ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ সম্পর্কে বলতে গিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ একবার বলেছিলেন যে, ঠাকুরের প্রতিটা কথা নিয়ে পাতার পর পাতা লেখা সম্ভব। আমরা জানি, শ্রীরামকৃষ্ণ এবং শ্রীমা সারদাদেবী অভিন্ন; সুতরাং মায়ের প্রতিটা কথার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। তাঁর ক্ষেত্রে কাজটি হয়তো আমাদের পক্ষে আরো কঠিন। কারণস্বরূপ শ্রীরামকৃষ্ণের বিখ্যাত সাক্ষাৎ-শিষ্য স্বামী প্রেমানন্দজীকে উদ্ধৃত করে বলা যায়—“শ্রীশ্রীমাকে কে বুঝেছে?… ঐশ্বর্য্যের লেশ নাই! ঠাকুরের বরং বিদ্যার ঐশ্বর্য্য ছিল; তাঁর ভাবাবেশ সমাধি এসব আমরা জন্মে দেখেছি…! কিন্তু মার—তাঁর বিদ্যার ঐশ্বর্য্য পর্যন্ত লুপ্ত! এ কি মহাশক্তি!” মায়ের সামান্য দৈনন্দিন কথার মধ্যেও কী সুগভীর বৈদান্তিক তত্ত্ব নিহিত থাকত তা ভাবলে বিস্মিত হতে হয়! এরকম একটি কথা নিয়ে আলোচনা করা যাক। শ্রীশ্রীমায়ের কথা গ্রন্থে পাওয়া যায়, স্বামী অরূপানন্দকে মা বলছেন : “জ্ঞান হলে মানুষ দেখে ঠাকুর-ঠুকুর সবই মায়া—কালে আসছে, যাচ্ছে।” মা কত সাধারণভাবে কথাটি বলেছেন, অথচ সমস্ত অদ্বৈত-বেদান্তই এর মধ্যে লুকিয়ে আছে! আলোচনার সুবিধার জন্য আমরা কয়েকটি ধাপে মায়ের কথাটি বিশ্লেষণ করব।

‘জ্ঞান’ বস্তুত কী?: আমরা সাধারণভাবে কী দেখি, জানি বা অনুভব করি?—এই নাম-রূপের জগৎ-সংসারকে। বেদান্ত বলে, এই জানা ঠিক নয়। এটি আমাদের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞানের ফল। এর ফল সাংঘাতিক—আমরা এই নানাত্ব-পূর্ণ জগৎ দেখছি, যার মধ্যে আমরা অতি ক্ষুদ্র এক বিন্দুপ্রায় অস্তিত্বমাত্র। আমাদের বাইরে এক বিরাট জগৎ বিদ্যমান; অন্যদিকে, আমাদের বহু অভাব এবং চাহিদা রয়েছে। আমরা ভাবছি, আমাদের এমন বহু কিছু নেই যা আমরা বাইরের জগৎ থেকে পেতেই পারি। সেই বাইরের বিরাট জগতের সঙ্গে আদান-প্রদানের মাধ্যমে নিজেদের আমরা সুখী করতে চাই, সুখভোগের বস্তু পেতে চাই। এই কামনার বশেই আমরা সারাজীবন কর্ম করে চলেছি। কিছু কর্ম ভাল, কিছু কর্ম মন্দ। ভাল কর্মের ফল পুণ্য, কুকর্মের ফল পাপ। এর ওপর ভিত্তি করেই আমরা একের পর এক জন্মলাভ করছি। তার সঙ্গে আমরা এই জন্ম-মরণ-সংকুল সংসারে ঘুরপাক খেয়ে চলেছি। সংক্ষেপে এই হলো বেদান্ত-মতে আমাদের সংসার-দুর্ভোগের কারণ।

অর্থাৎ, যাবতীয় সংসার-দুঃখের সূত্রপাত আমাদের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞান থেকেই। তবে প্রকৃত স্বরূপজ্ঞান কী? উপনিষদ বহুবার বলেছেন যে, আমাদের প্রকৃত স্বরূপ হলো ব্রহ্ম; আর সেই ব্রহ্ম-জ্ঞান বা উপলব্ধিতেই মানবজীবনের চরম সার্থকতা। যেমন— তৈত্তিরীয়োপনিষদের দ্বিতীয় অধ্যায়ের প্রথমদিকেই চরম ঘোষণা করে দেওয়া হলো—যিনি সেই ব্রহ্মকে জানেন তিনি পরম প্রাপ্তিলাভ করেন। ভগবান শঙ্করাচার্য তাঁর তৈত্তিরীয়োপনিষদ-ভাষ্যে এই পরম প্রাপ্তিকে সংসার-বীজের সামগ্রিক ধ্বংস বলে অভিহিত করেছেন। তিনি আরো বলেছেন : “অবিদ্যানিবৃত্তিঃততশ্চ আত্যন্তিকঃ সংসারাভাবঃ”—নিজের প্রকৃত স্বরূপ জ্ঞানে অবিদ্যার নিবৃত্তি এবং সংসারের একান্ত অভাব-উপলব্ধি হয়। অর্থাৎ, এই জ্ঞানের ফল হলো যাবতীয় দুঃখের সামগ্রিক নিবৃত্তি এবং পরমানন্দ প্রাপ্তি।

এই ব্রহ্ম কেমন? তৈত্তিরীয়োপনিষদের বিখ্যাত সেই মন্ত্র—“সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম”—ব্রহ্ম সত্যস্বরূপ, জ্ঞানস্বরূপ এবং অনন্তস্বরূপ। এই ব্রহ্মকে নিজের হৃদয়ের গভীরে যিনি উপলব্ধি করেন তিনি মুক্ত হয়ে যান।

