বর, কংসাবতী ও শিলাবতী নদী-উপত্যকার কৃষ্ণকায় অরণ্যচারী জনগোষ্ঠীসমূহের গোষ্ঠীপতিদের নেতৃত্বে বেশ কয়েকটি রাজ্য গড়ে উঠেছিল। বাঁকুড়া জেলায় এইরূপ চারটি রাজ্যের সন্ধান পাওয়া যায়। এগুলির অন্যতম ছিল তুঙ্গভূম। সিমলাপাল এই তুঙ্গভূমেরই অন্তর্ভুক্ত ছিল।

‘সিমলাপাল’ নামের উৎপত্তি নিয়ে গবেষকদের মধ্যে ভিন্নমত রয়েছে। কারো কারো মতে, শিলাইপাল থেকে এই নামের উৎপত্তি। শিলাবতী নদী লোকমুখে ‘শিলাই’ নামে পরিচিত, অন্যদিকে ‘পাল’ অর্থে নদীতীরবর্তী পলল ভূমি। অনেকের মতে, বসতি বোঝাতেও পাল শব্দটি ব্যবহৃত হয়। শিলাই নদীর ধারের বসতি থেকেই শিমলাপাল বা সিমলাপাল। আবার কারো মতে, শিমুল গাছের আধিক্য থেকেও এই নাম এসে থাকতে পারে।

গ্রাম-উৎপত্তির ইতিহাসও অন্ধকারে ঢাকা। জানা যায়, দ্বাদশ শতাব্দীতে ওড়িশার রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপনের নিদর্শন হিসাবে সারংগড়ে প্রথম উৎকল জনবসতি গড়ে ওঠে। বর্তমানে রানিবাঁধ থানার অন্তর্গত কুমারী নদীর তীরে অবস্থিত সারংগড়ে বেশ কিছু মাটির ঢিবি পাওয়া গেছে। খননকার্য চালিয়ে পাওয়া গেছে পুরানো ইট, যা থেকে অনুমান করা হয়—এখানে একদা ওড়িশার গঙ্গবংশীয় রাজা অনন্তবর্মণ চোড়গঙ্গের দুর্গ ছিল। অনন্তবর্মণের উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীদের মধ্যে ছিলেন বহু উৎকল ব্রাহ্মণ। দক্ষিণ বাঁকুড়ায় মধ্যযুগের মাঝামাঝি সময়ে রাজগ্রাম ও টিকরপাড়া নামে দুটি গ্রাম ছিল। পরে ওখানকারই জনৈক ভাগ্যান্বেষী উৎকল ব্রাহ্মণ স্থাপন করেন সিমলাপাল নামক গ্রামবসতি।

ভবিষ্যপুরাণের ব্রহ্মাণ্ড অংশের বর্ণনা অনুযায়ী এই অঞ্চলটি ছিল শাল ও অন্যান্য বৃক্ষের দুর্ভেদ্য অরণ্যে আবৃত। শিলাবতী-কংসাবতী-কুমারী উপত্যকার গভীর অরণ্যে বসবাসকারী কৃষ্ণকায় কোল-ভীল-মুণ্ডা-হোড়-ওঁরাওরা মূলত ছিল শিকারজীবী। অভ্যস্ত ছিল উত্তেজক পানীয় গ্রহণে। তাদের আরাধ্য দেবদেবীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন উগ্র ও রুক্ষ স্বভাবের।

