লোকনাট্যের ধারায় খনপালা বা খনগান একটি ঐতিহ্যলালিত পালাগান, যা মূলত অবিভক্ত বাংলার বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চলে অধিক প্রচলিত ছিল। কিন্তু দেশভাগ-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিম দিনাজপুর (১৯৯২ সালের পর যা উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর নামে পরিচিত) জেলায় খনপালাগানের ঐতিহ্য যেমন চর্চিত হয়েছিল, তেমনি পরম্পরা থেকে বেরিয়ে এসে খনপালাকে আধুনিক করে তোলার প্রয়াসও লক্ষ্য করা যায়। কাদের হাত ধরে খনপালা তার প্রচলিত ধারা থেকে সরে এসে আধুনিক হয়ে উঠল তা আলোচনার পূর্বে খন নিয়ে গবেষক ও তাত্ত্বিকেরা কী মতামত জানিয়েছেন—গোড়াতেই সেটা বিশ্লেষণ করা দরকার।
লোকসংস্কৃতির গবেষক আশুতোষ ভট্টাচার্য মনে করেছেন, সংস্কৃত ‘ক্ষণ’ শব্দ থেকে ‘খন’ কথাটি এসেছে এবং ‘খন গান তাৎক্ষণিকভাবে রচিত’।১ সংস্কৃত ‘ক্ষণ’ শব্দটি সময় বা কালকে বোঝায়, তাই ‘খন গান তাৎক্ষণিকভাবে রচিত’ কথাটিতে বিষয়ের একটিমাত্র দিক ধরা পড়ে—কীভাবে খনপালাগান পরিবেশনের সময় লোকশিল্পীরা তাৎক্ষণিকভাবে গান ও সংলাপ তৈরি করে। কিন্তু তাঁর এই বক্তব্যে অন্য একটি দিক অস্পষ্ট থেকে যায়—সমাজে সদ্য ঘটা কোনো ঘটনাকে ঘিরে যে খনপালা তাৎক্ষণিকভাবে গড়ে ওঠে তা জনমানসে তখনো টাটকা, তাদের মুখে মুখে হয়তো সেই ঘটনার নিন্দামন্দ আলোচিত হচ্ছে। এই দিকটা মাথায় রেখে বলা যেতে পারে, সমাজে সদ্য ঘটে যাওয়া কোনো একটি অপ্রিয় ঘটনাকে নিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে রচিত হয় খনপালা। অন্যদিকে নির্মলেন্দু ভৌমিকের মতে, ‘খন’ কথাটি এসেছে সংস্কৃত ‘খণ্ড’ থেকে, অর্থাৎ খণ্ড>খন্ন>খন। তিনি ‘খণ্ড’ বলতে এপিসোড বা খণ্ড-কাহিনিকে নির্দেশ করেছেন এবং সেই খণ্ড-কাহিনি থেকে খনের উদ্ভব বলে মনে করেছেন।২ তাঁর এই ভাষাতাত্ত্বিক বিবর্তন কষ্টকল্পনা বলে মনে হয়, কেননা ‘খণ্ড’র সঙ্গে ‘খন’-এর যোগসূত্র হিসাবে খণ্ড-কাহিনির যথাযথ ব্যাখ্যা আমরা পাই না। সাধারণত খনপালাগানে কোনো একটা কাহিনির খণ্ড অংশ অভিনীত বা গাওয়া হয় না, বরং কাহিনির একটি সামগ্রিক প্রকাশ ঘটে।
আবার ‘খণ্ড’ থেকে ‘খন’—এই একই অভিমত লোকসংস্কৃতি-গবেষক শিশির মজুমদারও প্রকাশ করেছেন, যদিও তিনি ‘খণ্ড’র সঙ্গে ‘কাণ্ড’র একটা সম্পর্ক দেখিয়েছেন। তাঁর মতে, ‘খণ্ড’ হলো ঘটনা এবং ‘কাণ্ড’ শব্দটি সাধারণভাবে ‘একটি নির্দিষ্ট কৌতূহলজনক ঘটনা বোঝাতে’ ব্যবহৃত হয়, যাকে দেশি-পোলি-রাজবংশী ভাষাভাষির মানুষজন ‘খণ্ড’ বলে। এই সূত্রে তিনি ‘কাণ্ড’র সঙ্গে ‘খণ্ড’র একটা সংযোগ স্থাপন করে দেখিয়েছেন— “এই ‘খণ্ড’ যখন গানে বাঁধা পড়ে, তখন তা ‘খন’।”৩ অর্থাৎ খণ্ড-ঘটনার ভিত্তিতে রচিত গানের সমাহারই খন। তিনি খণ্ড-ঘটনা বলতে বুঝিয়েছেন : “জীবনে একটি খণ্ড চিত্র এখানে (খনপালায়) ধরা পড়ে।… এটা জীবন থেকে বিচ্ছিন্ন নয়, জীবনের খণ্ড-অঙ্গ।”৪ এই বক্তব্য থেকে প্রশ্ন জাগে—শুধুমাত্র খনপালাতেই কী জীবনের খণ্ডচিত্র ধরা পড়ে, লোকনাট্যের অন্য শাখাগুলোতে বিশেষ করে গম্ভীরা, আলকাপ, পালাটিয়া, কুশানপালা কিংবা নটুয়াপালাতে কি জীবনের খণ্ডচিত্র প্রকাশ পায় না?