জ্ঞান কীভাবে হতে পারে? (পঞ্চকোশ-বিচার): স্বাভাবিকভাবেই ব্রহ্মের স্বরূপ সম্পর্কে জানার পর সাধকের সেই ব্রহ্মকে উপলব্ধির বাসনা হয়। কিন্তু এই বর্ণনা যে খুব বিমূর্ত (abstract)! এই ব্রহ্ম কী তা যেন কয়েকটি শব্দে বর্ণিত হলো, যা আমাদের চিন্তারও বাইরে। সেটিকে অন্তত বোঝা যাবে কীভাবে? কোনো উপায় কী আছে? না থাকলে যাবতীয় দুঃখের সর্বত-নিবৃত্তি এবং পরমানন্দ প্রাপ্তিরূপ প্রতিশ্রুতি যে বৃথা হয়ে যায়! শ্রুতি তাই এরপর এক আশ্চর্য উপায়ের সাহায্য নেন। একজন অসাধারণ শিক্ষকের মতো আমাদের জানা জগৎ থেকে ধীরে ধীরে অজানার দেশে নিয়ে যান। পিতামাতার থেকেও সহস্রগুণ হিতৈষী শ্রুতি আমাদের পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে চেনেন। তিনি জানেন যে, আমাদের সমস্ত ভাবনা জগৎ-কেন্দ্রিক—আমাদের দেহ-মন ইত্যাদিতেই তা সীমাবদ্ধ। অতএব, হঠাৎ করে আমাদের মতো সাধারণ অধিকারীদের চরম তত্ত্ব কিছুতেই বোধগম্য হবে না। তাই আমাদের পরিচিত বস্তু থেকেই তৈত্তিরীয়োপনিষদে ব্রহ্মবিদ্যা শিক্ষাদান শুরু হয়। শঙ্করাচার্য তাঁর ভাষ্যে একে বলেছেন ‘শাখাচন্দ্রনিদর্শন’। অর্থাৎ, ‘আকাশে চাঁদ কোথায়?’—‘ঐ যে গাছের শাখাটি দেখা যাচ্ছে, তার ওপরে।’ বাস্তবিকপক্ষে চাঁদ এবং গাছের শাখা বহুদূরবর্তী সম্পূর্ণ ভিন্ন পদার্থ, যাদের কোনো সম্পর্ক নেই। কিন্তু তবু গাছের শাখাটি দিয়ে চাঁদ নির্দেশ করা যায়। কারণ, এক্ষেত্রে সেটি আমাদের নাগালের মধ্যেই উপস্থিত।

তৈত্তিরীয়োপনিষদ তাই শুরু করেন একেবারে আমাদের নাগালের মধ্যে থাকা দৃশ্যমান জগৎ থেকে। আপাতভাবে কী দেখা যায়? যত কিছু জীব আছে, তারা সকলেই অন্ন থেকে জাত, অন্নের দ্বারা জীবিত থাকে। এর ফল হলো দৃশ্যমান শরীর বা স্থূলশরীর। তলোয়ারের যেমন খাপ থাকে, যাকে ‘কোশ’ বলা হয়, তেমনি আমাদের প্রকৃত স্বরূপের এ হলো সবচেয়ে বাইরের কোশ। এই দৃশ্যমান শরীরকে বলা হয় ‘অন্নময় কোশ’। ঠিক যেমন চাল শস্য থেকে আলাদা করা হয়, উপনিষদ এবার ধাপে ধাপে এর থেকে ব্রহ্ম নির্দেশ করবেন। আমাদের স্থূলশরীর থেকে সূক্ষ্ম কি অনুভূত হয়? একে বলা হয় ‘প্রাণময় কোশ’। আমাদের যাবতীয় জৈবিক কার্য প্রাণের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেমন নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, পরিপাকক্রিয়া ইত্যাদি সবই প্রাণময় কোশের কার্যস্বরূপ। এ দিয়ে আমাদের স্থূলশরীর ব্যাপ্ত হয়ে আছে, তাই প্রাণময় কোশকে অন্নময় কোশের থেকে সূক্ষ্ম বলা চলে। এর থেকে সূক্ষ্ম কি অনুভূত হয়, যা দিয়ে এই প্রাণময় কোশও পূর্ণ হয়ে আছে? মন—যা আমাদের প্রকৃত স্বরূপের আরেক আবরণ, একে ‘মনোময় কোশ’ বলে। মন সংকল্প-বিকল্পাত্মক। অর্থাৎ, যখন একজন ব্যক্তি একটি নির্দিষ্ট বস্তুকে নিশ্চিতভাবে নির্ধারণ করতে পারে না বা যখন সে নির্ধারণ করতে পারে না যে, সে একটি নির্দিষ্ট কাজ করবে কি না, তখন মন কাজ করে। এই মন দিয়েই তৈরি মনোময় কোশ, যা প্রাণময় কোশের থেকে সূক্ষ্মতর। এর থেকে সূক্ষ্মতর কী? ‘বিজ্ঞানময় কোশ’। এটি বুদ্ধি দ্বারা নির্মিত। ‘নিশ্চয়াত্মিকা অন্তঃকরণবৃত্তি’৬ হলো বুদ্ধি। অর্থাৎ, অন্তঃকরণের যে-কাজ নিশ্চিত করে কিছু ঠিক করে, তাই বুদ্ধি। বিজ্ঞানের অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার থেকে শুরু করে যেকোনো মহৎ সৃষ্টির সূত্রপাত এই কোশেই। এর থেকে সূক্ষ্মতর কোশ আর মাত্র একটি—‘আনন্দময় কোশ’। যেখানে মন-বুদ্ধির ক্রিয়া স্তব্ধ হয়ে যায়, কিন্তু অজ্ঞানবীজ রয়ে যায়—সুষুপ্তির সেই আনন্দময় অনুভূতি দিয়েই এই কোশ নির্মিত। এই আনন্দময় কোশ সবচেয়ে সূক্ষ্ম কোশ, কারণ তা প্রকৃত স্বরূপের সবচেয়ে নিকটে। কিন্তু এটিও প্রকৃত স্বরূপ নয়। তৈত্তিরীয়োপনিষদ এখানে হঠাৎ করে বর্ণনা বন্ধ করে দেন; কারণ এর পর আর কিছু ভাষায় বর্ণনা করা যায় না, শুধু এটুকু বলেন—“ব্রহ্ম পুচ্ছং প্রতিষ্ঠা।”৭ অর্থাৎ, এই সমস্ত কোশই নিজের প্রকৃত স্বরূপ ব্রহ্মে ভিত্তি করেই প্রতিষ্ঠিত। এই পঞ্চকোশ বিচার করে এই দেখানো হলো যে, ব্রহ্ম সকল কোশেরই আভ্যন্তরীণ কারণ এবং অধিষ্ঠান। আমাদের স্থূলশরীর বা অন্নময় কোশের কার্য প্রাণময় বা ক্রিয়াবিশিষ্ট কোশ ছাড়া অসম্ভব। আবার সেই প্রাণ বা ক্রিয়া চালিত হয় মনোময় কোশ বা অনিশ্চয়াত্মিকা জ্ঞানশক্তি দিয়ে। ঐ মনও আবার চালিত হয় নিশ্চয়াত্মিকা জ্ঞানশক্তি—বুদ্ধি বা বিজ্ঞানময় কোশ দিয়ে। আর বুদ্ধি আনন্দের সন্ধানে চলে; কারণ যাবতীয় বুদ্ধিবৃত্তির কারণ ভোক্তার আনন্দ। তাই বুদ্ধি বস্তুত চালিত হয় আনন্দময় কোশ দিয়ে। আর এই আনন্দময় কোশ প্রতিষ্ঠিত ব্রহ্মে। শঙ্করাচার্য তাঁর ভাষ্যে সারমর্ম করে বলেছেন—সেই অদ্বৈত ব্রহ্ম বর্তমান, যেখানে অজ্ঞতা দ্বারা সৃষ্ট দ্বৈততা তার অবসান খুঁজে পায় এবং যেটি দ্বৈততার প্রতিষ্ঠারূপ ‘পুচ্ছ’।