রিসলে তাঁর দি ট্রাইব্স অ্যান্ড কাস্টস অব বেঙ্গল বইতে এইসব বাউরি, বুনা, কোড়া জনগোষ্ঠীগুলিকে একই সামাজিক মর্যাদাশ্রয়ী বলেছেন। তাঁর বর্ণনা অনুযায়ী এই অঞ্চলে তখন বাস করত ভূমিজ, কোড়া, কুর্মি, সাঁওতাল, বাউরি, বাগদি, মাল, খেড়িয়া, খয়রা ইত্যাদি উপজাতীয় ও অর্ধ-উপজাতীয় জনগোষ্ঠীসমূহ। তাদের মধ্যে সাপ ছাড়াও নানাবিধ জীবজন্তুর মাংস ও উত্তেজক পানীয় গ্রহণের অভ্যাস ছিল। চুরি-ডাকাতি, লুঠতরাজ ও বন্য পশু শিকার ছিল তাদের জীবিকা। ষোড়শ শতাব্দী পর্যন্ত কৌম গোষ্ঠীগুলি কোনো উন্নত সাংস্কৃতিক মান অর্জন করতে পারেনি। তারা ছিল রাষ্ট্রশাসনবিহীন সম্প্রদায় অর্থাৎ তাদের মধ্যে রাষ্ট্রীয় শাসনব্যবস্থা বলে কিছুই ছিল না।

এই অঞ্চলের উপজাতিদের মধ্যে জলাভূমি আবাদ প্রথা গ্রহণ করে স্থায়ী বসতি স্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন উৎকল শ্রেণির ব্রাহ্মণেরা। হলায়ুধের ব্রাহ্মণ-সর্বস্ব গ্রন্থে উল্লেখ করা হয়েছে, উৎকল ব্রাহ্মণেরাই ছিলেন এই অঞ্চলের প্রধান ব্রাহ্মণ সম্প্রদায়। এঁদের দ্বারাই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সিমলাপাল রাজবংশ এবং এক ভিন্ন ধারার শাসনব্যবস্থা।

এক শ্রেণির গবেষকদের মতে, এই অঞ্চলে এই ব্রাহ্মণ শ্রেণির আগমন ঘটেছিল তিনটি পর্যায়ে। ১১৩৫ সাল নাগাদ এই অঞ্চলে অভিযান চালান ওড়িশার গঙ্গবংশীয় রাজা অনন্তবর্মণ চোড়গঙ্গ। তিনি নিজে জৈনধর্মাবলম্বী হলেও তাঁর উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীরা অনেকেই ছিলেন উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবারের। স্বাভাবিকভাবেই রাজ্যবিস্তারের সময় উৎকল ব্রাহ্মণদের আগমন ঘটেছিল এই অঞ্চলে। এই মতকে সমর্থন জানিয়ে এ. কে. বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছেন : “It is claimed that the ancestors of these Utkala Brahmins, following the trails of the victorious army of Chodaganga, came and settled in the District.”

কেউ কেউ মনে করেন, ওড়িশার রাজনৈতিক আধিপত্য স্থাপিত হওয়ার দরুন দক্ষিণ-পশ্চিম বঙ্গের জঙ্গলমহলে আবাদযোগ্য কৃষিজমির সন্ধানে ওড়িশা থেকে লোকজনের আগমন ঘটতে থাকে। কারণ হিসাবে মনে করা যেতে পারে, খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতাব্দী থেকে তাম্রলিপ্ত ও ওড়িশার উপকূল-বন্দরগুলির মাধ্যমে সমুদ্র-বাণিজ্যের অধঃপতন দেখা দেওয়ায় ওড়িশার আভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে যে-পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার চাপে নতুন জমির সন্ধানে দেশান্তর গমনের এক তীব্র তাগিদ ওড়িশার লোকজনের মধ্যে তৈরি হয়েছিল। এর পরবর্তী পর্যায়গুলি ছিল যথাক্রমে ১৩৫০ সাল নাগাদ নকুড়ের সহযোগী হিসাবে ২৫২টি উৎকল ব্রাহ্মণ পরিবারের আগমন এবং চতুর্দশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে শ্রীপতি মহাপাত্র কর্তৃক সিমলাপাল রাজবংশ স্থাপন।