অন্যদিকে লোকসংস্কৃতি-গবেষক পুষ্পজিৎ রায় ‘খন’-এর সঙ্গে ‘খনন’ (অর্থাৎ খোঁড়াখুঁড়ি করা) শব্দের অর্থগত সম্পর্কের কথা বলেছেন।৫ যদিও পরবর্তিকালে তিনি নিজেই তাঁর এই অভিমতকে ‘কষ্টকল্পনা’ মনে করেছেন। কেননা, তিনি দীর্ঘদিন উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর এবং মালদা জেলার কুড়িটি অঞ্চলে ক্ষেত্রসমীক্ষা করে জেনেছেন—খনের সঙ্গে ‘খেত’ ও ‘ফসল’ শব্দদুটি জড়িয়ে আছে। প্রথমে আমরা ‘খেত’ শব্দের সঙ্গে খনের সম্পর্ক বিষয়ে দৃষ্টিপাত করব। কলীন্দ্রনাথ বর্মণ রচিত রাজবংশী অভিধান-এ পাই—‘খন’ শব্দটি জলপাইগুড়ি অঞ্চলে ‘খেত’ অর্থে ব্যবহৃত হয়।৬ অথচ সেই অঞ্চলে খনপালাগান অপ্রচলিত এবং অপরিচিতও বটে। ফলে ‘খেত’-এর সঙ্গে খনের সম্পর্ক খোঁজা অনেকটা কষ্টকল্পনা নয় কি? অন্যদিকে ‘ফসল’-এর সঙ্গে খনের সম্পর্ক প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন: “খনগান হচ্ছে উৎসবের গান, উৎসবকালের গান, অবসর-অবকাশ বা বিরামকালের গান।”৭ কিন্তু ‘উৎসবের গান’ মানেই কি শুধু খনগানকে বুঝব? উৎসবকালে যে পালাগানের আসর বসত, সেখানে কি কেবল খনপালাগান পরিবেশিত হতো, অন্য কোনো লোক-আঙ্গিকের লোকনাট্য পরিবেশিত হতো না? সেইসঙ্গে তিনি ‘আনন্দ উপভোগের জন্য’ যে গান, তাকে খনগান বলেছেন। স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে—খনপালাগান ব্যতীত অন্যান্য যে লোকপালাগান পরিবেশিত হয় তা কি আনন্দ উপভোগের জন্য নয়? আবার যদি কোনো বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগে (বন্যা অথবা খরা) ফসল নষ্ট হয়, তাহলে কি উৎসবকালটা কৃষকদের কাছে আনন্দমুখর থাকে? তখন কি খনগানকে ‘উৎসবের গান’ কিংবা ‘আনন্দ উপভোগ’-এর জন্য গাওয়া গান বলা যাবে?
