চৈত্র অপরাহ্ণ এখানে ম্রিয়মাণ, দূরে তুষারাবৃত শৈলরাজি হতে বয়ে আসা শীতার্ত বাতাসে কান পাতলে শোনা যায় নিঃসঙ্গতার আখ্যান, যেন কোনো বিরহী কারোর অপেক্ষায় অলীক বাঁশির সুরে এই পুরানো উপত্যকা-শহরটিকে ভরিয়ে তুলেছে। মল্লিতাল লেকের সামনে থেকে শেরউড কলেজের পথে হাঁটছি, কয়েক ফার্লং এগতেই পাহাড়ি পথের বামদিকে বিশালাকায় ওক গাছের ছায়াতলে চোখে পড়ল একটি ছিমছাম বাড়ি—বাড়ি না বলে অবশ্য কটেজ বলাই ভাল। ঢালু চাল, দুপাশে পাহাড়মুখী প্রশস্ত বারান্দা, সামনে অনেকখানি জমির ওপর শীত-দেশের মনোরম উষ্ণ ‘সামার সিজন’-এর গোলাপ আর লিলি ফুল ফুটে রয়েছে, গেটের একদিকে রক্ষীর মতো দেওদার গাছের শরীর আইভি-লতায় সাজানো, পাশে আখরোট ও পাম গাছ। দূর থেকে এমন বাড়ি চোখে পড়তেই ভারতবর্ষের ব্রিটিশ কলোনির কথা মনে পড়ে গেল, যাকে কি না অতীতচারী মানুষ এখনো ‘রাজ অন দ্য ডেজ’ বলে থাকেন।

বাড়ির নাম ‘গার্নি হাউস’, নৈনিতালের মতোন ক্ষুদ্র শৈলশহরে কাদের ছিল এই কটেজ?

সে ভারি বিচিত্র আখ্যান! ‘গার্নি হাউস’-এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে আদ্যন্ত প্রকৃতপ্রেমিক, এমনকী আধুনিক বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের আদি পুরুষের নাম, তিনি এডওয়ার্ড জেমস করবেট—যাঁকে সারা পৃথিবীর মানুষ ‘জিম করবেট’ নামেই চেনেন।

১৮৭৫ সালের ২৫ জুলাই এই নৈনিতালে জন্ম নেওয়া মানুষটির পরিচয় এককথায় দেওয়া প্রায় অসম্ভব, ১৮৭৫-এর ১৮ অক্টোবর নৈনিতালের সেন্ট জন চার্চে ব্যাপটাইজড শিশুটি এডওয়ার্ড জেমস, তিনিই উনিশ শতকের শেষার্ধে ভারতবর্ষের উত্তরপ্রান্তে এই ক্ষুদ্র অরণ্যাকীর্ণ শ্বাপদসংকুল জনপদের হতদরিদ্র সরল মানুষের কাছে ‘কার্পিট সাহিব’। তাঁকে বন্ধু, আত্মীয়স্বজনরা আদর করে ‘জিম’ বলে ডাকতেন, আজও সমগ্র বিশ্বের অগণিত গুণমুগ্ধ মানুষের চোখে তিনি ‘জিম’। এই জিমই সোনার অক্ষরে নিজের জীবনের বিচিত্র কাহিনি লেখেন, আবার নৈনিতালের তৎকালীন ব্যাঙ্কের খাতায় তাঁকে খুঁজে পাওয়া যায় ‘মেজর এডওয়ার্ড জেমস করবেট, ভিডি’ পরিচয়ে, এই শহরের পৌরপিতা হিসাবে তিনি সরকারি কাগজে সই করেন—‘জেমস এডওয়ার্ড’। প্রকৃতার্থে কখনো একটি পরিচয় বা নামে এই বিচিত্রকর্মা হৃদয়বান মানুষটি নিজেকে সীমাবদ্ধ করেননি, আর আজও তাঁর সমস্ত নাম ও পরিচয়ের ছবিগুলি একত্রে সুতোয় বাঁধলে যে অপরূপ জলছবিটি গড়ে ওঠে, তার মধ্যেই বোধহয় চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন ক্রিস্টোফার উইলিয়াম করবেট ও মেরি জেনের সন্তান জিম করবেট, যাঁকে আর ভারতবর্ষের থেকে পৃথক করা যায় না। আক্ষরিকার্থে আইরিশ ও বিদেশি মানুষটির হৃদয়ে এই দেশের দরিদ্র সরল পাহাড়ি গ্রামবাসী কী করে সিংহাসন পেতেছিল তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়। এখানেই বোধহয় একজন প্রকৃত মানুষের সঙ্গে অপর মানুষের আত্মার যোগসূত্র রচিত হয়, আর সেই সুতোয় বাঁধা দোয়াতের কালি দিয়ে হৃৎকলমে ‘কার্পিট সাহিব’ লেখেন মাই ইন্ডিয়ার মতোন একখানি আশ্চর্য ভালবাসার বই।

