ছোটবেলায় আমি থাকতাম হাওড়া জেলার বলুহাটি গ্রামে। আমাদের গ্রামের বাড়ি থেকে বেলুড় মঠের দূরত্ব খুব বেশি হলে ছয়/সাত কিলোমিটার। আমার বাবা স্বর্গত সত্যচরণ চক্রবর্তী এবং বেশ কয়েকজন মিলে ৭০ দশকের শেষের দিকে এখানে একটি আশ্রম গড়ে তুলেছিলেন। তাই ছোটবেলা থেকে শ্রীরামকৃষ্ণ-ভাবাদর্শে আমি মানুষ হয়েছি। ৯০ দশকের শেষের দিকেও আমাদের গ্রামে শুধুমাত্র এই একটি আশ্রমই ছিল।

আশ্রমে ঠাকুরের জন্মদিন খুব বড় করে পালন করা হতো। সকালবেলা প্রভাতফেরি ও দুপুরে ভোগবিতরণ দিয়েই শেষ হতো না; প্রথম দিকে দেখেছিলাম সন্ধেবেলা মহারাজরা আসতেন ও রাত্রিবেলা গীতিনাট্য হতো। পরের দিকে সে-গীতিনাট্য আশ্রমের সদস্যদের দ্বারা পরিচালিত যাত্রায় পরিণত হলো। আশ্রমের একটা কোণে ঠাকুর, মা ও স্বামীজীর বই নিয়ে স্টল করা হতো—প্রধানত উদ্বোধন প্রকাশনার বই। এই বইয়ের প্রতি আমাদের একটা দারুণ আগ্রহ থাকত, বিশেষত আমার ও আমার মতো বেশ কিছু পড়ুয়া বন্ধু-বান্ধবদের। তার কারণ, বইগুলির মলাট অত্যন্ত সুন্দর দেখতে এবং রঙিন। ঠাকুর, মা, স্বামীজীর জীবনের ওপরে বা তাঁদের মুখে বলা গল্প নিয়ে বেশ বড় বড় অক্ষরে ছাপা বইগুলি পড়তে ভাল লাগত। কোনো কোনো সময় কমিক্স বইও থাকত। বইগুলো থরে থরে সাজানো থাকত একটা বড় টেবিলের ওপরে। উদ্বোধন পত্রিকা ঐ টেবিলের একটি পাশে রাখা থাকত আমরা হাতে তুলে নিয়ে দেখেও রেখে দিতাম, তার কারণ—সেটি পড়তে প্রথমে ভয় পেতাম। আসলে সেই বইগুলির মধ্যে ছবি কম থাকত, তাই ভাবতাম এটা বোধহয় বড়দের বই। আজ থেকে প্রায় কুড়ি/বাইশ বছর আগে বিবেকানন্দ যুবসম্মেলনে প্রণবেশ চক্রবর্তী বিভিন্ন সময়ে বক্তৃতা দিতে আসতেন। সেই সম্মেলনগুলিতেও উদ্বোধন পত্রিকার অবাধ বিচরণ ছিল এবং উদ্বোধন থেকে প্রকাশিত নানান বই আমাদের কাছে একটা আকর্ষণের বিষয় ছিল।

মনে আছে, আশ্রমেরই একজন সদস্য উদ্বোধন অফিস থেকে প্রতি মাসে সবার বই নিয়ে আসতেন, তারপর প্রত্যেক বাড়িতে গিয়ে দিয়েও আসতেন। আমার বাবাও প্রতি মাসে বই পেতেন। বাবা বছরের সব কয়টা বই একত্রিত করে বাঁধাই করে রেখে দিতেন। যখন প্রয়োজন হতো মাঝে মাঝে সেগুলো আবার উলটে-পালটে দেখতেন। এই বইগুলো দিয়েই প্রথম আমার উদ্বোধন পত্রিকা পড়া শুরু। বিভিন্ন সময়ে সেই পুরানো বইগুলো থেকে কিছু কিছু লেখা আমি পড়েছিলাম। কয়েকটি লেখা অবশ্যই পড়তে দারুণ ভাল লাগত, যেমন সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায় এবং স্বামী লোকেশ্বরানন্দজীর লেখা। এইভাবে উদ্বোধন পত্রিকার সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা।

পরবর্তিকালে এই ঘনিষ্ঠতা আরো গভীরতর হতে থাকে। রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন পড়তাম, তখন উদ্বোধন কার্যালয় ও মায়ের বাড়ী আমাদের কাছে খুব আকর্ষণের বিষয় ছিল। আমরা তিন বন্ধু মিলে কলেজ-জীবনে একটা পত্রিকা প্রকাশ করেছিলাম এবং তার জন্য বেশ কিছু বিজ্ঞাপন সংগ্রহ করে ছ-সাতশো টাকার মতো বাঁচাতে পেরেছিলাম। সেই টাকাটি মায়ের বাড়ীতে প্রণামী হিসাবে দান করি। অমল মহারাজের সাথে তখন আমাদের পরিচয় হয়। আমরা আস্তে আস্তে উদ্বোধন কার্যালয়ে যাতায়াত শুরু করি। সেই সময় স্বামীজীর বই পড়তে শুরু করেছি, বিশেষ করে স্বামীজীর কবিতা। কোনো একটি বইতে স্বামীজীর কবিতার মাঝের কয়েকটি লাইন পড়েছিলাম। কিন্তু সেটা কোন কবিতায় পাওয়া যাবে জানতাম না। সেই সময় উদ্বোধন পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজী। আমি ও আমার বন্ধু ঠিক করলাম সরাসরি ওনাকে জিজ্ঞেস করব। যেমন ভাবা তেমন কাজ।