শ্যামসুন্দরপুর পরগনা নামে পরবর্তিকালে পরিচিত রাইপুর থানার দক্ষিণাংশ হলো মধ্যযুগের তুঙ্গভূম। এই তুঙ্গভূম রাজ্যের রাজা হন নকুড়তুঙ্গ। কিংবদন্তি অনুসারে গণ্ডকী নদীর তীরবর্তী অঞ্চল থেকে তুঙ্গদেব জগন্নাথ-দর্শনে এলে জগন্নাথের আদেশমতো তিনি পুরীর রাজসিংহাসনে আরোহণ করেন। পরে তাঁর পৌত্র গঙ্গাধর তুঙ্গ জগন্নাথদেবের কাছে এই আদেশ পান যে, তাঁর পরবর্তী কোনো বংশধর আর পুরীর রাজা হতে পারবে না এবং তাঁর পুত্র নিজের নাম পরিবর্তন করে অন্য দেশে গিয়ে সেখানকার রাজা হবে। তখন গঙ্গাধর তুঙ্গের পুত্র নকুড় ‘নকুড়তুঙ্গ’ নাম ধারণ করে ১৩৪৮ সালে নিজ পত্নী, ধনরত্ন এবং কিছু সৈন্যসামন্ত-সহ পুরী পরিত্যাগ করে ভাগ্যান্বেষণে বেরিয়ে পড়েন। দীর্ঘ দশবছর ইতস্তত পরিভ্রমণের পর ১৩৫৮ সালে টিকরপাড়ায় বসতি স্থাপন করেন। পরে উৎকল ব্রাহ্মণ শ্রীপতি মহাপাত্রের সহায়তায় রাজ্য স্থাপন করে ‘রাজা ছত্রনারায়ণ দেব’ নাম গ্রহণ করে সিংহাসনে আরোহণ করেন।

রাজবাড়ির কুলদেবতা বলরামজিউর মন্দির

গবেষকদের মতে, রাজা দেবমুকুন্দ বা মুকুন্দদেবের রাজত্বকালে কালাপাহাড় পুরীর মন্দির আক্রমণ করে। সেই সময়ে মুকুন্দদেবের দুই পুত্র নকুড়দেব এবং ছকুড়দেব পুরী ত্যাগ করেন। তাঁদের সঙ্গী হন মুকুন্দদেবের প্রধান সেনাপতি শ্রীপতি মহাপাত্র। ঘুরতে ঘুরতে তাঁরা এসে উপস্থিত হন রাজনগর রাজ্যে। তখন রাজনগর রাজ্যের রাজা ছিলেন অন্ত্যজ শ্রেণির সামসর বা সামন্তসর। তিনি ছিলেন দুর্বলচিত্ত এবং অকর্মণ্য। রাজা সামন্তসরকে হত্যা করে নকুড়তুঙ্গ ফুলকুসমায় এবং ছকুড়তুঙ্গ শ্যামসুন্দরপুরের রাজা হন।

একাধারে গুরু, পুরোহিত এবং প্রধান সেনাপতি শ্রীপতি মহাপাত্রের ভূমিকায় সন্তুষ্ট হয়ে রাজা নকুড়তুঙ্গ তাঁকে প্রথমে নীলজড়া-সহ সাতটি মৌজার জায়গির দেন। পরে শ্রীপতি মহাপাত্র-কৃত পুত্রেষ্টি যজ্ঞে নিঃসন্তান রাজা পুত্রলাভে আনন্দিত হয়ে তাঁকে তাম্রপট্টের মাধ্যমে সিমলাপাল ও ভেলাইডিহা পরগনা ৮৭০ বঙ্গাব্দের দোলপূর্ণিমার দিন নিষ্কর ব্রহ্মোত্তর হিসাবে দান করেন।

