শান্তিনিকেতন থেকে ২ আশ্বিন ১৩৪৪ [শনিবার 18 Sep 1937] তারিখে পত্রাকারে লিখিত বিশ্বপরিচয় গ্রন্থের ভূমিকায় সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “আমি বিজ্ঞানের সাধক নই সে কথা বলা বাহুল্য৷ কিন্তু বালককাল থেকে বিজ্ঞানের রস আস্বাদনে আমার লোভের অন্ত ছিল না৷… পিতৃদেবের সঙ্গে গিয়েছিলুম ড্যালহৌসি পাহাড়ে৷… তিনি আমাকে নক্ষত্র চিনিয়ে দিতেন, গ্রহ চিনিয়ে দিতেন৷ শুধু চিনিয়ে দেওয়া নয়, সূর্য থেকে তাদের কক্ষচক্রের দূরত্বমাত্রা, প্রদক্ষিণের সময় এবং অন্যান্য বিবরণ আমাকে শুনিয়ে যেতেন৷… জ্যোতির্বিজ্ঞানের সহজ বই পড়তে লেগে গেলুম৷… স্যার রবর্ট বল-এর বড়ো বইটা আমাকে অত্যন্ত আনন্দ দিয়েছে৷ এই আনন্দের অনুসরণ করবার আকাঙ্ক্ষায় নিউকোম্ব্স, ফ্লামরিয়ঁ প্রভৃতি অনেক লেখকের অনেক বই পড়ে গেছি— গলাধঃকরণ করেছি শাঁসসুদ্ধ, বীজসুদ্ধ৷”
জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক রবীন্দ্রনাথ লিখিত একমাত্র গ্রন্থ বিশ্বপরিচয়-এর আত্মপ্রকাশকাল 1937 (১৩৪৪) খ্রিস্টাব্দকে মাইলস্টোন হিসাবে চিহ্নিত করলে আলোচ্য বিষয়টিকে দুটি বৃত্তে ভাগ করা যেতে পারে৷ একটি প্রস্তুতিপর্ব এবং অপরটি প্রকাশনাপর্ব৷
প্রস্তুতিপর্বে আলোচ্য গ্রন্থ প্রসঙ্গে উক্ত ভূমিকা অংশে সত্যেন্দ্রনাথকে রবীন্দ্রনাথ আরও লিখেছেন : “শ্রীমান প্রমথনাথ সেনগুপ্ত এম.এসসি. তোমারই ভূতপূর্ব ছাত্র৷ তিনি শান্তিনিকেতন বিদ্যালয়ে বিজ্ঞান-অধ্যাপক৷ বইখানি লেখবার ভার প্রথমে তাঁর উপরেই দিয়েছিলেম৷ ক্রমশ সরে সরে ভারটা অনেকটা আমার উপরেই এসে পড়ল৷ তিনি না শুরু করলে আমি সমাধা করতে পারতুম না৷ তা ছাড়া অনভ্যস্ত পথে শেষ পর্যন্ত অব্যবসায়ীর সাহসে কুলোত না৷ তাঁর কাছ থেকে ভরসাও পেয়েছি, সাহায্যও পেয়েছি৷”
প্রমথনাথের শান্তিনিকেতনে প্রথম আগমন প্রসঙ্গে কোনো নির্দিষ্ট তথ্য Visva-Bharati News বা অন্য কোথাও সম্ভবত প্রকাশিত হয়নি৷ আনন্দরূপম্ শীর্ষক প্রমথনাথের স্মৃতিগ্রন্থ থেকে জানা যায়, 1933 খ্রিস্টাব্দে তিনি সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অধীনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় নিযুক্ত হন৷ নির্দিষ্ট খ্রিস্টাব্দের উল্লেখ ছাড়াই উক্ত গ্রন্থে (পৃ.১৭) প্রমথনাথ লিখেছেন : “১৪ জুলাই শান্তিনিকেতনে পৌঁছোলাম, ১৫ জুলাই কাজে যোগ দিতে হবে৷ জীবনের একটা স্মরণীয় দিন বলে তারিখটা এখনও মনে আছে৷”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, Visva-Bharati News, December 1937 সংখ্যায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে তাঁর আগমনের আনুমানিক সময়কাল নির্ণয় করা সম্ভব৷
রবীন্দ্রভবনের ‘Ms.F. বিশ্বপরিচয়’ পাণ্ডুলিপির 1 থেকে 147 পৃষ্ঠাঙ্ক চিহ্নিত অংশটুকু আলোচ্য গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি৷ পরবর্তী অংশে আছে, গ্রন্থ সম্পর্কিত বিভিন্ন পত্র৷ উক্ত ১৪৭ পৃষ্ঠার মধ্যে ৬২ পৃষ্ঠা রবীন্দ্রহস্তাক্ষরের, ৬৭ পৃষ্ঠা বিশ্বপরিচয় গ্রন্থের প্রথম সংস্করণের মুদ্রিত পৃষ্ঠা হলেও রবীন্দ্রহস্তাক্ষরে সংশোধিত বা পরিমার্জিত এবং বাকি ১৮ পৃষ্ঠা ভিন্ন হস্তাক্ষরে লিখিত কিন্তু রবীন্দ্রহস্তাক্ষরে পরিবর্ধিত ও পরিমার্জিত; অনুমান করা যায় উক্ত পৃষ্ঠাগুলি সম্ভবত প্রমথনাথ লিখিত৷ পাণ্ডুলিপিটি যে প্রাথমিক খসড়া নয় সেকথা বলাই বাহুল্য, কারণ পূর্বপ্রকাশিত বিশ্বপরিচয় গ্রন্থের পূর্ব সংস্করণের মুদ্রিত পৃষ্ঠা সংকলিত৷ উক্ত পাণ্ডুলিপি ছাড়া আর কোনো পাণ্ডুলিপির সন্ধান পাই নি৷ পাণ্ডুলিপির পরিচয় প্রসঙ্গে বিশ্বভারতী কর্তৃক প্রদত্ত তথ্যানুসারে পৃষ্ঠাগুলিকে ‘প্রতিলিপি’ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে, সেখানে প্রমথনাথের প্রসঙ্গ নেই৷
বিশ্বপরিচয়-এর প্রস্তুতিপর্বে প্রমথনাথের সক্রিয় ভূমিকা প্রসঙ্গে শারদীয় অনুষ্টুপ ২০২১ [৫৬ বর্ষ ১ সংখ্যা] (পৃ. ১৬১-৮১) সংখ্যায় ‘‘বিশ্বরচনা’ থেকে বিশ্বপরিচয় : প্রমথনাথ থেকে রবীন্দ্রনাথ’ শীর্ষক প্রবন্ধে এবং আনন্দরূপম্ গ্রন্থ (সাহিত্য সংসদ (2021), পৃ. ৯-১৮)-এর ‘সূচনা কথা’ অংশে সঞ্জীব মুখোপাধ্যায় আনন্দরূপম্ এবং অন্যান্য গ্রন্থের অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করে তাঁর ব্যক্তিগত অভিমত ব্যক্ত করেছেন৷
স্মৃতিগ্রন্থ সম্পর্কে আমাদের অভিমত হলো : স্মৃতিগ্রন্থে উল্লিখিত সমস্ত তথ্যকে cross check না করে প্রামাণ্যতথ্য হিসাবে গ্রহণ করলে গবেষণায় অসঙ্গতি ঘটতে পারে৷ একথা স্মরণযোগ্য যে, বিশ্বপরিচয় গ্রন্থের প্রথম প্রকাশের প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পরে রবীন্দ্রমৃত্যূত্তরপর্বে 1970 খ্রিস্টাব্দে প্রথমে ধারাবাহিকভাবে সাপ্তাহিক বসুমতী পত্রিকায় এবং পরে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় আনন্দরূপম্ ৷ স্মৃতিচারণায় সর্বক্ষেত্রে ঐতিহাসিক পরম্পরা সম্ভবত রক্ষিত হয়নি৷ উদাহরণ স্বরূপ একটি বিষয়ের উল্লেখ করা হলো : জওহরলাল, কমলা ও ইন্দিরা নেহেরুর আগমন প্রসঙ্গে (পৃ. ৪৫-৪৬) যে তথ্য উল্লিখিত হয়েছে তা সম্ভবত প্রমথনাথের শান্তিনিকেতনে পঠন-পাঠনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পূর্বকালীন ঘটনা৷ Visva-Bharati News, February 1934 [Vol. 2, No. 8] সংখ্যায় ‘Jawaharlal at Santiniketan’ শিরোনামে লেখা হয় : “Pandit Jawaharlal Nehuru accompanied by his wife Sreejukta Kamala Devi and his Secretary Sjt. Upadhaya came here on the 19th January to pay a visit to Gurudeva.”
আনন্দরূপম্ গ্রন্থে (পৃ. ৪৫-৪৬) প্রমথনাথ লিখেছেন : “পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু সস্ত্রীক শান্তিনিকেতনে আসছেন কন্যা ইন্দিরাকে নিয়ে৷… যেদিন তিনি কমলাদেবী ও ইন্দিরাকে নিয়ে শান্তিনিকেতনে এলেন, সেদিন বিকেলে গুরুদেব সব অধ্যাপক ও কর্মীমণ্ডলীকে আমন্ত্রণ জানালেন উত্তরায়ণে৷”
আগমনের কারণ প্রসঙ্গে প্রমথনাথ লিখেছেন : ‘তাঁদের ইচ্ছা ইন্দিরা কিছুদিন এখানে থেকে শিক্ষাভবনে লেখাপড়া করুক’৷ বাস্তবিক উক্ত বিষয়ে আলোচনা করার কারণে কমলাদেবীকে সঙ্গে নিয়ে জওহরলাল যখন আসেন সেই সময়ে ইন্দিরাদেবী সঙ্গে ছিলেন না৷ তিনি এসেছিলেন আরো পরে কমলাদেবীর সঙ্গে৷ 2 July 1934 [সোমবার ১৭ আষাঢ় ১৩৪১] তারিখে অনিলকুমার চন্দকে চিঠিতে কমলাদেবী লিখেছেন : “I am accompanying Indira to Santiniketan. We shall reach there on 6th. I would like to stay there for two or three days.”
বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে ধীরেন্দ্রমোহন সেন স্বাক্ষরিত Indira Nehuru নামাঙ্কিত Provisional Permit-এর তারিখ 7 July 1934 [শনিবার ২২ আষাঢ় ১৩৪১]৷
নির্দিষ্ট তারিখের উল্লেখ ছাড়াই আনন্দরূপম্ গ্রন্থের তথ্যগুলি পরিবেশিত৷ উদাহরণ হিসাবে পৃষ্ঠাঙ্কসহ কয়েকটি উদ্ধৃত করা হলো : ‘সেইদিন সন্ধ্যার পর গুরুদেব ডেকে পাঠালেন উত্তরায়ণে৷… বললেন, ‘তোমার উপর একটা ভার দিতে চাই, বৈজ্ঞানিক বিষয়ে “লোকশিক্ষা” পাঠ্যগ্রন্থ প্রণয়ণের কাজ’ (পৃ. ২৩); ‘সেদিন থেকেই বিজ্ঞানের সহজ বই পড়তে লেগে গেলাম, তারপর ধীরে ধীরে শুরু হল বই লেখার কাজ’ (পৃ. ২৫); ‘‘বিশ্বরচনা’ বইয়ের প্রথম অধ্যায় ‘পরমাণুলোক’ লেখা শেষ হয়েছে৷ গুরুদেব সাগ্রহে গ্রহণ করলেন লেখাটা৷ বললেন যে, এরই প্রতীক্ষা করছিলেন’ (পৃ. ৩২); ‘তার পরদিন গুরুদেবের কাছে যেতেই বললেন ‘তোমার রচনা পড়েছি’,… (পৃ. ৩৪) ইত্যাদি৷ গ্রন্থকারের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে আমাদের অভিমত হলো : গবেষণাপত্রে এই জাতীয় স্মৃতিগ্রন্থের সমস্ত তথ্যকে অকাট্য প্রামাণ্য তথ্য হিসাবে গ্রহণ না করাই সমীচীন৷
১৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে শ্যামলী বাড়ির ছাদ নষ্ট হয়ে যাবার পর পুনশ্চ গৃহে অবস্থানকালের বর্ণনা প্রসঙ্গে রবিচ্ছায়া গ্রন্থে (মুক্তধারা 1972, পৃ. ৭০) প্রভাতচন্দ্র গুপ্ত লিখেছেন : “ফটকের কাছে যেতেই দেখলাম, একলা বসে আছেন ঘরে,… বললেন—“এই দেখ, একখানা new physics-এর (নব-পদার্থবিজ্ঞান) বই নিয়ে পড়তে বসেছিলাম৷”
প্রস্তুতিপর্ব প্রসঙ্গে আনন্দরূপম্ গ্রন্থে (পৃ. ৩০) প্রমথনাথ লিখেছেন : “ঘরে ঢুকে দেখি গুরুদেব প্রসন্নমুখে বসে আছেন, হাতে Sir Arthur Eddington-এর একখানা Astronomy-র Popular Series-এর বই, সামনে প্রকান্ড টেবিলের উপর আরও অনেক বই ও গুরুদেবের ছবি আঁকার লেখার সরঞ্জাম৷ স্মিত হাস্যে বললেন Popular Science Series-এর দুখানা বই আনিয়েছি৷ একখানা Arthur Eddington-এর আর একখানা James Jeans-এর৷… এদের মধ্যে অনেক নতুন তথ্য আছে যা বিশ্বপরিচয় গ্রন্থের পরমাণুলোক ও নক্ষত্রলোক অধ্যায়ে সন্নিবেশ করা যেতে পারে৷”
বিভিন্ন গ্রন্থ থেকে আহরিত তথ্যকে মাতৃভাষার মাধ্যমে কত সহজে সাধারণের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়, তারই সাধনায় মগ্ন ছিলেন উভয়েই৷ তথ্যগত সামঞ্জস্য দেখে রচনাদ্বয়ের মধ্যে একটিকে মৌলিক এবং অপরটিকে তার অনুকরণ হিসাবে চিহ্নিত করলে, বিচার বোধহয় যথোপযুক্ত হবে না৷
প্রমথনাথ ও রবীন্দ্রনাথের রচনাভঙ্গির তুলনামূলক আলোচনা অথবা রবীন্দ্রনাথের ‘সাহিত্যোচিত অতিরঞ্জন’-এর পরিমিতিবোধের পরিমাপ করা আলোচ্য প্রবন্ধের বিষয়বস্তু না হলেও, ‘বিশ্বরচনা থেকে বিশ্বপরিচয়’ শীর্ষক বিতর্কিত অধ্যায়ের মীমাংসা প্রয়োজন এবং সেইকারণেই প্রমথনাথের পাণ্ডুলিপি প্রথম লিখিত হওয়া সত্ত্বেও রবীন্দ্রনাথ লিখিত পরবর্তী পাণ্ডুলিপি গ্রন্থকারে রবীন্দ্রনাথ কেন স্বনামে প্রকাশ করলেন তার ইতিহাস-আলোচনা বোধহয় জরুরি। রবিজীবন-এর অনুপুঙ্খ আলোচনা করলে আমরা দেখতে পাব, সংশোধন করতে গিয়ে মূল রচনার রূপ প্রায় সম্পূর্ণ বদল হয়ে গেলে পরিবর্তিত রূপটি কখনো স্বনামে, কখনো বা ছদ্মনামে প্রকাশ করেছেন রবীন্দ্রনাথ। একবার বা দুবার নয়, অনেকবার। একটি উদাহরণ দেওয়া যাক। বিশ্বপরিচয় প্রকাশের প্রায় সাতাশ বছর পূর্বে প্রবাসী, অগ্রহায়ণ ১৩১৭ [১০ বর্ষ ২ খণ্ড ১ সংখ্যা] (পৃঃ ১৩২—৩৭) সংখ্যায় প্রকাশিত রচনা প্রসঙ্গে ২৭ ভাদ্র ১৩১৭ [সোমবার 12 Sep 1910] তারিখে চারুচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে লিখিত রবীন্দ্রপত্রটি উদাহরণ হিসাবে উল্লিখিত হলো। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “আজ রেজিস্ট্রি ডাকে দুটি সঙ্কলন পাঠাচ্ছি…। সঙ্কলনদুটির একটি হেমলতা বৌমা ও অন্যটি আমার কন্যার ভাগ্যে পড়েছিল—কিন্তু শোধন করতে করতে তাদের নিজস্ব এতই যৎসামান্য বাকি রয়ে গেল যে এই দুটি সঙ্কলনে তাদের নাম দেওয়া নিতান্ত অন্যায় হবে মনে করে এ দুটিকে বিনা নামেই চালােত ইচ্ছা করি।”
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, পত্রোল্লিখিত রচনা দুটির মধ্যে একটি, বড়দাদা দ্বিজেন্দ্রনাথের জ্যেষ্ঠ পুত্র দ্বিপেন্দ্রনাথের দ্বিতীয় পত্নী হেমলতাদেবী কর্তৃক লিখিত ‘সূফীমত’ এবং অপরটি কনিষ্ঠা কন্যা মীরাদেবী লিখিত ‘জৈনধর্ম্মতত্ত্ব’। রচনা দুটি ‘শ্রী’ ছদ্মনামে প্রকাশ করেন রবীন্দ্রনাথ। স্বল্প পরিসরে এসব ইতিবৃত্তের বিস্তারিত বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক সংশোধিত পাণ্ডুলিপির ইতিবৃত্তের হদিশ জানা থাকলে বিশ্বপরিচয়-এর ক্ষেত্রে আমাদের বক্তব্যের বিষয় বোধহয় বুঝতে সুবিধা হবে।
১৬ বৈশাখ ১৩৪৪ [বৃহস্পতিবার 29 Apr 1937] রথীন্দ্রনাথ, প্রতিমাদেবী, নন্দিতাদেবী, নন্দিনীদেবী, অনিলকুমার চন্দ-দের সঙ্গী করে পঞ্জাব মেল যোগে আলমোড়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন এবং সেখানকার কৃষি-বিজ্ঞানী বশীশ্বর সেন ও তাঁর মার্কিন পত্নী Sen, Emerson Gertude-এর সহযোগিতায় St. Marks নামক বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ৷ সম্ভবত ১৫ বৈশাখ ১৩৪৪ [বুধবার 28 Apr 1937] দিনটি সম্পর্কে আনন্দরূপম্ গ্রন্থে (পৃ. ১৫) প্রমথনাথ লিখেছেন : “গুরুদেব আলমোড়া যাবার আগের দিন অপরাহ্ণে বিশ্ব-পরিচয়-এর সমগ্র পাণ্ডুলিপি তাঁর হাতে পৌঁছে দিতে হবে এই ছিল তাঁর নির্দেশ৷… খুবই আগ্রহের সঙ্গে গুরুদেব পাণ্ডুলিপিটা গ্রহণ করলেন, বললেন যে, আলমোড়ায় নিভৃতে বসে ভাষার দিকটা আরও মাজাঘষা করার সময় পাবেন৷”
আলমোড়ায় অবস্থানপর্বে ২৬ বৈশাখ ১৩৪৪ [রবিবার 9 May 1937] কিশোরীমোহন সাঁতরাকে রবীন্দ্রনাথ চিঠিতে লিখেছেন : “বিশ্বপরিচয় বইখানা আজো নাড়াচাড়া মাজাঘষা করচি। বশীকে দেখিয়েছি যে অত্যন্ত খুশি হয়েছে- বইখানা ভালোই হবে।”
রচনা প্রসঙ্গে সফরসঙ্গী অনিলকুমার চন্দ ‘With Rabindranath in Almorah’ শীর্ষক রচনায় Visva-Bharati News, June 1937 [Vol. 5, No. 12] (pg. 95) সংখ্যায় লিখেছেন: It may surprise the world to know that he is deeply engrossed in writing a Science Primer in Bengali.
