পূর্ববঙ্গের (অধুনা বাংলাদেশ) ঢাকাস্থ ফরিদপুরের কবিরাজ কৃষ্ণচন্দ্র সেনের কনিষ্ঠ পুত্র রামপ্রসাদ কলকাতার মেডিকেল কলেজ থেকে পাশ করে ডাক্তারিতে মেতে যান স্বভূমিতে। পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হলেন ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র-দীক্ষিত ভাব-কবি কালীনারায়ণ গুপ্তের কন্যা হেমন্তশশীর সঙ্গে। তাঁদের প্রথম সন্তান এবং একমাত্র পুত্র অতুলপ্রসাদের জন্ম ২০ অক্টোবর ১৮৭১।
শিশুবেলা থেকেই তাঁর জীবন ছিল গীতিময়। মাতামহ কালীনারায়ণ এবং পিতা রামপ্রসাদের ব্রহ্মসংগীত সাধনাকালে গলা মেলাতেন বালক অতুলপ্রসাদ। মাঝে-মধ্যে সংগতও করতেন মৃদঙ্গে। গায়ক হিসাবে তাঁর খ্যাতি ছিল স্কুলে। জীবনের চোদ্দ-বসন্তে নাবালক-কলমে গান হয়ে উঠল ব্রহ্মচেতনা—এক আত্মীয়ার অন্নপ্রাশনের অনুষ্ঠানে—
“তোমারি উদ্যানে তোমারি যতনে উঠিল কুসুম ফুটিয়া।
এ নব কলিকা হউক সুরভি তোমার সৌরভ লুটিয়া।
প্রাণের মাঝারে নাচিছে হরষ সব বন্ধন টুটিয়া।
আজি মন চায়, অঞ্জলি লয়ে ধাই তব পানে ছুটিয়া।…
দীর্ঘায়ু হোক এ কোমল শিশু সকলের প্রেমে বাড়িয়া;
সে জীবনে প্রভু, যেন কোথা কভু না যায় তোমারে ছাড়িয়া।”
সেই শুরু। সূচনাকালেই অকালে প্রয়াত হন পিতা রামপ্রসাদ। মা আর তিন বোনকে সঙ্গী করে পরিবারভুক্ত হলেন দাদামশায়ের। তবে শুরুর যেমন শুরু থাকে তেমনি শুরু স্কুলজীবনে। ছাত্রদের প্রতি স্নেহপ্রবণ ছিলেন কলেজিয়েট স্কুলের প্রধান জনসন পোপ। তাঁর বদলিতে স্কুলের দায়িত্ব নেন বুথ সাহেব। গম্ভীর, রাশভারি, কঠোর বুথ ছিলেন পোপের সম্পূর্ণ বিপরীত। বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করে পড়াতেন ক্লাসে। তাঁর আচরণে মনোক্ষুণ্ণ অতুলপ্রসাদ বন্ধুমহলে লিখলেন—
“বুথের প্রধান কাজ অঙ্গভঙ্গি করা।
গোলমালে অবস্থির ঘণ্টা হল সারা।।
বিদ্যানিধি ডাক্তার রায় বলিতে অক্ষম।
প্রসন্ন তাহাকে ভাবে সদা অনুপম।।
সাহেবি ফ্যাসানে দক্ষ সারদারঞ্জন।
বুক ফুলিয়ে হাঁটেন বাবু সূর্যনারায়ণ।।”
শৈশবে অতুলপ্রসাদের কাব্যমননে মদত জুগিয়েছেন তাঁর সেজমামা গঙ্গাগোবিন্দ। নবাবপুরের নাট্যমঞ্চে সেজমামার সাহচর্যে জীবনের প্রথম নাটক দেখেন কালিদাসের শকুন্তলা। সেই শিশুমন ভারি হয়ে উঠেছে শকুন্তলার বেদনায়। দু-চোখ ভরে উঠেছে
জলে। তাঁর উত্তরকালের গানে ছায়া পড়েছে সেই বেদনার—
“বঁধু, ধরো ধরো মালা, পরো গলে,
ফিরে দিয়ো না বনকুসুম ব’লে।
কাঁটার ঘায়ে রাঙা হাতে
ফুল তুলেছি আঁধারে দুঃখ-রাতে;
তাহে গেঁথেছি বিজনে আঁখিজলে।”
তাঁতিবাজারের নাট্যমঞ্চেও বহু নাটক দেখেছেন অতুলপ্রসাদ। সেই নাট্যমঞ্চের পুরোধা চন্দ্রনাথ রায় গড়ে তুলেছিলেন একটি বাউলের দল। বাউল সেজে সকলে রাত্রিকালে বাড়ি বাড়ি ঘুরে বাউলগান পরিবেশন করত। সেই বাউলগানে বিভোর থাকতেন অতুলপ্রসাদ। তাই পরবর্তী জীবনে তাঁর বহু গানে মিলেছে শৈশবের সেসব বাউল সুরের প্রভাব। বাউল-অতুলের তেমনি এক রচনা—
“তোমায় ঠাকুর, বলব নিঠুর কোন্ মুখে?