‘দশম ব্যক্তি’ উপাখ্যান: বিষয়টি আরেকটু গভীরভাবে দেখা যাক। একটি বৈদিক উপাখ্যান এরকম—দশজন বোকা লোকের একটি দল সন্ধ্যাবেলা একটি নদী সাঁতরে অন্য পাড়ে গেছে। ওপারে পৌঁছে তারা ভাবল যে, দেখা দরকার সবাই পৌঁছেছে কি না। সুতরাং একজন গোনা শুরু করল—এক, দুই, তিন করে সে (নিজেকে বাদ দিয়ে) নয় পর্যন্ত গণনা করল। সে বলল : “সর্বনাশ, আমাদের এক বন্ধু নদীতে ডুবে গেছে! আমরা দশজনে রওনা দিয়েছিলাম, কিন্তু এখন গুনে দেখছি মাত্র নয়জন আছে!” সেই শুনে দলের বাকিরাও অত্যন্ত আতঙ্কিত হয়ে গুনতে শুরু করল—‘এক, দুই,…নয়!’ (সবাই নিজেকে বাদ দিয়েই গণনা করছে!) গোটা দলের মধ্যে কান্নার রোল উঠল—“হায়! আমাদের এক সঙ্গী নদীতে ডুবে গিয়েছে!” এই সময় পাশ দিয়ে এক পথিক যাচ্ছিল, কান্না শুনে ঘটনা কী জিজ্ঞেস করে সে তাজ্জব বনে গেল! সে স্পষ্টই দেখতে পাচ্ছে যে দশজনই রয়েছে! পথিক বলল : “ভয় পেও না, কেউ ডুবে যায়নি।” “সে কী করে হয়—আমরা সবাই যে গুনেছি!” “আবার গণনা কর।” দলের একজন শুরু করল—‘এক, দুই,…নয়’—সঙ্গে সঙ্গে পথিক বলে উঠল—‘দশমস্ত্বমসি’—“তুমিই হলে সেই দশম ব্যক্তি!” মুহূর্তের মধ্যে সেই গণনাকারীর ভুল ভেঙে গেল! সে বুঝল, কেউ ডুবে যায়নি। ঐ ‘দশম ব্যক্তি’ সবসময়ই তাদের সঙ্গে ছিল—সে নিজেই সেই ‘দশম ব্যক্তি’!

এই বিখ্যাত আখ্যায়িকাটি সহজভাবে পূর্বের পঞ্চকোশ বিচার থেকে ব্রহ্ম-ইঙ্গিত ব্যাখ্যা করে। বিদ্যারণ্য স্বামী তাঁর প্রসিদ্ধ পঞ্চদশী নামক গ্রন্থে৮ এই আখ্যানটি নিয়ে এক দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। আমরা আমাদের প্রকৃত স্বরূপের খোঁজে বিভিন্নভাবে অন্নময়, প্রাণময়, মনোময়, বিজ্ঞানময়, আনন্দময় কোশ বা আবরণ পেয়েছি। কীভাবে এইসব আবরণ ভেদ করে ব্রহ্ম উপলব্ধি হবে? সমস্যা হলো, আমরা আখ্যায়িকার বোকা লোকটির মতো কিছুতেই নিজেতে—নিজের প্রকৃত স্বরূপের দিকে দৃষ্টি দিচ্ছি না! শুধু তাই নয়, মনে করছি ব্রহ্ম বলে কিছুই নেই! এই অন্নময় ইত্যাদি শরীর নিয়েই মগ্ন হয়ে আছি। ফলাফল—সংসার-দুঃখ! শ্রীমা আমাদের এই বোকামি নিয়ে বলেছেন : “কি আছে এই হাড়মাসের খাঁচাটায়!… এই দেহটাতে আছে কি? কিসের জন্য এত মায়া! দু-দিন পরেই ত শেষ হয়ে যাবে, তখন পুড়ালে হবে দেড়সের ছাই! এ দেড়সের ছাই বইত নয়!”