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, Visva-Bharati News, July 1937 সংখ্যায় অনিলকুমার লিখিত রচনার শিরোনাম ছিল ‘With Rabindranath at Almorah (II)’৷ সেখান থেকে তারিখহীন অপর একটি পত্রে কিশোরীমোহনকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “বিশ্বপরিচয় লেখাটা শেষ হয়েছে-সবটাই আমাকে নতুন করে লিখতে হোলো বলে দেরি হোলো”
তারিখহীনভাবে আনন্দরূপম্ গ্রন্থে (পৃ. ১২৫-২৬) প্রমথনাথ লিখেছেন : “জুন মাসে (যতদূর মনে পড়ে) আলমোড়া থেকে গুরুদেবের লেখা কার্ড পেলাম, ‘বিশ্ব-পরিচয় থেকে আমার কলম এখনও ছুটি পায়নি’৷… এর কয়েকদিন পরেই শুনলাম খবরের কাগজে নাকি বের হয়েছে— আলমোড়ার সংবাদদাতা জানাচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ বিশ্ব-পরিচয় নামে একখানা বিজ্ঞানের বই লিখেছেন, বিশ্বকবির হাত দিয়ে এখানাই প্রথম বিজ্ঞানের গ্রন্থ রচনা৷”
রবীন্দ্রনাথের লেখা উক্ত কার্ডের কোনো হদিশ পাইনি এবং প্রমথনাথ উল্লিখিত ‘খবরের কাগজে’ প্রকাশিত সংবাদও উদ্ধার করতে পারিনি৷ আলমোড়া থেকে কলকাতা হয়ে ১৯ আষাঢ় ১৩৪৪ [শনিবার 3 Jul 1937] তারিখে সম্ভবত শান্তিনিকেতনে প্রত্যাবর্তন করেন রবীন্দ্রনাথ৷ নির্দিষ্ট কোনো তারিখ ছাড়াই উক্ত স্মৃতিগ্রন্থে (পৃ. ১২৬) প্রমথনাথ আরো লিখেছেন : “গ্রীষ্মের ছুটির পর গুরুদেব আলমোড়া থেকে ফিরে একদিন সন্ধ্যের সময় ডেকে পাঠালেন৷… তারপর বললেন—‘দেখো, বিশ্ব-পরিচয় লিখতে লিখতে দেখলুম এর ভাষাটা আমারই হয়ে গেছে, তাই এর মধ্যে তোমাকে কোথাও স্থান দিতে পারলুম না’৷… এই তো গেল বিশ্ব-পরিচয় গ্রন্থ রচনার ইতিবৃত্ত৷
প্রস্তুতিপর্ব শেষে বিশ্বভারতী গ্রন্থালয় থেকে কিশোরীমোহন সাঁতরা কর্তৃক ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের আশ্বিন মাসে গ্রন্থাকারে প্রথম প্রকাশিত হয় বিশ্বপরিচয় ৷ প্রকাশনাপর্বে সন্ধান পাওয়া অনেকগুলি পত্রের পূর্ণবয়ান সম্ভবত আজও অপ্রকাশিত৷ কালানুক্রমিক আলোচনায় সেগুলি সংকলিত হলো৷ সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে উৎসর্গীকৃত বিশ্বপরিচয়-এর ভূমিকার তারিখ উল্লেখ করে রবীন্দ্রজীবনী-কার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় (৪ খণ্ড, পৃ. ১০৮) লিখেছেন : “ছাপার কাজ ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের ভাদ্র মাসেই
শেষ হয়ে গিয়েছিল। ২ আশ্বিন (১৩৪৪) কবি ভূমিকা লিখিয়া দিলে উহা প্রকাশিত হইল।”বেঙ্গল লাইব্রেরির ক্যাটালগে গ্রন্থভুক্তির তারিখ ২২ আশ্বিন ১৩৪৪ [শুক্রবার 8 Oct 1937]৷ কিন্তু তার আগেই গ্রন্থপ্রকাশ প্রসঙ্গে 5 Oct 1937 [মঙ্গলবার ১৯ আশ্বিন ১৩৪৪] চিঠিতে সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রকে লিখেছেন : ‘বিশ্বপরিচয় বইখানা তোমাকে পাঠিয়ে দিতে লিখে দিলুম…’৷ উক্ত তারিখেই পত্র মারফৎ কিশোরীমোহনকে নির্দেশ দিয়েছেন : “সুরেন্দ্র মৈত্রকে বিশ্বপরিচয় ও ছবির ছড়া [য] পাঠিয়ে দিয়ো৷ বিশ্বপরিচয় সম্বন্ধে তাঁর অভিমত শোনবার যোগ্য৷”
6 Oct 1937 [বুধবার ২০ আশ্বিন ১৩৪৪] হেমন্তবালাদেবীকে লিখেছেন : ‘তোমাকে বিশ্বপরিচয় ও ছড়ার ছবি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে খবর পেয়েছি’৷ সম্ভবত পরের মাসে প্রমথনাথ শান্তিনিকেতন ত্যাগ করে ঢাকা যান৷ উক্ত প্রসঙ্গে Visva-Bharati News, December 1937 [Vol. 6, No. 6] (pg. 47) সংখ্যায় লেখা হয় : “Pramathanath Sen Gupta, who served the institution for the last four years as adhyapakaa of physics in the Siksha-Bhavana left us early last month to join the Dacca Intermediate College.”
প্রথম সংস্করণ প্রকাশের পর সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে লিখিত চিঠির উল্লেখ পাওয়া গেলেও মূল পত্রের হদিশ পাওয়া যায়নি৷ উক্ত সংস্করণের পর সংশোধন ও পরিমার্জন প্রসঙ্গে 11 Dec 1937 [শনিবার ২৫ অগ্রহায়ণ ১৩৪৪] নির্মলকুমারীকে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন :
“সেই বিশ্বপরিচয়ের সংস্কার করতে বসেছি৷ সত্যেন্দ্রকে যে চিঠি লিখেছিলুম, সাড়া পাইনে, বোধ হচ্ছে গাণিতিক সমস্যার মধ্যে জড়িয়ে পড়েছে— লজ্জা হয় ওকে ইস্কুলমাস্টারি সংশোধনের কথা বলতে৷… আমি তাই এডিংটন প্রভৃতি ওস্তাদের বই পাশে রেখে অতি সাবধানে মেরামতের কাজে লেগেছি— তবু কিছু কাঁচা থেকে যাবে৷”
প্রথম সংস্করণের পর সংশোধন-পরিমার্জন প্রসঙ্গে 31 Dec 1937 [শুক্রবার ১৬ পৌষ ১৩৪৪] অপর এক পত্রে নির্মলকুমারীকে আরো লিখেছেন : “প্রাণপণ চেষ্টায় বিশ্বপরিচয়ের সংস্কার সাধন করচি৷ ভুল আছে ত খবর পেয়েছি কিন্তু কোথায় ভুল নির্দেশ না পাওয়াতে ডাইনে বাঁয়ে ওস্তাদ লেখকদের বইয়ের পাতা খুলে নিজের ত্রুটি হাতড়াচ্ছি৷ দু চারটে বড়ো বড়ো আগাছা নিড়িয়েছি৷ আরও কোথায় কী লুকিয়ে আছে তাদের খোঁজ পাওয়ার মতো সাধনা আমার নেই৷… এদিকে অবিলম্বে সংশোধিত কপি নেবার জন্য কিশোরী বসে আছে৷”
প্রথম সংস্করণের পর বর্জিত অংশের উদ্ধৃতিসহ পরিমার্জন, পরিবর্জন-এর বিস্তারিত আলোচনা আছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত রবীন্দ্র-রচনাবলী, ষোড়শ খণ্ড (2001, পৃ. ১৩২৬-২৮)-এর গ্রন্থপরিচয়-এ। 1938 খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে (আখ্যাপত্র অনুযায়ী পৌষ ১৩৪৪) গ্রন্থের দ্বিতীয় সংস্করণ প্রসঙ্গে 11 Jan 1938 [মঙ্গলবার ২৭ পৌষ ১৩৪৪] কিশোরীমোহনকে লিখেছেন : “বিশ্বপরিচয় পাওয়া গেল৷ দ্বিতীয় সংস্করণ একখণ্ড যেন সত্যেন্দ্রকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়৷”
সংস্করণটি তাড়াতাড়ি নিঃশেষ হওয়ায় পরের মাসেই অর্থাৎ ১৩৪৪ বঙ্গাব্দের মাঘ মাসে পুনর্মুদ্রণ করতে হয়৷ উক্ত প্রসঙ্গে অপর একটি পত্রে কিশোরীমোহনকে 20 Jan 1938 [বৃহস্পতিবার ৬ মাঘ ১৩৪৪] লিখেছেন : “বিশ্বপরিচয়ের এত অত্যাধিক খাতির দেখে বিস্মিত হলুম৷ অবশ্য এ বইটির জন্য যত পরিশ্রম করেছি এমন কোনো বইয়ের জন্য করি নি— পরিশ্রম সার্থক হলো৷ ভেবেছিলুম পরবর্তী সংস্করণকে আরও পরিপূর্ণ করব কিন্তু সময় হবে না৷… বিশ্বপরিচয় যদি ছাপতে হয় তাহলে যথোচিত জায়গায় অর্ডর দিয়ো৷”
7 Mar 1938 [সোমবার ২৩ ফাল্গুন ১৩৪৪] চারুচন্দ্র দত্তকে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “একটা নিবেদন আছে৷ বিশ্বপরিচয় দিয়ে পরিচয়ের প্রথম ভূমিকা করে দিয়েছি—…কিন্তু তার পরে চাই আলাপ— আমার বিদ্যে ওখানে থই পায় না,… আসরে আপনাকে নাবতেই হবে৷ এবার ভূপরিচয়ের পালা৷”