শাসন তোমার যতই গুরু, ততই টেনে লও বুকে।
সুখ পেলে দিই অবহেলা,
শরণ মাগি দুখের বেলা;
তবু ফেলে যাও না চলে, সদাই থাক সম্মুখে।…
ভবের পথে শূন্য থালি,
বেড়াই ঘুরে দীন কাঙালি।
দৈন্য আমার ঘুচবে যবে পাব দীনবন্ধুকে!”
বাংলার নিজস্ব কীর্তন-বাউলের বনেদি বুননে গড়ে উঠতে থাকে অতুলপ্রসাদের বুনিয়াদি সংগীত-মানস। সহজিয়া সুর-সংগতিতে মিলেছে স্বতন্ত্র অতুল-কাব্য।
স্কুলজীবনের ইতিতে কলকাতার কলেজ-অধ্যয়ন শেষে ব্যারিস্টারি পড়ার আশায় বিলেতে পাড়ি দেন অতুলপ্রসাদ। সেই যাত্রাকালে ইতালির পানি-পথে ‘গন্ডোলা’ চালকদের গান শোনেন ভেনিসে। সে-গানের রূপকল্পে সদ্য দেশছাড়া অতুলপ্রসাদ রচনা করলেন এক অবিস্মরণীয় স্বদেশগাথা—
“উঠ গো ভারতলক্ষ্মী, উঠ আদি জগত-জন পূজ্যা,
দুঃখ দৈন্য সব নাশি করো দূরিত ভারত-লজ্জা।
ছাড়ো গো ছাড়ো শোকশয্যা, কর সজ্জা
পুনঃ কমল-কনক-ধন-ধান্যে!
জননী গো, লহো তুলে বক্ষে,
সান্ত্বন-বাস দেহো তুলে চক্ষে;
কাঁদিছে তব চরণতলে,
ত্রিংশতি কোটি নরনারী গো।”
গানের সঞ্চারিতে প্রবাসী অতুলের আবেগে প্রকাশ পেল ভিন্ন পদ—
“জননী, দেহো তব পদে ভক্তি,
দেহো নব আশা, দেহো নব শক্তি;
এক সূত্রে করো বন্ধন আজ
ত্রিংশতি কোটি দেশবাসী জনে।”
বিলাতে অতুলপ্রসাদের ব্যারিস্টারি পড়া এবং বসবাসের বিপুল ব্যয়ভার বহন করেন তাঁর মাতুলরা। তাঁর বড়মামা কৃষ্ণগোবিন্দ সপরিবারে বিলাত-ভ্রমণে যান সেসময়। মাতুল-কন্যা হেমকুসুম গান গাইতেন চমৎকার; সঙ্গে দক্ষ ছিলেন পিয়ানো আর বেহালা বাজানোয়। সংগীতপ্রেমী হেমকুসুমের সঙ্গে প্রণয় ও ঘনিষ্ঠতা জন্মায় অতুলপ্রসাদের। সমাজ-নিয়মে অসম বন্ধনে জড়িয়ে পড়লেন ভাই-বোন। হেমকুসুমের দেশে ফিরে যাওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই বিরহকাতর একাকীত্বে কলকাতা ফেরার তাগিদ অনুভব করতে থাকেন প্রেমিক অতুলপ্রসাদ। মনে মনে স্থির করেন—পাশ করেই ফিরে যাবেন কলকাতায়। সেখানেই গড়ে তুলবেন নিজের জীবন-কর্ম। ঘরে ফেরার আর্তিতেই রচনা করলেন ‘বিলাতে অদ্বিতীয়া গায়িকা মাদাম প্যেটি’র গাওয়া ‘Home Sweet Home’-এর অনুসরণে—
“প্রবাসী, চল্ রে দেশে চল্;
আর কোথায় পাবি এমন হাওয়া, এমন গাঙের জল!
