স্বামীজীর সঙ্গে দেখা হওয়ার স্মরণীয় দিনটির প্রতিটি মুহূর্ত আমার এখনো মনে আছে। গত আটচল্লিশ বছর ধরে এটি আমার জীবনের ভিত্তি। আমরা তখন ডবস্ফেরিতে মিসেস ডেভিডসনের সঙ্গে থাকতাম। একদিন নিউ ইয়র্কে ডোরা রোয়েথেলেসবার্জারের সঙ্গে মধ্যাহ্নভোজে যোগ দিতে এসে তাঁর লেখা একটি চিরকুট পেলাম, তাতে লেখা — 54 West 33rd Street-এ এসে স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা শুনে তারপর আমরা মধ্যাহ্নভোজ করব। সেইমতো মা১ এবং আমি ঐ বাড়িতে গিয়ে অভ্যাগতদের বসার কক্ষে উপস্থিত হলাম। সেখানে কুড়িজন মহিলা এবং দু-তিনজন পুরুষ উপস্থিত ছিলেন। স্বামীজী মেঝেতে বসেছিলেন। তাঁর প্রথম বাক্যটি আমাকে জানিয়ে দিল—আমি এক পরম সত্য সম্পর্কে শুনছি, সেই সত্য যা একজনকে মুক্ত করে দিতে সক্ষম। সেদিন (২৯ জানুয়ারি ১৮৯৫) যেন দেহবোধ, স্থান, কাল সবকিছুর ঊর্ধ্বে চলে গিয়েছিলাম! মনে হয় আমার জীবন যেন সেই ঘটনাটির পর থেকেই শুরু হয়েছে। যে-উদ্দেশ্যে আমি জন্মেছিলাম সেটা পূর্ণ হয়েছে—এক নতুন বুদ্ধকে চিনেছি।

মা এবং আমি সপ্তাহে তিনদিন নিউ ইয়র্কে আসতাম। আমরা স্বামীজীর কথা তখন কাউকে বলিনি। কারণ আমাদের কাছে তিনি ছিলেন এক পুণ্যাত্মা৷ কয়েক সপ্তাহ পরে পিটার২ আমাদের ওয়ালডর্ফ অ্যাস্টোরিয়াতে (স্বামীজী যেখানে ক্লাস নিতেন, তার ঠিক উলটোদিকে অবস্থিত) নৈশভোজে নিমন্ত্রণ করেন। আমরা তাঁর নিমন্ত্রণ গ্রহণ করলেও তাঁকে জানিয়ে দিই যে, সন্ধ্যাটা আমরা তাঁর সঙ্গে কাটাতে পারব না। সেইমতো রাত ৮টার সময় আমরা বক্তৃতা শুনতে যাব বলায় মিস্টার লেগেট আমাদের জিজ্ঞাসা করেন: “তোমরা কোথায় যাচ্ছ?” আমরা বক্তৃতা শুনতে যাচ্ছি বলায় তিনি জিজ্ঞেস করলেন, তিনিও আমাদের সঙ্গে যেতে পারেন কি না; আমরা তাঁকে আসতে বললাম। সেদিন স্বামীজীর বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পিটার তাঁর কাছে গিয়ে তাঁকে আমাদের সঙ্গে নৈশভোজে যোগ দেওয়ার জন্য আমন্ত্রণ জানান। সেই নৈশভোজেই আমরা স্বামীজীর সঙ্গে প্রথম ঘরোয়াভাবে মিলিত হই। এর কয়েক সপ্তাহ পরে আমরা সবাই এবং স্বামীজী রিজলি ম্যানরে ছয়দিনের জন্য যাই।

স্বামীজীর প্রতি আমাদের পরিবারের যে-মনোভাব (তাঁকে সম্পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া), তাঁকে আমাদের আরো নিকটবর্তী করে তুলেছিল। স্বামীজী সেখানে কয়েকদিন হয়তো কথাই বলতেন না, আবার কখনো দিনরাত কথা বলেই চলেছেন! আমরা তাঁর এই মানসিক ভাব লক্ষ্য করতাম এবং নিজেদের দৈনন্দিন কাজকর্মে ব্যস্ত থাকতাম। দেখতাম যাতে তিনি খুশি থাকেন এবং তাঁর ওপর কোনো চাপ সৃষ্টি না হয়।

