শ্রীরামকৃষ্ণের পূত চরিত্র ভারতবর্ষের সনাতন আত্মার অভিব্যক্তিতে শান্ত সমাহিত। তাঁহার ভালবাসার কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না। স্বামী বিবেকানন্দ বলিতেন, তাঁহার আবির্ভাবে জগতে এক আধ্যাত্মিক ভাবতরঙ্গের সূচনা হইয়াছে। অনাদিকাল হইতে প্রবাহিত অধ্যাত্ম-স্রোতস্বিনীর ধারাকে গতিময় রাখিবার জন্যই শ্রীরামকৃষ্ণের আবির্ভাব। স্বামীজীর মতে, তিনি ছিলেন ‘the latest and the most perfect (সবচেয়ে আধুনিক এবং সবচেয়ে পরিপূর্ণ)—জ্ঞান, প্রেম, বৈরাগ্য, লোকহিতচিকীর্ষা ও উদারতার এক জমাট-বাঁধা প্রতিমূর্তি। অপরদিকে বিবেকানন্দ ছিলেন স্বাধীনতা, সাম্য ও মানবতার আধুনিক ব্যঞ্জনায় গড়া এক প্রতিমা, যেখানে দ্যোতিত হয় শক্তি ও মানবতার অভূতপূর্ব রাজকীয় বিচ্ছুরণ। এই দুই মহামানবের নিবিড় সাহচর্য বস্তুত দেবত্ব ও মানবত্বের এক সন্নিবদ্ধ মিলনক্ষেত্র। প্রকৃত দেবত্ব হইল মানবত্বের ফলশ্রুতি এবং প্রকৃত মানবত্ব হইল দেবত্বের অভিপ্রকাশ। চিন্তা বা ভাব যখন বাস্তবায়নের জন্য উন্মুখ হয়, অরূপ ভাব যখন রূপ পরিগ্রহ করিয়া ক্রিয়াশীল হইতে ব্যগ্র হয়, তখনি এইপ্রকার দৈব সংযোগে জাগরিত হয় দুর্মর শক্তি। সেই শক্তির প্রয়োজন মহাযুগপরিবর্তনের নিমিত্ত। শ্রীরামকৃষ্ণ-সত্ত্বধারা ও বিবেকানন্দ-বীর্যতরঙ্গের সহগমনে উদ্বোধন-মহাশক্তির জাগরণ হইয়াছে। সেকারণে উদ্বোধন কোনো সাধারণ কালি-কলমের রূপ নহে। “ভগবান্ শ্রীরামকৃষ্ণ-প্রবোধিত সত্ত্ব বা ব্রহ্মশক্তি বীরাগ্রণি শ্রীবিবেকানন্দ-হৃদয়নিহিত রজঃ বা ক্ষত্রশক্তির সহিত মিলিত হইয়া পরকল্যাণের নিমিত্ত ইহাকে [উদ্বোধন-কে] জাগরিত করিয়াছে।”— লিখিয়াছেন সারদানন্দ মহারাজ। সত্য, জ্ঞান, প্রেম ও করুণার ব্রাহ্মণ্য স্নিগ্ধতা যেন মানবতা ও অনুপ্রেরণার ক্ষাত্রতেজের সহিত এক মহাশক্তিরূপে আত্মপ্রকাশ করিল। এই উদ্বোধিত মহাশক্তি উদ্বোধন-রূপে বিগত ১২৪ বৎসর ধরিয়া মানবচেতনার ঊর্ধ্বায়নের লক্ষ্য লইয়া কাজ করিয়া চলিয়াছে। উদ্বোধন এক মহাচেতনা, তাহার জন্তুণ হইয়াছে, তাহার স্পর্শে শত-সহস্রের জাগরণ হইবে। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের প্রাণদ বাণী-শক্তিকে ঘরে ঘরে বহন করিবার, তাঁহাদের অনন্ত মানবপ্রেমকে ক্রিয়াশীল রাখিবার আধার হইয়া উঠিয়াছে। উদ্বোধন-এর কৃতার্থতা এই যে, ইহা সুবিপুল রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের ভাব ধারণের অধিকার লাভ করিয়াছে।