সেই গল্প পরে হবে, আসুন আপাতত আমরা ‘গার্নি হাউস’-এর ভিতরে প্রবেশ করি!

করবেট পরিবারের এই গৃহ যেন অতীতের ছায়ামহল, চারটি ঘরের প্রথমটি অর্থাৎ বৈঠকখানায় সাজানো মেরি জেনের পিয়ানোটি দেখে আমার মনে হলো, কিছুক্ষণ পূর্বেই বোধহয় তিনি একটি অসমাপ্ত নোট রেখে উঠে গেছেন, ফিরে এসেই রুমঝুম শব্দে বাদ্যযন্ত্রটিকে জাগিয়ে তুলবেন। পিয়ানোর ওপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত ইতিহাসগন্ধী কামানের গোলার দুটি শূন্য খোলা এখন ফুলদানি হিসাবে পুরানো কালের অশ্রুত আখ্যান বুকে নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অদূরে ঘরের একপাশে রক্তে আদিম নেশার দ্রিমদ্রিম ছন্দ তোলা আফ্রিকার ড্রাম সাজানো, এটিকে সুদূর তাঞ্জানিয়া থেকে জিম নিয়ে এসেছিলেন। দেওয়ালে ক্ষুদ্র পাহাড়ি গ্রাম নৈনিতাল লেকের ওপর একখানি নিঃসঙ্গ ফিশার বোটের ছবি চারকোল পেন্সিলে এঁকে টাঙানো রয়েছে, ভাল করে খেয়াল করলে চিত্রকরের স্বাক্ষরটি চিনতে পারা যায়; ছবির বামদিকে এককোণে ধূসর মৌন অতীতের অস্ফুট শব্দে লেখা রয়েছে—‘জে করবেট’!

শিকারের পর দলের সাথে জিম করবেট


পাশের ঘরে বিশালকায় হাতির দাঁত টেবিলের ওপর রাখা, অদূরে কাচবন্ধ ড্রয়ারে সাজানো দুটি বাঘের করোটি, মানুষের আতঙ্কের প্রহর যেন এখনো ঐ মৃত নরখাদকের চোয়ালে লেগে রয়েছে!

পরের ঘরটি তুলনায় ছিমছাম, শুধু দেওয়ালে সম্বর হরিণের শিঙাল মাথায় সাজানো, উজ্জ্বল চোখে তারা আমার দিকেই চেয়ে রয়েছে!

শেষ ঘরে পুরানো রাইটিং ডেস্কটি দেখে এক মুহূর্তের জন্য থমকে দাঁড়ালাম, এখানে বসেই লেখা হয়েছিল সেই অবিস্মরণীয় গ্রন্থ—ম্যান-ইটার্স অব কুমায়ুন। বইটির একটি কপি আজও রাখা আছে সেখানেই, এর ইতিহাসও কম বিচিত্র নয়! প্রথমে কিন্তু বইটির নাম ছিল জাঙ্গল স্টোরিস!