রাজবংশের উত্তরাধিকারীদের কাছে গচ্ছিত উড়িয়া ভাষায় লিখিত একটি লেখনী থেকে জানা যায়, চোড়গঙ্গীয় বংশের রাজা দেবমুকুন্দের রাজত্বকালে প্রধান পুরোহিত ছিলেন শ্রীপতি মহাপাত্র। তাঁর পূর্বপুরুষদের চোড়গঙ্গীয় রাজারা জাজপুর থেকে তাঁদের রাজ্যে নিয়ে এসে পুরীর মন্দিরের পুরোহিত হিসাবে নিয়োগ করেন। এই তথ্যের সত্যতা প্রমাণিত হয় Sir John Beames-এর লেখা Tribe and caste of Orissa বইটি থেকে। সেখানে তিনি লিখেছেন, ওড়িশার গঙ্গবংশীয় রাজারা উচ্চ বৈদিক জ্ঞানসম্পন্ন কিছু ব্রাহ্মণকে জাজপুর থেকে জগন্নাথদেবের সেবার জন্য নিয়ে আসেন। নবাগত এই ব্রাহ্মণেরা জগন্নাথ-মন্দিরের ১৬ ক্রোশের মধ্যে বসবাস করতে শুরু করেন। রিসলে তাঁর হিন্দু ট্রাইব অ্যান্ড কাস্ট গ্রন্থে এই মতকে সমর্থন জানিয়েছেন।
অন্য একটি মতে, ওড়িশার কটক জেলার অন্তর্গত বীররামপুর থেকে এসে শ্রীপতি মহাপাত্র বিষ্ণুপুর রাজ্যের সামন্ত হিসাবে বর্তমান সিমলাপাল, রাইপুরের কিছু অংশ এবং তালডাংরার কিছু অংশের শাসনক্ষমতা লাভ করেছিলেন। কথিত আছে, তিনি নাকি বিষ্ণুপুররাজের প্রতিশ্রুতিমতো অশ্বপৃষ্ঠে একদিনে যে-পরিমাণ জমি প্রদক্ষিণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন তার মালিকানা পেয়েছিলেন।

তবে উৎকল ব্রাহ্মণদের ওড়িশা থেকে বাংলায় আসার এই তত্ত্বকে অনেক ঐতিহাসিক সমর্থন করেন না। তাঁদের মতে, ভারতবর্ষের রাজ্য পুনর্গঠনের আগে দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার এই অঞ্চল তৎকালীন কলিঙ্গ রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পরে রাজ্য পুনর্গঠনের সময় ওড়িশার এই বিস্তীর্ণ অঞ্চল পশ্চিমবঙ্গের অন্তর্ভুক্ত হয়। ইতিহাস থেকে জানা যায়—হর্ষবর্ধন, শশাঙ্ক এবং দেবপাল ‘পঞ্চগৌড়েশ্বর’ উপাধি ধারণ করেছিলেন। রাজতরঙ্গিনীতে পঞ্চগৌড়ের উল্লেখ আছে—সারস্বত, কান্যকুব্জ, গৌড়, মিথিলা ও উৎকল। স্বাভাবিকভাবেই একই শাসকের অধীনে থাকতে থাকতে রাজ্যগুলির মধ্যে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও কৃষ্টিগত যোগাযোগ সুদৃঢ় হয়েছিল।

এমনকী মহারাজা মানসিংহ প্রতাপাদিত্যকে পরাজিত করার পর জগন্নাথ-দর্শনে যাওয়ার পথের যে-বর্ণনা কবি ভারতচন্দ্র দিয়েছেন—“মল্লভূমি কর্ণগড় দক্ষিণে রাখিয়া।/ বঙ্গালার সীমা নেড়া দেউল দেখিয়া।।/ এড়ায় মেদিনীপুর নারায়ণ গড়ে।/ দাঁতন এড়ায়ে জলেশ্বরে ডেরা পড়ে।।” তা থেকে বোঝা যায়, সেসময়ে বর্তমান কেশপুর থানার অন্তর্গত নেড়াদেউল ছিল বাংলার সীমান্ত।