মানবজীবনের উৎকর্ষসাধনই উদ্বোধন-এর পরম লক্ষ্য। উদ্বোধনকে কেন্দ্র করিয়া বিবেকানন্দের যে গগনচুম্বী স্বপ্ন, তাহাতে পৌঁছানোর সেতুনির্মাণ করিয়াছিলেন স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দজী, যিনি স্বামীজীর উদ্বোধন-এর রথচক্র নিজশরীরের উপর দিয়া বাধাহীনভাবে চলিয়া যাক—এ-প্রতিজ্ঞায় অটুট ছিলেন বজ্রবাঁটুলের দৃঢ়তাসহায়ে। শুরুর দিনে তাঁহার প্রবল উদ্যম, নিরলস পরিশ্রম ও সশ্রদ্ধ আজ্ঞাবহতা এক পরাকাষ্ঠা রচনা করিয়াছে। কর্মপরিচালনা ও সেবাদানের সহাবস্থানে তিনি নূতন দিগন্ত নির্মাণ করিলেন। পত্রিকার দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম সংখ্যায় তিনি উদ্বোধন-এর উদ্দেশ্য খুব সহজ ভাষায় লিখিয়াছিলেন। উল্লেখ করিয়াছিলেন তিনটি মূল বিষয়ের—ক) “উদ্বোধনের উদ্দেশ্য কিছু নিম্নশ্রেণীর নহে; আবশ্যকীয় প্রসুপ্ত গুণাবলিকে জাগ্রত করিয়া দিবার চেষ্টা করাই উদ্বোধনের কার্য্য”; খ) “প্রয়োজনীয় যে সকল গুণাবলি স্বদেশে নাই তাহার আনয়ন করিতেই উদ্বোধনের আয়াস” এবং গ) “নিঃস্বার্থভাবে পরহিত-সাধনাই ইহার জীবনোদ্দেশ্য।”
সর্বতোমুখী কল্যাণই যেহেতু উদ্বোধন-এর উদ্দেশ্য, সেহেতু মানুষের অন্তর্জীবনের বিকাশসহায়ক অধ্যাত্মতত্ত্ব ও ধর্ম-দর্শনের পাশাপাশি মানবের বহির্জীবনের উন্নতি-বিধায়ক সমাজনীতি, দর্শন, বিজ্ঞান, কৃষি, শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি প্রভৃতিরও বহুল চর্চার পরিসর ইহার জন্মলগ্ন হইতেই সূচিত হইয়াছে। সেইসঙ্গে ইহাও স্মরণে রাখিতে হইবে যে, ঐহিক সমৃদ্ধির জন্য ভারতীয় ভাবরাশির সহিত পাশ্চাত্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের মেলবন্ধন প্রয়োজন। প্রাচ্য ভাবধারার সহিত পাশ্চাত্য প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের শক্তিপ্রদ সম্মিলনের প্রয়োজনীয়তার কথা স্বামী বিবেকানন্দ সুস্পষ্টভাবে বলিয়াছেন। তাঁহার ব্যক্তিত্বে আমরা প্রতীচ্যের আত্মবল ও প্রাচ্যের আত্মানুসন্ধানের এক সুষম অভিপ্রকাশ দেখি। কারণ, শুধু পুঁথিগতভাবে নহে, প্রায়োগিক প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতাতেও তিনি এই দুই সভ্যতার উৎকর্ষ ও সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সম্যক ওয়াকিবহাল ছিলেন। দুই ঐতিহ্যকে তিনি নিজের মধ্যে সমন্বিত করিয়া আধুনিক যুগের নব সভ্যতার কাছে এক আদর্শ রাখিয়া গিয়াছেন—যেখানে সাধুতা হইবে পৌরুষবিশিষ্ট, আবার পৌরুষে থাকিবে সাধুতার পরিচয়। বিবেকানন্দের উদ্বোধন এই সমন্বয়সাধনের উদ্দেশ্যে কাজ করিয়া চলিয়াছে।