দ্বিতীয় সংস্করণের পৃষ্ঠাঙ্ক সহ তথ্যের অসংগতিগুলি চিহ্নিত করে 19 Apr 1938 [মঙ্গলবার ৬ বৈশাখ ১৩৪৫] তারিখে প্রেসিডেন্সি কলেজের অঙ্কের অধ্যাপক জ্যোতির্ময় ঘোষ রবীন্দ্রনাথকে একটি পত্র লেখেন৷ পত্রটি সম্ভবত অপ্রকাশিত৷ সেই কারণে পূর্ণবয়ান উদ্ধৃত হলো৷ জ্যোতির্ময় লিখেছেন :
শ্রীচরণেষু, 19.4.1938
আপনার ‘বিশ্ব-পরিচয়’ পড়িলাম৷ পড়িতে পড়িতে কয়েকটি ত্রুটি চোখে পড়িল, তাহাই লিপিবদ্ধ করিয়া আপনাকে পাঠাইলাম৷ অবসরমত পড়িয়া দেখিবেন৷
নমস্কার জানিবেন৷ ইতি
বিনীত শ্রীজ্যোতির্ময় ঘোষ
বিশ্ব-পরিচয়
(পৃ: ১১)
Indigo-কে অতিনীল বলা হইয়াছে৷ ৪৪ পৃষ্ঠায় আছে—“ঘন নীলরঙের আলোর…৷” এস্থলে ঘন নীল কি indigo? যদি তাহাই হয়, তাহা হইলে এস্থলেও অতিনীল বলা উচিত৷
(পৃ: ১৩)
“বর্ণলিপি” ও “বর্ণচ্ছটা” বোধ হয় একই অর্থে ব্যবহৃত হইয়াছে৷ যদি তাহা হইয়া থাকে, তাহা হইলে দুইটি শব্দ ব্যবহার না করিয়া একটি শব্দ ব্যবহার করাই যুক্তিসঙ্গত৷ এই ক্ষুদ্র পুস্তকে এত বেশি নূতন কথা আছে, যে একার্থবোধক একাধিক শব্দ ব্যবহার না করাই সমীচীন৷
(পৃ: ১৯)
‘তর্জমা’ কথাটা বাদ দিয়া ‘অনুবাদ’ বলিলেই ভাল হয়৷
পজিটিভ=হাঁ-ধর্মী, নেগেটিভ=না-ধর্মী৷ কিন্তু ২১ পৃষ্টায় বলা হইতেছে ‘পজিটিভধর্মী’ এবং ‘নেগেটিভধর্মী’৷ ভাষাগত সামঞ্জস্য আবশ্যক৷
(পৃ: ২২)
“কখনো কখনো দেখা গেছে বিশেষ হাইড্রোজেনের…”৷ হাইড্রোজেন মৌলিক পদার্থ, সুতরাং বিশেষ হাইড্রোজেন কি, একটু বুঝাইয়া বলা আবশ্যক।
ন্যুট্রন=Neutron. ইংরাজি শব্দটিতে য-ফলা কোনো সংকেত নাই৷ ‘নিউট্রন’ হইলেই ভাল হয়৷ কথাটি যদি Nyutron হইত, তাহা হইলে বাংলায় ‘ন্যুট্রন’ লেখা চলিত৷
(পৃ: ২৫)
“ইংরেজ বিজ্ঞানী রদরফোর্ড পরমাণুরহস্যকে…৷ আরেক পণ্ডিত প্রমাণ করলেন যে…৷ অবশেষে এক গণিত–বিজ্ঞানী প্রমাণ করলেন…৷” এস্থলে উক্ত “আরেক পণ্ডিত” এবং “এক গণিত-বিজ্ঞানীর” নাম দেওয়া হইল না কেন? ইঁহারা উভয়েই প্রসিদ্ধ ব্যক্তি৷
(পৃ: ২৮)
“ভিজে হাওয়ার অনুকণার…৷” অনুকণা কি?
(পৃ: ২৯)
ব্যন্টগন্ রশ্মি৷ “রেন্ট্গেন” হইলেই ভাল হয়৷ য-ফলার কোনো ঈঙ্গিত মূলশব্দে নাই৷ Rӧntgen শব্দের Ӧ-এর উচ্চারণ এ-র কাছাকাছি, এবং e-এর উচ্চারণ স্পষ্ট এ৷
(পৃ: ৩৩)
(উপর হইতে দ্বিতীয় লাইন)—‘চার’ নয় ‘আট’৷ পৃথিবীর এক মেরু হইতে অন্য মেরুর দূরত্ব কেন্দ্র দিয়া আট এবং বিষুবরেখার উপর দিয়া সাড়ে বারো হাজার মাইল৷
(পৃ: ৩৪)
“যন্ত্রশক্তির বল” শ্রুতিকটু৷ শুধু ‘যন্ত্রের শক্তি’ বলিলেই অর্থ স্পষ্ট হয়৷
(পৃ: ৩৫)
কস্মিক রশ্মি৷ কস্মিক লিখিলেই ভাল হয়, কারণ বাংলায় স্ম-এর উচ্চারণ পৃথক৷ ‘কস্বা’র কোন অধিবাসীকে পত্র লিখিয়া যদি অকস্মাৎ ঠিকানায় ‘কস্বা’ লেখা হয়, তাহা হইলে কস্মিন্ কালেও তিনি পত্র পাইবেন না। ৩৬ পৃষ্ঠায় ঠিক কস্মিকই লেখা হইয়াছে৷
(পৃ: ৩৯)
“মানুষের মান্ধাতার পরমায়ু দরকার হবে”৷ সর্বাপেক্ষা দূরের গ্রহের সূর্যাবর্ত্তনকাল তিন শ বছরের বেশী নয়৷ মান্ধাতার পরমায়ু এর চেয়ে অনেক অনেক বেশী৷
“নক্ষত্রের ভিড়…ছুটছে৷” ভিড় ছুট্ছে—শ্রুতিকটু৷
(পৃ: ৪০)
“…ধুলোর কণা যদি রেখে দেওয়া যায়…”৷ কণাগুলি একত্র রেখে দিলে তো হবে না৷ সুতরাং বলা উচিত, “…ধুলোর কণা যদি পরস্পর হতে সমান দূরে রেখে দেওয়া যায়…”
(পৃ: ৪১)
নেব্যুলা—নেব্যুলে৷ Nebula, Nebulae, য-ফলার কোনো সংকেত নাই৷ ব’য় য-ফলা কেন হইল? ae-এর উচ্চারণ ‘ঈ’, ‘এ’ নহে৷ সুতরাং নেবুলা—নেবুলী হইলেই ভাল হয়৷ যেমন, সীজার, ফরসুলী ইত্যাদি৷
ন্যুটন৷ আবার য-ফলা! Newton-এর মধ্য য-ফলার ঈঙ্গিত কোথায়?
পৌঁচচ্ছে৷ একথাটি হইবে পৌঁছচ্ছে৷ ক্রিয়াপদটি ‘পৌঁছান’—‘পৌঁচান’ নয়৷
প্রতিবেশীর অপভ্রংশরূপে ‘পড়্শী’ হইলেই ভাল হয়৷
“অ্যাড্রোপীডা”য় ঈকার কেন?
“এক দূরবীন তার ভিতর খুব বড়ো এক নীহারিকা দেখা গেছে”৷ ‘তার ভিতর দিয়ে খুব বড়ো…’ এইরূপ হইবে৷ দূরবীনে ঈকার কেন? দূরবীক্ষণের অপভ্রংশ বলিয়া? তাহা হইলে ‘পড়শী’ কি দোষ করিল?
(পৃ: ৪৪)
“আলোর ঢেউয়ের পরিমাপ…”৷ পরিমাপের পরিবর্তে দৈর্ঘ্য হইলে ভাল হয়৷
(পৃ: ৪৬)
“ঐ পদার্থটি স্থির থাকলে যে পরিমাণ দৈর্ঘ্যের আলো… পারত কাছে এলে তার চেয়ে বেশি দেয়, দূরে গেলে তার চেয়ে কম দেয়৷”
‘কাছে এলে এবং দূরে গেলে’—ইহা ঠিক নয়৷ কোন পদার্থ কাছে এলে বা দূরে গেলে তাহার আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য পরিবর্তিত হয় না৷ কোনো জ্যোতিষ্মান্ পদার্থের দ্রষ্টার অভিমুখে অথবা তা বিপরীত দিকে গতি থাকিলে তৎকর্তৃক বিচ্ছুরিত আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পরিবর্তন হয়৷
(পৃ: ৪৭)
“একটা চ্যাপটা ঘুরপাক-খাওয়া জগৎ…৷” ঘুরপাক-খাওয়া কথাটি বুঝা গেল না৷
(পৃ: ৪৮)
‘…সূর্যের গতিবেগ এক সেকেন্ডে দুশো মাইল’৷ ৫৭ পৃষ্ঠায় আছে, ‘সূর্য দৌড়চ্ছে সেকেন্ডে বারো মাইল বেগে’৷ এই দুইটি কথার সামঞ্জস্য আবশ্যক৷
(পৃ: ৪৯)
মহাটান৷ কথাটা শ্রুতিকটু৷ একটি কুমড়া আকারে বড় হইলে তাহাকে মহাকুমড়া বলিলে ভাল শুনাইবে না৷
(পৃ: ৪৮)
Power of gravitation স্থলে force of gravitation হইলে ভাল হয়৷ গণিতে force এবং power একার্থবোধক নহে৷
(পৃ: ৫০)
‘কুন্ডলীচক্র পাকানো’ কথাটি একটু বেশী পাকানো হইয়াছে৷ শুধু ‘কুন্ডলিত’ বলিলেই সম্পূর্ণ অর্থবোধ হয়৷
(পৃ: ৫৭)
‘দানব তারা’৷ অতিকায় তারা বলিলেই ভাল হয়৷ giant star-এর অনুবাদ ‘দানব তারা’ কতকটা সুবর্ণসুযোগের মত মনে হয়৷
‘লাঠিম’ অপেক্ষা ‘লাটিম’ ও ‘লাট্টু’ কথাগুলি অধিক প্রচলিত৷
(পৃ: ৫৯)
‘নক্ষত্রেরা পরস্পর… ঘুরে বেড়াচ্ছে বলে…’৷ নক্ষত্রের গতি আছে সত্য, কিন্তু তাহাকে ‘ঘুরিয়া বেড়ান’ বলা ঠিক হইবে না৷ গ্রহ, উপগ্রহ, ধুমকেতু, উল্কা প্রভৃতি সকলেরই গতি আছে৷ ‘ঘুরিয়া বেড়ান’ কথাটি বরং এইগুলির পক্ষে প্রযোজ্য৷ নক্ষত্র সম্বন্ধে ওকথা বলিলে সাধারণ পাঠকের মনে ভ্রান্ত ধারণা হইবে৷ ময়রার দোকানে মাছি ভন্ ভন্ করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়৷ তাই বলিয়া হাইকোর্টের জজদের সম্বন্ধে বলা ঠিক হইবে না যে তাঁহারা ঘুরিয়া বেড়ান, যদিও তাঁহারাও সচল৷
‘গ্রহপরিচয়ওয়ালা নক্ষত্রসৃষ্টি… ব্যাপার’৷ এই বাক্যের সমস্ত কথাগুলিই সাধু সংস্কৃত কথা৷ ইহার মধ্যে ‘ওয়ালা’ বড়ই বেমানান হইয়াছে৷ ‘সমন্বিত’ হইলেই ভাল হয়৷
(পৃ: ৫৯-৬০)
‘ব্রহ্মাণ্ডের অন্ত-গোলকসীমা কেঁপে উঠতে উঠতে…৷’ অন্তগোলকসীমা কথাটির পরিবর্তে শুধু গোলকসীমা হইলেই ভাল হয়৷
(পৃ: ৬৫)
‘সূর্যের যে দাগ…৷’ Sun-spot এর বাংলা সৌরকলঙ্ক হইলে দোষ কি?
