আমরা যারা কলকাতার বাসিন্দা এবং শ্রীশ্রীঠাকুর, শ্রীশ্রীমা ও স্বামীজীর অনুরাগী, তারা সাধারণত বেলুড় মঠে ঠাকুরের জন্মতিথি উৎসবে যোগদান করে আনন্দ উপভোগ করি। জন্মতিথির পরবর্তী রবিবারে সাধারণ উৎসবেও মঠে বিশাল জনসমাবেশ হয়। লক্ষাধিক মানুষ উপস্থিত হয়ে শ্রীশ্রীঠাকুরকে হৃদয়ের শ্রদ্ধা জানায়। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, বক্তৃতা ইত্যাদি উপভোগ করে প্রসাদ পায়। যতই জনসমাগম হোক, প্রসাদ পেতে কারো কোনো অসুবিধা হয় না।
এবার ইচ্ছা হলো কলকাতার বাইরে ঠাকুরের জন্মোৎসব কেমন হয় তা দেখার। প্রথমে টাকি রামকৃষ্ণ মিশনে যাওয়া হলো। নবনির্মিত অতিথিভবনে থাকার সুবন্দোবস্ত হয়েছিল। নতুন বাড়িতে সবকিছুই ঝকঝকে তকতকে ও থাকার ব্যবস্থা স্বাচ্ছন্দ্যপূর্ণ।
প্রাতে ঠাকুরের মঙ্গলারতির পর বিশেষ পূজার সূচনা হয়। চণ্ডীপাঠ ও পূজার সমাপনে হোম হয় এবং সমবেত ভক্তগণ পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করে। স্থানীয় মহিলা ভক্তদের সংখ্যাই বেশি। এরপর প্রসাদ বিতরণের ব্যবস্থা। কয়েকশো মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে সুশৃঙ্খলভাবে প্রসাদ গ্রহণ করে।
পরের দিন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত অঞ্চল হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের স্যান্ডেলেরবিল রামকৃষ্ণ সেবাকেন্দ্রে যাওয়া হলো। নিকটবর্তী হাসনাবাদ হয়ে যেতে হয়। হাসনাবাদে এসে এক চমক! পেট্রল পােম্পর সামনে ব্রোঞ্জমূর্তিতে দণ্ডায়মান নির্ভীক সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ। ঐ মূর্তি এলাকার সৌন্দর্য বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। মূর্তিটি অল্প কিছুদিন আগেই উদ্বোধন করেছেন রামকৃষ্ণ মঠ ও রামকৃষ্ণ মিশনের সাধারণ সম্পাদক পূজ্যপাদ স্বামী সুবীরানন্দজী। প্রায় ৩০ কিমি অটোতে চেপে পৌঁছালাম স্যান্ডেলেরবিল রামকৃষ্ণ মিশন সেবাশ্রমে। কলকাতা থেকে সরাসরি গাড়িতে কিংবা ট্রেনে হাসনাবাদে নেমে এখানে আসা যায়। গ্রামের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত আশ্রমটির নির্মাণকাজ চলছে দ্রুতগতিতে। পুরানো কাঁচা চালের পরিবর্তে নবনির্মিত মন্দিরটি গড়ে তোলা হচ্ছে স্থানীয় মানুষের সহায়তায়। মাত্র দুজন মহারাজ এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। নির্মাণকার্যে সহায়তার জন্য আবেদন রাখা হয়েছে।
অন্যান্য কেন্দ্রের মতো এখানেও আগের দিন যথোচিত মর্যাদার সঙ্গে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের জন্মতিথি পালিত হয়েছে। বেশ কিছু ভক্ত প্রসাদ গ্রহণ করেছে।
প্রসঙ্গত জানিয়ে রাখি, এই আশ্রমের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৯৮১ সালে পূজ্যপাদ স্বামী দিব্যানন্দজী মহারাজের হাত ধরে। তার আগে এবং পরে তিনি বহুবার এখানে এসে ত্রাণকার্য করেছেন। এখনো আসেন, বছরে অন্তত একবার—ফেব্রুয়ারি মাসে প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে। সেই সময় এখানে প্রায় ৮,০০০ মানুষের সমাগম হয়। বিশেষ পূজা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, প্রসাদ বিতরণ প্রভৃতি অনুষ্ঠিত হয় সাড়ম্বরে। এছাড়া শ্রীশ্রীমায়ের তিথিপূজা বিশেষভাবে পালিত হয়। বর্তমানে বেলুড় মঠ থেকে হিঙ্গলগঞ্জ ব্লকের মানুষদের সেবায় এই আশ্রমের মাধ্যমে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। বিগত করোনা মহামারীর সময় এই আশ্রম প্রবল প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও দুর্গত মানুষের সেবায় আত্মনিয়োগ করেছিল। বর্তমানে একটি প্রাইমারি স্কুল ও বহু কোচিং ক্লাস এবং বিভিন্ন চিকিৎসাশিবির নিয়মিত পরিচালিত হচ্ছে। উপকৃত হচ্ছে বহু দুঃস্থ মানুষ। পূজা উপলক্ষে বস্ত্রদানও করা হয়।
ভাবতে অবাক লাগে, দুজন সন্ন্যাসী এবং কয়েকজন স্থানীয় ভক্তের অমানুষিক পরিশ্রমে এই আশ্রম সুন্দরবনের এমন প্রত্যন্ত অঞ্চলে জ্বালিয়ে রেখেছেন প্রকৃত মানবোন্নয়নের উজ্জ্বল দীপশিখা। শুধুমাত্র সহৃদয় মানুষের আর্থিক অনুদানের ওপর নির্ভর করে তাঁরা এত বড় এক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। তবে ঐ সন্ন্যাসিগণ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন, এবং আমরাও করি—শ্রীশ্রীঠাকুর, শ্রীশ্রীমা ও স্বামীজীর আশীর্বাদেই এটা সম্ভব হচ্ছে। আমার এক অপূর্ব অভিজ্ঞতা হলো এই আশ্রমে এসে।
অজয় ভট্টাচার্য
বিধাননগর সিটি, কলকাতা-৯১