এই বইটি ১৯৩৫ সালে জিম নিজের খরচায় মাত্র একশো কপি ছাপান। করবেট সাহেব সম্ভবত ভেবেছিলেন—জংলা সুবাসে আচ্ছন্ন বই হয়তো কেউ পড়বে না। সেই ছাপার শেষ কপিটি এখনো রয়ে গেছে লন্ডনে বিখ্যাত রাইফেল প্রস্তুতকারক সংস্থা ‘জন রিগবি এন্ড কোং’-এর কাছে। আক্ষরিকার্থেই জাঙ্গল স্টোরিস এখন দুর্মূল্য। ওঁদের সংগ্রহশালায় এই বইটির ছবি আমি দেখেছি, বাদামি রঙের ম্যানিলা জ্যাকেটে মোড়া লেটার প্রেসে ছাপা শতাব্দী-প্রাচীন এক বই, প্রচ্ছদে শুধু বইটির নাম আর নিচে ডানদিকের কোণে লেখা—‘বাই জিম করবেট’। দেখে ভারি ইচ্ছে হয়েছিল স্পর্শ করার, ঐ অক্ষরের মধ্যেই তো ঘুমিয়ে রয়েছে কত হতভাগ্য নরখাদক, আনাড়ি শিকারির গুলির চোটে যাদের একদিন তথাকথিত ‘ম্যান ইটার’ হয়ে উঠতে হয়েছিল; লেখা আছে আমার দেশের হতদরিদ্র সরল মানুষের জীবন, হিমালয়ের পদপ্রান্তে কত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রাম, আখরোট গাছ, গমখেত, দেওদার গাছের নির্জন ছায়া, কত মেঘ কুয়াশা আর রৌদ্রের ইতিবৃত্তান্ত আর সবাইকে আগলে নিয়ে বসে রয়েছেন সেই হৃদয়বান দীর্ঘ মানুষটি নিজে—যিনি পরবাসী হয়েও মাতৃভূমির মতো ভালবেসেছিলেন ভারতবর্ষকে, প্রতিবার নরখাদককে হত্যা করে যাঁর মন প্রেমকুসুম রেণুর মতো কোমল হয়ে উঠত, তিনিই আমাদের শিখিয়েছিলেন বন্যপ্রাণ সংরক্ষণের কথা। পরে জাঙ্গল স্টোরিস পুনরায় পরিমার্জনা করেন করবেট, নাম হয় ম্যান-ইটার্স অব কুমায়ুন। এবার আর নিজের পয়সায় নয়, বইটি ১৯৪৪ সালের অগস্ট মাসে বোম্বে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিত হয়। ওঁরা হাজার কপি ছেপেছিলেন এবং সবাইকে বিস্মিত করে দুই বছরেরও কম সময়ে নিউ ইয়র্ক অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে তৃতীয় মুদ্রণের সময় বইটি বিক্রি হয়েছিল পাঁচ লক্ষ ছত্রিশ হাজার কপি! একইসঙ্গে অনূদিত হয়েছিল ষোলোটি ভাষায়।

বইটি আপনার পড়া না থাকলে অদূরে শেরউড কলেজের সামনে বইয়ের দোকান থেকে এক কপি কিনে নিন। এবার দিনান্তের আবছায়ায় চলুন আমরা শৈলশহর ছেড়ে একটি ভাড়ার গাড়ি নিয়ে কালাধুঙ্গির পথে যাই—দুপাশে দেওদার আর পাইন গাছের নিঝুম সারি, ছায়ার অধিক আলোয় ভেসে আসছে বাতাসের নূপুরধ্বনি। এই বৈরাগী পথের শেষে কালাধুঙ্গি ছিল করবেট পরিবারের শীতাবাস, উত্তরের রুক্ষ নির্জীব শীতঋতু থেকে ওঁরা প্রতিবছর নভেম্বর কী অক্টোবরে চলে যেতেন ওখানে। ছোট্ট বাড়ি, চাষের খেত, গ্রাম্য বালকের দল, উঁচু পাহাড় থেকে ফসল খেতে নেমে আসা ঘুরালের দল—সব মিলিয়ে জিমের সে এক আশ্চর্য বালকবেলা! তবে সেকথা শুরু হওয়ার আগে ঐ দেখুন ধিকিধিকি অরণ্য শুরু হয়েছে, চোখ বন্ধ করলেই শতাব্দী-প্রাচীন এই জনপদ ও অরণ্য মনে দোলা দেয়। তখন নৈনিতাল ক্ষুদ্র পাহাড়ি গ্রাম, লেকের ও-মাথা থেকে এই মাথা অবধি জনবসতি, কয়েক ঘর পাহাড়ি গ্রামবাসী, একখান ছোট্ট বাজার, হাসপাতাল, আর্মির ক্যাম্প আর তার পরেই দিগন্তবিথারি অরণ্য। এমন পড়ন্ত বেলায় শোনা যায় কাকর হরিণের ভিতু ডাক, নির্জন পাকদণ্ডি পথে ভালুকের উৎপাত লেগেই রয়েছে, সঙ্গে নরখাদক শ্বাপদের ভয়… ঐ যে কালাধুঙ্গি দেখা যাচ্ছে, এখানে পা দিয়েই আমরা শুনব ‘কার্পিট সাহিব’-এর গল্প, তিনি এখনো এই জনপদে প্রাচীন কিংবদন্তি অথবা অরণ্য-প্রবাদের মতোন বেঁচে রয়েছেন।