(পৃ: ৭০)
‘ওর মুণ্ডটা উল্কাপিণ্ড দিয়ে তৈরি৷’ উল্কাপিণ্ড কিরূপ বস্তু তৎসম্বন্ধে কিছু না বলিলে তদ্বারা প্রস্তুত দ্রব্যের বিবরণ বুঝা যায় না৷
(শেষ লাইন) mass-কে ওজন বলা ঠিক হইবে না৷ ৭৩ পৃষ্ঠায় বস্তুমাত্রা বলা হইয়াছে৷ ইহা চলিতে পারে, কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত-পরিভাষায় প্রদত্ত ‘ভর’ কথাটি ব্যবহার করা যাইতে পারে৷ mass ওজন নহে৷
(পৃ: ৭৮)
‘বৃহস্পতি অতিকায় গ্রহ, …, পৃথিবীর চেয়ে তোরোশো মাইল৷’ পৃথিবীর চেয়ে তেরোশো মাইল— একথার অর্থ কি?
(পৃ: ৮৪)
‘তাপমাত্রা হবে ২৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে’৷ অর্থাৎ ২২৯ ডিগ্রি বা ২২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড৷ কিন্তু বক্তব্য তো তা নয়, কারণ পরেই আছে—এত শীতে অত্যন্ত দুরন্ত গ্যাসও তরল এমন কি নিরেট হয়ে যায়৷ তাপমাত্রা ২৩০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে হইলেই এ ব্যাপার সম্ভব নয়৷ আসল কথাটা এই, ‘তাপমাত্রা হবে সেন্টিগ্রেডের শূন্যের ২৩০ ডিগ্রি নিচে৷’ ভাষাটা একটু অসতর্ক হইয়াছে৷
(পৃ: ৯৪)
‘বাতাসকে যৌগিক পদার্থ বলে না৷’ যৌগিক কথাটার অর্থ কী? কবিতায় যেমন প্রদোষ বলিলে প্রভাত বুঝায়, তেমনি বিজ্ঞানে কি যৌগিক বলিলে মৌলিক বুঝায়?
(পৃ: ৯৮)
‘শরীরে জ্বরজারি বাতের ব্যথা৷ ও…৷’ জ্বরজারি কথাটা শুনিতে কেমন কেমন হইয়াছে৷
(পৃ: ৯৯)
‘অমীবা’৷ অ্যামিবা হইলেই ভাল হয়৷ ঈ-কারের প্রয়োজন কী?
সাধারণ বক্তব্য
বিজ্ঞানের প্রায় সমস্ত জটিল সমস্যাগুলি এত অল্পপরিসরের মধ্যে ব্যক্ত হওয়ায়, বক্তব্যবিবরণীগুলি সহজবোধ্য হয় নাই৷ পরমাণুলোক এবং নক্ষত্রলোক এই দুইটি অধ্যায়ই সাধারণ পাঠকের নিকট প্রায় অবোধ্য হইয়াছে৷
Atom, Electron, Proton প্রভৃতি সবই উল্লিখিত হইয়াছে, কিন্তু molecule—সম্বন্ধে কোথাও কিছু বলা হয় নাই৷
ব্রহ্মাণ্ডের বিবরণ হইতে ছায়াপথ (আকাশপথ) বা Milky Way একেবারে বাদ পড়াটা অত্যন্ত বিসদৃশ৷ যে কোনো রাত্রে পরিষ্কার আকাশের দিকে চাহিলেই সে বিরাট বস্তুটি আমাদের নয়নপথে উদিত হয় এবং যাহাকে অবলম্বন করিয়া ব্রহ্মাণ্ডের আকার, আয়তন প্রভৃতি বিষয়ে বর্তমান যুগের নূতনতম গবেষণাসমূহ অগ্রসর হইয়াছে, তাহার নামোল্লেখ পর্যন্ত নাই!
Frontispiece-এর চিত্রটি ব্যতীত মাত্র দুইখানি চিত্র এই পুস্তকে আছে, একখানি শনির এবং অপরটি ধূমকেতুর৷ আমাদের কুসংস্কারদূরীকরণ এই পুস্তকের অন্যতম উদ্দেশ্য নয় তো!
শ্রীজ্যোতির্ময় ঘোষ
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আলোচ্য বিষয়ে অনেকগুলি অপ্রকাশিত পত্রের সন্ধান পাওয়া যায়৷ স্থানাভাবে সবগুলির পূর্ণ বয়ান দেওয়া সম্ভব হলো না৷
১৮ বৈশাখ ১৩৪৫ [রবিবার 1 May 1938] আনন্দবাজার পত্রিকা-র ‘পুস্তক পরিচয়’ অংশে লেখা হয় :
‘বিশ্বপরিচয়ের’ আরও বিশেষত্ব এই যে, এখানি বিজ্ঞানের বই৷ পরমাণু, নক্ষত্র, সৌরজগৎ প্রভৃতি ইহার আলোচনার বস্তু৷ এমনি সব বিষয় নিয়েও যে কত সরল ও সহজ ভাষায় রচনা করা চলে তাহা প্রদর্শন করা বোধ হয় একা রবীন্দ্রনাথের পক্ষেই সম্ভব ছিল৷ কিন্তু ভাষা লঘু হইলেও রচনার জ্ঞানগৌরব লঘু নহে৷
গ্রন্থের সংশোধিত তৃতীয় সংস্করণের ভূমিকায় 27 Jun 1938 [সোমবার ১২ আষাঢ় ১৩৪৫] কালিম্পঙ থেকে লিখেছেন : “সহজ ভাষায় বিজ্ঞানের ব্যাখ্যার ছাঁচ গড়ে দেবার ইচ্ছা আমার মনে ছিল৷ আশা ছিল বিষয়বস্তুর ত্রুটিগুলির সংশোধন হতে পারবে বিশেষজ্ঞদের সাহায্যে৷… কৃষ্ণনগর কলেজের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত বিভূতিভূষণ সেন এবং বোম্বাই থেকে শ্রীযুক্ত ইন্দ্রমোহন সোম বিশেষ যত্ন করে ভুলগুলি দেখিয়ে দেওয়াতে সেগুলিই সংশোধন করবার সুযোগ হল৷”
প্রেসিডেন্সি কলেজের জ্যোতির্ময় ঘোষ প্রেরিত পত্রের প্রসঙ্গ রবীন্দ্রনাথ উল্লেখ করেননি এবং উক্ত পত্র প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখিত উত্তরপত্রেরও সন্ধান পাইনি৷ কৃষ্ণনগর কলেজের বিভূতিভূষণ সেন শুদ্ধিপত্রটি সরাসরি রবীন্দ্রনাথের কাছে পাঠাননি৷ উক্ত কলেজের অপর অধ্যাপক জিতেন্দ্রমোহন সেন মারফৎ প্রেরিত হয়েছিল৷ 3 May 1938 [মঙ্গলবার ২০ বৈশাখ ১৩৪৫] তারিখের পত্রের সঙ্গে বিভূতিভূষণ লিখিত শুদ্ধিপত্র পাঠিয়ে অনিলকুমার চন্দকে জিতেন্দ্রমোহন লিখেছেন : “আমাদের কলেজের গণিতের অধ্যাপক শ্রীযুক্ত বিভূতিভূষণ সেন জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিশেষ পাণ্ডিত্য লাভ করেছেন৷ তিনি বিশ্ব-পরিচয় বইখানির কয়েকটী কথা পরিবর্তন করে দিলে ভাল হয় মনে করেন— ভাষার দিক থেকে নয়, তত্ত্বের দিক থেকে পরিবর্ত্তনগুলি বইখানিকে নির্ভুল করবে বলে মনে হয়৷ তিনি যে পরিবর্ত্তনগুলি সম্বন্ধে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তা ধারাবাহিকভাবে লিখে দিয়েছেন৷ তাঁর লেখা কাগজখানি আপনার কাছে পাঠালাম৷ আপনি নিজে দেখে যদি ভাল মনে করেন তা’হলে গুরুদেবকে দেখতে দেবেন৷”
স্থানাভাবে উক্ত শুদ্ধিপত্রের পূর্ণ বিবরণ দেওয়া গেল না৷ তবে দ্বিতীয় সংস্করণের ৩৩, ৪১, ৪৮, ৫৫, ৬২, ৭১, ৭২, ৭৮, ৭৯, ৮০ পৃষ্ঠায় লিখিত বিষয়গুলির যথাযথরূপ উক্ত শুদ্ধিপত্রে লিখিত হয়৷ ২৩ বৈশাখ ১৩৪৫ [শুক্রবার 6 May 1938] কিশোরীমোহনকে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “বিশ্বপরিচয় বইয়ের তৃতীয় সংস্করণে যথেষ্ট সংশোধন দরকার হবে৷ তাড়াতাড়ি ছাপিয়ে বোসো না৷”
সংশোধনের জন্য ২৬ বৈশাখ ১৩৪৫ [সোমবার 9 May 1938] অপর পত্রে কিশোরীমোহনকে লিখেছেন : “বিশ্বপরিচয়ের যে কপিতে ছাপার ভুল সংশোধন করে রেখেছিলেম সেটা অবিলম্বে পাঠিয়ে দিতে বোলো৷”
14 May 1938 [শনিবার ৩১ বৈশাখ ১৩৪৫] কিশোরীমোহন চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছেন : :আজ দ্বিবেদীর (পণ্ডিত হাজারী প্রসাদ দ্বিবেদী) একটি চিঠি পেলাম৷ বিশ্ব-পরিচয় সম্বন্ধে তিনি ২/১টি প্রশ্ন তুলেছেন৷ চিঠিটি আপনার কাছে পাঠিয়ে দিলাম৷”
উক্ত তারিখহীন পত্রে দ্বিবেদী লিখেছেন : “বিশ্বপরিচয়ের হিন্দী অনুবাদ আজকে শেষ করিলাম৷ কালকে প্রেসে দিয়ে দিব৷ দুএক জায়গায় একটু সন্দেহ আছে৷… আমি আপনার কাছেই জানালাম৷ যাকে উপযুক্ত মনে করেন জিজ্ঞাসা করিয়া কিম্বা নিজেই দেখিয়া যথাশীঘ্র লিখিবেন যে উহা পরিবর্ত্তন করা উচিত কি না৷”
দ্বিবেদী লিখিত পত্রে ৪৪, ৪৫, ৮৩ পৃষ্ঠার কিছু বিষয় উল্লিখিত হয়৷ প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, শান্তিনিকেতনে হিন্দিভবন প্রতিষ্ঠায় হাজারী প্রসাদ দ্বিবেদী সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন৷ প্রবাসী, জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৫ [৩৮ বর্ষ ১ খণ্ড ২ সংখ্যা] (পৃ. ২৪৪-৪৬) সংখ্যায় সুরেন্দ্রনাথ মৈত্র কর্তৃক রবিবাসরে পঠিত প্রবন্ধটি ‘রবীন্দ্রনাথের “বিশ্ব-পরিচয়”’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়৷ প্রবন্ধে সুরেন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছেন : “কঠিন দুর্ব্বোধ্য বিষয় রসাত্মক প্রাঞ্জল ভাষায় লিখিত হলেও বিশেষ প্রণিধানের সঙ্গে পড়তে হয়৷ বিজ্ঞানের সঙ্গে যাঁদের কোন পূর্ব্ব-পরিচয় নেই, স্থানে স্থানে তাঁদের হয়ত পূর্ণ উপভোগে বাধা পড়বে৷… অস্পষ্ট আবছায়াগুলো যদি সুস্পষ্ট প্রশ্নের আকার ধারণ করে তাহলেই পাঠ সার্থক হবে৷ এই জিজ্ঞাসাই জ্ঞাতব্য তথ্য সন্ধানের পথ প্রদর্শক৷”
