।।১৬।।
[পূর্বানুবৃত্তি : ভাদ্র ১৪২৯ সংখ্যার পর]

উপাধি সর্বদা পরিচ্ছিন্ন

শাঙ্করভাষ্য—‘যদস্য ব্রহ্মণো রূপম্‌’ ইতি পূর্বেণ সম্বন্ধঃ। ন কেবলমধ্যাত্মোপাধিপরিচ্ছিন্নস্যাস্য ব্রহ্মণো রূপং ত্বমল্পং বেত্থ; যদপ্যধিদৈবতোপাধিপরিচ্ছিন্নস্যাস্য ব্রহ্মণো রূপং দেবেষু বেত্থ ত্বম্‌ তদপি নূনং দভ্রমেব বেত্থেতি মন্যেহহম্‌। যদধ্যাত্মং, যদধিদৈবং দেবেষু তদপি চোপা-ধিপরিচ্ছিন্নত্বাদ্দভ্রত্বান্ন নিবর্ততে।

ব্যাখ্যা—“‘যদস্য ব্রহ্মণো রূপম্‌’ ইতি পূর্বেণ সম্বন্ধঃ”—বলছেন, মন্ত্রের ‘যদস্য’ অংশটি পূর্বের ‘ব্রহ্মণো রূপম্‌’—এর সাথে সম্বন্ধ হবে। বলছেন, ব্রহ্মের যে এই রূপ, সে কীরকম?—“ন কেবলমধ্যাত্মোপাধি-পরিচ্ছিন্নস্যাস্য ব্রহ্মণো রূপং ত্বমল্পং বেত্থ”—তুমি শুধু এই অধ্যাত্ম-পরিচ্ছিন্নাদি মানে দেহাদিতে পরিচ্ছিন্নরূপে যে-ব্রহ্ম, দেহাদির সঙ্গে অভিন্নরূপে যে-ব্রহ্ম সেই তাঁকেই অল্পরূপে জান—এরকম নয়; “যদপ্যধিদৈবতোপাধি-পরিচ্ছিন্নস্যাস্য ব্রহ্মণো রূপং দেবেষু বেত্থ ত্বম্‌ তদপি নূনং দভ্রমেব” অর্থাৎ অধিদৈবত উপাধি-পরিচ্ছিন্ন ব্রহ্মের যে-রূপ দেবতাদের ভিতরে তুমি দেখ অর্থাৎ জান, ‘তদপি’—সেটিও ‘নূনং দভ্রমেব বেত্থেতি মন্যেঽহম্‌’—অল্পই জান বলে মনে করি। অর্থাৎ ব্রহ্মকে পরিচ্ছিন্নরূপে তুমি জান, অপরিচ্ছিন্ন রূপে জান না। ‘যদধ্যাত্মং যদধিদৈবং তদপি চোপাধিপরিচ্ছিন্নত্বাৎ’—অধ্যাত্ম অর্থাৎ দেহাদিতে যেমন, সেরকম অধিদৈব অর্থাৎ দেবতাদের মধ্যেও যে ব্রহ্মের রূপ, সেটিও উপাধি-পরিচ্ছিন্ন। সুতরাং উভয় রূপই উপাধি-পরিচ্ছিন্ন হওয়ার জন্য ‘দভ্রত্বাৎ [ক্ষুদ্রত্বাৎ]’—ক্ষুদ্রতারূপ, অল্পত্বরূপ দোষ থেকে তা ‘ন নিবর্ততে’—নিবৃত্ত হচ্ছে না। ‘দভ্র’ মানে ক্ষুদ্র। দেহাদি-পরিচ্ছিন্নরূপে যেরকম ক্ষুদ্রতা থাকছে, অধিদেবতাদি-পরিচ্ছিন্নরূপেও সেরকম ক্ষুদ্রতা থাকছে। দভ্রত্ব, ক্ষুদ্রত্ব থেকেই যাচ্ছে। এখানে সসীমত্বই হলো অল্পত্ব। উভয় রূপই সসীম বলে দভ্র অর্থাৎ অল্প।