আমরা সকলেই স্বামীজীকে বুঝতাম এবং ভালবাসতাম। হয়তো এই একটি ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে আমরা এতটা আনন্দের সঙ্গে একমত হতাম না। আমাদের ভাব অনুযায়ী আমরা একেক জন একেক ভাবে চলতাম, মা একরকম ভাবে, তুমি আরেকরকম ভাবে আমি আমার তৃতীয় আর একরকম ভাবে। আমরা কেউই সেই আধ্যাত্মিক শক্তিকে সম্পূর্ণরূপে ধারণা করে উঠতে পারিনি, তার সীমা যে কতদূর তাও বুঝতে পারিনি।

আমি বিশ্বাস করি, স্বামীজীর মতো এত বিশাল আধ্যাত্মিক শক্তিসম্পন্ন আর কেউ কোনোদিন আসেননি। আমরা যেন এক নতুন বুদ্ধকে জানতে পারলাম। আমি গভীরভাবে সেন্ট জনের উপদেশাবলি পাঠ করেছি—বড়ই রোমাঞ্চকর! একইরকম হলো স্বামীজীর প্রভাব— উপস্থিতির দ্বারা অন্যের জীবনকে পরিবর্তিত করে দেওয়া, জলকে মদে পরিণত করা বা রোগ ভাল করে দেওয়ার মতো নিছক অলৌকিক ক্ষমতা নয়। নতুন যুগপুরুষরা নতুন উপহার নিয়ে আসেন, তাই না? স্বামীজীর যে-বিষয়টি আমায় আকৃষ্ট করল, সেটি হলো তাঁর অসীমতা। আমি কখনো এর তলাতল খুঁজে পাইনি। এক আশ্চর্যজনক ব্যাপ্তি! আমি মনে করি, নিবেদিতাও একই ধারণা পোষণ করে। স্বামীজী যেমন এসেছিলেন আমাকে মুক্ত করার জন্য, তেমনি আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল—নিবেদিতাকে ত্যাগব্রতে উদ্বুদ্ধ করা এবং প্রিয় মিসেস সেভিয়ারকে একত্বের বোধে উপনীত করা। স্বামীজী ছিলেন একজন প্রকৃত বন্ধু— এমন বন্ধু যিনি ঈশ্বরদ্রষ্টা, সেইভাবেই তিনি এখনো আমার কাছে আছেন। স্বামীজীর সঙ্গে সাক্ষাত্মাত্রই আমার জীবন পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছে।

(বাঁদিক থেকে) জোসেফিন ম্যাকলাউড, সারা বুল, স্বামী বিবেকানন্দ ও সিস্টার নিবেদিতা, কাশ্মীর ১৮৯৮

আমাদের জীবনে বিবেকানন্দ-পর্বটি হলো অনন্ত গুণসম্পন্ন এক অধ্যায়। এটিই আমাদের লালন করে যেতে হবে। এক বিশ্বশক্তিকে আমি জেনেছি এবং তাঁর সঙ্গে জীবনের সাতটি বছর কাটিয়েছি। প্রতিটি মুহূর্তে আমি এর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছি। স্বামীজীর সঙ্গে পরিচিত হওয়া এবং তাঁর ভাবের সামান্যতম অংশকে আত্মগত করা খুব একটা সামান্য উত্তরাধিকারলাভ নয়।

স্বামীজী যেভাবেই হোন না কেন আমাদের প্রত্যেকের পিছনেই আছেন। আমাদের জীবন আর অনিশ্চিত ভবিষ্যতের হাতে নেই। আমরা তাঁর দ্বারা পরিচালিত এবং সুরক্ষিত। এক হিসাবে আমরা এটি বিশ্বাস করি কিন্তু আমরা যদি এটি প্রাণে উপলব্ধি করতে পারতাম তাহলে এক মুহূর্তের জন্যও আমরা আর উদ্বিগ্ন হব না। আমি অনুভব করি যে, স্বামীজী আমাদের জীবনের ভিত্তিরূপে দাঁড়িয়ে আছেন—আমার জীবনে এটিই তাঁর নির্দিষ্ট ভূমিকা। পূজা নয়, মহিমান্বিত করা নয়—শুধু একজনের পদতলে অটলভাবে বসে তা পরখ করে যাওয়া।

আমাদের যে বিশাল ভূমিকা পালন করতে হবে তা এখনো শুরু হয়নি। কীভাবে, কোথায় তা হবে আমি জানি না, জানতেও চাই না। আমরা অকারণে স্বামীজীর সঙ্গলাভ করিনি বা তাঁকে ভালবাসিনি। এর ফল মহানভাবে কার্যকরী হবেই; যদি তা নাও হয়, তবুও তাঁর সঙ্গে পরিচিত হওয়াই এই জগতে এবং পর জগতেও আমার কাছে এক মূল্যবান সম্পদ।