যখন ছিলি এতটুক্,
সেথাই পেলি মায়ের সুধা ঘুম-পাড়ানো বুক;
সেথাই পেলি সাথির সনে বাল্যখেলার সুখ; …
মনে পড়ে দেশের মাঠে খেত-ভরা সব ধান,
মনে পড়ে তরুণ চাষির করুণ বাঁশির তান,
মনে পড়ে পুকুর-পাড়ে বকুল গাছের গান
মনে পড়ে আকাশ-ভরা মেঘ ও পাখির দল। —
প্রবাসী, চল্ রে দেশে চল্।”
গানটি প্রসঙ্গে অগ্রজ সাহিত্যিক কেদারনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমীক্ষা— “শুনে আমার প্রাণ চমকে উঠেছিল। এ তো, কথা নয়,—কবিতা নয়,—এ যেন প্রাণের প্রতিধ্বনি শুনলুম। যৌবনে কবিরা অনেক কথাই লেখেন,—তাতে ক্ষমতার পরিচয় থাকতে পারে—সে তো এমন সত্যের মর্মস্পর্শী সুর শোনায় না। প্রাণটা যেন কেমন হয়ে গিয়েছিল।”
বাউল মনের আপন গানের অতুল-ব্যাখ্যায়— “আমার সেই মিষ্টি দেশটি আমার চোখের সামনে, আমার প্রাণের সামনে ভাসতে লাগল, ভাল ক’রে মনে হ’ল—আমি ভুলিনি, ভুলিনি আমার দেশ-মাতাকে, যদিও প্রায় পঁয়ত্রিশ বৎসর সে গ্রামখানিতে যাইনি। দূর দেশে থাকলে কি হবে, মার টান বড় টান।”
১৮৯৫। ব্যারিস্টারি পাশ করে বিলাত থেকে ‘মার টানে’ই কলকাতায় ফিরলেন অতুলপ্রসাদ। খ্যাতনামা আইনজীবী সত্যেন্দ্রপ্রসন্ন সিংহের সহকারী হিসাবে প্র্যাকটিস শুরু করলেন কলকাতা হাইকোর্টে। তখনকার কলকাতা মশগুল সংগীত ও সাহিত্যের বর্ণময় বনেদিয়ানায়। সরলাদেবীর দূতালিতে অতুলপ্রসাদের পরিচয় ঘটল রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই রবীন্দ্রনাথ আর দ্বিজেন্দ্রলালের বান্ধবজনদের উদ্যোগে গড়ে উঠল ‘খামখেয়ালি সভা’। সে-সভার সক্রিয় সদস্য হয়ে ওঠেন অতুলপ্রসাদ। সভার এক বৈঠকে রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামীর মার্গসংগীতের পরিবেশনায় অতুলপ্রসাদের গানের পালে লাগল নতুন হাওয়া। গানবাঁধার ভাবনা গেল বদলে। কিন্তু সময় সঙ্গ দিল না।
নতুন সুরের রেশে নিজেকে বেশি দিন ভাসিয়ে রাখতে পারলেন না অতুলপ্রসাদ। জীবন-নদীতে ঝড় উঠল—হেমকুসুমের সঙ্গে বিয়ের প্রস্তাবে। সাধারণ সমাজ-নিয়মের বিপরীত স্রোতে পিসতুতো দাদা আর মামাতো বোনের বিয়েতে সমর্থন ছিল না সমকালীন কোনো আইনের। অবশেষে সত্যেন্দ্রপ্রসন্নের পরামর্শে সমাজ-সংস্কারকে উপেক্ষা করে বিলেত পাড়ি দিলেন বিবাহার্থী হেমকুসুম আর অতুলপ্রসাদ। বিয়ে করলেন বিলেতের সীমান্তবর্তী স্কটল্যান্ডের গ্রেটনা গ্রিন
গ্রামে। সেখানে সিদ্ধ ছিল এমত বিবাহ। পরিশেষে, আইনের স্বীকৃতি পেল হেমকুসুম আর অতুলপ্রসাদের পরিণয়।