কালাধুঙ্গি আজও নিথর জনপদ, ১৮০০ সালের শেষে এই জনবসতির নির্জনতার আভাস এখনো পাওয়া যায়। বাজার পার হয়ে বাউর নালার অদূরে ছিল করবেট পরিবারের ছোট্ট বাড়ি, নামটি ভারি মিষ্টি—আরুনডেল। এখন শুধুই ধ্বংসস্তূপ, পুটুস ঝোপের আড়ালে ঘুমিয়ে রয়েছে এক সাহেব পরিবারের আখ্যান।

তবে কল্পনায় দেখা যায় সেদিনের ঐ ছোট্ট আইরিশ কটেজ। কতগুলি আমগাছের ছায়ায় মধুর, সামনে শিমুল আর হলদি গাছ। বাবা মারা যাওয়ার পর এই কালাধুঙ্গি গ্রামেই মাত্র আটবছর বয়সে জিমের প্রকৃতিপাঠ শুরু হয়েছিল, সঙ্গী ছিল বড় দাদা টম করবেট—ভাইকে শুধু বন্দুক চালানোই নয়, ঐ বয়সেই মৃত জন্তুর চামড়া ছাড়ানোর কৌশলও সে শিখিয়েছিল, যার পোশাকি নাম ‘স্কিনিং’। বালক জিম আরুনডেলের হাতায় এয়ারগান দিয়েই ঐ বয়সে গাছ থেকে নির্ভুল নিশানায় শিমুল ফুল ঝরিয়ে ফেলতেন, পরবর্তিকালে ক্র্যাক শুটার করবেটের হাতেখড়ি কুসুম ঝরানোর এই খেলার মধ্য দিয়েই হয়েছিল।