মিস্টার (হোমার) লেন বলেছেন, স্বামীজী তাঁর সমস্ত কিছুকেই পবিত্র করে দিয়েছেন—তাঁর জীবন, কর্মপ্রচেষ্টা, খেলা, প্রার্থনা সব কিছুই সমানভাবে পবিত্র হয়ে গেছে; জীবনযাপনের জন্য করণীয় এমন প্রতিটি কাজ পবিত্র। মিসেস হ্যান্সবরো সেই তিন বোনের একজন, যাঁরা গত চোদ্দ বছর ধরে একনিষ্ঠভাবে স্বামীজীর অনুরাগী। তিনি বলছিলেন—একবার এখানে (লস এঞ্জেলেস) স্বামীজীর একটি চমৎকার বক্তৃতার পর একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলেন: “তাহলে স্বামীজী আপনি দাবি করছেন যে, সব কিছুই সৎ?” স্বামীজীর উত্তর ছিল—“একেবারেই না, আমি বলেছি কেবলমাত্র ঈশ্বরই সৎ। এইটিই সমস্ত পার্থক্য গড়ে দিয়েছে।” মিসেস হ্যান্সবরো আরো বলেন যে, এই বাক্যটির ওপর ভিত্তি করেই তিনি এত বছর ধরে জীবনযাপন করে এসেছেন। স্বামীজী রোমে সেন্ট পিটার্স গির্জার ধর্মীয় অনুষ্ঠানের জাঁকজমক দেখে বলেছিলেন: “যদি তুমি কোনো ব্যক্তি-ঈশ্বরে বিশ্বাস কর, তাহলে তাঁকে তোমার সর্বশ্রেষ্ঠ বস্তুটিই দেওয়া উচিত।”

স্বামীজী তাঁর জাতিকে ফিরিয়ে দিয়েছেন হিন্দুধর্মের মহান শক্তিদায়ী ধারা, যেটি শ্রীরামকৃষ্ণ তাঁর জীবনে পালন করেছেন। এটি হচ্ছে সেই নতুন আদর্শ, যা সারা ভারত পরিব্যাপ্ত করে ক্রমশ সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ছে। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় যেমন বলা হয়েছে—‘শাশ্বত, সর্বব্যাপী, শক্তিশালী’। স্বামীজী অকারণে আমাকে কৃপা করেননি বা তিনি আমাকে ঘরে বসে কাঁদতেও বলেননি, বরং আমি মরে যাব তবু এর মোকাবিলা করব। এক পারসি যুবক আমাকে স্বামীজী সম্পর্কে এক সুন্দর ঘটনার কথা বলেছে, যা সে মাসখানেক আগে দুই মার্কিন যুবকের কাছ থেকে শুনেছে। এই পারসি যুবককে শিবানন্দজী কয়েক বছর আগে মন্ত্র দিয়েছেন। সে বলেছে, ঐ দুজন মার্কিন যুবককে মিশনারিরা ভারতে স্বামীজীর প্রভাবকে খর্ব করার জন্য পাঠিয়েছিল। তারা যখন স্বামীজীর কাছে আসে, তখন তিনি গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলেন। ধ্যান থেকে উত্থিত হয়ে তিনি যখন তাদের সামনে এলেন, তখন তাঁর জ্যোতিঃপূর্ণ মুখমণ্ডল দেখে তারা এত অভিভূত হয়ে পড়ল যে, স্বামীজীর সামনে বসে পড়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করল: “আমরা কোথায় সেই সত্যকে খুঁজে পাব? স্বামীজীর উত্তর ছিল—“সেটি তোমাদের অন্তরেই রয়েছে।” তারা তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করল। বর্তমানে তারা বৃদ্ধ। কখনো তারা ভারত ছেড়ে যায়নি।