নিরূপাধিক ব্রহ্ম সর্বদা অবিদিত

শাঙ্করভাষ্য—যত্তু বিধ্বস্তসর্বোপাধিবিশেষং শান্তমনন্তমেকমদ্বৈতং ভূমাখ্যং নিত্যং ব্রহ্ম ন তৎ- সুবেদ্যমিত্যভিপ্রায়ঃ।

ব্যাখ্যা—[তাহলে ব্রহ্মের কোন্‌ রূপটি অক্ষুদ্র অর্থাৎ অল্প নয়—এই প্রশ্নের উত্তরে ভাষ্যকার বলছেন] ‘যত্তু’—যেখানে ‘বিধ্বস্তসর্বোপাধিবিশেষং’—সর্ব উপাধি নাশ হয়ে গেছে, সর্ব উপাধির নিবৃত্তি হয়েছে; এবং যা ‘শান্তম্‌’—সর্ব বিক্রিয়ারহিত [শান্ত মানে সর্ব কল্পনারহিত, যেখানে সমস্ত তর্ক প্রতিহত হয়ে গেছে]; ‘অনন্তম্‌’—অন্তহীন, সীমাহীন [পরিচ্ছেদরহিত]; ‘একম্‌’—‘অদ্বৈতং’—দ্বৈতরহিত; ‘ভূমাখ্যং’—(ভূমা মানে অসীম, বৃহৎ) ভূমা নামক সেই ‘নিত্যং ব্রহ্ম’—নিত্য যে-ব্রহ্ম, [সেটিই হলো ব্রহ্মের অক্ষুদ্ররূপ]; ‘তৎ ন সুবেদ্যম্‌ ইতি অভিপ্রায়ঃ’—তা সুবেদ্য নয় [তোমার সুবেদ্য নয়, কারোরই সুবেদ্য নয়] অর্থাৎ তাঁকে তুমি জানতে পারবে না। তুমি দেহাদি-পরিচ্ছিন্নরূপে তাঁকে বলেছ কিন্তু উপাধির নিষেধরূপে, উপাধিনিরস্তরূপে যে-ব্রহ্ম বা আত্মা [যেটি অক্ষুদ্র] সেটি সুবেদ্য নয়—তাঁকে জানা যায় না। এই হলো শ্রুতির অভিপ্রায়।

মীমাংসার বিষয়

শাঙ্করভাষ্য—যত এবমথ নু তস্মান্মন্যেঽদ্যাপি মীমাংস্যং বিচার্যমেব তে তব ব্রহ্ম। এবমাচার্যোক্তঃ শিষ্যঃ একান্তে উপবিষ্টঃ সমাহিতঃ সন্‌, যথোক্তমাচার্যেণাগমমর্থতো বিচার্য তর্কতশ্চ নির্ধার্য স্বানুভবং কৃত্বা আচার্যসকাশমুপগম্যোবাচ মন্যেহহমথেদানীং বিদিতং ব্রহ্মেতি। ২।১।।