একদিন ঋষিকণ্ঠে ধ্বনিত হইয়াছিল—“আনো ভদ্রাঃ ক্রতবো যন্ত্র বিশ্বতঃ” (বিশ্বের সর্বদিক হইতে শুভ চিন্তা আমাদের দিকে প্রবাহিত হউক)। স্বামীজীও পাশ্চাত্য সভ্যতা-প্রবাহকে আহ্বান করিলেন ভারতের বুকে। উদ্বোধন-এর প্রস্তাবনায় এই মন্ত্রেরই প্রতিধ্বনি শুনিতে পাই। স্বামীজী লিখিয়াছেন: “আসুক চারিদিক্ হইতে রশ্মিধারা, আসুক তীব্র পাশ্চাত্য কিরণ। যাহা দুর্ব্বল, দোষযুক্ত, তাহা মরণশীল—তাহা লইয়াই বা কি হইবে? যাহা বীৰ্য্যবান, বলপ্রদ, তাহা অবিনশ্বর— তাহার নাশ কে করে?” কিন্তু ইহার পাশাপাশি তিনি আরেকটি কঠোর সত্যকে তুলিয়া ধরিয়াছেন: “দেশদেশান্তর হইতে… বিদ্যুদ্বেগে নানাবিধ ভাব, রীতিনীতি দেশমধ্যে বিস্তীর্ণ হইয়া পড়িতেছে। অমৃত আসিতেছে, সঙ্গে সঙ্গে গরলও আসিতেছে।” স্বামীজী তাঁহার ‘প্রস্তাবনা’য় পাশ্চাত্য সভ্যতার বহির্মুখী তরঙ্গে ভাসিয়া আমাদের মূলোচ্ছেদ হইবার আশঙ্কা-প্রকাশ করিয়াছেন। তাই সাবধান করিয়া দিয়াছেন। উপায়— আমাদের অবিনাশী পৈতৃক অধ্যাত্মসম্পদ সম্পর্কে সচেতন থাকা, গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসকে স্মরণে রাখা এবং কল্যাণময় কৃষ্টিকে অবধারণ করা।
নিস্তেজ ও শক্তিহীন বস্তুও বিদ্যুদ্বাহী হইলে অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন হয়, কারণ তখন তাহার শক্তির জোগান আসে পশ্চাতের বিদ্যুৎ-আধার হইতে। মানুষ অতি ক্ষুদ্র জীব, পৃথিবীর ধূলিতে তাহার জন্ম, পরিণতিও তাহার এই ধূলিতেই; কিন্তু পশ্চাতের কোনো এক মহাশক্তির নিবিড় স্পর্শে সেই মানুষ অসীম শক্তিশালী হইয়া পড়ে। হয়তো ইহা এতটাই ক্ষণিকের যে, সে-শক্তির পরিচয় মানুষ জানিতে পারে না। তবুও তাহার ভিতর দিয়া এই মহাশক্তি তাঁহার কার্যসিদ্ধি করিয়া যায়। এই মহাশক্তির সহিত যুক্ত থাকিতে পারিলে সসীম মানুষ অনন্ত জীবনের দিকে ধাবমান হয়, সার্থক হইয়া উঠে তাহার জীবন। আমাদের দেশ-সমাজের ক্ষেত্রেও ইহা সমভাবে সত্য। কোনো এক অত্যাশ্চর্য মহাশক্তির বলে বলীয়ান হইয়া আমাদের এই বিপুল সমাজ যুগযুগান্ত ধরিয়া বহু বাধাবিঘ্ন ও বিচিত্র পরিবর্তনের মাঝেও উন্নতশির; স্বীয় লক্ষ্যাভিমুখে ধাবমান। সর্বাগ্রে ধারণা করিতে হইবে, কোন মহাশক্তির ক্রিয়াতে আমাদের দেশসমাজ গতিশীল? ঐ মহাশক্তিটিই ভারতের জীবনসঞ্চারী রক্তপ্রবাহ। স্বামীজী বলিয়াছিলেন: “যদি সেই রক্তপ্রবাহ চলাচলের কোন বাধা না থাকে, যদি রক্ত বিশুদ্ধ ও সতেজ হয়, তবে সকল বিষয়েই কল্যাণ হইবে। যদি এই ‘রক্ত’ বিশুদ্ধ হয়, তবে রাজনীতিক, সামাজিক বা অন্য কোনরূপ বাহ্য দোষ, এমন কি আমাদের দেশের ঘোর দারিদ্র্যদোষ—সবই সংশোধিত হইয়া যাইবে।” দেশ-জাতির জীবনসঞ্চারী এই রক্তপ্রবাহকে অবিকৃত ও গতিশীল রাখা উদ্বোধন-এর অন্যতম জীবনব্রত৷