চারজন লোকসংস্কৃতি-গবেষক ও তাত্ত্বিকের অভিমতগুলি পর্যালোচনা করে আমরা খনের স্বরূপ সম্বন্ধে একটা ধারণা পাওয়ার চেষ্টা করলাম। যদিও তাঁরা প্রত্যেকেই নিজেদের যুক্তি সাপেক্ষে ভিন্ন মত পোষণ করেছেন। সেগুলি যেমন একেবারে অস্বীকার করা যায় না, তেমনই আবার সম্পূর্ণরূপে গ্রহণ করতে গিয়ে বেশ কিছু প্রশ্নও থেকে যায়। এঁদের পাশাপাশি খনপালাগানের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত খনশিল্পী মাধাই মহন্ত এবং খনপালার রচয়িতা ও পরিচালক খুশী সরকারের খন বিষয়ক মতামতগুলি আলোচনা করে নেওয়া যাক। মাধাই মহন্ত মনে করতেন, ‘খন’ শব্দটি এসেছে ‘খনা’ থেকে, অর্থাৎ খনা>খন।৮ কেননা, কিংবদন্তি খনার বচন যেমন সত্য, তেমনি লোকায়ত জীবনে ঘটে যাওয়া সত্য ঘটনা নিয়েই বাঁধা হয় খনপালাগান। এই উপলব্ধির পাশাপাশি তিনি মনে করতেন : “খন মাটির গান, জীবনের গান। যে গানে সুর-তাল, রাগ-রাগিণীর বালাই নেই।”৯ আবার খুশী সরকারের মতে, ‘খন’ কথাটি এসেছে উর্দু ‘খৎ’ শব্দ থেকে। উর্দুতে ‘খৎ’ কথার অর্থ হলো দলিল লিখন, অন্যদিকে খনপালাগানও গ্রামীণ লোকায়ত জীবনের এক চিত্রমূলক দলিল—যা লোকসংস্কৃতির লেখ্য দাসখত বা পরচা।১০ এই ভাবনার পাশাপাশি তিনি খন সম্পর্কে ভিন্ন একটা অভিমত জানিয়েছেন : “গ্রাম বাংলায় প্রেম ঘটিত যে সব ঘটনা ঘটে সেইসব প্রেমের ঘটনার ‘খ’ বা সূত্র ধরে লেখা… গাওয়া ও অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ঘটনার সবকিছু প্রকাশ পায়—সেই পালাকেই তখন ‘খন’ বলা হচ্ছে।”১১ তাঁদের এইসব ভিন্ন মত ও যুক্তিকে পাশে রেখে আমরা একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, খনপালাগান হলো লোকশিল্পকলার একটা বিশেষ অঙ্গ—যা একইসঙ্গে গান এবং পালা; কখনো শুধু খনগান গাওয়া হয়, আবার কখনো তা পালার আকারে গান, সংলাপ, নৃত্য, বাদ্য ও অভিনয় সহকারে পরিবেশিত হয়। আসলে ‘ফোক আর্ট’ বা লোকশিল্পকলায় লোকায়ত জীবনের ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনাকে বিভিন্ন আঙ্গিকে—কখনো তা গানের মাধ্যমে, কখনো বা নাচের মাধ্যমে, আবার কখনো পালাভিনয়ের মাধ্যমে দর্শকের মাঝে পরিবেশন করা হয়। তাই লোকশিল্পকলার একটি বিশেষ অঙ্গ হলো খন।
এবার আলোচনা করা যাক খনের প্রকারভেদ নিয়ে। সাধারণত খন দুই প্রকার—‘শাস্তোরী’ বা শাস্ত্রীয় খন এবং ‘অ-শাস্তোরী’ বা অ-শাস্ত্রীয় খন। খনের এই প্রকারভেদ নিয়ে আজ পর্যন্ত কোনো গবেষক দ্বিমত পোষণ করেননি। প্রচলিত ধারায় শাস্তোরী খন মূলত যোগশাস্ত্র ও দেহতত্ত্ব বিষয়ক; যথা—বোষ্টম, বাউদিয়া, নয়ন, শোরী। বর্তমানে শাস্তোরী খনপালা পরিবেশিত হয় না, কারণ সম্পর্কে সাংবাদিক সুনীল চন্দ জানিয়েছেন : “শাস্তরি খন এখন প্রায় অচল। লোকে এখন কিরচা অর্থাৎ কেচ্ছাটাই শুনতে চায়।”