ব্যাখ্যা—‘যত এবম্‌ অথ নু’—যেহেতু সেই ব্রহ্মস্বরূপ এরকম দুর্জ্ঞেয় ‘তস্মাৎ মন্যে অদ্যাপি মীমাংস্যং বিচার্যমেব তে তব ব্রহ্ম’—অতএব আমার মনে হয়, সেই ব্রহ্ম ‘অদ্যাপি মীমাংস্যং’—এখনো তোমার কাছে মীমাংসার বিষয়; তাকে তুমি এখনো বুঝতে পারনি। ‘বিচার্যমেব’—এখনো তোমাকে তাঁর সম্বন্ধে বিচার করতে হবে। ব্রহ্ম তোমার এখনো বিচারের বিষয়, যেহেতু তুমি স্বরূপেতে তাঁকে জান না। ‘এবমাচার্যোক্তঃ শিষ্যঃ একান্তে উপবিষ্টঃ সমাহিতঃ সন্’—এইপ্রকার আচার্য কর্তৃক অভিহিত হয়ে শিষ্য একান্তে উপবেশন করে, মনকে একাগ্র করে সমাহিতচিত্তে ভাবতে লাগল; ‘যথোক্তমাচার্যেণাগমম্‌’—আচার্য যে বলেছেন শাস্ত্রের কথা, সেই শাস্ত্রকে ‘অর্থতো বিচার্য’—অর্থের সঙ্গে বিচার করে [কী বলেছেন, তার মানে কী? এই হলো ‘অর্থতো বিচার্য’]; তারপরে বলছেন—শুধু অর্থ বিচার করলেই তো হবে না, ‘তর্কতশ্চ নির্ধার্য’—যুক্তির দ্বারা তার নির্ধারণ করে [গুরু যা বললেন তা যুক্তিযুক্ত কি না, তর্কের দ্বারা তা বিচার করছেন] ‘স্বানুভবং কৃত্বা’—নিজে অনুভব করে [সাক্ষাৎ অপরোক্ষভাবে জেনে] ‘আচার্যসকাশমুপগম্যোবাচ’—আচার্যের কাছে গিয়ে তারপর বলছে ‘মন্যেঽহমথেদানীং বিদিতং ব্রহ্মেতি’—আমি এখন মনে করছি যে, আমি ব্রহ্মকে জানি। সব বিচার করে তারপর বলছে যে, আমি জানি। আগে [গুরু] বলেছিলেন—যদি তুমি মনে কর ব্রহ্মকে জান, তা অল্পই জান; হয়তো তুমি ব্রহ্মের অধ্যাত্ম ও অধিদৈবত উপাধি-পরিচ্ছিন্ন যে ক্ষুদ্র রূপ তার সম্বন্ধে অবগত। এইজন্য তোমার আরো বিচার করার দরকার।

এখানে ব্রহ্মজ্ঞানের তত্ত্বটা বোঝানো হলো। ব্রহ্মজ্ঞান মানে আমি বুদ্ধি দিয়ে যদি ব্রহ্মকে জানি, তাহলে বুদ্ধির বিষয় যা হবে সে অব্রহ্ম হবে। বিষয়রূপে আমরা তাঁকে কখনো জানব না, তাঁকে নিত্য জ্ঞাতারূপে জানব। আমি যখন জানি বলছি, তাঁকে আমি জ্ঞানের বিষয় করছি। ব্রহ্ম কখনো জ্ঞানের বিষয় হতে পারেন না। তাহলে বলব কী করে? তা তো জ্ঞানের বিষয় নয়। সত্যিই তো বলা যায় না, সেকথা আগেই বলেছে—“অতো ন বিজানীমঃ যথা যেন প্রকারেণ এতদ্‌ব্রহ্মানুশিষ্যাৎ” (কেনোপনিষদ্‌, ১।৩ ভাষ্য)। তাহলে কী করে আমরা বিচার করব? বলছেন—তা জানি না। অর্থাৎ যেভাবে এই ব্রহ্মের উপদেশ দেওয়া দরকার বা দেওয়া যায় তা জানি না। জানি না এইজন্য যে, একথা বোঝানো খুব শক্ত। যখনি বোঝাতে যাব, সে অন্য জিনিসটা বুঝে নেবে, ব্রহ্মকে বুঝবে না। উদাহরণস্বরূপ যদি বলি—এই সব পরিব্যাপ্ত তিনি, তখন বলবে ব্রহ্ম তাহলে এইসব উপাধি-পরিব্যাপ্ত হয়ে গেল। ‘অশব্দমস্পর্শমরূপমব্যয়ম্‌’ বলা হলো; তাতে কী হলো?—উপাধির পরিচ্ছেদগুলি তাঁতে নেই, একথা বলা হলো। এটুকুমাত্র বলা হলো, কিন্তু ব্রহ্মকে কি এই করে বোঝানো হলো? ব্রহ্ম বস্তুটি কী তা তো কোথাও বলা হচ্ছে না, বলা যায়ও না। এখানে এটি হচ্ছে বেদান্তের গূঢ়তত্ত্ব। গূঢ় মানে যা সহজে বোধগম্য হয় না। এবস্তুকে বোঝানো যায় না, বোঝাতে গেলেই নিষেধমুখে বলতে হয়। নিষেধ মানে কিসের নিষেধ?—উপাধির নিষেধ। উপাধির নিষেধ করলে যাঁর উপাধি তাঁর কি স্বরূপ বলা হলো?