শ্রীপতি মহাপাত্রের রাজ্যস্থাপনের কথা শুনে বহু উৎকল ব্রাহ্মণ তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজ্যে এসে উপস্থিত হন বা শ্রীপতি নিজের শক্তি সংহত করার জন্য নিজেই তাঁদের এই রাজ্যে নিয়ে আসেন। এঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য ছিলেন আটটি ব্রাহ্মণ পরিবার। এঁরা হলেন কাশ্যপ মহাপাত্র, জামদগ্নি পাত্র, মৌদগল পতি, বশিষ্ঠ সৎপথী, কাত্যায়নী পণ্ডা, খুন্তিগাড়া পাইন, বাৎস্য ষণ্ণিগ্রহী এবং কাশ্যপ মহান্তী। কথিত আছে, মহাপাত্র মহান্তীদের নিজগোত্র কাশ্যপ দিয়ে নিজেদের গোষ্ঠীভুক্ত করেন। সমগোত্রে বিবাহ নিষিদ্ধ হলেও মহান্তী-মহাপাত্রদের মধ্যে বৈবাহিক সম্বন্ধ স্থাপিত হতে থাকে। এর কারণ হিসাবে ভাবা যেতে পারে—সেসময় শাসনক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন মহাপাত্র আর অর্থনৈতিক ক্ষমতা ছিল মহান্তীদের হাতে।

সিমলাপাল রাজাদের কাছারিবাড়ি

বলগোবিন্দ সিংহবাবুর রচিত একটি পদ্যের মাধ্যমে সিমলাপাল রাজবংশের পূর্ণ পরিচয় পাওয়া যায়—“শ্রীপতি, মাধব, জগন্নাথ, বাসুদেব/ খুড়া বলরাম, মোহনদাস, চিরঞ্জীব/ লক্ষণ, কৃষ্ণদাস, রাধানন্দ, বলরাম/ জগন্নাথ, চিরঞ্জীব, নটবর নাম/ মানগোবিন্দ, জগবন্ধু, মদনমোহন/ পূর্ণ সিমলাপালাধীন সপ্তদশজন/ শ্যামসুন্দরপুর রাজ্যপ্রাপ্ত পিতৃতিরোধানে/ ১৩৬১ সাল ২৩ শে আশ্বিনে।/ ১৩৬২ সালে নববর্ষ দিনে।/ জমিদারী মধ্যসত্ত্ব গত রাষ্ট্রাধীনে/ রাজেন্দ্রসংখ্যাতে শ্যামসুন্দর অষ্টাদশ/ বংশ পরিচয় কিন্তু, হইবে ষোড়শ।।”

শ্রীপতি মহাপাত্র তাঁর অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে শিলাবতী নদীর তীরে রাজধানী স্থাপন করেন। উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বের কোনো কোনো জায়গায় জলাশয় খনন করে রাজ্যকে সুরক্ষিত করেন। রাজধানীর নাম হয় ‘গড়সিমলাপাল’। শতপথী, পাঠক, পাইন, মহান্তী, পতি, ষণ্ণিগ্রহী ইত্যাদি স্বজাতির লোকজনদের তিনি নদীতীরবর্তী উর্বর এলাকাগুলিতে বসতিস্থাপন করান। অস্ত্র তৈরির জন্য বিষ্ণুপুর থেকে আনা হয় কর্মকারদের। যুদ্ধের প্রয়োজনে আনা হয় ছত্রীদের। চাষাবাদের প্রয়োজনে খনন করা হয় দিঘি।