আমি মেরি হেল ম্যাটিইনিকে৪ লিখেছি যে, তিনি কারো মারফত ইংল্যান্ড থেকে স্বামীজীর একটি স্ফটিকমূর্তি আনাতে পারেন কি না? আমি সেটি তাঁকে হেল পরিবারের জন্য আনন্দের সঙ্গে উপহার দিতে চাই। সেই দুঃসময়ে তাঁরা যদি স্বামীজীকে আশ্রয় না দিতেন এবং আনুকূল্য না দেখাতেন তাহলে আমরা তাঁকে আমাদের মধ্যে পেতাম না। কীভাবে প্রত্যেকেই স্বামীজীর পরিকল্পনায় বিভিন্ন ভূমিকা পালন করেছেন, সেটি দেখা খুবই আকর্ষণীয় নয় কি? হেল পরিবার একবছর ধরে তাঁকে দেখেছেন এবং আমি মনে করি, স্বামীজীর মধ্যে আমেরিকান মহিলাদের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও প্রশংসার মনোভাব তৈরি হয়েছিল, যেটি তাঁর জীবনে অতি গুরুত্বপূর্ণ, সেটি হয়েছে এর পরে। আমরা এসেছি তারও পরে এবং শেষ সাত বছর তাঁর সঙ্গ পেয়েছি।

বেলুড় মঠে বিবেকানন্দ মন্দিরের সামনে
জিন হার্বার্ট ও জোসেফিন ম্যাকলাউড, ১৯৩৯

যাকিছু বিদ্যমান তার একটা কারণ আছে, সেই কারণটিকে খোঁজ—এটিই স্বামীজীর দেওয়া শিক্ষার মূলভিত্তি বলে আমি মনে করি। স্বামীজী যেরূপ মৌলিক ভাবে মনে করতেন যে, ‘স্বাধীনতার প্রতি স্বাভাবিক বিশ্বাসই হচ্ছে সমস্ত যুক্তির ভিত্তি’—আমিও তাই মনে করি। স্বামীজী বলেছেন: “আধ্যাত্মিক স্তরে অবাধ মুক্ত হও, কিন্তু মানসিক এবং শারীরিক স্তরে কখনো বন্ধনহীন হয়ো না। এটিই হচ্ছে সংগ্রাম।” “আমাকে বল তোমরা কীভাবে কষ্টভোগ করেছ—আমি তোমাদের বলে দেব তোমরা কত মহান। তোমাদের ত্রুটির সঙ্গে যুদ্ধ করো না, নিজেদের মধ্যে অন্য ভাবগুলিকে গড়ে তোল; তাহলে ঐগুলি স্বাভাবিকভাবেই অপুষ্টিতে মারা যাবে।” বলেছেন: “হৃদয় হচ্ছে জীবন-নদী আর মস্তিষ্ক হচ্ছে সেই নদীর ওপরে সেতু। সবসময় হৃদয়ের কথা শুনে চলবে।” “আগে ঈশ্বরলাভ কর তারপর যা খুশি কর, ঈশ্বর ছাড়া কোনোকিছুই গুরুত্বপূর্ণ নয়।” “যেখানেই মলিনতা, নীচতা বা অজ্ঞতা দেখি—সেখানেই আমি সহায়তা করে থাকি৷” “যার মানুষের ওপর বিশ্বাস নেই সে খুব বেশি একটা এগতে পারবে বলে আমি মনে করি না।” স্বামীজীর মধ্যে এটি যথেষ্ট ছিল। তিনি জানতেন, আমরা সকলেই ঈশ্বরের সন্তান। সেজন্য তিনি উচ্চকণ্ঠে বলেছেন: “সকলকে ব্রাহ্মণত্বে উন্নীত কর—সহস্র সহস্র জনকে, সমস্ত জাতিকে; তাহলেই সব মানুষ জেগে উঠবে।” দেহত্যাগের একদিন পূর্বে স্বামীজী বলেছিলেন: “এই বেলুড় মঠ কী মহান স্থান!”

স্বামীজী ছিলেন ভবিষ্যদ্‌দ্রষ্টা পুরুষ। তিনি এই বিশ্বের দূরাগত সমস্যা ও পরিবর্তনসমূহ দেখতে পেতেন। তিনি যে সত্য ছিলেন—এটা আমার কাছে এক পরম পরিতৃপ্তির বিষয়। এটি শুধুমাত্র আমাদের বর্তমানের দায়িত্বগুলি সম্বন্ধে শিক্ষা দেয় না, সমাধানের পথও দেখায়।