অদূরেই ছোট-হলদিওয়ানি গ্রামে জিমের নতুন বাড়িটি এখন বনদপ্তরের সংগ্রহশালা, নাম দেওয়া হয়েছে—‘করবেট মিউজিয়াম’। ভারি সুন্দর কটেজ, দুপাশে মরশুমি ফুল, কতকগুলি আমগাছ, অন্দরসজ্জাও দেখার মতোন। পায়ে পায়ে সংগ্রহশালা থেকে বেরতেই কানে ভেসে আসে বালককণ্ঠ। ঐ যে দেখা যায়, বালক জিম কালাধুঙ্গি বাজার পার হয়ে নিঝুম অরণ্যের পথে চলেছে, সঙ্গী ছোট ভাই আর্চি আর তাদের বাড়ির কুলি রবিন। সুঁড়িপথ জনমানবহীন, শীতের শুরুর মুখে চারপাশ রুক্ষ, আলো-আঁধারি কুয়াশা মিহি কাপাসতুলোর মতোন চরাচর আবৃত করে রেখেছে। মাঝে মাঝেই তীক্ষ্ণ শব্দে ময়ূরের ডাক শোনা যায়, একটি ব্ল্যাক থ্রোটেড টিট মৃদু হুইসেলের শব্দ তুলে ডাকছে কোথাও—একটানা ডেকেই চলেছে। দীর্ঘকায় শালগাছগুলির উঁচু মাথায় কার্তিক মাসের সকালের নরম রৌদ্র যেন আতর সুবাস বিছিয়ে দিয়েছে। ক্রমশ গহিন হয়ে উঠছে অরণ্য অথচ আটবছরের এক বিস্ময়বালক তার চার বয়সি ছোট্ট ভাইয়ের সঙ্গে আপন খেয়ালে নির্ভয়ে হাঁটছে, পিছনে রবিন। বালকের মুগ্ধ চোখে অরণ্যদেবী মায়াকাজল পরিয়ে দিয়েছেন, হৃদয়ে দিয়েছেন প্রকৃতির অনন্ত রূপের ইশারা; ঐ অপরূপ বিভ্রম আজীবন জিমের মন থেকে মুছে যায়নি। পরবর্তিকালে রুদ্রপ্রয়াগের ত্রাস সেই হিংস্র নরখাদক লেপার্ডের পিছনে দিনের পর দিন অক্লান্ত হেঁটে যাওয়ার সময়ও তাঁর মনে হতো—কী আশ্চর্য এই অরণ্যজগৎ! একটি অশ্রুত সুর যেন কোনো অদৃশ্য বাজনদার বাজিয়ে চলেছেন, সে-কারণেই বোধহয় বর্ষাবিধৌত মেঘাবৃত রাত্রে শুধুমাত্র শব্দের ওপর নির্ভর করে লেপার্ডটিকে উঁচু মাচার ওপর থেকে গুলি মারার পর জিমের মন অবসাদে ভরে উঠেছিল—যেন কোনো প্রিয়জন, বহুদিনের খেলার সঙ্গী জগতের ধুলাখেলার শেষে ক্লান্তশরীরে অন্য ভুবনে ফিরে গেছে; শতাধিক মানুষের হত্যাকারী এক শ্বাপদ—যার ভয়ে দুটি বছর প্রায় শ্মশান হয়ে গিয়েছিল রুদ্রপ্রয়াগ ও সংলগ্ন বিস্তীর্ণ প্রান্তর। গ্রামের লোকরা বলত—ও কোনো জন্তু নয়, অশরীরী এক আত্মা। দিনের বেলাতেও নিঝুম মৃত্যুপুরী পাহাড়ি গাঁ-গঞ্জ, হাটবাজার। আর সূর্যের আলো পাহাড়ে মুখ লুকালেই বেজে উঠত মরণের ডঙ্কা। প্রতিবার ঐ লেপার্ডের সঙ্গে মোলাকাতের সমস্ত পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ার পরেও, চোখের সামনে একের পর এক অল্পবয়সি মানুষের নৃশংস মৃত্যুর পরেও, হ্যাঁ, জিম করবেটের মন ঐ শ্বাপদকে হত্যার পর অশ্রুসজল হয়ে উঠেছিল! এমন আশ্চর্য হৃদয়বান মানুষকে আমরা আজও শুধু ‘দক্ষ শিকারি’র উপাধির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখব? একবারও ভাবব না, বন্যপ্রাণের প্রতি আকুল ভালবাসা, প্রকৃতির ওপর কী অসীম নির্ভরতা থাকলে এবং ভারতের সহায়-সম্বলহীন হতদরিদ্র গ্রামবাসীর জন্য হৃদয়ে নীরব অশ্রুক্ষরণে একজন বিদেশি আইরিশ সাহেব ভারতাত্মার অন্তরে বয়ে চলা সেই চিরকালীন ভালবাসার সুরধুনীর স্রোতে নিজেকে আমৃত্যু বিছিয়ে দিতে পারেন? মানুষটির স্মৃতিকথার দিকে তাকিয়ে সেই চিন্তা করার সময় বোধহয় সমাসন্ন।

তাঁর মহাগ্রন্থ মাই ইন্ডিয়ার পাতায় তিনি প্রেম-রেণুর অক্ষরে লিখেছিলেন—সত্যিই এরা বড় গরিব; এদের প্রায়শই ‘ভারতের বুভুক্ষু কোটি কোটি মানুষ’ বলে বর্ণনা করা হয়ে থাকে কিন্তু এদের মধ্যেই আমি বসবাস করেছি, এদেরকেই আমি ভালবাসি। ভারতবর্ষের প্রকৃত সন্তানদের উদ্দেশে আমি আমার বইখানি শ্রদ্ধাভরে উৎসর্গ করলাম।

আক্ষরিকার্থেই মাই ইন্ডিয়া বইটি গাড়োয়াল হিমালয়ের প্রিয় ‘কার্পিট সাহিব’ তাঁর প্রকৃত আত্মীয়দেরকেই উপহার দিয়েছিলেন।

তবে এখন সেই পরিণতমনস্ক জিম সাহেবকে রেখে আমরা আবার চলে যাই ঐ বালকের কাছে, অরণ্যপথে আর্চিকে সঙ্গে নিয়ে সে যেন কোনো নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কারের নেশায় হাঁটছে। সহসা একটি কাকর হরিণের ব্বাক ব্বাক শব্দে চমকে উঠল নির্জল বনতলি, কেউ কিছু বোঝার আগেই অদূরে একটি অতিকায় ভারতীয় ভালুকের শরীর শাল জঙ্গলের মধ্যে দেখা দিয়েই ঘন ঝোপের মধ্যে আবার মিলিয়ে গেল। এখানে বলে রাখা ভাল, অরণ্যে বাঘ নরখাদক নাহলে তার দিক থেকে ক্ষতির সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই চলে। একলা দলছুট হাতি, পুরুষ হাতি বা মাকনা ও ভালুকের তুল্য বিপজ্জনক প্রাণী ভারতীয় উপমহাদেশের জঙ্গলে আর দ্বিতীয়টি নেই—বিশেষত ভালুক, সম্পূর্ণ বিনা প্ররোচনায় সে মানুষকে আক্রমণ করে তীক্ষ্ণ নখের আঘাতে হত্যা করে।