বিয়ের পর বিদেশেই ওকালতি শুরু করেন অতুলপ্রসাদ। পসার জমল না। অভাব বাড়তে থাকল সংসারে। অভাবের সংসারে জন্ম নিল যমজ সন্তান—দিলীপকুমার আর নিলীপকুমার। শীতের প্রকোপে, বিনা চিকিৎসায় বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হারাতে হয় নিলীপকে। শোকার্ত অতুলপ্রসাদ সপরিবারে ফিরলেন স্বদেশে।
এবার আর কলকাতা নয়, ডেরা বাঁধলেন লখনৌয়ে। বেদস্তুর বিয়ের জন্য কলকাতায় তখন তিনি সমাজ-নিন্দিত। বিলেতফেরত ব্যর্থ ব্যারিস্টারের গানে তারই আর্তি ফুটে উঠল—
“রইল কথা তোমারি, নাথ, তুমিই জয়ী হলে।
ঘুরে ফিরে এলাম আবার তোমার চরণ-তলে।
কুড়িয়ে সবার ভালোবাসা
ভবের ডালে বাঁধনু বাসা,
ঝড় এসে এক সর্বনাশা
হে নাথ, ফেলল ভূমিতলে।”
বিপন্নতায় কখনো আশা হারাননি অতুলপ্রসাদ। যখন তাঁর বিষাদবেদনা প্রকাশ পেয়েছে গানে, তখনো আঁকড়ে থেকেছেন আনুপূর্ব আশাকে। ব্যথা-বিচ্ছেদ-বিরহে কখনো তাঁর প্রেমিক সত্তাকে বর্জন করেননি অতুলপ্রসাদ। সংসারে প্রেমকে আশ্রয় করেছেন পরমেশ্বরের প্রতীকে—
“সংসারে যদি নাহি পাই সাড়া,
তুমি তো আমার রহিবে।
বহিবারে যদি নাহি পারি এ ভার,
তুমি তো, বন্ধু, বহিবে।…
দুঃখেরে আমি ডরিব না আর,
কণ্টক হোক কণ্ঠের হার;
জানি তুমি মোরে করিবে অমল
যতই অনলে দহিবে।”
ব্যারিস্টার-বন্ধু মমতাজ হোসেনের সহায়তায় লন্ডন-কলকাতা-ফেরত অতুলপ্রসাদের আইনি জীবনে মিলল সফলতা। মিলল অর্থ-বৈভব। কিন্তু, মিলল না সংসারী শান্তি-সুখ। মা হেমন্তশশী আর স্ত্রী হেমকুসুমের বেমিল টানাপোড়েনে অতুলপ্রসাদের সারাজীবনের পাকে জড়িয়ে রইল বেসামাল অশান্তি। সঙ্গীহীন এমত জীবনের দোস হলো সংগীত। কাব্যসুরের একান্ত চর্চায় শান্তিসন্ধানে মাতলেন অতুলপ্রসাদ। তাঁর কাব্য জুড়ে তাই অনুভব আর অভিজ্ঞতার অন্তর্লীন প্রকাশ। সুরের বন্দিশে প্রেম-বিরহের আবেগ-অন্তরাল। অতুলপ্রসাদের জীবন ঘিরে এমনি মর্মগাথার বেষ্টনী। অতুলপ্রসাদের সাক্ষাৎ শিষ্য পাহাড়ী সান্ন্যালের নিরীক্ষায়— আমার অতুলদা ছিলেন আশাবাদী মানুষ। যখন তিনি প্রগাঢ় বেদনা গানের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করেছেন তখনও তার মধ্যে তিনি কোনদিন আশাকে ছাড়েন নি। যার জন্যই তিনি বলতে পেরেছেন—
“দুঃখেরে আমি ডরিব না আর
কণ্টক হবে কণ্ঠের হার
জানি তুমি মোরে করিবে অমল যতই অনলে দহিবে।”
সেই গীতিময় স্বরূপে জয় করতে চেয়েছেন জীবনের সমস্ত দুঃখ-কষ্ট-জ্বালা। সংগীতের সৃজনেই মিলেছে সহায়-সম্বল বন্ধুতা—
“ওগো দুঃখ-সুখের সাথী, সঙ্গী দিনরাতি, সঙ্গীত মোর!
তুমি ভব-মরু-প্রান্তর-মাঝে শীতল শান্তির লোর!