স্বামীজী যেসব সম্পদ আমাকে দিয়েছিলেন, আমি সমস্ত হৃদয় উজাড় করে সেগুলি ধনগোপাল মুখার্জিকে দিয়েছি। আমার কাজ শেষ, আমি এখন বেশ হালকা বোধ করছি। বার্নার্ড শ-র ৮৮তম জন্মদিনে নিউ ইয়র্ক টাইম্স-এ কাঠ খোদাই করা তাঁর একটি ছবি প্রকাশিত হয়। এটি দেখে আমি তাঁকে লিখি যে, আমরা দুজনেই এখন আশির কোঠায়। তিনি এখনো কত পরিশ্রম করেন, কিন্তু আমি মোটেই করি না। সঙ্গে সঙ্গে আমি তাঁর সুন্দর হস্তাক্ষরে একটি পোস্টকার্ড পাই। তিনি লিখেছেন: “প্রিয় জোসেফিন, তোমার কাছ থেকে চিঠি পেয়ে খুব আনন্দ হচ্ছে। গত ১২ সেপ্টেম্বর থেকে আমি বিপত্নীক। তার সামান্য আগেই আমরা তোমার সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম এবং তোমার পরিবর্তন দেখে অবাক লাগছিল। তুমি সবসময়ই এক বিশেষ বন্ধু ছিলে এবং আছ সবসময়ই। আবার ‘হলক্রফট’৫-এ আমাদের অবশ্যই দেখা হবে—এই আশা রাখি। এখন অন্তরালে থাকতেই বেশি ভাল লাগে। আমি খুবই বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছি।”

লালিকের তৈরি বিবেকানন্দের ছোট্ট মূর্তিটি আমার লেখার টেবিলে রাখা আছে। প্রতিদিন বিকালে অস্তগামী সূর্যের রশ্মি পড়লে সেটি আলোকিত হয়ে ওঠে। মনে হয় যেন এটির ভিতরে এক পবিত্র শিখা প্রজ্বলিত হয়ে উঠেছে! লালিকের তৈরি স্বামীজীর স্ফটিকের মূর্তির জন্য ইসাবেল (মার্গেসন)-কে ধন্যবাদ জানিয়ে লেডি ওয়াভেল চিঠি লিখেছেন এবং আমাকেও স্বামীজীর চারটি পুস্তিকার জন্য ধন্যবাদসূচক পত্র পাঠিয়েছেন। ৮৫ বছর বয়সে এইসব সত্য সবার মধ্যে ছড়িয়ে দিতে বেশ লাগে। ফেব্রুয়ারি ১৯৩৯-এর প্রবুদ্ধ ভারত-এ ইসাবেল মার্গেসন স্বামীজী সম্পর্কে স্মৃতিচারণা করেছে। তাকে আমি বিবেকচূড়ামণি গ্রন্থ চারটে পাঠিয়েছি। স্বামীজী নিজেকে শঙ্কর বলতেন! ৮০০ বছর পর তিনি আবার ফিরে এসেছিলেন।

গতকাল সন্ধ্যা সাড়ে ছটায় আমি মশারির ভিতর ঢুকে পড়ার পর দুটি ভাই আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে। এদের মধ্যে ছোটটির বয়স ২৮ বছর (গত নয় মাস যাবৎ ঢাকা রামকৃষ্ণ মঠের সদস্য)। অষ্টাদশ শতকের অর্ডিন্যান্স বলে আটক থাকা নতুন ৭২ জন কারাবন্দির মধ্যে সে একজন। ২৪ অক্টোবর থেকে সে ঢাকা জেলে রয়েছে। আজ তাকে ২৪ পরগনার পুলিশ সুপারের সামনে হাজিরা দিতে হবে। পরবর্তী আদেশ না পাওয়া পর্যন্ত তাকে বাংলাদেশের হাড়োয়া গ্রামে অন্তরিন থাকতে হবে। এর প্রকৃত তাৎপর্যটি কী সেটি তাকে বলার এক সুযোগ আমার কাছে এল—স্বামীজী এবং ভারতের জন্য সে কী করতে পারে। স্বামীজীর ইচ্ছা ছিল—ভারতের প্রতিটি গ্রামে (সাত লক্ষেরও বেশি) একটি করে কেন্দ্র হবে, সেখানে একজন করে শিক্ষিত লোক থাকবে গ্রামটিকে পুনর্গঠনের জন্য। আমি ছেলেটিকে স্বামীজীর পাঁচ খণ্ড বই দিলাম এবং বললাম—গভর্নর ও কাউন্সিলের মাধ্যমে ‘মা’ তাকে বেছে নিয়েছেন তাঁর কাজ করানোর জন্য। কী বলব, এই কথা শুনে তার মুখের হতাশ ভাব কেটে গিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠল! কাজ শুরু করার জন্য তার কী আগ্রহ! বলল: “আমরা অজ্ঞ, তাই আমরা জানি না মহামায়ী এভাবে তাঁর কাজ করেন।” সরল ছেলে। আমি তাকে বললাম ধর্ম সম্বন্ধে স্বামীজীর ভাবটি। জ্ঞান আহরণ কর এবং এই উদ্দীপনা নিয়ে হাড়োয়ার ঐ নতুন গ্রামে যাও, গ্রামের প্রয়োজনগুলি বোঝ, গ্রামবাসীদের স্বাস্থ্য, ইংরেজি ভাষা এবং স্বামীজীর ভাবগুলি শিক্ষা দাও। তাদের সঙ্গে থাক এবং ভারতবর্ষকে ঊর্ধ্বে তুলে ধর।