১২ সময়োপযোগী না হয়ে ওঠায় শাস্তোরী খন কি তবে বিলুপ্তির পথে? অন্যদিকে অ-শাস্তোরী খন মূলত লোকজীবনে ঘটে যাওয়া কোনো কাহিনি নিয়ে পরিবেশিত হয়; তাই একে দেশি, পোলি, রাজবংশীতে ‘ঘিসা খন’ বা ‘খিসা খন’ও বলা হয়। প্রসঙ্গত বলা দরকার, খনপালার নামকরণে নায়ককে ‘বাউদিয়া’ ও নায়িকাকে ‘শোরী’ (শাস্তোরী খনে) বা ‘সোরী’ (অ-শাস্তোরী খনে) বলে উল্লেখ করা হয়। খনের এই প্রচলিত ধারণার বাইরে আমরা আরেক রকমের খনের প্রস্তাব রাখতে ইচ্ছুক, যাকে আমরা আধুনিক খন হিসাবে চিহ্নিত করতে চাই। এই আধুনিক খনের স্রষ্টা হলেন খুশী সরকার, যদিও তাঁর আগে আধুনিক খনের একটা পূর্ব-ইঙ্গিত মেলে ‘কাল্পনিক খন’-এ, যার সুস্পষ্ট ধারণা দিয়েছিলেন মাধাই মহন্ত।
‘কাল্পনিক খন’ শাস্ত্রের বিষয় কিংবা সমাজে ঘটে যাওয়া কোনো কাহিনি নিয়ে গড়ে ওঠে না, বরং সভ্যতার অগ্রগতির সাথে নতুন নতুন যেসব প্রযুক্তির আবিষ্কার হয় সেই বিষয়গুলিকে নিয়ে একটি কল্পিত কাহিনির মোড়কে তার কার্যকারিতা, গুরুত্ব এবং অভিনবত্ব খনপালায় পরিবেশিত হয়। এই খনপালাগুলিকে মাধাই মহন্ত ‘কাল্পনিক খন’ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন। বিষয়টিকে স্পষ্ট করার জন্য কয়েকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। প্রথম যখন গ্রামের মানুষের হাতে হ্যাজাক লাইট আসে তখন তাকে কল্পনা করে লেখা হয়েছিল ‘হ্যাজাক সোরী’, আবার চাষের জন্য যখন পাম্প এল তখন সেটাকে নিয়ে ‘পাম্পিং সোরী’, একইভাবে সাইকেলকে নিয়ে ‘সাইকেল সোরী’, আবার ঘরে ঘরে যখন বিদ্যুতের আলো পৌঁছায় তা নিয়ে ‘কারেন্ট সোরী’ ইত্যাদি খনপালা রচিত হয়েছিল। এই ধরনের খনপালায় শিল্পীর কল্পনাই হচ্ছে আসল চাবিকাঠি। আসলে সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে খনপালার প্রচলিত ঐতিহ্য বদলাতে শুরু করেছিল, কাল্পনিক খন যেন সেই পরম্পরা থেকে বেরিয়ে এসে আধুনিক হয়ে ওঠার প্রথম পদক্ষেপ।
এবার আমরা খুশী সরকারের লেখা খনপালার বিষয়ভাবনা ও প্রয়োগভাবনা পর্যালোচনা করে আধুনিক খনপালা বিষয়ক প্রস্তাবটি উল্লেখ করব। দক্ষিণ দিনাজপুরের ভূমিপুত্র খুশী সরকার (জন্ম ১৯৪৯) খুব ছোটবেলায় জ্যাঠামশাইয়ের কাছ থেকে খজাগর খনের সামান্য কিছু গান শিখেছিলেন এবং তারপর পড়াশোনার কারণে সে-পথ আর মাড়াননি। অভাবের সংসারে বড় হলেও স্বচেষ্টায় উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে অনেক কষ্টে স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরি পাওয়ার পর তিনি পুনরায় খনপালা দেখতে শুরু করেন। একদিন খনপালা দেখতে গিয়ে এক অভিনেতার অনুপস্থিতিতে বাধ্য হয়ে তাঁকে এক মাস্টারের ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়।