বন্ধুহীনের তুমি বন্ধু
তাপিত জনের সুধা সিন্ধু
বিরহ আঁধারে তুমি ইন্দু
নির্জন-জন-চিত-চোর!”
শোক থেকে উত্তরণে কবি শেলি লেখেন এডোনিস, টেনিসন লেখেন ইন মেমোরিয়াস আর অতুলপ্রসাদের রচনায় প্রকাশ পায় গীতিগুঞ্জ (স্বদেশ পর্যায়ের গান ব্যতিরেকে)। শুধু রচনাই নয়, তাঁর পরিবেশনাতেও ছিল এক অপরূপ শান্ততা। সাহিত্যিক হেমেন্দ্রকুমার রায়ের স্মৃতিতে জাগর ভারতী পত্রিকার দপ্তরে অতুলপ্রসাদের সুরালাপ— গান শোনাতে কোনদিন আসতেন কবি অতুলপ্রসাদ সেন; সৌম্যমুখে স্থিরভাবে বসে শান্ত কণ্ঠস্বরে স্বরচিত সঙ্গীত শুনিয়ে স্নিগ্ধ করে তুলতেন শ্রোতাদের চিত্ত।
সম-অভিজ্ঞতার সন্ধান মেলে রবিপুত্র রথীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতৃস্মৃতি-তে— অতুলপ্রসাদের গলা ছিল যেমন মিষ্টি, গাইবার ধরণও ভারি সুন্দর। সবচেয়ে ভাল লাগত তিনি যে আন্তরিকতার সঙ্গে ভাবে বিভোর হয়ে গান করতেন।” সংগীতজ্ঞানী ধূর্জটিপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতি-মুখরতায়— “অফিস-ঘর থেকে উকীলের ডায়েরী নিয়ে আসতেন, তারই পাতা থেকে গানের খসড়া বেরুত।… তাঁর গান গাওয়ার মধ্যে একটি কথা আমার চিরকাল মনে থাকবে। সেটি হলো অবসর। গান গাইবার সময় প্রত্যেক কথাকেঅবসর দিতেন, বাক্যের সাথে তার সম্বন্ধটি উপলব্ধি করবার জন্য উদ্গ্রীব হতাম। নীরবতার আশ্রয়ে গানটি মিলিয়ে যেত, যেন মায়ের কোলে ছেলে ঘুমিয়ে পড়েছে, আমরা নীরব হয়ে রস উপলব্ধি করতাম। তাঁর গান গাওয়া ছিল নিভৃতির কম্প্রিত রূপচ্ছটা, বাগ্ হত সম্ভ্রমের সংযত কুশলতা। এই বিরাম কি তাঁর বিশ্রামবিহীন জীবনেরই ক্ষতিপূরণ?”
ধূর্জটিপ্রসাদের আশঙ্কা সত্যি হয়ে উঠত তাঁর গানে। এক বন্ধুর জন্মদিনের অনুষ্ঠান-শেষে বাড়ি ফিরে অতুলপ্রসাদ দেখলেন—তাঁর সব পোশাক-পরিচ্ছদ আগুনে পোড়াচ্ছেন স্ত্রী হেমকুসুম। বাড়ির বাইরে থেকেই ফিরে গেলেন অতুলপ্রসাদ। পরের দিনই পৌঁছালেন কলকাতায় জেঠতুতো দাদা সত্যপ্রসাদের বাড়ি। ডায়েরির পাতায় সত্য-বয়ান— “অতুল আমার বুকে মাথা রাখিয়া পড়িয়া থাকিত। নীরবতার মধ্যেই তাহার প্রাণের বেদনা জানিতে ও বুঝিতে পারিতাম।… এরূপ সমবেদনায় আমরা কত বিনিদ্র রজনী কাটাইয়াছি। সেবারেই অতুল তাঁর গানটি রচনা করেন—“যাব না, যাব না, যাব না ঘরে, বাহির করেছে পাগল মোরে।” বঢ়ি মালকাজানের গাওয়া নট-মল্লারের ঠুংরি ‘সজনি বহকাউ না মোহে বহকাউ না’র আদলে ঘরপোড়া ব্যারিস্টার কবির মর্মগাথায় মূর্ত হলো হেম-প্রেমের কুসুমাঞ্জলি—
“যাব না, যাব না, যাব না ঘরে,…
নীল সরে হেমতরী-’পরে
হাসে নববিধু লাজ-ভরে।
‘এসো বঁধু’ ব’লে ডাকে মোরে
মোহন স্বরে।”
আবার অচ্ছনবাইয়ের ‘মুকটধারি কান্হা বজায়ে বাঁশুরিয়া রে’র ছাঁচে অতুলপ্রসাদ ‘প্রেম-তরী’ বাইলেন ‘হেম-যমুনায়’—‘দেশ-পিলু’র মেলবন্ধে—
“চাঁদিনী রাতে কে গো আসিলে?