মনে হয় আমিই শেষ জীবিত ব্যক্তি, যে ব্যক্তিগতভাবে স্বামীজীকে ভাল করে জানে। এবছর জুলাইতে স্বামীজীর শিকাগোতে প্রথম আগমনের পঞ্চাশ বছর। প্রতিটি বেদান্তকেন্দ্রে দিনটি পালিত হবে। স্বামী নিখিলানন্দ এই উপলক্ষে তাঁর কেন্দ্রে (১৭ই ৯৪ নং স্ট্রিট) আমাকে কিছু বলার জন্য অনুরোধ করেছেন। বেলুড় মঠের অধ্যক্ষ স্বামী বিরজানন্দ তাঁর গত চিঠিতে লিখেছেন: “ট্যান্টিন (জোসেফিন) এই ৪৮ বছর ধরে স্বামীজীর স্মৃতিকে যেভাবে পুঙ্খানুপুঙ্খ মনে রেখেছেন, তাতেই স্বামীজীর আধ্যাত্মিকতার শক্তিটি বোঝা যায়।”

তথ্যসূত্র
১ বেটি লেগেট। অ্যালবার্টা স্টার্জেস ছিলেন তাঁর প্রথম বিবাহ সূত্রের কন্যা। এই সময়কালে তিনি ছিলেন উইলিয়াম স্টার্জেসের বিধবা পত্নী।
২ ফ্রান্সিস লেগেট, বেটির দ্বিতীয় স্বামী
৩ এলিস মিড হ্যান্সবরো ক্যালিফোর্নিয়ার দক্ষিণ প্যাসাডোনার মিড ভগিনীদের অন্যতম, যিনি পশ্চিম উপকূলে স্বামীজীর সফরের সময় তাঁর বক্তৃতার আয়োজন ও বাড়ির কাজকর্ম করে সাহায্য করেছিলেন।
৪ মেরি হেল শিকাগোর মিস্টার ও মিসেস জি. ডব্লু. হেলের কন্যা। স্বামীজী তাঁর প্রথম আমেরিকা সফরের সময় এঁদের বাড়িতে দীর্ঘদিন ছিলেন। স্বামীজী তাঁকে ‘বোন’ বলতেন এবং তাঁকে বহু চিঠি লিখেছেন। পরবর্তিকালে তিনি ইটালিয়ান ধনী মিস্টার ম্যাটিইনিকে বিবাহ করেন।
৫ স্ট্রাটফোর্ড অন এভনের একটি বিখ্যাত বাড়ি।

‘স্বামী ত্রিগুণাতীতানন্দ স্মারক রচনা’রূপে প্রকাশিত হলো।

মিস জোসেফিন ম্যাকলাউড স্বামী বিবেকানন্দের দেহাবসানের পর আরো অর্ধশতাব্দী জীবিত ছিলেন। ভাইঝি অ্যালবার্টা স্টার্জেসকে তিনি ১৯১১ থেকে ১৯৪৬ সালের মধ্যে বেশ কিছু পত্র লেখেন, যেগুলি খুবই আকর্ষণীয় এবং তথ্যসমৃদ্ধ। অ্যালবার্টা এই মূল্যবান সম্পদ তাঁর কন্যা ইংল্যান্ডবাসী লেডি ফেথ কালমি-সেমুরের কাছে রেখে যান। তিনি এই পত্রগুলি ইংল্যান্ডের রামকৃষ্ণ বেদান্ত কেন্দ্রকে দেন। ঐ কেন্দ্রের তৎকালীন মিনিস্টার-ইন-চার্জ স্বামী ভব্যানন্দ ও তাঁর সহকারী স্বামী যোগেশানন্দ কঠিন পরিশ্রম করে চিঠিগুলির প্রাসঙ্গিক অংশ লিপিবন্ধ করেন। সেখান থেকে নির্বাচিত কিছু অংশ এখানে নিবেদিত হলো।