শ্রীপতির পর রাজা হন মাধব, মাধবের পর তাঁর পুত্র জগন্নাথ এবং জগন্নাথের পর সিংহাসনে আরোহণ করেন বাসুদেব। বাসুদেব অপুত্রক ছিলেন। তাই তাঁর মৃত্যুর পর জগন্নাথের ভাই বলরাম রাজা হন। তিনি ‘রাজা খুড়া বলরাম’ নামে পরিচিত। তাঁর তিন পুত্র মোহনদাস, দাশরথি ও নবজীবন। মোহনদাস রাজা হন। তিনি ছিলেন মল্লরাজ বীর হাম্বীরের সমসাময়িক (১৫৯১—১৬১৬)। বীর হাম্বীর তাঁর অষ্টমবর্ষীয়া কন্যা শ্যামাকুমারীর সঙ্গে তুঙ্গবংশীয় রাজা শ্যামসুন্দর তুঙ্গের বিবাহ দেন। সিমলাপাল এলাকাতেও প্রভাব বাড়তে থাকে বিষ্ণুপুর রাজপরিবারের আচরিত বৈষ্ণবধর্মের। মোহনদাসের মধ্যম ভ্রাতার সঙ্গে বিষ্ণুপুর রাজপরিবারের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্রেই তিনি সিমলাপাল রাজবাড়ির মধ্যে স্থাপন করেন কুলদেবতা কৃষ্ণ-বলরামের মন্দির। কনিষ্ঠ ভ্রাতা নবজীবন রাইপুর রাজবাটির গোলযোগ নিরসনে যান এবং সেখানেই স্থায়িভাবে থেকে যান। বংশধরগণ ‘প্রহরাজ’ নামে পরিচিত।
মোহনদাস সর্বপ্রথম ‘সিংহ চৌধুরী’ উপাধি ধারণ করেন। এর পর থেকেই প্রথা হয় রাজার উপাধি হবে সিংহ চৌধুরী। পরের ভাই ‘সিংহ হিকিম’ ও তার পরের ভাই ‘সিংহ বড়ঠাকুর’। অন্য ভাইরা ‘সিংহবাবু’ পদবি পান। পরবর্তিকালে সমস্ত মহাপাত্র পদবিধারীই ‘সিংহ মহাপাত্র’ উপাধি গ্রহণ করেন।
মোহনদাসের পুত্র চিরঞ্জীবের দশ পুত্র। রাজা চিরঞ্জীবের জীবদ্দশাতেই পুত্রদের মধ্যে কলহ বাধে। অতিষ্ঠ প্রজাদের মধ্যে ‘দ্ববিংশ কাশ্যপ’ রাজাকে সাময়িকভাবে উৎখাত করেন। শেষপর্যন্ত ১৬১৭ সালে বা ১০২৩ বঙ্গাব্দে সিমলাপাল রাজত্ব তিন ভাগে বিভক্ত হয়। বড়রানির ছেলে বিক্রম বয়সে ছোট ছিলেন বলে পান চার আনা, তাঁর ভাগের অংশ পড়ে বিক্রমপুরে। লক্ষণ থেকে যান গড়সিমলাপালে। তাঁর অংশের পরিমাণ দাঁড়ায় ছয় আনা। অপর ভ্রাতা লস্কর নতুন রাজ্যপাট পান তরুপুরে, পরে তিনি তাঁর রাজধানী স্থানান্তরিত করেন ভেলাইডিহায়। অপুত্রক বিক্রমের মৃত্যুর পর তাঁর অংশ সিমলাপালের সঙ্গে জুড়ে যায়। এর পর থেকে সিমলাপাল রাজবংশ দুটি ভিন্ন খাতে বইতে থাকে। রাজা দ্বিতীয় চিরঞ্জীবের সময় সিমলাপাল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ৯৯৩ নং তৌজিভুক্ত হয় এবং বার্ষিক ৮২২ টাকা খাজনা ধার্য হয়। ভেলাইডিহা ৯৯০ নং তৌজিভুক্ত হয়। এই সময়ে ভেলাইডিহার শাসনভার ছিল রানি প্রেমময়ীর হাতে। তিনি ছিলেন রাজা কৃষ্ণচন্দ্রের সহধর্মিণী। নিঃসন্তান অবস্থায় রাজা মারা গেলে রানি রাজ্যের শাসনভার নিজের হাতে তুলে নেন। মদনমোহন সিংহ চৌধুরীর পুত্র শ্যামসুন্দর ১৩৬১ বঙ্গাব্দের ২৩ আশ্বিন রাজা হন এবং জমিদারি প্রথা রদ হয় ১৩৬২-র নববর্ষে। সেই সময়ে ভেলাইডিহার রাজা ছিলেন প্রদ্যোৎকুমার সিংহ চৌধুরী।