আমাদের দৃষ্টি সেই বোকা লোকটির মতো—কেবল বাইরেই খুঁজে চলেছে প্রকৃত বস্তু। আরো একটি বিষয় একটু চিন্তা করার—গল্পের লোকটি (বা লোকগুলি) কিন্তু এক অর্থে যুক্তিপূর্ণ কাজই করছিল। কীভাবে? সে আশা করছিল, বাকি নয়টি লোককে যেখানে পাওয়া গেল অর্থাৎ ‘বাইরে’—সেখানেই দশম জনকেও পাওয়া যাবে। এ কিন্তু যথেষ্ট বৈজ্ঞানিক ধারণা। কিন্তু সমস্যা হলো, বৈজ্ঞানিক ধারণা মানেই তা সবকিছু objectify করবে বা বস্তু হিসাবে দেখবে; তাতে কিন্তু subject বা দ্রষ্টাকে পাওয়া যাবে না—ঠিক যে-ভুলটি গল্পের লোকগুলো করছিল!

জ্ঞানপথে গুরুর ভূমিকা: তবে উপায় কী? আগের গল্পের সেই ‘পথিক’—যিনি আধ্যাত্মিক জীবনে আমাদের গুরুর উপমা, তিনি আমাদের হাত ধরে সেই subject বা দ্রষ্টাকে ইঙ্গিত করে বলবেন ছান্দোগ্যোপনিষদ-বর্ণিত মহাবাক্য—“তুমিই সেই”—“তত্ত্বমসি”! মনে রাখা দরকার, যেমন পথিকের নির্দেশ অনুসারে লোকটি গণনা করে নিজে অনুভব করেছিল যে, দশম লোকটি সে নিজেই, ঠিক তেমনি গুরুর ইঙ্গিতে সাধনার পর স্বরূপ উপলব্ধি কিন্তু শিষ্যের নিজেকেই করতে হবে। ব্রহ্মজ্ঞ গুরু কীভাবে শিষ্যকে উপদেশ দেন তার উদাহরণস্বরূপ স্বামি-শিষ্য-সংবাদ গ্রন্থে স্বামী বিবেকানন্দের সঙ্গে শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীর কথোপকথন—

“শিষ্য। (অধোমুখে বিষণ্ণভাবে) মহাশয়, আমি আপনার শরণাগত, আমার মুক্তিলাভের পন্থা খুলিয়া দিন, আমি যেন এই শরীরেই তত্ত্বজ্ঞ হইতে পারি।

স্বামীজী। (শিষ্যের অবসন্নতা দর্শন করিয়া) ভয় কি? সর্বদা বিচার করবি—এই দেহ-গেহ, জীব-জগৎ সকলই নিঃশেষ মিথ্যা, স্বপ্নের মতো; সর্বদা ভাববি—এই দেহটা একটা জড় যন্ত্রমাত্র। এতে যে আত্মারাম পুরুষ রয়েছেন, তিনিই তোর যথার্থ স্বরূপ। মন-রূপ উপাধিটাই তাঁর প্রথম ও সূক্ষ্ম আবরণ, তারপর দেহটা তাঁর স্থূল আবরণ হয়ে রয়েছে। নিষ্কল নির্বিকার স্বয়ংজ্যোতিঃ সেই পুরুষ এই-সব মায়িক আবরণে আচ্ছাদিত থাকায় তুই তোর স্ব-স্বরূপকে জানতে পারছিস না। এই রূপ-রসে ধাবিত মনের গতি অন্তর্দিকে ফিরিয়ে দিতে হবে। মনটাকে মারতে হবে। দেহটা তো স্থূল—এটা মরে পঞ্চভূতে মিশে যায়। কিন্তু সংস্কারের পুঁটলি—মনটা শীগগীর মরে না। বীজাকারে কিছুকাল থেকে আবার বৃক্ষে পরিণত হয়; আবার স্থূল শরীর ধারণ করে জন্মমৃত্যুপথে গমনাগমন করে, এইরূপে যতক্ষণ না আত্মজ্ঞান হয়। সেজন্য বলি, ধ্যানধারণা ও বিচারকালে মনকে সচ্চিদানন্দ-সাগরে ডুবিয়ে দে। মনটা মরে গেলেই সব গেল—ব্রহ্মসংস্থ হলি।”১০

তৈত্তিরীয়োপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে এই উদাহরণ আরো একবার দেওয়া হয়েছে। ভৃগু ঋষি তাঁর পিতা বরুণের কাছে প্রকৃত জ্ঞান জানতে চাইলে বরুণ গুরুর ভূমিকা নিয়ে তাঁকে অন্নময় কোশ, প্রাণময় কোশ ইত্যাদি আত্মসাক্ষাৎকারের জন্য ভাল করে বিচার করতে বলেছেন। ভৃগু এই বিচারের সাহায্যেই প্রত্যগাত্মারূপে ব্রহ্মকে নিজ-স্বরূপরূপে উপলব্ধি করেছিলেন।