[পূর্বপক্ষী]—তাঁকে তো বিজ্ঞান বলা হয়েছে।

[সিদ্ধান্তী]—কিন্তু বিজ্ঞান তো তাঁর উপাধিধর্ম হিসাবে বলা হয়েছে। ইন্দ্রিয়াদির সঙ্গে, মনের সঙ্গে, বুদ্ধির সঙ্গে যে তাদাত্ম্য রয়েছে, একত্ব রয়েছে সেই দিক দিয়ে বলা হলো তিনি বিজ্ঞান। ‘বিজ্ঞান’ শব্দের মানেটা কী?—সর্বোপাধি-পরিচ্ছিন্ন যে-জ্ঞান। সেরকম জ্ঞান আমাদের জ্ঞানে আছে নাকি? যেখানে বোঝানোর নিষেধমুখে বোঝানো হচ্ছে। আর যেখানে জ্ঞানের স্বরূপ তাঁকে বলা হচ্ছে, সেটাও নিষেধমুখে বলারই একটা অন্য রূপ। অর্থাৎ বিভিন্ন বস্তুর সঙ্গে যে-জ্ঞান মিশ্রিত আছে, সেই মিশ্রণগুলিকে বাদ দিয়ে যে থাকে সেটি জ্ঞানস্বরূপ। সুতরাং জ্ঞানস্বরূপ বোঝালে কিছু বেশি বোঝানো হলো না, ঐ যে বিভিন্ন মিশ্রণ, উপাধি—সেই উপাধিগুলির নিরাস করা হলো। এই উপাধির নিরাসমুখে ছাড়া ইতিপদ দিয়ে কোনো বাক্য নেই। যেখানে ইতিপদে বলছেন [ব্রহ্ম] সচ্চিদানন্দ, সেখানেও বলছে যে, আসলে এটা নেতিপদ। ব্রহ্মের স্বরূপ লক্ষণ বলতে গিয়ে বলছে, এটাও স্বরূপলক্ষণ নয়। অলক্ষ্য ব্রহ্ম। এটা স্বরূপ নয়, কারণ ‘সত্য’ অর্থে ‘যা অনিত্য নয় তা সত্য’—এরূপ বোঝানো হয়ে থাকে। ‘জ্ঞান’ যেখানে বলা হয়, সেখানে ‘যা অজ্ঞান নয়’ তা বোঝাতে বলা হয়। ‘আনন্দ’ বলা হয় যেখানে সেটা ‘দুঃখ নয়’—এটা বোঝানোর জন্য ‘আনন্দ’ বলা হয়। ব্রহ্মকে তা নাহলে জ্ঞানের বিষয় করা হয়ে যেত। তিনি শব্দের বিষয় নয়, ‘অশব্দ’। শব্দ দিয়ে তাঁকে বোঝানো যায় না। বেদও বলবে না যে, আমি তোমাকে ব্রহ্ম বুঝিয়ে দেব। এইটি বোধ হলে বেদান্তের সব তত্ত্ব বোঝা হলো। ‘সত্যং জ্ঞানং আনন্দং ব্রহ্ম’ যেখানে বলা হয়েছে সেখানেও সত্য মানে বলা হয়েছে—যা মিথ্যা নয়; জ্ঞান মানে বলা হয়েছে—যা অজ্ঞান নয়; আনন্দ মানে বলা হয়েছে—যা দুঃখাকার নয়। এগুলি সব উপাধিধর্মের নিরাস করে বলা হয়েছে। উপাধিবর্জিতকে বলা যায় না। ‘উপাধিবর্জিত’ শব্দটি মাত্র বলা হলো, এতে কী বোঝা গেল? যাকে বলতে চাওয়া হচ্ছে তাকে বোঝা গেল, নাকি উপাধিগুলো সেখানে নেই—সেটা বোঝা গেল?