Patkar’s Old Block, Bandra থেকে 1 Jan 1938 [বুধবার ১৮ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৫] ইন্দ্রমোহন সোম রবীন্দ্রনাথকে লিখেছেন :
শ্রদ্ধাস্পদেষু,
বিশ্বপরিচয় পড়তে ২ কতকগুলো জায়গায় হোঁচট খেয়েছি৷ পেন্সিলের আকড়গুলো তারি নিদর্শন৷ কোথাও খটকা লেগেছে শব্দ অথবা তার প্রত্যয় নিয়ে (× চিহ্নিত) কোথাও অর্থের অস্পষ্টতা, কোথাও বা তথ্যগত অথবা ভাষাগত গরমিল৷
বইখানা সংশোধিত হয়ে ২য় সংস্করণে এসে ঠেকেছে৷ তৃতীয় সংস্করণে হাত [হয়ত] বা এদের কিছু বিহিত হতে পারে— এই ভেবে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করছি৷ বলা বাহুল্য বইখানা পাঠাতে অনেকখানি সংকোচ থাকায় কাটিয়ে উঠতে হয়েছে৷ একে বিজ্ঞানের সাধক নই, তার ওপর আপনার লেখা তার উপর সংশোধিত ২য় সংস্করণ৷ তবু সন্দেহ যায় না৷ সুতরাং নিবেদন করে খালাস হলাম৷ ইতি প্রণত
ইন্দ্রমোহন সোম৷
ইন্দ্রমোহন মুদ্রিত দ্বিতীয় সংস্করণের একটি কপিতে সংশোধন করে পাঠিয়েছিলেন এবং উক্ত চিঠির ‘পু:’ অংশে লিখেছেন : “কাজ হয়ে গেলে বইখানা ফেরত পেলে ভালো হয়—অথবা বদলি৷”
উক্ত পত্রের উত্তরে 8 Jun 1938 [বুধবার ২৫ জ্যৈষ্ঠ ১৩৪৫] উত্তরে ইন্দ্রমোহনকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন: “জরার জীর্ণতম স্বাভাবিক অনবধানতার দোষে এবং অভিজ্ঞতার অভাবে বিশ্বপরিচয়ে যথেষ্ট ভুল থেকে গেছে— কতক আমার চোখে পড়েছে সেগুলি এইবার সংশোধন করতে প্রস্তুত হচ্ছি৷ এই আনুকূল্যের জন্য তোমার কাছে আমার অন্তরের কৃতজ্ঞতা জানাই৷”
২ আষাঢ় ১৩৪৫ [শুক্রবার 17 Jun 1938] তৃতীয় সংস্করণ প্রসঙ্গে কিশোরীমোহনকে পুনরায় লিখেছেন : “বিশ্বপরিচয়ে অনেক ভুল ধরা পড়েচে৷ তারি সংশোধন ব্যাপারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে আছি৷ এইরকম কাটাকুটি জোড়াতাড়া মেরামতী কাজ একটুও ভালো লাগে না— ভালো এক দায় ঘাড়ে নিয়েছি৷”
30 Jun 1938 [বৃহস্পতিবার ১৫ আষাঢ় ১৩৪৫] অপর আরো একটি চিঠিতে কিশোরীমোহনকে লিখেছেন: “শেষ হয়েছে— এইবার ছাপিয়ে ফেললে তার পরে আমার নিষ্কৃতি৷”
১৩৪৫ বঙ্গাব্দের শ্রাবণ মাসে তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হয়৷ ২৯ আষাঢ় ১৩৪৫ [বৃহস্পতিবার 14 Jul 1938] Luker road, Allahabad থেকে অমিতা মজুমদার আলোচ্য গ্রন্থ প্রসঙ্গে দীর্ঘ পত্র লেখেন৷ সম্ভবত পত্রটি অপ্রকাশিত৷
শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সমীপেষু
বরেণ্য কবিগুরু
আপনার শারীরিক অসুস্থতার জন্যে আপনি পত্রলেখকদের আপনার প্রতি পত্রবাণ বর্ষণ করার থেকে বিরত থাকতে অনুরোধ করেছিলেন; কিন্তু আপনাকে না লিখে থাকতে পার্লাম না৷ আশাকরি যে জন্যে আপনাকে চিঠি লেখা স্থির করেছি সেটা নিতান্ত অবান্তর কারণ নয়৷
আপনার “বিশ্ব-পরিচয়” আমার অপূর্ব লেগেছে৷ বিশেষ করে প্রথম পরিচ্ছেদের পরমাণুলোকের জটিল বৃত্তান্ত যে এত সহজ ও straightforward বাংলায় লেখা যায় তা আমার ধারণার অতীত ছিল৷ ইংরাজীতে Modern Physics এর যে সমস্ত tecnical forms আছে তার বঙ্গানুবাদ অত্যন্ত সহজবোধ্য হয়েছে৷ বিশেষতঃ চোখে পড়ে, ‘ঋণাত্মক’ ও ‘ধন্যাত্মকের’ স্থানে আপনার ‘না-ধর্মী’ ও ‘হাঁ-ধর্মী’র ব্যবহার৷ আপনি আমার বাতুলতা ক্ষমা কর্বেন কিন্তু একটি জিনিস দেখে আমি অত্যন্ত আশ্চর্য হয়েছি, এবং সেটি এই যে, ‘পরমাণুলোকের’ মাত্র ৩৭ পৃষ্ঠার মধ্যে atomic theory ও spectroscopy অতি সূক্ষ্ম কথারও উল্লেখ আছে; যেমন Dӧppler-Fizma: Principle of the shift of spectral lines, ইত্যাদি৷
কিন্তু “বিশ্বপরিচয়ের” অভিনবত্বে বিস্মিত হয়ে আপনাকে চিঠি লিখ্লে বইটির অমর্যাদা করা হয়; তা’ ছাড়া আপনার কাছে “বিশ্বপরিচয়”-এর মত বইয়ের প্রশংসা করার মত স্পর্দ্ধা আমার নেই৷ মাত্র একটি জায়গায় একটা জিনিস বুঝতে পারলাম না৷
পৃষ্ঠা ৪৪এ নবম লাইনে লেখা রয়েছে “জ্বলন্ত ক্যালসিয়মের বেগ্নি রং”— ইত্যাদি৷ কিন্তু ক্যালসিয়ম ধাতু অথবা কোনো ক্যালসিয়মের Salt প্ল্যাটিনমের তারে আগুনের শিখার মধ্যে দিয়ে লাল রং দেখেছি৷ এবং MÜller-Pouillet-এর “Lehrbuch Der Physik, optik” এ ক্যালসিয়মের emission spectrum দেখলাম৷ তাতেও ‘লাইন’গুলি লাল ও হলদে অংশেই আছে, তার মধ্যে বর্ণসপ্তকের corresponding লাল অংশেই লাইন সর্বাপেক্ষা বেশী৷ তবে Indigo অংশে একটি অস্পষ্ট লাইন আছে (‘G’ লাইনের কাছে)৷ পট্যাসিয়ম ধাতুনিসৃত শিখার রং বেগনী হয়, এও দেখেছি৷ তবে কি ৪৪ পৃষ্ঠায় ক্যালসিয়ামের স্থলে পটাসিয়ম হবে? এ কথাটা যদি আপনি অনুগ্রহ করে জানান তা’হলে অত্যন্ত বাধিত হব৷
আশাকরি কালিম্পঙ্ থেকে ফেরবার পর আপনার স্বাস্থ্যের প্রভূত উন্নতি হয়েছে৷ আপনি যদি আমাকে একটি চিঠি দেন, অনুগ্রহ করে সেটি লিখতে যেন সেক্রেটারী মহাশয়কে অনুরোধ কর্বেন না৷ আশাকরি আপনার উপর আমি অত্যাচার করছি না৷ এর আগে আপনার হাতের লেখা পাবার সৌভাগ্য আমার কখনও হয়নি৷
আপনি আমার ভক্তিপূর্ণ প্রণাম গ্রহণ করবেন৷ ইতি৷
বিনীতা
অমিতা মজুমদার৷
উক্ত পত্রের উত্তরে 18 Jul 1938 [সোমবার ২ শ্রাবণ ১৩৪৫] অমিতা মজুমদারকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন :
কল্যাণীয়াসু
তোমার চিঠিখানি পড়ে খুশি হলুম৷ আমার জীর্ণবয়সে কঠিন বিষয় লিখতে মনোযোগের ত্রুটি আমার অজ্ঞাতসারেই ঘটে, সে রকম ভুলচুক বইখানি অধিকার করে আমাকে লজ্জা দিয়েছে৷ চতুর্থ সংস্করণ শীঘ্রই ছাপা হবে৷ প্রতিকার করব৷ তোমার চিঠিখানি আমাকে উৎসাহিত করেছে৷
আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করো৷ ইতি ১৮/৭/৩৮
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর৷
20 Aug 1938 [শনিবার ৩ ভাদ্র ১৩৪৫] তারিখে Lukergunj, Allahabad থেকে মেঘনাদ সাহার ছাত্র শশাঙ্ক রায় চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছেন :
শ্রদ্ধাস্পদেষু
অতি আগ্রহের সঙ্গে আপনার “বিশ্ব-পরিচয়” পড়লাম৷ যখন আরম্ভ করি তখন ভেবেছিলাম যে যা’ক অবশেষে কবিকে এক জায়গায় কায়দায় পেয়েছি৷ প্রাণভরে খুঁত ধরব, কসে সমালোচনা করব এই আশায় সুরু করলাম৷ কিন্তু যত শেষের দিকে যাই ততই হতাশ হই, শেষে অকৃত্রিম বিস্ময়ে বই শেষ করলাম৷ দুই একটি অতি সামান্য খুঁত এবং একটী মাঝারি ধরণের ছাড়া অনেক চেষ্টা করেও আর কিছুই উল্লেখযোগ্য ত্রুটি পেলাম না৷
কাজেই অন্য দিক থেকে সমালোচনা আরম্ভ কর্ত্তে হ’ল৷ বই আপনার আরও ভাল হ’ল না কেন?