মায়া স্বরূপত কী?: আমাদের আত্মস্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞানতাকে—যার ফলে আমরা এই ব্রহ্ম অনুভব করছি না, বরং এই নাম-রূপের জগৎ-সংসার দেখছি আর দেহ-মনে আত্মবুদ্ধি করছি—তাকেই অদ্বৈত-বেদান্তে ‘অজ্ঞান’ বা ‘মায়া’ বলা হয়েছে। সদানন্দ-যোগীন্দ্র প্রণীত বেদান্তসার গ্রন্থে ‘মায়া’ বা ‘অজ্ঞান’-এর সংজ্ঞা হিসাবে বলা হয়েছে যে, এটি ‘কিছু একটা’। তা কেমন? এমন যা ‘সৎ’ নয়, কারণ এটি নিত্য নয়। তবে এই অজ্ঞান কোনো আকাশকুসুমের মতো কোনো অলীক বা ‘অসৎ’ বস্তুও নয়; কারণ আমরা এই জগৎ ইত্যাদি সবকিছুকে অনুভব করি। তাই এই মায়া—না সৎ, না অসৎ—একে ‘অনির্বচনীয়’ বলা হয়। এই মায়ার দুরকমের শক্তি আছে—আবরণশক্তি এবং বিক্ষেপশক্তি। মায়ার আবরণশক্তি ব্রহ্মের স্বরূপকে আড়াল করে—যেমন সামান্য মেঘ আমাদের দৃষ্টি থেকে বিশাল সূর্যকে যেন আড়াল করে। মায়ার দ্বিতীয় শক্তিকে নাম দেওয়া হয়েছে বিক্ষেপশক্তি। আবরণশক্তি আমাদের স্বরূপকে আবৃত করে রেখেছে, অন্যদিকে বিক্ষেপশক্তি তাকে এই সমগ্র জগৎ-সংসাররূপে, যার মধ্যে আমাদের এই ক্ষুদ্র শরীর-মনও রয়েছে, প্রতিভাত করছে। এবিষয়ে বেদান্তের প্রিয় উপমা—একটি আধো-অন্ধকার স্থানে একটি দড়ি পড়ে আছে, সেটাকে দেখে আমি ভুল করে সাপ ভেবে ভয় পেলাম। এক্ষেত্রে আবরণ অর্থাৎ দড়িটাকে দড়ি বলে দেখতে পাচ্ছি না। আর বিক্ষেপ অর্থাৎ সেই দড়িটাকে সাপ মনে হচ্ছে, তার ফলে ভয় পাচ্ছি। তেমনি মায়ার আবরণশক্তিতে আমাদের স্বরূপ আবৃত হচ্ছে; আর বিক্ষেপশক্তিতে সেই স্বরূপের, এক অদ্বিতীয় ব্রহ্মের স্থলে এই বহুত্বপূর্ণ জগৎ-সংসার দেখছি।

‘জ্ঞান হলে…’-এর অর্থ কী?: জ্ঞান হলে কী হয়? নিজের প্রকৃত ব্রহ্মস্বরূপের উপলব্ধির সঙ্গে সঙ্গে মায়ার আবরণশক্তি তিরোহিত হয়ে যায়। আর এর ফল অজ্ঞান-নিবৃত্তি—মায়ার অন্য শক্তি অর্থাৎ বিক্ষেপশক্তি এরপর অর্থহীন হয়ে পড়ে থাকে। ব্রহ্মজ্ঞানের পর মায়ার আবরণশক্তি চলে যায় বরাবরের মতো। কিন্তু বিক্ষেপশক্তি থাকতে পারে—যদিও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষকে তা প্রভাবিত করতে পারে না। কারণ, তিনি এই নাম-রূপের বিক্ষেপের মাঝে সচ্চিদানন্দ-স্বরূপ অদ্বিতীয় ব্রহ্মকেই কেবল অনুভব করেন।

ধরা যাক, একজন অভিনেতা একটি নাটকে অভিনয় করছে। নাটকে তার ভূমিকা যাই হোক না কেন, সে কি নিজের প্রকৃত পরিচয় কখনো ভুলে যায়? অথচ অভিনয় সঠিকভাবে করার জন্য নাটক চলাকালীন সে নাটকের চরিত্রের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই, সে ইচ্ছা করলেই আবার নিজের প্রকৃত নাম বা পেশা ইত্যাদি সবকিছুই মনে করতে পারে। সে বাস্তবিকই জানে যে, নাটকের চরিত্র তার প্রকৃত পরিচয় নয়। কিন্তু আমাদের অবস্থা সেই অদ্ভুত অভিনেতার মতো—যে নাটকের চরিত্রকেই প্রকৃত ‘আমি’ মনে করে বসে আছে! মায়ার আবরণশক্তিতে আমরা নিজেদের ব্রহ্মস্বরূপ—প্রকৃত স্বরূপ ভুলে গিয়েছি। আর মায়ার বিক্ষেপশক্তিতে এই জগতের রঙ্গমঞ্চে আমাদের চরিত্রকেই ‘আমি’ বলে ভুল করে চলেছি। মায়ার আবরণশক্তি মিলিয়ে গেলেই প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি হবে; তখন আমাদের এই জগৎ-রঙ্গমঞ্চের চরিত্র আর ‘আমি’ বলে ভুল হবে না। এই প্রসঙ্গে মায়ের সঙ্গে স্বামী ঈশানানন্দের কথোপকথন স্মরণ করা যায়—“কিছু পরে আমি (স্বামী ঈশানানন্দ) বলিলাম : ‘আচ্ছা, আপনাদের কি সব সময়ে নিজের স্বরূপ মনে থাকে না?’ মা বলিতেছেন, ‘তা কি সব সময়ে থাকে? তাহলে কি এইসব কাজকর্ম করা চলে? তবে কাজকর্মের ভেতর যখন ইচ্ছা হয়, সামান্য চিন্তাতে দপ্‌ করে উদ্দীপনা হয়ে মহামায়ার খেলা সব বুঝতে পারা যায়।’”১১

ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর অননুকরণীয় উপমা দিয়ে কথামৃতে এই জ্ঞানকে বর্ণনা করেছেন : “বিচার করতে করতে আমি-টামি আর কিছুই থাকে না। পেঁয়াজের প্রথমে লাল খোসা তুমি ছাড়ালে, তারপর সাদা পুরু খোসা। এইরূপ বরাবর ছাড়াতে ছাড়াতে ভিতরে কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না।

“যেখানে নিজের আমি খুঁজে পাওয়া যায় না—আর খুঁজেই বা কে?—সেখানে ব্রহ্মের স্বরূপ বোধে বোধ কিরূপ হয়, কে বলবে!

“একটা লুনের পুতুল সমুদ্র মাপতে গিছিল। সমুদ্রে যাই নেমেছে অমনি গলে মিশে গেল। তখন খবর কে দিবেক?

“পূর্ণ জ্ঞানের লক্ষণ—পূর্ণ জ্ঞান হলে মানুষ চুপ হয়ে যায়। তখন ‘আমি’রূপ লুনের পুতুল সচ্চিদানন্দরূপ সাগরে গলে এক হয়ে যায়, আর একটুও ভেদবুদ্ধি থাকে না।”১২

এই হলো নিজের প্রকৃত স্বরূপজ্ঞান—ব্রহ্মজ্ঞান। শ্রীমার আলোচ্য বাক্যের ‘জ্ঞান’।

মানুষ দেখে—এই দেখা কীরকম?: মানুষ তিনভাবে দেখে বা অনুভব করে। প্রত্যক্ষ—নিজের ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে অনুভব, পরোক্ষ—অন্যের বা অন্য কিছুর সাহায্যে অনুভব। এই দুইয়ের বাইরে বেদান্তে অপরোক্ষ অনুভবের কথা বলা হয়—ইন্দ্রিয়ের সাহায্য-বিহীন অনুভব। অপরোক্ষ অনুভূতিরূপে জ্ঞানী স্বরূপ-ব্রহ্মকে ‘দেখেন’, অর্থাৎ উপলব্ধি করেন। স্বয়ম্প্রকাশ, যাবতীয় বুদ্ধিবৃত্তির প্রকাশক, সাক্ষিস্বরূপ নিত্য আত্মা সর্বদা অপরোক্ষ। জ্ঞানী সেই আত্মা এবং ব্রহ্মের অভেদত্ব অপরোক্ষরূপে অনুভব করেন, অনুভব করেন বৃহদারণ্যকোপনিষদ-বর্ণিত মহাবাক্য—“অহং ব্রহ্মাস্মি”। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার বহু স্থানে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই অবস্থার বিবরণ দিয়েছেন। উদাহরণস্বরূপ ত্রয়োদশ অধ্যায়ে জ্ঞানীর অনুভব সম্পর্কে বলা হয়েছে—“যদা ভূতপৃথগ্ভাবমেকস্থমনুপশ্যতি।/ তত এব চ বিস্তারং ব্রহ্ম সম্পদ্যতে তদা।।” অর্থাৎ, যখন (জ্ঞানী) ভূত বা বস্তুসকলের পৃথক ভাবকে এক আত্মাতেই অবস্থিত এবং সেই আত্মা থেকেই তাদের উৎপত্তি দর্শন করেন, তখন তিনি ব্রহ্মসম্পন্ন হন। শঙ্করাচার্য তাঁর ভাষ্যে ‘ব্রহ্ম সম্পদ্যতে’ (ব্রহ্মসম্পন্ন হন)-এর অর্থ ব্যাখ্যা করে বলেছেন : ‘ব্রহ্ম এব ভবতি’১৩—তিনি ব্রহ্মই হন। অবশ্যই তুলনীয় মুণ্ডকোপনিষদে বর্ণিত বিখ্যাত মন্ত্র—‘ব্রহ্ম বেদ ব্রহ্মৈব ভবতি’১৪—যিনি সেই পরম ব্রহ্মকে জানেন তিনি ব্রহ্মই হয়ে যান।

‘ঠাকুর-ঠুকুর সবই মায়া’-এর তাৎপর্য কী?: উপনিষদ বলেন, আমাদের প্রকৃত স্বরূপ যাবতীয় পরিবর্তন-নিরপেক্ষ। বৈদান্তিক ঋষিরা এই পরিবর্তন-নিরপেক্ষ প্রকৃত স্বরূপকে দেশ-কাল-বস্তু-পরিচ্ছেদশূন্য (সীমাশূন্য) অনন্ত ব্রহ্ম বলে নির্দেশ করেছেন। দেশ, কাল বা বস্তু বলে যা আমরা ধারণা করছি তা প্রকৃতপক্ষে অজ্ঞান বা মায়ার প্রভাব। মধুসূদন সরস্বতী তাঁর অদ্বৈতসিদ্ধি নামক বিখ্যাত মহাগ্রন্থে জগতের মিথ্যাত্ব প্রমাণ করতে এই তিন পরিচ্ছিন্নতাকে অন্যতম হেতু বা কারণ হিসাবে ব্যবহার করেছেন। কোনো কিছু ‘দেশ-পরিচ্ছেদশূন্য’র অর্থ তা সর্বব্যাপী। কোনো কিছু ‘কাল-পরিচ্ছেদশূন্য’র অর্থ তা চিরন্তন, তার জন্ম-মৃত্যু নেই। তেমনি, কোনো কিছু ‘বস্তু-পরিচ্ছেদশূন্য’র অর্থ বস্তুর দ্বারা কোনো সীমা নেই, অস্তিত্বের কিছুই এর থেকে আলাদা নয়—যার অর্থ এটি ‘অদ্বৈত’।

