যুগপুরুষ শ্রীরামকৃষ্ণ এবং যুগজননী সারদা বই দুটিতে ঠাকুর ও মায়ের পালিতা কন্যা ভবতারিণী দেবী বা বসুমতী-মার আত্মস্মৃতি পড়ে বড়ই আনন্দ পেলাম। আমার পরম সৌভাগ্য যে, তাঁর পুণ্যদর্শন পেয়েছি এবং এখনো তাঁর স্মৃতি আমার নব্বই-উত্তীর্ণ জীবনে সমুজ্জ্বল।
১৯৬৬ সালে কাশীতে রামকৃষ্ণ সেবাসদনে থাকার সময় তাঁকে দর্শন করি। সকাল দশটা নাগাদ তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাম। দোতলার একটা ছোট ঘরে শ্যামবর্ণা, আলুলায়িত কেশ, পা-দুটি জোড়া করে সামনের দরজার দিকে প্রসারিত করে, হাসি হাসি মুখে বসেছিলেন। তাঁকে প্রণাম করতে জিজ্ঞাসা করলেন : “কে পাঠাল?” সেবাশ্রমের মহারাজদের কথা বলাতে উনি বললেন : “হ্যাঁ, ওরাই তো আমার দেখাশুনো করে। আমার নাতনিও মাঝে মাঝে আসে। আর মঠের সন্ন্যাসিনীরাও আসে।” উনি আমাদের তিনটি স্মৃতিকথা বলেছিলেন—
(১) “জান মা, একবার আমার জপের মালাটা পাচ্ছিলাম না। তন্নতন্ন করে খুঁজলুম। কোথাও নেই। শেষে ঠাকুরকে খুব বকাবকি করলুম। ঠাকুর বললেন—‘ঐ তো তোর মালা ওখােন পড়ে গড়াচ্ছে।’ ওমা! কী আশ্চর্য মালাটা সত্যিই পড়ে আছে। কিন্তু আমরা ঐ জায়গাটা অনেক খুঁজেছিলুম, পাইনি।”
(২) “ঠাকুরকে একবার গরম দুধ খেতে দিয়েছিলুম। মনে হলো, এত গরম দুধে মুখ পুড়ে যাবে না তো? ভাবলুম, ভগবানের আবার ঠোঁট-মুখ পুড়বে কী! তাই দিলুম। চার-পাঁচদিন পর পায়ের বাতে গরম তেল মালিশ করতে গিয়ে বাটি-সুদ্ধ তেল আমার পায়ে পড়ল। যন্ত্রণায় চিৎকার করে উঠে ঠাকুরকে বকাবকি করতে লাগলুম। দেখি, সামনের তক্তপোশের ওপর আসন করে বসে ঠাকুর হাসছেন। বলছেন : ‘কীরে, গরম লাগে না? আমারও লাগে, বুঝেছিস।’ কোথায় গেল আমার ব্যথা, বুক ভেঙে কান্না এল। ক্ষমা চাইলাম পায়ে পড়ে। তিনি সব মুছে দিলেন।”
(৩) “ঠাকুরের দেহ যাবার পর ওঁরা সবাই শ্মশানে গেলেন। এমন সময় খবর এল—ওঁকে (স্বামী উপেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়) সাপে কামড়েছে। সকলে মিলে আমাকে অমুকখাকি, তমুকখাকি বলে ও আরো সব গালাগাল দিতে লাগল। আমি তো বসে আছি, কিছুই বুঝতে পারছি না! এমন সময় দেখা গেল—উনি বেঁচে আছেন। ওঁর কিছু হয়নি। তখন সবাই কৌটো কৌটো সিঁদুর আমার মাথায় ঢালতে লাগল আর ‘সাবিত্রী সাবিত্রী’ বলতে লাগল।”
বসুমতী-মা স্মৃতিতে ডুবে গেলেন। ঠাকুরের ছেলেরা যখন সবে দক্ষিণেশ্বরে যাতায়াত করছেন, তারও আগে থেকে তিনি ওখানে উপস্থিত। তাঁর জীবনের সবচেয়ে বড় ঘটনা—ছোটবেলায় ঠাকুরের কোলে শুয়ে খুব বায়না ধরেছিলেন ঠাকুর যেন তাঁকে ভগবান দেখান। ঠাকুরও তাঁকে ভগবান দর্শন করিয়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ একটা বিরল ঘটনা।
শ্রীরামকৃষ্ণ-পরিমণ্ডলে ঠাকুর-মায়ের মেয়ে হিসাবে বসুমতী-মা চিরকাল পরম শ্রদ্ধার আসনে উপবিষ্টা। স্বামী বিবেকানন্দও তাঁকে খুব স্নেহ করতেন। আমার একান্ত অনুরোধ, যদি ঐ দুটো বই থেকে তাঁর স্মৃতিকথা দুটি চয়ন করে একত্রে একটি পুস্তকরূপে প্রকাশিত হয়, তাহলে বহু ভক্ত উপকৃত হবেন।
চিত্রা মল্লিক
কলকাতা ৭০০০১৯