যা’ নেই তা’ নেই কেন? অবশ্য একোনও অভিযোগই নয়—
কিন্তু আপনার বই যখন সকলেই পড়বে (অন্ততঃ এ বই সকলেরই পড়া উচিৎ), তখন আমাদের দাবী বইটী নিখুঁত, সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হোক৷
আপনার কাছে এই আমার প্রথম চিঠি কাজেই বিশেষ কিছু লিখতে সাহস হল না এবং সঙ্খেপে [য] সকল কথা পরিষ্কার হ’ল না৷ যদি অনুমোদন পাই, তবে বর্ত্তমান চিঠির— Mechanics, Quanta ও Scale সম্বন্ধে যা আভাষ দিয়েছি, পত্রান্তরে তা’ পরিস্ফুট করতে চেষ্টা করব৷
ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি যে আরও বহুকাল ধরে আপনি প্রকৃতি ও মানুষের গভীরতর রহস্যের পরিচয় সুন্দরতর করে দিতে থাকুন৷ ইতি
শ্রীশশাঙ্ক রায়
(ডা: সাহার ছাত্র)
পু: এই চিঠির উত্তরে যদি আপনার স্বহস্ত লিখিত একটী লাইনও পাই, তবে ধন্য মনে করব৷
আধুনিক বৈজ্ঞানিকরা
আপনার নক্ষত্রলোক, পরমাণুলোক কোথাও Einsteinএর সাক্ষাৎ না পেয়ে মর্ম্মাহত হলাম৷ Planck, Bohr এবং আরও অনেকে, যাঁরা আধুনিক পরমাণুলোক ইত্যাদির সৃষ্টিকর্তা, তাঁদের সৃষ্টির পরিচয়ের সঙ্গে তাঁদের নামোল্লেখ করলে বোধ হয় অনেক সুখী হতেন৷
কয়েকটী সামান্য কথা
পৃ. ৫৯:— ‘সৌরজগৎ’ বলতে আমরা সূর্য্যের সঙ্গে গ্রহ, উপগ্রহ, ধুমকেতু সবই বুঝি৷ এই পরিচ্ছেদে শুধু সূর্যের পরিচয় দেওয়া আছে অতএব এর নাম সৌরলোক বা অনুরূপ কিছু হলে ভাল হ’ত৷
পৃ. ৩০:— “এই শক্তি পরমাণুমহলে প্রোটনকে যেমন টানে ন্যুট্রনকেও তেমনি টানে, অর্থাৎ বৈদ্যুতের চার্জ্জ যার আছে আর যার নেই উভয়ের পরেই তার সমান প্রভাব”৷
পরমাণু কেন্দ্রে প্রোটন, প্রোটন এবং নিউট্রন উভয়কেই টানে বটে তবে সমানভাবে টানে না৷ টানার কায়দা (প্রধানতঃ Exchange Force) সঠিক ভাবে জানা নেই বটে তবে এই টান প্রোটন এবং নিউট্রনের প্রতি বিভিন্ন৷ ইলেকট্রন তো কেন্দ্রে থাকতেই পারে না৷
পৃ. ৮:— “কেবল আলোর ব্যবহার থেকে এটা একেবারে নিশ্চিত জানা গেছে যে ওটা ঢেউ বটে৷ কিন্তু… আলো অসংখ্য জ্যোতিষ্কণা নিয়ে, অতি ক্ষুদে ছিটেগুলির মত তার বর্ষণ”৷
আলোর দ্বৈতরূপের খবর রয়েছে বটে তবে ঢেউরূপের উপর জোরটা বেশী মনে হয়৷ ‘একেবারে নিশ্চিত’ কথাটী খুব সুপ্রযুক্ত হয় নি৷ দুই রূপের উপরই সমান জোর দেওয়া উচিত ছিল৷ আলো এবং (তার সঙ্গে সমস্ত জড় পদার্থের) দ্বৈতরূপ—কণারূপ এবং ঢেউরূপ— ও দুয়ের সমন্বয়েই Wave Mechanics বা নব ফিজিক্সের জন্ম৷
তারার জীবনী
পৃ. ৫৫ :— “বেটেলজিয়ুস নামে এক নক্ষত্র আছে, তার লাল আলো দেখলে বোঝা যায় তার বয়স হয়েছে যথেষ্ট৷ নক্ষত্রটী আলোচনা কর্ব্বার আগে তারাদের জীবনী সম্বন্ধে একটু আলোচনা করা যাক৷
আজকাল আকাশে যে সমস্ত নক্ষত্র দেখা যায় আকার অনুযায়ী তা’দের দুইভাগে ভাগ করা যায়— দানব-তারা (অর্থাৎ মহাকায় অতি সূক্ষ্ম নক্ষত্র) এবং বামন-তারা (ক্ষুদ্রকায় ঘন নক্ষত্র)৷ এই দু রকম তারাকেই আবার রং অনুযায়ী ভাগ করলে— লাল, কমলা, হলদে, সাদা, নীলাভ মোটামুটি কয় ভাগে ভাগ করা যায়৷ দেখা যা’ক এর কারণ কী৷
বৈজ্ঞানিক বলেন যে তারার জন্ম হয় এক মহাকায় দৈত্য তারা রূপে৷ তখন তার আকার যাকে বলে বিশাল (কয়েকটা সৌরজগৎ তার মধ্যে অনায়াসে থাকতে পারে); তার দেহ থাকে অতি সূক্ষ্ম ও বায়বীয়৷ তারপর মাধ্যাকর্ষণের জন্য তার অণু-পরমাণুগুলি ভিতরের দিকে ছুটে যেতে চায় এবং এই ছোটাছুটির ফলে এর Temp বাড়তে থাকে অর্থাৎ মাধ্যাকর্ষণ শক্তি (Gravitational Energy) তাপশক্তিতে পরিণত হয়৷ নক্ষত্রটীও আকারে ছোট হতে থাকে৷ অবশ্য তাপশক্তি অন্য প্রকারেও আসতে পারে যেমন Radio activity-র জন্য বা জড়ের ধ্বংসের জন্য, এবং নক্ষত্র ইত্যাদির ক্ষেত্রে এই সমস্ত কারণ মোটেই উপেক্ষণীয় নয়৷
যত টেম্পারেচার বাড়ে নক্ষত্রের রঙ্গ ততই বদলাতে থাকে (পৃ. ৯০) এবং তত বেশী শক্তি সে চারিদিকে ছড়াতে থাকে৷ প্রথম অবস্থায় (যথা Beteguse [Betelgeuse]) তারাটী থাকে লাল৷ পরে ধীরে ধীরে কয়েক শত কোটী বছরে— সেটী হয় কমলা রঙ্গের৷ ক্রমশ হলদে, সাদা হয়ে শেষে সে হয় নীলাভ সাদা৷ এই অবস্থাকে (যথা Sirius) বলা যেতে পারে তারার যৌবন কাল৷
কারণ এই টেম্পারেচারের (প্রায় ৩০,০০০০C) এর পর সে এত বেশী উত্তাপ বিকীরণ করে যে মাধ্যাকর্ষণ শক্তি তার যোগান দিয়ে উঠতে পারে না৷ কাজেই তারারা ঠান্ডা হতে আরম্ভ করে৷
জীবনী
কিছুকাল এই যৌবন উপভোগের পর তারারা প্রৌঢ়ত্বে প্রবেশ করে৷ এ সময় এরা এত ছোট হয়ে আসে যে এদের বলা হয় বামন তারা৷ অবশ্য Temp. কমবার সঙ্গে সঙ্গে পুনরায় এদের রঙ্গ বদলাতে থাকে৷ নীলাভ সাদা হ’তে ক্রমশ ২ সাদা, হলদে, (আমাদের সূর্য্য এই অবস্থায় আছে এখন) কমলা, লাল হয়৷ অবশেষে একেবারে অন্ধকার হয়ে তারা সৃষ্টির বহির্ভূত হয়ে যায়৷ আকাশে এই রকম অসংখ্য মৃত তারা আছে৷
উক্ত পত্রে বিজ্ঞান বিষয়ক আরো কিছু তথ্য দিয়েছেন শশাঙ্ক রায় কিন্তু পরিসরের কারণে সংক্ষিপ্ত করা হলো৷ উক্ত পত্রের উত্তরে 29 Aug 1938 [সোমবার ১২ ভাদ্র ১৩৪৫] রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “তোমার চিঠিখানি পড়ে খুশি হলুম৷ শরীরে অস্বাস্থ্য ও জরাজনিত অনবধানতাবশত বিশ্বপরিচয়ে অনেক ত্রুটি রয়ে গেছে৷ তৃতীয় সংস্করণ সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে তাতে যথাসাধ্য সংশোধন করা হয়েছে— কিন্তু অনভিজ্ঞতার অনিবার্য ত্রুটি ও স্খলন নিশ্চয়ই এখনো রয়েছে৷ আমি ইংরেজি বিজ্ঞানের বই থেকে সাধ্যমতো বিষয়বস্তু সংগ্রহ করেছি— যদি ভ্রমপ্রমাদ নির্দেশ করে দাও তবে ক্রমশ বইখানি নির্দোষ হতে পারবে এই আশা মনে রাখলুম৷ আমার আশীর্বাদ গ্রহণ করো৷”