যাবতীয় পরিবর্তন-নিরপেক্ষ উপনিষদে বর্ণিত ব্রহ্ম কোনো গুণের অধীন নয়—নির্গুণ। এই নির্গুণ ব্রহ্ম যখন গুণযুক্ত হন তখন তাঁকে সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর বলে। কীভাবে গুণযুক্ত হন? মায়ার ফলে। অর্থাৎ, ব্রহ্ম অনির্বচনীয় (সমষ্টি-) মায়াশক্তির দ্বারা উপহিত হলে সৃষ্টি হয় ঈশ্বরের। একেই সাধারণভাবে মা ‘ঠাকুর-ঠুকুর’ বলেছেন। ঈশ্বর মায়াধীশ, কিন্তু একইসঙ্গে ঈশ্বরের সঙ্গে সমষ্টি-মায়াশক্তি মহামায়ারূপে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে আছে। অর্থাৎ, ঈশ্বরের কথা বললে মায়াশক্তির কথা বুঝতেই হবে, অন্যদিকে মায়াশক্তির কথা এলে মায়াধীশ ঈশ্বরকেও বুঝে নিতে হবে। অপরপ‌ক্ষে জীব মায়াধীন। জীব হলো ব্যষ্টি বা স্বতন্ত্র মায়া-উপহিত নির্গুণ ব্রহ্ম।

‘কালে আসছে, যাচ্ছে’—কাল কী? জ্ঞানী কীভাবে দেখেন?: যেহেতু ব্রহ্ম কাল-পরিচ্ছেদশূন্য, তাই ‘কাল’ ধারণাটি মায়ার ফলেই উৎপন্ন হয়। যদি প্রশ্ন ওঠে—মায়ার কারণ কী? স্বামী বিবেকানন্দ এর পরিপ্রেক্ষিতে বলেছিলেন : “The question—what is the cause of Maya (illusion)?—has been asked for the last three thousand years; and the only answer is : when the world is able to formulate a logical question, we shall answer it. The question is contradictory.”১৫ যেহেতু মায়া থেকেই কালের উদ্ভব আর কালের ওপর ভিত্তি করেই কার্য-কারণ সম্পর্ক (cause and effect), তাই ‘মায়ার কারণ কী?’—এই প্রশ্নটাই ভুল। কাছাকাছি একটি সাদৃশ্য কিন্তু আধুনিক পদার্থবিদ্যাতেও পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়—‘বিগ ব্যাং’ (Big Bang) থেকেই এই জগতের উৎপত্তি। ‘Time’ বা কালের উৎপত্তিও সেখান থেকেই। অর্থাৎ, Big Bang সময়ে কেউ যদি জিজ্ঞেস করে যে—এর আগে কী ছিল?—তবে তার উত্তরে বিনীতভাবে বলতে হবে—এর আগে ‘আগে’ শব্দটিরই কোনো মানে ছিল না; কারণ ‘আগে’ শব্দটি একটি কাল-কেন্দ্রিক শব্দ, আর Big Bang থেকেই কালের উৎপত্তি। তার আগে কালের আলোচনা এক গাণিতিক অসংলগ্ন বস্তুর উদ্ভব করে, যার পোশাকি নাম—‘ম্যাথেমেটিক্যাল সিঙ্গুলারিটি’ (mathematical singularity)। তাই প্রশ্নকর্তার প্রশ্নটাই ভুল।

আমরা একটু আগেই দেখেছি, সমষ্টি-মায়াশক্তি এবং ঈশ্বর অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। তাই বলা যেতে পারে যে, আমাদের প্রকৃত স্বরূপ ব্রহ্ম—যা কালাতীত, তা ঈশ্বরকেও অতিক্রম (বেদান্তের পরিভাষায়—‘বাধিত’) করে যায়। যতক্ষণ কালের ধারণা থাকবে ততক্ষণ কালাধীশ ঈশ্বরও থাকবেন। কিন্তু প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধিতে মায়ার নিবৃত্তির সঙ্গে মায়াধীশ ঈশ্বর এবং মায়াধীন কাল—উভয়ই বাধিত হয়। যতক্ষণ আমাদের স্বরূপ সম্পর্কে অজ্ঞানতা রয়েছে, যতক্ষণ আমাদের কর্তৃত্ব-ভোক্তৃত্ব বোধ রয়েছে, ততক্ষণই দেশ, কাল, ঈশ্বর ইত্যাদির অস্তিত্ব রয়েছে। জ্ঞান হলে উপলব্ধি হয় যে, অদ্বৈত-ব্রহ্ম ছাড়া দ্বিতীয় আর কোনো বস্তু নেই। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিষ্য শরচ্চন্দ্র চক্রবর্তীকে বলছেন : “এই জ্ঞাতা-জ্ঞেয় বা জানাজানি-ভাব থেকেই দর্শন-শাস্ত্র, বিজ্ঞান—সব বেরিয়েছে। কিন্তু মানব-মনের কোন ভাব বা ভাষা জানাজানির পারের বস্তুকে সম্পূর্ণরূপে প্রকাশ করতে পারছে না। দর্শন-বিজ্ঞানাদি partial truth (আংশিক সত্য)। ওরা সেজন্য পরমার্থতত্ত্বের সম্পূর্ণ expression (প্রকাশ) কখনই হতে পারে না। এইজন্য পরমার্থের দিক দিয়ে দেখলে সবই মিথ্যা বলে বোধ হয়—ধর্ম মিথ্যা, কর্ম মিথ্যা, আমি মিথ্যা, তুই মিথ্যা, জগৎ মিথ্যা। এখানে ‘মিথ্যা’ শব্দটি ‘জ্ঞাননিবর্ত্যত্বং মিথ্যাত্বম্’—এই অর্থে ব্যবহৃত। অর্থাৎ জ্ঞান হলে যার অস্তিত্ব থাকে না, তাকেই মিথ্যা বলা হয়। সহজ করে বললে অনিত্য অর্থেই এখানে মিথ্যা শব্দটি প্রযুক্ত। ব্রহ্মজ্ঞান হলে জগতের জ্ঞান বাধিত হয়। তাই জগৎ মিথ্যা—জগৎ অনিত্য বলা হয়। তখন বোধ হয় যে, আমিই সব, আমিই সর্বগত আত্মা, আমার প্রমাণ আমিই। আমার অস্তিত্বের প্রমাণের জন্য আবার প্রমাণান্তরের অপেক্ষা কোথায়? শাস্ত্রে যেমন বলে, ‘নিত্যমস্মৎপ্রসিদ্ধম্’—নিত্যবস্তুরূপে ইহা স্বতঃসিদ্ধ—এইভাবেই আমি সর্বদা ইহা অনুভব করি। আমি ঐ অবস্থা সত্যসত্যই দেখেছি, অনুভূতি করেছি। তোরাও দেখ, অনুভূতি কর… তবে তো শান্তি পাবি।”১৬