একদিন উদ্বোধনে এসে দোতলায় উঠতে যাচ্ছি, দেখলাম পাশ দিয়ে হন হন করে মহারাজ বেরিয়ে যাচ্ছেন। আমরা তাঁর পিছন পিছন ছুটলাম। নিচের মেন গেটের সামনে মহারাজ দাঁড়ালেন, আমাদের সমস্যাটা শুনলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ইউ টার্ন নিয়ে আমাদের সঙ্গে করে বই বিক্রয়কেন্দ্রে ঢুকে ডানদিকে একদম শেষ আলমারির তৃতীয় তাকের ধারে একটি বই বের করে আমাদের সামনে ধরলেন। তারপর চটপট করে সেই কবিতাটি বের করে আমাদের বললেন : “পড় তোমরা।” মহারাজের দিকে তাকাতেই দেখি, তিনি হালকা হেসে ধীরে ধীরে বেরিয়ে চলে গেলেন। এই স্মৃতি ভোলার নয়।

পরবর্তিকালে কাজের সূত্রে আমি হাড়োয়া গোপালপুর এলাকায় একটি রামকৃষ্ণ আশ্রমে বাংলা ও ইংরেজি মাধ্যম দুটি স্কুলে বেশ কিছুদিন প্রধানশি‌ক্ষক হিসাবে কাজ করেছিলাম। স্বামী ব্রহ্মানন্দজীর শিকড়া-কুলীন গ্রাম ওখান থেকে খুব কাছে, তাই সেখানে মাঝে মাঝে যেতাম। এই আশ্রমে এসে উদ্বোধন পত্রিকা পড়ার নেশাটা আরেকটু বেড়ে গেল; তার কারণ সেখানে পুরানো বহু সংখ্যা এবং নতুন সংখ্যা থাকত। বারে বারে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে সেগুলো পড়তাম। শুধুমাত্র ঠাকুর, মা, স্বামীজীর কথাই নয়, পত্রিকার বিশেষ আকর্ষণের মধ্যে থাকত বিজ্ঞান ও ভ্রমণ বিষয়ক প্রবন্ধ। আর ঐ রামকৃষ্ণ আশ্রমে দেখতাম, সকলে অপে‌ক্ষা করে থাকত কবে আশ্রমের উৎসবের খবরটি পত্রিকায় বেরবে।

বাবা মারা যাওয়ার পরে আমি নিজে উদ্বোধন-এর গ্রাহক হই। যখন পত্রিকা আমাদের ঘরে আসে, সন্ধেবেলা স্কুল থেকে বাড়ি ঢোকার সাথে সাথে আমার সাত বছরের ছেলে চিৎকার করে এসে জানিয়ে দেয় : “বাবা, তোমার উদ্বোধন এসে গেছে।” আমি তখন তাকে জিজ্ঞাসা করি—তুমি পত্রিকাটা দেখেছ? সে দৌড়াতে দৌড়াতে শুধুমাত্র বলে : “হ্যাঁ বাবা, অনেকগুলো লেখা আছে আর ভিতরে ঠাকুরের ছবি আছে।” শুনে ভাবি, আমার অবর্তমানে নিশ্চয়ই আমার ছেলেও এই পত্রিকার গ্রাহক হবে।

এত বছর ধরে আমি উদ্বোধন পত্রিকা পড়ছি কিন্তু একটা জিনিস আমার কাছে খুব আশ্চর্য মনে হয় যে, কোনো সময় কোনো নির্দিষ্ট দুটি প্রবন্ধকে একইরকম মনে হয়নি। প্রত্যেকটি প্রবন্ধ তাদের স্বকীয়তা নিয়ে থেকেছে, যেটা খুব গুরুত্বপূর্ণ। কোনো কোনো সময় গানের ওপর তথ্যবহুল প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে, যেগুলো সত্যিই সংগ্রহে রাখার মতো।

উদ্বোধন পত্রিকার সঙ্গে এই সখ্য খুব ছোটবেলা থেকে গড়ে উঠেছিল বলে এখনো প্রতি মাসে অপেক্ষা করি কখন আমার ছেলে আমাকে শোনাবে পত্রিকার আগমনবার্তা। এটা ঠিকই যে, শুধুমাত্র আধ্যাত্মিক পত্রিকার মধ্যে নিজেকে গণ্ডিবদ্ধ না করে সামাজিক সমস্ত বিষয়কে তুলে ধরার প্রচেষ্টা করে যাওয়াটা এই পত্রিকার দীর্ঘদিন টিকে থাকার অন্যতম চাবিকাঠি।

একটা পত্রিকার ১২৫ বছর পার হওয়া এবং উত্তরোত্তর গ্রাহকসংখ্যা বৃদ্ধি প্রমাণ করে দিচ্ছে, এই পত্রিকা কীভাবে পরিশীলিত ও পরিবর্তিত হচ্ছে আধ্যাত্মিকতার মূল ধাঁচকে অক্ষুণ্ণ রেখে। উদ্বোধন পত্রিকার অন্যতম একটি আকর্ষণীয় বিষয় হলো তার প্রচ্ছদ। পত্রিকার প্রচ্ছদ কত গুরুত্বপূর্ণ তা শুধুমাত্র এই পত্রিকাকে দেখলেই আমরা বুঝতে পারব। তবে সর্বাগ্রে যেটা বলার তা হলো—পত্রিকায় লেখার মান এখনো সেই আগের মতোই উচ্চাঙ্গের। তথ্যবহুল বিশ্লেষণাত্মক লেখা বরাবরই আমাদের সমৃদ্ধ করে। এখনো যে সেই সমৃদ্ধশীলতাকে হাতিয়ার করে উদ্বোধন এগিয়ে চলেছে, আমাদের কাছে এটা বড় আনন্দের।

অভিজিৎ চক্রবর্তী
বালি, হাওড়া ৭১১২০১