প্রশ্ন—কিন্তু তাঁকে তো বিজ্ঞান বলা হয়েছে।

উত্তর—সেই বিজ্ঞান জিনিসটাকে আমরা যখন বলি, তখন আমরা অমুক বিষয়ক বিজ্ঞান, তমুক বিষয়ক বিজ্ঞান এইরকম বলি। সেই বিষয়গুলো নিরাস করলে যা থাকবে তাই হলো ব্রহ্ম, সেটা আমরা শব্দ দিয়ে বোঝাতে পারি না।

প্রশ্ন—বিজ্ঞান কথার অর্থ বললেন যে, উপাধিবর্জিত যে-জ্ঞান সেটাই বিজ্ঞান।

উত্তর—আগে বলা হলো, শ্রুতিতে এইভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে—“বিজ্ঞানমানন্দং ব্রহ্ম”; “বিজ্ঞানঘন এব”; “সত্যং জ্ঞানমনন্তং ব্রহ্ম”; “প্রজ্ঞানং ব্রহ্ম” ইত্যাদি। [সিদ্ধান্তী] বলছেন—বলা হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সেটা ‘তদন্তঃকরণদেহেন্দ্রিয়োপাধিদ্বারেণৈব’—সেই অন্তঃকরণ-দেহ-ইন্দ্রিয়-উপাধি দ্বারাই ‘বিজ্ঞানাদিশব্দৈঃ নির্দিশ্যতে’—‘বিজ্ঞান’ প্রভৃতি শব্দের সাহায্যে [ব্রহ্মের] নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। ‘বিজ্ঞান’ যখন বলছি, তখন অন্তঃকরণাদি উপাধিবিশিষ্ট যে, তাকে আমরা বিজ্ঞান বলছি। আমাদের যে অনুভূত বিজ্ঞান, যে-বিজ্ঞানকে আমরা জানি—তাকে এইভাবেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ‘তদ-নুকারিত্বাদ্দেহাদিবৃদ্ধিসংকোচোচ্ছেদাদিষু নাশেষু’—কারণ সেই দেহেন্দ্রিয়াদির বৃদ্ধি, সংকোচন, ছেদন, নাশ প্রভৃতি এখানে [ব্রহ্মে] নেই বলে [এইরূপে] ব্রহ্মকে বলা হয়েছে। শব্দের দ্বারাই বলা হয়েছে, কিন্তু উপাধিনিষেধরূপে। তারপরে বললেন—“অবিজ্ঞাতং বিজানতাং বিজ্ঞাতম্‌ অবিজানতাম্‌”, অর্থাৎ তিনি ‘বিজানতাং অবিজ্ঞাতম্‌’ আর ‘অবিজানতাং বিজ্ঞাতম্‌’। ‘অবিজানতাং বিজ্ঞাতম্‌’ বলা হলো কারণ, সে ঠিক বুঝেছে। এখানে ‘জ্ঞাতম্‌’ মানে সে জ্ঞানের বিষয় করেছে—তা নয়।

শিষ্যের নিজানুভূতি বর্ণন
নাহং মন্যে সুবেদেতি নো ন বেদেতি বেদ চ।
যো নস্তদ্বেদ তদ্বেদ নো ন বেদেতি বেদ চ ।। ২।২ ।।

অন্বয়—[শিষ্য নিজের ব্রহ্মজ্ঞানের পরিচয় দিয়ে বলছেন] সুবেদ ইতি ([ব্রহ্মকে] উত্তমরূপে জানি বলে) অহম্‌ (আমি) ন মন্যে (মনে করি না); [তবে] ন বেদ (জানি না) ইতি নো (এরকমও নয়)। বেদ (জানি) চ (আবার [জানিও না])। নঃ (আমাদের মধ্যে) যঃ (যে) নো ন বেদ ইতি বেদ চ (জানি না যে তা নয় আবার জানি যে সেটাও নয়) তৎ (ঐ বাক্যার্থ) বেদ (জানে), [সেই] তৎ (ব্রহ্মকে) বেদ (জানে)।

মূলানুবাদ—(শিষ্য) আমি এরূপ মনে করি না যে, আমি ব্রহ্মকে উত্তমরূপে জেনেছি; অর্থাৎ ‘জানি না’—এটা মনে করি না এবং ‘জানি’—এটাও মনে করি না। ‘জানি না যে তাও নয় এবং জানি যে তাও নয়’—আমাদের মধ্যে যিনি এই বচনটির মর্ম জানেন, তিনিই ব্রহ্মকে জানেন।