রাজত্বস্থাপনের প্রথম দিন থেকেই ধর্মীয় চেতনা লক্ষ্য করা যায় সিমলাপাল রাজপরিবারের মধ্যে। জগন্নাথের সেবাইত হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই বিষ্ণুর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন এই পরিবার। স্থানে স্থানে বিষ্ণুমন্দির স্থাপন এই তথ্যের সত্যতা প্রমাণ করে। রাজা মোহনদাসের মধ্যম ভ্রাতা দাশরথি বসতবাটির মধ্যে মাকড়া পাথরের দক্ষিণমুখী আটচালাযুক্ত বলরাম জীউর মন্দির স্থাপন করেন। মন্দিরটির উচ্চতা ৩৫ ফুট, দৈর্ঘ্য-প্রস্থে ২১ ফুট ৯ ইঞ্চি।

মন্দিরনির্মাণে গ্রিসীয় ধরনের থামযুক্ত সমতল ছাদের রীতি গ্রহণ করা হয়েছে। মন্দিরগাত্রে প্রোথিত রয়েছে বেশ কয়েকটি হিন্দু এবং জৈন দেবী অম্বিকা ও তীর্থঙ্করের মূর্তি। জৈন মূর্তিগুলি পরবর্তিকালে মন্দিরগাত্রে সংযোজন করা হয়েছে, যা রাজাদের উদার ধর্মচিন্তা এবং পুরাতত্ত্বের প্রতি টান প্রমাণ করে।

ভেলাইডিহার রাজপরিবারের কুলদেবতা হলেন রাধাগোবিন্দ। রাজা লস্কর সিংহ চৌধুরী এই মন্দির নির্মাণ করেন। পরবর্তিকালে লস্কর সিংহ চৌধুরীর প্রতিষ্ঠিত মন্দির শিলাবতী নদীর গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ায় তা আবার নতুন করে নির্মাণ করা হয়।

বিক্রমপুরের রাজা অপুত্রক অবস্থায় মারা যাওয়ার ফলে রাজ্য-পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন রানি তারাসুন্দরী। কারো কারো মতে, তারামণি বা তারা মন্দির প্রতিষ্ঠা করতে। তবে তাঁর অকালমৃত্যুর পর তাঁর স্বপ্ন পূরণ করেন রানি তারাসুন্দরী। তিনি স্বামীর স্বপ্নপূরণে রাধাদামোদর মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। প্রসঙ্গত, তারাসুন্দরীর প্রতিষ্ঠিত মন্দিরটি সিমলাপাল থানা এলাকার মহিলা দ্বারা প্রতিষ্ঠিত একমাত্র মন্দির। মন্দিরটি নির্মিত হয়েছিল কৃষ্ণপুর মৌজার দাশ পরিবার কর্তৃক—দান করা ৮২ শতক জমির ওপর। মন্দিরটি নির্মাণ করেছিলেন বিষ্ণুপুর থেকে আগত শিল্পীরা। মন্দিরগাত্রের পোড়ামাটির অলংকরণ এই তথ্যের সত্যতা প্রমাণ করে। মন্দিরটির নির্মাণকাল আনুমানিক ১০৩০—৪০ বঙ্গাব্দ। রানি পুজোর জন্য একটি অষ্টধাতুর রাধাকৃষ্ণ-মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৫৮ সালে মূর্তিটি চুরি হয়ে যায়। পুজোর জন্য তিনি পুরোহিত নিয়োগ করে ১০০ বিঘা দেবোত্তর সম্পত্তি দান করেছিলেন।
দানধ্যানেও মনোযোগী ছিলেন সিমলাপাল রাজপরিবার। রাজা চিরঞ্জীব সিংহ চৌধুরীর চতুর্থ ভ্রাতা বীর সিংহের সহধর্মিণী রূপমঞ্জরীর কথামতো রাজা চিরঞ্জীব সিংহ চৌধুরী রানির পিতৃকুলকে বিনা খাজনায় ৫২ বিঘা জমি দান করেন, যা ‘সতীর দান’ নামে খ্যাত। বীর সিংহের মৃত্যুর পর সহমৃতা হন রূপমঞ্জরী।