উজল নয়নে কে গো হাসিলে?…
হেম-যমুনায়
প্রেম-তরী বায়,
কে ডাকে আমায়—‘আয় গো আয়’?
প্রভাতবেলায়
সোনার ভেলায়
কেমনে চ’লে যাবে হায়!”
অতুলপ্রসাদের স্নেহধন্য বিনয়েন্দ্রনাথ দাশগুপ্তের স্মৃতিপটে— এক রবিবার সকালে একটি বড় আসর… শ্রীকৃষ্ণ [রতনঝন্কার] প্রাণ খুলে একটি গানই চল্লিশ মিনিট গাইলেন—“ভবানীদয়ানী মহিষাসুরমদনী…”। সকলের মন ভরে গেল… পরের দিন সন্ধ্যাবেলায় আমি আর ধূর্জটিবাবু ধীরে ধীরে সেন মশায়ের কক্ষে প্রবেশ করলাম। তিনি বিশেষ আনন্দে স্বাগত জানালেন এবং তারপর শোনালেন যে-গানটি তিনি সদ্য লিখেছেন, ‘ভবানীদয়ানী’র অনুকরণে—
“সে ডাকে আমারে, বিনা সে সখারে
রহিতে মন না রে, সে ডাকে
প্রভাতে যারে দেখিবে বলি, দ্বার খোলে, কুসুমকলি’
কুঞ্জে ফুকারে অলি, যাহারে বারে বারে…”
ভৈরবীর মধ্যে একটু বিশেষ ঢং লাগিয়ে গানটিকে কি মনোমোহকর করে তুললেন। বিনয়েন্দ্রর ভিন্ন স্মৃতিলেখায়— ভাব যখনই ভাষাতে রূপ পেল, সুর এসে আশ্রয় নিল,… তখনই আমরা পূর্ণতার আস্বাদ পেয়েছি—যেমন…
“মিছে তুই ভাবিস মন,
তুই গান গেয়ে যা, গান গেয়ে যা আজীবন,
পাখীরা বনে বনে, গাহে গান আপন মনে,
নাই বা যদি কেহ শোনে, গেয়ে যা গান অকারণ…।”
আকাঙ্ক্ষিত আবেগ গ্রামোফোন রেকর্ডে অতুলপ্রসাদের নিজস্ব গায়নে পরিপূর্ণতা পেল ‘জানি জানি তোমারে গো রঙ্গরানি’র যুগলবন্দিতে।
ব্যারিস্টার বন্ধু হামিদ আলি খাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল গজল রচনায়। বন্ধুর সাহচর্যে অতুলপ্রসাদ রচনা করলেন বাংলা গজল—
“ভাঙা দেউলে মোর কে আইলে আলো হাতে?
ব’লে দিল কে পথ এ কালো রাতে?”
পছন্দের রাগ পিলুতে বাঁধলেন ভিন্ন গজল—
“ওগো ক্রন্দসী পথচারিণী,
তুমি কোথা যাও, তুমি কারে চাও?
কী ব্যথা তব অন্তরে,
ও বিষাদিনী, মোরে বলে যাও। …
দেখ তল্লাসি এই অন্তরে,
তুমি যারে চাও যদি তারে পাও।”
বর্ণময় কাব্য-সুরের গানের আড়ালে জীবনভর অতুলপ্রসাদ আগলে রেখেছিলেন হেম-প্রেমের বিস্ময়-বিষাদ। রবীন্দ্রকাব্যে তারই সমর্থন—
“মৈত্রী তব সমুচ্ছল ছিল গানে গানে
অমরাবতীর সেই সুধা-ঝরা দানে।
সুরে ভরা সঙ্গ তব
বারে বারে নব নব
মাধুরীর আতিথ্য বিলালো;
রসতৈলে জ্বেলেছিল আলো।।”