১২৫ বর্ষে পদার্পণ করা একটি সাময়িক পত্রের ছেদহীন পথচলার ঐতিহ্য বাস্তবিক বিস্ময় জাগায়। ইহা তাহার বর্ণময় যাত্রায় রাখিয়া গিয়াছে সুদূর অতীত হইতে বর্তমান পর্যন্ত কত মনীষীর অনুভূত ভাব, সুর, ছন্দের বিচিত্র মণিরত্নমালা। এত দীর্ঘ বৎসর সে অতিক্রম করিয়াছে, তাহাতে বাধা কম ছিল না; কিন্তু বাধাই যে অগ্রগতির অন্যতম অভিজ্ঞান। উদ্বোধন-এর জীবনপথে যখন বাধা-বিপত্তি রহিয়াছে, তখন তাহার গতি এবং প্রাণশক্তিও অনস্বীকার্য। এই বাধাবিঘ্নের মধ্য দিয়া পথ করিয়া লইয়াই তাহাকে চলিতে হইবে, কেননা বিবেকানন্দ-ন্যস্ত গুরুদায়িত্ব তাহার উপর রহিয়াছে। উদ্বোধন-এর ললাটে স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ অঙ্কিত করিয়া দিয়াছিলেন অনবদ্য এক মহাজাগরণের মন্ত্র—‘উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধত’। ইহা যেন উদ্বোধন-এর জন্য নির্দিষ্ট আদর্শবাণী, ইহার মধ্যেই তাহার লক্ষ্য সম্পর্কে এক সুস্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়। বিবেকানন্দের আশিসে তাহার মধ্যে দুর্দমনীয় শক্তির জাগরণ হইয়াছে, মানুষকে তাহার স্বরূপের অরূপ স্পর্শ লাভের জন্য সে প্রাণিত করিয়া চলিয়াছে।
উদ্বোধন যেন নিরবচ্ছিন্ন ভাবের এক নিরবধি বহতা স্রোতোধারা। পূত ইহার উৎস, পূত ইহার গতিপথ, পূত ইহার সঙ্গম। উদ্বোধন বিবেকানন্দের এক অতুলনীয় নির্মাণ—এক বহমান মননধারা। মানবমনকে সতেজ রাখিবার সাধনায় ব্রতী সে। স্বামীজী পত্রিকাটির ধারাবাহিক দৈনিক প্রকাশ দেখিতে বড়ই অভিলাষী ছিলেন। কারণ, উদ্বোধন শ্রীরামকৃষ্ণের কথা বলে। শ্রীরামকৃষ্ণকে আশ্রয় করিয়াই ভারত জাগিবে। আবার ভারতকে ধরিয়া পৃথিবী নব দিশা দেখিবে। নবভাবে বোধিত বিশ্ববাসী নিত্য প্রাণিত হইতে প্রয়োজনীয় উপাদান উদ্বোধন হইতে খুঁজিয়া লইবে; উহা আমাদের দৈনন্দিন স্বাধ্যায়ের বিষয় হইয়া উঠিবে। তখন শুধুমাত্র প্রকাশনার ক্ষেত্রে নহে, ইহার বহুল আচারে, প্রচারে ও উপচারে উদ্বোধন দৈনিক পত্রিকার রূপ লইবে। সার্থক হইবে স্বামীজীর স্বপ্ন। উদ্বোধন-এর প্রথম সংখ্যায় স্বামীজী বলিয়াছিলেন: “এবার কেন্দ্র ভারতবর্ষ।” পঞ্চম বর্ষের উদ্বোধন-এ সারদানন্দ মহারাজ লিখিয়াছিলেন: “আপাতঃ শিশু হইলেও ইহা [উদ্বোধন] প্রবীণ, স্বল্পবয়স্ক হইলেও অমিতবলশালী এবং ক্ষুদ্র হইলেও ভারতের একাংশের এবং কালে সমগ্র ভারতের কল্যাণসাধনে বদ্ধপরিকর।… নববর্ষে নবোদ্যমে পুরাতনশক্তি আবার জাগরিতা।” সেই পুরাতন শক্তির চির নূতন জাগরণ ও বহুজনহিতে আত্মোৎসর্গের মন্ত্র যেন এই বলিয়া প্রতিধ্বনিত হইতেছে: “এবার কেন্দ্র মহাশক্তির উদ্বোধন।”