ব্যাখ্যা—শিষ্য উত্তর দিচ্ছেন—‘নাহং মন্যে সুবেদ ইতি’—আমি মনে করি না যে, আমি ব্রহ্মকে ভাল করে জানি। ‘নো ন বেদ ইতি’—আবার জানি না যে তাও নয়। আমি ব্রহ্মকে ভাল করে জানি তাও নয়, আবার জানি না যে তাও নয়। তারপরে বলছেন—‘বেদ চ’—এবং জানিও বটে। পরে ভাষ্যে বলেছেন, এই ‘বেদ চ’ যেখানে আছে সেখানে ‘বেদ চ ন বেদ চ’, অর্থাৎ জানিও বটে আবার জানি নাও বটে—এরূপ অর্থ ধরতে হবে। ‘যঃ নস্তদ্বেদ’—আমাদের মধ্যে যে ব্রহ্মকে এইরূপে জানে, অর্থাৎ ‘জানি না যে তা নয় আবার জানি যে তাও নয়’—এই বাক্যের মর্ম যথার্থরূপে জানে; ‘তদ্বেদ’—সেই ব্রহ্মকে যথার্থ জানে।

শিষ্য কর্তৃক নিজ ব্রহ্মজ্ঞানের দৃঢ়তা প্রতিপাদন

শাঙ্করভাষ্য—কথমিতি, শৃণুত। নাহং মন্যে সুবেদেতি, নৈবাহং মন্যে সুবেদ ব্রহ্মেতি। নৈব তর্হি বিদিতং ত্বয়া ব্রহ্ম? ইত্যুক্তে আহ—নো ন বেদেতি বেদ চ। বেদ চেতি চশব্দাৎ ন বেদ চ।

ব্যাখ্যা—[শিষ্য বলছেন, আমার মনে হয় এখন আমার ব্রহ্ম জানা হয়েছে] ‘কথমিতি’—সে আবার কীরকম? ‘শৃণুত’—শুনুন। ‘নাহং মন্যে সুবেদ ইতি, নৈবাহং মন্যে সুবেদ ব্রহ্মেতি’—আমি ভাল করে জানি এরকম মনে করি না, অর্থাৎ আমি ব্রহ্মকে উত্তমরূপে জেনেছি এরকম মনে করি না। [তখন গুরু বলছেন] ‘নৈব তর্হি বিদিতং ত্বয়া ব্রহ্ম?’—তাহলে তুমি কি ব্রহ্মকে জান না? ‘ইত্যুক্তে আহ’—[গুরু] এরকম বললে [শিষ্য] তার উত্তরে বলছেন—‘নো ন বেদেতি বেদ চ’—‘আমি জানি না—একথাও ঠিক নয় আবার জানিও বটে।’ ‘বেদ চ ইতি চ শব্দাৎ ন বেদ চ’—[মন্ত্রের] ‘বেদ চ’ অর্থাৎ ‘জানিও’ এই অংশের ‘চ’ শব্দ দ্বারা [‘জানিও বটে’—এই অনুবাদের ‘ও’-কার দ্বারা] ‘ন বেদ চ’ অর্থাৎ ‘জানি নাও বটে’—এইরূপ অর্থও বুঝতে হবে। [মন্ত্রে শুধুমাত্র] ‘বেদ চ’ আছে, সেইজন্য ‘চ’ শব্দে ‘ন বেদ চ’—এরূপ অর্থ বুঝতে হবে।

গুরু কর্তৃক শিষ্যের ব্রহ্মজ্ঞানের প্রতি সংশয়

শাঙ্করভাষ্য—ননু বিপ্রতিষিদ্ধম্‌—নাহং মন্যে সুবেদেতি, নো ন বেদেতি বেদ চেতি। যদি ন মন্যসে—সুবেদেতি, কথং মন্যসে বেদ চেতি? অথ মন্যসে—বেদৈবেতি, কথং ন মন্যসে—সুবেদেতি? একং বস্তু যেন জ্ঞায়তে, তেনৈব তদেব বস্তু ন সুবিজ্ঞায়ত ইতি বিপ্রতিষিদ্ধং সংশয়-বিপর্যয়ৌ বর্জয়িত্বা। ন চ ব্রহ্ম সংশয়িতত্বেন জ্ঞেয়ম্‌, বিপরীতত্বেন বেতি নিয়ন্তুং শক্যম্‌। সংশয়-বিপর্যয়ৌ হি সর্বত্রানর্থকরত্বেনৈব প্রসিদ্ধৌ।