সিমলাপাল হাইস্কুল, লাইব্রেরি এবং আশ্রম নির্মাণের জন্য রাজা মদনমোহন সিংহ চৌধুরী ২২ বিঘা করে জমি দান করেন। খরার মরশুমে চাষের নিমিত্ত একাধিক বাঁধ খনন করান রাজারা।

বহুদিন ধরে বসবাস করলেও আজও বাঁকুড়া, পুরুলিয়া ও মেদিনীপুরের উৎকল ব্রাহ্মণদের মধ্যে নিজস্ব সংস্কৃতি বাহিত হয়ে চলেছে। যেমন আজও বিবাহের আসরে বর ও কনের পিতারা ওড়িয়া ভাষায় বিবাহের আজ্ঞা দেন। শ্রাদ্ধের আগের দিন ঘাটে স্নান করার পর অগ্নিকর্তা বাড়িতে এসে একটা চাটাইয়ে ধান মাপ করেন এই বলে—“শুভ পকায়ে অশুভ মাপুচি/ অশুভ পকায়ে শুভ মাপুচি।” আজও গ্রামে গ্রামে সাড়ম্বরে পালিত হয় জ্যৈষ্ঠসন্তান পূজা বা পৌড়াষ্টমী। বাড়ির মহিলারা নির্মাণ করেন কাঁখরা, গড়গড়া ইত্যাদি পিঠে। 

তথ্যসূত্র

১ Banerjee, Amiya Kumar, West Bengal District Gazetteers, State Editor West Bengal District Gazetteers, Calcutta, 1968, p. 74
২ রায়, ভারতচন্দ্র, মানসিংহ, কবিতা রত্নাকর, কলিকাতা, ১২৬১, পৃঃ ১০
৩ সিমলাপাল রাজপরিবারে সূত্রে প্রাপ্ত

সহায়ক গ্রন্থাদি
১ O’Malley, L.S.S., Bengal District Gazetteers : Bankura, The Bengal Secretariat Book Depot, Calcutta, 1908
২ Risley, H. H., The Tribes and Castes of Bengal, The Bengal Secretariat Press, Calcutta, 1892, vol. 1
৩ চৌধুরী, রথীন্দ্রমোহন, বাঁকুড়া জনের ইতিহাস-সংস্কৃতি, পশ্চিম রাঢ় ইতিহাস ও সংস্কৃতি চর্চাকেন্দ্র, বাঁকুড়া, ২০০০
৪ পশ্চিমবঙ্গ, বাঁকুড়া জেলা সংখ্যা, ২০০২
৫ মাহাতো, বাবুলাল এবং দাস বিশ্বাস, প্রকাশ (সম্পাদনা) কাঁসাই-কুমারী, খাতড়া মহকুমা প্রশাসন, বাঁকুড়া, ২০১২
৬ ‘কৃষ্টিকিরণ’, ৯ম বর্ষ, ৯ম সংখ্যা
৭ সিংহ চৌধুরী, প্রদ্যোৎ কুমার, ভেলাইডিহা রাজপরিবার ইতিহাসের আলো-ছায়ায়, লেখক (প্রকাশক), ভেলাইডিহা, বাঁকুড়া, ২০২০

ব্যক্তিঋণ
চিরঞ্জীব সিংহ চৌধুরী (সিমলাপাল রাজপরিবার)
প্রদ্যোৎ কুমার সিংহ চৌধুরী (ভেলাইডিহা রাজপরিবার)