ভালুকটিকে দেখতে পেয়ে সতর্ক হয়ে ওঠে রবিন। এই শিশু-দুটির দায়িত্ব এখন তার, মুহূর্তের অবকাশে কোমরে বাঁধা ভোজালিটি বের করে সে সামনে এগিয়ে আসে, কিছু দমবন্ধ মুহূর্তের পর অবশ্য বোঝা যায় ভালুকটি কোনো অজ্ঞাত কারণে আত্মগোপন করে রয়েছে। অতি সাবধানে সেদিন শিশু-দুটিকে নিয়ে বাড়ি ফেরে রবিন। এই ঘটনা বালক জিমের মনে গভীর রেখাপাত করে, সম্ভবত তার জীবনের প্রথম আরণ্যক রোমাঞ্চ, পরবর্তী জীবনে করবেট সাহেব এই বিশ্বস্ত পাহাড়ি মানুষটিকে মনে রেখে নিজের অতি প্রিয় কুকুরের নাম রাখেন রবিন। কার্যত প্রথম রবিনের মতোন দ্বিতীয় রবিনও অরণ্যে শিকারের সময় বহুবার করবেট সাহেবের প্রাণরক্ষা করেছিল। সেই রবিনের মৃত্যুর পর তাকে কালাধুঙ্গির নতুন বাড়ির হাতায় জিম সমাধিস্থ করেন। আজও সেখানে রবিনের সমাধিটি রয়ে গেছে। পাশে একখানি নিম গাছ, চৈত্র মাসের ঝরঝর উদাসী বাতাসে সাহেবের চিরনিদ্রিত বন্ধুর সমাধির ওপর ঝুমঝুম শব্দে নিমফুল খসে পড়ে, কান পাতলে হয়তো শোনা যায় এক মানুষ ও না-মানুষের অপরূপ প্রেমাখ্যান।

কালাধুঙ্গির শৈশবেই বালক জিমের বন্ধু হয়ে ওঠে স্থানীয় দেশি গ্রাম্য বালক-বালিকার দল। তাদের নিয়ে জঙ্গলে রামগঙ্গা নদীর তীরে চড়ুইভাতি, বনমোরগ শিকার, শীতের রাত্রে উষ্ণ আগুন ঘিরে বসে গাঁও-মোড়লের মুখে শোনা বিচিত্র দেশীয় উপকথা, কত কিংবদন্তি, লোককথা, বাঘের হাতে মারা যাওয়া মানুষের অতৃপ্ত আত্মার করুণ বিলাপের সুর শোনার আখ্যান, অড়হর ডালের খেতে নেমে আসা কোটরা হরিণ কী শম্বর তাড়ানো, অলস মন্থর দুপুরে ছিপে মাছ ধরা, ধীরে ধীরে গাছপালা, পাখি, ফুল, নদী, ঝরনা চিনতে শেখা, অদূরে ধ্যানগম্ভীর হিমালয় পর্বতের নিঃসঙ্গ রূপ, রাত্রে মাথার ওপর নক্ষত্রের আঁচলে সাজানো অনন্ত আকাশ—এই রূপকথার ছেলেবেলাই প্রকৃতপক্ষে জিমকে পরিণত মানুষ করে তোলে। তার মুখের ভাষায় ঢুকে পড়ে দেহাতি শব্দ, শুরু হয় ভারতবর্ষের সঙ্গে বন্ধুত্ব। সারাজীবন ইংরেজি ও দেহাতি শব্দ মিশিয়ে কথা বলতেন জিম। এই অপূর্ব ছেলেবেলায় জিমের সঙ্গী ছিলেন আরেকজন মানুষ—উত্তর আমেরিকার প্রখ্যাত লেখক ফেনিমোর কুপার। তাঁর লেখা পাথফাইন্ডার বইটি ছিল জিমের সর্বক্ষণের সঙ্গী। আশ্চর্য মানুষ এই কুপার, অরণ্য ধ্বংস ও সামাজিক উন্নতির প্রশ্নে তিনি বরাবর পক্ষ নিয়েছিলেন অরণ্যবাসী মানুষের; আবেগ ও ভালবাসায় তৈরি করেছেন একের পর এক চরিত্র, শুনিয়েছেন বদ্ধ জমাট স্থবির জীবনের বিপরীতে এক রোমাঞ্চকর, আলো-বাতাসের মতোন চঞ্চল, সৎ, নির্ভীক ও অরণ্যপ্রেমে মুগ্ধ এক অপরূপ জীবনের কথা। আর এই বিচিত্র জীবন দেখার পথটির নাম দিয়েছিলেন ‘কুপারিয়ান ওয়ে অব লাইফ’!