ব্যাখ্যা—‘ননু বিপ্রতিষিদ্ধম্‌—নাহং মন্যে সুবেদেতি, নো ন বেদেতি বেদ চেতি’—গুরু শঙ্কা করছেন, এ তো বিরুদ্ধ কথা হলো। ‘ননু’ মানে বিতর্কে; ‘বিপ্রতিষিদ্ধম্‌’ মানে বিরুদ্ধ। গুরু শিষ্যকে বলছেন যে, তুমি বলছ— ‘নাহং মন্যে সুবেদেতি’—‘আমি [ব্রহ্মকে] ভাল করে জানি বলেও মনে করি না’, ‘ন বেদ’—‘জানি না বলেও মনে করি না’, ‘বেদ চ’ অর্থাৎ ‘আবার জানিও’—এরূপ কথা তো পরস্পরবিরুদ্ধ। ‘যদি ন মন্যসে—সুবেদেতি, কথং মন্যসে বেদ চ ইতি’—যদি মনে কর আমি ব্রহ্মকে ভাল করে জানি না, তাহলে আবার জানি বলছ কেন? ‘অথ মন্যসে’—অথবা তুমি যদি মনে কর ‘বেদ এব ইতি’—‘আমি জানি’ অর্থাৎ ব্রহ্মকে তুমি যদি জান বলেই মনে কর ‘কথং ন মন্যসে—সুবেদেতি?’—তাহলে তুমি ‘ভাল করে জানি’—এরকম মনে কর না কেন? ‘একং বস্তু যেন জ্ঞায়তে, তেনৈব তদেব বস্তু ন সুবিজ্ঞায়ত ইতি বিপ্রতিষিদ্ধং সংশয়-বিপর্যয়ৌ বর্জয়িত্বা’—কারণ, যে-বস্তুকে যে-ব্যক্তি জানে, সেই ব্যক্তির কাছেই আবার সেই বস্তু সুবিজ্ঞাত নয় বলা হলে তা পরস্পরবিরুদ্ধ হয়ে পড়ে। কেবল বিরুদ্ধ নয় কোনখানে? উত্তরে বলছেন— ‘সংশয়-বিপর্যয়ৌ বর্জয়িত্বা’—সংশয় এবং বিপর্যয় ছাড়া। যেখানে সংশয় হয় যে, এই বস্তুটা এটাই কি না? সেখানে বলতে হয়—আমি জানিও বটে আবার জানি নাও বটে; দুটি কল্পে জ্ঞান হচ্ছে, বিরুদ্ধকল্পে জ্ঞান হচ্ছে। সংশয়জ্ঞান [একই ধর্মীতে বিরুদ্ধ নানা ধর্মের জ্ঞান] অথবা বিপর্যয়জ্ঞান—যে-বস্তু যা নয়, তাতে সেইরূপ বুদ্ধির নাম হলো বিপর্যয়। যেটা যা নয়, তাকে সেটি বলে গ্রহণ করা হলো বিপর্যয়জ্ঞান, বিপরীতজ্ঞান। উদাহরণরূপে বলা যায়—দড়িটা সাপ নয়, তাকে যদি সাপ বলে জানি তাহলে সেটি বিপরীতজ্ঞান হয়। তাহলে সাপ বলে জানি যখন, তখন জানি আবার জানি না। জানি মানে তার বিকল্পরূপেতে জানি, উপাধিবিশিষ্টরূপেতে জানি, সাপরূপে তাকে জানি। আবার জানি না মানে তার স্বরূপেতে জানি না, দড়িরূপে জানি না। সুতরাং বিপর্যয়জ্ঞানের ক্ষেত্রে দুই-ই বলা যায়—জানি আবার জানি না। [ক্রমশ]