১৩ ছোটবেলার সেই খজাগর পালার পর এই প্রথম বিনা প্রস্তুতিতে বহু দর্শকের সামনে অভিনয় করে তিনি মনে একটা জোর পান। পাশাপাশি স্বাস্থ্য বিভাগে চাকরির কারণে তাঁকে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরতে হতো, ফলে বিচিত্র মানুষের সাথে মেলামেশার সুযোগ ঘটেছিল। তিনি তো আর জাত অভিনেতা নন, তাই স্থির করেন—বিশেষ অঞ্চলে ঘটা মুখরোচক কাহিনিমূলক খন থেকে সরে এসে নিজের শিক্ষা ও অভিজ্ঞতা থেকে সমকালীন ইতিহাস ও আন্দোলন কিংবা জনসাধারণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ন্যায্য অধিকার নিয়ে নতুন ঢঙে খনপালা লিখবেন—তা যেমন একদিকে প্রচলিত খনপালার ঐতিহ্যকে বহন করবে, অন্যদিকে আধুনিকতারও প্রবল দাবিদার হয়ে উঠবে।
‘আধুনিক খন’ কী এবং কোন কোন দিক থেকে খুশী সরকারের খনপালাগুলি আধুনিক হয়ে উঠেছে—তা সূত্রাকারে চিহ্নিত করা যাক। প্রথমত, তিনিই প্রথম খনপালার আঞ্চলিক গণ্ডিটাকে ভেঙে একটা বৃহত্তর সমাজেতিহাসের ঘটনাকে খনপালার বিষয়ীভূত করেছিলেন। তিনি তাঁর খনপালায় বৃহত্তর সমাজের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথাকে প্রকাশ করেছিলেন। যেমন, তেভাগা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ‘তে-ভাগা’ ও ‘খাঁ-পুর’ নামক দুটি খন এবং সাঁওতাল বিদ্রোহের পটভূমিতে ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ নামক আরেকটা ইতিহাস বিষয়ক খনপালা লিখেছিলেন। দ্বিতীয়ত, তাঁর লেখা প্রথম ‘তে-ভাগা’ খনে প্রচলিত আসর-বন্দনা১৪ থাকলেও তিনি দ্বিতীয় খন ‘চল পরিবা যাই’ থেকে প্রচলিত আসর-বন্দনা বাদ দিয়েছেন, যা তাঁর পূর্বে কেউ কোনোদিন ভাবতেই পারেনি। দ্বিতীয় খন থেকে বিষয়ানুযায়ী আসর-বন্দনা লিখেছেন : “নিরকখরা দূর করিতে/ সাকখরতে দেউরে মন/ ওমন— মনরে—/ …ঘরে ঘরে রব তুল/ সাকখরতার আলই জ্বাল/নিরকখর থাকব না কেউ/ জীবন মরণ কর পণ।”১৫ এটি অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক এবং আধুনিকমনস্কতার পরিচয় বহন করে। তৃতীয়ত, তিনিই প্রথম খনপালায় গানের প্রাধান্যকে কমিয়ে বিষয়ানুযায়ী সংলাপের ওপর জোর দিয়েছিলেন এবং সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে খনপালাকে অনেক বেশি ‘স্টাইলাইজ্ড’ করেছিলেন। চতুর্থত, তিনি একদিকে যেমন খনপালার প্রচলিত ধ্যান-ধারণাকে পাশ কাটিয়ে নিজস্ব বোধবুদ্ধিতে আধুনিক খনপালা নির্মাণ করেছিলেন, অন্যদিকে নিজের মাতৃভাষার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও ভালবাসা থেকেই দেশি, পোলি, রাজবংশী ভাষায় খনপালাকে আধুনিকমনস্ক করে তুলেছিলেন একক প্রচেষ্টায়। পঞ্চমত, তিনি সচেতনভাবেই নিজের লেখা প্রতিটি খনপালাকে লিখিত আকারে এবং বেশ কয়েকটি খনপালাকে নিজের উদ্যোগেই গ্রন্থাকারে প্রকাশ করে সংরক্ষণ করার তাগিদ অনুভব করেছেন। তিনি এটা বুঝেছিলেন, সাধারণভাবে প্রচলিত খনপালার কোনো লিখিত পাণ্ডুলিপি থাকে না, তা মূলত স্মৃতিতে এবং শ্রুতিতে মুখে মুখেই চলতে থাকে—যা কয়েক প্রজন্মের পর হারিয়ে যায়, মানুষ বিস্মৃত হয় এবং সর্বোপরি চিরতরে বিলুপ্ত হয়। সেদিক থেকে খুশী সরকারের এই প্রয়াস আধুনিক চেতনার পরিচয় বহন করে।