শ্রীমার প্রকাশ শ্রীশ্রীচণ্ডী-বর্ণিত ‘যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা’-রূপে। যাঁকে উদ্দেশ করে ব্রহ্মা স্তব করেছেন—‘অর্ধমাত্রা স্থিতা নিত্যা যানুচ্চার্যা বিশেষতঃ’১৭ (অর্থাৎ, বিশেষরূপে যা অনুচ্চার্যা নির্গুণ বা তুরীয়া—তাও আপনি), তাঁরই আধুনিক আগমন শ্রীমায়ের মধ্যে। জ্ঞানস্বরূপা দেবী শ্রীমার “জ্ঞান হলে মানুষ দেখে ঠাকুর-ঠুকুর সবই মায়া—কালে আসছে, যাচ্ছে।”—এই সহজ উক্তির সুগভীর তাৎপর্য আমরা এখন সামান্য বুঝতে পারি। প্রকৃত জ্ঞানের উদয়ে অজ্ঞান মায়া সম্পূর্ণ তিরোহিত হলে উপলব্ধি আসে যে, কেবল সৎ-চিৎ-আনন্দ-স্বরূপ অদ্বৈত-ব্রহ্মই বস্তু। এর বাইরে সবকিছুই মরীচিকার মতো, স্বপ্নের মতো, অনিত্য—মায়া-নির্মিত মিথ্যা। সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বরও সেই মহামায়ার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িয়ে আছেন। ব্রহ্ম চিরন্তন একমাত্র সত্য বস্তু—যেখানে কালের ধারণাও পর্যন্ত আসে মায়ার ফলে; অতএব ‘কাল’ মিথ্যা। জ্ঞানী দেখেন, অদ্বৈত ব্রহ্ম ছাড়া সবকিছুই (এমনকী ঈশ্বর পর্যন্ত মায়া) কালের ধারণার সঙ্গে আসছে এবং চলে যাচ্ছে।

তথ্যসূত্র

১ স্বামী প্রেমানন্দের পত্রাবলী, উদ্বোধন কার্যালয়, কলকাতা, ১৯৯৪, পৃঃ ১৩১-৩২
২ শ্রীশ্রীমায়ের কথা, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১১, অখণ্ড, পৃঃ ১৮৯
৩ তৈত্তিরীয়োপনিষদ, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০২১, ২।১।ক, শাঙ্করভাষ্য
৪ ঐ, ২।১, পৃঃ ২৮৬ ৫ ঐ, ২।১।ঙ, শাঙ্করভাষ্য
৬ দ্রঃ স্বামী অমৃতানন্দ (অনুবাদ ও টীকা), বেদান্তসারঃ, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০২০, পৃঃ ৬৫
৭ তৈত্তিরীয়োপনিষদ, ২।১।৫
৮ দ্রঃ বিদ্যারণ্য স্বামী, পঞ্চদশী, উদ্বোধন কার্যালয়, ১৯৯৯, পৃঃ ২৩৪-৩৫
৯ স্বামী সারদেশানন্দ, শ্রীশ্রীমায়ের স্মৃতিকথা, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৫, পৃঃ ১০৭
১০ স্বামী বিবেকানন্দের বাণী ও রচনা, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১৫, ৯ম খণ্ড, পৃঃ ১১৪
১১ শ্রীশ্রীমায়ের কথা, পৃঃ ২৭৯
১২ শ্রীম-কথিত, শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণকথামৃত, উদ্বোধন কার্যালয়, ২০১১, অখণ্ড, পৃঃ ১৯
১৩ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, ১৩।৩০ এবং ঐ, শাঙ্করভাষ্য
১৪ মুণ্ডকোপনিষদ, ৩।২।৯
১৫ The Complete Works of Swami Vivekananda, Advaita Ashrama, Kolkata, 2021, vol. 5, p. 276
১৬ বাণী ও রচনা, ৯ম খণ্ড, পৃঃ ১১৫
১৭ শ্রীশ্রীচণ্ডী, ৫।৭১—৭৩, ১।৭৪

‘স্বামী সারদানন্দ স্মারক রচনা’রূপে এটি প্রকাশিত হলো।

অধ্যাপক, গণিত বিভাগ, নর্থ ডাকোটা স্টেট ইউনিভার্সিটি, আমেরিকা