গ্রন্থের তৃতীয় সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর ৮ আশ্বিন ১৩৪৫ [রবিবার 25 Sep 1938] পুস্তক পরিচয় বিভাগে আনন্দবাজার পত্রিকা-য় লেখা হয় : “বাঙ্গলা ভাষায় বৈজ্ঞানিক সাহিত্য রচনার যে পথ রবীন্দ্রনাথ এই গ্রন্থে প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহার ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা সুদূর-প্রসারী বলিয়াই আমরা মনে করি৷… রবীন্দ্রনাথের ভাষার গুণে নীরস বৈজ্ঞানিক সত্যগুলিও যেন কাব্য— সৌন্দর্য্যমণ্ডিত হইয়া উঠিয়াছে৷”
১ কার্তিক ১৩৪৫ [মঙ্গলবার 18 Oct 1938] ভাগলপুর থেকে বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায় চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছেন :
‘বিশ্ব পরিচয়’ পড়ে শেষ করলুম৷ বইটি ছোট কিন্তু রচনার এমন ঠাস বুনোনি যে একটি লাইন চোখ এড়িয়ে গেলে পরের লাইন অর্থহীন ঠেকে৷ অনেক জিনিস আমার জানা ছিল না, শিখলুম৷ বইটা পড়ে একটা কবিতার প্রেরণাও পেলুম৷
উক্ত পত্রের সঙ্গে কবিতা [জীবনের স্রোতে ভেসে যাবে পরমাণু]-টিও পাঠান৷ কবিতাটি ৪ স্তবক, ৪০ ছত্র বিশিষ্ট৷ উক্ত পত্রের উত্তরে পরের দিন অর্থাৎ 19 Oct 1938 [মঙ্গলবার ২ কার্তিক ১৩৪৫] রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “বিশ্বপরিচয়ের সংঘাত লেগে একখানা ভালো কবিতার দ্যুতি তোমার মনে বিচ্ছুরিত হয়েছে সেটা জাগতিক ঘটনা৷ পালটিয়ে পালটিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে সংঘাতে সংঘাতে, মনের সঙ্গে মনের, ঘটনার সঙ্গে ঘটনার, সংস্কৃতির সঙ্গে সংস্কৃতির; তেজের সঙ্গে তেজের৷… কেমেস্ট্রিতেও এই দেখেছি৷ ফিজিক্সেও তাই আবার সাইকলজিতেও জগৎ জুড়ে নিরন্তর সংঘাতে সংঘাতে অন্তরে বাহিরে সৃষ্টির অন্তহীন বৈচিত্র্য৷”
১৩৪৫ বঙ্গাব্দের পৌষ মাসে আরো সংশোধিত পরিমার্জিত হয়ে গ্রন্থের চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হয়৷ তার কিছুকাল পরে প্রমথনাথ সেনগুপ্ত পুনরায় বিশ্বভারতীর কাজে যোগ দেন৷ উক্ত বিষয়ে Visva-Bharati News, June 1939 [Vol. 7, No. 12] (pg. 95) সংখ্যায় লেখা হয় : “We are glad to welcome Pramathanath Sen-Gupta M.Sc. (Class I, Gold Medalist) who will rejoin the Siksha-Bhavana as Adhyapaka of Physics from the begining of the next session in July. He had temporarily left our service in 1937 and comes back after an absence of almost two years.”
অনুমান করা যায়, চতুর্থ সংস্করণ প্রকাশিত হওয়ার পর পুনরায় সংশোধিত তালিকা পাঠান ইন্দ্রমোহন সোম৷ কিন্তু উক্ত তালিকার হদিশ পাইনি৷ 26 Aug 1939 [শনিবার ৯ ভাদ্র ১৩৪৬] চিঠিতে ইন্দ্রমোহনকে রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “তোমার চিঠিখানি পেয়ে আনন্দিত ও কৃতজ্ঞ হলুম৷ আমার শক্তি এখন ক্লান্ত, আমি তোমার প্রেরিত ত্রুটির তালিকা স্বহস্তে ব্যবহার করতে পারব সে আশা রাখিনে—কোনো সুযোগ্য বিজ্ঞান অধ্যাপকের হাতে দিলুম পুনঃ সংস্করণের সময় কাজে লাগাবেন৷ যত চেষ্টাই করি ভুল চুক আনাড়ির হাত এড়িয়ে যায় বিশেষত মনের জীর্ণ অবস্থায়৷”
এর কিছুকাল পরে 26 Sep 1939 [মঙ্গলবার ৯ আশ্বিন ১৩৪৬] বরিশালের বি.এম. কলেজ থেকে কামিনীকুমার দে চিঠিতে রবীন্দ্রনাথকে লিখেছেন :
পরম শ্রদ্ধাষ্পদ
শ্রীযুক্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সমীপেষু,
‘বিশ্বপরিচয়’ পরিবর্ত্তিত চতুর্থ সংস্করণ পাঠের পর, উহা ম্যাট্রিক পাঠ্য পুস্তক বলিয়াই এইটুকু নিবেদন করিতেছি৷
২৭ পৃষ্ঠা ২১ পংতি— Ore বুঝাইতে ‘ধাতু’ শব্দ ব্যবহার করিয়াছেন৷ ইহাতে নূতন পাঠকের মনে একটা ভ্রান্ত ধারণা থাকিয়া যাইবে৷ লিখা যায়—
‘পিচ্ব্লেন্ড নামক এক খনিজ পদার্থ থেকে য়ুরেনিয়াম ধাতুকে’ ইত্যাদি— অথবা Ore শব্দের অন্য কোনো ভাল প্রতিশব্দ৷’
৩৮ পৃষ্ঠা ৫’ম পংতি ‘সাতটী প্রদক্ষিণকারী ‘ইলেকট্রনওয়ালা’ লিখিলে বুঝিবারও সুবিধা, প্রতিবাদেরও কিছু নাই৷
নীহারিকা সম্বন্ধে যাহা লিখা হইয়াছে তাহা হইতে ধারণা ঠিক জন্মিবে না৷
এরপর উক্ত পত্রে বিজ্ঞান বিষয়ক কয়েকটি তত্ত্ব উল্লেখ করেন কামিনীকুমার৷ আলোচ্য রচনায় স্থানাভাবে তার পূর্ণ উদ্ধৃতি দেওয়া সম্ভব হলো না৷
1939 খ্রিস্টাব্দে বিশ্বভারতীর কাজে পুনরায় যোগ দেওয়ার পরবর্তী সময়ের কথা উল্লেখ করে প্রমথনাথ আনন্দরূপম্ গ্রন্থে তারিখহীনভাবে লিখেছেন : “এর কিছুদিন পর গুরুদেব ডেকে পাঠালেন, বললেন, ‘বিশ্ব-পরিচয়’ তো ছাপা হল, এবার পৃথ্বী-পরিচয় তাড়াতাড়ি শেষ করো, এর ভূমিকাটি আমি লিখে দেবো স্থির করেছি’৷ পৃথ্বী-পরিচয় লেখা সম্পূর্ণ হলে তার পাণ্ডুলিপি দিয়ে এলাম ওঁর হাতে, … কয়েকদিন পর ডেকে পাঠিয়ে বললেন— ‘‘তোমার বইটার ‘‘ভূমিকা’’ লিখে লোকশিক্ষা গ্রন্থমালার অন্তর্ভূত করে প্রেসে পাঠিয়ে দিয়েছি, কী ভূমিকা লিখেছি দেখো৷’’ … ভূমিকাটি পড়ে অভিভূত হলাম, …৷”
আমাদের অনুমান, ইন্দ্রমোহন সোম প্রেরিত ত্রুটির তালিকা প্রমথনাথকে দেখিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ৷ রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় প্রকাশিত বিশ্বপরিচয় গ্রন্থের শেষ তথা পঞ্চম সংস্করণ সম্ভবত প্রমথনাথের সক্রিয় সহযোগিতায় পূর্ণতর হয়ে ওঠে৷ বিশ্বপরিচয় গ্রন্থের প্রস্তুতিপর্বের সূচনায় এবং প্রকাশনাপর্বের সমাপ্তিতে সমান সক্রিয় ছিলেন প্রমথনাথ৷
9 Jan 1940 [মঙ্গলবার ২৪ পৌষ ১৩৪৬] শেষ সংস্করণের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন : “এই গ্রন্থে যে সকল ত্রুটি লক্ষগোচর হয়েছে সে সমস্তই অধ্যাপক শ্রীযুক্ত প্রমথনাথ সেনগুপ্ত বিশেষ মনোযোগ করে সংশোধন করেছেন— তাঁর কাছে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করি৷”
‘নিমাইসাধন বসু স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।
প্রাবন্ধিক ও রবীন্দ্র-গবেষক