এই বিষয়গুলিকে মাথায় রেখে আমরা খনকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করতে চাই—(এক) শাস্তোরী খন, (দুই) অ-শাস্তোরী খন এবং (তিন) আধুনিক খন। আগেই আমরা শাস্তোরী এবং অ-শাস্তোরী খন নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছি। এবার আমরা মাধাই মহন্তের ‘কাল্পনিক খন’ এবং খুশী সরকারের খনপালাগুলির পর্যালোচনার সাপেক্ষে ‘আধুনিক খন’কে প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করতে চাই—(ক) কাল্পনিক খন, (খ) ইতিহাস বিষয়ক খন এবং (গ) জনচেতনা বিষয়ক খন। কাল্পনিক খন নিয়ে পূর্বেই আমরা আলোচনা করেছি, যার স্পষ্ট ধারণা দিয়েছিলেন মাধাই মহন্ত। অন্যদিকে সমকালীন ইতিহাস ও আন্দোলন নিয়ে খুশী সরকারের লেখা খনগুলিকে আমরা ‘ইতিহাস বিষয়ক খন’ হিসাবে চিহ্নিত করতে চেয়েছি। যেমন, তেভাগা আন্দোলনের ইতিহাস নিয়ে লেখা দুটি খন ‘তে-ভাগা’ (১৯৮৪-৮৫) ও ‘খাঁ-পুর’, বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলন নিয়ে ‘কমলা বাই’, মণিপুরের নারীদের আন্দোলন নিয়ে ‘শর্মিলা দেবী’, সাঁওতালদের আন্দোলন নিয়ে ‘সাঁওতাল বিদ্রোহ’ ইত্যাদি ‘ইতিহাস বিষয়ক খন’-এর দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে জনসাধারণের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও ন্যায্য অধিকারের ভিত্তিতে রচিত শ্লোগানধর্মী বা প্রচারধর্মী খনপালাগুলিকে আমরা ‘জনচেতনা বিষয়ক খন’ হিসাবে দেখাতে চেয়েছি। এই খনকে আবার বিষয়ানুযায়ী তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়—(১) জনশিক্ষা বিষয়ক খন, (২) জনস্বাস্থ্য বিষয়ক খন এবং (৩) জনাধিকার বিষয়ক খন। জনশিক্ষা বিষয়ক খনের দৃষ্টান্ত হলো—সাক্ষরতা অভিযানের ওপর লিখিত ‘চল পরিবা যাই’ (১৯৮৯-৯০) এবং সর্বশিক্ষা অভিযানের ভিত্তিতে রচিত ‘হরিহরের বিচার’। জনস্বাস্থ্য বিষয়ক খনের দৃষ্টান্ত হিসাবে উল্লেখ্য—সাধারণ মানুষের মধ্যে পাল্স পোলিও সচেতনতা নিয়ে লেখা ‘গবানু বাউদিয়া বাতাসী সোরী’ (১৯৯৪), কুষ্ঠ নিয়ে গ্রামের মানুষের কুসংস্কার বিষয়ে ‘কুষ্ঠ না হয় পাপের ফল’, এইড্স নিয়ে ‘মরণ ফাঁদ এইড্স’, কন্যাসন্তানের গুরুত্ব ও অধিকার নিয়ে ‘বেটি বাঁচাও’ ইত্যাদি খন। অন্যদিকে জনাধিকার বিষয়ক খনের উদাহরণ হিসাবে বলা যায়—‘কামে হামার অধিকার’, ‘সম্মেলন সোরী’, ‘শিলিগুড়ি চল’ ইত্যাদি।
সবশেষে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারি যে, খুশী সরকার তাঁর শিক্ষা ও বিচিত্র অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রচলিত খনপালাগুলিকে আত্মস্থ করে খনের আঞ্চলিক গণ্ডিকে অতিক্রম করে বৃহত্তর সমাজেতিহাসের ঘটনাকে নিয়ে রচনা করেছেন একের পর এক খনপালা—যা একাধারে লোকনাট্যের ঐতিহ্য ও পরম্পরাকে ধারণ করে আছে, অন্যদিকে বিষয় ও প্রয়োগ ভাবনায় খনপালাগুলি একই সাথে হয়ে উঠেছে আধুনিক।