বালক ও কিশোর জিমের কাছে সেই পথ যে গভীর নির্জন অন্তরঙ্গ সঙ্গী হয়ে উঠেছিল তা তাঁর পরবর্তী জীবনের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, এমনকী উত্তর আমেরিকার আরণ্যক মানুষের স্বর্গের প্রবাদ ‘হ্যাপি হান্টিং গ্রাউন্ডস’-এর কথা জিম তাঁর লেখা ম্যান-ইটার্স অব কুমায়ুন বইয়ে প্রিয় বন্ধু রবিনের মৃত্যুর কথা বলার সময় ব্যবহার করেছেন। অশ্রুদায়ী সেই স্মৃতিকথায় করবেট লিখেছেন: “I have told you the story, and while I have been telling it, Robin—the biggest -hearted and the most faithful friend man ever had, has gone to the Happy Hunting Grounds, where I know I shall find him waiting for me.”

জীবনটিও ছিল সত্যিই বিচিত্র, কোথাও তেমন থিতু হননি, ইস্কুলের পর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন বটে জিম কিন্তু পারিবারিক অভাবের কারণে তাঁকে রেলের চাকরি নিতে হয়, তখন তাঁর বয়স আঠারো। বেঙ্গল-নর্থ ইস্টার্ন রেলওয়ের ফুয়েল ইন্সপেক্টরের চাকরি, মাসে বেতন একশো টাকা, কর্মস্থল বিহারের মোকামাঘাট। এখানেই মধ্যভাগের ভারতবর্ষের সঙ্গে তাঁর অন্তরঙ্গ সখ্য গড়ে ওঠে।

এরপর অবশ্য চলে যান যুদ্ধে, পরপর দুটি— প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ও সেখান থেকে ফিরেই ১৯১৯ সালে ইন্দো-আফগান যুদ্ধ।

এর পূর্বেই শুরু হয়েছে তাঁর পেশাদার শিকার জীবন, ১৯১০ সালে প্রথম হত্যা করেন গাড়োয়ালের চম্পাবত অঞ্চলের বিভীষিকা এক বাঘিনীকে। প্রায়চারশো দশটি মানুষ হত্যার পর জিম তাকে মারেন, এই শ্বাপদ ইতিহাসে চম্পাবতের নরখাদক বাঘিনী হিসাবেই পরিচিত।

শুধু নরখাদক হত্যা করে সাধারণ দরিদ্র গ্রামবাসীর জীবনরক্ষা করতেন তাই নয়, এর পাশাপাশি নিজের বাড়ির কাছে তিনি একটি ‘নেচার স্টুডিও’ গড়ে তোলেন; লুকানো ক্যামেরায় ছবি উঠত বন্যপ্রাণের, সেটিই সম্ভবত পৃথিবীর প্রথম ওয়াইল্ড লাইফ ট্র্যাক ক্যামেরা।

সময় এগিয়ে চলে, জিমের বয়স বাড়ে, ভাইবোন-বাবা-মা সকলেই মারা যান। অকৃতদার মানুষটি ভারতবর্ষের স্বাধীনতার পর একমাত্র জীবিত বোন ম্যাগি করবেটকে সঙ্গে নিয়ে কেনিয়া চলে যেতে বাধ্য হন, এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে; পড়ে থাকে এখানকার জমিজমা-বসতবাড়ি, কিছু বিক্রি করেছিলেন, কিছু দান করেছিলেন গ্রামবাসীদের— যেমন কালাধুঙ্গির কাছে ছোট-হলদিওয়ানি গ্রামটি লিখে দেন পরিচিত বিশ্বস্ত একজন গাঁয়ের মানুষকে। হয়তো ইচ্ছা ছিল প্রাণপ্রিয় কুমায়ুনে আবার ফিরে আসবেন, কিন্তু অনির্দিষ্ট ভালবাসার পথে চলা মানুষের ঘরে ফেরা হয় না, তেমনই নিয়ম!