তথ্যসূত্র
১ দ্রঃ ভট্টাচার্য, আশুতোষ, বাংলার লোকসাহিত্য, এ মুখার্জি অ্যান্ড কোং প্রাঃ লিঃ, কলকাতা, ২০০৪, পৃঃ ১৪৯
২ দ্রঃ ভৌমিক, নির্মলেন্দু, ‘জনযোগাযোগ : উত্তরবঙ্গের লোকনাটক’, নকশি কাঁথা, ২০০৮, পৃঃ ৩৩
৩ মজুমদার, শিশির, ‘খন’, লোকনাট্য-নাটক-কথা, মোম, কলকাতা, ২০০৫, পৃঃ ৯৫
৪ মজুমদার, শিশির, ‘দিনাজপুরের লোকনাট্যগীতি : “খন” গান’, শিশির মজুমদার (সম্পাদক), নাট্যশালা শতবর্ষ স্মরণিকা, পশ্চিম দিনাজপুর, পশ্চিম দিনাজপুর জেলা বাংলা সাধারণ নাট্যশালা শতবর্ষপূর্তি উৎসব সমিতি, রায়গঞ্জ, ১৯৭৩, পৃঃ ৮৬
৫ দ্রঃ রায়, পুষ্পজিৎ, ‘গ্রামীণ লোকনাটক : খন’, সনৎকুমার মিত্র (সম্পাদিত), বাঙলা গ্রামীণ লোকনাটক : আলোচনা এবং সংগ্রহ, সাহিত্য প্রকাশ, কলকাতা, ২০১৫, পৃঃ ১৭৯
৬ দ্রঃ ‘খন’, লোকনাট্য-নাটক-কথা, পৃঃ ৯৫
৭ রায়, পুষ্পজিৎ, ‘লোকনাটক খনগান’, মুখোশের কথা ও অন্যান্য, শ্রীভারতী প্রেস, কলকাতা, ২০১৭, পৃঃ ১৬৮
৮ ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে খগেন মণ্ডল (দক্ষিণ দিনাজপুরের শুকদেবপুরের বাসিন্দা এবং মাধাই মহন্তের শেষজীবনে কয়েক বছর তাঁর কাছে প্রায়শই আসতেন) খন নিয়ে মাধাই মহন্তের এই ব্যতিক্রমী ভাবনার কথা জানিয়েছেন (২০ মে ২০১৯)।
৯ চন্দ, সুনীল, ‘লোকনাট্য খন ও শিল্পী মাধাই মহন্ত’, মনোনীতা চক্রবর্তী (সম্পাদিত), দাগ, ৩য় বর্ষ, ৩য় সংখ্যা, উৎসব-১৪২০, পৃঃ ১৩১
১০ দ্রঃ সরকার, রণজিৎ কুমার, ‘লোকসংস্কৃতির দর্পণে দক্ষিণ দিনাজপুরের খন যাত্রাগান’, বালুরঘাট বার্তা, শারদীয়া সংখ্যা ২০১১ পৃঃ ১২-১৩
১১ দ্রঃ সরকার, খুশী, ‘খন-গান’, পৃঃ ১ [ব্যক্তিগত সংগ্রহ : অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপি]
১২ দাগ, পৃঃ ১৩১
১৩ ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার (১৩ এপ্রিল ২০১৯)
১৪ তে-ভাগা খনে প্রচলিত আসর-বন্দনাটি এইরকম :
“পুরুবে বন্দনা করি/ ধর্ম ঠাকুরের চরণ বন্দি/ ধর্ম ঠাকুরের ছিরি-চরণে জানাই প্রণাম।/ পশ্চিমে বন্দনা করি/ পির সাহেবের চরণ বন্দি/ পির সাহেবের ছিরি-চরণে জানাই প্রণাম।/ উত্তরে বন্দনা করি/ দুর্গা মায়ের চরণ বন্দি/ দুর্গা মায়ের ছিরি-চরণে জানাই প্রণাম।/ দক্ষিণে বন্দনা করি/ গঙ্গা মায়ের চরণ বন্দি/ গঙ্গা মায়ের ছিরি-চরণে জানাই প্রণাম।/ আসরে বন্দনা করি/ দশ ঠাকুরের চরণ বন্দি/ দশ ঠাকুরের ছিরি-চরণে জানাই প্রণাম।/ শুন শুন তমরা দশ ঝন/ এই আসরে গাউনা হবে/ আধিয়ার বিদ্রোহ তে-ভাগা আন্দোলন।” [সরকার, খুশী, ‘আসর-বন্দনা’, তে-ভাগা, লেখক (প্রকাশক), দক্ষিণ দিনাজপুর]
১৫ সরকার, খুশী, ‘ভূমিকা’, চল পরিবা যাই, রেখা সরকার (প্রকাশক), দক্ষিণ দিনাজপুর, ২০০৫