কালাধুঙ্গির এই বাড়িতেই ১৯৪৭ পর্যন্ত বাস করেন জিম করবেট

কেনিয়ায় ১৯৫৫ সালের ১৯ এপ্রিল পর চিরশুভ্র শ্বেতপাথরের সমাধিফলকে বামদিকে একখানি জংলা লতাফুলের ছবি এঁকে লেখা হয়—‘আনটিল দ্য ডে ব্রেকস অ্যান্ড দ্য স্যাডোস ফ্লি অ্যাওয়ে’!

তখন কত দূরে নৈনিতালের শুখাতালে রয়েছেন বালক জিমের বাবা-মা, আর দূর প্রবাসে কেনিয়ায় সমাধির ওপর সেখান থেকেই হয়তো ভেসে আসছে ভারতবর্ষের বাতাস। আমি চোখ বন্ধ করলে এখনো স্পষ্ট দেখতে পাই, খবর এসেছে দূর গ্রামে মানুষ মেরেছে নরখাদক বাঘ আর জিম খাকি জামাপ্যান্ট, হান্টিং শ্যু, মাথায় শোলার হ্যাট চাপিয়ে তৈরি হচ্ছেন, হাতে প্রিয় রিগবি রাইফেল। ম্যাগি দ্রুতহাতে গুছিয়ে দিচ্ছেন হোল্ডওল, সুটকেস। বিশ্বস্ত রবিন আর দেহাতি বন্ধু মাল বয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত। পাকদণ্ডি পথে হাঁটছেন এডওয়ার্ড জেমস করবেট। উজ্জ্বল রৌদ্রে আলোর সমুদ্রে পালতোলা নৌকার মতো বয়ে চলেছে বাতাস। দূরে তুষারশৃঙ্গগুলি যেন এই মায়া চরাচরের প্রহরী। অতিকায় ময়ালের মতো আঁকাবাঁকা পাহাড়ি পথের নিচে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কাঠের ঘরবাড়ি, চাষের ঝুমখেত—দরিদ্র সরল ভারতবাসীর প্রতিদিনের সংসার। মাঝে মাঝে আলতো কুয়াশার মতো মেঘে অস্পষ্ট হয়ে উঠছে চরাচর, আবার পরক্ষণেই কে যেন সযত্নে তাদের মুছে দিয়ে দৃশ্যমান জগতের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে। জিম জানেন, এই দেশটি বড় সুন্দর, এখানকার মানুষেরাও বড় ভাল, অসহায় মানুষগুলি তাঁর পথ চেয়েই বসে রয়েছে, সরল বিশ্বাস তাদের বারবার মনে করিয়ে দিচ্ছে— সাহেব এসে পৌঁছালেই সকল আতঙ্কের অবসান হবে।

তিনি আজও হাঁটছেন, সকল চোরাশিকারের বিপরীতে। ঝরা পাতা ও বিচিত্র বর্ণে সাজানো মধ্য চৈত্রের অরণ্যপথে হাঁটছেন ভারতবর্ষের প্রিয় ‘কার্পিট সাহিব’—যতদিন না এই দেশে নির্ভয়ে অরণ্যমাঝে শুখানালায় জল খেতে পারে ভিতু কোটরা বা সম্বরের দল, পাখির দল ফাঁদে না পড়ে উড়বে আনন্দে, আপনমনে রাজকীয় ভঙ্গিমায় ঘুরে বেড়াতে পারে অতিকায় দাঁতাল, আর সমাসন্ন সন্ধ্যায় কোনো পাথরের গুহামুখে উঠে দাঁড়াবে সেই অতিকায় রাজা— আমাদের জাতীয় পশু, যার মেঘমন্ত্রিত কণ্ঠস্বরে ঘোষিত হবে অভয়ারণ্যের বার্তা। যতদিন মানুষ ও বন্যপ্রাণের সংঘাতে একটি মানুষ বা পশুর মৃত্যু হবে, অরণ্যের অক্লান্ত চিরপ্রেমিকের চলা থামবে না।

সাহিত্যসেবী ও সফ্‌টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার

জিম করবেট রুদ্রপ্রয়াগে চিতাবাঘ শিকারের আগে মাচা তৈরি করছেন।